Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দূরদর্শন || Arpita Roy Modak

দূরদর্শন || Arpita Roy Modak

“আজ কাল পরশু একদিন
সময়ের সমুদ্রে মিশে যায়।
ইট কাঠ পাথরের পাঁজরে
ইতিহাস ফিসফিস কথা কয়
দিন বদলায়, রং বদলায়
মন তবু খোঁজে ..
জন্মভূমি জন্মভূমি জন্মভূমি…. “

“দ্যাখলাইন দি, বেডি কিমন বজ্জাত!  বেডি দাঁতের লগে দাঁত  চিবায়া কতা  কয়!……… ” 
ভগবতী বিড়বিড় করে ঘুমের ঘোরে । ভগবতীর অবচেতন মন পৌঁছে গেছে সন্ধ্যাকালীন বিনোদনের আসরে। জন্মভূমি ধারাবাহিকের পিসিমার উপর রেগে গিয়ে ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে উঠছে।

ভুল বুঝতে পরেে খানিক থম মেরে রইলো   ।  সময়টা ঠিক ঠাহর হয় না। কতদনি ভোরের মৃদু আলো দেখা হয়নি! এখানে ল্যাম্পপোস্টের আলো ঠেলে সকাল আসে ঝুপ্ করে।
আলুথালু শাড়ি কাঁধে টেনে তুলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোয় ভগবতী।   বালতির জলে আধোডোবা  গ্লাসটাতে জল তুলে পুরোটা জল এক নিশ্বাসে শেষ করে দম পেল।

কেমনধারা দেশ! জলেও শান্তি নেই!   এমন তুলে রাখা জলে কি তৃপ্তি আসে? কোথায় টিউবওয়েল টিপে টিপে কিছুটা জল তুলে ফেলে দিয়ে তারপর ঠান্ডা জল, আহাঃ প্রাণ জুড়িয়ে যেত একদম! ভগবতীর বিচারে এদেশের আলো জল মাটি – পুরোটাই মন্দ!

কিছুই আর ভালো লাগে না । প্রায় রাতে সিদ্ধান্ত নেয় ভগবতী , সকালে উঠে জোর গলায় বলবে ছেলেকে, সে দেশে ফিরে যাবেই।ছেলে বৌমার দরবারে আর্জি জানাবে বলে থরেথরে কথা সাজয়েি রাখে । সকাল হতেই কি যে হয়! গুছয়েি রাখা কথা ও যুক্তি সব এলোমলোে হয়ে যায়।  ছেলে বউমার সামনে দাঁড়িয়ে ফিরে যাওয়ার কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না। দুটো প্লাসটিকের চেয়ার আর হাঁড়িকুঁড়ি ও বাঁকা আলনার সংসার। তবুও তো একজন  পাহারাদার চাই। ছেলে বৌমার উপর ভগবতীর ভরসা খুব কম। 

নিতাই ভগবতীর একমাত্র সন্তান । স্বামী মারা গেছে অনকে আগেই। যখন ছেলের বয়স মাত্র পাঁচ বছর।

ভগবতী বলে -” নিতাইয়ের বাপে মরলো আষাঢ়ো,আমাতি লাগছিন। হেইবারের লাগান বিষ্টি আর দেহি নাই!  ম্যালিরিয়া হইছিন। ওষুদ  নাই, একটা মশুরীও নাই।  কাঁইপ্যা কাঁইপ্যা জ্বর আইতো। খগনে দাকতরের ওষুদ কামে দেয় নাই। হেইসমবেলা বুদ্ধি পরামইর্শ করনের কেউয়েই নাই। ভালা দাকতরের ঠ্যাইন লয়া গেলে মানুষডা অহনও থাকলো হইলে ।  বাপ মায়ে আগে আগে খুঁজ খবর লইছে। অহনে আর কেউয়েই   খুঁজ করে না। ভাইয়েগো সনসারে এক গিলাস জলের আশা নাই! “

স্বামী মারা যাওয়ার পর নিত্য কবিরাজের বাড়িতে বাঁধাধরা কাজ করতো ভগবতী। ধান সেদ্ধ শুকনো করা, মুড়ি চিড়া ভাজা – এসব করতে হতো।  সময়ে ক্ষেতে গিয়ে আলু তোলা, পাট ধোয়া — এসবও করতো।

ছেলে নিতাই বড় হলো। শহরের এক কাপড়ের দোকানে কাজে ঢুকলো । সকালের ট্রেনে যায় আর সন্ধ্যার ট্রেনে ফিরে আসে । ভালোই চলছিল সব। ভগবতী অবসর যাপনের সুখ উপভোগ করতে শিখলো।

নিতাইয়ের জীবনে বসন্ত ঝড় এসে তাণ্ডব শুরু করে দিল। প্রজাপতি ঋষির চক্রে আধাশহরের মেয়ে বকুলির হৃদয় তোলপাড় করে দিল নিতাই ।

বকুলির কারনে অকারনে শহরে আসা যাওয়া বেড়ে যাচ্ছিল । নিতাই কাজে ফাঁকি দিতে শিখলো । এখানে ওখানে গলির মোরে বকুলি বান্ধবীর হাত ধরে অপক্ষোয়। মুখে হাসি চোখে ভয় ও ধূর্ততা । নিতাইয়ের বড় বিপদ । বকুলির পুরো মুখ কিছুতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে না। ঠিক কেমন দেখতে বকুলি? ছুটে গিয়ে আরেকবার দেখে আসতে ইচ্ছে করে।

বকুলির বাড়িতে জানাজানি হতে সময় লাগেনি । বকুলির পায়ে বেড়ি পরলো।  বকুল ফুলের গন্ধ পেতে মন  হাঁকপাঁক করে ।

বিরহ সহ্য করা চাট্টিখানি কথা নয় । নিতাই কেমন নেতিয়ে পড়েছিল। ভাগ্যিস বনের মোষ তাড়ানো বন্ধুরা বুক চিতিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল ।  রাতের বেলা বকুলিকে শাখা সিঁদুর পরিয়ে বাড়িতে নিয়ে এল। ভগবতী বকুলির মুখের সামনে  কুপি উঁচিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো।  

বকুলির নিজের বাড়ির লোকজন খুব বেশিদিন মুখ ফিরিয়ে থাকেনি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বকুলি সন্তান সম্ভবা।

নিতাই ও বকুলির কলিজার টুকরোটি তখন সারা উঠোনময় হলেদুলে হাঁটে। বকুলির চোখ সরে না। এই শিশুটিকে ঘিরে ওর আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়াবে। বড়মানুষের ছেলেদের মত পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে পাঠাবে । এই অজপাড়াগাঁতে থেকে তা সম্ভব নয়। এছাড়া নিতাইয়ের বাঁধাধরা আয়ে বাঁধাধরা জীবন। বকুলি নিজে হাত পা নাড়িয়ে যে কটা বাড়তি পয়সার মুখ দেখবে সে উপায়ও নেই।

বকুলির মামা নিতাইয়ের জন্য একটা নতুন কাজের সন্ধান দিল। এই গ্রামে থকেে তা  সম্ভব নয়। বকুলি অনকে করে বুঝিয়ে রাজি করালো নিতাইকে ।

ভগবতী অনেকবার বলেছে – “তরা যা গিয়া , আম্ব এইনোই থাকবাম । ” নিতাই কিছুতেই বুড়ো মাকে ছেড়ে যেতে রাজি নয়।

ভগবতী চোখের জল মুছতে মুছতে বিদায় জানালো বাঁশরে খুঁটি, চারটে ইঁট দিয়ে বাঁধানো তুলসী মঞ্চ, মরা নদীর জলকে। ভগবতী তখন সন্তান সুখে গরবিনী মা। এতশত মায়া ফেলে ছেলের হাত ধরে শহরে আসার আগে পাশের বাড়ির শিবুর মাকে দুঃখ দুঃখ সুখ নয়েি বলেছে — ” পুলায় জুরাজুরি করতে আছে। আমারে থুইয়া যাইতো না। আমরার আর কি আছে কইন, আমরার দিন অহনে শ্যাষ। তাগো মুক চাইয়া থাহি। তাগো সুকেই আমার সুক। “

রোজ সন্ধ্যা বলো শিবুর মা’র সাথে মঝেতে চট পেতে জন্মভূমি দেখা, শুক্রবারের বিকেলে বাংলাদেশের সিনেমা দেখা আর হবে না! বিকেল বেলা খালের ধারে শিবুর মাকে এখন একাই  শাক কুড়াতে যেতে হবে। বাড়ির বউ যে কত বেশি বাজে খরচ করে – বন্ধ হলো সে আলোচনাও। নদীর জলে আধা ডোবা হয়ে থাকা পাথরটাতে কাপড় কাচা নিয়ে কারোর সাথে মন কষাকষিও আর হবে না। শিবুর মা’র সাথে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হলওে আবার নিচু হয়ে টিভি দেখতেও যেতে হবে না ।

বস্তির এক স্যাতস্যাতে ঘরে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে যায় ভগবতীর।পঁচা নর্দমার দুগর্ন্ধ, মশার অত্যাচারে দিনের বেলাতেও টেকা দায়!   সকাল হতেই বালতি হাতে রাস্তার কলে ঝগড়া! টেনে আনা মাপা জল দিয়ে কাজকর্ম ও স্নান।  রাতের বেলা এরতার মদ গিলে ঝগড়াঝাঁটি। একেকটা দিন যেন নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি।

ভগবতী মুখ ফুটে বলতে না পারলেও অনুভব করছে, ভীষণ রকম অনুভব করছে। জীবনের প্রতিটি দিনই কিছুটা হলেও নিজের জন্য বাঁচা প্রয়োজন। সন্তান হোক বা আর কেউ নিজেকে শূন্য করে কখনো বাঁচা যায় না। প্রতিনিয়ত শূণ্যতায় হাহাকার করে ওঠে ভগবতীর মন।

বকুলি শহরে এসে খুব খুশি। স্বাধীনতার সুখ যেন উপচে পড়ে ওর চোখেমুখে । ও নাইটি চুরিদার পরার স্বাধীনতা পয়েছে। দু -বাড়ি রান্নার কাজ জুটিয়ে নিল।

নাতি কোলে এর তার সাথে উপযাচক হয়ে ভাব জমাতে চায় ভগবতী। ভাব জমে না। এখানে সবাই যে যার মত তরঙ্গের মত বয়ে চলেছে।

সবটা মানিয়ে নিলেও সন্ধ্যা বেলা ভগবতীর মন চরম বিদ্রোহ  করে ওঠে । সন্ধ্যাবলো কাজের বাড়ি থেকে রাতের রান্না সেরে এসে বাড়িতে রান্না করতে মন চায় না বকুলির । দুপুরের যা কিছু থাকে তার সাথে টিফিন কৌটোতে আনা   তরিতরকারি দিয়ে রাতটা  চালিয়ে দিতে চেষ্টা করে।

ভগবতী বুঝতে পেরে সন্ধ্যা বলোতইে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে। খেতে ডাকলে রোজই পেটে দুটো চাপড় মেরে এক  বাহানা —” খিদা নাই রে ,  প্যাট ফাঁইপ্যা রইছে ! তরা খা যায়া “। কৃত্রিম ঢেঁকুর তোলার চেষ্টায় চোখের কোণে জল এসে জমে ।  সারারাত ঘুম আসে না। রাস্তার কুকুরগুলোর তীব্র চিৎকার , ঘরের ভিতরে এঁটো বাসনে খুটখাট করতে থাকা ইঁদুর ছুঁচোর দ্রুত ছুটে চলা  জাগিয়ে রাখে সারারাত। শেষ রাতে চোখে স্বপ্ন নেমে আসে, দ্যাশের বাড়ির স্বপ্ন।

দেশ আবার কি গো? নগন্য তুচ্ছ মানুষ ভগবতী। সে দেশ বা রাজ্যের   গণ্ডি চেনে না। দেশ বলতে চেনে শুধু গুটিকয়েক চেনা মুখ।

ভগবতী স্বপ্ন দেখে – শিবুর মা হামান দিস্তায় পান ছ্যাঁচে, শিবু উঠোনে পোঁতা এ্যানটেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবি ঠিক করে । জন্মভূমির পিসিমা ভ্রূ  তুলে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শোনায়।  নিশু বাংলাদশের সিনেমা দেখে উত্তেজিত হয়ে মা –  মাম – মাম – মার   বলে ভগবতীর গায়ে হাত পা চালিয়ে দেয়। ভগবতী কেঁপে কেঁপে ওঠে । শিবুর মা শাক কুড়াতে কুড়াতে গভীর জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঠিক তখনই শিবুর মাকে চৎকিার করে ডেকে ওঠে ভগবতী — “আপনে কুনো গ্যালাইন গো দি? আম্ব এইনো “।
ভগবতীর অস্ফুট কথাগুলো গোঙানরি মত শোনায়।

আজ সন্ধ্যা বেলা বকুলি বাড়ি ফিরতে দেরি করায় নাতি কোলে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ চলে এসেছিল ভগবতী।
সেই চেনা সুর!
“মন তবু খোঁজে…..
জন্মভূমি জন্মভূমি জন্মভূমি…..”

থমকে দাঁড়ালো । বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি বাগান পেরিয়ে প্রথম ঘরটাতে টিভি চলছে। দূর থেকে তিন ভাগের শেষ ভাগ সিরিয়াল দেখে বাড়ি ফিরলো । অনেকদিন পর কথার ফুলঝুরি ছুটলো ভগবতীর মুখে । দেশ ছেড়ে বিদেশে এসে হঠাৎ চেনা মুখ দেখে যেমন উচ্ছ্বসিত হতে হয়, ঠিক তেমনই উচ্ছ্বাস ।

এরপর পরপর দুদিন একই প্রয়াস- দূর্রদশন। তৃতীয় দিন এক বয়স্ক ভদ্রমহলাি ঘরে ডেকে নিলেন ভগবতীকে। ভগবতী ভালো করে ঘোমটা টেনে বসলো বিদেশিনীর সামনে । আচারে ব্যবহারে তাদের পার্থক্য থাকলওে এই এক সুতোতে তাঁরা বাঁধা পড়েছে — দূরদর্শন

ভগবতীর এখন আর একটুও খারাপ লাগে না। ভদ্রমহিলার সাথে ভাব হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলা একাই থাকেন। দুজনে অনকে গল্প হয়। ভগবতীর শিবুর মা আর মরা নদীর গল্পের সঙ্গে কখনো কখনো মিলে যায় বিদেশিনীর গল্প।  
বিজ্ঞাপন বিরতির সময় দুদনি চা করেও এনেছেন।

সেদিন ধারাবাহিকের দুটো ভাগ শেষ হতে না হতে এক কমবয়েসী ছেলে বাজারের থলে হাতে ঢুকলো। ভগবতীকে দেখে বিরক্তি নিয়ে ভ্রূ নাচিয়ে ভদ্রমহলািকে ইশারা করলো। ভগবতী আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ঝট করে উঠে আসতে পারলো না।
ধারাবাহিক শেষ হতে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে এল ।

ভগবতী সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। ধারাবাহিকের মোহে পরের দিন সন্ধ্যাবেলা যন্ত্রচালিতের মত ঠিক পৌঁছে গেল বাড়িটার সামনে । দরজা জানালা বন্ধ। আরেকটু সাহস করে দরজায় দুটো টোকা দিল।
— “ঘরো আছুইন নি দি? ও দ্দি? “

কেউ দরজা খুললো না। ভয়নাক রকম নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে চারিদিকে । যেন রাতারাতি পিশাচ এসে দখল জমিয়েছে। ভগবতী আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো।
ভগবতী সবেমাত্র রাস্তায় পা রেখেছে। বাড়িটির ভিতর থেকে ভেসে আসছে এক ক্ষীণ সুর – “জন্মভূমি…. জন্মভূমি… “

আজ আর দূর- দর্শন হলো না!

টলতে টলতে বাড়ি এসে বছািনায় শরীর এলিয়ে দিল । খুব ঘুমও পাচ্ছে।
ভগবতী দেখতে পাচ্ছে -জন্মভূমির পিসিমা ভ্রূ তুলে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে বকছে ভগবতীকে। ভগবতী একটা কথারও যুতসই উত্তর খুঁজে পেল না। হাবাগোবা ভগবতী তোতালাতে লাগলো।

এও এক দূরদর্শন। দূর থেকে দেখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress