স্টেশন থেকে বাড়িতে
কাল যে পথ দিয়ে স্টেশন থেকে এ বাড়িতে এসেছিল, সেই পথে হাঁটতে শুরু করল অর্জুন। রাস্তা ফাঁকা বলাই ঠিক, দু-চারজন কাজে-কর্মে বেরিয়েছে। তারা অবাক হয়ে অর্জুনকে দেখছে। হাঁটতে হাঁটতে সেই বিশাল গাছের পাশে এসে দাঁড়াল সে। গত রাতে এখানেই সে বৃষ্টির জল এড়াতে দাঁড়িয়ে ছিল। এখানে দাঁড়িয়ে বিদ্যুতের আলোয় সেই চারজনকে দেখতে পেয়েছিল। এখন মনে হল, ওরা নির্ঘাত ওপাশের মাঠ ভেঙে এসে রাস্তায় উঠেছিল। মাঠের দিকে তাকিয়ে খানিকটা জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখতে পাওয়া গেল না। অর্জুন মাথা নাড়ল। কৌতূহলী হয়ে ওদিকটা দেখতে যাওয়া ঠিক হবে না। যারা সারারাত এই গ্রামে রাজত্ব করে, তারা দিনেরবেলায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকার মতো বোকামি নিশ্চয়ই করবে না।
স্টেশনে এল অর্জুন। প্ল্যাটফর্মে একটা গোরু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঝিমোচ্ছে।
স্টেশনমাস্টারের ঘরে উঁকি মারল সে। ভদ্রলোক খালি গায়ে লুঙ্গি পরে একটা খাতায় কিছু লিখছেন। সে জিজ্ঞেস করল, ভাল আছেন?
মুখ ফিরিয়ে দেখে নিয়ে স্টেশনমাস্টার বললেন, তা হলে বেঁচে আছেন?
মরে যাওয়ার মতো কোনও ঘটনা তো ঘটেনি। অর্জুন ভিতরে ঢুকল।
আপনার ভাগ্য ভাল বলতেই হবে।
বসতে পারি?
ভিতরের ঘরে গিয়ে বসুন। আমি কাজ শেষ করে আসছি।
অর্জুন ভিতরের ঘরে চলে এল। বোঝা যাচ্ছে, এই ঘরটাই স্টেশনমাস্টারের শোওয়া এবং রান্নার ঘর। পাশে একটা বাকথরুম-কাম-ল্যাট্রিনও রয়েছে। মিনিটখানেক পরে স্টেশনমাস্টার ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, চা খাবেন?
না। একটু আগে খেয়েছি।
ঘণ্টাদেড়েক পর একটা ট্রেন আসছে ভুবনেশ্বর থেকে। হরিরাম বোধহয় ওই ট্রেনে ওষুধ নিয়ে ফিরবে। তুলসীদাসজি কেমন আছেন?
ভাল।
খুব খারাপ লাগে। শুনলাম, ওঁর স্মৃতিশক্তি একদম লোপ পেয়ে গিয়েছে। আপনাকে কী বললেন? স্টেশনমাস্টার তাকালেন।
আমাকে উনি সত্যি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কি না এখন সন্দেহ হচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি কারও স্মৃতিবিভ্রম হতে পারে? ওঁর ভাই-বোনেরা জানতেন বলে আমি আতিথ্য পেয়েছি।
তা হলে আজ ঠিকই শুনেছি।
কার কাছে শুনলেন?
যে ডাক্তার ওঁর চিকিৎসার জন্যে এই গ্রামে রয়ে গিয়েছেন, তিনি স্টেশনে এসেছিলেন ভুবনেশ্বরে ফিরে যাওয়ার ট্রেনের সময় জানতে। তিনিই বললেন, অবস্থার খুব দ্রুত অবনতি হচ্ছে। স্টেশনমাস্টার মাথা নাড়লেন, তা হলে আপনার এখানে আসা বৃথা হল?
মনে তো হচ্ছে।
যে ডেকেছে সে যদি মনে করতে পারে, তা হলে থেকে কী করবেন? আবহাওয়া আরও খারাপ হওয়ার আগেই চলে যান।
আচ্ছা, আপনি তো একজন সরকারি অফিসার, এখানে অনেকদিন আছেন। হঠাৎ গ্রামটার আবহাওয়া খারাপ হল কেন বলুন তো?
আপনি কী করে ভাবলেন, জানলেও আমি বলব? আপনি অচেনা অজানা মানুষ। মুখ খুললে বিপদে পড়ব না এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। স্টেশনমাস্টার কথা শেষ করামাত্র একটা মিহি স্বর ভেসে এল, মাস্টার, দরজাটা খুলুন।
এত সরু গলা, কিন্তু তা মেয়েদের নয়। মাস্টার মাথা নাড়লেন, এই সময় হঠাৎ এল? আপনি এখানে চুপচাপ বসে থাকুন। কোনও শব্দ করবেন না। ফিসফিস করে বললেন স্টেশনমাস্টার। তারপর গলা তুলে বললেন, এক মিনিট, আসছি।
একটু পরে স্টেশনমাস্টারের গলা কানে এল অর্জুনের, আরে। আসুন, আসুন।
মিহি গলা জিজ্ঞেস করল, কী করা হচ্ছিল?
বাথরুমে গিয়েছিলাম।
হুঁ। আজ রাতে মেল ট্রেনটাকে এখানে এক মিনিটের জন্যে দাঁড় করাতে হবে।
মেল ট্রেন? এখানে তো দাঁড়ায় না।
দাঁড়ালে আমি এখানে আসব কেন? মিহি হাসি শোনা গেল, ওই লাল পতাকা আর লণ্ঠন দেখলেই অত বড় ট্রেনটা জিভ বের করে দাঁড়িয়ে যাবে।
শুনুন। আমার কোনও অধিকার নেই মেল ট্রেনকে এখানে দাঁড় করানোর। যদি করি, তা হলে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে। সন্তুষ্ট না হলে কর্তৃপক্ষ আমাকে সাসপেন্ড করবেই। গরিবের চাকরিটা চলে গেলে আপনাদের কী লাভ হবে?
ট্রেনটা আসছে তা আপনি কখন জানতে পারবেন?
জংশন ছাড়লেই আমাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
তা হলে বলি, আপনাকে একটু কষ্ট দিতে বাধ্য হব। মেল ট্রেন জংশন ছাড়লেই আপনি প্ল্যাটফর্মের উপর হ্যাঁজাকটাকে রেখে দেবেন। ওর আলো দেখতে পেলে বুঝতে পারব মেল ট্রেন আসছে। ভুল যেন না হয়।
কিন্তু…!
আপনি যখন পারবেন না তখন বাকিটা আমরাই করে নেব।
দেখুন, এটা ঠিক হচ্ছে না।
ঠিক-বেঠিক আমরা আপনার কাছে শিখব না। অন্য কেউ হলে এত কথা আমাকে বলতে হত না। কিন্তু স্টেশনমাস্টার হওয়ায় আপনাকে আমাদের প্রয়োজন আছে। দয়া করে এসব কথা উপরমহলকে জানানোর মতো ভুল করবেন না। ঠিক আছে?
খানিক পর দরজা বন্ধ করার আওয়াজ হল। স্টেশনমাস্টার ফিরে এলেন। তাঁর মুখ প্রায় রক্তশূন্য। হাত কাঁপছিল। অর্জুন বলল, আপনি বসুন।
স্টেশনমাস্টার বসলেন। অর্জুন কুঁজো থেকে জল গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে দিল। ভদ্রলোক চটপট জল খেয়ে নিলেন। নিয়ে মাথা নাড়লেন, গত কয়েক মাস ধরে আমি চার-চারটে দরখাস্ত করেছি বদলির জন্যে, ওরা পাত্তাই দিচ্ছে না। কী যে করি!
মেল ট্রেনটা কখন এখান দিয়ে যায়?
অ্যাঁ! আপনার কী দরকার?
আপনি তো আমাকে কিছু বলেননি। ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি নিজেই শুনেছি। অর্জুন বলল, হ্যাঁ, কখন ট্রেনটা যায়?
রাত দশটা-দশটা এক। তবে মাঝে মাঝে লেট করে।
তার আগের ট্রেন?
সন্ধে সাতটায়। স্টেশনমাস্টার বললেন, ওটা লোকাল ট্রেন।
মেল ট্রেন শেষ কোথায় থামে?
আপনি কী চাইছেন বলুন তো?
অর্জুন উঠে দাঁড়াল, দুপুরের পর এখান থেকে ওদিকে যাওয়ার ট্রেন আছে?
আছে। তিনটের সময়।
স্টেশনমাস্টারকে বিহ্বল অবস্থায় রেখে অর্জুন বেরিয়ে এল। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। তুলসীদাসজির বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল সে। কিছু দূর যাওয়ার পর বাচ্চাদের গলার হইচই চিৎকার শুনতে পেল সে। বাঁক ঘুরতেই সে দেখতে পেল, পাগলটি দৌড়ে আসছে আর তার পিছনে মজা পেয়ে ছুটছে কয়েকটা বাচ্চা, কেউ-কেউ ঢিল ছুড়ছে। হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন ছোটখাটো একজন মানুষ। ধমক দিলেন বাচ্চাদের, অ্যাই কী হচ্ছে? পাগলের পিছনে কেন লাগছ? যাও, বাড়ি যাও। পাজির পাঝাড়া ছেলে সব।
ছেলেগুলো থমকে গেল। তারপর দৌড়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলে গেল। অর্জুন অবাক হয়ে গেল। এই কণ্ঠস্বর একটু আগে সে শুনেছে। স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে যে লোকটি কথা বলছিলেন, তিনি অবশ্যই এই ব্যক্তি। পাগল ততক্ষণে তার পাশে এসে দু’হাত মাথার উপর তুলে অভিযোগ জানাচ্ছিল। অর্জুন বলল, ঠিক আছে। আর ভয় নেই। আপনি আপনার বাড়িতে চলে যান।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাড়িতে থাকলেই তো হয়! কিন্তু বাড়ি থাকলে তো থাকবে! শুনলাম, এই পাগলটাকে কয়েকদিন আগেও কেউ এখানে দ্যাখেনি। কোত্থেকে এটা এসে জুটল কে জানে? কিন্তু আপনাকেও তো প্রথমবার দেখছি। অর্জুনের দিকে তাকালেন বিরক্ত লোকটি।
হ্যাঁ। আমাদের এই প্রথম দেখা হল। আপনি এই গ্রামেই থাকেন?
আমার চোদ্দো পুরুষ এই গ্রামে ছিলেন। আপনি কে? কোন বাড়ি?
বিষ্ণুদাসজির বাড়িতে বেড়াতে এসেছি।
অ্যাঁ। আপনি পায় না আবার শঙ্করাকে ডাকে। ওটা বিষ্ণুর বাড়ি হল কবে থেকে? ওর এখানে কোনও বাড়িঘর নেই। আচমকা মানুষটি হাঁটতে লাগলেন গ্রামের দিকে।
পাগল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল। সেই অবস্থায় বলল, নিজেকে খুব মাতব্বর ভাবে। বলেই চট করে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। অর্জুন দেখল, দু দিকের রাস্তাই জনমানবশূন্য। সে গাছটার পাশে এসে দাঁড়াতেই পাগল বলল, সবচেয়ে অসুবিধে হয় সিগারেট খাওয়ার সময়। পাগল তো সিগারেট খায় না। মাঝে-মাঝে বিড়িতে দু’-একবার টান দিতে পারে। লোকটি একটা সিগারেট বের করে সন্তর্পণে ধরাল। একগাল ধোঁয়া কিছুক্ষণ ধরে রেখে বেশ তৃপ্তির সঙ্গে ছাড়ল।
আপনি এভাবে এখানে পড়ে আছেন কেন?
ডিউটি ইজ ডিউটি। অর্জুনবাবু, এটা আমার শেষ সুযোগ।
আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?
যারা জানার তারা জেনে গিয়েছে। ওই বিষ্ণুদাস আর ডাক্তার বাসস্ট্যান্ডের চায়ের দোকানে বসে চারবার আপনার নাম বলেছে। আপনি এখানে সত্যসন্ধান করতে নর্থ বেঙ্গল থেকে এসেছেন। সিগারেট খাবেন?
না।
আপনি পুলিশে চাকরি করেন?
ঠিক পুলিশে নয়। আই বি-তে। এখানে যে ভয়ংকর ভৌতিক কাণ্ড হচ্ছে তা হেডঅফিস বিশ্বাসই করে না। যেহেতু আমি কোনওদিন কোনও কেস সমাধান করতে পারিনি, তাই আমাকে ডেকে বলল, এই গ্রামে এসে পাগল সেজে খোঁজখবর নিতে। যদি সঠিক সন্ধান দিই তা হলে প্রমোশন হবে। আরে মশাই, আমার দশ বছর পরে ডিপার্টমেন্টে ঢুকে ওরা প্রাশন পেয়ে গেল, আর আমি এক জায়গায় আটকে আছি। এবার যেমন করে হোক…!
সিগারেট নেভান।
অ্যাঁ।
লোকটির হাত থেকে সিগারেট নিয়ে মাটিতে ফেলে জুতোর তলায় রাখতে–রাখতেই সাইকেল দুটোকে দেখা গেল। দুটি তরুণ দ্রুত বেরিয়ে গেল ওদের পাশ দিয়ে। অর্জুন বলল, আপনি সিগারেট খেতে খেতে আমার সঙ্গে গল্প করছেন দেখলে আর পাগল সেজে থাকতে পারতেন না। আপনার নাম কী?
জগন্নাথ দাস। অথচ কোথায় তিনি, কোথায় আমি!
জগন্নাথবাবু, আপনি স্টেশনে চলে যান। ওখানকার প্ল্যাটফর্মে পাগলের মতে থাকুন। বিকেল তিনটের সময় যে ট্রেন আসবে তাতে চড়ে বসবেন। আপনার সঙ্গে তারপরে আমার দেখা হবে।
আমি যদি এখানেই পৌনে তিনটে পর্যন্ত থাকি?
কী করে সময় বুঝতে পারবেন?
তা নিয়ে আপনি ভাববেন না। কিন্তু আমার উপর গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ নেই। ওটা করলে কৈফিয়ত দিতে হবে অনেক।
দেবেন। আমি বলে দেব কী দিতে হবে। অর্জুন গাছের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল।
.
দোতলায় উঠতেই বংশী ছুটে এল, আপনি ফিরছেন না বলে সবাই দুশ্চিন্তা করছিলেন। বেলা হয়ে গিয়েছে। স্নান-খাওয়া করবেন তো?
হরিরাম স্নান করেছে?
উনি জলখাবার খেয়ে সেই যে শুয়েছেন, এখনও ঘুম ভাঙেনি।
তুলসীদাসজির খাওয়া হয়ে গিয়েছে?
হ্যাঁ।
আমি একবার যেতে পারি?
যান। ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়ে গেলেন। এখনও বোধহয় জেগে আছেন।
অর্জুন তুলসীদাসজির কাছে গিয়ে দেখল, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। সে দরজায় দু’বার টোকা মারল। একটু পরে দরজা খুললেন দুই মহিলার মধ্যে যিনি ছোট, মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ঘুমোচ্ছেন নাকি?
আসুন। সরে দাঁড়ালেন মহিলা।
অর্জুন ওঁর পিছন পিছন তুলসীদাসজির ঘরে ঢুকল। তুলসীদাসজি বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। বিছানায় পড়ে থাকা হাতের আঙুলগুলো মাঝে মাঝে নড়ছে। মহিলা বললেন, বেশ ভাল ছিলেন। গল্প করতে করতে খাওয়াদাওয়া করলেন। কিন্তু ডাক্তার এসে পরীক্ষা করার পর আবার ইঞ্জেকশন দিলেন। বললেন, নাড়ি খুব চঞ্চল হয়েছে। হরিরামের আনা ইঞ্জেকশনটা এঁকে দিলেন তিনি। দিতেই ঝিম মেরে গেলেন উনি। একে ঘুম বলা ভুল হবে।
অর্জুন তুলসীদাসজির মুখের উপর ঝুঁকে দেখল। চোখ বন্ধ। শ্বাস পড়ছে। সে টেবিলের উপর রাখা অনেক ওষুধের দিকে তাকাল। তারপর কাছে গিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, কোন ইঞ্জেকশনটা দেওয়া হয়েছে?
মহিলা একটা ইঞ্জেকশনের বাক্স দেখিয়ে দিলেন। অর্জুন সেটা তুলে নিয়ে নাম পড়ল। ক্যাশমেমোর নামের সঙ্গে কোনও মিল নেই। তলায় লেখা রয়েছে, এটিতে স্টেরয়েড রয়েছে। অবাক হয়ে গেল সে। এই ওষুধ তো হরিরাম আনেনি। মহিলা বললেন, আজ থেকে এই ট্যাবলেট খাওয়াতে বললেন।
ট্যাবলেটের নাম পড়ল অর্জুন, লিপিয়াম।
উনি নিশ্চয়ই ইঞ্জেকশনটা সঙ্গে এনেছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনারা আপত্তি করবেন। কোনও ইঞ্জেকশন বা ট্যাবলেট ওঁকে দেওয়া চলবে না।
কিন্তু আপত্তি করলে বলবেন, আমরা চিকিৎসায় বাধা দিচ্ছি।
বলুক। কিন্তু এগুলো ওঁর ক্ষতি করছে বলে আমি মনে করছি। আর একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার।
স্নান-খাওয়া শেষ করে ঘড়ি দেখল অর্জুন। পৌনে দুটো বাজে। তৈরি হয়ে সে সোজা বিষ্ণুদাসজির ঘরে গেল। ভদ্রলোক খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তাকে দেখে সোজা হয়ে বসে বললেন, আসুন, আসুন, শুনলাম স্টেশনের দিকে বেড়াতে গিয়েছিলেন। দিনেরবেলায় অবশ্য কোনও সমস্যা নেই। বসুন।
কে বলল আপনাকে? অর্জুন বসল।
এই গ্রামেরই একজন। বলুন, কী খবর?
হরিরামকে আর-একবার ভুবনেশ্বরে পাঠাতে হবে।
নিশ্চয়ই পাঠাব। কিন্তু কেন? কী হয়েছে?
ওকে ডাক্তারবাবু যে ইঞ্জেকশন আনতে দিয়েছিলেন তার ক্যাশমেমো করেও প্যাক করার সময় কেমিস্ট ভুল করে অন্য ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছে।
সে কী! ।
ওর কাছে ডাক্তারবাবুর লেখা প্রেসক্রিপশন এবং দোকান থেকে দেওয়া ক্যাশমেমো রয়েছে। মিলিয়ে দেখলেই পার্থক্য বুঝতে পারবেন।
সর্বনাশ! এত বড় ভুল দোকানদার করল? আর এই বুন্ধুটা সেটা না দেখে নিয়ে চলে এল? বিষ্ণুদাসজি বেশ উত্তেজিত।
ভুল মানুষমাত্রেরই হয় বিষ্ণুদাসজি। হরিরাম ভুল করে ওষুধ নিয়ে এল, ডাক্তারবাবুও ভাল করে না দেখে আপনার দাদার শরীরে সেই ওষুধ পুশ করে দিলেন? দেখলে নিশ্চয়ই দিতেন না। শান্ত মুখে বলল অর্জুন।
সেই ইঞ্জেকশন অলরেডি দাদাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ। তারপর থেকেই উনি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছেন। অবশ্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আবার ঠিক হয়ে যাবেন।
দেখুন, আমি এসবের কিছুই জানি না। আপনি বাইরের লোক হয়েও এত জানলেন আর আমাকে কেউ জানাল না! না না। ডাক্তারের উচিত ছিল কী দিচ্ছে তা দেখে দেওয়া।
ভুল তো হতেই পারে। উনি কত বড় ডাক্তার। নিজের প্র্যাকটিস ফেলে রেখে এখানে এসেছেন। আচ্ছা, আমি একটু বেরোব। আপনি হরিরামকে এখনই ওগুলো পালটে নিয়ে আসতে বলুন।
আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
একটু বেড়িয়ে আসি।
দাঁড়ান। আপনার সামনেই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলব।
ডাক্তারকে পাওয়া গেল বাগানে। একটা ইজিচেয়ারে আধশোওয়া হয়ে গাছ দেখছেন। বিষ্ণুদাসজি তাঁকে গোলমালের কথা বলামাত্র তিনি মাথা নাড়তে লাগলেন, অসম্ভব। আমি একজন ডাক্তার। এত বড় ভুল আমি করতে পারি না।
অর্জুন বলল, ভুল অজান্তেই হয় ডাক্তারবাবু। যে ইঞ্জেকশনটা আপনি তুলসীদাসজিকে দিয়েছেন, সেটা টেবিলের উপর রয়ে গিয়েছে।
মিথ্যে কথা। প্রায় গর্জন করলেন ডাক্তার, হতেই পারে না। ইঞ্জেকশনটা দিয়ে আমি প্যাকেটটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। কিছু রেখে আসিনি।
তা হলে যেটা ওখানে আছে সেটা…?
আমার ব্যবহার করা নয়। কেউ আমার চরিত্র হনন করার জন্যে ওটা ওখানে রেখে এসেছে। কী ইঞ্জেকশন ওটা?
আপনারা ওখানে গেলেই দেখতে পাবেন। আচ্ছা, আপনি কি ওঁকে লিপিয়াম ট্যাবলেট খাওয়াতে বলেছেন?
হ্যাঁ বলেছি। ওটা এখন ওঁকে সাহায্য করবে।
তা হলে বিষ্ণুদাসজি, ডাক্তারবাবুর কথা নিশ্চয়ই সত্যি, ওই ইঞ্জেকশন কে ওখানে রেখে গেল তা নিয়ে খোঁজখবর করা দরকার। কিন্তু আমার অনুরোধ, আপনি কোনও উদ্যোগ নেবেন না। যে আসামি সে নিশ্চিত থাক এই ভেবে যে, আপনি কিছু জানেন না। যা করবার তা আমি করব। আচ্ছা চলি।
.
স্টেশনে পৌঁছে অর্জুন দেখল, ট্রেন আসার সিগনাল দেওয়া হয়েছে। স্টেশনমাস্টার গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। সে কাছে গিয়ে বলল, সবচেয়ে কম ডিসট্যান্সের একটা রিটার্ন টিকিট আমাকে দিন।
শর্ট ডিসট্যান্সে রিটার্ন টিকিট হয় না। মুখ ফেরালেন স্টেশনমাস্টার।
তা হলে ওয়ানওয়ে টিকিট দিন।
স্টেশনমাস্টার তাঁর ঘরে ফিরে গেলেন। অর্জুন চারপাশে তাকিয়ে পাগল সাজা লোকটাকে দেখতে পেল না। তিনটে স্টেশন পরে একটা জংশন স্টেশন, যার নাম খুরদা, সেই পর্যন্ত যাওয়ার টিকিটের দাম বত্রিশ টাকা দিতে হল। টিকিট দেওয়ার সময় স্টেশনমাস্টার বললেন, অনুগ্রহ করে আমাকে ঝামেলায় ফেলবেন না।
টিকিট নিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতেই সে হরিরামকে দেখতে পেল। প্রায় দৌড়ে দৌড়ে আসছে। স্টেশনমাস্টারের কাছ থেকে টিকিট কিনে হাঁপাতে হাঁপাতে অর্জুনের পাশে এসে বলল, কী সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছিল বলুন তো। ওষুধের দোকানদার যে ভুল ওষুধ প্যাক করে দেবে, তা কে জানত? ডাক্তারবাবু আমাকে খুব ধমক দিলেন। এখন আবার ভুবনেশ্বরে গিয়ে বদলে নিয়ে আসতে হবে। সাইকেলটাকে আসার সময় দেখতে পেলাম না বলে হেঁটে আসতে হল। আজকের রাতটা আবার জেগে কাটাতে হবে।
আমার মনে হয় তার দরকার হবে না।
মানে? লোকাল ট্রেনে ভুবনেশ্বর পৌঁছোব যখন, তখন দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। স্টেশনেই থেকে যাব। সকালে দোকান খুললে ইঞ্জেকশন নিয়ে মেল ট্রেনে ফিরতে ফিরতে…!
আপনাকে ভুবনেশ্বরে যেতে হবে না।
আশ্চর্য! দোকানটা তো ভুবনেশ্বরে।
জানি। কিন্তু ওষুধ বদলাবার দরকার নেই।
কেন? ওরা ভুল ওষুধ দিয়েছিল।
কী করে প্রমাণ করবেন? ক্যাশমেমোতে ব্যাচ নাম্বার পর্যন্ত লিখে দিয়েছে। সেটা লেখার পর এত বড় ভুল কোনও কেমিস্ট করতে পারে না।
তা হলে এই ওষুধ এল কোত্থেকে?
হরিরামের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে দূরে ট্রেন হুইসল দিল। ইতিমধ্যে আরও চার পাঁচজন যাত্রী প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গিয়েছে। ট্রেন যেভাবে এসে থামল, তাতে মনে হচ্ছিল ওর চলতে মোটেই ইচ্ছে করছে না। অর্জুন এবং হরিরাম প্রায় ফাঁকা কম্পার্টমেন্টে উঠে বসল। স্টেশনমাস্টার দাঁড়িয়ে আছেন প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন ছাড়ল।
হরিরাম বলল, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
দেখুন, আপনি যে ওষুধ এনেছিলেন সেটা ঠিকঠাকই ছিল। এমনও তো হতে পারে সেটা বদলে গিয়েছে। যে বদলেছে সে ভাবতেই পারেনি বদলটা ধরা পড়ে যাবে। তাই স্বাভাবিক অভ্যেসে ওটা টেবিলের উপর রেখে গিয়েছিল সে।
হাঁ হয়ে শুনছিল হরিরাম। মুখ বন্ধ করার আগে জিজ্ঞেস করল, কে?
আমি জানি না।
ডাক্তারবাবু ছাড়া আমাদের বাড়িতে এসব করার বুদ্ধি কারও হবে না।
উনিও তো প্রতিবাদ করলেন। অর্জুন হাসল, তাই আপনাকে আর ওষুধ পালটাতে ভুবনেশ্বর যেতে হবে না।
কিন্তু মামা বললেন, আপনি নাকি বলে এসেছেন, আমাকে ওষুধ পালটাতে ভুবনেশ্বর পাঠাতে। মনে পড়ে গেল হরিরামের।
হ্যাঁ। কারণ, আপনাকে আমার দরকার হবে।
বলুন, কী করতে পারি?
বলব, আর-একটু ধৈর্য ধরুন।
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল হরিরাম। চাষের মাঠ, গাছগাছালি, গোরু ছাগল ছুটে যাচ্ছে পিছনে। মাথা নেড়ে সে বলল, তা হলে তো বড়মামাকে খুন করার চেষ্টা হচ্ছে।
আপনার বড়মামাকে খুন করা হলে কার লাভ হবে?
মানে? লাভ হবে কেন?
আহা! উনি চলে গেলে বাড়ি-জমি ও অন্যান্য সম্পত্তির মালিক কে হবেন?
ছোটমামা। চোখ বড় হয়ে গেল হরিরামের, তা হলে ছোটমামাই কি বড়মামাকে খুন করতে চাইছেন? ইস, বড়মামা ছোটমামাকে কী আদর করে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন, একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, আবার সম্মানের জায়গা দিলেন। তার বদলে ছোটমামা এতটা বিশ্বাসঘাতকতা করছেন?
আরে! আপনি আচমকা অনুমান করে সিদ্ধান্তে আসছেন কেন? কোনও প্রমাণ আছে আপনার হাতে? তা ছাড়া বিষ্ণুদাসজিকে তাঁর বাবা ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। ওই সম্পত্তির উপর তাঁর কোনও দাবি নেই একথা তিনি জানিয়েছেন। তাই তুলসীদাসজির মৃত্যুর পরে তাঁর তো মালিকানা পাওয়ার কথা নয়। অর্জুন বলল।
তা হলে? ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল হরিরাম।
তুলসীদাসজির আর কোনও ভাই নেই। বিয়ে-থা না করায় স্ত্রী অথবা সন্তানও নেই। আছেন দুই বোন। একজনের সন্তান হয়নি। আর-একজনের সন্তান আপনি। অতএব আপনারই দাবি সবচেয়ে বেশি।
আমি?
হ্যাঁ। তুলসীদাসজি মারা গেলে আপনারই লাভ হবে। অর্জুন হাসল।
আপনি কী বলতে চাইছেন? হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গেল হরিরাম, আমি ভুল ওষুধ এনে দিয়েছি? যদি তাই হয়, ডাক্তারবাবু সেটা না দেখে বড়মামাকে ইঞ্জেকশন দিলেন কী করে? কোনও ডাক্তার এই ভুল করবে? নাকি, ভুল ওষুধ আনার জন্যে আমাকে ভর্ৎসনা করবে?
ঠিক। এ সবই ঠিক। কিন্তু আমাদের দেশে এরকম উদাহরণ আছে। ডাক্তারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খুন করার চেষ্টা, এর আগেও হয়েছে। অর্জুন বলল।
হরিরাম হাঁ হয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল, এ কী বলছেন! আমি বড়মামাকে খুন করার চেষ্টা করব? ছি ছি ছি!
না, আপনি সেই চেষ্টা করবেন না। কারণ, ডাক্তারকে আপনি চেনেন । তা ছাড়া আপনার মা তাঁর দাদাকে ভালবাসেন। সেটাও আপনি জানেন। আমি যেসব সম্ভাবনা থাকে তার একটা আপনাকে বললাম। এবার শুনুন, আপনাদের গ্রাম যে থানার মধ্যে পড়ে সেটা কত দূরে?
দুটো স্টেশন পরে।
স্টেশনটা এলে বলবেন, আমরা নামব।
কেন?
থানায় যেতে হবে। আপনি ভুবনেশ্বর যাচ্ছেন, আমি যাচ্ছি খুরদা জংশনে। স্টেশনমাস্টার তাই জানেন। কেউ যদি জানতে চায় তা হলে সে-ও তাই জানবে। কিন্তু লোকটা গেল কোথায়? অর্জুন চারপাশে তাকাল।
কোন লোক?
আপনাদের গ্রামে কয়েকদিন হল একটা পাগল এসেছে। তারও এই ট্রেনে যাওয়ার কথা ছিল। বলতে বলতে পরের স্টেশনে ট্রেন থামল।
অর্জুন জানলায় মুখ বাড়াতেই দেখতে পেল লোকটিকে। ওপাশের কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে দৌড়ে এসে এই কম্পার্টমেন্টে উঠল। উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল।
অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে বলল, চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। ট্রেন ছাড়ার সময়ও আপনাকে দেখতে না পেয়ে ভাবলাম আপনি হয়তো ভুলেই গিয়েছেন।
লোকটি হরিরামের দিকে তাকাল। হরিরাম খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড় পরা, হাতে বস্তা নিয়ে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে অর্জুনের দিকে তাকাল।
অর্জুন বলল, ইনি শ্ৰীযুক্ত জগন্নাথ দাস। সরকারি অফিসার। আপনাদের গ্রামে পাগল সেজে ছিলেন যদি রহস্যের সন্ধান পান সেই চেষ্টায়। বসুন জগন্নাথবাবু।
জগন্নাথ বসলেন। অর্জুন বলল, ইনি হরিরাম, তুলসীদাসজির ভাগনে।
হরিরাম বলল, আশ্চর্য! আপনাকে আমি গ্রামে দেখেছি। কিন্তু আপনি যে পাগল নন, তা ভাবতে পারিনি।
জগন্নাথ বললেন, আমি একটু কথা বলি?
অর্জুন বলল, অবশ্যই।
আমার আর প্রমোশন হবে না। জীবনটার কোনও মানে আর থাকল না।
কেন? অর্জুন অবাক হল।
এই যে শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরলাম, আর-একটু হলে পারতাম না, তার কারণ কী জানেন? ওই গ্রামের পাবলিক জেনে গিয়েছে আমি পাগল নই। আমি কী তা ওরা হয়তো জানে না, কিন্তু পাগল নই তা ওরা নিশ্চিত জানে।
কী করে? আপনি তো ভালই অভিনয় করছিলেন।
খিদে পেয়েছিল। খিদে যে মানুষের কী সর্বনাশ করে! আপনি দেখেছেন, ওই পিছনের নদীতে গিয়ে ঝোঁপের মধ্যে বসে মাছ ধরে পুড়িয়ে খেয়ে পেট ভরাই। ওই খাওয়াতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। এই গ্রামের কেউ মুড়িটুড়ি দিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খাই, যেভাবে পাগলরা সাধারণত খেয়ে থাকে। আপনি চলে গেলে মনে হল খিদে পেয়েছে। গ্রাম পেরিয়ে অত দূরে যেতে ইচ্ছে করল না। তা ছাড়া ছোঁড়াগুলো যে ঢিল ছোড়ে, তা সহ্য করা বেশ কঠিন। রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, ওই যে ঝাঁকড়া কিছু বড় গাছ রয়েছে, তার ডান দিকে মাঠের মধ্যে নেমে দেখলাম, একটা জঙ্গল রয়েছে। সেই জঙ্গলের ভিতর ঢুকে একটা বড় পুকুর দেখতে পেলাম। ভাবলাম ওই পুকুরেই মাছ ধরি। ছিপ নেই, বঁড়শি-ফাতনা তো ঝোলায় আছে। ফড়িং ধরে বঁড়শিতে গেঁথে সবে জলে ফেলেছি, অমনি একটা মাগুর কপাত করে গিলে ফেলল। ওটাকে ডাঙায় টেনে এনে পুড়িয়ে খেয়ে ভাবলাম একটা সিগারেট ধরাই। ঠিক তখনই গুলির শব্দ কানে এল। জগন্নাথ শ্বাস নেওয়ার জন্যে থামলেন।
গুলির শব্দ? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আমার তো তাই মনে হল। রিভলভারের আওয়াজ। আমি উঠে দাঁড়ানোমাত্র একটা লোক জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই, তুই কে? তখন থেকে দেখছি, ঠিকঠাক মাছ ধরলি, পুড়িয়ে খেলি, সিগারেট ধরাচ্ছিস, তার মানে তুই পাগল নোস। আমি আবার পাগলের ভান করতেই লোকটা আমার হাত চেপে ধরে বলল, চোপ। চল আমার সঙ্গে বস-এর কাছে। বস ঠিকই সন্দেহ করছিল।
প্রাণ বাঁচাতে লোকটাকে আচমকা ঘুসি মারলাম। লোকটা পড়ে গেল। ওর মুখে আরও কয়েকবার আঘাত করে পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে দৌড়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে বুঝলাম, ভুল পথে চলেছি। স্টেশনের দিকে না গিয়ে উলটোপালটা ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে ট্রেন লাইনের কাছে চলে এসে একটা সাঁকোর নীচে লুকিয়ে থাকলাম। তারপর ট্রেনটা এল। নীচে বসে বুঝলাম সাঁকোটা বোধহয় শক্ত নয়, তাই ট্রেন খুব আস্তে আস্তে সাঁকোটা পার হচ্ছে। অমনি বেরিয়ে এসে একটা কামরার দরজা খোলা পেয়ে দৌড়ে দৌড়ে হাতল ধরে উঠে বসলাম। ওরা আমাকে খুঁজতে স্টেশনে আসতে পারে এই ভয়ে টয়লেট থেকে বের হইনি। টয়লেটের জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, আপনারা ওপাশের কম্পার্টমেন্টের দিকে যাচ্ছেন। ভরসা পেয়ে পরের স্টেশনে নেমে এখানে চলে এলাম। আর আমার প্রমোশন হবে না।
এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়বেন না জগন্নাথবাবু। এবার বলুন, এই ক’দিনে আপনি কী তথ্য পেয়েছেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
সেই সিগারেটটা ধরাই? জগন্নাথ জিজ্ঞেস করলেন।
সিগারেট যদিও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমি না বলব না।
সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে জগন্নাথ বললেন, গ্রামের সব মানুষ খুব ভয়ে ভয়ে বাস করছে। রাতে রাস্তায় কেউ থাকে না।
রাতে কী দেখলেন?
কী করে দেখব?
মানে?
আমি তো রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের চাতালের এক কোণে সন্ধে হলেই ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করতাম।
সে কী! রাতে খোঁজখবর নিতেন না?
কী করে নেব? দিনেরবেলায় যা বলবেন তাই করতে পারি। রাতে সব সাহস উধাও হয়ে যায়। ছেলেবেলা থেকে ভূতের ভয় আমার। আর যখন শুনছি রাত বাড়লেই গ্রামে ভূতেরা ঘোরাফেরা করে, তখন সাহস দেখিয়ে মারা পড়তে রাজি নই।
চমৎকার!
ঠাট্টা করছেন। কিন্তু স্যার, ভূত আছে। এই যে, দিনেরবেলায় যখন আমি জঙ্গলে ঢুকতাম, তখন হঠাৎ হঠাৎ এমন লোককে দেখতাম যার সেখানে থাকার কথা নয়। ওরা কেউই গ্রামের মানুষ নয় একথা আমি। হলপ করে বলতে পারি। আমাকে দেখেই এত দ্রুত উধাও হয়ে যেত যা কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে তারা মেছোভূত নয়, একথা আমি। বলতে পারি।
কী করে?
তা হলে আমি যখন মাছ ধরতাম তখন আমার কাছে মাছ চাইত।
হরিরাম একমনে শুনে যাচ্ছিল। এবার বলল, এই লোকগুলো কারা আমি জানি না। তবে জানলার ফাঁক দিয়ে এক রাতে ওদের আমাদের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছি। সেদিন চাঁদের রাত বলে দেখতে পেয়েছিলাম।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কখনও আপনাদের বাড়ির বাগানের পিছনে যে ব্যারাকবাড়ি আছে তার ভিতরে গিয়েছেন?
ছেলেবেলায় গিয়েছি। জিনিসপত্র রাখা হত ওখানে।
কতদিন ঘরগুলো ব্যবহার করা হয়নি?
বলতে পারব না। আমরা পাকাপাকি এখানে আসার পর কেউ ওখানে গিয়ে বাস করেনি, দরজা খুলতেও দেখিনি। হরিরাম বলল।
দ্বিতীয় স্টেশনে ট্রেন থামল। এখন ঘড়িতে সাড়ে তিনটে। অর্জুন বলল, জগন্নাথবাবু, সামনের স্টেশনে নেমে আমরা থানায় যাব। ওখানকার ও সি-কে আপনি চেনেন?
বলরামবাবু। কেন?
কীরকম মানুষ?
আর মাস সাতেক পর অবসর নেবেন বলে কোনও কাজ করতে চান না।
সে কী?।
তা ছাড়া ভুবনেশ্বরে যারা পোস্টিং পান, উনি তাঁদের অপছন্দ করেন। কারণ, উনি চেষ্টা করেও তা পাননি।
এস পি কে?
একজন বাঙালি। অরূপ দত্ত। অল্প বয়স। আমাকে দু-তিনবার দেখেছেন।
আপনি আমাকে ভাল জানেন না। আমার নাম অর্জুন। আমি পশ্চিমবাংলার উত্তর অঞ্চলের শহর জলপাইগুড়িতে থাকি। আমার পেশা সত্যসন্ধান করা।
সত্যসন্ধান! মানে…?
ইংরেজিতে যাকে টুথ ইনভেস্টিগেটার বলে, তাই।
হরিরাম হাসল, বড়মামার মুখে শুনেছি। যাকে বলে গোয়েন্দা, আপনি তা নন।
ডিটেকটিভ? জগন্নাথ বিজ্ঞের মতো মুখ করলেন।
না। আমার কাজ শুধু অসত্যকে সরিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। যাকগে, আমরা থানায় গেলে আপনি বড়বাবুকে এই পরিচয়টা দেবেন। আর হ্যাঁ, বলবেন, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কর্তাদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক আছে।
বেশ। বলব। কিন্তু আপনি থানায় যাচ্ছেন কেন?
ওই যে, যে লোকটা আপনাকে বসের কাছে নিয়ে যেতে চাইছিল সেই বসের খবর দিতে। অবশ্য লোকটাকে আপনি পুকুরে ফেলে দিয়ে এসেছেন, যদি ডুবে মারা গিয়ে থাকে তা হলে ঝামেলায় পড়তে পারেন। অর্জুন হাসল।
ট্রেন থামতেই ওঁরা নেমে পড়লেন। অর্জুন আড়চোখে দেখল, জগন্নাথবাবু তাঁর পাগলের বস্তাটা ট্রেনেই রেখে এলেন। স্টেশনের বাইরে এসে সে জিজ্ঞেস করল, থানা কত দূরে?
কাছেই। মিনিট তিনেক হাঁটতে হবে। জগন্নাথ বললেন।
জায়গাটা একেবারেই সাদামাটা মফসল শহর। জলপাইগুড়ি থেকে তিস্তা পেরিয়ে আলিপুরদুয়ারের দিকে গেলে যেসব ছোট-ছোট শহর পড়ে, সেগুলো এর চেয়ে অনেক বেশি জমজমাট।
থানার ভিতর ঢুকে ওঁরা দেখলেন, দু’জন সেপাই খবরের কাগজ পড়ছে। জগন্নাথ তাদের জিজ্ঞেস করলেন, বড়বাবু আছেন?
এখন ঘুমোচ্ছেন।
কখন ঘুম ভাঙবে?
বলতে পারব না।
জগন্নাথ খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে পকেট থেকে তাঁর আইডেন্টিটি কার্ড বের করে ওদের সামনে ধরতেই একজন করুণ মুখে বলল, এখন ডাকলে খুব রাগ করবেন।
কিছু করার নেই। ডাকো।
লোকটি ভিতরে চলে গেল। এই সময় একজন এস আই বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? আপনাদের তো চিনতে পারলাম না।
আপনাদের এই থানায় টোটাল স্টাফ ক’জন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
এস আই বেশ অবাক হয়ে গেলেন, আপনি কে?।
জগন্নাথ বললেন, উনি অর্জুন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছেন। আমি আই বি সাব-ইনস্পেক্টর। নিজের পরিচয়পত্র দেখালেন।
এস আই-কে বেশ বিভ্রান্ত দেখাল, দশজন থাকার কথা।
এখন দেখছি তিনজন আছেন। মনে হচ্ছে এখানে অশান্তি হয় না।
না না। খুব কাম অ্যান্ড কোয়ায়েট জায়গা। আপনারা হঠাৎ এখানে?
আপনার সঙ্গে কথা বললে যদি সমাধান সম্ভব হয় তা হলে বলতে পারি।
না, মানে, আসলে বড়বাবুই তো সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু…!
তিনি এখন ঘুমোচ্ছেন। ওঁকে খবর দিতে গিয়েছেন একজন। আমরা অপেক্ষা করছি।
তা হলে ভিতরে এসে বসুন। এস আই-এর ব্যবহার বদলে গেল। বড়বাবু নামলেন আরও আধঘণ্টা পরে। বেশ রোগা, গাল ভাঙা, পরনে বাড়ির পোশাক। মাথার অর্ধেকটায় টাক চকচক করছে। মুখে বিরক্তি স্পষ্ট। এস আই ওঁদের বড়বাবুর টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারে বসতে বললেন। মুখোমুখি বসলেন, এস আই ওঁদের দুজনের পরিচয় দিলেন বড়বাবুকে। দুটো কনুই টেবিলের উপর, হাতের উপর চিবুক রেখে বসে ছিলেন বড়বাবু, কোনও প্রতিক্রিয়া ফুটল না মুখে।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকে পুরী, ভুবনেশ্বর, গোপালপুর যায়, এখানে কেন?
আমরা বেড়াতে আসিনি, এসে মনে হচ্ছে আপনার সাহায্য দরকার।
ভদ্রলোকের মুখ থেকে আলতো শব্দ বের হল, উঃ।
আপনি কি অসুস্থ?
দেখেই বুঝতে পারছেন?
দেখে মনে হচ্ছে আপনার শরীরে ব্লাডসুগার বেশ বেড়ে গিয়েছে।
হাত সরালেন ভদ্রলোক, আপনি ডাক্তারি জানেন নাকি?
খুব সাধারণ জ্ঞান থেকে বলছি। লক্ষ করছি, চেয়ারে বসার পর থেকে আপনি বারবার পজিশন বদল করছেন। সচরাচর পাইসের পেশেন্টরা এটা করেন।
এস আই মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, স্যারের ওই দুটোই আছে। খুব কষ্ট।
আঃ, চুপ করো। আমি মরছি যন্ত্রণায় আর তোমার মুখে হাসি ফুটছে। বড়বাবু খেঁকিয়ে উঠলেন, ছেড়ে দিন এসব কথা। বলুন, কী দরকার?
অর্জুন হরিরামকে দেখাল, এর নাম হরিরাম। দুটো স্টেশন পরে অঞ্জলি গ্রামে থাকে। ওর বড়মামা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছেন। ওই গ্রাম নাকি সন্ধের পর ভুতেদের দখলে চলে যায়। তখন সমস্ত গ্রাম মড়ার মতো পড়ে থাকে।
জানি। ওদের বলুন, ওঝা ডেকে ভূত নামাতে। পুলিশের কাজ ভূত ধরা নয়। ভূত ধরার মতো কোনও অস্ত্র আমাদের নেই। চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকালেন বড়বাবু।
আপনি অঞ্জলি গ্রামের খবর জানেন?
ওই যেটুকু বললেন। ওখানকার কেউ এসে যখন কোনও অভিযোগ করেনি, তখন ধরেই নিচ্ছি ওরা বেশ শান্তিতে আছে।
ভূত কখনও ইলেকট্রিকের লাইন কেটে দিতে পারে?
আমি জানি না। জানতেও চাই না।
আপনি জানতে চাইছেন না কিন্তু জগন্নাথবাবুকে ভুবনেশ্বরের আই বি অফিস এ-ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে পাঠিয়েছে। অর্জুন বলল।
চোখ খুললেন বড়বাবু, আপনি ভুবনেশ্বরে পোস্টেড?
মাথা নাড়লেন জগন্নাথ, হ্যাঁ।
আই বি?
হ্যাঁ।
বেশ আছেন। নেই কাজ তো খই ভাজ। আমরা পড়ে আছি বনবাদাড়ে। এখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা আমাদের জিজ্ঞেস না করে খরচা করে আপনাদের পাঠাচ্ছে ফোপড়দালালি করতে। আর ক’মাস পর অবসর নিতে হবে। অসুখ-বিসুখে শরীর কাহিল হয়ে যাচ্ছে। ভুবনেশ্বরে থেকে কর্তব্যরত অবস্থায় চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলাম। সেই সুযোগ উপরওলা আমাকে দিল না। আর কিছু বলার আছে?
আছে। অঞ্জলি গ্রামে বেশ কিছু বাইরের লোক ঢুকেছে। দিনেরবেলায় তাদের দেখা যায় না। রাত নামলে তারা রাস্তায় নামে।
নামতেই পারে। দিনেরবেলায় ঘুমিয়ে রাতে কেউ জাগলে জাগতেই পারে।
হঠাৎ হরিরাম মুখ খুলল, আমার বড়মামা তুলসীদাস মহাপাত্রকে কেউ বা কারা ধীরে ধীরে খুন করার চেষ্টা করছে।
অ্যাঁ? এটা কী বললেন? ধীরে ধীরে খুন করা যায় নাকি! যত্ত সব।
অর্জুন হাসল, আমি বুঝতে পারছি আপনার শরীর এবং মন খুবই খারাপ। ভুবনেশ্বরে গিয়ে চিকিৎসা করালে ভাল হয়ে যেতেন। ছুটি নিয়ে সেটা করুন না!
পাগল। এই সময় কেউ ছুটি নেয়? ছুটির টাকা মারা যাবে তা হলে?
আচ্ছা, অরূপবাবুর কি কোনও ক্ষমতা আছে?
কে অরূপবাবু?
আপনাদের এস পি সাহেব। অরূপ দত্ত।
আচমকা সোজা হয়ে বসলেন বড়বাবু, চেনেন নাকি?
অর্জুন নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
ও, বুঝেছি। তিনিও বাঙালি, বিলক্ষণ ক্ষমতা আছে। কিন্তু উনি আমাকে সহ্য করতে পারেন না। কোনও কারণ নেই, দুর্ব্যবহার করেন।
আপনার অসুখের কথা বোধহয় জানেন না। ব্লাডসুগারের খুব ভাল আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা আছে। বিশাল চেহারার মানুষ ব্লাডসুগারের চাপে কড়ির মতো গুটিয়ে গিয়েছিল। সেই চিকিৎসায় স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছে। আর পাইল্সটা আপনি অপারেট করিয়ে নিন। লোকে বলে অপারেশনের পরেও আবার হয়। সেটা হতে হতে বছর আট-দশ কেটে যায়। আচ্ছা, আপনি যখন ডায়েরি নেবেন না তখন…।
বসুন। এই যে গুণধর, এঁদের জন্যে চা বলো। কতক্ষণ এসেছেন অথচ তোমার খেয়ালই নেই?
এস আই বেরিয়ে যেতে আবার মুখ খুললেন, মুশকিল হল, আমার এখানে স্টাফ খুব কম। আমরা কবে শেষবার গুলি ছুঁড়েছি, তা নিজেরাই ভুলে গিয়েছি। অঞ্জলিতে গিয়ে অ্যাকশন নিতে হলে যে শক্তি দরকার তা এখানে নেই। বড়বাবু টাকে হাত বোলালেন, ভাল আয়ুর্বেদ চিকিৎসা কোথায় হয় নিশ্চয়ই জানেন?
জানি।
যদি দয়া করে নাম-ঠিকানা লিখে দেন। একটা কাগজ আর কলম খুঁজে বের করে এগিয়ে দিলেন বড়বাবু।
কিন্তু আপনাকে সেখানে যেতে হবে। ছুটি নেবেন?
ওই তো মুশকিল।
আমি ভেবে দেখছি। আপনার যাবতীয় শারীরিক অসুবিধেগুলো ওই কাগজে লিখে রাখবেন, আমি কাগজটা ডাক্তারকে দেখিয়ে বলব, আপনার। সঙ্গে ফোনে কথা বলতে। সেটা জানার পর উনি যদি সন্তুষ্ট হয়ে ওষুধ দেন। তা হলে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।
খুব উপকার হয় তা হলে! হাসি ফুটল বড়বাবুর মুখে।
এই সময় এস আই একটা লোককে নিয়ে ঢুকলেন। লোকটা কেটলি থেকে গ্লাসে চা ঢেলে বড়বাবু ছাড়া সবাইকে দিয়ে চলে গেল।
বড়বাবু বললেন, গুণধর, ডায়েরির খাতাটা নিয়ে এসো। ওঁদের অভিযোগ খাতায় তোলো। অর্জুনের দিকে তাকালেন তিনি, আপনাদের অভিযোগ গ্রহণ করে আমি এস পি সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দেব। উনি যা বলবেন তাই হবে। ও হ্যাঁ, পাইল্স কি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় সারে না?
জিজ্ঞেস করতে হবে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?
খু-উ-ব। টয়লেটে গেলে রক্তে ভেসে যায়।
একদিকে মঙ্গল। কিছু চিনি শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বলছেন?
আমি এস পি সাহেবকে একটা ফোন করতে পারি?
অবশ্যই। অপারেশনে আমার খুব ভয়, বুঝলেন। ল্যান্ডফোনটা এগিয়ে দিলেন বড়বাবু।
অর্জুন জগন্নাথবাবুকে ইশারা করতে তিনি ডায়াল করলেন। তৃতীয়বারে লাইন পাওয়া গেল। জগন্নাথ চিৎকার করলেন, স্যার, আমি জগন্নাথ বলছি, এস আই, আই বি ভুবনেশ্বর। অঞ্জলি গ্রামে ডিউটি পড়েছিল। এখন লোকাল থানায় বড়বাবুর ঘরে…। ঠিক আছে, ঠিক আছে, কথা বলুন।
রিসিভারটা বড়বাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন জগন্নাথবাবু, আপনার সঙ্গে…।
আবার আমাকে কেন? রিসিভারটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন বড়বাবু, স্যার, সত্যেন বলছি। না স্যার, আমি ওকে ফোন করতে বলিনি। ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে অর্জুনবাবু এসেছেন, উনি কথা বলতে চাইছেন! অ্যাঁ। কে অর্জুনবাবু? ঢোক গিললেন বড়বাবু। অর্জুন হাত বাড়িয়ে রিসিভার টেনে নিয়ে বলল, নমস্কার, আমি কি মি. অরূপ দত্তের সঙ্গে কথা বলছি।
ইয়েস। আপনি কে?
আমাকে সবাই ‘অর্জুন’ বলেই জানে। এখানে এসেছি জলপাইগুড়ি থেকে। আমার জীবিকা সত্যসন্ধান করা। অর্জুন বলল।
সত্যসন্ধান? অর্জুন! আপনি কি…।
অর্জুন ওঁকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল, টুথ ইনভেস্টিগেটার।
আমি যদি ভুল না করি, যিনি লাইটার সমস্যার সমাধান করেছিলেন, সেই মানুষটি আপনি?
না, আপনি ভুল করছেন না।
আরে মশাই! হোয়াট এ সারপ্রাইজ! তা এত জায়গা থাকতে আপনি। সত্যেনবাবুর থানায় কী করছেন? ও আপনাকে বসতে বলেছে?
হ্যাঁ। বড় অমায়িক ব্যবহার করছেন সত্যেনবাবু।
রিয়েলি! আপনি নিশ্চয়ই কোনও সমস্যার কারণে এসেছেন?
আসার পর জেনেছি। আপনার সাহায্য পাওয়া খুব জরুরি।
আমি যেখানে আছি সেখান থেকে থানায় পৌঁছতে চল্লিশ মিনিট লাগবে। অপেক্ষা করবেন?
অবশ্যই। রিসিভার নামিয়ে রেখে অর্জুন বলল, এস পি সাহেব এখানে আসছেন।
সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বড়বাবু, সে কী! উনি নিজে থেকেই বললেন আসবেন? তা হলে তো আপনি, আপনি বিখ্যাত মানুষ। ও গুণধর, ঝাড়ুদারকে ডাকো, যত তাড়াতাড়ি পারো, থানা পরিষ্কার করো। যাও।
গুণধর দৌড়ে বেরিয়ে যেতে বড়বাবু বললেন, মিষ্টি খাবেন? ভাল। সন্দেশ?
আপনি খান? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
জিভ বের করলেন বড়বাবু, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও খেতে পারি না। অভিশাপ মশাই। মিষ্টির দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় উলটো দিকে মুখ করে থাকি।
.
অরূপ দত্তের বয়স চৌত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ। লম্বা, পেটানো শরীর, চলাফেরায় সপ্রতিভ ভাব। হাত মেলানোর পর বড়বাবুর চেয়ারে বসে বললেন, বলুন, আপনি যখন এত দূরে এসেছেন তখন সমস্যা বেশ গভীর?
অর্জুন ঘরের মানুষগুলোর দিকে তাকাল। অরূপ দত্ত বললেন, আপনারা সবাই বাইরে যান। আমি ওঁর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই।
অর্জুন ইশারা করতে হরিরাম এবং জগন্নাথবাবু বড়বাবু এবং গুণধরের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে অরূপ দত্ত বললেন, হ্যাঁ, বলুন।
তুলসীদাসজির টেলিফোনে আমন্ত্রণ থেকে শুরু করে যা-যা ঘটেছে তা সংক্ষেপে বলল অর্জুন। শোনার পর অরূপ দত্ত বললেন, দেখুন, কী অবস্থা। ওই অঞ্জলি গ্রামে কিছু একটা হচ্ছে তা ভুবনেশ্বরের আই বি ডিপার্টমেন্ট সন্দেহ করে লোক পাঠিয়েছে, অথচ এই থানায় সেই খবর আসেনি। এলেও কাজ করতে হবে বলে এরা হয়তো আমাকে জানায়নি।
অর্জুন বলল, বড়বাবু বললেন, যেহেতু কেউ অভিযোগ করেনি, তাই উনি কিছু জানেন না।
ছেড়ে দিন। সমস্যা একটা হল, অঞ্জলি গ্রামের আশপাশের জঙ্গলে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। তাদের দিনেরবেলায় দেখা যায় না, কিন্তু রাতে তারাই গ্রামের দখল নেয় বলে আপনার অনুমান। অথচ গ্রামে গুজব চালু হয়েছে যে, ওখানে ভূতের উপদ্রব হচ্ছে। এই লোকগুলো কারা এবং কেন এসেছে তা জানা যাচ্ছে না। যেহেতু এদের আচরণ রহস্যময়, তাই এরা ভাল কিছু করতে চাইছে তা ভাবার কারণ নেই।
অর্জুন খুশি হল, একদম ঠিক।
দ্বিতীয় সমস্যা হল, আপনি যার অতিথি, সেই তুলসীদাসজির চিকিৎসার জন্যে তাঁর ভাই ভুবনেশ্বর থেকে ডাক্তার নিয়ে এসেছেন। ওই ডাক্তার সম্পর্কে তুলসীদাসজির বোনেরা আপনার কাছে অভিযোগ করেছেন। আপনি জেনেছেন, ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে যে ওষুধ আনিয়েছেন তা ব্যবহার করে অন্য ওষুধ ইনজেক্ট করেছেন। আপনার মনে হচ্ছে তুলসীদাসজিকে খুব ধীরে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাঁকে মারতে পারলে কার লাভ হবে?
ওঁর ভাই বিষ্ণুদাসজি চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু সম্পত্তির অধিকার পাবে ভাগনে হরিরাম, যে আমার ডান দিকে বসে ছিল। অথচ হরিরামের মনে তার মামাকে খুন করার বাসনা বিন্দুমাত্র নেই। মনে রাখতে হবে, তুলসীদাসজির বাড়ির পিছনে বিশাল বাগান আর ব্যারাকবাড়ি প্রতিটি রাতে বাইরের লোক ব্যবহার করে। হয়তো ওঁকে মেরে ফেলার ব্যাপারে ওদেরও স্বার্থ আছে। অর্জুন বলল, আর শেষটা খুবই সন্দেহজনক। গ্রামের একজন প্রবীণ লোক, তিনি স্টেশনমাস্টারকে আদেশ দিয়েছিলেন ট্রেনটাকে দাঁড় করাতে। মেল ট্রেন যেহেতু ওখানে দাঁড়ায় না তাই স্টেশনমাস্টার রাজি হননি। ওঁরা নিজেরাই স্টেশনের একটু আগে ট্রেনটাকে দাঁড় করাবেন এবং স্টেশনমাস্টার যাতে সহযোগিতা করেন তাই শাসিয়ে গিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হল, ওঁরা কেন ট্রেনটা দাঁড় করাতে চাইছেন? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, ওঁরা কারা?
অর্জুন হাসল, একবার শুনেই আপনি ব্যাপারটাকে সুন্দর সাজালেন। যেহেতু এখন ছ’টা বাজতে বেশি দেরি নেই, এই মেল ট্রেন আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই এলাকা দিয়ে চলে যাবে। তাই আমাদের হাতে বেশি সময়ও নেই। ভুবনেশ্বরে পৌঁছোবার অনেক আগেই মেল ট্রেন সেখান থেকে ছেড়ে আসবে। আমার সন্দেহ, ওই ট্রেনে এমন কিছু নিয়ে আসা হচ্ছে যা অঞ্জলির রহস্যময় মানুষজনের প্রয়োজন হয়েছে। এই জিনিসগুলো আটকাতে পারলেই লোকগুলোর হদিশ জানা যাবে।
অরূপ দত্ত বললেন, ঠিক কথা। আমরা খুরদা স্টেশনে ট্রেনটাকে সার্চ করতে পারি। ওখানে মাত্র এক মিনিট মেল ট্রেন দাঁড়ায়। সার্চ করে কিছু পেতে গেলে অন্তত পনেরো মিনিট দরকার হবে। কোন কামরায় কী আছে তা তো আমাদের জানা নেই।
হয়তো তার চেয়ে বেশি সময় লাগবে। কিন্তু মি. দত্ত, খবরটা অঞ্জলিতে পৌঁছে যাবে। মোবাইল ফোনের দৌলতে সেটা সম্ভব। আর তা হলে আমরা জিনিসগুলোই পাব, লোকগুলো নাগালের বাইরে চলে যাবে। অর্জুন বলল।
তা হলে?
ওরা ট্রেন অঞ্জলিতে ঢোকার মুখে থামিয়ে জিনিসগুলো নামাতে চাইছে। ওদের সেটা নামাতে দিন। তারপরেই আপনারা ওদের হাতেনাতে ধরুন।
কাদের নিয়ে ধরব? এই থানার স্টাফদের চেহারা তো দেখেছেন।
খুরদায় আপনাদের ফোর্স নেই?
গুড আইডিয়া। আছে। তবে আমার এলাকার মধ্যে পড়ে না। ঘড়ি দেখলেন অরূপ দত্ত। তারপর মোবাইল ফোন অন করে নাম্বার টিপলেন, সৎপতি, অরূপ দত্ত বলছি। আমার এলাকা অঞ্জলিতে ঘণ্টাতিনেকের মধ্যে অ্যাকশন নিতে হবে। আমার পক্ষে এখনই স্টাফ আনানো সম্ভব নয়। তুমি কত লোক দিতে পারবে?
ওপাশের কথা শুনে অরূপ দত্ত বললেন, অ্যাকশন মানে অ্যাকশন। গুলি চালাতে হতে পারে। তুমি সহযোগিতা করলে আমি হোম সেক্রেটারিকে ফোন করে জানাব।
আবার শুনলেন অরূপ দত্ত, ঠিক আছে, কুড়িজন এনাফ। ওদের এখনই তৈরি হয়ে ভুবনেশ্বর থেকে যে মেল ট্রেনটা আটটা নাগাদ খুরদায় একমিনিট থামবে, তাতে তুলে দিয়ে। ওদের লিডার কে? বাঃ, এ তো আমার সৌভাগ্য। তুমি এলে তো কথাই নেই। শোনো, অঞ্জলিতে ট্রেনটা থামে না। কিন্তু দেখবে, অঞ্জলি ক্রস করার আগে ধীরে ধীরে ট্রেনটা থেমে যাবে। ট্রেন থামার পর ঠিক দু’মিনিট অপেক্ষা করবে। দেখবে, কেউ বা কারা ট্রেন থেকে জিনিসপত্র নামাচ্ছে। ঠিক তখনই আমি রিভলভারের গুলি ছুড়ব। শোনামাত্র তোমার লোকজন ওদের চার্জ করবে। আমি চাইছি সবাইকে হাতেনাতে ধরতে। গুলি করলে যেন পায়ের দিকে এইম করে। ওকে?
মোবাইলে দ্বিতীয় নাম্বারে ফোন করে ইংরেজিতে বিস্তারিত জানালেন অরূপ দত্ত। শেষে বললেন, ব্যাপারটা আমাদের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের বোধহয় জানা আছে। ওরা একজন এস আই-কে খোঁজখবর নিতে পাঠিয়েছে। হা স্যার, আপনাকে আমি সাড়ে ন’টা নাগাদ রিপোর্ট করব।
অর্জুন বলল, এখান থেকে খুরদায় গিয়ে ট্রেন ধরা যাবে কি না জানি না, কিন্তু আমরা তো বাই রোড অঞ্জলিতে যেতে পারি।
এখন এ ছাড়া কোনও উপায় তো নেই। অরূপ দত্ত বললেন, এবার ওদের ডেকে নেওয়া যাক। আমার মনে হয়, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি তা এই মুহূর্তে ওদের না জানানোই ভাল হবে।
হাত বাড়িয়ে বেল বাজালেন অরূপ দত্ত। একটি পিয়ন গোছের লোক ঘরে ঢুকতে তিনি বললেন, সত্যেনবাবুদের এখানে আসতে বলো।
ওঁরা এলেন। অরূপ দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, সত্যেনবাবু, থানার গাড়ি দুটো ঠিক আছে?
সত্যেনবাবু গুণধরের দিকে তাকালেন, আছে?
গুণধর মিনমিন করে বলল, একটা একদম ঠিকঠাক আছে। অন্যটা স্টার্ট। নিতে গোলমাল করছে, তবে স্টার্ট নেওয়ার পর দারুণ চলছে।
অরূপ দত্তের মুখে রক্ত জমল। তিনি সত্যেনবাবুর দিকে তাকালেন, পুলিশের একটা গাড়ি খারাপ হয়ে আছে জেনেও সারাতে দেননি কেন? সত্যেনবাবু মাথা নাড়লেন, আমাকে কেউ বলেনি স্যার। আমি তো ওই গাড়িতে চড়ি না। এখনই সারাতে পাঠাচ্ছি স্যার।
দাঁড়ান। ওই গাড়ি সারিয়ে আসার আগেই আপনি রিটায়ার করে যাবেন। এক্ষুনি একটা ভাল বলেরো বা সুমো গাড়ি ভাড়া করে আনুন। আধঘণ্টার মধ্যে চাই।
সত্যেনবাবু হাঁকলেন, গুণধর!
যাচ্ছি স্যার। গুণধর বেরিয়ে গেল।