দিদিমাসির জিন (Didimasir Jin) : 07
সারা পৌষ মাস ধরেই কাজলরেখার মাসি-দিদিমার বাড়িতে পিঠে হয়। হরেক রকম পিঠে—এ বাংলার, ও বাংলার।
সেসব অন্য কোথাও, অন্য কোনও বাড়িতে কেউ খেতে পাবে না। এই পিঠেপুলির ঐতিহ্য জিইয়ে রেখেছেন অবশ্যই মাসি-দিদিমা, যাঁকে কাজল দিদিমাসি বলে ডাকে। কাজলের বাপের বাড়ি বলতে এখন প্রায় এই দিদিমাসির বাড়িই। নিজের বাপের বাড়ি শূন্য ঢনটন করছে।
সকালের রান্না-বান্না সারতে না-সারতেই ফোন পেল কাজল। ফোনের ওধারে দিদিমাসির গলা, কি রে কাজলা মনে করেছিস কী?
—কী আবার মনে করবো?
—কী মনে করবি? মনে করবি দিদিমাসি টেঁসেছে। আর কী!
—বালাই ষাট।
—তবে আসছিস না কেন? খবর্দার গঙ্গার দোষ দিবি না, গঙ্গা আমার কোনদিনই বউয়ের আঁচল-ধরা নয়।
—তবে কার আঁচল ধরা?
—কারো আঁচল যদি ধরতেই হয়, তবে দিদিমাবুড়ির, আর কার? শোন, আজই একবার আসবি।
দিদিমাসির একবার আসবি বলা মানে জোর তলব, খুবই দরকার পড়েছে। কাজল গঙ্গাপ্রসাদকে সেদিন তাড়াতাড়ি খাইয়ে বাড়ির বার করে দিল।
গঙ্গাপ্রসাদ দু-একবার প্রতিবাদ করবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন—এক্ষুনি খাবো কী? আমার দুটোয় ক্লাস।
—একেক দিন একেক রকম সময়ে খেলে শরীর খারাপ হয়।
—কই এতদিন তো …
—বাজে তর্ক করতে তোমার জুড়ি নেই। খাও দাও, বেরিয়ে পড়ো, পুরুষ
মানুষের আবার অত ঘরে বসে থাকা কী, জুটেছেও তেমনি চাকরি! সবার বর দেখো হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল, আমারটি দুপহর বেলা পর্যন্ত বিছানায় লুটোচ্ছেন।
গঙ্গাপ্রসাদ সম্প্রতি একটি বাংলা বিশ্বকোষের কিছু কাজ পেয়েছেন। অত্যন্ত মন দিয়ে সেই কাজই করছিলেন। টেবিল বই-কণ্টকিত, তিনি তাঁর বিছানার ধারে চেয়ারটা টেনে এনেছেন, শয্যাটাকেই আপাতত টেবিল হিসেবে ব্যবহার করছেন। মোটা মোটা অভিধান, নোট নেওয়া সব ডায়েরি, কালো এবং ‘সবুজ’ চারপাশে ছড়ানো। এই হচ্ছে তাঁর বিছানায় লুটোনো। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন—তোমার কি কোথাও যাবার আছে?
—হ্যাঁ, গোয়াবাগান
—ঠিক আছে। খেয়ে নিচ্ছি, কিন্তু এখন বেরোতে পারবো না।
—দরজায় খিল দিতে মনে থাকবে?
—থাকবে?
—বেল বাজলে খুলে দিতে?
—হ্যাঁ।
—তিন সত্যি করো।
—দিব্যি গালাটালা আমার দ্বারা হবে না।
—তাঁহলে বেঁরোও না বাঁবা—এবার কাজল মোক্ষম অস্ত্র ছাড়ল। কাকুতিমিনতি করতে লাগল গঙ্গাপ্রসাদকে বেরোবার জন্যে।
বেগতিক দেখে, আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গঙ্গাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি দুমুঠো খেয়ে কলেজ স্ট্রিটের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন, তখন সাড়ে দশটাও বাজেনি। দুজনে একইসঙ্গে বেরোলেন এবং তাকে গোয়াবাগান পৌছে দিতে হবে কাজলের এই বায়না তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন।
—কেন তুমি কি একা-একা কোথাও যাও না?
—যাই তো! কিন্তু দিদিমাসির বাড়িতে তুমি না গেলে…
—আমি না গেলে কী!
—যে কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়ি তুমি সঙ্গে না গেলে—
—না গেলে কী-ই?
—কেমন বিধবা-বিধবা লাগে।
এর পর গঙ্গাপ্রসাদ আর এক মিনিটও দাঁড়াননি।
শ্যামবাজারে যেদিন পিঠে হয় সেদিন অন্য কিছু হয় না। সংক্রান্তির এখন দেরি আছে। কিন্তু তার আগেই দু-তিন দিন পিঠে উৎসব হয়ে যায় একে দিদিমাসি বলেন মহড়া।
কাজল ঘরে ঢুকতে দেখল উঁচু পালঙ্কের ওপর দিদিমাসি বসে আছেন, সামনেই একটা জলচৌকিতে কী সব আয়োজন! দিদিমাসি পাঁচালি পড়ছেন:
যমজ ভগিনী ছিল সুশীলা সরলা।
গুণে সরস্বতী আহা রূপেতে কমলা॥
সুশী সরি নাম দেন দাদামহাশয়।
শীলাসলা দাস-দাসী-পড়োশিতে কয়॥
সুশীতলা সরোবালা বলে ঠাকুমাতা।
জলের প্রপার্টি কন্যা পাবে এই কথা
ঠার্কুদাদা গর্বভরে রটান চৌদিকে।
অন্য সব কন্যাদের যশ হল ফিকে॥
বয়স বাড়িলে দুয়ে ডফ স্কুলে যায়।
যতেক স্কটিশ মিস গুণগান গায়॥
অল্প দিনে রপ্ত হল পিয়ারিমোহন।
ঐক্য বাক্য মাণিক্যেও করিল যতন॥
বাইবিল পাঠ ক’রে খৃষ্টতত্ত্ব আহা।
বুঝায় ভগিনীদ্বয় লোকে বলে বাহা॥
কংগ্রেস ভজেন পিতা গণয়ে প্রমাদ।
গৌরীদানে প্রথমেতে মনে নাহি সাধ॥
ঈশ্বরচন্দ্র, রাজারাম, মহর্ষির নাম।
না লইয়া কভু না করেন জলপান॥
সাধ ছিল কন্যা দিগে করেন যোড়শী।
কমলা ও বাগ্দেবী উভয়েরে তোষি॥
কিন্তু একে মেমমিসে বাইবিল গায়।
তাহে পিছে ফুলবাবু ফিটনেতে ধায়॥
সুশীলা দুর্বলা বড় নারিলেন তাই।
প্রাণ ধরে দিতে তারে বড় ঘরে ঠাঁই॥
অধ্যাপক বেহাইয়ের একটি সন্তান।
কালীঘাট ভদ্রাসন সুশী সেথা যান॥
সরলার জন্য পিতা খুঁজেন ভূস্বামী।
বৃহৎ সংসার, সরি হবে রাজরাণী॥
অ্যানাবেল মেমসাব পিতারে ডাকেন।
এমন মেধাবী কন্যা বাল্য বিয়ে দ্যান?
বয়স এগার মোটে জানে না কিছুটি।
সংসার জটিল অতি, এরচে’য়ে বিছুটি
হাতেপায়ে ঘষে কন্যা জলে ফেলে দ্যান।
কিম্বা এই কন্যারত্ন আমাদেরে দ্যান॥
পাঠাবো এডিনবরা হইবে ডাক্তার।
কিম্বা লন্ডন যাবে হবে ব্যারিস্টার॥
শুনিয়া রায়ান কহে শুনো হে ম্যাডাম।
ভূস্বামীতনয় পুত্র অতি রূপবান॥
স্বর্ণময় শস্যক্ষেত্র স্বর্ণময় গোলা।
সরির শ্বশুরঘরে বড় বোলবোলা॥
দিঘিতে থই থই মৎস্য গোহালের দীপ।
শতেক গাভীর চক্ষে ঝলসায় টিপ॥
পরিবার পরিজন বহু আছে ম্যা’ম।
লন্ডনেতে যেমতি আপনকার বাকিংহ্যাম॥
হবে ব্যারিস্টার সরি, লন্ডনেতে নয়।
ভেনু হবে জিলা মৈমনসিঙেতে নিশ্চয়॥
এত বলি রায় অট্টহাসে মহাসুখে।
অ্যানাবেল মিসিবাবা ফেরে ম্লানমুখে॥
শুনো শুনো সুশীসরি জীবন-আখ্যান।
বসুজায়া কহে, শুনে শ্রোতা মুহ্যমান॥
দিদিমাসি পাঁচালি বন্ধ করলেন। সামনে কী সব মাটির ঢিপি চাপা ছিল তাতে কিছু ফুলতুলসী দিলেন। চোখ বুজে দু মিনিট চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন—বল্।
—বল্ মানে? এসব কী? তোমার সামনে ও চৌকিতে কিসের মূর্তি?
—মূর্তি কেন হবে?
—আচ্ছা বাবা দেব দেবী।
—দেবদেবীও নয়।
—তবে?
—ওই যে পাঁচালি শুনলি, ওই ঢিপি দুটো হচ্ছে সুশী-সরি।
—বাবা বা, নিজেকেই নিজে ফুল-তুলসী-গঙ্গাজল দিচ্ছো?
—অনেক সময়ে নিজের ছেরাদ্দটাও নিজে করতে হয়, তা জানিস? অনেক দিন ধরে সুশী-সরির পাঁচালি লিখছিলুম। শেষ হয়েছে, তাই সারা মাস ধরে পড়ব, আর ফুল-তুলসী দোব। তুই কিছু করতে পারবি?
—যত্ত সব অলুক্ষুণে কাণ্ড।
দিদিমাসি চিন্তিত মুখে বললেন—সুশীর ধারা পেয়েছিস।
—কী রকম?
—সুশীটা বড্ড ভিতু ছিল। বাবা যখন বিয়ের ঠিক করছিল, বলেছিলুম চল—মিস অ্যানাবেলের কাছে পালিয়ে যাই। ব্যারিস্টার হবো, ডাক্তার হবো …। তা বললে অলুক্ষুণে কথা বলিসনি। যেমন ভয়, তেমন কুসংস্কার। তা সেই ভূতগুলো বা বলতে পারিস জিনগুলো তোর মধ্যে একটু একটু ঢুকেছে। তা মাঝখান থেকে প্রথম সন্তান বিইয়েই সে মরে গেল। অত ভয়, ভক্তি, ছেদ্দা কোনও কাজে এলো না। অথচ আমি দেখ—তেরটা বিইয়েছি। তার মধ্যে তিনটে অসময়ে মরেছে। নিজে নব্বুইয়ে ঘা দিতে চললুম। দিব্যি আছি। থাকলেও দিব্যি, না থাকলেও দিব্যি। যা, এখন খেয়ে আয়।
—খেয়ে আয় মানে? আমি এখানে তোমার সামনে বসে খাবো। কী কী হয়েছে গো আজ?
—পাটিসাপটা, পাটিজরা, রসবড়া, মুগসামলি, কলার বড়া দিয়ে নতুন গুড়ের পায়েস, নারকোল-চিঁড়ে।
—মুখ যে বড্ড মিষ্টিয়ে যাবে গো!
—মটরশুটির কচুরি আর আলুর দম তবে হল কী জন্যে?
—তুমি কোনটা করেছ দিদিমাসি?
—সে তোকে খেয়ে বলতে হবে।
কাজলকে আর উঠতে হল না, তার এক মামিমাই এই সময়ে বড় কাচের প্লেটের ওপর কলাপাতা পেতে হরেকরকম সাজিয়ে এনে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে একটা কাচের বাটিতে বাদামি রঙের পায়েস।
কাজল খাচ্ছে আর জিভে তারিফের টক্টক্ শব্দ করছে। দিদিমাসি বললেন—তুই কি ঘড়ি হয়ে গেলি নাকি রে কাজলি?
—না গো, সবগুলোই তোমার তৈরি বলে মনে হচ্ছে যে।
দিদিমাসি হাসতে লাগলেন রহস্যময়ভাবে—এক মায়ের দশটি সন্তান, তারা সবাই মায়ের কিছু কিছু হয়ত পেয়েছে। কিন্তু একজন পেয়েছে এমন নির্ভুলভাবে যে তাকে মায়ের সন্তান বলে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারা যায়। কেমন, কি না? তোর মামিরা তো শিখেচে সবই আমার কাছে। প্রত্যেক বছর তার পরীক্ষাও হয়ে থাকে। কাজেই …
—রসবড়া—হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠ্ল কাজল। —ঠিক বলেছি?
—একেবারে ঠিক। সারা বঙ্গদেশে এরকম রসবড়া যদি আর কেউ তোয়ের করতে পারে তাহলে জানবি সে এই বংশের না হয়েই যায় না।
খেয়েদেয়ে মুখ ধুয়ে এসে, এক কাঁসার ঘটির জল খেয়ে কাজল বলল—যাঃ পেটটা ফুলে গেল যে গো!
দিদিমাসি একটা কৌটো থেকে কী এক মুখশুদ্ধি বার করে তাকে দিলেন—খা। গিলে ফেলবি না, আস্তে আস্তে তারিয়ে তারিয়ে খা। পেট নেমে যাবে। এ তো আর সে পেটফোলা নয়?
—সে পেট ফোলা কী গো?
—কেন আমাদের? তেরো-চোদ্দ বছর থেকে আরম্ভ হত আর কারও চল্লিশ, কারও বেয়াল্লিশ তবে নিষ্কৃতি।
—উঃ, তুমি বড্ড অসভ্য দিদিমাসি।
—অসভ্য! না? তোমার হলে তুমি বুঝতে।
বারো মাস বমি হচ্ছে হুড়হুড় করে, মাথা ঘুরচে, বুক ধড়ফড় কচ্চে। চাদ্দিকে বেশির ভাগ খাবার-দাবারেই নরকের সোয়াদ-গন্ধ জানিস না? আমি তো তেরো বছর থেকে বিয়োতে শুরু করলুম, দু বছর অন্তর অন্তর। তেরোটা বিইয়ে তার পর বেওয়া হলুম। শান্তি!
—শান্তি কী গো? কী বলছো দিদিমাসি!
—আরে বাছা ঘাটের দিকে পা আর কি মিছে কথা বললে সাজে? বাবা তো রূপবান ভূস্বামী তনয় দেখে রাজরানি করে দিলেন। তা সে তনয় তো ছিল কম্মের ঢিপি, বিরাট জমিদারি, নায়েব, গোমস্তা, খাজাঞ্চি, বাজার সরকার আর দোর্দণ্ড প্রতাপ তার বাপ রয়েছেন, সে তো খালি কোঁচা দুলিয়ে ঘুরে বেড়াত আর আমার ওপর তম্বি করত। আধপাগলা গোছের। তোর মামাদের কটাকে দেকিস না? সব ওই ধারা পেয়েছে। যেটা পালালো, সেটাও তো ওই ধারা।
—আচ্ছা, দিদিমাসি, এই যে সব দোষ দাদুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছো …
—কিসের দোষ?
আমতা আমতা করে কাজল বলল—এই তেরোটা সন্তান হেন-তেন।
শুনে দিদিমাসি অনেকক্ষণ কিছুটা কৌতুক—কিছুটা বিদ্রূপে ভরা শাণিত চোখে কাজলের দিকে চেয়ে রইলেন। শেষ পর্যন্ত কাজলের মুখ লালচে হয়ে গেল, সে মুখ নামাতে বাধ্য হল। দিদিমাসি বললেন—বাপু হে বিশ একুশ বছর বয়সে গুচ্ছের বই-টই পড়ে জ্ঞান সংগ্রহ করে সাতাশ বছরের নাতজামাইকে বে করেচিস। তের বছুরে ছুঁড়ির জ্বালা তুই কী বুঝবি? গ্রামদেশের দুধ-ঘি খেয়ে গুচ্ছের কুস্তি-কাস্তা করে সে তো একটা দশাসই মিনসে। তার ওপর দুর্বাসা মেজাজ। খাবার পছন্দ হল না, লাতি মেরে ফেলে দিল, জামা-কাপড় এয়েছে, কেমন ফিনফিনে দেখতে ফড়-ফড় করে ছিঁড়ে ফেলল। হাটে গেচে বেগুন পছন্দ হয়েচে বড় বড় মুক্তকেশী বেগুন। যার কাছে যত ছিল সব কিনে নিয়ে এয়েছে। বেগুনভাজা, বেগুনপোড়া, বেগুনি, বেগুনের ঝোল, দই-বেগুন— সব্বাই ভয়ের চোখে দুবেলা খেয়ে যাচ্চে। শেষে সাত দিনের দিন ছোটবোন বেগুন খেতে গিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললে, তখন সেই সমস্ত বেগুন হুকুম দিয়ে মাটিতে পোঁতালে। তা বলি নাতনি-সুন্দরী সেই লোকের সঙ্গে রস আসে? তার সামনে টুঁ করতে পারবি?—সরি তা-ও করেছিল। তখন বোধহয় বছর পনেরো বয়স। বললুম—আমি বচর-বিউনি হতে পারবো না।
—কী বললে?
—বছর-বিউনি। লোকে বলচে আর হাসচে আমাকে দেখে।
—কে কে লোক? মুখ রাগে লাল।
—আমি বললুম—সব লোক, যে যেখানে আচে।
এক রাম থাপ্পড়ে আমাকে পালঙ্কে ফেলে দিলে। শেষরাতে পালালুম। তিনদিন পরে সইয়ের বাড়ি থেকে খুঁজেপেতে আমার শ্বশুর আমায় নিয়ে এলেন। কলকাতা থেকে মা-বাবা এসে হাজির। নিতে এয়েচেন। খুব আনন্দ। এবার বোধহয় আমাকে ত্যাগ দিচ্চে। হে ভগবান, হে কেষ্ট ঠাকুর, হে যেশুকৃষ্ট তাই যেন হয়। নাচতে নাচতে বাপের বাড়ি ফিরলুম। বাড়ি এসে দেখি ও হরি এ যে ছোড়দার বে, তাই। ছোড়দার বউও অষ্টমঙ্গলা গেল আমাকেও সে মিনসে এসে পদ্মাপারে নিয়ে গেল।
—আচ্ছা দিদিমাসি, একটু, এই এতটুকুও কি ভালোবাসতে না?
—খুনে-পাগলকে কি ভালোবাসা যায় দিদি, বড্ডজোর একটু করুণা করা যায়। যখন গেল, এমন কিছু তো বয়স হয়নি, আমার চোক দিয়ে একফোঁটাও জল কেউ বার করতে পারেনি। সবাই বললে শোকে পাতর হয়েচে। ঠুকেঠুকে শাঁখাগুলো সব ভাঙলে। সিঁদুরটুকু আমি নিজেই মুচে সারলুম। সরু কালাপাড় শাড়ি এনে দিলে বড় দেওর। দেকে রাগ হল, বললুম—থান আনো, একবারে সাদা। সবাই বললে—কী জাজ্বল্য সতী। বাপ রে বাপ!
দিদিমাসির কথার ধরনে কাজল হাসতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে বলল—দিদিমাসি তোমার মনে কি খুব দুঃখ?
—কিসের দুঃখু রে কাজলা?
—এই, লেখাপড়া শিখে দশজনের একজন হতে চেয়েছিলে, পারলে না। ভালোবাসার মতো বর পাওনি। এত বুদ্ধি নিয়ে সংসারের মধ্যে বদ্ধ থাকতে হয়েছে। তারপরে ধরো তোমার যমজ বোন আমার দিদিমা মারা গেল, তোমার তেরোজন ছেলেমেয়ের মধ্যেও পাঁচজন মোটে বেঁচে। …
সরলা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন—তেমন কোনও দুঃখু নেই রে কাজলা।
—সে কি গো? বিপুল বিস্ময়ে কাজল বলল।
—এতখানি বয়সে পোঁচে আর কোনও শোক থাকে না বোধহয় দিদি। সমস্ত জীবনটা যেন একটা লম্বা গরমের দিন। প্রচণ্ড বিষ্টি, ভাদুরে গুমোট, জলে ভিজে জ্বর, ঝুড়ি ঝুড়ি আঁব, নিচু, কালোজাম, জামরুল, ঝমঝম বিষ্টিতে ভেজা, কাগজের নৌকো ভাসানো, কালো মেঘে ভরা আকাশের বুকে লক লকে বিদ্যুৎ … সবাই যেন খেলুড়ি। যার যতক্ষণ দম ততক্ষণ খেলছে তা পরেই মোর, বাড়ি চলে যাচ্ছে। আমার ফুরোলে আমিও যাবো … আর এ পাইনি ও পাইনি এমনটা ছোটতে একটু একটু ছিল বইকি! কিন্তু যখন দেখলুম কিছুতেই অন্যকিচু হবার নয়, তখন নালিশগুলো কেমন গুটিয়ে গেল।
—অর্থাৎ দিদিমাসি তুমি এত বুদ্ধিমতী উদ্যোগী এসব হয়েও কিন্তু আজকাল যাকে বলে প্রতিবাদী চরিত্র তা নও। একখানা সিমোন হতে পারোনি।
—সে আবার কে রে?
—সে আছে একজন।
—খুব ত্যাড়া নাকি রে?
—হ্যাঁ, মানে বিয়ে না করা বরের সঙ্গে থাকতেন, তা ছাড়াও সব অনেক ফ্রেন্ড-টেন্ড ছিল আর কি?
অম্লানবদনে দিদিমাসি বললেন—ওমা আমিও তো ওইরকম খানিকটা ছিলুম রে!
কাজল চমকে উঠে বলল—বলছো কী?
—আমার অনেক বয়ফ্রেন্ড ছিল, বাপের বাড়িতে অরুণদা, প্রভাতদা, পল্টু, শ্বশুরবাড়িতেও ছিল শম্ভু, রঞ্জিত আমার সইয়ের ভাই সব, আর দ্যাওরের সঙ্গে তো এত ভাব ছিল যে তাকে তোরা আজকালকার দিনে প্রেমই বলবি।
—তবু, কারো সঙ্গে তো মানে কিছু …
—কী যে বলিস কাজলা, বয়ফ্রেন্ডরা দু-একবার হাত ধরবে না, দু-একটা চুমু-টুমু খাবে না তা হতে পারে? সবই তোদের কালে, ভুঁই থেকে গজালো? না কী? তবে হ্যাঁ গভ্ভের ছেলেমেয়েগুলো সবই তোর সেই দুর্বাসা দাদুর।
কাজল লজ্জা পেয়ে বলল—উঃ দিদিমাসি, তুমি যে কী অসভ্য, কী অসভ্য!
—না খোলাখুলি সব কবুল করাই তো ভালো রে। থাকলে বলে দিতুম। তখন ওরকম একটা-আধটা হয়ে যেত। বড় বড় সব সংসার। যত শ্বশুর, তত ভাসুর, তত দ্যাওর, তার ওপরে বাইরের থেকে অমুকতুতো তমুকতুতোরা আসচেই আসচেই। ও সব হত। কিছু টের পাওয়া যেত না। কিছু পাওয়া যেত। গেলেও প্রমাণাভাবে হজম, আর কিছুর জন্যে বিষ, গলায় দড়ি, পুকুরে ডোবা,
এই সব কথা হতে হতে দিদিমাসি একটা বিদেশি খাম তার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, পড় তো দেখি কাজল। কী লিখচে?
পড়ে টড়ে কাজল অবাক। কে এক মিঃ সিং ওকলাহোমা, ইউ.এস.এ থেকে লিখছেন, তাঁর মেয়ে এডিথ পালিয়ে গেছে। সম্ভবত সে ভারতবর্ষের, কলকাতায় ৩ নম্বর শ্যামবাজার স্ট্রিটে যাবে। মিসেস বোস বা তাঁর আত্মীয়রা যেন তাকে যেভাবে হোক আটকে রাখেন এবং মিঃ কাপুরকে একটা ফ্যাক্স করে দ্যান। ফ্যাক্স নম্বর দেওয়া আছে। কিন্তু কে এই এডিথ এবং মিঃ সিং, তার কোনও উল্লেখই চিঠিতে নেই। এভরিথিং উইল বী এক্সপ্লেইন্ড লেটার।
কাজল বলল—এ চিঠি তোমাকে কে দিল? কেন দিল?
সরলা বললেন—ওরে ওপরে পষ্ট আখরে লেকা মিসেস সরলা বোস। না হলে তোর দুই মামীর কাউকে দিত হয়তো হরিনাথ।
—এই জন্যে ডেকেছো?
—ডেকেছি পিঠে খেতে, তার সঙ্গে এইটুকু পিঠোপিঠি। এই চিঠিটা তুই জিরক্স করে নে। নাতজামায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরামর্শ কর। কী ব্যাপার…
ছেলেমেয়ে তো গেছে জয়দেবের মেলায়।
—আরে বাপু ফিরবে তো! না সেখানেই বাউল-বাউলি হয়ে থেকে যাবে? তোর ছেলেটার খুব বুদ্ধি। মেয়েটারও। তবে বাচ্চা তো! এখনও তেমন পাকেনি। মিত্তির বাড়ির, ঘোষ বাড়ির জিন পেয়েছে সব। আমারগুলো সবই বসু-পরিবার।
—জিন-টিন কী সব বলছো দিদিমাসি? এ সব তুমি জানো?
—বাঃ জানবো না? পত্র-পত্রিকাগুলো সব পাশে ডাঁই করা থাকে, ভাবিস বুঝি খালি নবেল পড়ি! ডি এন.এ. জিন, ক্রোমোজাম স-ব জানি। বুজলি?
—তা তোমার ছেলেমেয়ে বসু-পরিবার বললে কেন? বসু-পরিবার তো বসুই হবে।
—কাজলা, তুই সুশীর এই মাটির ঢিপিটার মতো হয়েছিস। আসল সুশী আরও অনেক বুদ্ধিমতী ছিল।
—বেশ বোকা আছি, আছি। তুমি বুঝিয়ে বলো।
—আরে আমার নিজের দশটা ছেলেমেয়ে। যে তিনটে অল্প বয়সে গেছে তাদের কথা ছেড়ে দিচ্চি। তা এ দশটার কেউ-কেউও তো আমার মতো বা আমার বাড়ির মতো হবে। বড় নবতারা-বসানো ওর ঠাকুমা, চেহারায়, চাল-চলনে, মেজ ললিতা—ওর বাপের মতো, সেজ নরহরি তো দেখেছিসই—খ্যাপাটে, দশাসই, এক চড় ওঠালে তোকে সাত চড়ে শায়েস্তা করে দেবে। ন’ ভজ, ভজহরি—একেবারে ওর কাকার মতো!
—যে কাকার সঙ্গে তোমার প্রেম ছিল দিদিমাসি?
—মোটেই না, সে আমার থেকেও ছোট ছিল, বাড়িতে একমাত্তর মানুষের মতো। তার মতো হলে তোর কেচ্ছা করার খুব সুবিদে হয়, না?
কাজল এত্ত বড় করে জিভ কেটে বলল—কৌতুহল, বিশ্বাস করো জাস্ট কৌতূহল!
—সে ছিল একটা ভোঁদলা কাকা। কথা বললে ভেবলে চেয়ে থাকবে। তিনবার জিজ্ঞেস করলে একবার জবাব দেবে। ভজ সেই কাকার মতো হয়েছে।
—তারপর?
—কনে লাবণ্য—বাপের মতো, চেহারায়, স্বভাবে আবার সেই ভোম্বুলে কাকার মতো। নতুনের নামও তো নতুন, সে কেমনধারা ছিল আমার ভালো মনে নেই—খ্যাপাটে তো বটেই। বউটাকে আমার ওপর ফেলে নিরুদ্দেশ হল। মরতে চল্লুম এখনও তার কোনও হদিশ নেই। রাঙা হল সুচরিতা, সব রবীন্দ্রনাথ থেকে নাম দিয়েছিলুম—ওর পিসির মতো—অমনি ছিঁচকাদুনে হেঁশেল-অন্ত প্রাণ। হেঁশেলের চাবি নিয়ে বউয়েদের সঙ্গে কী কাণ্ডই না করচে। ফুল হল গিয়ে—ক্যামেলিয়া নাম দিয়েছিলুম—এনারা বদলে করে দিলেন—কমলা, তো কমলা-ও চলে গেল—ও-ও ঠাকুমার মতো ছিল। সোনাটা ছিল সোনা ব্যাং, মাকাল ফল, বাপের মতো চেহারা, কিন্তু পাঁড় অলস, কিচ্ছুটি করবে না, যাক সে তো আর নেই, সব ছোট্ট কুট্টিটা তো বছর পনেরো বয়সে পালিয়ে গেল। যতদূর মনে পড়ে সে-ও ছিল খ্যাপাটে, বদমেজাজি, বাপের জিরক্স কপি। তা এই তো হিসেব দিলুম। তোর মামাত-মাসতুত ভাই-বোনেদের তো দেখতেই পাস, বলি আমার জিনটা গেল কোথায়? এত কষ্ট করে করে যেসব জন্ম দিলুম, সায়েন্স বলচে চারটের মধ্যে তিনটে যদি এর মতো হয় তো অন্তত একটা অন্যের মতো হবে। তা কই রে? মানুষ শুনেচি বংশবৃদ্ধি করে নিজেকে ফিরে ফিরে দেখবার বাসনায়—আমি নিজে বন্দী হয়ে গেচি, কিচু করতে পারিনি যা চেয়েচি—সে অন্য কথা। কিন্তু এ তো বড় একটা বংশ তোয়ের করলুম তার কোথ্থাও আমি নেই—এটা আমার বড্ড লেগেচে রে!
দিদিমাসি এমনভাবে বললেন যেন তাঁর কোনও নিকট আত্মীয়ই তাঁর মনে ব্যথা দিয়েছে।
সে দিদিমাসিকে সান্ত্বনা দিতে বলল—তোমার জিন আরব্যোপন্যাসের জিন হয়ে গেছে, তাকে কেউ ঘড়ায় পুরে, মুখ এঁটে সমুদ্রের জলে ফেলে দিয়েছে। এখন কোথায় গিয়ে ঠেকে দেখো।