Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দুঃস্বপ্নের রাত || Mayukh Chowdhury

দুঃস্বপ্নের রাত || Mayukh Chowdhury

দুঃস্বপ্নের রাত

আমি চললুম। জাঙ্গাতে থাকব এবং তোমার জন্য ওইখানেই অপেক্ষা করব। কোনো কারণেই এখানে অপেক্ষা করবে না–সোজা চলে এসো জাঙ্গাতে। সব লেখা চলে না। দেখা হলে সব কিছু খুলে বলব।

প্রায় দিন দুই আগেকার তারিখ-বসানো চিঠির উপরে বা নীচে কোনো সম্বোধন বা স্বাক্ষর নেই, মাটির দেয়ালের গায়ে পিন দিয়ে আটকানো অবস্থায় ঝুলছে!

স্বাক্ষর বা সম্বোধন না-থাকলেও হাম্বার সাহেব বুঝলেন, চিঠিটা লিখেছেন তার বন্ধু মলিনাক্স। পূর্বব্যবস্থা অনুযায়ী মাটির তৈরি এই রেস্ট হাউস বা বিশ্রাম-আগারটিতেই মলিনাক্স বাস করছিলেন এবং এখানেই তাঁর থাকার কথা।

হঠাৎ তিনি মত পরিবর্তন করলেন কেন? গ্রামের ভিতর শ্বেতাঙ্গদের উপযোগী কোনো বাসস্থান যখন নেই, তখন এমন চমৎকার বিশ্রামাগারের আরাম ছেড়ে মলিনাক্স হঠাৎ কেন জাঙ্গা গ্রামে চলে গেলেন?

চিঠিতে এই মত পরিবর্তনের কার্যকারণ কিছুই উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেননি মলিনাক্স। হাম্বারের মস্তিষ্ক তাই উত্তপ্ত হয়ে উঠল।

তবে যতই রাগ হোক, বন্ধুর সঙ্গে দেখা তো করতেই হবে। বিশ্রামাগারে একটুও বিশ্রাম না-করে হাম্বার সাহেব সেই জাঙ্গা নিগ্রো-পল্লির দিকে সবেগে পদচালনা করলেন।

সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বেরই নয়, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যের প্রশ্নও জড়িত ছিল। হাম্বার এবং মলিনাক্স নাইজিরিয়ার এই অঞ্চলে এসেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানের বেতনভোগী কর্মচারী হয়ে, অতএব রাগ হলেও দেখা না-করে উপায় ছিল না।

জাঙ্গা গ্রামে গিয়ে বন্ধুর দেখা পেলেন হাম্বার। একটা কুঁড়েঘরের ভিতর বসে মলিনাক্স বিশ্রাম করছেন। হাম্বার দেখলেন বন্ধুর চোখে-মুখে স্পষ্ট অবসাদের চিহ্ন। চিঠিতে স্থানত্যাগের কার্যকারণ না-লিখে হঠাৎ চলে আসার জন্য হাম্বার একটু বিরক্তি প্রকাশ করতেই মলিনাক্স বাধা দিয়ে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু বিশ্বাস করো, ওখানে আর একটি রাতও কাটানো সম্ভব ছিল না। সারারাত ধরে সেদিন যে কী ভীষণ উদবেগ আর দুশ্চিন্তায়

অসহিষ্ণু কণ্ঠে হাম্বার বললেন, তোমার মানসিক অবস্থার বিশ্লেষণ শুনতে চাই না। আসল কথাটা বলো। কী হয়েছিল?

-বলছি।

.

মলিনাক্সের সে-কাহিনি শোনার আগে পূর্ববর্তী ঘটনা একটু জানা দরকার। হাম্বার ও মলিনাক্স নামক এই দুজন শ্বেতাঙ্গ একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাইনিং ডিপার্টমেন্ট বা খনিজ বিভাগে কাজ করেন। খনিজ বিভাগের দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কর্মচারীরা কাজ করেন জোড়ায় জোড়ায় হাম্বার আর মলিনাক্স ছিলেন ওইরকম এক মানিকজোড়। আফ্রিকার অন্তর্গত নাইজিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে দুই বন্ধু নানারকম খনিজ দ্রব্যের অনুসন্ধান করেন। কখনো সাফল্যের আনন্দ, কখনো-বা ব্যর্থতার আক্ষেপ নিয়ে সুখে-দুঃখে তাদের দিনগুলো ভালোই কাটছিল।

নাইজিরিয়ার জারিয়া প্রদেশ পরিদর্শন করে হাম্বারের ধারণা হল, এখানে বোধ হয় অভ্রের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং তার আরও কয়েক দিন সেখানে থাকা দরকার। মলিনাক্স রওনা হলেন জাঙ্গা নামক হওসা জাতীয় নিগ্রো-পল্লির দিকে। জাঙ্গার নিগ্রো-পল্লির বাইরে একটা সুন্দর রেস্টহাউস বা বিশ্রাম-আগার আছে। দুই বন্ধুর মধ্যে ব্যবস্থা হল যে, ওখানেই আশ্রয় গ্রহণ করবেন মলিনাক্স এবং জারিয়া থেকে হাম্বারের প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত ওইখানেই অপেক্ষা করবেন।

হাম্বারের অনুমান নির্ভুল, অভ্রের সন্ধান পাওয়া গেল জারিয়াতে। তবে জমির অবস্থা দেখে তিনি বুঝলেন, ডিনামাইট, ড্রিল প্রভৃতি সাজসরঞ্জাম না হলে কাজ করা সম্ভব হবে না। প্রতিষ্ঠানের প্রধান দপ্তর তখন জাঙ্গাতে। অতএব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি সংগ্রহের জন্য হাম্বার জাঙ্গাতে ফিরে এলেন।

নির্দিষ্ট স্থানে বন্ধুর দেখা পেলেন তিনি। বিশ্রাম-আগারটিও দেখলেন। তাঁর বেশ ভালাই লাগল। মাটির তৈরি বৃত্তাকার ঘরটি বিশ ফিট জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে। জানালা-দরজা নেই, দরজার পরিবর্তে মাটির দেয়ালে দুটো মস্ত ফাঁক হাঁ করে আছে এবং ফাঁক দুটো কাটা হয়েছে। পরস্পরের বিপরীত দিকে। বাঁশের তৈরি একজোড়া মাদুর ঝুলিয়ে ফাঁক দুটিকে ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। রৌদ্রদগ্ধ নাইজিরিয়ার তপ্ত বায়ু বিশ্রাম-আবাসের মধ্যস্থলকে উত্তপ্ত করতে পারে । ঘাসপাতা আর বাঁশের আচ্ছাদনের নীচে মাটির ঘরের শীতল অভ্যর্থনা সত্যি লোভনীয়।

সব দেখেশুনে হাম্বারের ধারণা হল, মলিনাক্স সহজে এখান থেকে নড়বেন না। মলিনাক্সও জানিয়ে দিলেন, বন্ধুর অনুমান সত্য।

খুব কাছাকাছি কয়েকটা শুষ্ক নদীর বুকে কিছু মূল্যবান খনিজ দ্রব্যের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে মলিনাক্স আশা করছেন এবং ওই জায়গাগুলির উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখতে হলে এই রেস্ট-হাউসের মতো আরামদায়ক আস্তানা আর কোথায় পাওয়া যাবে?

তা ছাড়া আর একটা কারণও আছে, মলিনাক্স বললেন, কাছেই একটা সিংহ আছে। আমি দেখেছি। ওটাকে মারব।

সিংহ?হাম্বার হেসে উঠলেন, এ-অঞ্চলে সিংহ নেই। যে-জন্তুটাকে তুমি সিংহ মনে করছ, আসলে সেটা হয়তো লেপার্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।

আরে, না, না, মলিনাক্স জোর দিয়ে বললেন, আমি সিংহই দেখেছি। স্থানীয় বাসিন্দারা সবাই ওটার কথা জানে। জন্তুটা বড়োই উপদ্রব চালাচ্ছে–গাঁয়ের ভিতর থেকে কুকুর আর ছাগল নিয়ে যাচ্ছে, একটি লোককে সেদিন এমনভাবে জখম করেছে যে, সে বেচারা বাঁচে কি না সন্দেহ। জানোয়ারটাকে কোনোভাবেই মারা যাচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, ওটা কোনো জাদুর আওতায় আছে। জন্তুটাকে যদি পারি তো আমিই মারব। যেদিন ওটাকে দেখেছিলুম, সেদিন আমার কাছে বন্দুক ছিল না।

হাম্বারের আগ্রহ দেখে সেদিনের ওই সিংহ-দর্শনের ঘটনাটি খুলে বললেন মলিনাক্স।

জাঙ্গার নিগ্রো-পল্লির কাছে দুই মাইলের মধ্যে একটা নদী আছে। নদী এখন প্রায় শুকনো, সামান্য জলের ধারা দেখা যায়। একদিন সকালে নদীতীরের বালুকাময় ভূমি পর্যবেক্ষণ করে মলিনাক্সের সন্দেহ হল, বালির মধ্যে হয়তো সোনার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। বালি পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত সরঞ্জাম অর্থাৎ গোল্ডপ্যান নিয়ে তিনি বিকেল বেলার দিকে যথাস্থানে উপস্থিত হলেন। মলিনাক্সের সঙ্গী হল দুটি চাকর এবং তাঁরই পোষা কুকুর দুটো। কুকুর হিসাবে তারা কিন্তু মোটেই ফেলনা নয়। একটি হচ্ছে ভয়ংকর বুলমাস্টিফ, অপরটি বর্ণসংকর হলেও তার রক্তে ছিল বিলাতি কুকুরের আভিজাত্য।

নদীর ধারে লম্বা লম্বা ঘাস ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছেন মলিনাক্স, হঠাৎ বিপরীত দিকে নদীর পাড়ের ওপর একটি সচল বস্তু তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

সিংহ!

হ্যাঁ, সিংহই বটে!

প্রায় চল্লিশ ফিট দূরে গুঁড়ি মেরে বসে আছে একটা মস্ত সিংহ! তার জ্বলন্ত চক্ষুর হিংস্র দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে মলিনাক্সের দিকে এবং সুদীর্ঘ লাঙ্গুলটি পাক খেয়ে দুলে দুলে উঠছে দারুণ আক্রোশে।

পরক্ষণে সিংহের রক্তিম মুখগহ্বরের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করল তীক্ষ্ণ দন্তের সারি! মলিনাক্সের সর্বাঙ্গে ঘামে নেয়ে উঠল।

তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু নড়লেই সিংহ আক্রমণ করতে পারে। তার বন্দুকটাও হাতে নেই, অনেক পিছনে একটা চাকর সেটা বহন করে আনছে এবং কুকুর দুটিও রয়েছে প্রায় এক-শো গজ দূরে।

এই জীবন-মরণ সংকটে মলিনাক্স কী করবেন, স্থির করতে পারছেন না, এমন সময় আশ্চর্য ব্যাপার! সিংহটা হঠাৎ এক লাফ মেরে নদীর নিকটস্থ ঘন ঘাসঝোপের জঙ্গলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। অত্যন্ত অবাক হলেন মলিনাক্স।

আমি ভাবতেই পারিনি যে, ওখানে একটা সিংহ থাকতে পারে আর সে এমনিভাবে পালিয়ে যাবে, বন্ধুকে উদ্দেশ করে বললেন মলিনাক্স, জন্তুটার গায়ের রং নদীর তীরের বালির সঙ্গে এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে, আমি সিংহের অস্তিত্ব বুঝতেই পারিনি। শুধু লেজটা নড়ছিল বলেই তার দিকে আমার দৃষ্টি পড়েছিল। জন্তুটার কেশর নেই। প্রথমে ভেবেছিলুম ওটা সিংহী। কিন্তু ভালোভাবে নজর করে দেখলুম, নাঃ, সিংহই বটে! সঙ্গেসঙ্গে মনে পড়ল, নাইজিরিয়ার এসব অঞ্চলে সিংহদের মাথায় কেশর থাকে না।

ঘটনাটা বিবৃত করে মলিনাক্স শেষে বললেন, বুঝলে বন্ধু, একটু চেষ্টা করলে সিংহটাকে বোধ হয় আমরা মারতে পারি। কি বল?

আফ্রিকার জঙ্গলে ইতিমধ্যে তাদের গুলি খেয়ে ইহলীলা সংবরণ করেছে কয়েকটা লেপার্ড, জলহস্তী, কুমির ও অ্যান্টিলোপ। তবে বনের রাজা সিংহের উপর গুলি চালানোর সুযোগ তাদের একবারও হয়নি।

পেশাদার শিকারি না হলেও শিকারের শখ দুজনেরই আছে। তাই বন্ধুর প্রস্তাবে সঙ্গেসঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন হাম্বার। কয়েকদিন পর পর রাত্রিবেলা গ্রামের নিকটবর্তী অরণ্যে একটা ছাগল বেঁধে গাছের উপর রাইফেল হাতে সিংহের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন হাম্বার ও মলিনাক্স। কিন্তু রাত্রি জাগরণই সার হল–পশুরাজ ছাগ-মাংসের লোভে শিকারির ফাঁদে পা দিল না। এমনকী ধারেকাছেও এল বলে মনে হয় না।

এ ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দারা কিন্তু মোটেই অবাক হল না। তাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস, মায়াবী সিংহ আগে থেকেই সব জানতে পারে। দুই বন্ধু কিন্তু খুবই হতাশ হলেন। হাম্বার চলে গেলেন জারিয়ায় তার কার্যস্থলে। আর মলিনাক্স বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন পূর্বোক্ত। বিশ্রাম-আগারে। কথা রইল, কাজ শেষ হলে হাম্বার ওইখানে এসে। বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হবেন।

কিন্তু দিন কয়েক পরে যথাস্থানে। এসে মলিনাক্সের চিঠি দেখে হাম্বার : তো হতভম্ব! কী ব্যাপার?

এইবার শুরু হল মলিনাক্সের বিবরণ।

সেদিনকার দুঃস্বপ্নে ভরা রাত্রির সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ঘটনা তিনি বন্ধুকে বলতে শুরু করলেন :

বৃহস্পতিবার রাত্রি। চাকররা আলোর ব্যবস্থা করে জাঙ্গা গ্রামে ফিরে গেছে। আমি রাতের আহার সারলুম বিশ্রাম-আগারের বাইরে, কারণ ঘরের মধ্যে গরমে অস্বস্তি বোধ করছিলুম। বিশ্রাম-আগারের কাছেই যেখানে রান্না হয়, সেই কুঁড়েঘরটা তুমি দেখেছ। আমার কুকুর দুটো সেই রান্নাঘরের ভিতর তাদের বরাদ্দ খাদ্যে ক্ষুধা নিবৃত্তি করছে। আমি বিশ্রাম-আগারের ভিতর একটা বই নিয়ে বসলুম। অবশ্য বইয়ে মনোনিবেশ করার আগে বাঁশের তৈরি পর্দা ফেলে ফাঁক দুটি ঢেকে দিতে ভুলিনি…

হঠাৎ ঘরের বাইরে মাটির ওপর শুষ্ক ঝরা পাতার বুকে জাগল মর্মরধ্বনি। পরক্ষণেই পর্দার তলা দিয়ে তিরবেগে ঘরে ঢুকল আমার দুটি কুকুর!

দারুণ আতঙ্কে জন্তু দুটোর উদ্ধত লাঙ্গুল আশ্রয় নিয়েছে পিছনের দুই পায়ের ফাঁকের মধ্যে। আর কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে আসছে অবরুদ্ধ আর্তনাদ!

কুকুর দুটো ঘরের ভিতর প্রবেশ করার সঙ্গেসঙ্গেই শুনতে পেলুম একটা গুরুভার জীবের ধাবমান পায়ের আঘাতে মাটির উপর থেকে সশব্দে উড়ে যাচ্ছে ঝরা পাতার রাশি।

অদৃশ্য আগন্তুক সশব্দে পর্দা-ঝোলানো ফাঁকটার পিছনে এসে থেমে গেল। পরক্ষণেই বজ্রপাতের মতো গম্ভীর গর্জনে কেঁপে উঠল ঘরটা!

কণ্ঠস্বরেই অন্ধকারে অদৃশ্য জীবটির পরিচয় পেলুম–সিংহ!

দারুণ আতঙ্কে কুকুর দুটো ছুটে এসে ঘরের মাঝখানের খুঁটির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। রাইফেলের সন্ধান করতে গিয়েই চমকে উঠলুম। মনে পড়ল, অস্ত্রটাকে খুলে তেল দিয়ে বাক্সবন্দি করা হয়েছে এবং তৈলসিক্ত অবস্থায় আমার রাইফেল বন্ধুটি এখন চামড়ার বাক্সে বিশ্রাম করছে বিশ্রাম-আগারের বাইরে!

সর্বনাশ! এখন উপায়?

আবার, আবার জাগল সেই হিংস্র শ্বাপদকণ্ঠের ভয়াবহ গর্জনধ্বনি! বদ্ধ কুটিরের ভিতর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে সেই প্রচণ্ড শব্দতরঙ্গ নিশ্চিত মৃত্যুর কণ্ঠস্বরের মতোই আমার কানে এসে বাজল। পর্দা-ঝোলানো ফাঁকটার যেদিক থেকে গর্জনটা ভেসে এল, তার বিপরীত দিকের পর্দা লক্ষ করে ছুটল কুকুর দুটো। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, আতঙ্কে অস্থির হলেও কুকুর দুটোর বুদ্ধি-ভ্রংশ ঘটেনি।

উলটো দিকের ফাঁকটার কাছাকাছি এসেই তারা থমকে দাঁড়াল। জানোয়ারের সহজাত সংস্কারের বশেই তারা বুঝেছিল, আলোকিত ঘরের বাইরে অন্ধকারের মধ্যে বিপদের সম্ভাবনা আছে।

কুকুর দুটো ভালোই করেছিল।

মুহূর্ত পরেই বিশ্রাম-আগারের বাইরে ধাবমান পদধ্বনি জানিয়ে দিল যে, পশুরাজ উলটো দিকের ফঁক লক্ষ করে ঘুরে আসছে।

আমি এবার শটগান হাতে নিলুম। এ ধরনের বন্দুক সিংহ-শিকারের উপযুক্ত নয় সন্দেহ নেই, কিন্তু রাইফেল না-থাকায় বাধ্য হয়ে শটগানটাকেই বাগিয়ে ধরলুম। মনে করলুম, সিংহ যদি ঘরের ভিতর ঢোকে, তবে এই শটগান দিয়েই তাকে গুলি করব। মারা না-পড়লেও গুলিতে সে আহত হবে নিশ্চয়ই, তারপর যা থাকে বরাতে।

মোট কথা, বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে আমি রাজি নই…

মুখের সামনে খাদ্য আছে, কিন্তু ধরার উপায় নেই! ভিতরে ঢুকতেও বোধ হয় ভরসা হচ্ছে না, কারণ ঘরে আলো জ্বলছে। তাই অস্থির হয়ে উঠল পশুরাজ।

বুঝতে পারছি, তার প্রথম লক্ষ্য চতুষ্পদ সারমেয় দুটি। তার পরে বোধ হয় দ্বিপদ জীব। হিসাবে আমার পালা।

অবশেষে কুকুর দুটোকে ধরার জন্য পশুরাজ এক চমৎকার ফন্দি আঁটল। সে একদিকের পর্দা-ঝোলানো ফাঁকের পিছনে এসে গর্জন করেই তাড়াতাড়ি উলটো দিকের ফাঁকটার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার আশা, কুকুর দুটো যদি ভয় পেয়ে উলটো দিকের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়, তাহলেই সে তাদের ধরে ফেলতে পারবে।

কুকুর দুটো কিন্তু গর্জন শুনলেই ভয় পেয়ে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে, তার বিপরীত দিকের ফঁকটা লক্ষ করে ছুটে যাচ্ছে বটে, কিন্তু পর্দার বাইরে একবারও পদার্পণ করছে না।

একটু পরেই লক্ষ করলুম, দারুণ আতঙ্কে তারা ক্রমেই দিশাহারা হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণের মদ্যেই তাদের বুদ্ধিভ্রংশ ঘটবে এবং তখনই কুটিরের বাইরে ছুটে পালাতে গিয়ে পড়বে সিংহের কবলে।

নাঃ! আমার পোষা জন্তু দুটোকে এভাবে মরতে দিতে পারি না।

কুকুর দুটোকে টেনে এনে আমি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেললুম। তারপর হাতের বন্দুক বাগিয়ে ধরে ফাঁক দুটোকে লক্ষ করতে লাগলুম নিবিষ্ট চিত্তে…

রাতের আকাশে অন্ধকার মেঘের আবরণ সরিয়ে উঁকি দিল রুপোলি চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলোতে বাঁশের তৈরি পর্দার বুনোনির ফাঁক দিয়ে সিংহের অস্পষ্ট মূর্তি আমার দৃষ্টিগোচর হল–প্রকাণ্ড জানোয়ার!

–একবার মনে হল দিই গুলি চালিয়ে, পরক্ষণে ফিরে এল শুভবুদ্ধি। জন্তুটা এখন প্রায় পনেরো গজ দূরে আছে, এখান থেকে শটগানের গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করা যাবে না। কিন্তু আহত হলে সিংহ নিশ্চয়ই খেপে গিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে আক্রমণ করবে।

তখন অবস্থাটা কী দাঁড়াবে?

নাঃ, গুলি ছোঁড়া হবে আত্মহত্যারই নামান্তর। নিজেকে আমি সংবরণ করলুম…

গভীর অন্ধকার রাত্রি। ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছে সিংহ। মাঝে মাঝে গম্ভীর গর্জনে বিরক্তি প্রকাশ করছে। আর একটা ঠুনকো বন্দুক হাতে ঘরের ভিতর আমি বসে আছি মৃত্যুর মুখোমুখি।

রাত্রি গড়িয়ে চলে…

হঠাৎ লক্ষ করলুম, একটা লণ্ঠন ধূম উদগিরণ করছে! আলোটাও যেন কম!

তিন-তিনটে লণ্ঠনের আলোর জন্যই সিংহভিতরে আসতে সাহস পাচ্ছেনা। কিন্তু আলোর তেজ কমে গেলে আর তাকে ঠেকানো যাবেনা। জীবন্ত কুকুর-মাংসই তাকে আকৃষ্ট করেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘরের ভিতর সে একবার প্রবেশ করলে আমারও রেহাই পাবার কোনো কারণ নেই।

এইসব কথা ভাবছি, হঠাৎ খেয়াল হল, পশুরাজের বজ্রকণ্ঠ নীরব হয়ে পড়েছে। কী ব্যাপার? ও কি চলে গেছে?…

আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে সাবধান করে দিল–না, যায়নি, কাছেই আছে মূর্তিমান মৃত্যু!

আছে–আছে–আছে…

একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল। বুঝলুম, সশব্দে ঘ্রাণ গ্রহণ করছে পশুরাজ। সচমকে দেখলুম, যেদিক থেকে শব্দ ভেসে এল, সেদিকের বাঁশের পর্দাটা যেন হাওয়ার ধাক্কায় একটু দুলছে।

পরক্ষণেই বংশ-নির্মিত যবনিকার তলদেশ দিয়ে আলোকিত কুটিরের ভিতর প্রবেশ করল ভয়ংকর ভয়ংকর মস্ত বড়ো এক থাবা!

থাবা আরও একটু এগিয়ে এল, কোষমুক্ত কিরীচের মতো মাংসল খাপ খুলে থাবার ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করল বাঁকা বাঁকা ধারালো নখের সারি!

ফাঁকের পাশে দেয়ালের গায়ে সনখর থাবাটা ঘুরে ঘুরে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে!

আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা লণ্ঠন তার কর্তব্য করতে রাজি হল না। দপ করে নিভে গেল আলোটা। শটগানের ট্রিগারে সরে এল আমার আঙুল। ইচ্ছে হল, গুলি চালিয়ে ওই থাবাটাকে উড়িয়ে দিই। অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করলুম।

কুকুর দুটো তখন ছটফট করছে আর চেঁচাচ্ছে পাগলের মতো এই বুঝি গলার বকলস ছিঁড়ে তারা বেরিয়ে যায়!

একটু পরে আবার নিভে গেল আর একটা লণ্ঠন। আবার ঘর্মাক্ত দেহ থেকে জলের স্রোত বইছে।

রাত্রির প্রহর কাটে…

থাবাটা এক সময় সরে গেল ঘরের ভিতর থেকে অন্ধকারের গর্ভে। সিংহের তীব্র হুংকার-ধ্বনি আর শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ অবরুদ্ধ কণ্ঠের চাপা গর্জনে প্রকাশ পেল ক্ষুধার্ত শ্বাপদের ক্ষোভ এবং নৈরাশ্য!

কিন্তু কেন? অবাক হয়ে মনে মনে কারণ খুঁজবার চেষ্টা করছি, হঠাৎ পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে নজর পড়ল। আর সঙ্গেসঙ্গে আমার বুকে সাহস ফিরে এল, আতঙ্কের পরিবর্তে অনুভব করলুম বাঁচার নতুন ইঙ্গিত–এযাত্রা বেঁচে গেলুম বোধ হয়… একটা মাত্র লণ্ঠন তখন আলো দিচ্ছে। কিন্তু তার অবস্থাও শোচনীয় যেকোনো মুহূর্তে কম্পিত আলোকশিখাঁটি অন্ধকারের গ্রাসে লুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু না, ঘরের মধ্যে লণ্ঠনের আলোকশিখা নিভে যাওয়ার আগেই আকাশ ও পৃথিবীর অন্ধকার ভেদ করে জ্বলে উঠল চিরন্তন সেই রক্তিম আলোর ধারা…

জয়! দিনমণির জয়! এল নতুন প্রভাত!

দূর বনপথ থেকে ভেসে এল অনেকগুলি মানুষের কণ্ঠস্বর।

পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলুম, সিংহ সচমকে ফিরে দাঁড়াল এবং নিঃশব্দে আত্মগোপন করল জঙ্গলের মধ্যে।

একটু পরেই আমার লোকজন যখন ঘরের ভিতর এল, তখন আমি কঁপছি। ঘর্মাক্ত সারা দেহ। দারুণ আতঙ্কে ও উদবেগ অবসাদে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, তাদের কোনো কথাই বলতে পারলুম না। পরে সব শুনে তারা বলল সাহেব, এযাত্রা বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছ! আর থেকো না এখানে। ওকে মারবারও চেষ্টা কোরো না। তাহলে নিজের জীবনই বিপন্ন হবে।

দিনের বেলা একটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু অসম্ভব! ওই ঘরের ভিতর ঘুমানো অসম্ভব। চোখ বুজলেই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি হিংস্র ভয়াল শ্বাপদ এখনই হানা দেবে শরীরী দুঃস্বপ্নের মতো। ভালোভাবেই জানতুম, দিনের বেলা ভয় পাওয়ার কোনোই কারণ নেই। কিন্তু মন মানতে চায় না। তুমি হয়তো বলবে, এখানকার বাসিন্দাদের কুসংস্কার আমাকেও আচ্ছন্ন করেছে। হতে পারে। সে ভয়ংকর রাতের অভিজ্ঞতা তোমার হয়নি, তাই বলতে পার ও-কথা।

যাই হোক, প্রকাশ্য দিবালোকেও যেখানে আমি আতঙ্কে ঘুমাতে পারিনি, সেখানে রাত কাটানো কি সম্ভব? অতএব তোমাকে ওই চিঠি লিখে রেখে এখানে পালিয়ে এসেছি.. তুমি আমার এখন সিংহ-শিকারে আগ্রহ প্রকাশ করলে আমি ভীষণ অসন্তুষ্ট হব…

মনে রেখ বন্ধু–আমরা খনিজ দ্রব্যের বিশেষজ্ঞ, শিকারি নই বুঝেছ?

হ্যাঁ, মলিনাক্সের কথা বুঝেছিলেন হাম্বার। জাঙ্গা ছেড়ে সেইদিনই অন্যত্র যাত্রা করেছিলেন দুই বন্ধু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *