দিদিমাসির জিন (Didimasir Jin) : 01
তীর্ণা, যশজিৎ, অনীক, গোপাল আর রাংতা— মোট এই পাঁচজনের একখানা দল। যশজিৎ আর গোপাল মাঝে-মধ্যেই ট্রেকিং-এ যায়, রাংতা যায় হংকং, সিঙ্গাপুর, তীর্ণা আর অনীক ভদ্র মধ্যবিত্ত বাঙালির সাধ্য ও আয়ত্তের বাইরের রাজ্যে এখনও গিয়ে উঠতে পারেনি। ওরা যাবে—সান্দাকফু বা মণিমহেশ নয়— রোমা ভেনিজিয়া পাহরী এসবও নয়। নেহাতই কেন্দুলিতে। ‘মন দিতে মন খুলিতে’ ও নয়। নিতান্তই কৌতুহলের টানে।
তৎসত্ত্বেও তীর্ণা-অনীকের মা কাজল খুঁতখুঁত করছিলই। করছিলই।
—কে যশজিৎ, আমি চিনি না। জানি না। কোনদিন নাম শুনিনি, ধাম শুনিনি।
—তুমি চেনো না বলেই একটা আছে মানুষ তো নেই হয়ে যেতে পারে না মা!
অনীক হাসি-হাসি মুখে মায়ের ভয় ভেঙে দিতে চেয়েছিল।
আসল কথা, গোপালকে কাজল মোটে পছন্দ করে না। তার ধারণা হয়েছে, যাচ্ছে শুধু অনীক তীর্ণা আর গোপাল, বাকি নামদুটো স্রেফ ব্ল্যাঙ্ক শট। বানানো। এবং তীর্ণা ও গোপালের ঘনিষ্ঠতায় সহযোগিতা করতেই অনীকের দাদাসুলভ এই বদান্য আয়োজন।
—আছে, অথচ আমি কোনদিন শুনলুম না? সে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকে।
—গোপালের বন্ধুর কথা তুমি কী করে শুনবে মা? তুমি কি কখনও গোপালের সঙ্গে দু মিনিটও কথা বলেছ?— তীর্ণা বলল।
—দু মিনিট কেন, পাঁচ মিনিটও বলেছি দশ মিনিটও বলে থাকতে পারি, তবে আমি বলিনি তোমাদের গোপাল বলেছে। আর কাউকে কথা বলতে দেয় নাকি সে? ঝড় যেন একটা!
—ঝঞ্ঝাবাত্যা— অনীক শুদ্ধ করে দিল।
—রাংতা আবার কারও নাম হয় নাকি? কাজলের দ্বিতীয় খুঁতখুঁতুনি শুরু হয়।
— তা সত্যি, রাংতা সিগারেটের প্যাকেটে থাকে, রাংতা প্রতিমার গয়নায় থাকে। আর কোথায় কোথায় থাকে মা?
মা এবার সত্যি সত্যি রেগে যায়।
তখন দু ভাইবোনে গান ধরে—
‘কাজল কাজল কুমকুম
শিউলি ঝরে ঝুমঝুম।
সোনার আলোয় ভাসিয়ে তরী চলছে মেঘের মরশুম।’
মা রাগ করে সবুজ আঁচল দুলিয়ে চলে যাবার উপক্রম করে। তারপর হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বলে— কী জানি, রাংতা-টাংতা নাম শুনলে আমার খুব সন্দেহ হয়।
—কেন তুমি আমার বন্ধু চইয়ের নাম শোননি? চই যদি হতে পারে, রাংতা কেন নয়?
—কেমন একটা মিথ্যে-মিথ্যে গন্ধ ছাড়ছে নামটা থেকে।
—মা!!! তুমি আমাদের মিথ্যেবাদী, ভাবছ? সন্দেহ করছো? তীর্ণা এবার ভীষণ আহত গলায় বলে।
—দেখো মা, তোমার মতো পাকা এবং জেদী মেয়ে খুব কমই আছে। ক্লাস সেভেনে পড়ে, ছেলের নাম ঠিক হয়ে গেল। ক্লাস এইটে পড়ে, মেয়ের নাম ঠিক হয়ে গেল … সবাইকার মা তো আর এ রকম নয়!— অনীক মাকে মোক্ষম জায়গায় মোচড় দিয়েছে।
কাজল আর দাঁড়ায় না। তার এইসব ছেলেবেলাকার গল্প এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে করা মানে তাদের হাতে নিজের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে দেওয়া। সেই বোকামিটাই সে করেছে। সবাই জানে, বাচ্চারা একটা স্টেজে বাবা-মাদের ছোটবেলার গল্প শুনতে চায় এবং কাজল তখন কথাগুলো ওদের বলে ফেলেছিল।
—জানিস আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখনই ঠিক করে ফেলেছিলুম—মেয়ে হলে, হবেই একটা, তার নাম দেবো তীর্ণা। আর ছেলে হলে অনীক।
—আর বাবার নাম? বাবার নাম ঠিক করোনি?
এইটে কাজল বলতে গিয়েও বলেনি। কী জানি বাবা কার মনে কী রি-অ্যাকশন হয়! তীর্ণা-অনীকের নাম নিয়েই যা তুলকালাম! নার্সিংহোমে জ্ঞান ফিরতেই শ্বশুরমশাইয়ের মুখ— যাক মা ঈশ্বরের প্রসাদে সব ভালোয় ভালোয় হয়ে গেছে। শিবপ্রসাদের ওজন সাড়ে ছ পাউন্ড। হী ইজ ডুয়িং ওয়েল।
—শিবপ্রসাদ কে?— দুর্বল কণ্ঠে নতুন জননীর জিজ্ঞাসা।
—কে আবার? আমার প্রথম পৌত্র?
কাজল লাজ-লজ্জা ভুলে হেঁকে উঠেছিল—ও মা, ও বাবা ওর নাম যে অনীক। শিবপ্রসাদের মতো সেকেলে বিচ্ছিরি নাম আমি মোটেই দেবো না।
শ্বশুরমশাই আর নার্সিংহোম-মুখো হননি, তবে মেয়ে হতে গম্ভীরভাবে বলেছিলেন— কী বউমা, ইটি কি অনকিনী? সে ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সশস্ত্র হতে হবে।
—না বাবা, ও তীর্ণা।
—তীর্ণা? তা তোমার তীর্ণা বড়ই জীর্ণা এবং শীর্ণা হয়েছেন। মনে হচ্ছে আমার ঠাকুমাই আবার ধরায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি যে রকম ভুগতেন তাতে করে আমার পৌত্রী উপসর্গবিহীন হলেই ভালো।
কাজল ছেলেমেয়েকে যেটা বলেনি সেটা হচ্ছে— বরের নামটাও সে ঠিক করে ফেলেছিল, এবং ওই ক্লাস এইটে পড়তেই। নামটা ধীমান। এবং এই বরের নাম নিয়ে যা ভোগা তাকে ভুগতে হয়েছিল, সে এক মহাভারত বিশেষ। বাড়িতে মেয়ের বর খোঁজা হচ্ছে, কিন্তু বড়দের তো আর বলা যায় না ধীমান নামের বর খোঁজো। খোঁজা হচ্ছে, হোক। ইতিমধ্যে কাজলও খুঁজতে থাক। এক বন্ধুর বাড়িতে তার দিদি না দাদার বিয়েতে গিয়ে লুচি ছিঁড়তে ছিঁড়তে কানে এলো ‘ফিশ ফ্রাইয়ের ঝুড়িটা এদিকে ধীমানদা!’ আর খাওয়ায় মন নেই। কোন পরিবেশনকারীটি ধীমানদা বোঝবার জন্যে সে তখন ছোট বড় কটাক্ষ পাঠাচ্ছে। ইতি-উতি। ফিশ ফ্রাইয়ের ঝুড়ি নিয়ে অবশেষে ধীমানদা এলো। কাজল জীবনে অত মোটা লোক দেখেনি। চুল কাঁচা-গোঁফ পাকা। দুটি গাল দুটি খাগড়াই কাঁসার জামবাটির মতো। ধীমানের পেছন পেছন এলো ধীমানের সদ্য-তরুণ তনয়। ‘উঃ বাবা! তুমি যদি একবার বেকায়দায় হেলো না, এখানে একটা ঘটোৎকচ পাত হয়ে যাবে, ট্রেটা আমাকে দাও।’
—‘আর তুই?’ ধীমান রেগে বললেন, ‘তুই যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। অর্ধেক ফিশ ফ্রাই পরিবেশন করবি, বাকি অর্ধেক তোর নিজের পেটে ইতি গজ হয়ে যাবে! মশায়রা এই ছোকরা মহা সেয়ানা, নজর রাখবেন।’ বলে ধীমানবাবু কোনক্রমে তাঁর বিপুল বপু দুই পঙ্ক্তির মধ্যিখান থেকে সরালেন।
তবু অঘটনও তো ঘটে! একদিন কান খাড়া করে কাজল শুনল, বাবা মাকে বলছেন— পাত্র ভালো। সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বি কম পাশ করে ছোকরা ল পড়ছে। এখনও পড়ছে। বাবা অবশ্য উকিল। রেডি পসার, তবু পড়ুয়া ছেলেই তো! নামে যেমন ধীমান, ঘটে বুদ্ধিও যদি তেমনি থাকে তাহলে তো …
মা বললেন— না বাপু, ও সব পড়ুয়া-টড়ুয়া ছাড়ো। ছোট ঠার্কুদার উদাহরণ চোখের সামনে থাকতেও যে কী করে তোমরা …
বাবা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন— আরে বাবা তখনকার দিনে সব্বাই পড়ুয়া পাত্রের সঙ্গেই মেয়ে বিয়ে দিত।
—সে সব তো আর বিয়ে ছিল না, ছিল পুতুল খেলা। তার ফল হয়েছে বিষময়।
—কী যে বলো! সব ফলই অমনি বিষময় হয়ে গেল!
যাই হোক, বাবার আগ্রহে ধীমান পিতা এবং বন্ধু সহযোগে এলো।
পিতা বললেন— ‘দেখুন মশাই আমরা আইন বেচে খাই। উই আর অ্যাকাসটমড টু কল আ স্পেড আ স্পেড। আপনার মেয়েটি কালো। মানে, ইচ্ছে করলে আপনি শ্যামবর্ণ বলতে পারেন, আপনি ডিফেন্সে আছেন, আমি কিন্তু সরকার পক্ষের কৌঁসুলি, ছাড়ব না এক কথায়। রং পেনসিল, ভুষো কালি, চেলপার্ক সব মজুত রেখে মিলিয়ে মিশিয়ে প্রমাণ করব পাত্রী কালো। এখন সে ক্ষেত্রে আপনাকে কিছু জরিমানা দিতে হয়। বিশ হাজার ধার্য করলুম ক্যাশে, সোনা দেবেন ত্রিশ ভরি। বাসন-কোশন, আসবাবপত্র আপনার রুচি-অনুযায়ী। যাই হোক, আসুন আমরা একটু আড়ালে যাই আমার পুত্রেরও কিছু জেরা ন্যাচারালি আছে।’
ধীমান এবং তার বন্ধুরা এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে রসগোল্লা, পানতুয়া ইত্যাদি উদরস্থ করছিল এবং খাদ্যগুলির গুণাগুণ বিচার করছিল। যেমন ‘রসগোল্লাটা নবীনের পাক, কিন্তু পানতুয়াটা কোথাকার বল তো! চিত্তরঞ্জনের?’ ‘রাবড়ি ননীর না হয়েই যায় না’, ‘খাস্তার নিমকি নির্ঘাৎ গাঙ্গুরামের’।
দুই পিতা অদৃশ্য হতে শ্রীমান ধীমান বলল— আচ্ছা, আপনাদের নির্ঘাৎ গাড়ি আছে, না?
—হ্যাঁ।
—কী করে ধরলুম, জিজ্ঞেস করলেন না তো?
কাজল চুপ করে রইল। সারা কলকাতা পদব্রজেই কি তারা খাবারের স্যাম্পল পরীক্ষা করে থাকে, এ প্রশ্ন তার মনে উঠেছিল। ধীমানের শার্লক হোমস গিরির চেয়েও তীব্র এ কৌতূহলী জিজ্ঞাসা। কিন্তু সে চুপ।
আর্ল স্ট্যানলি গার্ডনারের পেরি মেসন কেসেস পড়েছেন?
—না।
—স্ট্যানলি গার্ডনারের কোর্ট সিনগুলো না পড়লে ওকালতিতে কি করতে পারবেন না।
কাজল এতক্ষণে বলল— আমাকে তো কেস প্লীড করতে হবে না, হবে আপনাকে।
—হিয়ার হিয়ার—এক বন্ধু সোৎসাহে বলে উঠল।
—শুনেছিলুম অনার্স গ্র্যাজুয়েট, এ দিকে হ্যাঁ আর না ছাড়া কিছুই শুনছি না। যাক বোবা নয়।
কাজল ততক্ষণে বুঝেছে এই ফাজিল ফিচেল ছোকরার দল তাকে পছন্দ করেনি, স্রেফ ভাঁড়ামো করছে। সে উঠতে উঠতে বললে— বাকি মিষ্টিগুলো খেয়ে ফেলুন, আখেরে কাজ দেবে। সারা নর্থ ক্যালকাটা ঢুঁড়ে আনা। —এই বলে সে সেবার রণে ভঙ্গ দেয়। এবং ধীমান নামের ওপর তার এতই বিতৃষ্ণা হয়ে যায় যে সে গঙ্গাপ্রসাদ নামের পাত্রকে বিয়ে করতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি।
ছেলেমেয়ে চালাক কম নয়। সুবিধে পেলেই জিজ্ঞেস করে— আচ্ছা মা, যে তরুণ-তরুণীর নাম অনীক এবং তীর্ণা এবং যাদের মায়ের নাম কাজলরেখা, তাদের পিতার নাম কী করে গঙ্গাপ্রসাদ হয়? দিস সীমস এ মিস্ত্রি।
বেশি চাপাচাপি করতে কাজল গম্ভীরভাবে বলেছিল— বাবাদের, মানে বরেদের তো আর স্ত্রীরা অন্নপ্রাশন, নামকরণ ইত্যাদি করতে পারে না!
—তা পারে না, কিন্তু চুজ করতে পারে, পারে না? কী করে গঙ্গাপ্রসাদে রাজি হলে মা?
এই সময়ে গঙ্গাপ্রসাদ স্বয়ং ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে তিনজনকে জমায়েত দেখে ইউরেকার ভঙ্গিতে বলেছিলেন : এই তোমরা। তোমাদের তিনজনের মধ্যেই কেউ।
—কী বাবা? আমাদের তিনজনের মধ্যে …
—মাল্যবান।
—মাল্যবান? কী রকম রামায়ণ রামায়ণ গন্ধ ছাড়ছে না?
—পড়ো তো খালি হ্যারল্ড রবিনস আর হেডলি চেজ। রামায়ণের কী জানো? জীবনানন্দের উপন্যাস ‘মাল্যবান’, পাওয়া যায় না। আমি জেরক্স করিয়ে নিয়েছিলুম। কোথাও পাচ্ছি না।
—পাবে বাবা পাবে, তোমার অতি সন্নিকটেই পাবে।
বাবা ঝড়ের মতো চলে গেলেন।
অনীক বলল : আহা, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা …’
আচ্ছা মা, এই লাইনটা বাবা নিশ্চয় তোমায় ফুলশয্যার রাতে বলেছিল। বলেনি? হ্যাঁ ঠিক ধরেছি।
কাজলের মুখ লাল হয়ে উঠছে। সত্যিই বলেছিল তার বর। এই ছেলেগুলো কী রকম এঁচড়ে পাকা দেখো, যে ফুলশয্যার ঘরে আড়ি পাতবার তাদের কোনও সম্ভাবনাই ছিল না, সেখানকার সংলাপ স্রেফ বুদ্ধি আর অনুমান দিয়ে … ‘হ্যাঁ বলেছিলো, তোকে বলেছে কানে ধরে।’ কাজল যথেষ্ট তীব্র প্রতিবাদ করে। কিন্তু কাজ দেয় না সেটা। ওদিকে তীর্ণা ততক্ষণে ধরে ফেলে—
‘আমি যদি হতাম বনহংস
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে …’
এটা অন্তত মা, নিশ্চয়ই। কাজলের লালিমা আরও বেড়ে যায়। কারণ এটাও … এবং ওই ফুলশয্যার রাতেই। গঙ্গাপ্রসাদের জীবনানন্দ-প্যাশন তার ছেলেমেয়ে স্ত্রী সবাই জানে।