দায়িত্ব
আর্থিক সঙ্কট পারিবারিক জীবনে এক অশান্তির কারণ হলেও সবার হৃদয় পাথরের মতো কঠিন নয়। পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে এই সঙ্কটকে লঙ্ঘন করারও অনেক পথ রয়েছে। কিন্তু একা বিধবা রমণীর কাছে ছোট ছোট পাঁচজন ছেলে মেয়েকে মানুষ করার কথাটা ভাবতেই মনে হয় কে যেন পিছন থেকে এসে গলাটি টিপে ধরে রেখেছে। অসহনীয় কষ্টের জ্বালা লাঘব করার লক্ষ্যে তাঁর বড় ছেলেকে মামার বাড়ী পাঠিয়ে দেওয়া হলো। একান্ত আশা যে মামার বাড়ীতে থেকে অন্যান্য ভাই বোনদের সাথে স্কুলে গিয়ে পড়াশুনা করে মানুষ হবে। উদ্দেশ্য ভাল বলে মন হলেও দায়িত্ব সমাধা করা বড় কঠিন।
যখন সে আমাদের বাড়ী এল তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্র হয়েছে। মার কাছ থেকে জানতে পারলাম আমাদের পিসতুতো দাদা। নাম তার ‘গোপাল’। এখন থেকে আমাদের সঙ্গেই থাকবে। স্বভাব যে তার কিরূপ তা সহজে জানা গেল না।
পরদিন সকালবেলায় জল খাবারের পর আমরা বাড়ীর বাইরে এলাম। সম্মুখেই স্কুল। রয়েছে এক বিশাল মাঠ। মাঠের এক কোণে অতি বিশালকায় বটগাছের তলে নানান ছেলের উপস্থিতি গোপালদার বালক মনেক টানতে লাগল। বারবার বারণ করা সত্যেও দাদা আমাকে রেখে একাই সেই বালকের দলে মিশে গেল।
সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেল । কিন্তু দাদার কোন খোঁজ নেই। পাড়ার আনাচে কানাচে কোথাও তার দেখা নেই। খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আমরা বাড়ীর ছোটরা দুপরের খাওয়া সেরে নিলাম। অন্যদিকে বাড়ীর বড়দের দুঃশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেল। বিকেলের পরন্ত বেলায় প্রতিবেশী এক কাকাবাবু খবর দিয়ে গেলেন যে ‘গোপাল’ বাড়ীর অনতিদূরে এক জঙ্গলের ধারে খালিগায়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ীতে ঢুকতে কেন জানি তার ভয় ভয় করছে। কাল বিলম্ব না করে আমরা ছুটে গিয়ে তাকে আবিষ্কার করি। তাকে দেখে আমরা সবাই স্তম্ভিত। পরনে শুধুমাত্র হাফ্প্যান্ট। শরীরে গেঞ্জি পর্যন্ত নেই। হাতে ও পায়ে মাটিমাখা। মুখ তার লজ্জা ও ভয়ে কম্পিত। আমি জিজ্ঞাস করলাম : ” গোপালদা, তোমার শরীরে জামা ও গেঞ্জি কোথায় ?”
দেখতে পেলাম জামাটি মুড়িয়ে বাম হাতে প্যাঁচিয়ে রেখেছে। কোন কথার উত্তর না দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম: “তারাতারি বাড়ীতে এসো, মা এখনও না খেয়ে বসে আছে।” এই কথা শুনা মাত্রই সে বাড়ীতে চলে এল। বাড়ীর উঠোনে পা রাখতেই বড়রা সবাই জিজ্ঞেস করল যে সে এতক্ষণ কোথায় ছিল। আর শরীরেরই বা এমন অবস্থা কেন?
তাকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুল হলো না যে সে দোষজনিত এমন কিছু করেছে। এমন সময় মা এসে ধমক দিয়ে জিজ্ঞ্যেস জিজ্ঞজ্ঞস করল: “তোমার গেঞ্জি কোথায়?”
গোপালদা উত্তর করল : “মাঠের এক কোণের জঙ্গলে মাটিতে পুতে রেখেছি।” তার উত্তর শুনে আমরা সবাই অতিশয় স্তম্ভিত। কারণ এমন কথা আমরা আগে কখনও শুনিনি। মা জিজ্ঞাস করল: কেন ?
এবার কিন্তু কিছুতেই মুখ থেকে উত্তর বেরোল না। অবশেষে অনেক কষ্টে সে বলল: গেঞ্জিটাতে মাৰ্ব্বেল রেখেছি। আসলে সকালবেলায় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মার্বেল খেলতে গিয়ে আমি তাদের কয়েকজনকে হারিয়ে দিয়ে আমার প্যান্টের পকেট ভর্তি করে ফেলি। মার্বেল খেলায় আমার পারদর্শীতার খবর পেয়ে পাড়ার সবথেকে ভাল খেলোয়ারদের সঙ্গে খেলায় জড়িয়ে পড়ি। এইভাবে একে একে সকলকে হারিয়ে আমি এতগুলো মার্কেল জিতে যাই যে পকেটে আর জায়গা নেই। তাই বুদ্ধি করে গেঞ্জিটাকে ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার করে প্রায় তিনশত মার্ব্বেল রাখি।
মা জিজ্ঞ্যাস করল: তবে সে গুলো বাড়ীতে আননি কেন?
—এমন অবস্থায় মামা যদি সেগুলো দেখে ফেলে তাহলে আর রক্ষে নেই! তাই ভাবলাম চুপচাপ করে বাড়ী এসে স্নান করে খাওয়া দাওয়া করে নেই। সন্ধ্যার সময় গোপনে সেগুলি নিয়ে আসব।
সবকিছু শুনে তারাতারি গোপালদাকে সঙ্গে নিয়ে লুকিয়ে রাখা মাটির ভিতর থেকে আনা এক টোপলা মার্কেল দেখতে পেয়ে আমি অত্যন্ত খুশি হলাম। এবং বুঝতে পারলাম তার মত অভিজ্ঞ মার্বেল খেলোয়াড় এ অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টি নেই।
প্রথম দিনের এই ঘটনাটি বালক মনের চঞ্চল চিত্তের এক সামান্য ঘটনা বলে মনে হলেও এটি তার চারিত্রিক অনুশাসনহীনতার বহিঃপ্রকাশ বলে গণ্য হল। স্কুলে ভর্ত্তি করে দিবার পর মনে হল নতুন পরিবেশে সহজেই মানিয়ে নিতে তার কষ্ট হবে না। কিন্তু পরিবেশ সুন্দর হলেও মানুষের কদর্য দিকগুলি খুব সহজেই চারিদিকে
দেখতে পেলাম জামাটি মুড়িয়ে বাম হাতে প্যাঁচিয়ে রেখেছে। কোন কথার উত্তর না দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম : “তারাতারি বাড়ীতে এসো, মা এখনও না খেয়ে বসে আছে।” এই কথা শুনা মাত্রই সে বাড়ীতে চলে এল। বাড়ীর উঠোনে পা রাখতেই বড়রা সবাই জিজ্ঞেস করল যে সে এতক্ষণ কোথায় ছিল। আর শরীরেরই বা এমন অবস্থা কেন?
তাকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুল হলো না যে সে দোষজনিত এমন কিছু করেছে। এমন সময় মা এসে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল: “তোমার গেঞ্জি কোথায় ? ”
গোপালদা উত্তর করল : “মাঠের এক কোণের জঙ্গলে মাটিতে পুতে রেখেছি।”
তার উত্তর শুনে আমরা সবাই অতিশয় স্তম্ভিত। কারণ এমন কথা আমরা আগে কখনও শুনিনি। মা জিজ্ঞেস করল: কেন ?
এবার কিন্তু কিছুতেই মুখ থেকে উত্তর বেরোল না। অবশেষে অনেক কষ্টে সে বলল: গেঞ্জিটাতে মার্ব্বেল রেখেছি। আসলে সকালবেলায় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মার্বেল খেলতে গিয়ে আমি তাদের কয়েকজনকে হারিয়ে দিয়ে আমার প্যান্টের পকেট ভর্তি করে ফেলি। মার্বেল খেলায় আমার পারদর্শীতার খবর পেয়ে পাড়ার সবথেকে ভাল খেলোয়ারদের সঙ্গে খেলায় জড়িয়ে পড়ি। এইভাবে একে একে সকলকে হারিয়ে আমি এতগুলো মার্কেল জিতে যাই যে পকেটে আর জায়গা নেই। তাই বুদ্ধি করে গেঞ্জিটাকে ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার করে প্রায় তিনশত মার্ব্বেল রাখি।
মা জিজ্ঞেস করল: তবে সে গুলো বাড়ীতে আননি কেন?
—এমন অবস্থায় মামা যদি সেগুলো দেখে ফেলে তাহলে আর রক্ষে নেই! তাই ভাবলাম চুপচাপ করে বাড়ী এসে স্নান করে খাওয়া দাওয়া করে নেই। সন্ধ্যার সময় গোপনে সেগুলি নিয়ে আসব।
সবকিছু শুনে তারাতারি গোপালদাকে সঙ্গে নিয়ে লুকিয়ে রাখা মাটির ভিতর থেকে আনা এক টোপলা মার্কেল দেখতে পেয়ে আমি অত্যন্ত খুশি হলাম এবং বুঝতে পারলাম তার মত অভিজ্ঞ মার্বেল খেলোয়াড় এ অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টি নেই।
প্রথম দিনের এই ঘটনাটি বালক মনের চঞ্চল চিত্তের এক সামান্য ঘটনা বলে মনে হলেও এটি তার চারিত্রিক অনুশাসনহীনতার বহিঃপ্রকাশ বলে গণ্য হল। স্কুলে ভর্ত্তি করে দিবার পর মনে হল নতুন পরিবেশে সহজেই মানিয়ে নিতে তার কষ্ট হবে না। কিন্তু পরিবেশ সুন্দর হলেও মানুষের কদর্য দিকগুলি খুব সহজেই চারিদিকে পরিলক্ষিত হয়। প্রতিদিন সকালে পড়তে বসে একই বিষয়বস্তু বৎসরব্যাপী পাঠ করে গেল । পাঠ্যপুস্তকের সেই পংক্তিটি আজও কানে বাজে : ” আগুনের পরশমণি, নবী মোর সোনার খনি।”
একদা দাদু জিজ্ঞেস করল: গোপাল তুমি রোজ রোজ একই কবিতা কেন পড়?
গোপালদা অতি যত্ন সহকারে উত্তর করল: বাকি বিষয়বস্তুগুলি রাত্রে পড়ে নিয়েছি। শুধু এই কবিতাটি শিখতে বাকী। দাদুরও বুঝতে বাকী রইল না যে নাতি তাকে ছেলে ভুলানো উত্তর দিল। মনে মনে ভাবতে লাগল বিদ্যার দৌড় আর বেশী অগ্রসর হবার নয়।
পড়াশুনার প্রতি আগ্রহী না হলেও কাজকর্ম ও খেলাধূলার প্রতি সে একান্ত ব্রতী। এমন অনেক দিন ঘটেছে যে সে সারাদিনের জন্য বাড়ী থেকে নিরুদ্দেশ। শুধু তাই নয় বিভিন্ন মহল থেকে তার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ আসা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। পরের ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে বাবা ও কাকাবাবু রীতিমত হিমশিম খেয়ে গেল। গোপালনাকে রাস্তায় আনতে গিয়ে নানান লাঞ্ছনাও ভোগ করতে হল। তবুও হাল ছাড়েননি তারা। যেভাবেই হোক ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে। লক্ষ্য স্থির হলেও চলার পথে অনেক বাধার সম্মুখিন হতে হয়। এই একটি মাত্র দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও নানান দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে হৃদয় আকাশে মাঝে মাঝে একরাশ কালোমেঘের আগমন ঘটে।
বেশ কয়েকটি মাস কেটে গেল। গোপালদা আর আগের মতো এখানকার পরিবেশকে মানিয়ে নিতে পারল না। হঠাৎ একদিন বাবাকে ডেকে বলল: “মামা, আমাকে মার কাছে দিয়ে এসো। এখানে আর থাকতে পারব না। আর যদি আমাকে জোড় করে রাখার চেষ্টা কর তাহলে গাড়ির নীচে পরে মরে যাব!”
গোপালদার কথা গুলো বাবার কানে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হল! বুঝে উঠতে পারলেন না তৎক্ষণাৎ কি করণীয়। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন: “ভেবেছিলাম তোমাকে মানুষ করে ছোট বোনের হাতে তুলে দিতে পারলে তার অনেকটাই কষ্ট দূর হবে। কিন্তু তোমার তো সেই ভাবনা নেই। আছে শুধু নিষ্ফল আবেদন। যাইহোক তোমাকে জোড় করে এখানে আর রাখতে চাই না। অঘটন ঘটে গেলে বোনের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। তবে একটাই কথা, মাত্র কয়েকটা দিন রয়েছে বার্ষিক পরীক্ষার। সামান্য কষ্ট হলেও পরীক্ষা দিতে ভুলো না।”
পরের ছেলেকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করার দায়িত্ব অতি পুণ্য কর্ম। কিন্তু এই দায়িত্ব শুধু একার নয়। সোনা ভাল না হলে অলংকার তৈরী হবে কি করে?