Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দুয়ো রানী || Rana Chatterjee

দুয়ো রানী || Rana Chatterjee

দুয়ো রানী

“…না ঠাম্মা আজ আমি রূপকথার  গল্প নয় তোমার গল্প শুনবো “।আমার আবার গল্প কি গো দাদুভাই , আমিতো সামান্য একজন মানুষ বলে হা হা করে হেসে উঠলেন পান খাওয়া লাল টুকটুকে ঠোঁটে প্রভাদেবী।এত বয়স তবু কি উজ্জ্বল আভা যেন আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে।বহু বছর ধরে উনি লোক চক্ষুর আড়ালে কেবল দুখানি ঘরের অলিন্দে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছেন।

নাতি তখনো জোর দিয়ে বলছে, “না, আমি জানি তুমি রাণীমা, বলো না গো তোমার নিজের গল্প”। নাতি দেবাংশুর  মাথায় হাত বুলিয়ে উদাস হয়ে তিনি বললেন, “তা বটে তবে ভালো রানী আর কই হতে পারলাম আমি দুয়োরানী”! কথাটা বলেই চোখের জল চলে আসে ঠাম্মার।

একি তুমি কাঁদছো কেন ঠাম্মা, ও মা দেখো..” হাঁক দেওয়ার আগেই মা সুনয়না হাজির হয়ে।তিনি  উল্টে দেবাংশুকে বকছেন। তুই নির্ঘাত বড্ড উল্টোপাল্টা প্রশ্নে ঠাম্মাকে আঘাত দিয়েছিস, চুপ করে ঘুমা।”না মা আমি তো আবদার করেছি কেবল ঠাম্মার নিজের গল্প শুনতে” ! সুনয়না  বিষয়টা এড়িয়ে কিছু না বলে বাইরে গেলেন দেখে কৌতূহল  বাড়লো ছোট্ট দেবাংশুর।

কাল বেলায় মামারবাড়ী এসে পাশের যে চুন সুরকির পড়ে থাকা বাড়িটা আছে, খেলার বল ওদিকে ছিটকে চলে যেতেই তিনতলার এক চোরা কুঠুরিতে পৌঁছে যায় দেবাংশু।বেড়াল ছানাটা পিছু পিছু কোথায় যে ঢুকে গেলো!বল পেয়ে ওকে খুঁজতে গিয়ে একটা ভাঙ্গা ট্রাঙ্ক দেখে থমকায় সে। একটা ধূলো মাখা রাজবাড়ীর বিরাট তোরণ, বন্ধ দরজার ছবি দেখে মনে পড়ে যায় আরে এটা তো শহর ঢোকার মুখে বাস থেকে দেখেছে মল্লিক পুরের ওদিকে।ভেতর থেকে ব্যাগে রাজা রানী র ছবি দেখে বেশ অবাক হয় শিশু মন, এ যে রানিমার মুখ হুবহু তার ঠাম্মার মুখের মতো।আজ দুপুরে সবাই বিশ্রাম নেওয়ার সময় আবার চুপিসাড়ে ওই নির্জন বাড়ি গেছিলো সে! শুধু ভেবে উত্তেজিত হচ্ছিল তবে কি তার ঠাম্মা সত্যিকারের রাণীমা আর তারা সবাই রাজ রাজাদের বংশ! কই কেউ কোনদিন তাকে একথা বলেনি তো!

দেবাংশুর মনে পড়লো ফটোতে দেখা রাজবাড়ীর তোরণ, বন্ধ দরজা আজও আগাছা ধূলো নোংরা জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে ইতিহাসের স্মৃতি বহন করে অথচ পাশের অংশে সরকারি কলেজ কাছারি হওয়ায় রঙের প্রলেপ পড়েছে।এরপর দেবাংশু  মামারবাড়ী এলেও ওই পুরনো বাড়ি আর পায় নি কারণ ওটা ভেঙে একটা আবাসন তৈরি হয়েছে। প্রায় বছর চার পাঁচ মামার বাড়ি আসতে পারে নি । তার ঠাম্মা বয়সের ভারে মারা গেলে মামা  বাড়ি জমি সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি বাটোয়ারা করে ফ্ল্যাট কিনে চলে আসে আসানসোল শহরে।

দেবাংশুর খুব আফসোস হয় ভাবলে, কেন যে সেদিন ওই রাজবাড়ীর তোরণ ও রাণীমার সজ্জায় তার ঠাম্মির ছবিটা সরিয়ে রাখে নি। ক্লাস সেভেনের তখন  সে কোথায় যে লুকিয়ে রাখবে ছবি সেটাও মাথায় আসে নি।যাইহোক এখন দেবাংশু বেশ বড়ো, প্রিয় বিষয় ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়ছে।ঠাম্মা নেই  কিন্তু ওই ছবি আজও যেন দেবাংশু কে পিছু তাড়া করে বেড়ায়।

বহুবার মা-বাবাকে দেবাংশু অনুরোধ করেছিল ঠাম্মাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে কিন্তু প্রতিবারই ওনারা অগ্রাহ্য করেছেন কারণ ঠাম্মা কিছুতেই ওই পুরনো বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না।  অথচ ঠাম্মার মৃত্যুর পর মামার মধ্যে  নিজেদের ভিটে বাড়ি, শহরের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে  রাখার  কোনো তাগিদ দেখেনি। ঠিক এইখানেই দেবাংশুর মনে কৌতূহল বেড়েছিল, ঠাম্মা ও নিজেকে দুয়োরানি বলে উল্লেখ করে কেন কেঁদেছিল তবে কি কোনো লুকানো গল্প আছে!এটা  তার মনকে খুব চঞ্চল করে তোলে।

একদিন কলেজের লাইব্রেরীতে ইতিহাসের স্যর পুরানো রাজবাড়ীর ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থের সন্ধান করতেই সে  প্রশ্ন করেছিলো স্যর আপনার মল্লিক বাড়ি রাজবাড়ি সম্পর্কে কিছু জানা থাকলে বলবেন। কেন সামান্য কিছু অংশ- তোরণ পরিত্যক্ত রেখে পুরো রাজবাড়ীর  সৌন্দর্যায়ন, এর পেছনে কি কোনো কারণ আছে?রাজা বা রানিমাদের ইতিহাস পড়তে যদি কোনো বইয়ের নাম বলেন পটাপট এ সব প্রশ্ন করা কৌতুহলী ছাত্রকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন স্যর। ছাত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে মাথা দুলিয়ে বলেছিলেন, ” বাহ এইতো তুমি যথার্থ ইতিহাসের ছাত্র”। আসলে প্রশ্ন করতে না পারলেও ঠাম্মার সাথে রাজবাড়ীর কোনো মিল আছে কিনা সেটা জানার খুব ইচ্ছা ছিল দেবাংশুর।

সেদিন স্যর একটা বইয়ের নাম উল্লেখ করে সংক্ষেপে সারমর্ম বলেছিলেন যা শুনে অবাক হয় দেবাংশু।রঘুবীর নামে রাজবাড়ির এক বিশ্বস্ত দারোয়ান ছিল যে কৌশলে রাজবাড়ির অভ্যন্তরে তার প্রভাব বিস্তার করতে  রাজপরিবারের  মেজো সন্তান দীনেন্দ্রর  সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। সে সামান্য দারোয়ান থেকে একদম ব্যক্তিগত দেহরক্ষী পদে উঠে আসেন। সমস্যার সূত্রপাত হয় তখনই যখন ক্ষমতালোভী  রঘুবীর প্রেম নিবেদন করে বসে দীনেন্দ্রর কন্যা প্রভাকে।তাকে বিয়েতে রাজি করানোর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল রাজপরিবারের অভ্যন্তরে আরো প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর।একজন সামান্য দারোয়ান থেকে ক্ষমতা বাড়িয়ে ততদিনে নিজের প্রভাব বাড়ানো রঘুবীর কিনা রাজবাড়ির তাও নিজের কন্যাকে বিয়ে করছে এ আঘাতে দীনেন্দ্র আত্মঘাতী হোন। অনেকে বলে দীনেন্দ্র কে মেরে ফেলার পেছনে নাকি ছিল রঘুবীরের গোপন আঁতাত ও বিষ প্রয়োগ।এর পর রঘুবীর সিংহাসনে পদার্পণ করে রাজপরিবারের সকল সদস্য সদস্যাদের গৃহবন্দি করে। রানী প্রভাদেবী বহুবার চেষ্টা করেছেন স্বামীকে ঠিক পথে আনার কিন্তু তার দুর্ভাগ্য যে তার স্বামী ছিল লম্পট ।রঘুবীর আরো দুটো রাজ্য  জয় করে সে রাজ্যের রাজকন্যাদেরও বিয়ে করে নিজের স্ত্রী প্রভাকেই দুয়োরানীর তকমা দেয়।

   রাজপরিবারের ভাঙ্গন ঠেকাতে ও অপমানের বদলা নিতে প্রভাদেবী গোপনে নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন।তবু তার বড্ড দেরি দেরি হয়ে গেছিলো।উল্টে দুয়োরানীর তকমা পাওয়া রাণীমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয় ওই আজও পড়ে থাকা পরিত্যক্ত তোরণ দিয়ে।যা এত বছর পর আজও জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে  কারণ শহরবাসীর মনে একটা ধারণা হয়ে গেছিলো ওটা দুয়োরানী দরজা।ওই দুয়োরানী বদনাম জুটেছিল রানীমার এতে বরং প্রজারা সবাই খুশি কারণ রাজ পরিবার, রাজ্যের অমঙ্গল ওনার জন্যই হয়েছে। উনি দারোয়ান রঘুবীর কে বিয়ে না করলে রাজপরিবারের এইভাবে অনর্থ, ভাঙন হতো না।

বিস্তারিত শুনে এরপর আর বুঝতে বাকি থাকে না দেবাংশুর কি কারনে ঠাম্মা নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি রেখেছিলেন। স্যর আরও বললেন তারপর থেকে ওই দুয়োরানী মাকে আর কেউ জনসমক্ষে  দেখতেও পায়নি, হয়তো উনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় আত্মঘাতী  বা আত্মগোপন করেছিলেন।সামগ্রিক গল্পটি শুনে দেবাংশুর চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়লো , খুব মিস করছে ঠাম্মা কে। আমৃত্যু কি মানসিক যন্ত্রণাটাই সহ্য করেছেন উনি। দেবাংশুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি কেন তার কৌতূহল মেটাতে  মা, বাবা, মামা- ঠাম্মা কেউই আগ্রহ দেখায় নি কারণ এটা একটা পরিবারের কলঙ্কের ইতিহাস যা বন্ধ দরজার মতোই অন্তরালে চলে যাওয়া কাম্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress