Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দানিয়েলকুঠির হত্যারহস্য || Syed Mustafa Siraj » Page 3

দানিয়েলকুঠির হত্যারহস্য || Syed Mustafa Siraj

বাগানবাড়ির পাঁচিল ঘেরা মাঠে একটা শিরীষ গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। কর্নেল, সত্যেন্দ্র, ডাঃ পট্টনায়ক আর স্থানীয় পুলিশ অফিসার হিতেন চক্রবর্তী আলোচনা করছিলেন। কর্নেল হিতেনবাবুকে প্রশ্ন করছিলেন। এবার সত্যেন্দ্রের দিকে ঘুরে বললেন–খুনের দিন তাহলে ইদ্রিস খানের সেই কর্মচারী রনু ছেলেটি এসেছিল বিকেল চারটেয়। তাই না?

সত্যেন্দ্র বলল–হ্যাঁ। একটু-আধটু এদিক-ওদিক হতে পারে, তবে চারটের কাছাকাছি বলা যায়।

–রনু দেখা করেছিল মিঃ গুপ্টার সঙ্গে। ইজ ইট?

–হ্যাঁ। মিঃ চক্রবর্তী, ওর স্টেটমেন্টটা এই ফাইলে আছে। প্লিজ, বের করে এঁকে দিন না।

হিতেনবাবু ফাইলের নির্দিষ্ট জায়গাটা খুলে কর্নেলের সামনে ধরলেন। কর্নেল চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন। তারপর বললেন–হুম! রনুর সঙ্গে বারান্দায় কথা বলেন মিঃ গুপ্টা। তারপর রনু চলে যায় দক্ষিণের পোর্শনে–ওদের ঘরটায়। বিজনদের জন্যে সে অপেক্ষা করতে থাকে। সত্যেন্দ্র, আমি ছেলেটির সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে চাই।

–তাকে এখন এখানে পাবেন কোথায়?

হিতেনবাবু বললেন না স্যার। রনু আর ইদ্রিস সায়েব সকালে এসেছেন। চলুন, দেখা হয়ে যাবে।

মাঠ ঘুরে আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে সবাই দক্ষিণের অংশে গেলেন। সদর ঘরের দরজা খোলা। বারান্দায় চেয়ারে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে বসে রয়েছেন। একটি আঠারো-ঊনিশ বছরের ছেলে সামনে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

এঁদের দেখে ভদ্রলোক শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালেন। হিতেনবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন। কর্নেল বললেন–আপনিই তাহলে এ বাড়ির মালিক? বাঃ, আলাপ করে খুশি হলুম মিঃ খান। অবশ্য, আপনার মানসিক অবস্থা বুঝতেই পারছি একে ছিল ভূতের বাড়ি, এবার খুনের ঘটনা বেচারার বরাতে এসে পড়ল। এসব পুরনো বাড়ির কী যেন অভিশাপ আছে!

ইদ্রিস সায়েব অমায়িকভাবে হাসলেন। হাসিটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।

–আর তুমিই তাহলে মিঃ সেলিমের আত্মীয়রনু?

রনু মাথা নেড়ে হাসবার চেষ্টা করল।

তুমি আমার ছেলের বয়সী। তাই নাম ধরে ডাকছি বা তুমি বলছি। রাগ করছ না তো ইয়ংম্যান?

না স্যার। কী যে বলেন?

–এস, আমরা ওই গাছটার নীচে যাই। একটু গল্প করে আসি।

কর্নেল তার হাতে ধরে অন্তরঙ্গভাবে একটা অর্জুন গাছের তলায় নিয়ে গেলেন। সত্যেন্দ্ররা ইদ্রিস সায়েবের সঙ্গে গল্প করতে থাকল।

কর্নেল বললেন–আচ্ছা রনু, তুমি খুনের দিন ঠিক ক’টায় এখানে এসেছিলে?

–সে তো একবার বলেছি, স্যার! প্রায় চারটে-টারটে হবে। ঘড়ি দেখিনি!

–এসে ঠিক কী কী করেছিলে একটু বলো তো বাবা?

রনু নার্ভাস হয়ে বলল–এসে? এসে তো বাহাদুরকে ডাকলুম প্রথমে। বাহাদুরকে বললুম–আমার সেই দাদা আর তার বন্ধুরা আসছেন। সে যেন ফাইফরমাশ খেটে দেয় আগের মতো। বাহাদুর শুনে নিজের ঘরে চলে গেল। ওর বউটা খুব দজ্জাল মেয়ে স্যার! পাকা কুল শুকাতে দিয়েছিল, তার পাহারার ভার ছিল বাহাদুরের ওপর। তাই.. ।

তারপর তুমি কী করলে?

–ঘর খুললুম। কিচেনে গিয়ে কুকার জ্বালালুম। তারপর চায়ের জল চাপিয়ে দিলুম। তারপর মিঃ গুপ্টাকে খবরটা দিতে গেলুম।

–ঠিক কতক্ষণ লাগল এসব কাজে?

—কতক্ষণ?

–ভেবে বলবে কিন্তু।

বড়জোর মিনিট পনেরোর বেশি নয়।

–কোন পথে মিঃ গুপ্টার কাছে গেলে?

–কেন? এই আগাছার ঝোঁপ পেরিয়ে। ওই তো পথটা রয়েছে।

–বেশ। গিয়ে কী করলে?

–আমি ওদিকের বারান্দায় উঠতেই মিঃ গুপ্টা বেরিয়ে এসে বললেন কী খবর রনু? আমি বললুম–আজ সেলিমভাই আর তার বন্ধুরা পিকনিক করতে আসছে একটু পরেই। রাত্রে থাকবে। আপনাকে জানাতে বলেছে।

মিঃ গুপ্টা কী বললেন?

খুব খুশি হলেন মনে হল। কী আর বলবেন?

সত্যি খুশি হলেন?

-হ্যাঁ।

–ভাবো। তোমাকে সময় দিলুম ভাবতে। ভেবে বলো!

রনু আরও নার্ভাস হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কর্নেল ওর কাঁধে হাত রেখে ফের বললেন–কোন ভয় নেই। জাস্ট থিঙ্ক, মাই বয়!

–স্যার!

হু?

–মিঃ গুপ্টা বোধ হয় খুশি হননি!

–কেন, কেন?

–ওর মুখটা মনে পড়ছে স্যার। হা–মনে পড়ছে, উনি, ভুরু কুঁচকে ছিলেন। বলেছিলেন–তাই নাকি? এ অসময়ে পিকনিক! আছে ভালো সব! তারপর ঠিক আছে’ বলে তক্ষুণি ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। আমার বেশ অবাক লেগেছিল কিন্তু। একটু খারাপ লেগেছিল। এলুম তার কাছে, আর উনি হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়লেন…

–আচ্ছা, আচ্ছা! এবার বলো, কতক্ষণ তুমি দাঁড়িয়ে থাকলে?

–এক মিনিটও নয়। মনে হয়েছিল–হয়তো ব্যস্ত ছিলেন, তাই আমার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বললেন না!

–ওঁর ঘরের কোন আওয়াজ তোমাদের কোন ঘরে পৌঁছায়?

না স্যার। সলিড দেয়াল রয়েছে ছাদ অব্দি। শুনেছি, দানিয়েল সায়েব তার এক বন্ধুর জন্যে পরে বাড়িটার মাঝামাঝি দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন। পরীক্ষা করলেই দেখতে পাবেন–সেজন্যেই ঘরগুলো ছোট হয়ে গেছে। সেই বন্ধু দানিয়েল সায়েবের স্ত্রীকে নাকি এলোপ করে পালান। তাই সায়েব শেষে পাগল হয়ে যান!

–তুমি অনেক খবর রাখো দেখছি। আচ্ছা রনু, তোমার কি মনে হয়েছিল, মিঃ গুপ্টার ঘরে তখন ওঁর স্ত্রী বাদে আর কেউ ছিল?

-আমি তো ভেতরে যাইনি স্যার।

–তাহলেও জাস্ট একটা আইডিয়ার কথা বলছি।

–স্যার!

–হুঁ, বলো রনু।

–স্যার, আপনি ঠিকই বলেছেন।

–হুউ?

–আমার তাই মনে হয়েছিল বটে। ঘরে কারো সঙ্গে কথা বলতে বলতে উঠে এসেছিলেন যেন গুপ্টা সায়েব। কারণ, আমার পায়ের শব্দ পেয়েই উনি বেরোলেন। তারপর হঠাৎ আবার চলে গেলেন! হা-একটা আবছা ধারণা হয়েছিল মনে পড়ছে। তাছাড়া…

তাছাড়া?

–ওঁকে একটু মাতালও মনে হচ্ছিল। মদের গন্ধ পেয়েছিলুম।

–সেই ঠিকই। কারণ, যে বোতলটা পাওয়া গেছে, তাতে মদ আর অল্পই ছিল। আচ্ছা, চলো–আমার কথা শেষ হয়েছে।

চলতে চলতে রনু বলল–কোন বিপদ হবে না তো স্যার?

-কেন?

–এত সব তো পুলিশকে বলিনি!

না, না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। বলে কর্নেল বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন। কর্নেল ভাবছিলেন, দুটো গ্লাস পাওয়া গেছে। তৃতীয়টা গেল কোথায়?

ফেরার পথে পুলিশের গাড়িতে বসে কর্নেল ফাইলটা খুললেন। মিঃ গুপ্টার কর্মচারী আনন্দের বিবৃতিটা পড়তে লাগলে।

আনন্দ ৭ই মার্চ বিকেলে ক্যামাক স্ট্রিট ফ্লাটের জিনিসপত্তর ট্রাকে যাবার সময় সঙ্গে যায়। সব গোছগাছ করতে রাত দশটা বাজে ওখানে। মিঃ গুপ্টা জানান, পরদিন অফিস বন্ধ থাকবে। তিনি বিশ্রাম নেবেন। আনন্দরও ছুটি। তবে ৮ই মার্চ সকালে ওঁর বড় বউকে যেন সে জানিয়ে আসে–সায়েব হঠাৎ কাজে দিল্লি গেছেন। ফিরবেন ১০ই মার্চ। হ্যাঁ, আনন্দ জানে–বড় বউ এতে কিছু হইচই করেন না। স্বামীর খামখেয়ালি আচরণে তিনি অভ্যস্ত। যাই হোক, আনন্দ কথামতো সব করেছিল।

এসব বিবৃতির প্রতি বরাবর কর্নেল গুরুত্ব দেন না। প্রচলিত গতানুগতিক ঢঙে একজন পুলিশ অফিসার খসখস করে লিখে যান এবং সই করিয়ে নেন। খুঁটিয়ে কিছু প্রশ্ন করা হয় খুব কমই। অর্থাৎ পুলিশের পদ্ধতি হল, আগে সিদ্ধান্তে পৌঁছেই ওঁরা প্রমাণ হাতড়াতে ব্যস্ত হন। কর্নেলের হল উলটো। আগে প্রমাণ, পরে সিদ্ধান্ত।

সুতরাং আনন্দকে মুখোমুখি চাই। একটা প্রশ্ন খুব তীব্র। মিঃ গুপ্টা হঠাৎ রাতারাতি কেন বাগানবাড়িতে চলে এলেন ঊর্মিকে নিয়ে? আনন্দকে তিনি এর কৈফিয়ত দিয়েছিলেন কি? কিংবা আনন্দের কি কোন কৌতূহল হয়নি?

ইদ্রিস সায়েব বলছেন–২১শে মার্চ ও বাড়িতে মিঃ গুপ্টা আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ ৭ই মার্চ দুপুরে মিঃ গুপ্টা ইদ্রিস সায়েবের কলকাতার অফিসে ফোন করে বলেন যে এদিনই তিনি যেতে চান। ইদ্রিস সায়েব আপত্তি করেননি। তাজ্জব হয়েছিলেন কি? তা তো হবারই কথা। তবে তাজ্জব হয়েছিলেন অন্য কারণে নয়– লোকে ওই বয়সেও কচি বউয়ের বায়না মেটাতে অমন পাগল হয়, সেটা লক্ষ্য করেই। ইদ্রিসের ধারণা, ওঁর দ্বিতীয়পক্ষটি খুব খামখেয়ালি বিবি ছিলেন। হঠাৎ ‘উঠল বাই তো মক্কা যাই’ গোছের স্রেফ খেয়াল ছাড়া আর কিছু নয়।

তাছাড়া গুপ্টা সায়েব ও বাড়িতে গিয়ে থাকলে ইদ্রিসের একটা বড় অস্বস্তি দূর হয়। কেউ আর গিয়ে জবরদখল করে বসতে পারবে না। সরকারও খালি কোঠি’ বেমক্কা কেড়ে নিতে পারবেন না। ঠিক এজন্যেই তো ইদ্রিস কষ্ট করে মাসের পর মাস কলকাতা থেকে গিয়ে ওখানে রাত কাটাতেন।

তাই উনি প্রস্তাবটা শোনামাত্র বলেছিলেন–ইশা আল্লা! খুব ভালো, উদা বাত আছে। চলে যান এক্ষুণি, কোঠি তো আপনার আছে গুপ্টা সায়েব। রনু বাহাদুরকে চাবি দিয়ে আসছে। সব সমঝে দিচ্ছি ওকে। আভি পাঠাচ্ছি। বাহাদুর ঝামেলা করবে না।

ইদ্রিস খানের কাছে কিছু আর নতুন জানার নেই। এখন আনন্দকে দরকার। কর্নেল একটু কেশে বললেন–সত্যেন্দ্র আমি মিঃ গুপ্টার কর্মচারী আনন্দবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই।

সত্যেন্দ্র বলল–নিশ্চয় বললেন। চলুন, লালবাজার পৌঁছেই ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–আমি এখন কিন্তু যাচ্ছি না তোমার সঙ্গে। বাসায় ফিরতে চাই। তুমি বরং আনন্দবাবুকে আমার বাসায় যেতে বলো। ঠিকানা দিয়ে দিও।

কর্নেল বাকি পথ চুপ করে থাকলেন। হুম, বাহাদুর লোকটা বউকে বড় ডরায়। রনু ঠিকই বলছিল। সব সময় সে বাচ্চা কোলে নিয়ে পাকা কুল পাহারা দেয় বউয়ের হুকুমে। আর দক্ষিণের গেটের দিকে লক্ষ্য রাখে। কেউ ঢুকলে ওখান থেকেই ধমক দেয়। উত্তরের দিকে কিছু ঘটলে সে টেরও পায় না। ৭ই মার্চ মাত্র একবার ওদিকে গিয়ে নতুন সায়েবকে দরজা খুলে দিয়েই দৌড়ে নিজের কাজে চলে এসেছিল সে। সেদিন আর যায়নি। গিয়েছিল ওর বউ লক্ষ্মীরানী। লক্ষ্মী সায়েবদের এক বালতি জল দিয়ে আসে সন্ধ্যার দিকে। তারপর সেও আর সেদিনের মতো যায়নি। পরদিন ৮ই মার্চ সকালে বাহাদুরকে ডাকেন সায়েব। বাহাদুরকে এক বালতি জল দিতে বলেন। সে জল দিয়ে আসে। দুপুরে একবার সায়েব ও মেমসায়েব বেরিয়েছিলেন। দক্ষিণের গেট দিয়ে হেঁটে দু’জনে বেরোন। সেই সময় বাহাদুরকে জিগ্যেস করেন, কোন্ রাস্তায় গেলে বাজার বা হোটেল পড়বে। ওঁরা খেতে বেরিয়েছিলেন। ফেরেন আন্দাজ ঘণ্টা দুই পরে। বাজারের দিকে তিনটে বড় হোটেল আছে। পান্থনিবাস হোটেলের মালিক যা বর্ণনা দিয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে ওঁরা সেখানেই লাঞ্চ সেরেছিলেন। বাহাদুরের বউ লক্ষ্মী খুব চাপা মেয়ে। খুব কম কথা বলে। কী যেন জানে ও, বলতে চায় না।

কর্নেল একবার ভাবলেন, এ তাঁর নিছক অনুমান–পরে ভাবলেন, তাহলে লক্ষ্মীর মুখে কেন হঠাৎ অমন ভাবান্তর লক্ষ্য করলেন তখন?

ভাবান্তর একটা ঘটেছিলই। উত্তরোত্তর এ সন্দেহ দৃঢ় হল। লক্ষ্মী কিছু একটা গোপন করেছে, এ ধারণা কিছুতেই গেল না কর্নেলের মন থেকে।

কিন্তু ওই অশিক্ষিতা লক্ষ্মীর কাছ থেকে কথা আদায় করা স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষেও যেন অসম্ভব। অনেক কূট প্রশ্ন করেও পাত্তা পাননি কর্নেল। লক্ষ্মীর এক কথা–সে ওদিকে আর যায়নি। কিছু শোনেনি বা দেখেওনি।

অথচ……।

কর্নেল নড়েচড়ে বসলেন। শ্যামবাজার চৌমাথা পেরোচ্ছে পুলিশের গাড়ি। বললেন–আমাকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউতে মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড়ে নামিয়ে দেবে, সত্যেন্দ্র।

সত্যেন্দ্র বলল–কেন বাসায় ফিরবেন না?

–ফিরব। ওখানে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে যাব। আমার জন্যে ব্যস্ত হয়ো না।

–আপনার লাঞ্চের দেরি হয়ে যাবে কিন্তু।

কর্নেল হাসলেন। না। ওখানে আমার নেমন্তন্ন আছে। এইমাত্র মনে পড়ল।

বড় রাস্তার ওপর বাড়িটা। পাঁচতলা বিশাল বাড়ি। রাজস্থানি স্থাপত্য। কর্নেল মুখ তুলে এক মিনিট বাড়িটার ছাদ অব্দি দেখলেন। তারপর সরু গলিতে ঢুকলেন। বাঁদিকে চওড়া সিঁড়ি। লিফট নেই। বুড়োদের পক্ষে নিশ্চয় খুব কষ্টকর ব্যাপার। তবে কর্নেল অন্য মানুষ। এখনও অনেক কুস্তিগীরকে ধরাশায়ী করার মতো জোর ও কৌশল তাঁর আছে।

অবশ্য কেউ তাঁকে এ বাড়িতে লড়াই দেবার জন্যে অপেক্ষা করছে না। চারতলায় উঠে একটা ফ্ল্যাটের বোতাম টিপলেন। এখন অসময় দেখা করার পক্ষে। কিন্তু কাজটা সেরেই যেতে হবে।

একটি সুন্দর স্বাস্থ্যবান কিশোর দরজা খুলে হিন্দিতে বলল–কাকে চান?

–তোমার নাম কী বাবা? …বলে কর্নেল মিষ্টি হেসে ওর চিবুকটা নেড়ে দিলেন।

কিশোরটি ভুরু কুঁচকে ওঁকে দেখছিল। এবার বিরক্ত হয়ে বলল–কে আপনি?

–তোমার বাবার বন্ধু। মাকে বলো আমার কথা।

কিশোরটি মুখ ঘুরিয়ে ডাকল–মা, দেখ তো কে এসেছেন।

একটি মহিলা-চল্লিশের মধ্যে বয়স, সুশ্রী চেহারা, দরজার কাছে এসে বললেন–কাকে চাই আপনার?

কর্নেল একটু হাসলেন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। মিঃ গুপ্টার… ।

মহিলাটি গম্ভীর হয়ে বললেন–আপনি কি পুলিশের লোক?

কর্নেল জবাব দিলেন–মোটেও না। আমি মিঃ গুপ্টার একজন বন্ধু। দুঃখের ব্যাপার, কাগজে ওঁর মৃত্যুর খবর দেখলুম–প্রথমে বুঝতেই পারিনি উনি আমার বন্ধু প্রকাশ গুপ্টা কি না। পরে খোঁজ নিয়ে জানলুম, ব্যাপারটা তাই! খুব বিচলিত হয়ে পড়লুম। ওঁর সঙ্গে আমার বহুকালের দোস্তি ছিল। বেচারা গুপ্টা..

মহিলাটির দু’চোখ হঠাৎ জ্বলে উঠল। –থাক্। আর দোস্তের জন্য আপনি সিমপ্যাথি দেখাবেন না। আপনারাই তো ওঁকে পাপের পথে ঠেলে দিয়েছেন! আপনারাই অমন ভাল মানুষটার সর্বনাশ করেছেন! এখন এসেছেন আমাকে সান্ত্বনা দিতে! আমি কারও সান্ত্বনা চাইনে! আপনি দয়া করে আসুন।

কর্নেল বিব্রতমুখে কিছু বলতে যাচ্ছেন, সেই সময় একটি যুবক মিসেস গুপ্টার পিছনে এসে দাঁড়াল। তার চেহারা দেখে মনে হল, সে বাঙালি। সে বলল–কী হয়েছে ভাবীজী? কে উনি?

কর্নেল বাংলায় বললেন–যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে, মাই ডিয়ার ইয়ং ম্যান, আপনি নিশ্চয় আনন্দ সান্যাল?

-হ্যাঁ। আপনি কে?

বলছি। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে তো কথা বলা যাবে না আনন্দবাবু!

মিসেস্ গুপ্টা আর একবার ওঁর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সন্দিগ্ধভাবে বললেন–খুব জরুরি কিছু বলার থাকলে আসুন। তবে আগেই বলে রাখছি, কোম্পানির কোন ব্যাপারে আমি এখন কথা বলব না। বোম্বে থেকে আমার দেওর আসছে। সে এলে কথা হবে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–আনন্দবাবু, আপনার বন্ধুরা আপনার বন্ধুরা মানে পারুল অ্যাডের বিজনবাবুরা আমাকে চেনেন। আমি…

আনন্দ এবার লাফিয়ে উঠল। চিনেছি স্যার! আপনি কর্নেল সরকার। ডেসক্রিপসন মিলে যাচ্ছে। আমি আপনার কাছে যেতুম, স্যার।

মিসেস্ গুপ্টা অবাক হয়ে আনন্দের দিকে তাকালেন। আনন্দ ওঁর কানেকানে কিছু বলল। তখন উনি বললেন–আপ অন্দর আইয়ে!

মিঃ গুপ্টার বড় বউ জাঁদরেল ধরনের গৃহিণী সন্দেহ নেই। ঘরদোর পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো। সবখানে পরিবারের ধর্মানুরাগের পরিচয় সুপ্রকট। বসার ঘরে ঢুকে কর্নেল লক্ষ্য করলেন–মিঃ গুপ্টার একটি বিশাল ছবিতে মালা দেওয়া রয়েছে। ভারতীয় নারীরা সত্যি খুব অবাক করে দেয়! একটি বারো তের বছরের ফুটফুটে মেয়ে ও একটি আট-ন’বছর বয়সের সুন্দর ছেলে একবার উঁকি দিয়ে চলে গেল। আঃ, এমন সুন্দর পবিত্র সংসার ফেলে প্রকাশ গুপ্টা কী খুঁজে পেয়েছিল মিলি সেনের কাছে? ভাবতে কষ্ট হয়।

কর্নেল বসলেন। আনন্দও একপাশে বসল। মিসেস গুপ্টা সামনে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। শোকের মলিনতা এরই মধ্যে কাটিয়ে উঠেছেন মহিলাটি। এটা মেয়েরাই পারে সম্ভবত। তারা সর্বংসহা। কর্নেল মনে মনে তারিফ করলেন।

আনন্দ বলল–জানেন? আমিও বিজনদের সঙ্গে আপনার কাছে যেতুম। কিন্তু এ বাড়িতে ভাবীজীকে সামলানো, ওদিকে কোম্পানি–এসব নিয়ে একটু ফুরসত পাচ্ছিলুম না।

কর্নেল বললেন–আনন্দবাবু, আপনাকে আমি পরে প্রশ্ন করব। আপাতত মিসেস্ গুপ্টার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা সেরে নিই।

মিসেস্ গুপ্টা বললেনবলুন।

–আপনি বসুন, প্লিজ।

উনি বসলেন। কর্নেল এক মিনিট চুপ করে থাকার পর বললেন–ঊর্মি দেবীর সঙ্গে মিঃ গুপ্টার সম্পর্কের কথা কি আপনি জানতেন?

মিসেস্ গুপ্টা মুখ নামিয়ে জবাব দিলেন–হ্যাঁ।

আনন্দ চমকে গেল, তা লক্ষ্য করলেন কর্নেল। তারপর বললেন–আনন্দের কাছে শুনেছিলেন, নাকি অন্য কোন উপায়ে জেনেছিলেন?

–আনন্দ আমাকে কিছু জানায়নি। বেচারিকে আমি এর জন্যে এতটুকু দোষ দিইনে। ও খুব ভাল ছেলে। ও মাথার ওপর না থাকলে আজ খুব বিপদে পড়ে যেতুম। ও কী করবে? মনিবের বদমাইসি কি তার কর্মচারী মনিবের স্ত্রীর কাছে বলতে সাহস পায়? তবে আমি বরাবর জানতুম। জেনেও আর কী করব? মিঃ গুপ্টাকে ফেরাবার সাধ্য আমার ছিল না।

–কীভাবে জানতে পেরেছিলেন?

–সে অনেক কথা। গত বছর অব্দি আমরা বোম্বেতে ছিলুম। ওঁর ব্যবসাও ছিল সেখানে। মেসিনারি জিনিসপত্রের দালালির কারবার ছিল কতকটা অর্ডার সাপ্লায়ের মতো। হঠাৎ উনি কলকাতায় ব্যবসা করবেন বললেন। চলেও এলেন। দু’মাস পরে আমাদের নিয়ে এলেন। আমি ভাবলুম, ভাল হল। বেশ্যা মেয়েটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল। কিন্তু এখানে এসেই টের পেলুম, ওঁর কলকাতা আসার কারণ কী। মেয়েটা ক্যামাক স্ট্রিটের একটা ফ্ল্যাটে রয়েছে। আর…

বাধা দিলেন কর্নেল। আপনার প্রথম প্রশ্নের জবাব পাইনি কিন্তু!

-হ্যাঁ, বোম্বাতে উনি ফিল্ম লাইনেও ঘুরতেন। বলতেন–ছবি প্রডিউস করবেন। ওঁর এক বন্ধু ছিলেন প্রডিউসার। ভদ্রলোক মাদ্রাজিনাম, নারায়ণ কুমারমঙ্গলম।

–মাদ্রাজি! কর্নেল চমকে উঠলেন।

–হ্যাঁ। …বলে একটু চুপ করে গেলেন মিসেস্ গুপ্টা। তারপর বললেন– এসব কথা বলা হয়তো উচিত নয়। কিন্তু বলছি। পাপ কখনও চাপা থাকে না। কুমারমঙ্গলমের সঙ্গে মিলে উনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কুমারমঙ্গলমও খুব একটা পয়সাওয়ালা ছিলেন না। কিন্তু মাথায় ফিল্মের হাওয়া ঢুকলে যা হয়। দুই বন্ধু মিলে ষড়যন্ত্র করলেন। মিঃ গুপ্টার দু’ভাই। বড়ভাই মারা গিয়েছিলেন অনেক পয়সা কামিয়ে। ওঁর একটি মাত্র ছেলে ছিলনাম রূপেশ।

কর্নেল দ্বিতীয়বার চমকে উঠলেন। –রূপেশকুমার!

-হ্যাঁ, ফিল্মে ওই নাম নিয়েছিল বেচারা। বোকা ছেলে! চাচার ষড়যন্ত্র জানতে পারেনি। রূপেশের মাও সরল সাদাসিধে মেয়ে। আমার স্বামী ভেবেছিলেন, রূপেশকে সরাতে পারলে ওঁর সম্পত্তি কায়দা করতে দেরি হবে না। সেই লোভে আমার স্বামী স্যুটিংয়ের সময় নকল রিভলবারের বদলে আসল গুলিভরা রিভলবার পাচার করলেন বেশ্যা মেয়েটার হাতে। সে ছিল ওই ছবির হিরোইন। আগে থেকে সব ঠিক করা ছিল।

–কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে, এখনও বলেননি কিন্তু।

আমাদের সোফার ছিল আমার বাবার দেশের লোক। তার কাছে। জেনেছিলাম। কলকাতায় এসে তার কাছেই জানতে পারলুম, এখানে আমার স্বামী কী করছেন।

-হুম্ তারপর?

–গাড়িটা বেচে দিলেন উনি গত মাসে। বেচারার চাকরিও গেল। ও বোম্বে ফিরে গেল। যাবার দিন দেখা করেও যায়নি। এখন ভাবছি, লোকটা থাকলে হয়তো আরও অনেক কিছু জানতে পারতুম।

–মিঃ গুপ্টা এবং ঊর্মি দেবীকে কে খুন করেছে বলে আপনার ধারণা, জানতে পারি কি মা?

মাথা নাড়লেন মিসেস্ গুপ্টা। জানি না। তবে আমার সন্দেহ…

–হ্যাঁ, বলুন বলুন!

–সন্দেহ করতুম না। কিন্তু আনন্দ এতদিনে সন্দেহটা মাথায় ঢুকিয়ে দিল। আনন্দই বলুক বরং।

কর্নেল আনন্দের দিকে সপ্রশ্ন তাকালেন। আনন্দ কুণ্ঠিত মুখে বলল– সন্দেহটা ভুল হতেও পারে। তবে মাঝেমাঝে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের একটা বাড়িতে এক ভদ্রলোকের কাছে আমাকে পাঠাতেন সায়েব। একটা প্যাকেট দিতেন উনি। প্যাকটটা গুপ্টা সায়েবকে পৌঁছে দিতাম। বেশ বড় প্যাকেট। বলতেন স্মাগলিং করে আনা বিলিতি মদ আছে। কখনও বলতেন কাপড় আছে। বার তিনেক আমি এনেছি গত তিনমাসে। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তায় নির্দিষ্টা একটা তারিখে আমাকে যেতে হত। কোন মাসে দু তারিখ, কোন মাসে সাত তারিখে। ভদ্রলোক খুব বদরাগী। সায়েবেরই বয়সী। ফেব্রুয়ারি মাসের সাত তারিখে গেলে প্যাকেট দিলেন–বেশ ভারী। কিন্তু খুব ধমকালেন আমাকে। তারপর বললেন–গুপ্টাকে বলো, আর কারবার চলবে না এভাবে। সব কিছুর শেষ হয়ে যাবে। আমি তো তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলুম। ফিরে এসে ওঁকে বললে উনি রেগে গেলেন। বললেন, ঠিক আছে, আমি এবার থেকে নিজেই যাব মোকাবিলা করতে।

কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। আজ চলি তাহলে। আনন্দবাবু, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের সেই ঠিকানাটি কি আপনার মনে আছে?

আনন্দ বলল-খুব আছে স্যার।

–একটা কাগজে লিখে দিন।

মিসেস্ গুপ্টা শশব্যস্তে বললেন কর্নেল সাহাব, প্লিজ মাফ করবেন। এক গেলাস সরবত খেয়ে যান। আমার ভুল হয়ে গেছে।

কর্নেল হাত তুলে মিষ্টি হাসলেন। পরে হবে মা, আজ চলি।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress