দুঃস্বপ্ন – দুই
কে এই মানুষ! প্রশ্নটা দুজনের মনেই উঁকি দিয়েছে। সোমার ভিতর নানাভাবে দূরের স্মৃতি উঁকি দিয়ে যাচ্ছে আর মনীষ ভেবেছে সোমা তার কাছে লুকোবার চেষ্টা করছে। টেবিল থেকে উঠে পড়ার সময় সে দেখেছে সোমা এবং সেই মানুষটি কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে ছিল। ধরা পড়ে যাবার ভয়টুকু পর্যন্ত সোমার প্রাণে ছিল না।
ফলে ওরা যখন সিঁড়ি ধরে নামছিল, তখন কেউ কথা বলেনি। চুপচাপ নেমে গেছে। সোমা ভেবেছে মনীষ কথা বলছে না কারণ ওরা পরস্পর ভিন্ন মত পোষণ করছে বই সম্পর্কে। এবং সোমা ওকে ছোট করার জন্য সব বলে দিয়েছে, এমনকি নিজের ভালো না লাগার ব্যাপারও জানিয়ে এসেছে, এসব কারণে মনীষ ওর ওপর রাগ করতে পারে। তবে সে মনীষের এই রাগ অথবা অভিমান মুহূর্তে ভেঙে দিতে পারে, তার হাতে জাদুর কাঠি, সে শুধু দু’দিন শরীর খারাপ যাচ্ছে, কিছু ভালো লাগছে না বলে গলায় র্যাপার জড়িয়ে শুয়ে থাকবে। তখনই মনীষের মুখ বড় কাতর। সে কেমন শিশুর মতো মুখ করে রাখে। সে কাছে এসে বসবে। মাথায় হাত বুলাবে। আদর করতে চাইবে। তারপর সেই এক জায়গায় চলে যাওয়া। সে হাত দিতে দিতে যখন জায়গামতো চলে যাবে তখনই বলা—আমার শরীর ভালো নেই, আমি পারব না মনীষ। আমাকে তুমি আর কষ্ট দিও না। এবং তারপরই মনীষের পালা। কী করে এই মেয়ে সোমা যার চোখ বড়, যার লাবণ্য শরীরে বাড়ে দিনে দিনে, যে না হলে তার রাতের জলপান হয় না, সে তৃষ্ণার্ত থাকে। কী নরম আর পুষ্ট বাহু সোমার। সে সোমার শরীরে হাত রাখার জন্য পৃথিবীর যাবতীয় ঐশ্বর্য তখন চুরি করে আনতে পারে। সুতরাং মনীষ যে কথা বলছে না, মনে মনে সোমার ওপর চটে গেছে, সেজন্য তাকে সোমা আদৌ আমল দিল না। সোমা চুপচাপ পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে, সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে এবং গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেছে।
বেশ শীতের ঠান্ডা। ক’দিন আগে ঝড়—বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় ওরা শীত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। ভিতরে ঠান্ডা ঢুকছে। মনীষ ওপাশের দরজায় কাচ তুলে দিলে। এবং নিজের দিকের কাচ তুলে চুপচাপ একের পর এক সিগারেট খেয়ে চলল।
হঠাৎ সোমা একটা ওকের মতো তুলে আর একটু সরে বসল। সে জানে এই ওক দেওয়া মনীষকে উদ্বিগ্ন করে তুলবে। সে বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে না। সোমা আবার একটু বড় ঢেঁকুর তুলে কেমন কষ্টবোধের ভান করল। এবং সে যেন এখন কিছুই দেখছে না শুধু শহরের ট্রাম—বাস দেখছে। ওদের গাড়ি গড়ের মাঠ পার হয়ে চলে যাচ্ছে। বোধহয় শীতের জ্যোৎস্না মাঠে। এমন জ্যোৎস্নায় আর কেউ বুঝি আজকাল এই মাঠে প্রেম করতে আসে না। সোমার ইচ্ছা হল, বলে, আমরা কতবার এসেছি এখানে, গঙ্গার জেটিতে গিয়ে বসেছি। ফোর্ট উইলিয়ামের র্যামপার্টে। সে—সব তোমার মনে পড়ে মনীষ? কিন্তু মনীষ উলটোমুখে গাড়ি—ঘোড়া এবং যে—সব বেশ্যা রমণীরা বের হয়েছে মাঠে খদ্দেরের আশায় তাদের দেখছে। সোমা আবার একটা গলা—জ্বালা ছেঁকুর তুলে ভীষণ কষ্টবোধে কাতর হচ্ছে এমন চোখ—মুখ করে রাখল।
মনীষ আর পারল না। তোমার কী প্যাটিস খেয়ে অম্বল হয়েছে?
না।
তবে এমন ঢেঁকুর উঠছে কেন?
কী করে বলব বল?
কোনো কষ্ট হচ্ছে?
বুকটা কেমন করছে।
জ্বালা জ্বালা করছে না তো?
ঠিক জ্বালা জ্বালা না। কেমন ধড়ফড় করছে।
কাল অসিতকে একটা তবে কল দিচ্ছি।
তুমি যে কী না মনীষ! টাকার গাছ আছে তোমার।
শরীর ভালো লাগছে না বলছ। বুক কেমন করছে—
ঠিক হয়ে যাবে।
আবার চুপচাপ। ওরা হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঢুকে গেল। বড় সব এমপ্লিফায়ারে গানের সুর ভেসে আসছে। মনীষ বলল, কতদিন আর বড় জলসাতে রাত কাটাই না। চল একদিন আমরা সারারাত গান শুনব।
এই শীতের সময় বড় সামিয়ানার নিচে বসে আলি হোসেনের সানাই অথবা গোলেমালির গান কী মজা! পাশে সোমার মতো মেয়ে বসে থাকবে, চুলে সুন্দর গন্ধ, তসরের বেনারসি পরনে, নীল রঙের ব্লাউজ, আর কপালে বড় সিঁদুরের টিপ চুল টেনে বাঁধা, পায়ে সে কখনও যদি রুপোর চেলি পরে যায় মনীষের মনে হয় রাত নিশীথে সে আর সোমা গানের জলসায় দুই বেহুলা—লক্ষীন্দর। সোমার সুন্দর চোখ দেখলে সে কিছুতেই আর রাগ পুষে রাখতে পারে না।
সোমা বলল, চল এখানেই আজ আমরা বসে যাই।
গেলে ভালো হত, আমরা আবার আমাদের পুরনো দিনগুলো ফিরে পেতাম। বস্তুত এই এক মানুষের রহস্য, কিছুদিন কাছে থাকলে ভিতরের রহস্য মরে যায়। মনীষ বিয়ের আগে সোমাকে দেখবে বলে গাড়ি চালিয়ে সেই দেবদারু গাছটার নিচে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত। কী মজা ছিল, কী যে মধুর মনে হত, এখন সে সব তার মনে হয় মরে গেছে। এত কাছে থাকলে শুধু বুঝি শরীরটা থাকে।
সোমা ইচ্ছা করেই নানা কথার ভিতর নিজেকে অন্যমনস্ক হতে দিচ্ছে না। সে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেই ধরা পড়ে যাবে বুঝি। সে কে? তাকে সে কোথায় দেখেছে? তার চোখ দেখে মনে হয়েছিল সে কিছু সোমাকে বলতে চায়। তার চারপাশে যে জীবন—প্রবাহ চলেছে, তার থেকে মানুষটা যেন আলাদা।
তার চোখে কী এক ভাষা ছিল, কী এক মাধুর্য ছিল যে কেবল তার অজান্তেই তাকে নদীর পারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
সোমা বলল, আমার কিছু ভালো লাগছে না মনীষ। তুমি কেন যে আমাকে কফি হাউসে নিয়ে গেলে?
কী ঘটেছে?
কী ঘটবে?
তবে তুমি এমন বলছ? মনীষ ইচ্ছা করেই ওর সেই অপলক দেখা এবং মতিবিভ্রম হয়ে যাওয়া খানিক সময়ের জন্য, এড়িয়ে গেল! সোমা নিজে থেকে কিছু না বললে সে—ও কিছু বলছে না। সে যেন ব্যাপারটা জানে না এমন চোখে—মুখে থাকল।
ওরা যেতে যেতে ফুটপাথে অজস্র ভিখারি দেখল। শীতের রাতে কুণ্ডলী পাকিয়ে সব রাস্তায় সারি সারি শুয়ে আছে। কিছু গাছগাছালি আছে এখানে, কিছু অন্ধকার আছে, ভিতরে মনে হল কোনো পুরুষ রমণী পরস্পর আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আর দূরে একটা বাচ্চা ছেলে লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
মনীষ গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, ননসেন্স! কলকাতায় ভদ্রভাবে মানুষের চলা দায় সোমা।
সোমা বলল, সবাই শরীর বেচে খাচ্ছে। ওদের আর দোষ কী।
তোমার আজ কী হয়েছে সোমা?
কী আবার হবে।
মনীষের কেমন আর্ত গলা শোনা গেল। গাড়িটা আবার গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। গ্যারেজের তালা খুলে সে ভিতরে গাড়ি রেখে দিল। মাথার ওপর আলো। এবং নানারকমের পোকা সেই আলোর চারপাশে। এমন সুন্দর আলো আর তার চারপাশে কত সব কুৎসিত নীলবর্ণের পোকা। মনে হল দু—একটা পোকা ওর মাথার ওপর এসে বসেছে। সে হাত দিয়ে সেই সব পোকা ধরতে গেলে দেখল ওরা উড়ে গেছে। হাতে সব পোকা ধরা যায় না, ধরে মারাও যায় না।
গাড়িটা ঢুকিয়ে গেট টেনে দিল এবং বড় একটা তালা ঝুলিয়ে দিল গেটে, গেটের ওপর পেতলের তালা, সেটা লোহার রডের সঙ্গে লেগে কেমন ঢঙ ঢঙ করে শব্দ করছে। সেই শব্দ মনীষের বুকে কী একটা তোলপাড় তুলে ওকে উধাও করে দিতে চাইল। সেই মানুষটা কে? সোমার কে হয়? সোমার আগে কোনো প্রণয় ছিল বলে তার জানা নেই। যদি থাকে সে কী তার ভিতর কেউ? নতুবা সোমার চোখে ওর চোখে এমন দুষ্টবুদ্ধি ধরা পড়ে গেছে কেন? ভিতরে ভিতরে মনীষ গুমরে মরছিল। তার কিছু জেদ আছে। সে সেই জেদের বশেই সোমাকে কিছু প্রশ্ন করল না। সোমাকে সে আপ্রাণ বিশ্বাস করে। মানুষের কিছু দোষ—ত্রুটি থাকে, সে সেটা নিয়ে না জন্মালেও ইনস্টিংক্ট তাকে সে সব বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্মাতে সাহায্য করে। এবং সোমারও যে এমন কিছু ঘটনা ঘটবে তাতে বিচিত্র কী। তবু এ সব ব্যাপারে সে যতটা জানে সোমা জীবনে কোনো কুৎসিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েনি। ওর মতো মেয়ের পক্ষে জড়িয়ে পড়া সম্ভবও নয়। এক সময় সে এই কফি হাউসের অনেককে চিনত। তার কবিতা লেখারও স্বভাব ছিল। সে প্রথমত এই এখানে কবিতার টানেই চলে আসত। কতদিন সে সোমাকে তার কবিতা শোনাবে বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে আর কাপের পর কাপ কফি নিজে খেয়েছে, বন্ধুবান্ধবদের জন্য অর্ডার দিয়ে গেছে। সোমা এলেই ওর প্রাণে জল আসত। সোমার বিধবা মা আর সে। বাবা কিছু টাকা ব্যাঙ্কে রেখে গেছেন সে এমন জানত। ওর মা খুব বুদ্ধিমতী এবং হিসেবি। সোমাকে এতটা বড় করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় সে যে হাজির করেছিল তার কৃতিত্ব যত না তার, তার চেয়ে বেশি মায়ের। সোমা বাড়ি থেকে গোনাগুনতি পয়সা নিয়ে বের হত। ওর কোনো কোনো দিন টিফিনের পয়সা থাকত না। সে এলেই প্রথম বলত, কী খাবে সোমা? কী অর্ডার দেব?
সোমার খেতে কোনো আপত্তি থাকত না। যা সে পছন্দ করত তাই সে অর্ডার দিত। তারপর কবিতা পড়া। সোমা ভালো না বললে সে কবিতা যথার্থই কিছু হয়নি তার এমন মনে হত। সে সেই কবিতা যে কতবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখেছে। ওর কিছু কবিতা লিটল ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়েছিল একসময়। সবই যেন প্রেমের ব্যাপারে পাল্লা দেওয়া। সে ছাত্র হিসাবে মোটামুটি ভালো। দেখতে রূপবান না হলেও মানানসই। সে তেমন উঁচু লম্বা নয়। তবু সোমার পাশে দাঁড়ালে তাকে বেমানান লাগে না। সে সোমাকে পাবে বলে যা সে করে না তাও করেছে।
যেমন সে একবার সব বন্ধুদের নিয়ে ম্যাড হাউসে গিয়েছিল। অশোক এমন একটা চালিয়াতি মার্কা জীবনযাপন করত এবং আড্ডার টেবিলে তার এমন ব্যাখ্যা রাখত যে মনে হত মাঝে মাঝে এ—সব না করলে, যেমন একটু মদ্যপান, পালিয়ে চুমু খাওয়া ভালোবাসার মেয়েকে এবং রঙিন কোনো ছায়াছবিতে একপাশে সব শেষের রো—তে বসে ফষ্টিনষ্টি, একটু হাত দেওয়ার ব্যাপার না থাকলে প্রেম—ফেমের মূল্য কী। মনীষ সে সব বিয়ের আগেই সোমাকে নিয়ে করেছে। সোমার এতে সায় ছিল। এবং এত বেশি সায় ছিল যে সে কথায় কথায় মাঝে মাঝেই রঙিন ছবিতে একটা মুরগি—মোরগা পাছা তুলে নাচছে এমন দেখতে পেত। সবচেয়ে সেই ছবি যেখানে নায়িকা মুরগি বনে গেছে এবং কক কক করে ডাকছে—অ মোরগা।
মোরগ—মুরগির লড়াইতে সোমা কম যায় না। নাচে ভালো। সব ভালো তার। তবু আজ কেন জানি সোমার চোখে চুরি করে অন্য ঘরে উঁকি দেওয়া ভালো লাগল না। সে ভাবল সোমা যখন একা শুয়ে থাকবে, নীল মৃদু আলো জ্বালিয়ে শিয়রে, সে যখন রবীন্দ্রনাথের গান শুনবে রেকর্ড—প্লেয়ারে এবং অবিকল নকল করে সেই গান গাইবে তখন তার পাশে বসে কোমল, উষ্ণ উত্তাপের ভিতর হাত রাখতে রাখতে বলবে, সে কে সোমা? তুমি চুরি করে কাকে দেখছিলে?
মনীষ চুপচাপ আবার সিঁড়ি ভাঙতে থাকল। মনোরমা এসে দরজা খুলে দিচ্ছে। সে জেগে থাকে। যতক্ষণ না বাবু—বিবি বাড়ি ফিরে আসে ততক্ষণ সে জেগে থাকে। ওদের ফিরতে কোনো কোনোদিন বেশ রাত হয়ে যায়। বোধহয় পার্টি থাকে। পার্টিতে কতরকমের খাবার। সোমা অথবা মনীষের আজকাল সেসব অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে রোজ রোজ ভালো লাগে না। মাসে দু—একবার হলে মন্দ নয় এমন ভাব। সে বেশি কিছু খায় না। দু—পেগ জিন, ওর ওতেই ম্যাকসিমাম। মনীষ আজকাল যেদিন খায় চার—পাঁচ পেগ অনায়াসে টেনে আসতে পারে। মনীষকে ছোটখাট একটা ব্যবসা চালাতে হয়। তার বড়মামা ব্যবসায় ফন্দিটা শিখিয়ে দিয়েছে। এবং সে তার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কত সহজে এ তিন—চার বছরে দশগুণ করে ফেলেছে। এবং ওর ধারণা সোমা লক্ষ্মীমেয়ে। সে না এলে লক্ষ্মী তার ঘরে এমন দশভুজা হয়ে আসত না। তার চারপাশে আজকাল মাঝে মাঝে ঝমঝম করে টাকার বৃষ্টি নামে। সে তখন ভেবে পায় না এই শহরে এত ঐশ্বর্য আর এসব মানুষেরা কেন ফুটপাথে থাকে? আসলে ওর মনে হয় তখন, এদের বড় বেশি উদ্যমের অভাব।
সোমা ঘরে ঢুকেই কেমন সোফাতে গা এলিয়ে দিল। এখন মনোরমা আসবে। এসেই জিজ্ঞাসা করবে খাবার গরম করে দেবে কিনা। কারণ খাবার কোনো কোনো দিন ঠান্ডা হয়ে যায়। সোমার নিজেরই ঠিক থাকে না কখন ফিরবে। যেমন আজই ধরা যাক ওদের কথা ছিল ছবি দেখে সোজা বাড়ি চলে আসবে। কোথাও বসবে না। কিন্তু আটকে গেল। এমন কথা ছিল না। এ—স্বভাবটা মনীষেরও আছে সেই প্রথম জীবনের কিছু ঠিকঠাক না থাকার মতো।
সোমা মনোরমাকে দেখেই বলল, আমরা আজ বেশি কিছু খাব না। খেয়ে এসেছি।
মনীষ সোজা বাথরুমে ঢুকে গেছিল। ওর বাইরে কোথাও বাথরুমের দরকার হলে খুব অসুবিধা হয়। ওর নিজের জন্য আলাদা বাথরুম। বাথরুমের চারপাশে বড় আয়না। পাশের বাথরুম সোমার। সোমার বাথরুমেও চারপাশে বড় আয়না আছে। ওদের শোবার ঘরে চারপাশে বড় আয়না। সাধারণত সে ঘরে কোনো আত্মীয়স্বজনের ঢোকার নিয়ম নেই। মনোরমা দিনে দুবার ঢুকতে পারে। একবার সকালে। আর একবার বিকেলে। পৃথিবীর যাবতীয় ন্যুড ছবি ঘরে। দেওয়ালে কোণারকের ডিজাইন। সে এ—ঘরটা নিজের পছন্দমতো তৈরি করেছে। সঙ্গে এ—ঘরেও আলাদা আলাদা দুটো বাথরুম। সেজন্য বাইরে কোথাও বাথরুম ব্যবহার করতে পারে না। বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই ওদের বাথরুমে যাবার স্বভাব। অথচ আজ বাথরুমে ঢুকেই সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। নীলবর্ণের একটা আলো জ্বেলে দিল। সে কেন যে এভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকছে, সে কি এখনও সেই রহস্যজনক মুখের কথা ভাবছে? এবং ভিতরে একটা হিংসা, ক্রোধ। অথবা সে কি নিজেকে কোনো অপরিণামদর্শী যুবক ভাবছে? কিছু করণীয় নেই, সব ভবিতব্য। সে যে কেন দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারল না। কোনো কোনো দিন অত্যধিক মদ্যপান করলে সে এ—ভাবে একা বাথরুমে নীলরঙের আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরটা তার খালি মনে হয়। সেই বড় গম্বুজের মতো মুখের মানুষটাকে দু’নখে চিরে ফেলতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু সে জানে তার কাছে অথবা তাদের মতো মানুষের কাছে সে বান্দা। সে যা চাইবে তাই দিতে হবে। যদি সে তার সোমাকে চায়, এমন বৈভবের চাবিকাঠি তাদের হাতে সে না দিয়ে যাবে কী করে। কারণ না দিলেই সোমা আর দশভুজা থাকবে না। সোমা লক্ষ্মীছাড়া হয়ে যাবে।
বস্তুত একা দাঁড়িয়ে মনীষ যে কী ভেবেছিল নিজেও জানে না। সে বুঝতে পারছে শুধু এলোমেলো চিন্তা ওকে গ্রাস করছে। সে অসহায়ের মতো আয়নায় অবিরাম নিজেকে দেখে চলেছে। বস্তুত সে এতদিনে নিজের এই চেহারা চিনতে পারছে কিনা, এই মানুষই মনীষ দত্ত কিনা, ভেবে পাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সে নিজেকে কেন জানি চিনতে পারে না। মাথার ভিতর তার কেমন গোলমাল হয়ে যায়।
এমন সময় ওর মনে হল পাশের বাথরুমে ফোয়ারা থেকে জল পড়ছে। জল পড়ার শব্দে ওর হুঁশ ফিরে এল। আয়না থেকে সে চোখ নামাল। ওপরের দিকে অহেতুক তাকাল সে। এ—সময়ে সোমা স্নান করছে। সোমা এই শীতের রাত্রিতে স্নান করছে। কিছু অপবিত্রতা তাকে সময়ে সময়ে গ্রাস করে, কী যে সেই অপবিত্রতা সে বুঝতে পারে না! গভীর রাতে কখনো কখনো বিছানা ছেড়ে সোমা বাথরুমে ঢুকে অনবরত ফোয়ারার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। আজও ওর এমন হয়েছে। মাঝে মাঝে সে এটা সোমার অসুখ ভাবত। চার বছরের ওপর ওরা এই বাড়িতে উঠে এসেছে। বিয়ের পরই সে এখানে উঠে এসেছে। সে কী জেনে ফেলেছে মনীষ দত্ত এই পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে বান্দা হয়ে আছে? প্রয়োজন হলে মনীষ দত্ত সোমা নামক এক সুন্দরী মেয়েকে অবহেলায় বিক্রি করে দিতে পারে? সে যে কী ভাবছে!
মনীষ যখন বাথরুম থেকে ফিরে এল তখন সে দেখল ঘড়িতে দশটা বাজে। মনোরমা বাইরের বারান্দায় পায়চারি করছে। পার্লারে সে নতুন একটা লাল রঙের কার্পেট বিছিয়েছে কিছুদিন আগে। সেই কার্পেটে কত বিচিত্র সব ফুলের ছবি। ছবিতে কত রঙ—বেরঙের প্রজাপতি। মনোরমা গরম কফি রেখে গেছে। সে একটা চুরুট ধরিয়েছে, কফি খেতে খেতে অফিসের কিছু ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। সে এক বিষাদ কুড়িয়ে এনেছে সঙ্গে এবং এই বিষাদে তাকে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে, কেন যে সোমা এমন রহস্যময় মুখের কাছে ধরা পড়ে গেল বুঝতে পারছে না। আর পারছে না সে। সে এবার সোমা বাথরুম থেকে বের হয়ে এলেই বলবে, তুমি ওকে চেন সোমা? তোমার সঙ্গে ওর কবে আলাপ?
মনোরমা বলল, দাদাবাবু আপনার খাবার ঠিক করব?
মনীষ বলল, সোমা আসুক।
দশটা বাজলে ওরা খেয়ে নেয়। দশটা বেজে গেছে বলেই মনোরমা ওদের খাবার টেবিল সাজাবে কিনা জিজ্ঞাসা করল। সোমা এমন কতদিন এসেই বলে দেয়, আমরা কিছু খাব না, খেয়ে এসেছি। যেন সোমা বাইরে থেকে এসে কতক্ষণে শরীর মুছে ধুয়ে অথবা স্নান করে তার সেই প্রিয় রেকর্ড—প্লেয়ার খুলে গান শুনবে। ওর প্রিয় গান সব থাকে সাজানো। অনেকদিন সে আলো জ্বেলে শুয়ে থাকে। রেকর্ডপ্লেয়ারে তখন বাজছে ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে, উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে’। মনীষ তখন দেখতে পায় একটা নীলরঙের আলোর নিচে সোমা সিল্কের গাউন পরে শুয়ে আছে। সাদা রঙের বিছানায় ঠিক একটা পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে মনে হয়। সে এসে ধীরে ধীরে কখনো ডেকে দেয়। সোমা এসো খাবে। কোনো কোনো রাতে সোমা আপন মনে জানালায় দাঁড়িয়ে গায়। তখন অজস্র নক্ষত্র আকাশে। কেমন অসুখী মনে হয়। মনের ভিতর ওর যে কী কষ্টের ছায়া পড়েছে ক্রমে সে বুঝতে পারছে না।
আজও মনে হল বাথরুম থেকে বের হয়ে সে চুপচাপ বসে থাকবে। অথবা আপন মনে সে গাইবে ওর সেই প্রিয় গানটা—গোলাপফুল ফুটিয়ে আছে, মধুপ হোথা যাসনে, ফুলের মধু লুটিতে গিয়ে কাঁটার ঘা খাসনে। মাঝে মাঝে গাইতে গাইতে চোখ থেকে জল পড়ে সোমার। অথচ কখনো কখনো সে সোমাকে নিয়ে যখন গাড়ি করে বের হয়ে যায়, কোনো পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে হাত ধরাধরি করে অথবা পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে যায়, অনেক ওপরে, কেন যে মনে হয় তখন এই পৃথিবীতে সে আর সোমা, সোমা বিহনে সে নদীর পাড়ে একা পড়ে থাকবে—কেবল যেন গাইবার ইচ্ছা, ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে, শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানি, ওগো সুন্দরী। চাও কী প্রেমের চরম মূল্য দেব আনি, দেব আনি, ওগো সুন্দরী। সে সোমার হাত ধরে পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। চারপাশে উপত্যকাময় অজস্র ফুলের ওপর বাতাস বয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোথায় কোন ম্লান অন্ধকার চুপ করে প্রতীক্ষা করছে মনে থাকে না। সে তখন সোমাকে নিয়ে কতদূরে চলে যেতে পারে। তার ভয় থাকে না। অথচ আজ কী যে ভয় তাকে পেয়ে বসেছে!
সোমা স্নান করে এসে এতটুকু শীতে কাঁপল না। ঘরের ভিতর এখন উষ্ণ আবহাওয়া। বড় পবিত্র চোখ—মুখ তার। এয়ার কন্ডিশান মেশিনটা কেমন একটা থেকে থেকে ক্লপ ক্লপ শব্দ করছে। আমার খেলা যখন ছিল তোমার মনে, ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত, যেন আমার আপন সখার মতো—সোমা গুনগুন করে গাইতে থাকল—তখন কে তুমি কে জানত, ওগো সেদিন তুমি গাইলে যে—সব গান, কোন অর্থ তাহার কে জানত শুধু সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ, সদ্য নাচত হৃদয় অশান্ত। হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি, স্তব্ধ আকাশ নীরব শশী রবি, তোমার চরণ পানে নয়ন করি নত, ভুবন দাঁড়িয়ে আছে একান্ত, খেলা যখন ছিল তোমার সনে….। সোমা মাথা নিচু করে রেখেছে। এবং নিভৃতে গেয়ে চলেছে। মনীষ গান শেষ হলে ডাকল, সোমা।
গানটা শেষ করার পরও তার ভিতরে গানের রেশ থাকছে। সে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে পারল না।
মনীষ কাছে এসে বসল। ওর ঠান্ডা হাত তুলে ডাকল, তুমি ওকে চিনতে?
সোমা কিছু বলল না। মনীষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
আমি দেখেছি সোমা, তুমি ওকে চুরি করে দেখছিলে, তুমি কি চেন ওকে?
সোমা ঘাড় নাড়ল। না। সে চিনতে পারছে না এমন বলতে চাইল।
তবে সে তোমার দিকে এমন তাকাচ্ছিল কেন?
জানি না।
তুমি কিছু জান না সোমা?
না, কিছু জানি না।
কিন্তু তোমাদের মুখ দেখে মনে হয়েছে যেন কতকালের জানা—চেনা।
ওর চোখ দেখে আমারও তাই মনে হয়েছে। কতকালের যেন সে চেনা—জানা।
সোমার এই মুখ দেখলে কে বলবে, কিছুক্ষণ আগে কফি হাউসে বসে সোমা ঠাট্টা—মসকরা করেছে, সে ওকে দেখতে দেখতেও ঠাট্টা—মসকরা করেছে। কিন্তু সোমা যখন উঠে আসছিল, সোমা যখন দেখছিল—তখনও মানুষটা তাকে দেখছে এবং কাছে যেতেই কী যে মনে হল তার, সোমা কেমন নিভৃতে চলে গেল। অন্ধকারের অন্তরে সে বারবার তাকে সাড়া দিচ্ছে। সে আর কথা বলতে পারল না। চুপচাপ সিঁড়ি ধরে নেমে এসেছিল। আমি আবার আসব। সোমার চোখে—মুখে এমন আভাস যেন।
মনীষ এ সময় আর ওকে এসব বলে বিব্রত করতে চাইল না। তুমি বরং খেয়ে নাও।
তুমি না খেলে ভালো লাগে?
মনীষের অনুরোধে সে টেবিলে বসল মাত্র। সে খুব যত্নের সঙ্গে মনীষকে পরিবেশন করল। শুধু এটা ওটা নিয়ে সে চেখে দেখল। দেখতে দেখতে বলল, মনীষ, কাল তুমি অফিস যেয়ো না। আমি একা থাকলে মরে যাব, আমার কেমন ভয় করছে।
সোমার রাতে ঘুম আসছিল না। দরজা—জানালা বন্ধ। মনীষ পাশের খাটে ঘুমোচ্ছে। ওর এখন বাইরের বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। সদর বন্ধ। লম্বা করিডোর পার হয়ে গেলে মনোরমার ঘর, সিঁড়ির নিচের ঘরে রসুল থাকে। রসুল মনীষের খাস বেয়ারা। সোমা অথবা রসুল একজন না একজন মনীষের সঙ্গে থাকে। যখন ওরা দূরে বেড়াতে যায় তখন রসুল ওদের পাহারাদার। বড় বিশ্বস্ত রসুল।
সোমার কেন যে ভয় ভয় করছিল! সে মানুষটা তার বাড়ি চিনে যদি চলে আসে। রসুল ওকে চেনে না, রসুল ওকে ঢুকতে দেবে না। সে রসুলকে যদি বলে আমি সোমার সঙ্গে দেখা করব, রসুল এমন একজন চেহারার মানুষকে কিছুতেই ফেরাতে পারবে না। সে এসে বলবে কে একজন এসেছেন মা, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। সোমা পায়ে তখন আলতা পরবে। চোখে কাজল। বিনুর বড় ইচ্ছা ছিল কাজল টেনে চোখে বিনুর সঙ্গে সে কোথাও বেড়াতে যায়। সোমা পাশ ফিরে শোবার সময় এমন ভাবল।
ওর কষ্ট হচ্ছিল মনীষের কথা ভেবে। বেচারা সত্যি ভয় পেয়ে গেছে। ভয় পেলে ঘুমোয় কী করে। সে কি ঘুমোচ্ছে, না চুপচাপ শুয়ে আছে? নড়ছে না। ওর ইচ্ছা হচ্ছিল উঠে একবার দেখে—সে ঘুমোচ্ছে কিনা। না ঘুমোলে সে আজ আবার সারারাত ওকে পাশে বসিয়ে রেকর্ড—প্লেয়ার চালিয়ে দেবে। কিছু ইংরেজি গান মনীষের পছন্দ। কিছু ইংরেজি সাহিত্য ওর প্রিয়। এবং ওথেলো নাটকের কিছু সংলাপ। যখন মনীষ অত্যধিক মদ্যপান করে ফেলে তখন মনীষ সোমাকে জড়িয়ে কিছু অবিশ্বাসের সংলাপ একের পর এক বলে যায়। সোমা তখন খিলখিল করে হাসে।
কে সেই মানুষ! মনীষের চিরদিন একটা অবিশ্বাস। সোমা এত বেশি সুন্দর যে ওর বিশ্বাস সোমা কবে যে নদীর পারে চলে যাবে। সে ভয়ে ভয়ে থাকে। সোমাকে তার সব ঐশ্বর্য দেবার জন্য সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। সোমার আজকাল কোনো শৈলশহরে বাড়ি কেনার ইচ্ছা। বাড়িটা সাদা রঙের হবে। সদরে দারোয়ান। এবং দারোয়ানের চোখ—মুখ একটা কাফ্রির মতো। কানে বড় বড় রিং। হাতে বল্লম নিয়ে সে পাথরের মতো সদরে বসে থাকবে। প্রায় জল্লাদের মতো চেহারা। নীচে অজস্র গ্রাম্য কুটির। সেখানে শীতের রাতে আগুন জ্বেলে পাহাড়ি মানুষেরা যে মাংস পুড়িয়ে খাবে সোমা পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে তা দেখবে। অথবা রাতে সোমা এবং সে ওথেলো নাটকের সংলাপ আবৃত্তি করতে করতে সামান্য মদ, নরম চিলি চিকেন, মৃদু আলো, আকাশ ভরা নক্ষত্র উপভোগ করবে। এত করেও পাশ ফিরে শুলে সেই মুখ—অপলক তাকে দেখছে। যেন বলছে সোমা তোমার তো এমন হওয়ার কথা ছিল না।
আমার কী হওয়ার কথা ছিল?
তুমি ভুলে গেছ তা?
কে এমন মানুষ যাকে বলে এসেছে সে অন্যরকমের হবে? সে তার কলেজ জীবনের কথা মনে করার চেষ্টা করল। এই যেমন রমেন আর অনিল। ওদের একজন কি সে! সে ভালো করে ওদের মুখ—চোখ পর পর ভেবে গেল। সাত—আট বছরে সে ওদের ভুলে যাবে? ওদের এত বেশি পরিবর্তন আসবে? ঠিক চিনতে পারেনি বলে ওকে দূর থেকে দেখেছে। ওর চোখের ওপর ওরা মিছিলের মতো ভেসে গেল। রমেন কালো, বেঁটে। চুল ওর ব্যাকব্রাশ করা। চোখ ছোট। মানুষটার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। আর একজন উঁচু, লম্বা, নাক চ্যাপটা, থুতনিতে ভাঁজ, চুল শ্যাম্পু করা সব সময়—সে তো অমিয়। ওদের ভিতর অনিল স্মার্ট। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। কিন্তু চোখে—মুখে বড় বেশি স্বার্থপর সে। তবু অনিলকে সোমার ভালো লাগত।
সে তার অনার্সের অনেক নোট অনিলের কাছে নিয়েছে। কলেজের শেষ প্রান্তে যেখানে জেলখানার পাঁচিল আরম্ভ হয়েছে, যেখানে সার মণীন্দ্র নন্দী, কে. সি. আই—এর স্ট্যাচু আছে তার নিচে বসে ওরা দুজন প্রায়ই গল্প করত। কিছু কিছু সংলাপ সে এখনও মনে করতে পারে। যেমন অনিল প্রায়ই বলত, তুমি সাঁতার জানো সোমা?
কেন জানব না।
অনেক মেয়ে সাঁতার জানে না।
তুমি অনেক মেয়ের মতো আমাকে ভাবলে কী করে?
তুমি তা হলে আলাদা?
আমার তাই মনে হয়।
মেয়েরা কখনো আলাদা হয় না।
কেন হয় না?
ওদের ঈশ্বর গড়েছেন একভাবে।
তুমি ঈশ্বর—টিশ্বর মানো দেখছি।
তুমি মানো না?
না, আমার মানতে ভালো লাগে না।
কেন লাগে না?
এই ঈশ্বরই প্রথম মানুষকে মিথ্যাকথা বলতে শিখিয়েছে বলে।
কী বলছ সোমা?
ঠিক বলছি। এই যেমন ধর ঈশ্বর যে বলেছেন আমি ঈশ্বর—
ঈশ্বর কখনো এমন কথা বলেন?
তবে মানুষ বলছে—ঐ দ্যাখো ওপরে ঈশ্বর আছেন।
মানুষ বলেছে বলতে পারো।
মানুষ কি ঈশ্বর দেখেছে?
মানুষ কল্পনা করেছে।
সোমা মাঝে মাঝে রেগে উঠলে বেশি, আঁচলটা মাথার ওপর টেনে দিত। তারপর খুব যেন ভেবে উত্তর দিচ্ছে, তা হল দেখো সেই কল্পনাটাকেই সত্য ভেবে আমরা কী না করছি। আমরা মন্দিরে মসজিদে মাথা ঠুকছি। ঈশ্বর নিজেই প্রথম মিথ্যার বেসাতি খুলে মানুষকে ভড়কে দিয়েছে।
অনিল চুপ করে থাকত। সে এসব তর্ক পছন্দ করে না। সে হালকা তর্ক করতে চায়। কিন্তু যা মেয়ে সোমা, তাকে এত সহজে ছেড়ে দেবে না। সে বলত, তুমি বলতে চাও, যার কোনো মূল অস্তিত্ব নেই তাকে নিয়ে আমরা মন্দির মসজিদ বানিয়ে নিরুপায় মানুষকে ভয় দেখাচ্ছি?
তা ছাড়া আর কী।
দ্যাখো সোমা, আমরা এ—সব তত্ত্বকথা এখনও তেমন বুঝি না। আমাদের সে বয়স হয়নি। এত সহজে কিছু নস্যাৎ করা ঠিক না।
আমি করতে পারি।
তুমি তবে রাজমহিষী।
অন্য কিছু বল।
আর কী বিশেষণ দিতে পারি?
যা খুশি।
তোমাকে একটা বিশেষণে ডাকব বলে অনেকদিন ভেবেছি। কিন্তু পারিনি। ভয় করেছে।
ভয় করলে থাক। তেমন বিশেষণে আমার দরকার নেই।
তুমি অভয় দিলে—
তুমি পুরুষ নও অনিল। তোমাদের ভিতর তুমি সবচেয়ে স্মার্ট, তার যদি এমন অবস্থা হয় তবে পুরুষ জাতটার ওপর আর বিশ্বাস রাখি কী করে?
তুমি অভয় দিলে আমি বলতাম।
যাক। যা বলছিলাম। তুমি বলে যাও, আমি নোট করে নিচ্ছি। ঐ দ্যাখো, এন. কে. জি. যাচ্ছেন। চুপচাপ মুখোমুখি বসে থাকতে দেখলেই বলবেন, দুপুরবেলায় টাওয়ারের মাথায় আজকাল চাঁদ ওঠে নাকি সোমা?
অনিলের মুখটা ভীষণ লাল দেখাচ্ছিল সেদিন।
আর সোমার কী হাসি পাচ্ছিল। সে মাথায় আঁচল তুলে বলল, অনিল, আমাদের বাড়ি এসো একদিন। তুমি যা ভাবছ সেটা সুবিধামতো ভেবে দেখা যাবে। এখন নোট নিচ্ছি, নোট নিতে দাও।
সে নোট নিতে নিতে অনিলের মুখ চুরি করে দেখছিল। আহা বেচারা, দুঃখে আর তাকাচ্ছে না। কেবল খাতায় মুখ রেখে বলে যাচ্ছে। ভয়ে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। তাকালেই বুঝি সোমা হেসে ফেলে। সে অপমান বোধ করবে আবার! অথচ সোমার শরীরে কী যে আকর্ষণ, উঁচু লম্বা সোমার চোখে কাজল থাকে না। কাজল দিলে এই যুবতীর চোখে এক অকারণ বিষণ্ণতা ভেসে ওঠে।
সোমা পাশ ফিরে আবার মনীষের দিকে তাকাল। ওর শরীর থেকে চাদর সরে গেছে। সে উঠে গিয়ে পাশে বসল এবং শরীরের চাদরটা তুলে দিতেই খপ করে ধরে ফেলল মনীষ।
তুমি ঘুমোওনি তবে?
না, আমার ঘুম আসছে না।
তোমার ঘুম না আসার কী হল?
তুমি তো জান আমার কেন ঘুম আসে না।
আমি আজ আর পারব না বাপু।
লক্ষ্মীমেয়ে। একটু পাশে শোও।
লক্ষ্মীছেলে। এমন করে না। দুষ্টুমি আমার এখন ভালো লাগবে না!
মনীষ উঠে বসল। সাপ্টে ওকে কোলের উপর ফেলে দিয়ে চুমু খেল। ভীষণ খারাপ লাগছে সোমা। আমি পারছি না।
সোমা বলল, ছাড় তো আগে।
মনীষ ছেড়ে দিল।
সোমা জানলা খুলে দিল। কেমন গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে পৃথিবী থেকে যাবতীয় শীত কারা চুরি করে নিয়ে গেছে। সে এতটুকু ঠান্ডা বোধ করছে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কেন জানি মনীষকে পর্যন্ত ভয় পেতে শুরু করেছে।
নিচে লন। সবুজ ঘাস। কিছু লাল গোলাপ। দামি ফ্লোরেসেন্ট বাতি গোলাপের ভিতর। ছোট ছোট টিনের ফ্রেমে সেই আলো জাফরি কাটা। চারপাশে কী সমারোহ বাঁচার। আর একটু দূরে গেলেই ফুটপাথে অজস্র মানুষ, শীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। গরিব, খেতে না পাওয়া হাজার হাজার মানুষের মুখ যেন চুপি চুপি পাঁচিলের পাশে এসে জড়ো হয়েছে এবং রাতে যখন সে ঘুম যাবে, সদরে কেউ থাকবে না, সোমা দত্ত ঘুম যাবে, তখন অতর্কিতে আক্রমণ ঘটবে। এইসব অন্নহীন মানুষের ভিতর সেই মানুষের মুখটাও উঁকি দিয়ে আছে দেখতে পেল। তাকে ওরা এ—বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
সোমা কেমন অতর্কিতে হাহাকার করে উঠল—মনীষ মনীষ!
মনীষ ছুটে বের হয়ে গেল? কী হয়েছে! এমন করছ কেন?
সোমা কেমন বোকার মতো তাকিয়ে আছে। সে দেখল শুধু গোলাপ, বড় বড় লাল গোলাপ, শুধু আলো, চারপাশে আলো আর আলো, এই আলো, ফুল এবং নক্ষত্র দেখে কেমন তার বুক কেঁপে উঠেছিল। আর কিছু নেই। মনীষ বারবার ওকে বলেও কিছু জানতে পারছে না।—তোমার যে কী হয়েছে সোমা!
সোমা বলল, আমি জল খাব।
মনীষ টিপয় থেকে কাচের মীনা—করা গেলাস এনে সামনে ধরল।
সে যেবার জার্মানিতে ব্যবসা—সংক্রান্ত টুরে গিয়েছিল, এবং যাদের কলাবরেশনে সে মধ্যমগ্রামের কাছে একটা দুর্লভ কাচের কারবার করবে ভেবেছিল, তাদের উপহার দেওয়া এই গেলাস। দামি। কত দামি মনীষেরও জানা নেই। সোমা এই গেলাসেই জল খেতে পছন্দ করে। সে বলল, আরও জল খাব? এনে দেব?
গেলাসটা দেবার সময় সোমা বলল, না আর লাগবে না।
তুমি আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। ভিতরে এসো।
তুমি যাও, আমি যাচ্ছি।
আমাকে তুমি এভাবে ডাকলে কেন?
তোমাকে ডেকেছি!
ডাকলে না?
হঠাৎ কী যে হল।
মনীষ মাঝে মাঝে সোমার কিছু স্নায়বিক দুর্বলতা লক্ষ্য করেছে। ওর ডাক্তার বন্ধুর অভাব নেই। সে কাউকে এ—ব্যাপারে খুব কিছু একটা খুলে বলেনি। বললেই ওর অতীত নিয়ে আলোচনা হবে। এবং অতীতে সোমা কোনো ভয়াবহ কাজে লিপ্ত ছিল কী না, শিশুকালে কোনো অপমৃত্যু দেখেছে কী না, অথবা সে এমন কোনো পাপ কাজের সঙ্গে নিযুক্ত ছিল যা এখন তাকে মাঝে মাঝে অস্থির করে তুলছে।
মনীষ এও জানে বেশি সময় সোমার এটা থাকে না। সে সেজন্য আজ আর কোনো দৈহিক সম্পর্কের কথা ভাবল না। সে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আমি কিছু করব না। ভয় করলে তুমি আমার পাশে শোও। ছুঁয়ে বলছি তোমাকে ডিস্টার্ব করব না। আমার পাশে শুলেই তুমি ঘুম যেতে পারবে।
সোমা হাসল। বলল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি মনীষ। বিশ্বাস করি বলেই তোমাকে বিয়ের আগেই সব দিয়ে ফেলেছিলাম। কেউ দেয়? বল, মেয়েদের এইটাই তো অহঙ্কার?
মনীষ এমন কথায় আপ্লুত না হয়ে পারল না। সে বলল, এসো সোমা, আমার পাশে শোবে। বলে মনীষ নিজেই দুটো খাট টেনে একসঙ্গে করে নিল। বিছানা বড় করে ফেলল। বালিশ পাশাপাশি রেখে দিল। সোমা নরম বালিশে ঘুম যেতে পারে না। ওর শক্ত বালিশ লাগে। সোমা শোবার আগে আঁট করে খোঁপা বাঁধে। সাদা রঙের সিল্কের গাউন। নানারকম লাল সবুজ সুতোর লতাপাতা আঁকা। ফুলের ওপর প্রজাপতি আঁকা। কোনো কোনো দিন সে খুব কালো রঙের গাউনও পরে। ওর সাদা পা তখন মোমের মতো নরম লাগে। যেন একটু তাপ লাগলেই গলে যাবে। এত নরম আর উষ্ণ যে সে ভয়ে তখন ওকে আলিঙ্গন করতে পারে না। জোরে চাপ দিতে পারে না। হুড়মুড় করে হাড়—পাঁজরা বুঝি তার সব ভেঙে যাবে।
সোমা ওর খাটের পাশে চুপচাপ বসে থাকল। শুল না।
তুমি মনে করতে পারলে?
না।
কোথায় দেখেছ মনে করতে পারছ না?
না পারছি না। আমি যে কী করি! কিন্তু জান, খুব চেনা। এবং কতকালের চেনা মনে হচ্ছে।
তুমি যে বলতে ছেলেবেলা তোমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিল, তার মা—মরা ছেলে তোমাদের বাড়ি থেকেই মানুষ?
অমলের কথা বলছ?
হ্যাঁ, অমল।
ওকে দেখলে আমি চিনব না! সে কি বসে থাকার ছেলে! দিদি বলে ছুটে আসত না!
তুমি অযথা ভাবছ। হয়তো চেনাই নয়। তুমি সুন্দর বলে চোখ ফেরাতে পারেনি। পালিয়ে পালিয়ে তোমাকে দেখছিল।
তা এ—ভাবে দেখে?
তোমার মন বড় দুর্বল। সে হয়তো এমনি দেখছিল, এখন তুমি তার নানারকম অর্থ খুঁজছ।
হবে। সে এ নিয়ে আর তর্ক করতে চাইল না। না, ঘুমোনো যাক, বলে সে এক পাশে আলগা হয়ে শুল।
কাছে এসে শোও না, যেন পরপুরুষের কাছে রাত কাটাতে এসেছ।
সোমা বলল, বেশ আছি মনীষ। আমাকে আর টানাটানি কোরো না। আমাকে ঘুমতে দাও।
সে এবার ঘুম যাবার জন্য চোখ বুজল। এবার সে ঘুমোবে। অযথা সে আর আজে বাজে চিন্তা মনে টেনে আনবে না।