Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন || Muhammad Zafar » Page 8

দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন || Muhammad Zafar

পাহাড়ের মতো মানুষটা ভেতরে ঢুকে আমাদের সবাইকে একনজর দেখে বলল, “দেখছিস মাইনকা, চার গোলামের সাথে এখানে দুই বিবি যোগ হইছে।”

প্রথমে আমার মনে হল আমাদের গোলাম বলে গালি দিচ্ছে, একটু পরে বুঝতে পারলাম সে তাসের গোলাম আর বিবির কথা বলছে। আমরা কিছু বললাম না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাহাড়ের মতো মানুষটা ঘরের ভেতরে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকাল। তারপর শাবলটা দিয়ে চঞ্চলের পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, “কী, পেয়েছিস ব্যাঙের ছাতা? ব্যাঙের ছাতার জন্যে মাটির এতো নিচে আসতে হল?”

আমরা এবারেও কোনো কথা বললাম না। মানিক বলল, “আমি প্রথম যখন এই চার মক্কেলকে দেখেছি তখনি বুঝেছি কোনো গোলমাল আছে। মনে আছে ওস্তাদ, কী রকম চোখের পাতি না ফেলে মিথ্যা কথা বলে গেল? এরা যখন বড় হবে তখন কতো বড় ক্রিমিনাল হবে চিন্তা করতে পারেন?”

মোটা মানুষটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এই জন্যেই তো দেশের উন্নতি হয় না। ছোট পোলাপান ছোট পোলাপানের মতো থাকে না, বড় মানুষের কাজের মাঝে নাক গলায়।”

আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা কী চান?”

প্রথমে মানিক তারপর পাহাড়ের মতো মানুষটা হা হা করে হাসতে থাকে যেন আমি খুবই হাসির কথা বলেছি। এক সময় হাসি থামিয়ে মানিক বলল, “আমরা দুজন এখানে এসেছি আপনাদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্যে! আপনারা এই রকম কামেল মানুষ আমরা যদি আপনাদের অটোগ্রাফ না নেই তা হলে কে নিবে?”

মোটা মানুষটা বলল, “আচ্ছা দেখি, তোরাই বলতে পারিস কী না! বল দেখি আমরা কী জন্যে এসেছি?”

আমি অনুমান করতে পারছিলাম কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। বললাম, “জানি না।”

মানুষটা তার শাবলটা দিয়ে সিন্দুকটা দেখিয়ে বলল, “ঐ যে সিন্দুকটা দেখছিস না? তার ভিতর কী আছে বল দেখি?”

আমরা সেটাও অনুমান করতে পারছিলাম কিন্তু মুখে বললাম, “জানি না।”

“ঐ সিন্দুকের ভিতর আছে সাত রাজার ধন! মিশকাত খানের সাথে কাজ করতো ডাকাতের দল। তার ছিল কয়েকটা দোনলা বন্দুক। সে ডাকাতদের সেই দোনলা বন্দুক দিত ডাকাতি করার জন্যে। তারা ডাকাতি করে সোনাদানা আনতো, মিশকাত খান তার বখরা নিত। সব সে এই সিন্দুকে রেখে গেছে।”

চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেমন করে জানেন?”

“মিশকাত খানের ডান হাত ছিল গজু ডাকাত! আমি হচ্ছি গজু ডাকাতের ছেলের ঘরের নাতি। আমি যখন ছোট তখন আমার বাপ-চাচা আমার কাছে গল্প করেছে, বলেছে মিশকাত মঞ্জিলের নিচে আছে যক্ষের ধন। এই হচ্ছে সেই যক্ষের ধন। আমি ছয় বছর ধরে খুঁজেছি পাই নাই! তোরা সবাই একসাথে তিন দিনে খুঁজে পেয়ে গেলি। তোদের একটা পুরস্কার দেওয়া দরকার! বল দেখি তোদেরকে কী পুরস্কার দিব?”

চঞ্চল বলল, “জানি না।”

“তোদের সাথে একজনের পরিচয় করিয়ে দিব, তোদের বন্ধু। তারপর তোরা মিলেমিশে থাকবি।”

মানুষটা কী বলছে আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, চঞ্চল বলল, “বন্ধু? কোন বন্ধু?”

পাহাড়ের মতো মানুষটা তখন সিন্দুকের উপর শুয়ে থাকা বাচ্চাটার কঙ্কালটাকে দেখিয়ে বলল, “এই যে তোদর বন্ধু! আরেকজন বিবি! চার গোলাম দুই বিবি ছিলি, এখন হবি চার গোলাম তিন বিবি!” এই ঘরে সবাই মিলে থাকবি। গল্প-গুজব করবি। যখন রাত হবে তখন নাকি সুরে কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াবি।”

মানুষটার কথা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠল, কী ভয়ানক কথা বলছে। আমাদের এখানে আটকে রাখবে! আমি মিথিলার দিকে তাকালাম, ভেবেছিলাম দেখব ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, কিন্তু ঠিক কী কারণ জানা নেই, তাকে দেখে মনে হল না সে খুব ভয় পেয়েছে। সে টুনির হাত ধরে রেখে শান্ত মুখে মানুষগুলোকে দেখছে।

মানিক আমাদের দিকে রিভলবারটা ধরে রাখল, আর তার পাহাড়ের মতো ওস্তাদ লোহার শাবলটা ঘাড়ে নিয়ে সিন্দুকটা ঘুরে একটা চক্কর দেয়। তারপর মুখ দিয়ে লোল টানার মতো শব্দ করে বলল, “আমার আর সহ্য হচ্ছে না। সিন্দুকটা খুলি। মাইনকা টর্চ লাইটটা এদিকে ধর।–”

চঞ্চল বলল, “আমাদের কাছে মোমবাতি আছে। লাগবে আপনাদের?”

“মোমবাতি?” পাহাড়ের মতো মানুষটার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, “আগে বলবি তো? টর্চ লাইট ধরে কী কাজ করা যায়? বার কর মোমবাতি।”

চঞ্চল কেন গায়ে পড়ে মানুষগুলোকে সাহায্য করতে চাইছে অন্য কেউ সেটা বুঝতে পারল না, শুধু আমি বুঝতে পারলাম। সে তার ইনডাকশন কয়েলটা বের করতে চাইছে।

মানিক রিভলবারটা চঞ্চলের দিকে তাক করে রেখে বলল, “খবরদার কোনো রকম রং তামাশা করবি না। ভদ্রলোকের মতো মোমবাতিটা বের করবি।”

চঞ্চল তার ব্যাগ থেকে মোমবাতি বের করার ভান করে অনেক কিছু বের করল, তার ইনডাকশন কয়েলটাও। সেখান থেকে মোমবাতিগুলো আলাদা করে মানিকের হাতে দেয়, তারপর বের করা জিনিসগুলো আবার ব্যাগের ভেতর ঢোকাতে থাকে। আমি চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করলাম সে অন্য জিনিসগুলো ব্যাগে ঢোকালেও ইনডাকশন কয়েলটা ঢোকালো না। আমি তখন চঞ্চলকে সাহায্য করার জন্যে মানিকের দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করলাম। তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনারা তো সিন্দুক খুলে সোনাদানা পাবেন। আমরা কি এখন যেতে পারি?”

মানিক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বললি?”

“বলছি যে আমরা কি এখন যেতে পারি?”

“কোথায় যাবি?”

“বাসায়।”

“বাসায়?” আমার কথা শুনে মানিক এতো অবাক হল যে বলার মতো নয়। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, “তোর মাথায় কী গোবর না কী অন্য কিছু? তুই কেমন করে ভাবলি যে আমরা তোদের ছেড়ে দিব? তোদেরকে ছেড়ে দিলে তোরা যে বাইরে গিয়ে খবর দিবি আর পুলিশ, র‍্যাব, মিলিটারি এসে আমাদেরকে ধরবে সেটা তোর মোটা মাথায় ঢুকে না?”

অবশ্যই ঢুকে কিন্তু আমি যে তার দৃষ্টি আমার দিকে রাখার জন্যে কথাগুলো বলছি সেটা তো আর বলতে পারছি না। তাই আমি আলাপ চালিয়ে যাবার জন্যে বললাম, “ঠিক আছে তা হলে আমাদেরকে সোনাদানার একটু ভাগ দেন তা হলে আমরা কাউকে বলব না।”

“কী বললি?” মানিক আমার কথা শুনে এবারে শুধু অবাক নয় মনে হয় রেগেও গেল। বলল, “তোদের সোনাদানার ভাগ দিব?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “কেন দিবেন না? আমরাই তো এই জায়গাটা খুঁজে বের করেছি।”

মানিক তখন পাহাড়ের মতো মানুষটার কাছে নালিশ করল, বলল, “শুনছেন ওস্তাদ এই পোলা কী বলে? তারে না কি সোনাদানার ভাগ দিতে হবে।”

“এদের কথা শুনিস না মাইনকা। এরা মেলা তাঁদর। এদের কথা শুনলে কানের পোকা নড়ে যায়।”

এতক্ষণে চঞ্চল নিশ্চয়ই ইনডাকশন কয়েলটা তার হাতে লাগিয়ে ফেলেছে আমি তাই আর কথা বললাম না। পাহাড়ের মতো মানুষটা মোমবাতিগুলো ঘরের এদিক-সেদিক রেখে সেগুলো জ্বালিয়ে দেয়। সাথে সাথে ঘরের ভিতর একটা নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে। টর্চ লাইটটা নিভিয়ে পাহাড়ের মতো মানুষটা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই সিন্দুকের চাবি কার কাছে?” টিটন তার হাতের চাবিটা

এগিয়ে ধরে, মোটা মানুষটা এসে ছোঁ মেরে চাবিটা নিয়ে নেয়।

পাহাড়ের মতো মানুষটা বলল, “এখন আমি এই সিন্দুকের তালা খুলব। তোরা কোনো গোলমাল করবি না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। চোরের গুষ্টি চোর।”

আমার কেমন জানি রাগ উঠে গেল, বললাম, “চুরি করতে এসেছেন আপনারা, আর আমাদেরকে বলছেন চোর?”

মানিক তখন হঠাৎ যেন খেপে গেল, চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললি? কী বললি তুই? আমরা চুরি করতে এসেছি? তোর এতো বড় সাহস, তুই আমাদের চোর ডাকিস?” মানিক রাগে দাঁত কিড়মিড় করে রিভলবারটা আমার মাথার দিকে তাক করে, আমি দেখতে পেলাম সে রিভলবারের ট্রিগারটা টেনে ধরেছে, যে কোনো মুহূর্তে একটা গুলি বের হয়ে আসবে।

তখন অত্যন্ত বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল, মিথিলা ছুটে এসে মানুষটার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে আনল আর ঠিক তখন রিভলবার থেকে একটা গুলি বের হয়ে আসে। ছোট ঘরটাতে প্রচণ্ড শব্দে সেটি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। মিথিলা মানুষটার হাত ধরে ঝুলে থাকে, কিছুতেই ছাড়ে না। মানিক ঝটকা মেরে মিথিলাকে সরানোর চেষ্টা করে, পারে না। তখন সে বাম হাত দিয়ে মিথিলার ঘাড়টা ধরে তাকে টেনে সরায়। তারপর মিথিলার বুকের কাছে ফ্রকটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “এই ছেমড়ি? তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে? এক ঘুষিতে আমি যদি তোর সবগুলো দাঁত না ফালাই তা হলে আমার নাম মাইনকার বাচ্চা মাইনকা না।”

আমি তখন আমার জীবনের সবচেয়ে বিচিত্র দৃশ্যটি দেখতে পেলাম। টুনি দুই হাত উপরে তুলে হিংস্র গলায় বলল, “এই যে মাইনকার বাচ্চা মাইনকা সাহেব, বাচ্চা মেয়েটারে ছাড়েন। আর যদি সাহস থাকে তা হলে আমার কাছে আসেন।”

মানিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, সে বিস্ফারিত চোখে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “কী বললি?”

টুনি কিছু না বলে এক আঙুল দিয়ে মানিককে নিজের দিকে ডাকে। মানুষ পথে-ঘাটে কুকুর কিংবা বিড়ালের বাচ্চাকে যেভাবে ডাকে, অনেকটা সে রকম। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম টুনির সারা শরীর ইস্পাতের তারের মতো টান টান হয়ে গেছে, সে তার দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে নাচের ভঙ্গি করে দুলতে থাকে।

মানিক এবারে মিথিলাকে ছেড়ে দেয় তারপর রিভলবারটা টুনির দিকে তাক করে এগিয়ে আসে। হঠাৎ করে মনে হল ঘরের মাঝে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমরা দেখলাম টুনি ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়, তার পা শূন্যে উড়ে যায়, আমরা কিছু বোঝার আগে দেখলাম টুনি তার পা দিয়ে মানিকের মুখের মাঝে প্রচণ্ড জোরে লাথি মেরে বসেছে। একজন মানুষের পা যে এত উপরে উঠতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে আমরা বিশ্বাস করতাম না। মানিক একটা আর্ত চিৎকার করে ঘুরে পড়ে যায়। সে এখনো বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। আমরা মানিকের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম তখন টুনি চিৎকার করে আমাদের থামাল, বলল, “তোরা সব যা।”

বিড়াল যেভাবে ইঁদুরের বাচ্চা ঘিরে ঘুরতে থাকে, টুনি এখন ঠিক সেভাবে মানিককে ঘিরে ঘুরতে থাকে। মানিক তার রিভলবারটা তুলে ধরে, আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি সে এখন গুলি করে বসবে কিন্তু তার আগেই টুনি বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমরা দেখতে পেলাম তার একটা লাথিতে হাত থেকে রিভলবারটা উড়ে গিয়ে নিচে পড়েছে। টিটন তখন ছুটে গিয়ে রিভলবারটা নিজের হাতে তুলে নিল।

টুনি নাচের ভঙ্গিতে মানিককে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে বলল, “মানিকের বাচ্চা মানিক সাহেব, দুই হাত পিছনে নিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ন তা না হলে আপনার দুটি দাঁত এক্ষুনি খুলে যাবে। আমি ফোর্থ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট। আমাকে দেখে মনে না হতে পারে কিন্তু খালি হাতে আমি আপনার মতো দুই-চারজনকে খুন করে ফেলতে পারি।”

মানিক টুনির কথা বিশ্বাস না করে দুর্বলভাবে ওঠার চেষ্টা করল, আর সাথে সাথে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো টুনি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আমি দেখলাম সাথে সাথে মানিক হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, আর ওঠার সাহস পেল না।

টিটন তখন রিভলবারটা তুলে পাহাড়ের মতো মানুষটার দিকে তাক করে ধরেছে, চিৎকার করে বলছে, “হ্যান্ডস আপ।”

পাহাড়ের মতো মানুষটার মুখ দেখে মনে হল সে এখনো পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস করছে না। সে অবাক হয়ে একবার টুনির দিকে আর একবার টিটনের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “কী বললি? হ্যাঁন্ডস আপ? এই বান্দরের বাচ্চা তুই হ্যাঁন্ডস আপ মানে জানিস?”

টিটন কোনো কথা না বলে রিভলবারটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। পাহাড়ের মতো মানুষটা তখন টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই নিজেকে কী ভাবিস? ফিল্ম স্টার? মাইনকা হচ্ছে মাজাভাঙা টিবি রোগী! তার সাথে মাইরপিট করে তোর সাহস বেড়েছে? আয় তা হলে আমার কাছে–তোর ফিলমি কায়দা আমার সাথে কর! তোর কলজে যদি আমি ছিঁড়ে না ফেলি তা হলে আমি বাপের ব্যাটা না।”

টিটন বলল, “হ্যান্ডস আপ। যদি আপনি হ্যাঁন্ডস আপ না করেন গুলি করে দিব।”

মানুষটা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “তুই গুলি কর! দেখি তোর গুলি আমার চামড়া ফুটা করতে পারে কি না। কর গুলি।”

টিটন গুলি করল না, শুধু চিৎকার করে বলল, “হ্যান্ডস আপ। না হলে গুলি করে দিব।”

মানুষটা হঠাৎ এগিয়ে এসে খপ করে টিটনের হাতটা ধরে রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে বলল, “এই ছেমড়া, তোর রিভলবারকে আমি ভয় পাই?” মানুষটা রিভলবারটাকে তার কোমরে গুঁজে বলল, “আমার সাথে রংবাজি? আমি সবগুলোকে এখন খুন করে ফেলব। খালি হাতে আমি তোদের মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলব।”

পাহাড়ের মতো মানুষটা টিটনের চুল ধরে তাকে হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে টেনে আনে, মনে হয় সত্যিই বুঝি টিটনের মাথাটা ছিঁড়ে ফেলবে। ঠিক তখন চঞ্চল বলল, “ভালো হবে না কিন্তু, ছেড়ে দেন, ছেড়ে দেন ওকে।”

মানুষটা চঞ্চলের গলার স্বর শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কে কথা বলে?”

চঞ্চল বলল, “আমি।”

মানুষটা বলল, “আমি তাই ভেবেছিলাম। তুই না হলে এতো বেশি কথা আর কে বলবে? তোরে না আমি না করেছি বেশি কথা না বলার জন্যে। আমার কথা কানে যায় না?”

চঞ্চল ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আপনি ওকে ছেড়ে দেন।”

পাহাড়ের মতো মানুষটা টিটনকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে ছেড়ে দিলাম। তোরে ধরলে তোর কোনো আপত্তি আছে?”

চঞ্চল বলল, “না, নাই।”

“ফড়িংয়ের বাচ্চা ফড়িং তোর সাহস তো কম না।” মানুষটা দাঁত কিড়মিড় করে চঞ্চলের দিকে এগিয়ে আসে। চঞ্চল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কাছে আসতেই সে খপ করে মানুষটাকে দুই হাতে তাকে ধরল সাথে সাথে আমরা দেখতে পেলাম মানুষটা বিকট আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল। তার দুই চোখে অবিশ্বাস, কী ঘটেছে সে কিছু বুঝতে পারছে না।

চঞ্চল দুই হাত সামনে বাড়িয়ে মানুষটার দিকে এগিয়ে যায় আর মানুষটা ভয়ে-আতঙ্কে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। চঞ্চল আবার দুই হাতে তাকে ধরে ফেলল, আর আমরা অবাক হয়ে দেখলাম এতো বড় মানুষটার সারা শরীর ঝাঁকুনি খেতে থাকে, মানুষটা থরথর করে কাঁপছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার চোখ উল্টে গেল, মুখ হাঁ হয়ে গেল, তখন চঞ্চল তাকে ছেড়ে দিল আর সে দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল, মনে হল বিশাল একটা কোলা ব্যাঙ বুঝি লাফ দিয়েছে।

চঞ্চল আবার এগিয়ে যায়, মানুষটার দুই চোখে তখন আতঙ্ক, সে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল, সিন্দুকটাতে তার পা লেগে যায় আর সে প্রচণ্ড শব্দ করে মেঝেতে আছড়ে পড়ে। টুনি চিৎকার করে বলল, “ধর! ধর এটাকে।”

আমরা সবাই তখন মানুষটাকে চেপে ধরলাম, সে যদি শুধু একটা ঝটকা দেয় তা হলে আমরা উড়ে যাব কিন্তু মানুষটা আর সাহস করল না, চঞ্চল ঠিক তার পিঠের উপর বসে বলল, “যদি আপনি একটু নড়াচড়া করেন তা হলে ইলেকট্রিক শক দিয়ে আমি আপনার বারোটা বাজিয়ে দিব। দেড় ভোল্টের ব্যাটারির জায়গায় আমি নয় ভোল্টের ব্যাটারি লাগিয়েছি, আপনার হার্টটাকে আমি থামিয়ে দিতে পারব।”

মানুষটা নড়াচড়া করল না। টুনি প্রথমে তার কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবারটা বের করে নিল। আমি ছুটে গিয়ে ব্যাগ থেকে নাইলনের দড়ি বের করলাম তারপর দুই হাত পেছনে এনে শক্ত করে বাঁধলাম। টুনি দেখল ঠিক করে বাঁধা হয়েছে কি না, তারপর বাড়তি দড়ি দিয়ে আমরা পা দুটি বেঁধে ফেললাম।

চঞ্চল বলল, “আমি যে জিনিসটা দিয়েছি সেইটার নাম ইনডাকশন কয়েল। আমার নিজের হাতে তৈরি করা। এর মাঝে আছে প্রাইমারি কয়েল আর সেকেন্ডারি কয়েল। প্রাইমারি কয়েলের জন্যে ব্যবহার করেছি সতেরো গেজের তার। দুই লেয়ার। সেকেন্ডারি কয়েল চল্লিশ গেজ। বিশ লেয়ার। শক দেওয়ার জন্যে কানেকশন দিতে হয়। সেই জন্যে আছে ভাইব্রেটর। শব্দ শুনছেন?

ইলেকট্রিক শক খেয়ে এই মানুষটা যতটুকু কাবু হয়েছিল চঞ্চলের বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শুনে তার থেকে বেশি কাবু হয়ে যন্ত্রণায় শব্দ করতে লাগল।

আমি বললাম, “ছেড়ে দে। অনেক হয়েছে।”

চঞ্চল বলল, “বিগ ব্যাং নিয়ে একটু বলি।”

“থাক। আর কষ্ট দিস না।”

চঞ্চল তখন পাহাড়ের মতো মানুষটাকে ছেড়ে দিল।

টুনি বলল, “এবারে চোখ দুটি বেঁধে ফেল।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

“এই মানুষটাকে বিশ্বাস নাই, চোখ বাঁধা থাকলে নড়াচড়া করার সাহস পাবে না।”

আমরা তখন তার চোখও বেঁধে ফেললাম।

ঘরের আর এক কোনায় মানিক উপুড় হয়ে পড়েছিল, আর নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে, কেমন যেন ঘিনঘিনে চেহারা, দেখে ঘেন্না লাগে। টুনি বলল, “এটাকে নিয়ে কোনো ভয় নাই, কিন্তু এটাকেও বেঁধে ফেলি।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে।” তারপর তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললাম। আমাদের কাজ আপাতত শেষ।

আমরা ঘরটার দিকে তাকালাম, “সিন্দুকের উপর বাচ্চা মেয়েটার কঙ্কাল নিঃশব্দে শুয়ে আছে। দেখে মনে হল মেয়েটি বুঝি পুরো দৃশ্যটি নিঃশব্দে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।

আমি বললাম, “আয় সবাই যাই।”

পাহাড়ের মতো মানুষটা বলল, “কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”

আমি বললাম, “তোমার কী মনে হয়?”

“প্লীজ পুলিশকে খবর দিও না। প্লীজ! প্লীজ!”

“সেটা দেখা যাবে। আপাতত তোমরা শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নাও।”

সিন্দুকের উপর তালার চাবিটা রাখা ছিল আমরা সেটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা বন্ধ করে বিশাল তালাটা ঘটাং করে লাগিয়ে দিলাম।

আমরা তখন প্রথমবার একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। আমি মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মিথিলা থ্যাংকু। তুই যদি লাফ দিয়ে মানিকের হাতটা না ধরতি তা হলে মনে হয় আমাকে গুলি করে মেরেই ফেলত!”

মিথিলা বলল, “কতো বড় সাহস! টুনি আপু উচিত শিক্ষা দিয়েছে। তাই না টুনি আপু?”

আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, আমি বললাম, “অসাধারণ ফাইট!”

চঞ্চল বলল, “তুই তো কখনো বলিসনি তুই ফোর্থ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট! কী সাংঘাতিক!”

“তোরা কি আমাকে বলার চান্স দিয়েছিস? সবসময় আমাকে সরিয়ে রেখেছিস। তোদের ধারণা শুধু তোরাই সবকিছু পারিস আমরা কিছু পারি না।”

অনু বলল, “আর সরিয়ে রাখব না। এখন থেকে আমরা সবাই ব্ল্যাক ড্রাগন।”

আমরা মাথা নাড়ালাম, বললাম, “হ্যাঁ। ব্ল্যাক ড্রাগন।”

মিথিলা বলল, “কিংবা কালা গুইসাপ।”

আমরা সবাই হি হি করে হাসলাম, কালা গুইসাপ কথাটিকেও এখন খুব খারাপ শোনাচ্ছে না।

চঞ্চল বলল, “একদিনের জন্যে অনেক অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে। চল যাই।”

আমি বললাম, “চল।”

আমরা সেই সুড়ঙ্গ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়িটার দিকে এগোতে থাকি। হঠাৎ করে টুনি থেমে গিয়ে বলল, “ওটা কীসের শব্দ?”

আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম এবং শুনতে পেলাম সত্যিই দুম দুম করে একটা চাপা শব্দ হচ্ছে।

অনু বলল, “এখানে এতো ধুলা কেন?”

আমরা অবাক হয়ে দেখলাম সত্যিই সুড়ঙ্গের মাঝে ধুলা উড়ছে। হঠাৎ করে আমার একটা জিনিস মনে হল, সাথে সাথে ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল, আমি বললাম, “সর্বনাশ!”

“কী হয়েছে?”

“মনে নাই তোদের বলেছিলাম মিশকাত মঞ্জিল ভেঙে ফেলবে?”

“হ্যাঁ।”

“মনে হয় ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করেছে।”

চঞ্চল বলল, “আমাদের তাড়াতাড়ি বের হতে হবে।”

“হ্যাঁ। খুব তাড়াতাড়ি।”

আমরা ছুটতে ছুটতে সিঁড়ির কাছে এসে হতবাক হয়ে যাই। পুরো সিঁড়িটা ভাঙা ইট-সিমেন্ট-সুড়কি দিয়ে বোঝাই। উপর থেকে দালানটা ভাঙতে শুরু করেছে আর আমাদের বের হওয়ার রাস্তাটা বুজে গেছে। এখান থেকে এখন বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।

আমরা অনেক উপরে চাপা দুম দুম শব্দ শুনতে পেলাম। অনেক মানুষ মিলে পুরো বিল্ডিংটা ভেঙে ফেলছে আর আমরা তার ভিতরে আটকা পড়ে গেছি।

মিথিলা চিৎকার করে বলল, “বন্ধ কর! বন্ধ কর!” কেউ তার কথা শুনল না, কেউ কিছু বন্ধ করল না।

তারপর আমরা সবাই মিলে চিৎকার করলাম, আমাদের চিৎকার সুড়ঙ্গের মাঝে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল কিন্তু বাইরের কেউ শুনতে পেল না। তারা দুম দুম শব্দ করে ভাঙতেই থাকল।

আমি দেখলাম মিথিলার চোখে-মুখে ভয়াবহ আতঙ্ক। আমার নিজের জন্যে না–মিথিলার জন্যে হঠাৎ মায়া হতে থাকে।

টুনি ফিসফিস করে বলল, “আমরা খুব বড় বিপদে পড়ে গেছি।”

কেউ কোনো কথা বলল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *