Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দিদিমাসির জিন || Bani Basu » Page 12

দিদিমাসির জিন || Bani Basu

শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ইন করতেই প্ল্যাটফর্মে গঙ্গাপ্রসাদ তীর্ণার হাসি-হাসি মুখখানা দেখতে পেলেন। সে অবশ্য পেছনে ছিল, সামনে ফাদার জেনকিনসের গাবদা গোবদা মুখ, কিন্তু বাপের চোখ! ফাদার জেনকিনসকে ভেদ করে গঙ্গাপ্রসাদ তীর্ণাকে দেখতে পেলেন। এবং উৎসাহ উদ্বেলিত স্নেহ ইত্যাদির বশে নামতে গিয়ে পা ফসকে প্ল্যাটফর্মে প্রায় উড়ে অবতীর্ণ হলেন।

তীর্ণা তাড়াতাড়ি ছুটে এল, — বাবা, বাবা, পা মচকায়নি তো?

গঙ্গাপ্রসাদ দু পায়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে বললেন— না না, হয়ত ভেঙে থাকতে পারে কিন্তু কখনোই মচকায়নি। কী ফাদার জেনকিনস? তিনি ফাদার জেনকিনসের দিকে মিটমিটে হাসি হাসি চোখে তাকাতে লাগলেন।

তীর্ণা ব্যস্ত হয়ে বলল— ভেঙেছে কী? যাঃ, সর্বনাশ।

ফাদার জেনকিনস এগিয়ে এসে হাসি মুখে বললেন— ভাংগে তুবু মচকে না। কী? সঠিক বলেছি তো অধ্যাপক মিত্র?

—চমৎকার, চমৎকার বলেছেন বাবা জেনকিন্‌স্‌।

আবার বাবা জেনকিনস শুনে ফাদার একটু ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু তাড়াতাড়ি আবার সামলে নিয়ে বললেন। —আপনার নুতুন ছাত্রীকে সাক্ষাৎ করুন অধ্যাপক, এই হল সেই এডিথ সিং কাপুর।

সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল— এডিথ টুকু উৎকৃষ্ট আছে। কিন্তু কডডুর সিং কাপুর তা বিবেচনা কোরা হবে।

—এ কি বাবা জেনকিনস? আপনি তো অলরেডি একে সবই শিখিয়ে ফেলেছেন!

ফাদার জেনকিন্‌স্‌ খুব লজ্জিত ভঙ্গি করে বলতে লাগলেন— না না, আমি আর কী! আমি ট্যামন কিছু।…

একটি চমৎকার বাংলো বাড়ি। একেবারে রতনপল্লীর বুকের মধ্যে। প্রচুর মরসুমি ফুল ফুটেছে। বাড়িটিতে একটি খুব বশংবদ কেয়ারটেকার তার পরিবার নিয়ে একদিকের একটি ঘরে থাকে। ফাদার জেনকিনসের জন্য বরাদ্দ একটি ঘর। অন্যটি তীর্ণা ও এডিথের। অগত্যা গঙ্গাপ্রসাদেরও ফাদার জেনকিনসের ঘরেই ব্যবস্থা হয়।

চমৎকার ভুনি খিচুড়ি রেঁধেছে কেয়ারটেকারের স্ত্রী। কুড়মুড়ে আলু ভাজা, বাঁধাকপির শুকনো শুকনো ঘন্ট, ভেটকি মাছ ভাজা আর টোম্যাটোর চাটনি।

গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— আঃ, খেয়ে যেন মুখটা ছেড়ে গেল।

ফাদার জেনকিনস বললেন— আপনার মুখ, আপনাকে চেড়ে চোলে গেল? হোয়াট আ সিচুয়েশন!

—আঃ, ফাদার এটা একটা ইডিয়ম… তীর্ণা বলল— এর মানে…

—আমি বুঝেচি বুঝেচি এর মানে আপনার মুখ আপনাকে চেড়ে চোলে ছিল। এখন ফিরে এসেচে। জাস্ট দি অপোজিট! কেমন কি না? আচ্ছা অধ্যাপক মিত্র, এর প্রয়োগটা আর একটু উডাহরণযোগে…

—ধরুন আপনি রোজ ঝোল মানে কারি খাচ্ছেন। রোজ। সপ্তাহের সাত দিনই। কী অবস্থা হবে আপনার?

—আয়্যাম ক্রেজি অ্যাবাউট কারি, অধ্যাপক মিত্র।

—আঃ! বিরক্তির শব্দ করলেন গঙ্গাপ্রসাদ।

—আচ্ছা ধরুন, সপ্তাহের সাত দিনই আপনি সুপ খাচ্ছেন।

—সুপ তো খাতেই হয়, রোজ।

গঙ্গাপ্রসাদ অসহায় বোধ করেন। এই ইংরেজ-অস্ট্রেলিয়ান এরা একঘেয়ে খেতে ওস্তাদ।

তীর্ণা তাঁকে উদ্ধার করে, বলে— আচ্ছা ফাদার, আজ এই খিচুড়ি, ভাজা এসব খেয়ে আপনার কেমন লাগল।

—উৎকৃষ্ট, চমৎকার, এর পর নাই।

—রোজ যা খান তার থেকে অন্য রকম তো?

—সম্পূর্ণ। সবটাই।

—এই নূতনত্বটাকে বলবেন মুখ ছেড়ে যাওয়া।

গঙ্গাপ্রসাদ উৎসাহিত হয়ে বললেন— তীর্ণাই তো এডিথের বাংলা শেখার ভারটা নিতে পারে।

সে চলা বাংলা, কিন্তু বাউল ভাষা, বাউল গান? ক্ষিতিমোহন উপেন্ড্রনাঠ এসব পোড়াতে হবে। ‘মোনের মানুষ কেলছে দ্বিডলে।’ ইনটারপ্রেট কোর্তে হবে। —কার বা আমি কে বা আমার। আসল বস্টু টিক নাহি টার—কী মানে হচ্ছে?

—‘ফাদার, কেমন পাকেড়ছি?’ এই ধরনের একটা ভাব করে গঙ্গাপ্রসাদের দিকে চেয়ে থাকেন।

খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরবেলায় সামনের বাগানটাতে পায়চারি করতে করতে তীর্ণা বলল— বাবা, তুমি দাদাকে বলো নি তো? আমি এখানে আছি?

—একেবারেই না। তুই যেই বললি আমি শান্তিনিকেতনে—অমনি আমি বললাম— অ্যাঁ—এটা বিস্ময়সূচক—যেই বললি ফাদার জেনকিনসের কাছে, আমি আরেকটা অ্যাাঁ দিলুম। এটা স্রেফ ভয়ে বুঝলি তো? আর যখন বললি— কাউকে বলল না তখন আরেকটি অ্যাাঁ এটা সম্মতিসূচক। এই তিনটি অব্যয় ছাড়া আমার মুখ থেকে আর কিচ্ছু বেরোয় নি।

—মা শুনে কী বলল?

—অশান্তিনিকেতন-টন কী সব বলছিল আমি গ্রাহ্য করিনি।

—আসতে চাইল না?

—তার এখন মেয়ে ভাগলপুর, মাথার ঠিক আছে? সে আসতে চাইবে?

—সে কি? তুমি মাকেও বলো নি?

—তুই তো কাউকে বলতে বারণ করলি?

—সে আমি দাদাদের মিন করেছিলুম, ওদের একটু ভোগা উচিত। মেলার মধ্যে আমাকে আর রাংতাকে ছেড়ে উধাও হয়ে গেল এডিথের খোঁজে। কিন্তু মাকে না বলে তুমি খুব অন্যায় করেছ। দাঁড়াও আমি একটা ফোন করি।

—কেন, ও-ও একটু ভুগুক না!

—আহা মা তো আর কোনও দোষ করে নি।

—তোর কাছে হয়ত করে নি। আমার কাছে হয়ত করেছে।

—সে তুমি বুঝবে। আমি মাকে খবর দিয়ে আসি।

—শোন শোন, গোয়াবাগানে হয়ত মাকে পাবি না, শ্যামবাজারে ওর মামার বাড়িতে করিস।

কিন্তু তীর্ণা, মাকে গোয়াবাগানেই পেল।

ফোন বেজেই যাচ্ছে, তীর্ণা ভাবছে ছেড়ে দেব এমন সময়ে মা ফোন ধরল।

—কে?

—মা, আমি তীর্ণা …

—কে?

—তীর্ণা মা।

—কোথাত্থেকে কথা বলছো? ম্যারেজ রেজিস্ট্রার? রেজিস্ট্রেশন ফিনিশ্‌ড্‌?

—আচ্ছা মা, তুমি আমাকে কী ভাবো বলো তো?

—যেমন ভাবাও তেমনি ভাবি।

—উঃ! তুমি না একটা ইমপসিব্‌ল্‌! শোনো আমি শান্তিনিকেতনে রয়েছি।

—সে কী! তোমার পিতৃদেবও তো শান্তিনিকেতনে।

—হ্যাঁ আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে, আমরা একসঙ্গে ফিরব, ভেবো না।

বাবার সঙ্গে তার দেখা হওয়ার পেছনে যে ষড়যন্ত্র সে-সব তীর্ণা আর ফাঁস করল না। মায়ের মেজাজ বিশেষ ভালো না।

হঠাৎ তীর্ণা জিজ্ঞেস করল— আচ্ছা মা, শ্যামবাজার স্ট্রিটে সরলাবালা বোস কে?

—কেন, দিদিমাসি!

—দিদিমাসি! সত্যি! সত্যি! সত্যি! কী আশ্চর্য! কী-ই আশ্চর্য!

—হ্যাঁ, মিথ্যে হবে কেন? এতে এত আশ্চর্য হবারই বা কী আছে? তোমাদের আদিখ্যেতার একটা সীমা থাকা দরকার!

কিন্তু ততক্ষণে তীর্ণা ফোন ছেড়ে দিয়েছে।

কাজল একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিল। যাক বাবা এবার আরাম করে একটু হাত-পা মেলা যাবে। অনীকটা সাতসকালে বেরিয়ে গেছে, হন্যে হয়ে ঘুরছে। অনুমান হয় সঙ্গে গোপালও রয়েছে। হয়ত সেই যশ ছোকরাও। ও ঘুরুক, ওদের একটু শিক্ষা হওয়া দরকার।

রাত্তির দশটার সময়ে অনীক হা-ক্লান্ত হয়ে ফিরে ধড়াচুড়া সমেত শুয়ে পড়ল। মাথার তলায় দুই হাত। চোখ কড়িকাঠে।

—কী রে। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিবি আগে!

—নাঃ খাবো না!

—বাইরে থেকে খেয়ে এলি বুঝি? চাইনিজ না মোগলাই?

—মা। তোমার ফাজলামোগুলো একটু বন্ধ রাখবে? নিজের মেয়ে হারিয়ে বসে আছে আর তুমি চাইনিজ না মোগলাই… —উঃ ভাবতে পারা যায় না কারুর মা এই রেটে ফাজিল হতে পারে। গোপাল ঠিকই বলে।

—গোপালের কথা উচ্চারণ করলে আমি আর তোমাকে খেতে সাধবোও না।

বলে কাজল আঁচলের চাবি ঝমঝমিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

অনীক নিজের ঘরে গিয়ে আবার মাথার তলায় দু হাত দিয়ে শুয়ে পড়ল। তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে রাংতার ওপরে। দুজনে ফিরে আসবি ঠিক করেছিলি তো মত বদলালি কেন? আর যশজিৎকে নিয়ে যদি এতই জেলাসি তো আর পাঁচজনের সঙ্গে কেঁদুলির মেলায় আসার দরকারটা কী? ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ-টঞ্জে গেলেই তো হত, শোনা যায় সেখানে হনিমুনের চমৎকার ব্যবস্থা, বড় বড় লেখক, বড় বড় ফিল্‌ম্ স্টাররা বাড়ি কিনে ফেলে রেখে দিয়েছেন। কিংবা অত দূরে না যেতে চাস— ডায়মন্ডহারবার যা, পূর্বরাগের পক্ষে আইডিয়্যাল জায়গা। নিদেনপক্ষে বকখালি। বলেই তো দিয়েছে বক আছে সেখানে, খালি বক। বক দেখাও, বকবক করো, বকাবকি ঝকাঝকি করো, কেউই দেখতে আসবে না। পাঁচজনের সঙ্গে জুটে মেলা-টেলায় যাবে কারা? যাদের সেরকম মানসিকতা। পাঁচে এক, একে পাঁচ। গোপালের ওপরেও অনীকের দারুণ রাগ হচ্ছে। তার বরাবরের ধারণা গোপালটার তীর্ণার ওপর একটু ইয়ে আছে। তো দ্যাখ! সে মেয়েটাকে যত্ন কর! নিদেন তার দিকে নজর রাখ, না যশের এক আদি্‌খ্যেতার আত্মীয় তাকে খুঁজতে গোয়েন্দাগিরি করছে। দিদিমাসি হলে বলত ‘আ মলো যা!’ ঠিকই বলত! দিদিমা-ঠাকুমাদের মুখনিঃসৃত এইসব উক্তি এতো এক্সপ্রেসিভ! হঠাৎ দিদিমাসির কথা কেন মনে পড়ল? অনীক নিজের এ প্রশ্নের জবাব পেল না। কিন্তু দিদিমাসির কথা তার কেন কে জানে বারে বারেই মনে পড়ছে। সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার সেই সাদা-চুল বাউলনীর কথা মনে পড়ল, ও-ই নাকি যশের সেই আত্মীয় এডিথ সিং কাপুর। এই আমেরিক্যান মেয়েগুলোর কোনও একটা ইয়ে নেই। একটা নোংরা বুড়ো বাউলের পাশে ছদ্মবেশে বাউলনী সেজে বসে আছে। শুধু বসে কি আর আছে? ঘুরছে, থাকছে! ম্যা গো! আবার একটা দিদিমাসি ব্যবহৃত অব্যয়। ভারি এক্সপ্রেসিভ। সিলিং-এ বাউলীর বদলে দিদিমাসির মুখ। ধবধবে ফর্সা। বড় বড় চোখগুলো এখন কোটরে ঢুকেছে। চোখ ঘিরে গাঢ় কালি। মাথায় ধবধবে সাদা ঢেউ খেলানো চুলের একটা ঝুঁটি। নকল দাঁতগুলো চালের দানার মতো মনে হল। আশ্চর্য লাল ঢেউ খেলানো ঠোঁট। হাসিটা গাল-ভরা। দেখলেই মনে হবে এমন সুখে আর ভূ-ভারতে কেউ নেই, কখনো ছিল না। অথচ অনীক শুনেছে দিদিমাসির বর ছিলেন খ্যাপাটে, বদমেজাজি, দিদিমাসি ছেলেমেয়েদের নিয়েও প্রচুর ভুগেছেন। দুজন তো বেপাত্তা। তার ওপরে দেশভাগের সময়ে ওঁদের জমিদারি-টারি প্রায় সবই যায়, কোনমতে যা বেঁচেছে সে-ও হয়ত অনেক। তবে দিদিমাসি নাকি গা-ভরা গয়না পরে টাকার গদির ওপর বসে থাকতেন। এখনও যে পালঙ্কটাতে বসেন অনীকের মায়ের ধারণা সেই পালঙ্কে দিদিমাসির বসবার আসনটার তলায় টাকা-ফাকা সোনা-দানা আছে। দূর হোক গে, দিদিমাসির গুষ্টির পিণ্ডি! এসব কথা আজ এতো মনে হচ্ছে কেন কে জানে! অনীক তো ভাবছিল বোনের কথা। তার বোন তীর্ণা। কেন যে সে ওই শিখটার সঙ্গে জুটতে গেল গোপালের কথায়! আবার দুটো মেয়েকে নিয়ে যাবার পরিকল্পনাও যশজিতের। ওরা নাকি ঘাই-হাঁস। দুটো মেয়ে আরেকটা সমবয়সী মেয়েকে টেনে আনবে। যশ একটা মড ছেলে হয়ে যে এই ধারণা কী করে করল? একটা মার্কিন মেয়ে অত সরলমতি হবে? তা ছাড়া মার্কিন মেয়েদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে কাছে আনতে যদি কেউ পারে সে কখনোই সমবয়সী মেয়ে হবে না। সমবয়সী কিংবা বেশ বয়স্ক পুরুষ হবে। চাই কি ওই বাউলটির মতো বুড়োও হতে পারে।

আহা তীর্ণা! তীর্ণা! ছোট্ট বাধ্য বোনটি অনীকের! কোথায় যে গেল! খুদে সেই তাকলামাকান পার হবার সময়ে অভিমান করেছিল বটে। ভেবেছিল সে রাংতার প্রতি মনোযোগী। তীর্ণা জানত না রাংতা যশের ইয়ে। রাংতার প্রতি অনীক সাধারণ ভদ্রতা আর বন্ধুত্ব ছাড়া কিছুই বোধ করে নি। অনীক এখনও তার যে ইয়ে হতে পারে তাকে খুঁজে পায় নি। খুঁজে পেলেও সে তার ছোটবেলার সাথী তীর্ণা বোনটিকে কখনো অবহেলা করবে না। এবারে অবহেলা করে যা শাস্তি পেল! আচ্ছা তীর্ণাকে যদি আর পাওয়া না যায়! তারা লালবাজারে ডায়েরি করে এসেছে। কিছুদিনের মধ্যেই দূরদর্শনে তীর্ণার ছবি দেখানো হবে। …কিন্তু মেয়েটাকে যদি এরা মধ্যপ্রাচ্যের প্লেনে অলরেডি তুলে দিয়ে থাকে!

দুর্ভাবনায় অনীক আর বসে থাকতে পারল না। সে তড়াং করে উঠে পড়ল, দুবার পায়চারি করল, তারপর বাইরে বেরিয়ে দেখল তার মা আঙুল চাটতে চাটতে রান্নাঘরের দিক থেকে আসছে।

—কি রে খাবি? কাজল প্রশ্ন করল।

—না।

—তুই না খেলে যে আমিও খেতে পারছি না।

—কেন। তোমার তো দিব্যি খাওয়া-দাওয়া শেষ দেখছি। আঙুল-ফাঙুল চাটছো!

—ওঃ। ও তো আচার! ছেলে না খেলে মা খেতে পারে! বল! তাই একটু আচার খাচ্ছিলুম!

উঃ, মা, তুমি পারোও। তীর্ণাটা কোথায় গেল তার নেই ঠিক, আর তুমি আচার খাচ্ছো!

—কেউ হারালে তাকে খোঁজা ব্যাটাছেলের কাজ। তুই আছিস, তোর বাবা আছে। নাঃ সে আবার নেই। সে শান্তিনিকেতনে বিদ্যে ফলাতে গেছে। তোর অকালকুষ্মাণ্ড বন্ধুগুলো আছে। তোরা যা পারিস করবি। আমার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করতে চাইছিস কেন? জানিস না আমার গ্যাসট্রিক? আমি গৃহবধূ, গৃহ-মা বলেই না তোদের এত অবহেলা। গ্যাসট্রিক থেকে আলসার-আলসার থেকে অপারেশন, দশটি হাজার ডাক্তারের টেবিলে না রাখলে ছুরি ধরবে না, তা জানিস? তখন তোদের টনক নড়বে। বিপদ, ইন টার্মস অফ মানি।

—মা, তুমি চুপ করবে?— অনীক প্রায় চিৎকার করে উঠল।

—হ্যাঁ, এবার তোর ওই অকালকুষ্মাণ্ড, এঁচড়ে পাকা বন্ধুর মতো বল কাজলরেখা মিত্তির পৃথিবীর শেষতম মহিলা যাকে আমি মা বলে ডাকব …

অনীক দুম দুম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

কাজল আপনমনেই বলল— বোন হারিয়েছ, বাড়িতে খেতে বড্ড লজ্জা করছে তাই হোটেলে-মোটেলে খেতে গেলে। তোমাদের আমি চিনি না? আমিও দিদিমাসির নাতনি! অতটা বুদ্ধি না ধরতে পারি। কিন্তু বোকা বলে কি আর কাজল অতই বোকা?

বলে-টলে কাজল রান্নাঘরে গিয়ে খাবারের ঢাকা খুলল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress