দুঃস্বপ্ন – আট
বাড়িটা কেমন নিঝুম লাগছে। মনীষ ঘুম ভেঙে গেলে দেখল, জানালায় চুপচাপ সোমা দাঁড়িয়ে আছে। কী দেখছে যেন। অপলক। ঘুম ভাঙলে শরীরে ভীষণ জড়তা থাকে। এবং চিঠি পাবার পর থেকে জড়তা কেমন ভীষণ বেড়ে গেছে, উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সবকিছু ফাঁকা, নিরিবিলি, এ—ভাবে বেঁচে থাকার মানে হয় না, এবং কেমন সবকিছুর ওপর বিদ্রোহ করতে ইচ্ছা হয়, দেশের মানুষ, পুলিশ, সরকার সবকিছুর ওপর। সাংঘাতিক সাংঘাতিক ঘটনা, এবং সে নিজের গলায় হাত দিল। আর এ—ভাবেই বোধহয় মনে পড়ে যায়, কী কী ঘটেছে, কীভাবে সব হত্যা, অর্থাৎ কীভাবে সব মানুষের গলা কেটে দেওয়া হচ্ছে। কেউ কিছু করতে পারছে না। দিনদুপুরে হাজার মানুষ যাচ্ছে, তার ভিতর তিনজন ওরা অথবা চারজন, সবাইকে বলছে সরে যান, আমরা এর গলা কেটে দেব। আর সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের জানালা দরজা বন্ধ, রাস্তা ফাঁকা। যে যার মতো পড়িমরি ছুটছে। ভাবলেই চোখমুখ ঘোলা ঘোলা হয়ে যায়। চিঠির কথা মনে হয়। কথা আছে ওরা আসবে। ওরা আসবে কথা থাকলে আসেই।
ওর এখন যা যা করণীয়, সে উঠে পড়ে ঠিক করে নিল। অন্য দিন সোমা জানলায় দাঁড়িয়ে থাকলে, তাকে পাশে নিয়ে সেও দাঁড়াত। কথা বলত। বাগানের সব নানাবর্ণের ফুলের সঙ্গে সোমার অঙ্গ—প্রত্যঙ্গের তুলনা দিতে ভালোবাসত। যেমন একটা লাল তাজা গোলাপের মতো ওর সুন্দর সুষম জায়গা, নরম তাজা, এবং লাল গোলাপ চটকালে যে মধুর ইচ্ছা কাজ করে বেড়ায় তেমন ইচ্ছায় কথা বললে, সোমা বলত, তুমি ভারি অসভ্য।
এ—মুহূর্তে সে আর সোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না। বুকের ভিতরে সেই একটা কষ্ট, কেমন থেকে থেকে ধক করে উঠছে। এমন তো ওর কখনও ছিল না। সে, সোমাকে আজও প্রশ্ন করতে পারত, কিন্তু করে লাভ নেই। বরং সে ভেবেছে, এখন যে যে জায়গায় তার পরিচিত ব্যক্তিরা হত্যা হয়েছে, সব জায়গায় সে এক এক করে জিজ্ঞাসা করবে, প্রত্যেকে চিঠি পেয়েছিল না চিঠি পায়নি, চিঠি পাবার পর ওরা কতদিন সাধারণত দেরি করে থাকে, অথবা যারাই চিঠি পেয়েছে, তারাই নিহত হয়েছে, না কেউ কেউ রেহাই পেয়েছে, এবং সেটা শতকরা কী দাঁড়ায়, সেজন্য সে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে গেল। কিন্তু বাথরুমে ঢুকেই মনে হল, সোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি, সে আবার দরজা খুলে বের হয়ে এল! কিন্তু সোমা তখনও জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। এটা কেন হবে, সে সোমার পাশে গিয়ে ডাকল। কেমন অহেতুক একটা জড়তা শরীরে সোমার। সর্বনাশ এটা কী! সোমা, সোমা! আশ্চর্য তো, সোমার হুঁশ নেই।—এই সোমা!
সোমা বলল, হুঁ।
তুমি কী দেখছ?
কিছু না।
তুমি এমন শক্ত হয়ে যাচ্ছ কেন?
আমি শক্ত হয়ে যাচ্ছি!
হ্যাঁ। তোমার কী হয়েছে?
কিছু না।
এ—ভাবে কেউ দাঁড়ায়। এসো, বসবে।
সোমাকে ও খাটের দিকে ধরে ধরে নিয়ে গেল।—কী হয়েছে?
কিছু না।
ঠিক করে বল!
কিছু না।
তুমিও শেষে এমন করলে আমি কী করি!
আমি কী করেছি!
তুমি আয়নায় এসো, চোখ দেখবে।
আমার চোখ, কী!
চোখ ঘুরছে না!
কী যে বল!
সত্যি। একেবারে স্থির।
এটা হয়েছে বুঝি!
অ মাই গড। আমি কী করব।—অসিত, অসিত, সে জোরে চিৎকার করে উঠল ফোনে।
এই সকালে! কী হয়েছে?
শিগগির আয় ভাই!
অ্যাকসিডেন্ট!
না, তার চেয়েও বেশি। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে ডাকল, মনোরমা, চিৎকার করে উঠল, মনোরমা! মনোরমা এলে দেখল, কেমন স্থির চোখে শুয়ে আছে দিদিমণি। চোখ দেখেই টের পেয়েছে, ভীষণ ভয় পেলে মানুষের এমন হয়ে থাকে। সে তাড়াতাড়ি এক গেলাস জল এনে, চোখে পরপর ঝাপটা দিতেই কেমন, চোখ ঘুরতে থাকল। সোমা দেখল পাশে দাঁড়িয়ে আছে মনীষ। সে কেমন বোকার মতো বলল, আমার কী হয়েছিল, চোখে জলের ঝাপটা দিলে কেন!
মনীষ বলল, শুয়ে থাক। উঠতে হবে না। কিছু হয়নি।
কিছু হয়নি তো শুয়ে থাকব কেন! জোর করে শুইয়ে রাখতে চাও?
না, জোর করে না। তোমার শরীরটা ভালো না। তোমার বিশ্রামের দরকার।
সে হবে। সারাদিনই তো তার জন্য আছে। রাত্রিটা আছে। আমাকে একবার বের হতে হবে।
সোমা উঠে বসল।
প্লিজ সোমা। আমার কথা রাখো।
আমাকে এক্ষুনি একটু বিনুর কাছে যেতে হবে।
লোক পাঠাচ্ছি বিনুর কাছে। ওকে নিয়ে আসুক।
শুধু বিনুর কাছে গেলেই হবে না। অন্য অনেক জায়গায় যেতে হবে। আমার অনেক কাজ মনীষ।
সোমা!
সত্যি বলছি। তুমি ভাববে না।
তোমার চোখ কোথায় চলে গেছে!
সে তোমারও।
আমার আবার ঠিক হয়ে যাবে।
আমারও।
সোমা, অসিতকে অন্তত আসতে দাও।
কিন্তু ততক্ষণে বিনু যদি বের হয়ে যায়।
বিনুকে বাড়ি থাকতে বলে পাঠাচ্ছি।
সোমা বুঝতে পারল, অসিত না আসা পর্যন্ত সে বের হতে পারছে না। ঘরের দামি আসবাবপত্রের মতো আর সোমাকে মনে হচ্ছে না। কেন যে এক রাতেই শ্রীহীন হয়ে গেছে। সে যে রসুলকে নিয়ে শেষ রাতের দিকে মাঠে ঘুরে বেড়িয়েছে, মনীষ জানে না। জানলে আরও ঘাবড়ে যাবে।
আর মনীষ পাশের একটা ডিভানে বসে কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। রাতের পোশাক এখনও শরীরে। অসিত আসার আগে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অসিত না এলেও কোনো ক্ষতি নেই। যে—ভাবে সোমা এখন স্বাভাবিক, তাতে অসিত হয়তো এসে বলতে পারে, আমাকে তুই কী এপ্রিল ফুল করলি। এখন সে এলে কী যে বলবে! তবু ওর মনে হল সব খুলে বলাই ঠিক। অঞ্জনের কথা সে খুলে বলবে। সারারাত সে কাল ঘুমিয়েছে বলবে, তারপরই মনে হল, না ঘুম ঠিক হয়নি, কেমন তন্দ্রার মতো, যেন অসাড় অবশ, শুধু শুয়ে থাকা চোখ বুজে, চারপাশে কী হচ্ছে সব সে বুঝতে পারে, কেবল কথা বলতে পারে না, চোখ খুলতে পারে না, এবং এক সময় মনে হল শেষ রাতের দিকে সোমা নিচে নেমে গিয়েছিল, কেমন সে অনায়াসে এ—সব মনে করতে পারে, একটু মনের ভিতর ডুবে গেলেই যেন, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঘুমের ভিতর এই বাড়িতে কী হয়েছে, কটা কীটপতঙ্গ ডেকেছে, একটা বেড়াল কখন ম্যাউ ম্যাউ করে গেছে সে সব বলতে পারে এবং এমন ভাবলেই কেমন সোমার জন্য এসব হচ্ছে টের পায়। কী দরকার ছিল, সেই লোকটার দিকে তাকানো, সে লোকটা কে! সোমা কি শেষ পর্যন্ত মনে করতে পারছে, সে কে? কোথায় তাকে দেখেছে!
মনীষ বাথরুম থেকে ফিরে ভাবল, সোমাকে বলবে, সোমা, তুমি চিনতে পারলে তাকে। কিন্তু সোমা এই অবসরে, ভীষণ সেজেছে। ওর নখে সাদা নেল পালিশ। বোধহয় সকালেই সেসব পোশাক পালটে কী পরবে ঠিক করে রেখেছিল। সে মুখ গালে এমন রঙ মেখেছে যে একসময় মনে হল মনীষ নিজেই হেসে দেবে। সোমা এমনিতেই ভারি সুন্দর, তাকালে মনে হয় সে সব দেখে ফেলছে মানুষের। মানুষেরা তাকালে মনে হবে, এক নদী বয়ে যায়। নিরন্তর গাছপালার ভিতরে সেই নদীর নীল জল ভারি গভীর। তবু এমন সাদা কেন। সেই যে মানুষটা, সে কী জেনেছে, সোমার এই ভারি চোখ, অথবা স্পষ্ট বাহু, এবং নাভিমূলে যে আশ্চর্য নীল জলের খেলা সব তার চেনা। নতুন কিছু সোমা তাকে দিতে পারে না। দিতে না পারলেই যা হয়, জ্বালা, ভিতরে জ্বালা কী যে মনে হয় নিজেকে, যেন সংকোচের শেষ নেই, নানাভাবে সেজেও মনে হয় ঠিক সাজা হল না, হয়তো সে দেখে তার দিকে তাকাবেই না। মনীষ বলল, এই সাত সকালে এমনভাবে সানফ্লাওয়ারের মতো ফুটে থাকলে!
সোমা বলল, সত্যি।
মনীষ পাশে গিয়ে বলল, ভীষণ খারাপ লাগছে।
ভীষণ খারাপ লাগছে কেন!
আর একটু হলে হেসে দিতাম। বলেই সে ঠোঁটে চুমু খেল। লক্ষ্মী মেয়ে, অসিত আসছে। মুখের রঙ ধুয়ে ফেল, তোমার নিজের এমন সুন্দর রঙ থাকতে কেন যে ছাইপাঁশ মাখা বুঝি না। ভীষণ ভালো তুমি। তুমি পরিষ্কার হয়ে এসে বোসো।
আর তখনই মনে হল কেউ উঠে আসছে। নিচে কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। মনীষ বাইরে বের হয়ে সিঁড়ির মুখে দাঁড়াল। সিঁড়ির মুখে পার্লারে বসাল অসিতকে এবং তারপর ডেকে যখন সাড়া পেল সোমার, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে, সোমা এল সাধারণ বেশে। সোমাকে মনীষের আবার সুন্দর লাগছিল। আসলে সোমার চারপাশে থাকে বর্ণময় এক গন্ধ। ছুঁয়ে দিতে পারলেই যেন লাভ, কী যে মিহি শরীর, অথচ কী দেখে এমন হয়ে গেল! এবং মনীষ অসিতকে সকালের ঘটনা বলে কী ভাবল, তারপর সোমাকে ছেড়ে দিল। সিঁড়ি ধরে নামার সময় অসিত বলল, হিস্টিরিয়ার মতো কিছু একটা হচ্ছে।
তুই একবার ডাক্তার অমিতাভ চৌধুরীকে দেখাতে পারিস। মন—টনের ব্যাপারটা তিনি ভালো বোঝেন। বলেই বলল, তুই কেমন আছিস?
ভালো।
আর চিঠি এল?
না।
সব বাজে। আজকাল অনেক উড়ো চিঠি আসছে। তবে সময় খারাপ। বড় খারাপ। সে তারপর বলল, যাই হোক, সাবধানে থাকিস। আর নামতে নামতেই যেন মনে পড়ে গেল। বলল, সোমা লোকটাকে চিনতে পারল?
না।
কিছু বলছে না?
কী বলবে। সকালে মূর্ছা যাবার আগে কিছু একটা নিশ্চয় দেখেছিল।
সেটা কী?
আমি জানি না।
তুই জানিস না মানে! তুই তখন কোথায় ছিলি?
ঘরেই।
তবে?
আমি কী করে বুঝব, দাঁড়িয়ে সোমা মূর্ছা যেতে পারে। কী করে বুঝব বাজ—পড়া মানুষের মতো সোমা দাঁড়িয়ে আছে।
দেখে বুঝতে পারিসনি?
সকাল বেলাতে রোদ আসার আগে ওর তো অভ্যাস, জানালায় দাঁড়ানো। আজও তেমনি দাঁড়িয়ে আছে ভাবলাম। ঘুম থেকে উঠেই ভাবলাম, একবার শান্তিবাবুর কাছে যাব। তারপর যাব সমরজিতের কাছে। ফোনে এ—সব কথা হয় না। গরজ আমার, নিজেই যাব ভাবছি।
ওরা গাড়ি বারান্দায় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। পাশে একটু দূরে ড্রাইভার। মনীষ আস্তে আস্তে মুখোমুখি কথা বলছে। অসিত সময় দিয়ে শুনছে। যেন কেউ শুনতে না পায়, শুনলে আবার দুকান হবে, সে সন্তর্পণে বলছে, শান্তিবাবুদের নাকি একটা লিস্ট টানিয়ে দিয়েছে!
কীসের লিস্ট?
কীসের লিস্ট আবার। লাল কালির লিস্ট।
কে কে আছেন?
প্রায় একুশ জনের নাম আছে।
—সবাই অধ্যাপক!
সবাই। কেউ আরও উঁচুতে।
এইসব নিরীহ মানুষদের মেরে কী হবে!
জানি না।
তুই এখন ওখানে যাবি?
না গিয়ে উপায়! এখন কাউকে কিছু বিশ্বাস করে বলাও যায় না। কে যে কার লোক! আর জানিস সবসময় ভয় হয়, কেউ আমাকে ফলো করছে।
অসিত কিছু বলতে পারল না। কারণ সে সঠিক বলতে পারবে না কী ঘটনা। সে শুধু সাবধান করে দিতে পারে। সে আর বলতে পারে না, শুধু মিথ্যা ভয় দেখানো। বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার জন্য হয়তো শান্তিবাবুরা যাবেন। ওদের তিন মাসের সময় দেওয়া হয়েছে।
অসিত একটু ভেবে বলল, তোকে কোনো সময় দেয়নি?
না।
পুলিশে চিঠিটা দিয়ে দে।
কী হবে! ওরা তো তবে আরও ক্ষেপে যাবে। আমি চেষ্টা করছি ভালো হবার। যারাই পুলিশে কেস দিয়েছে কেউ বাঁচেনি। ওদের ভিতরও লোক আছে। তাছাড়া ওরা নিজেরাই তো নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না।
চেষ্টা করছিস?
কী করব! ভেবেছি আজই গিয়ে সব চর্বিটর্বি নষ্ট করে দিতে বলব। মিনারেল অয়েল আর ব্যবহার করতে বারণ করব। তারপর কপালে যা হয়। মুশকিল কী জিনিস, ঠিক মাপ দিলে দামে পড়তা আসে না। এত লোক কাজ করে, ওদের পয়সা তবে দেব কোত্থেকে!
অসিত বলল, হ্যাঁ ভাববার কথা।
—ভাববার কথা না! কেউ এখন প্রকৃতিস্থ নেই। কেন যে এমন হল!
অসিত বলতে পারত, আমরা নানাভাবে অধার্মিক হয়ে গেছি। তবে এভাবে কী এর সমাধান! এটাও সে ভাবল। সুতরাং মনীষকে সে কিছু বলতে পারল না। কিছু বলতে না পারলে যা হয়, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা, ওরা চুপচাপ কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে যখন বুঝল আর কোনো এখন কথা হতে পারে না, তখন অসিত গাড়িতে বসে বলল, যা ওপরে যা।
অসিত চলে গেলে সে কেমন একা হয়ে গেল। রসুল এখন থাকে না, রাম অবতারের বোধহয় গেটে ডিউটি। কিন্তু সে এত সতর্ক থেকেও কেমন অসহায় বোধ করছে। সে এটা কাউকে বুঝতে দেয় না। সে যেমন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করে থাকে তেমনি করার চেষ্টা করছে। এবং এটা যে হচ্ছে, ওর ধারণা, রসুল মনোরমা আর অসিত বাদে পৃথিবীর আর কেউ জানে না। সে ভাবল, কোনোরকমে গাড়ি করে অপরিচিত জায়গায় চলে যেতে পারলে এতটা ভয় থাকবে না। কারণ ওর মনে হচ্ছে, এই বাড়ির যেখানে সে থাকুক না, ওরা ঠিক টের পেয়ে যায়। যেন ওরা চারপাশে ওর সতর্ক নজর রেখেছে, সে কী করছে। সে আর মুহূর্ত দেরি করল না। লাফিয়ে কাঠের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে গিয়ে দেখল, সোমা খুব সাধারণ পোশাকে নেমে যাচ্ছে। মনীষকে বলার পর্যন্ত সময় দিল না, যেন কতকটা সে পালিয়ে চলে যাচ্ছে।
মনীষ এবার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ডাকল, সোমা।
নিচ থেকে সোমা বলল, বিনুর কাছে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হলে ভাববে না।
সোমা গ্যারেজের ভিতর ঢুকে গেল। গাড়ি বের করার শব্দ হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো গাড়িটা নিয়ে বের হচ্ছে। বের না হলেই যেন খারাপ হত। সে ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে থাকল। সকালের কাগজে কী আছে আজ, বাড়িতে সবাই ওকে কাগজ পড়তে দিচ্ছে না। নিশ্চয়ই সোমা কাগজ লুকিয়ে রেখে গেছে। আজকে কী ঘটেছে, অথবা এ—ভাবে অকারণ হত্যা, অথবা কোথাও কি মানুষ রুখে দাঁড়াচ্ছে না, এমন খবর কি কোথাও নেই—সে কেবল তেমন একটা খবরই দেখতে চায়। চারপাশের জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে না, এ—ভাবে একজন সাধারণ পুলিশ, সাধারণ সুদখোরের জীবন নিয়ে কী যে হচ্ছে, অথবা ওর কথাই ধরা যাক না, সে তো সবই নিজে নিয়ে নিচ্ছে না, সবই তো যারা কাজ করে তাদের জন্য, তা বলে একটা লাভের অঙ্ক থাকবে না, ক্যাপিটেল তৈরি হবে কী করে, ক্যাপিটেল তৈরি না হলে নতুন নতুন কারখানা হবে কী করে, বেশি লোক কাজ পাবে কী করে।
গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে নিচ্ছে সোমা। ডিমের মতো গাড়ির আকার। সাদা, ডিমের মতো রঙ, রঙ কখনও মলিন হয় না। অনেক চেষ্টার পর সে গাড়িটা পেয়েছে। অথবা দাম অনেক বেশি দিয়েছে, তবু সোমা যখন এ গাড়িটা চড়ে সুখ পায় তখন আর টাকার দুঃখ থাকে না। গাড়িটা অর্ধেক দামে কেনা যেত। এত বেশি মাঝখানে দালাল পড়ে গেল যে সবার মুখ বন্ধ করার জন্য সে টাকার মায়া করেনি। এবং এ—গাড়িটায় চড়ে কোনো রাস্তায় বের হলে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষেরা গাড়িটার ভিতর আছে সহজেই মানুষেরা ভেবে ফেলতে পারে। সে এটা অস্বীকার করে না, সে নানাভাবে রাজার মতো যখন বেঁচে ছিল, তখন এক অতীব বিষাক্ত কীটের উপদ্রব। একটা জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। ওকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। সে এমন শক্ত মানুষ, তাকে কীভাবে যে দুর্বল করে ফেলেছে!
সোমা বের হয়ে গেল। গেট খুলে যাচ্ছে। সোমা, হাত নাড়ল, এটা সোমার স্বভাব। সোমা পথের ওপরে পড়েই সাঁ সাঁ করে বের হয়ে গেল। এবং মনীষ দেখল, এসময় সে ভীষণ একা, এবং ঘরের ভিতর ঢুকতে পর্যন্ত ভয় করছে। ঘর ফাঁকা পেয়ে যদি কেউ পাঁচিল বেয়ে উঠে এসে থাকে। ব্যালকনি থেকে সে নড়তে পারল না। সে এই শীতেও ঘামছে। ভিতরে ঢুকেও যদি দেখে কেউ চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে!
সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেবার চেষ্টা করছে। প্রথমে সে মৃত্যু একটি অতি সহজ ঘটনা, সে, যে—কোনো মুহূর্তে আসতে পারে। সে তারপর ভাবল, ভাগ্য। ভাগ্যে লেখা থাকলে ঘটবে। কেউ রুখতে পারবে না। তারপরই ভাবল, সে কী যা তা ভাবছে। ভাগ্য আবার কী! সে তো এতদিন সোমাকে বুঝিয়েছে, পুরুষকার। সে তার বুদ্ধি এবং কৌশলের দ্বারা এমন এক অপূর্ব মণি—কাঞ্চনের ব্যবস্থা করেছে। সবাই পারে না। সবাই সে—জন্য গাড়িও চড়তে পারে না। সবার গাড়ি চড়া ঠিক না। সবাই গাড়ি চড়লে কাজ করবে কে। পৃথিবীতে কাজের লোক না থাকলে মণি—কাঞ্চন সংগ্রহ হয় না।
তারপরই মনে হল, এসবও ওর ভাবার কথা না। সে সাহসের সঙ্গে সবকিছুর সম্মুখীন হবে ভাবল। সে এক পা এগোচ্ছে আর সাহস কথাটা ভাবছে। সাহস কথাটা ওর কাছে আশ্চর্য একটি শব্দ মনে হচ্ছে। সাহস কথাটার ভিতর খুব বড় একটা ব্যাপার আছে। না হলে এমন সামান্য শব্দ, যা সে ভাবত, এমন কিছু না, এখন তাকে একেবারে গলা শুকিয়ে দিচ্ছে। সে এবার যেন না ডেকে পারল না, মনোরমা! সে ডাকল, রসুল। কেউ সাড়া দিচ্ছে না। ওরা কি কেউ নেই! সে ডাকল, রাম অবতার। না, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। সে করিডোরে ঢুকে গেল। ওর পা এগুচ্ছে না। দুপাশে দেয়ালে সব ছবি। নানাবর্ণের ছবি। সে ছবির এগজিবিশান হলেই ভালো ভালো ছবি কিনে ফেলে। একটা ইঁদুরকে ঈগলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, অথবা কোনো বনের ভিতর র্যাটেল সাপের ভয়ংকর মূর্তি, এসব মিলে সে ভাবল, আর ঢোকা যাবে না। ভিতরে কী আছে কে জানে!
তখনই মনীষ অবাক হয়ে গেল ভেবে, সারা বাড়িটা এ—ভাবে কখনও কখনও ভূতুড়ে হয়ে যায়। সে মরে যাবে ভাবতেই কী আশ্চর্য, এ বাড়ির চারপাশে যেন এক অতিকায় নৈঃশব্দ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় মোটরের হর্ন, মানুষজন এত, তবু মনে হচ্ছে, এখানে কিছুক্ষণের ভিতরই এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটবে। সে দ্রুত সিঁড়ি ধরে নেমে বলল, কৈ হায়।
জি হুজুর।
কেউ রয়েছে?
কোথায় হুজুর?
এই দ্যাখো তো বাগানের দিকে।
রাম অবতার বাগানের চারপাশে ঘুরে এসে বলল, কৈ, না।
মনীষ বলল, রসুল কাঁহা?
রসুল! রসুল কাহারে! হুজুর বলাতা হ।
রসুল এলে মনীষ বলল, এসো।
সে রসুলকে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকল। রসুল কখনোই এত ভিতরে ঢুকতে পারে না। সে দেখে অবাক, মানুষেরা এ ভাবে বাঁচে! বেহেস্তের শামিল। তিনি ভিতরে খুট খুট করে কী করছেন। এবং কিছুক্ষণের ভিতর বের হয়ে এলে রসুল বুঝতে পারল, হুজুর কোথাও বের হচ্ছে। মনীষ একটা চাবি ওকে ছুড়ে দিল। এবং সে নিচে নেমে যখন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে গেল, মনে হল মুক্তি। এত বড় মুক্তি সে কখনও পাবে ভাবেনি। তাকে এখন কেউ চেনে না। যেন একটা বড় বাড়ির ভিতরই তাকে চেনা যায়, তার নাম মনীষ দত্ত। হবু ক্যাপিটালিস্ট। হবু ক্যাপিটালিস্টদের ওরা বোধহয় বেশি খুঁজছে। সে প্রায় পালাবার মতো গাড়ি নিয়ে এ—গলি সে—গলি করে যেন তাকে কেউ ফলো করতে না পারে, এবং সে এ—ভাবে কখন কোথায় কোথায় কীভাবে সে ঘুরে ঘুরে শান্তিবাবুর ফ্ল্যাটে কড়া নাড়ল, নিজেও বলতে পারল না। যখন শান্তিবাবু দরজা খুলে দিলেন, সে দেখতে পেল দেয়াল ঘড়িতে এগোরোটা বাজে। সে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল সাতটায়। শান্তিবাবুর বাড়ি পৌঁছাতে খুব বেশি চল্লিশ মিনিট। বাকি সময় ভয়ে সে কেবল একটা ইঁদুরের মতো এ—গলি সে—গলি করেছে।