দাদুভাই
দাদু কেন ফিরে আসছে না? বাপন মাঝে মাঝে ভাবে l দাদুকে যে সেই নিয়ে গেলো, আর ফিরিয়ে আনলো না l ঠাম্মা আর মা খুব কাঁদছিলো l সেই সময় জেঠু জ্যেঠিমনি দাদাকে নিয়ে কোচবিহার গিয়েছিলো l বাবা, কাকু, সমরদাদু সুনীলজেঠু, আরও অনেকে দাদুকে মাচার উপর সাদা কাপড় জড়িয়ে ‘হরিবোল’, ‘হরিবোল’ করতে করতে নিয়ে গেলো l দাদুকে কোথায় নিয়ে গেলো জিজ্ঞেস করতে মা বললো, দাদু ভগবানের কাছে চলে গেছে l বাপন বুঝতে পারে না, জেঠু যখন দাদাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো, তখনও জ্যেঠিমনি খুব কাঁদছিলো l ঠাম্মা, মা জ্যেঠিমনিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলো, এপেন্ডিক্স এমন কিছু নয় l অপারেশন করলেই সেরে যাবে l দাদাও ব্যথায় খুব কাঁদছিলো l দাদাতো কিছুদিন পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে এসেছিলো l কিন্তু দাদুতো কাঁদছিলো না, মুখ হাঁ করে ঘুমিয়ে আছে যেন l বাবা, কাকু দাদুকে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিতেও অন্যদিনের মতো চিৎকার করছিলো না l তবে কি দাদু সত্যিই মরে গেছে, আর ফিরে আসবে না l তাকে আর ‘দাদুভাই’, ‘ও দাদুভাই’ করে কেউ আর ডাকবে না l ভাবতেই বাপনের বুকে একটা কষ্ট আছড়ে পড়লো l বাপন কান্না চাপিয়ে উদ্ধশ্বাসে দৌড় শুরু করলো l
বারান্দা পার হয়ে বড় ঘরের মাঝ দিয়ে দাদুর ছোট ঘরটায় আসতেই বাপন থমকে দাঁড়ালো l ঘরটাকে কেমন খালি খালি দেখাচ্ছে l খাটটার উপর কিছু নাই, যেখানে দাদু শুয়ে থাকতো l আলমারির উপর দাদুর সুটকেসটা অবহেলায় পড়ে আছে l দাদু যেটা কাউকে ছুঁতে দিতো না l দাদুর রাজ্যের সম্পদ বোধহয় ওখানে লুকানো আছে l ঘরের এক কোণে অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছে দাদুর প্রিয় লাঠিটা l লাঠিটা বাপনের ছুঁয়ে দেখতে ভীষণ লোভ হচ্ছে l এই লাঠি নিয়েই বাপনের সাথে দাদুর ঝগড়া লেগে যেত l কিছু দুস্টুমি করলেই দাদু লাঠি নিয়ে বাপনকে তাড়া করতো l বাপনও কিছুটা দূরত্বে গিয়ে দাদুকে খেপিয়ে তুলতো – ধরো দাদু, ধরো দাদু l
বাপনের চোখে মুখে দুস্টুমি গড়িয়ে পড়তো l আবার কখনো দাদুর অন্যমনস্কতার সুযোগে লাঠি নিয়ে গুটি গুটি পায়ে মুহূর্তে ত্রিসীমানার বাইরে l দাদুর তখন পরিত্রাহি চিৎকার, ‘ও ছোটমা, ও বড়মা, আমার লাঠি নিয়ে গেলো গো, দাঁড়া, একবার ধরি, দেখাবো মজা l জ্যেঠিমনি, মা তখন বাপনকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ফিরিয়ে আনতো লাঠিটা l
আচ্ছা দাদু কেন মা, জ্যেঠিমনিকে ছোটমা, বড়মা বলে ডাকে l তবে কি দাদু ওর আর দাদার মতো ছোট হয়ে গেছে l বাপন ভেবে পায় না l মা বলে, বুড়ো হলে মানুষ ছোট বাচ্চা হয়ে যায় l ও দাদার থেকেও অনেক বড় হয়ে গেছে l দাদু ওকে গুড বয় বলে ডাকে l দাদুর বাপনের নার্সারি বইয়ের সবগুলো রাইমস মুখস্ত l বাপন একটু ভুল করলে, দাদু ঠিক ধরে ফেলে l দাদুইতো প্রথম শিখিয়েছিলো, ‘টুইঙ্কল, টুইঙ্কল, লিটল ষ্টার, হাউ ই ওয়ান্ডার, হোয়াট ইউ আর ‘ l
ওদের ঘরে বাপন মা’র সাথেই ঘুমায় l বাবা না থাকায় বাপনের ঘুম আসতে চায় না l বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় l আকাশের তারাগুলো গুনতে শুরু করে – এক, দুই, তিন, চার…. l গুনতে গুনতে কেমন যেনো খেই হারিয়ে ফেলে l তারাগুলো কোথা থেকে আসলো l মা বলে- মানুষ মরে নাকি তারা হয়ে যায় l তবে কি দাদুও তারা হয়ে গেছে? মা বাপনকে বুকে জড়িয়ে ধরে l হাঁ, বাবা, তোমার দাদু তারা হয়ে গেছে l তোমার দিকে কেমন মিট মিট করে তাকিয়ে আছে l তোমাকে বলছে, দাদুভাই, ভালো করে পড়াশুনা করো, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে l মা’র কথা শুনবে, দাদার সাথে মারামারি করবে না l ঠাম্মাকে দেখে রাখবে l
বাপনের চোখে ঘুমের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে l বাপন দাদুর কথা শুনতে পারছে – দাদুভাই, ও দাদুভাই ! সেই ছড়াটা একবার বলোতো – টুইঙ্কল, টুইঙ্কল, লিটল ষ্টার …. l