Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সুতরাং সকালের দিকে বাড়িতে একটা থমথমে ভাব। সোমা সবাইকে ফোনে খবরটা দিয়েছে। পুলিশে এখনও খবর দেওয়া হয়নি। মনীষ একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে। শুধু লিখেছে, আমি যাচ্ছি। কলকাতায় থাকলে, আমি পাগল হয়ে যাব। কাউকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। সংসারে এ—সব যখন হচ্ছে, তখন তাকে নিবৃত্ত করা যাবে না। পরিচয়হীনভাবে কিছুদিন থাকছি। এ—সময়ে বোধহয় এর চেয়ে আর বড় উপায় আমার জানা নেই। আমার জন্য চিন্তা করবে না। বড়বাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে কারখানা চালাবে। আর মনে রেখো, ইচ্ছা করলেই সব একদিনে পালটানো যায় না। তুমি হলেও পারতে না। আমরা সবাই ভীষণ অসহায়। অসহায় হলে প্রত্যেক মানুষই নিজের নিরাপত্তার জন্য যে—ভাবে হোক টাকা রোজগার করে যাবে। এখন তুমি যা ভালো মনে কর করবে। সোমা চিঠিটা বারবার পড়ে অনেক ভেবেছে। এখন কার কার সঙ্গে পরামর্শ করা যায়, বিনুকে ডাকলে হয়, সুধীর অথবা অশোক এবং অসিতবাবু, এরাই তাকে কী করা দরকার পথ বাতলে দিতে পারে।

প্রথম ওর দরকার বিনুর সঙ্গে। প্রথমে সে বিনুকেই ফোন করছিল।

বিনুর পাশের বাড়িতে ফোন আছে। ওর নেই। দরকার—টরকার পড়লে ডেকে দেয়। এমন সকালে কে ফোন করছে সে বুঝতে পারল না। সে ভাবল, বোধহয় পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে। কারণ হাসপাতালে ওর ভাই। ওর ভাই কি তবে মারা গেছে! ফোন যখন কিছু আরজেন্ট ব্যাপার। না হলে এমন সাতসকালে কেউ ফোন করে না। ওর বুকটা ফোনের খবর পেয়েই ধক করে উঠেছিল। মা ছুটে এসেছিল, ফোন, ফোন কেন রে!

এমন সময়ে বাড়ির সবাই খুব সতর্ক থাকে। যেন যে—কোনো সময়ে ফোনে একটা দুর্ঘটনার খবর আসবে। পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে, এবং অসুস্থ সে, হাসপাতালে আধমরা হয়ে পড়ে আছে শুনে মা যেন খুব নিশ্চিন্ত ছিল। যা—হোক এখন আর তত ভয় নেই। বাইরে থাকলেই ভয়। কে কখন কোনদিক থেকে আক্রমণ করবে ঠিক কী। এখন তো শোনা যাচ্ছে, দলের ছেলেরাই দলের ছেলেদের খুন করছে। অবিশ্বাস দানা বাঁধলে যা হয়। আর তখনই কিনা সাতসকালে ফোন। মার উদবিগ্ন মুখ দেখে বিনু বলেছিল, যাচ্ছি। এত উতলা হলে চলবে কেন!

বিনু সাহস পাচ্ছিল না ফোনের কাছে যেতে। এটা আজকাল তার নিজেরও হয়েছে। বাবা মারা যাবার পর সেই ছোটভাইদের মানুষ করার ভার নিয়েছিল। সে নিজে আর বেশি পড়াশোনা না করে, সংসারের রোজগার কী করে বাড়বে এবং ভাইয়েরা কী করে মানুষ হবে এই ছিল তার একান্ত দায়িত্ব। আসলে সে ওদের মানুষ করছিল নিজের ছেলের মতো। এদের নিয়েই তার সব কিছু। এদের ছাড়া সে নিজেকে ভাবতে পারে না। এবং কোনো ফোন এলেই কী যেন ভয়াবহ একটা খবর রয়ে গেছে মনে হয় ফোনে।

সে কোনোরকমে ফোন ধরলেই শুনল, সোমা কথা বলছে। সে আর ভয়ের কিছু ভাবছে না। বোধহয় কোনো পিকনিক টিকনিকের খবর দেবে সোমা। ওদের তো কোনো চিন্তাভাবনা নেই তাকে সেটা জানাতে চায়। সে বলল, কিরে কেমন আছিস!

সোমা কেমন কথা বলতে পারছে না। ওর গলা জড়িয়ে আসছে। সে তবু যেন কোনোরকমে বলল, আমার সর্বনাশ হয়েছে! তুই শিগগির চলে আয়।

বিনু বলল, কী বলছিস যা তা।

কী আর বলব, আয়।

কী হয়েছে বলবি তো!

না এলে বলতে পারছি না। তুই আয়। আমি মরে যাব বিনু একা থাকলে আমি মরে যাব।

যাচ্ছি। বিনু বাড়ি ফিরে দরজায় দাঁড়িয়েই বলল, মা সোমা আমাকে ডেকেছে। ফোনে আমাকে যেতে বলেছে। সে সোমার সর্বনাশের কথা বলল না। বলল না এইজন্য যে, বললে, আরও দশটা কথা বলতে হবে। ওর তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। তা ছাড়া যে—কোনো ঘটনাতেই মা এমন করতে থাকেন যে, নিজের হোক পরের হোক, একেবারে কেমন বিষণ্ণ হয়ে যান। মাকে এ—সময়ে আর দুঃখে ভাসিয়ে কাজ নেই।

মা বলল, কিছু খেয়ে যাবি না? এই সাতসকালে বের হচ্ছিস!

ওখানে খাব। তুমি ভেবো না।

সে যখন চলে যাচ্ছিল, রাস্তায় হনহন করে হাঁটছিল, মা তখন জানালায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, কখন ফিরবি!

হয়ে গেলেই ফিরব।

এখন এমন একটা সময় যে, বের হয়ে গেলে কেউ আর ফিরবে কি না ঠিক থাকে না। কেউ ওকে, সোমা ডাকছে বলে, ডেকে নিয়ে গেল না তো! আজকাল তো এ—ভাবেও অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। বিনু চলে গেল। ওকে আর দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে এমন অরাজকতার ভিতর বিনু কেন যে এত সকালে বের হয়ে গেল। জানলায় মার মুখ দেখলে এ—ছাড়া এখন আর কিছু মনে হবে না। সংসারে বিনুই ওদের পারাপারের কড়ি। সে না থাকলে সংসারের কী হতে পারে, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।

বিনু সোমাদের গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। সব ঠিকঠাক আছে। রসুল গেটে পাহারা দিচ্ছে। সেই মাধবীলতার গুচ্ছ গুচ্ছ নীলাভ পাতাসকল চারপাশে দেয়ালের, সেই মারবেল বিছানো পথ, সেই ইউক্যালিপটাসের গাছ আর সেই কামিনী ফুলের গাছ, শীতের সময়, এবং শীতকালীন রোদে একটা ভারি মনোরম আমেজ আছে। একটা শীতের কাক পর্যন্ত ডাকছে দেয়ালে। দুটো একটা শালিক পাখিও সে দেখতে পেল। কেবল মনে হচ্ছিল, দু’জনের পক্ষে এটা সত্যি খুব বড় বাড়ি। ও—পাশে গ্যারেজ। সে ভেবেছিল, কোনো একটা খুন—টুনের ব্যাপার হবে। কিন্তু এমন নিরিবিলি এতবড় বাড়িটা দেখে, সে বুঝতে পারছে না, কী হয়েছে! সে ভিতরে ঢুকল, রসুল উঠে সেলাম দিল। বিনু ভাবল একবার রসুলকে জিজ্ঞাসা করবে, কিন্তু এ—বাড়ির আভিজাত্যের খবর সে রাখে। ভিতরে কী হচ্ছে না হচ্ছে, ওরা সহজে জানতে পারে না। জানতে পারলেও না—জানার ভান করে থাকে। খুব নিজের লোক না হলে কিছু প্রকাশ করে না। বিনুকে রসুল দুবার কী তিনবার বেশি হলে দেখেছে। সুতরাং রসুলের কাছেও কোনো খবর সে পেতে পারে না। সে প্রায় ছুটে নুড়ি—বিছানো পথের ওপর দিয়ে বের হয়ে গেল এবং কাঠের সিঁড়ি প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেল। কিন্তু লম্বা করিডোরে কেউ নেই। খাঁ খাঁ করছে যেন। সে দেখেছে এখানে এই করিডোরে এলেই কেউ—না—কেউ দাঁড়িয়ে থাকে ওকে ভিতরে নিয়ে যাবার জন্য। এবং এমন অবস্থায় পড়লে ঘাবড়ে যাবার কথা। সে এখন কী করবে ভেবে পেল না।

আর তখনই দেখল, সোমা শীতের চাদর গায়ে কেমন পীড়িত চোখে মুখে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এতবড় বাড়িতে এভাবে না হাঁটলে বুঝি সৌন্দর্য বাড়ে না। সোমা এই সকালেও সুন্দর করে সেজে বসে আছে, ওর চুলে কোনো অন্যমনস্কতা নেই, পরিপাটি করে চুল বাঁধা। সোমা কী সকালে উঠেই চুল বাঁধতে বসেছিল। সোমা যে গতকাল খুব সুন্দর করে সেজে বসেছিল, মনীষ ফিরলেই অনন্ত জলরাশি আছে পৃথিবীতে, সেই জলরাশিতে অবগাহন কী যে আরামের এবং লম্বা বিছানায়, সাদা চাদরে সোনালি ফুল ফল আঁকা চাদরে কেবল সাঁতার কাটা এবং নরম বিছানার সঙ্গে কেবল মিশে যাওয়ার জন্য এ—মেয়ে যে গতকাল সেজে বসে থেকে সারারাত প্রতীক্ষায় ছিল, মনীষ ঠিক ফিরবে, ফিরছে, অনেক রাতে ওর মনে হল মনীষ ফিরছে না, টেবিলে একটা চিঠি, চিঠিটা আবিষ্কারের পর সে চুপচাপ সারারাত একই জায়গায় বসেছিল। নিথর। টেবিল থেকে এই সকালে মাত্র সে ফোন তুলে এক এক করে সবাইকে ফোন করছে। প্রথমে বিনুর পালা।

বিনুকে দেখে সোমা বলল, আয়।

বিনু পার্লারে ঢুকে গেল সোমার সঙ্গে।

বিনু বলল, কী ব্যাপার বলতো!

বোস।

বিনু বসল। সোমাও ধীরে ধীরে বসল। সোমা বিনুকে অপলক দেখছে। এত বেশি বিনুকে দেখছে, যে বিনুর ভীষণ সংকোচ হচ্ছিল। যেন এই যে সর্বনাশ ঘটেছে, কী সর্বনাশ সে এখনও জানে না, তবু একটা কিছু যখন ঘটেছে, তার জন্য দায়ী বিনয়, এবং বিনয়ের দিকে এমন একটা চোখেই যেন তাকিয়ে আছে সোমা। কিছু বলছে না।

বিনু বলল, মনীষ কোথায়?

সোমা বলল, বোস বলছি।

সোমা, মনে হয় কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না, অথবা কোথা থেকে আরম্ভ করবে বুঝতে পারছে না। সে বলল, আমি কীভাবে আরম্ভ করব ঠিক বুঝতে পারছি না।

বিনু বলল, কী হয়েছে বলবি তো!

সোমা ধীরে ধীরে বলল, মনীষ চলে গেছে।

কোথায়!

জানি না।

কিছু বলে যায়নি!

না।

কবে গেল?

কাল!

কাল কখন!

রাতে। আর ফিরে আসেনি। টেবিলে চিঠি। আমি চলে যাচ্ছি। বলে চিঠিটা বিনুকে পড়তে দিল।

বিনু চিঠিটা পড়ল। বিনু পাজামা পাঞ্জাবি পরেছিল। সে সেই পরে চলে এসেছে। দুদিন পরেছে বলে খুব চাকচিক্য নেই জামাকাপড়ে। তবু বিনুর চোখেমুখে কী যেন আছে, যা দেখলে খুব নিজের মানুষ মনে হয়। সব সহজেই বলা যায়। বিনু পড়ে বলল, খুব ছেলেমানুষ তো!

তুই বল বিনু, এটা ছেলেমানুষী না!

আপাত তাই মনে হচ্ছে। ওকে কী কেউ ভয়—টয় দেখিয়ে ছিল?

সোমা ভাবল বলবে কী বলবে না। কিন্তু একজনকে তো বলতেই হবে। বিনু বাদে তার এ—মুহূর্তে নিজের কে আছে! বিনু অথবা অসিতবাবুর পরামর্শমতো চলা দরকার। পুলিশে খবর দিতে হবে কিনা তাও পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। অসিতবাবু মনীষের বন্ধু। মনীষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি। ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কম। মানুষটাকে মনীষ যত জানে, সে ঠিক ততটা জানে না। বরং বিনুকে সোমা অসিতের চেয়ে ভালো জানে। বিনু কখনও অপকার করতে পারে না। তাকেই সব খুলে বলা যেতে পারে।

বিনু বলল, সেই লোকটার খবর পেলি!

সোমার যেন খুব শীত করছে। সে চাদরটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিল। কিন্তু তাতেও শীত যাচ্ছে না। সে বলল, বিনু আয় আমরা সামনের করিডোর পার হয়ে পুবের ছাদে গিয়ে বসি। সেখানে বোধহয় এতক্ষণে রোদ এসে গেছে।

সোমা এবং বিনু সোমার শোবার ঘর অতিক্রম করে ছাদে চলে এল। এতবড় শোবার ঘর কেউ ব্যবহার করে পৃথিবীতে! এবং এমন সব ছবি, ছবিগুলো সব অদ্ভুত ধরনের, ছবিগুলো সব ন্যুড এবং ছবিগুলো দেখলে মাথায় রক্ত উঠে আসে অথবা এক লহমায় উত্তেজনা। এ—সব ছবি দেখলে তো মানুষের ভেতর এমনিতেই সবসময় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার কথা, ওরই তো শরীর কেমন করছে, অথচ সোমা নির্বিকার! যেন ওতে কিছু নেই। ব্যবহারে ব্যবহারে সোমা কিছুটা ভোঁতা হয়ে গিয়ে থাকবে! তা না হলে, সোমা কিছুতেই এ—ভাবে এখানে নিয়ে আসতে পারত না। অথবা মনীষের জন্য মাথা ঠিক নেই। ওর খেয়ালই নেই, এ—ঘরে পৃথিবীর দুজন মানুষ ঢুকতে পারে, মনীষ দত্ত এবং সোমা দত্ত তাদের নাম। আর ঢুকতে পারে মনোরমা।

সোমা বলল, পেলাম না।

বিনু বলল, আসলে তোর মনের ভুল এটা।

এখন আমারও মনে হয়।

তুই কাউকে ও—ভাবে জানিস না।

কিন্তু চোখ দুটো যে বড় চেনা!

তাই হয়। আসলে কী জানিস! বলে বিনু বেতের চেয়ারে বেশ আরামে হেলান দিল। চাদর ভালো করে জড়িয়ে নিল শরীরে। সামনে একটি টিপয়। সাদা ঝালরে ঢাকা এবং মীনা করা, মনে হয় হাতির দাঁতের কারুকার্য আছে ওতে। সে চায়ে চুমুক দিল।

সোমা চায়ে চুমুক দিল না। হাতে নিয়ে বসে থাকল। আসলে কী জানিস—তারপর বিনু কী বলবে শোনার প্রতীক্ষাতে সে উদগ্রীব। বিনু কিছু না বলা পর্যন্ত সে চা খেতে পারছে না।

বিনু বলল, আসলে কী জানিস, আমরা মনে মনে যা ভাবি তা পাই না।

সোমা বলল, মানে!

মানে এই দ্যাখ না, কত আশা ছিল আমার। পৃথিবী জয় করব আশা ছিল, কিন্তু হল কোথায়! এখনও কিন্তু ভাবি, ঘরে ফিরেই একটা চিঠি পাব। মনে হয় কেউ আমাকে একটা চিঠি দেবে, তা পেয়ে আমি আঁৎকে উঠব, এবং সেখানে আমার রাজ্য জয়ের খবর থাকবে। প্রতিদিন এভাবে কেটে যাচ্ছে, চিঠি আসছে না, তবু রোজ ভাবি চিঠি আজ হোক কাল হোক আসবে।

সোমার এতসব কথা ভালো লাগছিল না। সে সোজা বুঝতে চাইছিল। রহস্যটা কোথায়! কিন্তু বিনু এমনভাবে নিজের কথা বলছে যে, সে যেন তার নিজের কথা শোনাতে এসেছে এখানে। সোমার যে এমন একটা বিপদ তা আমলই দিচ্ছে না। মনীষের এটা ছেলেমানুষী ভাবছে। সেও কথার পিঠে কথায় সায় দিয়ে গেছে, ছেলেমানুষী বলে। কিন্তু পর পর যা ঘটনা একে একে ঘটে গেছে, এবং যেভাবে ওরা ক্রমে অস্থির হয়ে উঠেছিল, তাতে যে—কোনো মানুষের পক্ষে পাগল হয়ে যাওয়া সম্ভব। সে বলল, তোকে সব বলিনি বিনু। শুনলে কিন্তু আর সমাধান খুঁজে পাবি না।

বিনু বলল, সমাধান নেই এমন ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে না। বলে কেমন দার্শনিক চোখে তাকিয়ে থাকল বিনু।

সোমা তারপর সব ঘটনা খুলে বলে একে একে প্রশ্ন করে গেল, চিঠিটার ব্যাপারে কী মনে হয়!

বিনু বলল, চিঠির ব্যাপারে তোকে আগেও বলেছি।

সবই এত সরল তুই ভাবিস! এত সহজে সমাধান! সোমা ভাবল, আসলে বিপাকে পড়েছে সোমা, কাজেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। যে—ভাবেই হোক ওকে বোঝানো যত সহজ ভাবছে বিনু, ব্যাপারটা, তত সহজ নয়। সে বলল, জানিস একরাতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে!

বিনু খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল, কী!

মনে হল, আমার সেই মানুষটি, বড় মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং সোমা সে রসুলকে নিয়ে এক রাতে বের হয়েছিল সে কথাও বলল। তারপর সেই বৃদ্ধ মানুষের খবর, তার আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকা, কেউ তার কাছে আসে, খড়কুটো দিয়ে যায় তাও বলল। সোমা বলল, আমার মনে হয়েছিল, সেই লোকটাই অঞ্জন।

বিনু খুব অনায়াসে বলে ফেলল, তা হতে পারে।

কিন্তু তারপরের ব্যাপারটা কী হবে!

সেটা আবার কী?

এসে দেখলাম গাড়ি বারান্দার ছাদে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

তা থাকতে পারে!

কী করে!

অন্য কেউ কি গাড়ি বারান্দার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না?

ভোর রাতে কে আসবে।

তোমার বাড়িতে মানুষের তো অভাব নেই।

কেউ তো স্বীকার করল না।

স্বীকার না করলেই দাঁড়াবে না সে কথা কে বলল!

এমন সহজ কথা স্বীকার করতে ক্ষতি কী!

সোমা ভাবল কত অনায়াসে সমাধান বিনুর। আসলে বিনু মানুষটাই এ—স্বভাবের। সহজে সবকিছু ভেবে নেওয়ার স্বভাব। সে বলল, বাড়িতে এতসব ঘটনা একের পর এক ঘটছে, আর কেউ আর একটা নতুন ঘটনা ঘটিয়ে ব্যাপারটাকে আরও ঘোরালো করে তুলবে আমার বিশ্বাস হয় না।

বিশ্বাস সহজে কিছু হয় না। তোমার বাড়িতে মনোরমা আছে, রসুল আছে, রামঅবতার না কে আছে, মালিরা আছে। মনোরমার সঙ্গে একটা সম্পর্ক যে তোমাদের অগোচরে কেউ ঘটায়নি সে কে বলবে।

বুঝতে পারছি না। বলে সোমা তার চাদর দিয়ে শরীর যেন আরও ঢেকে দিল। পুবের বারান্দার মতো ছাদের এ অংশটা। বেশ শীতের রোদে ওরা দুজনই বেশ উষ্ণতা ভোগ করছে। কারও এখন বিশেষ শীত করছে না। সোমা বলল, অবাক!

অবাক হবার কিছু নেই। তুমি বাড়ি নেই, মনীষ ভয়ে কাতর, রামঅবতার অথবা তোমাদের মালিদের কেউ সে—সময় মনোরমার ঘরে যায়নি এবং তোমার ফিরে আসার খবর পেয়ে বের হয়ে আসেনি, গাড়ি বারান্দায় একপাশে অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে নিজেকে গোপন করেনি কে বলবে।

সোমা কিছুক্ষণ আর কথা বলতে পারেনি। হতে পারে। এমন একটা ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে কেউ স্বীকার করবে না বুঝতে পারে। সে বলল, তবে সেই বাথরুমে….।

বাথরুমে মানে!

বাথরুমের আয়নায় দেখলাম, ঠিক সেই চোখ দুটো, আমি যেমন যেমন ভাবে অঞ্জনকে ভেবেছি, ঠিক হুবহু সেই মানুষটা আয়নায় দাঁড়িয়েছিল।

তা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে বইকি!

এবারে সোমা ভীষণ অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। সে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ ঝুঁকে বলল, দাঁড়িয়ে থাকতে পারে মানে! কী বলছিস সব!

তুই ভীষণ উত্তেজিত সোমা। তোর মাথায় সবসময় সেই চোখদুটো, সেই মানুষের হুবহু ছবি চলাফেরা করছে। তোর একটা ইলিউসান দেখা অস্বাভাবিক না।

সোমা বলল, তুমি কি আমাকে গ্রাম্য বালিকা ভেবেছ বিনু! তুমি কী বলতে চাও বুঝি না। ওরা এখন তুমি তুমি করে কথা বলছে। গুরুত্বপূর্ণ কথার সময় এটা বোধহয় হয়।

আসলে সোমা, এবার বিনুও উঠে দাঁড়াল, আমরা সবাই শৈশবে নানাভাবে স্বপ্ন দেখে থাকি। তোমার শৈশবেও স্বপ্ন ছিল। সব মানুষের স্বপ্ন এক রকমের থাকে না। তোমার শৈশবে কী স্বপ্ন ছিল বললে, ব্যাপারটা আরও সহজ করে বোঝানো যেতে পারে।

শৈশবে আমি একটা প্রতিশোধের কথা ভাবতাম কেবল। বাবার আত্মহত্যার কথা মনে হলেই এটা মনে আসত।

বিনু বলল, তোমার বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন!

সোমা এমন গোপন পারিবারিক কথা এত অনায়াসে বলে ফেলে অবাক। কেউ জানে না, কেবল শৈশবে সেই দুঃখের দিনে যারা তার চারপাশে ছিল ওরা জানত। সে যে বিনুকে কোনোদিন কথাটা বলেনি, কেবল বিনু কেন, মনীষও জানে না, সেই আত্মহত্যারখবর, তার মা একজন ধনী ব্যক্তির রক্ষিতা, এ—সব খবর সে কাউকে বলেনি, বলেছে বলে অন্তত এই মুহূর্তে মনে করতে পারছে না, সে বলল, বিনু তুমি যখন সব জেনেছ এটা না জানলে বাকিটুকু বুঝতে পারবে না। আসলে বাবা আমার খুব দুঃখী লোক ছিল। মা ছিলেন ভীষণ সুন্দরী এবং বাবার আত্মহত্যার মূল কারণ ছিল সেই ধনী ব্যক্তির লোভ এবং মার নিদারুণ অসহায় মনোভাব। তুমি জানো না হয়তো আমার মাকে পাবার জন্য নানাভাবে একটা সামাজিক চাপ ছিল বাবার প্রতি। সেই অসাম্য চাপের বিরুদ্ধে আমার ভীষণ বিদ্রোহ ছিল। আমি চাইছিলাম কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়াবে, সে আমার সঙ্গে একটা জয়েন্ট কমান্ডো তৈরি করবে। একজন সৎ মানুষের কথা সবসময়ই ভাবতাম। এবং মনে হত, সেই মানুষ আমাকে বারবার বলেছে, তুমি সোমা কাজল পর না। আমি এতদিনে মনে করতে পারছি কে আমার মনের মানুষ। কাজল পরলে সঠিকভাবে পৃথিবীকে চেনা যায় না। বলতে বলতে সোমা কেমন হাঁপিয়ে উঠল। সে আর বোধহয় দাঁড়াতে পারছিল না। সে সোফাতে নিদারুণ দুঃখী যুবতীর মতো বসে থাকল। মাথার ওপর এতবড় আকাশ রয়েছে, শীতের সময় বলে বাগানে কত রক্ত—গোলাপ, আর চারপাশে নিরিবিলি সব গাছপালার ভিতর এক আশ্চর্য মহিমা আছে সে বুঝতে পারছে না।

বিনু বলল, তাহলে তোমার নিজের কথাতেই আসা যাক। তুমি এ—ভাবে একজন মনের মানুষ চেয়েছিলে পাওনি। বরং উলটো এমন একজন তোমার কাছে হাজির যাকে তুমি চাওনি। বলে একটু থামল। কী ভাবল।—আচ্ছা সেদিন যাকে বাথরুমে দেখেছিলে সে দেখতে কেমন।

ভারি সুন্দর।

তুমি সোমা এমন একজন মানুষকেই চেয়েছিলে সঙ্গে। কিন্তু মানুষের দোষ কতভাবে যে থাকে। তাকে তুমি পাওনি, না পেয়ে ভালোই হয়েছে। পেলে তার দাম থাকত না। সারাদিন তুমি তবে আরও একাকী থাকতে। সে একাকিত্ব আরও মারাত্মক।

সোমা কিছুক্ষণ কথা না বলে একটু নিজের ভিতর ফিরে আসতে পেরে বলল, তবে চিঠিটা!

চিঠিটার কথা তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি ভয় পাইয়ে দেওয়া।

তবে তুমি বলছ, এই যে হত্যাকাণ্ড সব ঘটছে এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।

আমার মনে হচ্ছে, না।

আর ঠিক সে—সময়ই ফোনে কে যেন সোমাকে চাইছে।

সোমা উঠে গিয়ে ফোনে কী শুনতে শুনতে টেবিলে মূর্ছা গেল। বিনু ছুটে গেল টেবিলের কাছে। সে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল, কে? সোমা টেবিলের ওপরই পড়ে আছে। সে ফের বলল, হ্যালো, কে বলছেন! এবং সে বুঝতে পারল পুলিশ অফিস থেকে ফোন। কেউ যেন বলছে, মনীশ দত্তের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলাম, আপনি কে!

সে বলল, মনীশ দত্তের স্ত্রী মূর্ছা গেছে।

তবে শুনুন। একটা লাশ পাওয়া গেছে। ব্যান্ডেলের কাছে রেললাইনের ধারে পাওয়া গেছে। ওর ডায়রি থেকে সব খবর জেনে ফোন করছি।

বিনুর হাত কাঁপছিল। সেও বোধহয় মূর্ছা যেত। সে বলল, আপনাদের ঠিকানা!

লালবাজার, স্পেশাল স্কোয়াডে খবর নেবেন।

বিনু এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। সে প্রথমে সোমাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে চিৎকার করে ডাকল, রসুল! মনোরমা!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *