Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অকস্মাৎ দিনকয়েকের অবিশ্রান্ত বারিপাতে সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম এমন অচল হইয়া গেল যে, অপ্রতিহত-গতি জেলার ম্যাজিস্ট্রেটও তাঁহার তদন্তের চাকাটাকে ঠেলিয়া আনিতে পারিলেন না। তবে তাঁহার হুকুম ছিল, বর্ষণ কমিলেই তিনি চণ্ডীগড়ে পদার্পণ করিবেন, এবং সেই হুকুম তামিলের দিন পড়িয়াছে আজ। খবর পৌঁছিয়াছে, গ্রামের বাহিরে বারুইয়ের তীরে তাঁহার তাঁবু খাটানো হইতেছে, মুরগী, আণ্ডা, দুধ, ঘি প্রভৃতি যোগান দেওয়ার কাজে এককড়ি প্রাণপাত পরিশ্রম করিতেছে এবং খুব সম্ভব দ্বিপ্রহরের দিকেই চণ্ডীগড়ে তাঁহার ঘোড়ার পদধূলি পড়িবে।
জোর করিয়া বলিবার জো নাই দুর্যোগ থামিল, কিংবা আবার চারিদিক আকুল করিয়া আসিবে। বাড়ি পোড়ার পরে, বাহিরের দিকে যে দ্বিতল ঘর দুখানিতে জীবানন্দ আশ্রয় লইয়াছিল, তাহারই একটি ক্ষুদ্র বারান্দায় ক্যাম্পখাট পাতিয়া সে সকালবেলায় বারুইয়ের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া ছিল। পাহাড়ের ঘোলা জল নামিয়া নদীর সেই শীর্ণ দেহ আর নাই; উদ্দাম স্রোত তটপ্রান্তে সবেগে আঘাত করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে—জীবানন্দ কত কি যে ভাবিতেছিল তাহার ঠিকানা নাই। জ্বর এবং তাহার আজন্ম সহচর বক্ষশূল কমিয়াছে, কিন্তু সারে নাই। আজও সে শয্যাশায়ী, উঠিতে হাঁটিতে পারে না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পৌঁছানোর খবর পাইলে সে পালকিতে করিয়া নিজে গিয়া দেখা করিবে। মিথ্যা কিছুই বলিবে না তাহা সে স্থির করিয়াছে—যেমন করিয়া মদ-ছাড়া সে স্থির করিয়াছিল, ঠিক তেমনি করিয়া; যেমন করিয়া সে সঙ্কল্প স্থির করিয়াছিল, এ জীবনে দুঃখ কাহাকেও আর দিবে না, ঠিক তেমন করিয়াই ইহাও সে স্থির করিয়াছিল। কিন্তু আজ যথার্থই তাহার কাহার বিরুদ্ধেও কোন বিদ্বেষ, কোন নালিশ ছিল না; সে মনে মনে এই বলিয়া তর্ক করিতেছিল যে, অপরাধ ত মানুষেই করে, অন্যায় ত মানুষের জন্যই সৃষ্টি হইয়াছে, সুতরাং তাহার সাক্ষ্যে সে ছাড়া আর কেহ শাস্তি পাইবে চিন্তা করিয়া সে বাস্তবিক বেদনা বোধ করিতেছিল। কি করিয়া বলিলে যে কাহারও কোন ক্ষতি হয় না, এই কথাই যে কতরূপে সে আলোচনা করিতেছিল তাহার নির্দেশ নাই, কিন্তু কোন বিষয়ই সুশৃঙ্খলায় শেষ পর্যন্ত ভাবিবার মত অবস্থা তাহার ছিল না, তাই ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবল একই সমস্যা একই মীমাংসা লইয়া বার বার তাহার সুমুখে আসিতেছিল। এই লইয়া সে যখন প্রায় হয়রান হইয়া উঠিয়াছিল, এমনি সময় সম্পূর্ণ একটা নূতন জিনিসের উপর গিয়া তাহার মন এবং দৃষ্টি একই সময়ে স্থিতিলাভ করিল। একখানা ছোট নৌকা স্রোতের অনুকূলে অত্যন্ত দ্রুতবেগে আসিতেছিল, এবং তাহার বাটীর সম্মুখে উপস্থিত হইবামাত্রই মাঝি ডাঙ্গার উপরে নোঙ্গর ছুড়িয়া ফেলিয়া তাহার গতিরোধ করিল। এ নদীতে নৌকা চলাচল অত্যন্ত বিরল। বৎসরের অধিকাংশ দিন যথেষ্ট জল থাকে না বলিয়াই শুধু নয়, বর্ষাকালেও একটানা খরস্রোতে যাতায়াতের সুবিধা বড় হয় না। বিশেষতঃ তাহারই বাটীর সম্মুখে আসিয়া যখন এমন করিয়া থামিল, তখন কৌতূহলে সে বালিশে ঠেস দিয়া উঁচু হইয়া বসিয়া দেখিল জন-দুই পুরুষ এবং তিনজন রমণী নামিয়া আসিতেছেন। ঘন-পল্লব গাছের অন্তরালে ইঁহাদের স্পষ্ট দেখা না গেলেও একজনকে জীবানন্দ নিশ্চয় চিনিতে পারিল, তিনি জনার্দন রায়। প্রৌঢ়া স্ত্রীলোকটি খুব সম্ভব তাঁহার পত্নী এবং অপরটি তাঁহার কন্যা, হয়ত কোথাও গিয়াছিলেন, ম্যাজিস্ট্রেট আসার সংবাদ পাইয়া ত্বরা করিয়া ফিরিয়াছেন।
শুধু একটা কথা সে বুঝিতে পারিল না, নিজেদের ঘাট ছাড়িয়া এতদূরে আসিয়া নৌকা বাঁধিবার হেতু কি। হয়ত সুবিধা ছিল না, হয়ত ভুল হইয়াছে, হয়ত—বা ম্যাজিস্ট্রেটের দৃষ্টিপথে পড়া তাঁহার ইচ্ছা নয়; কিন্তু সে যাই হোক, লোকটা যখন রায়মহাশয় ও তাঁহার স্ত্রী ও কন্যা, তখন কষ্ট করিয়া বসিয়া থাকা নিষ্প্রয়োজন মনে করিয়া জীবানন্দ আবার শুইয়া পড়িল। চোখ বুজিয়া সে মনে মনে হাসিয়া কহিল, অপরাধের সাজা দিবার মালিক কি একা আদালত? এই মানুষটিকে ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব হয়ত, কখনো দেখেও নাই, দেখিলেও হয়ত চিনিত না। তবুও ইহার শঙ্কা ও সতর্কতার অবধি নাই। স্ত্রী ও কন্যার কাছে এই যে ভীরুতার লজ্জা, দণ্ডের পরিমাণে ইহাই কি সামান্য?

সহসা কে একজন আসিয়া তাহার শিয়রের দিকে বসিয়া পড়ার চাপে তুচ্ছ ক্যাম্প-খাটখানা মচ্‌ করিয়া উঠিল। জীবানন্দ চমকিয়া চাহিয়া কহিল, কে? বারান্দায় প্রবেশ করিবার পদশব্দও সে কাহারও পায় নাই, যে বসিয়াছিল সে তাহার কপালের উপর একটা হাত রাখিয়া কহিল, আমি।

জীবানন্দ হাত বাড়াইয়া সেই হাতখানি নিজের দুর্বল হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পর আস্তে আস্তে বলিল, এই নৌকাতে তুমি এলে?

হ্যাঁ।

রায়মহাশয় তোমাকে ধরে নিয়ে এলেন, তাঁকে বাঁচাতে হবে?

হাঁ, কিন্তু সে হৈমর বাবাকে, জনার্দন রায়কে নয়।

বুঝেচি। কিন্তু প্রজারা মকদ্দমা ছাড়বে কেন, সাগর স্বীকার করবে কেন?

আমার কাছে তারা স্বীকার করেচে।

করেচে? আশ্চর্য! বলিয়া সে চুপ করিয়া রহিল।

ষোড়শী কহিল, না আশ্চর্য নয়। তারা আমাকে মা বলে।

আমি তা জানি। জীবানন্দের হাতের মুঠা শিথিল হইয়া আসিল। সে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল, ভালই হয়েছে। আজ সকাল থেকেই আমি ভাবছিলাম অলকা, এই ভয়ানক শক্ত কাজ আমি করব কি করে? আমি বাঁচলাম, আর আমার কিছুই করবার রইল না। তুমি সমস্তই করে দিয়েচ।

ষোড়শী মাথা নাড়িয়া কহিল, তোমার করবার আর কিছু না থাকতে পারে, কিন্তু আমার কাজ এখনো বাকী রয়ে গেছে। এই বলিয়া সে জীবানন্দের যে হাতটা স্খলিত হইয়া বিছানায় পড়িয়াছিল, তাহা নিজের মুঠোর মধ্যে গ্রহণ করিয়া তাহার কানের কাছে মুখ আনিয়া কহিল, নৌকা আমার প্রস্তুত, কোনমতে তোমাকে নিয়ে পালাতে পারলেই আমার এইসকল কাজের বড় কাজটা সারা হয়। চল। এই বলিয়া সে হেঁট হইয়া মাথাটা তাহার জীবানন্দের বুকের উপর রাখিয়া স্থির হইয়া রহিল। বহুক্ষণ কেহই কোন কথা কহিল না, কেবল একজনের প্রবল বক্ষস্পন্দন আর একজন নিঃশব্দে অনুভব করিতে লাগিল।

জীবানন্দ কহিল, কোথায় আমাকে নিয়ে যাবে?
ষোড়শী কহিল, যেখানে আমার দু’চোখ যাবে।

কখন যেতে হবে?

এখনই। সাহেব এসে পড়ার আগেই।

জীবানন্দ তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া ধীরে ধীরে কহিল, কিন্তু আমার প্রজারা? তাদের কাছে আমাদের পুরুষানুক্রমে জমা করা ঋণ?

ষোড়শী তাহার দৃষ্টি এড়াইয়া চুপি চুপি বলিল, পুরুষানুক্রমে আমাদের তা শোধ দিতে হবে।

জীবানন্দ খুশী হইয়া বলিল, ঠিক কথা অলকা। কিন্তু দেরি করলে ত চলবে না। এখন থেকে ত আমাদের দু’জনকে এ ভার মাথায় নিতে হবে।

ষোড়শী সহসা দুই হাত জোড় করিয়া কহিল, হুজুর, দাসীকে এইটুকু শুধু ভিক্ষে দেবেন, প্রজাদের ভার নেবার চেষ্টা করে আর ভারী করে তুলবেন না। সমস্ত জীবন ধরেই ত নানাবিধ ভার বয়ে এসেছেন, এখন অসুস্থ দেহ একটু বিশ্রাম করলে কেউ নিন্দে করবে না। কিন্তু কে সাহেব এসে পড়তে পারে, চলুন।

প্রত্যুত্তরে জীবানন্দ শুধু একটুখানি হাসিয়া তাহার হাত ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। কহিল, এমন করে আমার সমস্ত ক্ষমতা তুমি কেড়ে নিয়ো না অলকা—আমাকে দুঃখীর কাজে লাগিয়ে দেখো কখ্‌খনো ঠকবে না।

কথা শুনিয়া অলকার দু’চক্ষু ছলছল করিয়া আসিল, এবং এমন একান্ত আত্মসমর্পণের দ্বারা যে তাহার সর্বস্ব জয় করিয়া লইয়াছে, তাহারই মুখের প্রতি চাহিয়া তাহার পদতলের মাটিটা পর্যন্ত যেন অকস্মাৎ কাঁপিয়া দুলিয়া উঠিল, কিন্তু আপনাকে সে তৎক্ষণাৎ সংবরণ করিয়া লইয়া হাতের উপরে একটু চাপ দিয়া হাসিয়া বলিল, আচ্ছা চল ত এখন। নৌকাতে বসে তখন ধীরে-সুস্থে ভেবে দেখবো কি কি ক্ষমতা তোমাকে দেওয়া যেতে পারবে এবং কি কি একেবারেই দেওয়া চলবে না।

সেই ভালো! বলিয়া জীবানন্দ ষোড়শীর হাত ধরিয়া অগ্রসর হইল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
Pages ( 28 of 28 ): « পূর্ববর্তী1 ... 2627 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *