দুঃস্বপ্ন – তিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল, সোমা বিছানাতে নেই। সোমার ঘুম থেকে বেলায় ওঠার স্বভাব। মনীষ ঘুম থেকে উঠে একবার চা খেয়ে নেয়। তখনও সোমা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। ওর সুন্দর পা বিছানার ওপর খালি। গাউন ওপরে উঠে থাকে। এ—ঘরে কেউ আসবার যেহেতু নিয়ম নেই, মনীষ ইচ্ছা করেই গাউন টেনে নামিয়ে দেয় না। সে ধীরে ধীরে চায়ের কাপ নিয়ে এ—ঘরে ঢুকে যায়, চা খায়। এবং পায়চারি করতে করতে সোমার অস্বাভাবিক সুন্দর সুঠাম শরীর দেখতে দেখতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। আজ সে দেখল বিছানা খালি। এত তাড়াতাড়ি উঠে যাওয়ায়, বাথরুমে গেছে সে এমন ভাবল। সে ডাকল, সোমা আছ? কোনো সাড়া সে পাচ্ছে না।
সে বাইরে এসে দেখল সোমা একটা ইজিচেয়ারে মোটা একটা র্যাপার জড়িয়ে বসে আছে। সব শরীর ঢাকা। শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। হলুদ রঙের স্কার্ফ। করুণ শীতার্ত চোখ—মুখ তার। মনীষকে দেখেও সে এতটুকু নড়ে বসল না। প্রায় স্থির পাথরের মূর্তির মতো। যেন কেউ এই সকালে বারান্দার দেয়ালে সুন্দর এই শীতার্ত ছবি এঁকে দিয়ে গেছে। চোখের নিচে ঘুম না যাবার চিহ্ন। ক্লান্ত চোখ—মুখ। সে বলল, তোমার ঠান্ডা লাগবে সোমা।
সোমা কেমন ওম শব্দ করে ফের নিরুত্তর থাকল। মনীষ কেন যে ভীষণ ক্ষেপে গেল, সে বলে উঠল, কী বলছি শুনতে পাচ্ছ? বলছি ভিতরে যাও। ঠান্ডা লাগিয়ে অসুখ বাধাবে।
যেন দেয়ালের ছবি মুহূর্তে জ্ঞান পেয়ে ওর দিকে চোখ তুলে তাকাল। কী বলছে শোনার চেষ্টা করল, তারপর ফের ঘুম গেল দেয়ালে। সোমা চোখ নামিয়ে নিল।
মনীষ বুঝল এবার ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার। এভাবে ব্যাপারটাকে চাপা দিলে চলবে না। সে ফোন করল, অসিত আছিস?
কে?
আমি মনীষ।
মনীষ দত্ত? কী ভাগ্য! সহসা গরিবের এত্তালা?
শোন, তুই সকালে ফ্রি আছিস?
কেন, কী হয়েছে?
আছিস কিনা বল?
নেই। তবে তুমি বললে করে নিতে হবে।
একটু আমার বাড়িতে আসবি? সোমাকে একটু দেখবি?
কী হয়েছে ওর?
ফোনে সব বলা যাবে না। এলে জানতে পারবি।
সোমা কান খাড়া করে শুনছিল। মনীষ ওকে জোর করে কিছু করতে চায়। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। মনীষ ডাক্তার ডাকছে। আমার কিছু হয়নি মনীষকে এমন বলতে চাইল। কিন্তু বললে কে শুনছে? সে রাতে ঘুমোতে পারেনি। সে এখানে এসে এই শীতের রাতে কেমন কষ্ট অনুভব করতে চেয়েছে। যেন এই যে চারপাশে এত দীন দুঃখী মানুষ সারারাত ফুটপাথে কাটায়, এই যে গ্রামে মাঠে মানুষ অন্নহীন বস্ত্রহীন দুঃখী, সে দুঃখী মানুষের মতো থাকতে চায়। সে তার মুখ দেখার পর চোখ দেখার পর এমন করতে ভালোবাসে।
আর আশ্চর্য, অসিত এলে সোমা তাকেই বলল, আসুন। কী ব্যাপার, এদিকে পথ ভুল করে?
মনীষ এমন স্বাভাবিক চেহারা সোমার আশাই করতে পারেনি। শুধু চোখে—মুখে রাতের না ঘুমোনোর কষ্টকর ছবি। সে সিনেমাতে যে সোমাকে নিয়ে গিয়েছিল এ ঠিক সেই সোমা।
সোমা অনুযোগ করল, আজকাল আর এদিকে একেবারেই আসেন না।
অসিতের চোখ ট্যারচা হয়ে গেল। তবু সে ডাক্তার। অনেক সময় রুগির স্বাভাবিক কাজকর্মের ভিতরই অনিয়ম থাকে, শৃঙ্খলা থাকে না। আপাত মনে হবে সবই ঠিক, অথচ একটু খুঁটিয়ে দেখলে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, না, গোলমাল আছে। সে বসল।
সোমা বলল, কফি না চা? হট না কোল্ড? কী চাই?
অসিত বলল, হট।
সোমা বলল, আজকাল হটই পছন্দ সবার। যা দিনকাল পড়েছে।
অসিত বলল, আজ আমাদের হাসপাতালে চারজন এসেছে।
সবাই বেঁচে আছে তো?
একজন বাদে সবাই টেঁসে গেছে।
কীরকম বয়স?
এই পনেরো থেকে কুড়ি!
আহা রে! কার মার সন্তান!
অসিত সোমার মুখ দেখল। সোমা উঠে গেলে মনীষকে বলল, কিরে, বাপ হবার চেষ্টা করছিস না?
করছি তো। কিন্তু কিছুতেই পা মাড়াচ্ছে না। সব অনিয়ম হতে পারে, কিন্তু ট্যাবলেটটি খেতে ভুলবে না।
আমার তো কিছু খারাপ লাগছে না, কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
মনীষ গত রাতের ঘটনা সোমার অজ্ঞাতে বললে অসিতকে কেমন চিন্তিত দেখাল।
সোমা এসে দেখল দুই বন্ধু মুখ ভার করে বসে আছে। সোমা বুঝতে পারল মনীষ সব বলেছে। সে হেসে দিল ওদের মুখ দেখে।—কী হল আপনাদের? চুপচাপ?
অসিত তাকাল সোমার দিকে। সোমা আবার হেসে দিল। আপনারা ভাবছেন কী জানি কী হয়ে গেল। কিচ্ছু হয়নি। কাল কফি হাউসে আমার খুব পরিচিত একজন মানুষকে দেখলাম। অথচ চিনতে পারলাম না। এখনও মনে করতে পারছি না। কেবল এটুকু মনে পড়ছে আমি যা হতে চেয়েছিলাম পারিনি।
মনীষ বলল, দ্যাখো সোমা, ছেলেবেলায় আমরা অনেক কিছু ভাবি। ছেলেরা সবাই বিদ্যাসাগর হতে চায়। আর মেয়েরা ভগবতী দেবী। কিন্তু কী জান, যত বড় হই তত দেখি এমন সমাজ—জীবনে আমরা বড় হয়ে উঠেছি, যেখানে কেউ আর ইচ্ছে করলেই সেটা হতে পারে না! বলে সে প্রায় ব্যাখ্যা করার মতো বলল, এই যে ধর যদি আমি চাইতাম বিদ্যাসাগর হব, কিংবা তোমার কোনো পরিচিত বন্ধু বিনুর কথাই ধর, সে তো কম সৎ ছেলে নয়, আমি ওকে জানি, কিন্তু বেচারা কী করবে, টাকার জন্য বস্তাপচা নোট লিখছে এখন। সে জানে এতে প্রকৃত শিক্ষা হয় না, কিন্তু ওর এতবড় সংসারে কে সাহায্য করবে? ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়ালে তোমরা ওকে আর চিনতেই পারবে না। আমাদের সবারই এখন ভয়—কাল ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াব। ন্যায় অন্যায় বুঝছি না, যা পারছি সংগ্রহ করে ব্যাঙ্কে জমা রাখছি।
সোমা খুব মন দিয়ে শুনল। তুমি আজকাল ভালো কথাও শিখে গেছ মনীষ! একেবারে নেতাগোছের মানুষের মতো একটা বক্তৃতা করে ফেললে।
বক্তৃতা নয়। তোমাকে তো আমি জানি। তোমাকে আমি এ—সব কথা ক্লাস করার ফাঁকে ফাঁকেও বলতে শুনেছি। ফুটপাথে অথবা কোনো গ্রামে—গঞ্জে মানুষের অপমান দেখলেই তুমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে, বলতে এসব আর দেখা যায় না চোখে। সব ভেঙে ফেলা দরকার।
অসিত এসেছে ডাক্তারি করতে। এখন সে বুঝতে পারছে না কে রোগী। মনীষ না সোমা। সোমার মুখ হাসিতে সব সময় সপ্রতিভ। সে এতটুকু রাগছে না। মনীষ কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। এবারে অসিত নিজেই সোমার মুখে গোটা ঘটনাটা জানতে চাইল—কাল কী হয়েছে আপনাদের!
কিছুই হয়নি। কেবল আমি ভাবছিলাম ওকে আমি কোথায় দেখেছি।
মনে করতে পারছেন না?
না।
তার জন্য ভাবনার কী আছে।
আমি তো তাই বলছি ওকে।
সময় সময় মানুষের এটা হয়। খুব একটা প্রিয় ঘটনা, যা জীবনে সবচেয়ে মনে বেশি থাকার কথা, সেই ঘটনার নায়ক সামনে হাজির হলে, সাময়িক স্মৃতিবিভ্রম হয়। পরে সেটা আস্তে আস্তে কেটে যায় এবং যখন সব মনে পড়বে, তখন অদ্ভুত হাসি পাবে। আরে, এমন ঘটনা জীবনে ঘটেছে তা বেমালুম ভুলে গেছি। বলে সে সোমার দিকে তাকাল। এ নিয়ে বেশি ভাববেন না।
আমি আদৌ ভাবছি না। যে ভাবছে তাকে বলুন।
মনীষ কেমন হতাশার চোখে দেখল সোমাকে। এই যুবতীকে সে এত ভালোবাসে! ওর এতটুকু কিছু হলে ওর ঘুম আসে না। আর কাল সোমা যা দেখে রাতে ঘুমোল না ভাবলে ভিতরটা আগুন হয়ে যাচ্ছে। সে আধুনিক ছেলে। সে মেয়েদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবু এমন একজন রূপবান ছেলেকে সে চিনতে পারছে না, সে যে বলতে পারছে না, এই মুহূর্তে তার বিশ্বাস করতে কেন জানি কষ্ট হচ্ছে। সোমা ইচ্ছা করেই সব গোপন রাখছে। সে যখন এমন সুন্দরী, তখন তার কৈশোরে কেউ পাশাপাশি হেঁটে আসেনি, কেবল সে—ই ওকে ধরে নিয়ে এসেছে অথবা জয় করেছে —ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল।
সে বলল, সোমা আমার ঘাট হয়েছে। কিন্তু অসিত তুই জানিস, সকালে বের হয়ে দেখি শীতের বারান্দায় একটা সামান্য র্যাপার জড়িয়ে বসে রয়েছে। ডাকছি হুঁশ নেই।
সোমা বলল, ওটা কিছু না। তুমি তো জানো মনীষ, বাবা আমাদের জন্য তেমন কিছু রেখে যাননি। মা খুব অনটনের ভিতর আমাকে সেই টাকাতেই মানুষ করেছেন। আমি সুন্দরী ছিলাম। কী অসিতবাবু এ—ব্যাপারে আপনার কী মত?
আপনি এখনও দেবীর মতো।
তা হলে বুঝতে পারছ মনীষ, দূরের পথ হাঁটতে গেলে কিছু হোঁচট খেতেই হয়। আর রূপবতী হলে তো কথাই নেই।
এখানেই অসিতের একটু গোলমাল ঠেকল। তৃতীয় ব্যক্তির সামনে সোমা কেমন বেআব্রু হয়ে যাচ্ছে। সে অন্যদিকে কথা টানার জন্য বলল, দেখলে তো মনীষ, বাংলাকে সন্তোষ ট্রফি থেকে কেমন জোর করে হারিয়ে দিল।
মনীষের এ—সব শুনতে ভালো লাগছে না। সে শুধু বলল, অসিত, তুই আয়।
অসিত বলল, তা হলে আসি।
সোমা বলল, কফি হচ্ছে।
আর একদিন হলে হয় না?
যা দিনকাল পড়ছে, আর একদিন যে আসতেই পারবেন ঠিক কি?
মনীষ কিছু বলছে না। নিজের এই আহাম্মুকির জন্য কেমন সে এবার নিজের ওপরই ক্ষেপে গেল। বলল, তোরা বোস, আমি আসছি।
তুমি গেলে চলবে কী করে? তুমি বোস।
মনীষ সোমাকে কেন যে চটাতে ভয় পায়। সে বসে পড়ল।
আজকাল এটা ওর হয়েছে অসিতবাবু। খুব সহজে চটে যায়। ভেঙে পড়ে। কিছুই ধৈর্য ধরে শুনতে চায় না।
অসিত বলল, দেশের যা অবস্থা, খুব ধৈর্য ধরে না শুনলে যে চলবে না।
মনীষ বলল, তাই বলে কি মানুষ দিনদুপুরে হত্যা করবে? বিচার থাকবে না? অসিত বলল, আজকাল বুঝি এসব খুনোখুনির ব্যাপার আপনাদের খুব হন্ট করছে? বলে সে সোমার দিকে তাকাল।
আমাকে করছে না।
কেন করছে না? মনীষ এবার উত্তেজিত হয়ে পড়ল। রক্তমাংসের শরীর হলে না করে পারে?
কী করব! বল তোমাকে এ—ব্যাপারে অনেক কথা বলতে পারি। তবে বলব না। অসিতবাবু এসেছেন, বলা ঠিক হবে না।
সোমা আর কোনো কথা বলতে চাইল না। সে কফির পট থেকে লিকার ঢেলে অসিতের দিকে তাকাল। বলল, পাতলা না ঘন? দুধ কম বেশি। চিনি দেব, না দেব না?
অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন এখন অসিত। সে বলল, আমি আজকাল সবরকমের খেতে অভ্যস্ত। যা দেবেন। তারপর সে মনীষের দিকে তাকিয়ে বলল, গিন্নি কি তার লেফট—মাইন্ডেড?
কী জানি ভাই, কী মাইন্ডেড সে—ই জানে। নারী—চরিত্র দেবতারা শুনেছি বুঝতে পারে না। আর শালা আমি তো মনুষ্য—জাতির অযোগ্য। হবু ক্যাপিটালিস্ট।
সোমা বলল, তুমি সব ব্যাপারে নিজেকে টান কেন?
টানব না? তুমি এমন এক—একটা ব্যাপার করবে যে মনে হবে সব বুঝি গেল। আমার ভাবনার অন্ত থাকে না। কী করতে যে শখ করে পুরনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম!
পুরোপুরি হয়ে গেলে তোমার এসব আর থাকবে না।
তার মানে?
মানে তখন দেখবে তোমার সময়ই হবে না বউ কোথায় থাকছে, কী করছে।
তোমাকে আজ জার্মানি, কাল আমেরিকা। বউ এদিকে পার্টি দিচ্ছে, পার্টি করছে। এখনও হওনি। চুনোপুঁটি হলেও না হয় কথা ছিল।
অসিত চাইছে না সোমার এসব উক্তি ওর সামনে হোক। কিন্তু সোমার দিকে তাকিয়ে বুঝল, সোমা আদৌই মাইন্ড করছে না। এ—সব কথা ঘরের সে তা আদৌই ভাবছে না। কোথায় যেন একটা অসীম দুঃখ আছে, সোমা তার বদলা সুদে—আসলে নিতে চায়। সেটা কি নিজের কাছে? সে কী বলছে, তুমি বড় ভুল করেছ সোমা, তুমি কিছু কিছু সৎ ব্যাপার এ—পৃথিবীতে আশা করেছিলে। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখছ আর্থিক অনটন তোমাদের সংসারকে কীভাবে তছনছ করে দিয়েছিল? তুমি বলেছিলে সবাইকে, তোমার বাবা মারা যাবার আগে কিছু ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স রেখে গেছেন। তোমার মা—ও তোমাকে এমন বলেছে। তুমিও সবাইকে এমন সব বলেছ। কিন্তু তুমি বড় হতে গিয়ে জানতে পারলে, এই অর্থ মা তোমার কীভাবে আনছেন। তোমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। মানুষের ওপর বিশ্বাস তোমার হারিয়ে গেল। তখন তুমি একজন মানুষকে মনে মনে খুঁজছিলে। সে থাকলে কিংবা তাকে পেলে তুমি হয়তো আর তোমার বিশ্বাসকে এমনভাবে বিসর্জন দিতে পারতে না। সমাজকে বদলে দেবার শপথ নিয়ে তুমিও হয়তো বের হয়ে পড়তে।
আচ্ছা, সোমা, তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি কি ওকে সত্যি চিনতে পারনি?
না। চিনতে পারিনি। মিথ্যা বলে লাভ নেই।
মনীষের চিৎকার করে বলার ইচ্ছা—তোমার পূর্বপ্রণয়ী। আমি ঠিক জানি। তুমি আমার কাছে সব গোপন করছ।
সোমা মনীষের মুখ—চোখ দেখে বুঝতে পারল, মনীষ এ—ব্যাপারে সেন্টিমেন্টে ভুগছে। সে বলল, অসিতবাবু, মানুষটা কে আমার নিশ্চয়ই মনে পড়বে। আমি আজ তাকে আবিষ্কারের জন্য সারাদিন ভাবব। তবে দোহাই আপনাদের, আমার কোনো অসুখ আছে ভাববেন না। অসুখটা মনীষের। ওর টাকা করার বাতিক। একের পিছনে সে পর পর কেবল শূন্য বসিয়ে যেতে চায়। এটা মানুষের বড় রোগ। এ—রোগে পেলে মানুষ তার মায়া—মমতা হারিয়ে ফেলে। সমাজের যা কিছু সুন্দর সে হরণ করে নিতে চায়। চারপাশে এত কদর্য জীবনযাপন, সে চোখে কিছুতেই তখন তা দেখতে পায় না।
অসিত উঠে গেলে সোমা কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে থাকল। তার কোনো কোলাহল যেন ভালো লাগছে না। এমনকি মনীষকেও তার ভালো লাগছে না। সে চোখ বুজে থাকলে টুকরো টুকরো ঘটনা মনে করতে পারে। একা ব্যালকনিতে পায়চারি করলে বাবার মুখ মনে করতে পারে। কী নিরীহ ছিল তার বাবা। সামান্য তার প্রত্যাশা। সে তার স্ত্রী এবং কন্যাকে সামান্য সুখে রাখার জন্য যৎকিঞ্চিৎ অর্থ এদিক—ওদিক থেকে রোজগারের চেষ্টা করত।
বাবা সামান্য কেরানি। জেলা অফিসে সে টেন্ডার ফাঁস করে কিছু অধিক রোজগার করত।
সোমা বাবার মুখ এ—সময় আর ভাবতে পারল না। কারণ বাবা তার কাছে সব সময়ই নিরীহ মানুষ। বাবার আত্মহত্যার পর এ—সব খবর যেন কানাঘুষা শুনেছে। তার এখনও বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সে জানে, সমাজে যারাই আছে, তারা এটা না করে বাঁচতে পারছে না। বাবাও পারেননি। সে তার বাবাকে এজন্য সব সময়ই ক্ষমা করে দেয়। তার বাবা মাঝে মাঝে তার জন্য তেলেভাজা কিনে আনত। বাবা এবং সে, মাকে গোপন করে কতদিন তেলেভাজা খেয়েছে। মা দেখলে বড় রাগ করত।
যেন চোখ বুজেই বলল, বাবা তুমি বড় বোকা। যে লোকটার হয়ে এসব করতে, সে কিন্তু বড় মান্য ব্যক্তি সমাজের। সে মাকে এখনও ভালো মাসোহারা দেয়। এটা ওর কী বদান্যতা! মাকে এত বলেও সোমা মাসোহারা নিতে বন্ধ করাতে পারেনি। মা—র এক কথা—এমন দুর্দিনে তিনি আমাদের দেখেছেন।
যত সে বড় হচ্ছে তত মনে হচ্ছে সংসারে তার মা—ও এক পাপে লিপ্ত। সে জানে না, কী যে যথার্থ কারণ। প্রথম যেদিন সে জেনেছিল, বাবার ব্যাঙ্কে কোনো ব্যালেন্সই নেই, বাবা সব তেলেভাজা খেয়ে উড়িয়ে গেছেন, এবং এই টাকা এক মহামান্য ব্যক্তির, তখন সোমার কী যে ঘৃণা হয়েছিল মায়ের ওপর! কিন্তু মা—র চোখমুখ দেখে সে কিছু বলতে পারেনি! মা—র মুখে বড় বিষণ্ণতা ছিল সেদিন। কার জন্য আমি এটা করেছি সোমা? তোর জন্য। আমার আর কী আছে! তোর বাবার বড় ইচ্ছা ছিল তুই বড় হবি। লেখাপড়া শিখবি। তোর বাবা বি.এ. পাস ছিল না। তুই বি.এ. পাস করবি। তোর বাবা থাকলে আজ কী যে তিনি সুখী হতেন।
সোমার ভাবলে অবাক লাগে তার বাবা টিপিক্যাল ছাপোষা মানুষ ছিলেন।
সোমা এখন উঠবে ভাবল। রসুলকে গাড়ি বের করতে বলল। সে অযথা ঘুরবে আজ। সে মনীষকে বলল, আমি একটু বের হচ্ছি মনীষ।
মনীষ তার ঘরে বসে কিছু ফাইলপত্র দেখছিল। আর একটু বেলা বাড়লেই অফিসের বড়বাবু এসে মনীষকে কী বোঝাবে। তখন সোমার সারা বাড়িটার ওপর রাগ হয়। সংসারে একমাত্র মানুষটার টাকা বাদে অন্য চিন্তা নেই। সে সেই বড়বাবুকে দেখলেই বলবে, আপনাদের কী বাজার—টাজার করতে হয় না? সকালে এসে সারাক্ষণ কী যে এত আপনাদের কাজ। বলার পরই মনে হয় সে মনীষের বউ। মনীষ এ—ব্যাপারে রাগ করতে পারে। তার অযথা কথা বলা উচিত হচ্ছে না। সে একেবারে চুপ করে যায়।
এই সকালে কোথায় যাবে?
একটু গঙ্গার ধারে যাব।
মনীষ চাবিটা ছুঁড়ে দিল সোমাকে।—কখন ফিরবে?
তোমার অফিসের আগেই ফিরব।
সোমা গাড়ি নিয়ে বের হয়ে দেখল চারপাশে শীতের রোদ। রাস্তায় এখনও ভিড় বাড়েনি। সে যে কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। একবার ভাবল কাল সে যেখানে ওকে দেখেছিল, সেখানে যাবে। সে যদি আবার আসে।
সোমা খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে। আঁচল পড়ে যাচ্ছিল, সে সেটা গুঁজে দিল। হালকা রোদের ভিতর নীল রঙের গাড়ি, সোমা লাল সিল্ক পরেছে। পায়ে আলতা। সে চোখে আজ কাজল দিয়েছে। এই প্রথম সে কাজল দিয়েছে। সেই কত কাল আগে কাকে যেন জীবন থেকে সে হারিয়ে ফেলেছিল। সে বুঝি আবার ফিরে এসেছে। সে তাকে আজ খুঁজে বের করতে যাচ্ছে।
সোমার মাঝে মাঝে নানা দৃশ্য মনে আসে। মানুষটা কী অনিমাসির ভাশুরপো সমর? সমর কী এত সুন্দর ছিল? সে সমরকে বেশিদিন দেখেনি। মাত্র বিয়ের ক’দিন দেখেছে। সে নানাভাবে তাকে দেখল, সমর সুন্দর ছিল না। ভ্রূ সমরের এত টানা নয়। সে এ—ভাবে তাকাতে জানে না। সুতরাং সে কেন হবে। সে হলে ওর সঙ্গে উঠে দেখা করে যেত। এ—সুসময়ে আমাদের কথা তোমার মনে হয় তো? সে এ—সব জিজ্ঞাসা করত।
অনিমাসির মেয়ের বিয়ের দিনের কথা। জলি ওর বয়সি। অনিমাসি বারবার বলে গেছে, তুই যাবি সোমা। তুই না গেলে জলি খুব দুঃখ পাবে। সোমা তখন অনার্স নিয়ে পড়ছে। কোথাও কেউ যেতে বললে ওর বড় ভালো লাগে। সে যে সোমা দত্ত, তখন অবশ্য দত্ত ছিল না সে, গাঙ্গুলি, সে সুন্দর করে শাড়ি পরতে জানে, খোঁপা বাঁধতে পারে, চোখে কাজল না দিলেও মনে হয় কাজল দিয়েছে, আর তা ছাড়া প্রথম সে কলেজে ঢুকেছে, আবার তার অনার্স আছে, সে ভালো ছাত্রী, নাম—ডাক, সে যে কত ভালো এবং মেধাবী, কান পাতলে ফিসফিস কথায় সে যেন তা টের পায়।
সোমার মনে হত তখন সে আছে বলেই চারপাশে এত হাসি গান আনন্দ। সে ভালোভাবে তাকাতে পারে না চোখ চুলে। তাকালেই চোখে চোখ পড়ে যায়। সব যুবকেরা তার চারপাশে যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে। সে হাত তুলে দিলে সব সারি সারি যুবকের মিছিল, সামান্য তৃষ্ণার জল পান করবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
সে গিয়েছিল সকালে। তখন অনিমাসি ছাদের ঘরে ভাঁড়ার সামলাচ্ছে। বোধহয় সেটা ফাল্গুন মাস ছিল। ফাল্গুন মাসই হবে। কারণ তখন আকাশ বড় পরিষ্কার ছিল। খুবই পরিষ্কার। সে, সমর, এবং আরও চার—পাঁচজন যুবক ছাদে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে নক্ষত্র গুনত। কে ক’টা নক্ষত্র নির্ভুলভাবে গুনতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলত। সবাই পরস্পরের সততায় বিশ্বাস করত। সোমা বারবার গুনতে গিয়ে দেখছে সে ঠিকমতো গুনে যেতে পারে না। আকাশে এত নক্ষত্র, সে গুনবে কী করে! একদিক থেকে একটা দুটো পাঁচটা গুনলেই মনে হয় ভিতরে অজস্র নক্ষত্র রয়ে গেছে তার গোনা হয়নি। সে বলেছিল, না সমর, আমি গুনতে পারছি না।
সমর বলেছিল, যা, গুণতে পারবে না কেন? সবাই সব গুনতে পারে।
তুমি পার সমর?
পারি।
কত নক্ষত্র আকাশে বল?
দু হাজার তিনশো ছত্রিশ।
গুল।
গুল না সোমা। আমার আকাশে দু হাজার তিনশো ছত্রিশই আছে। যারা বাদ গেছে তারা আমার আকাশে নেই।
সোমা বলেছিল, তুমি বড় গুল মারতে পার সমর। আমার গুল মারতে ভালো লাগে না।
তুমি তবু গুল বলছ!
বলব না?
বলা উচিত না সোমা। কারণ—
কী কারণ? ছাদের ওপর সোমা আলগা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে আকাশ দেখছে। সমরের মুখ দেখে মনে হয়েছে সত্যি বুঝি আকাশের নক্ষত্র গোনা যায়। সে বলল, আমি যে পারছি না সমর। ক’টা গুনেই দেখছি তার চারপাশে অজস্র, আবার গুনতে গেলে দেখছি তার ভিতর আরও অজস্র। আমি গুনে শেষ করতে পারছি না, হাঁপিয়ে উঠছি।
বোকা। ও—ভাবে কী কেউ আকাশের তারা গুণে শেষ করতে পারে! বলে সমর ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি গুনছি তোমার হয়ে।
গোনো।
সে গুনতে থাকল। খুব সন্তর্পণে যেন সে গুনছে। একেবারে নিবিষ্ট মনে। আর যারা ছিল, তারা একে একে নেমে গেছে। আকাশে ওদের তারা গোনা বুঝি শেষ। কেবল বাকি সোমার। সোমারটা হয়ে গেলেই সমর নেমে যাবে।
সোমা নিশ্বাস বন্ধ করে প্রায় তাকিয়ে ছিল সমরের দিকে। সে গুনে কত নক্ষত্র বলবে সেই আশায়। নিশ্চয়ই বলবে সেই দু হাজার তিনশো ছত্রিশ। কিন্তু যখন বলল তখন দেখা গেল মাত্র একটা বলছে সমর, মাত্র একটা নক্ষত্র আকাশে!
কী বাজে বকছ?
হ্যাঁ ঠিক বলছি সোমা। তোমার আকাশে একটাই নক্ষত্র।
সোমা হেসে দিয়েছিল, বলেছিল, থাক মশাই, আপনাকে আর নক্ষত্র গুনতে হবে না। নিচে চলুন। বর এসে গেছে। এ—ভাবে দুজনকে ছাদে দেখে ফেললে নির্ঘাত প্রেম করছি ভাববে।
সমর এতবেশি স্মার্ট কথাবার্তা আশা করেনি। সে বলেছিল, তাহলে মেয়েরা প্রেম—ফেম করে আজকাল?
মেয়েরা করে না তো ছেলেরা করে?
কারা যে কী করে সোমা বুঝি না। তবে সত্যি বলতে কি, তোমাকে দেখলে প্রেম না করে পারা যায় না। কেবল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
আর আমার তখন ইষ্টনাম জপতে ইচ্ছা হয়।
কিছু ইচ্ছা—টিচ্ছা হয় না সোমা?
হবে না কেন? সবই হয়।
আমারও যে কী ইচ্ছা হয়! হলে পরে ভালো লাগে না! একা দাঁড়িয়ে তখন নক্ষত্র গুনি। তবে কী জান, আমার আকাশে সব সময় সেই দু হাজার তিনশো ছত্রিশ। কেউ আমার দিকে তাকায় না। বড় কষ্ট হয় সোমা। সমর সত্যি কেমন বলতে বলতে সিরিয়াস হয়ে গেল।
এই রে খেয়েছে। এবারে আর রক্ষা নেই। ঠিক অরণ্যদেবের পাল্লায় পড়ে যাব। সোমার জন্য ঝড় জল, নদী সমুদ্র এবার সাঁতরে পার হয়ে যাবে মানুষটা।
সমর বলেছিল, তা তুমি ঠাট্টা করতে পার। তুমি কী তেল মাখো সোমা?
আমি তেলই মাখি না।
এমন সুন্দর চুল।
চুলে তেল মাখলে আজকাল চুল উঠে যায়।
কেন? কী কারণ?
তোমাকে আমাদের ফার্মে নিয়ে যেতে পারি। কী করে বাংলাদেশে টাকা তৈরি হচ্ছে দেখাতে পারি। ভেবেই তার মনে হল কী যে ভাবছে! সমরকে সে এখন পাবে কোথায়? তার ফার্ম তখন ছিল কোথায়? সে তো তখন বেঙ্গল কেমিক্যালের কী একটা তেল মাখত। এখন সে তেলের নাম মনে করতে পারছে না।
সোমা এবার চারপাশে লক্ষ্য রাখল। মাঝে মাঝে সে এ—ভাবে একা বের হয়। কলকাতার ফুটপাথে এবং গাছের নিচে অথবা গাড়ি বারান্দার নিচে অজস্র দুঃখী মানুষের ছবি দেখতে দেখতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। যেন বাংলাদেশের সব মানুষ চোখ বুজে আছে। এত বড় অসাম্য কারও চোখে পড়ছে না। সে মাঝে মাঝে কোনো যুবতী, হয়তো পাগল কিংবা অভাবে অনটনে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি, ফুটপাথে দেখতে পায়। একা একা হেঁটে যাচ্ছে। গায়ে কোনো জামা—কাপড় নেই। অথবা কোনো কোনো রাতে সে বাড়ি ফেরার সময় দেখে ফুটপাথে উলঙ্গ মানুষ, অথবা এক বৃদ্ধ দীর্ঘদীন না খেতে পেয়ে মরে আছে। সে বাড়ি ফিরেই কেমন চুপচাপ বসে থাকে।
এ—সব দেখলেই সোমার মনে হয়, চুলে যে কোনো তেল মাখে না সেই মানুষটার মুখ উঁকি দেয় মনে! সে কে? সে কেন সহসা এসেছিল সেখানে? সে কেন তাকে এ—ভাবে টানছে? তার তো এখন কোনো অভাব নেই। সে বিরাট প্রাচুর্যের ভিতর দিনযাপন করছে। সময় কাটছে না বলে কোনো মিশনারি কলেজে অধ্যাপনা। গাড়িতে যায়, গাড়ি চালিয়ে নিজে ফিরে আসে। এই যে সে বলে এসেছে অফিসের আগেই সে বাড়ি ফিরবে, ফিরতে সে নাও পারে, তাতে মনীষের কোনো অসুবিধা হবে না, কারণ অফিসে তার কয়েকটা গাড়ি। নিজের নামে কোনো গাড়ি নেই। সে হাত ফাঁকা করে বসে রয়েছে। বড় চালাক মনীষ। এবং সেই মানুষের মুখ মনে পড়লেই সোমার কেন জানি মাঝে মাঝে মনীষকে বড় ধূর্ত মনে হয়।
কই, তুমি বললে না—তো সোমা, কী তেল মাখো?
কী তেল মাখি আমি জানি না সমর।
সে কী হয়! তুমি তেল মাখো তার নাম জানো না?
তুমি কী আমার মাথায় তেলের গন্ধ পাচ্ছ?
খুব সুন্দর তেলের গন্ধ।
ওটা তেলের গন্ধ নয় সমর। ওটা আমার শরীরের গন্ধ।
সমর বলল, সোমা, তোমার শরীরের এমন সুন্দর গন্ধ ভাবা যায় না।
কী করি বল। থাকলে তাকে তো ফেলে দিতে পারি না।
সমর ছাদে দাঁড়িয়ে আরও গল্প করতে চেয়েছিল। সোমার কেন জানি আর গল্প করতে ভালো লাগছিল না। নিচে মানুষজনের কোলাহল। কেউ কেউ উঠে দেখে গেছে সমর সোমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কী করছে। একবার সোমার মা সোমাকে ডেকেও গেছে। ও—ভাবে ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করলে চলবে? নিচে কত কাজ!
সমর বলেছিল, যাই মাসিমা।
সোমা বলেছিল, যাচ্ছি। তুমি কি এখন নামবে না সমর?
না। আমার এখানে কেন জানি আজ একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে।
সোমা আর দেরি করেনি। সে নিচে নেমে গিয়েছিল। আয়নার ভিতর সে নিজেকে দেখেছিল। খুব সে তেমন সাজেনি। মুখে সামান্য পাউডার! এবং পোশাকে সে সবসময় সাধারণ। অথচ সে বুঝতে পারছে এই পোশাকই ওকে আজ এ—বাড়ির সবচেয়ে দামি এবং নামি মেয়ে করে রেখেছে। সে লক্ষ্য করেছে, সে একবার যেখানেই গেছে, মৃদুগুঞ্জন। মাইরি ভাই, আমি আর থাকতে পারছি না। কী রে, খপ করে ধরে ফেলব? আহা কী যে হেরিনু! সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে! আসলে কী যে অন্ধকার! আমি জানি না, আমার আজ কী হবে! কত রকমের সে কথা শুনতে পায়। আগে সে এ—সব কথায় মনে মনে রাগ করত, কিন্তু কেন জানি তার এ—সব দিনে দিনে গা—সওয়া হয়ে গেছে। এবং সে যত বড় হচ্ছে, মানুষেরা চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে থাকলে তার ভালো লাগে। সে ওদের কথায় রাগ করে না। মুচকি হাসে। এই হাসিটুকু কী যে রহস্যময়ী করে রাখে সোমা বুঝি জানত না। আর এই রহস্যময়তাই সোমাকে এত বেশি দামি করে রেখেছে। মনীষ কিছু বলতে পারে না। কিছু বললেই যেন সোমা তার ঘরে আর থাকবে না। সে সারা শৈশবে এবং সে যখন তরুণী ছিল, যে সব স্বপ্ন দেখত, সেই সব স্বপ্নের ভিতর ডুবে যাবে অথবা হারিয়ে যাবে।
সোমা সারাক্ষণ কাজ করেছিল তারপর। সে সমরের কথা ভুলে গিয়েছিল। সবাই ওকে ডেকে যেন কিছু বলতে চায়। কিছু যেন জিজ্ঞাসা করতে চায়। সে আর চারপাশে তাকাতেই পারে না। চোখ তুলে তাকালেই চোখে চোখ পড়ে যায়। চোখে চোখ পড়ে গেলে তার ভারী লজ্জা লাগে।
সে চারপাশে তাকিয়ে কাজ করেনি বলেই জানে না সমর তখন কোথায়। যখন বরযাত্রীরা খেয়ে চলে গেল তখন ওর হুঁশ হয়েছিল সে অনেকক্ষণ সমরকে দেখছে না। এ—বাড়িতে একমাত্র সমরই সাহস করে ওর সঙ্গে আলাপ জমিয়েছে। আর যারা ওর মতো তরুণী অথবা যুবক পাশাপাশি, তারা কেউ আসেনি আলাপ করতে। পরিচয় করিয়ে দিলে কেমন নাবালকের মতো ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে। ভীতু কাপুরুষ মনে হয়েছিল সবাইকে। বরং সমরই বলেছিল, তোমার হাতে কী কাজ?
কিচ্ছু না।
চল ছাদে দাঁড়িয়ে একটু গল্প করি।
কী গল্প করবে?
যে গল্প করতে তুমি ভালোবাসবে।
এমন কথায় সোমা সাড়া না দিয়ে পারেনি। চল। তারপরই আকাশের নক্ষত্র দেখা! সেই মানুষটাকে সারা বাড়িতে সে কোথাও আর দেখতে পেল না। রাত গভীর হয়ে গেছে। সবাই খেয়ে চলে গেছে। জলিকে নিয়ে সে কিছুক্ষণ মেতে ছিল। ওর বরকে নানারকম ঠাট্টা—রসিকতা করেছে। জলির বরটা যে কি! সে কথা বলতে পর্যন্ত পারে না যেন। ওর মনে হয়েছিল, মানুষটা দেখাচ্ছে এমন, যেন সে কিছু জানে না। তুমি যে সব জানো মশাই সে আমার জানতে বাকি নেই। আজ রাতে সবুর সইবে তো? এই জলি, আজ রাতে কিছু করেছিস তো খুব খারাপ হবে।
জলির বর এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন সে সোমাকেই খপ করে পাশে বসিয়ে ঠেলে ফেলে কী যে করে ফেলবে! সোমা চোখ দেখলেই মন দেখতে পায়। মানুষটা বড় বজ্জাত। সব জানে, অথচ নাবালকের মতো মুখ করে রেখেছে। এ মশাই, মুখ তুলুন। আপনাকে দেখে কে বর কে কনে বোঝা মুশকিল।
নানারকম সুবাস, এবং বাসর জেগে সোমার ক্লান্তি এসেছিল। ঘুম এসেছিল। সে উঠে বাইরে গেল। সমর গেল কোথায়? সমর ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে বলেছিল ঠাট্টা করে। সে কী সেখানেই আছে? সে কি কিছু খায়ও নি? ওর কেন জানি মনে হল ওকে খুঁজে দেখা উচিত। এ—বাড়িতে একমাত্র সমরই নিজের মানুষের মতো ব্যবহার করেছে। সবাই যখন কোনোরকমে জায়গা করে নিচ্ছে শোবার, যখন মাসিমা—মামিমারা ঘরে গোল হয়ে বসে আছে, জায়গা নেই বলে ঘুমাতে পারছে না, ওদের বিয়ের দিনের গল্প বলে হাসাহাসি করছে, তখন সোমা ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙছিল। সে কোথায়? সমর, সে ধীরে ধীরে ডাকল, সমর তুমি আছ?
ছাদে উঠেই সোমা দেখেছিল সমর সেই একভাবে ছাদের কার্নিসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সোমা যে ডাকছিল, তা পর্যন্ত ওর খেয়াল নেই। গভীর মনোযোগ দিয়ে সে আকাশ দেখছে। কী সুন্দর আকাশ, কত নক্ষত্র, নিচে দুই তরুণ—তরুণী। কাছাকাছি, অথচ ওরা কতদূরে। সোমা সমরের পাশে দাঁড়াল। কোনো কথা বলল না। নিচে বাসর। সবাই ঘুমিয়ে গেলে হয়তো মানুষটা জলিকে জিজ্ঞাসা করবে, তুমি আমার দিকে ও—ভাবে তাকালে কেন? জলি বলবে, কীভাবে?
সে বলবে, এই যে যেন আমি একটা চাষা মানুষ, তোমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি।
জোর করেই তো নিয়ে যাচ্ছ!
জোর করে না নিয়ে গেলে তোমাকে পেতাম কোথায়? বলে হয়তো জলির হাতটা দুহাতের ভিতর রেখে জলির শরীরের উষ্ণতা মাপছে এখন। জলি শিউরে উঠছে। ওর ভিতরটা কাঁপছে। মানুষটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তুমি আমাকে নাও। আর পারছি না। কতদিন এই এক অপেক্ষাতে ছিলাম।
সোমা ডাকল, সমর।
বল।
এ—ভাবে সারাক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে?
থাকতে ভালো লাগল সোমা।
খেলে না?
খেতে ইচ্ছে হল না।
না খেলে শরীর খারাপ করবে।
একদিন না খেলে কিছু হয় না।
কী দেখছিলে এতক্ষণ?
আকাশ দেখছিলাম।
আকাশে এত কী?
কী যে জানি না। সারা আকাশে সোমা বিশ্বাস কর তোমাকে দেখেছি।
আমাকে তোমার সত্যি ভালো লাগে?
সমর হাসল।
সোমা ওর আরও কাছে গেল। জান কী যে হল, বাসর জেগে আমারও ভালো লাগছিল না। কেবল তোমার কথা মনে হচ্ছিল।
সত্যি?
সত্যি।
আর কিছু লাগে না সোমা। আমার আর কিছু লাগে না। বলে সে কাছে এসেছিল। এবং ওর কপালে চুমু খেয়েছিল।
গালে খাও।
সমর ওর গালে চুমু খেয়েছিল।
ঠোঁটে।
সমর ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল।
তারপর সমর সম্মতি পেয়ে আরও দূরে হাত দিতে চেয়েছিল। সোমা বলেছিল আজ আর না। প্রথম রাতে এর চেয়ে বেশি দিতে নেই।
সোমা পরদিন সকাল না হতেই বাড়ি ফিরে এসেছিল। সেই মধুর ঘটনার আর বাড়াবাড়ি সে চায়নি। তাকে কত বড় হতে হবে। তার সামনে কী সুন্দর ভবিষ্যৎ। আর এক জায়গায় আটকে থাকলে চলে না।
সোমা এবার গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিল।