দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন : 07
সকালবেলা আমরা পেয়ারা গাছের নিচে আমি টিটন আর চঞ্চল একত্র হয়েছি। অনু এখনো আসেনি সে সবসময়ই দেরি করে আসে। মোটাসোটা মানুষেরা মনে হয় সবকিছুই আস্তে ধীরে করে। অনু পৌঁছলেই রওনা দিয়ে দেব, তার জন্যে অপেক্ষা করছি। এতো সকালে কোথায় যাই সেটা নিয়ে আমাদের বাসায় কেউ তেমন কিছু বলেনি। আগেও এরকম অনেকবার হয়েছে–বাসার সবাই মেনে নিয়েছে যে আমরা মাঝে মাঝে এরকম ছোটখাট পাগলামি করি। আমাদের বাসায় শুধু মিথিলা খুব ভোরে উঠে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া, কই যাও?”
আমি আমার অভ্যাস মতো খেঁকিয়ে উঠলাম, “সেটা তোর জানার দরকার কী?”
ভেবেছিলাম আমার ধমক খেয়ে মিথিলা নাকি সুরে আম্মুকে নালিশ করে দেবে, আম্মু দেখো, ভাইয়া আঁমাকে বাঁকা দিচ্ছে কিন্তু কী কারণ কে জানে, সে নালিশ করল না। শুধু যে নালিশ করল না তা না–মনে হল একটু মিচকি হাসি দিল! কেন নালিশ না করে মিচকি হাসি দিল আমি এখন আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না।
অনু কেন এতো দেরি করে আসছে আমরা যখন সেটা নিয়ে তাকে বকাবকি করছি তখন দেখলাম সে হেলতে দুলতে আসছে। পিঠে বিশাল ব্যাকপেক। হাতে একটা খাঁচা সেখানে সাদা রঙের একটা কবুতর। আমরা গরম হয়ে বললাম, “এতো দেরি করে এসেছিস কেন?”
অনু আরো গরম হয়ে বলল, “সকালবেলা খাঁচার ভিতর একটা কবুতর হাতে নিয়ে রওনা হয়ে দেখ সকাল সকাল আসতে পারিস কি না। হেন-ত্যাননা একশটা প্রশ্ন।”
“তুই কী বলেছিস?”
“বলেছি আমরা কবুতরের পায়ে লাগিয়ে চিঠি পাঠানো যায় কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।”
চঞ্চল বলল, “ভেরি গুড। খুবই ভালো উত্তর দিয়েছিস।”
টিটন বলল, “অনুর মতো বানিয়ে বানিয়ে আর কেউ বলতে পারে না। মনে নাই, সেই দিন ব্যাঙের ছাতার গল্পটা বলেছিল?”
আমি বললাম, “বড় হয়ে লেখক হবে তো, সেই জন্যে এখন থেকেই গুলপট্টি মারা প্র্যাকটিস করছে।”
চঞ্চল বলল, “আয় রওনা দেই।”
“চল।” আমরা রওনা দিলাম।
আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে, মিশকাত মঞ্জিলে গিয়ে যদি দেখি ফুটকি জিব মানিক আর তার ওস্তাদ মিঃ পাহাড় ঘোরাঘুরি করছে, তা হলে একটা মহা ঝামেলা হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের কপাল ভালো এতো সকালে সেখানে কেউ নাই, শুধু পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে। আমরা তাড়াতাড়ি গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় আমাদের ঘরটাতে ঢুকে গেলাম। আমরা ব্যাকপেকগুলো পিঠ থেকে খুলে নিচে রেখে দিই, টিটন আগাছার মাঝে লুকিয়ে রাখা শাবলটা বের করে আনল।
আমি বললাম, “মনে আছে ঐ দিন একটা বেজি বের হয়েছিল? ভিতরে বেজি থাকে মনে হয়।”
চঞ্চল বলল, “হ্যাঁ।”
“আজকেও যদি ভেতরে থাকে?”
“যদি একটু শব্দ করি তা হলেই পালিয়ে যাবে।”
আমরা শাবল দিয়ে দেয়ালে এখানে সেখানে ঘা দিলাম তখন সত্যি সত্যি প্রথমে একটা বড় বেজি তারপর দুইটা ছোট বেজি গর্ত দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে গেল। অনু বলল, “বেজি পরিবার সুখী পরিবার।”
চঞ্চল বলল, “আহা বেচারা, আমরা তাদের বাড়িটা নষ্ট করে ফেলব। এখন আর সুখী পরিবার থাকবে না।”
আমি বললাম, “এখানে অনেক জায়গা আছে, বেজি পরিবার থাকার জন্যে অনেক জায়গা পেয়ে যাবে।”
টিটন জিজ্ঞেস করল, “আমরা কোথায় গর্তটা করব?”
চঞ্চল বলল, “যেখানে ছোট গর্তটা আছে সেখান দিয়েই শুরু করি।”
টিটন তখন শাবলটা দিয়ে সেখানে জোরে একটা ঘা দিল, সাথে সাথে একটা ইট খুলে এলো। তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। দেখতে দেখতে একজন মানুষের ঢোকার মতো একটা গর্ত হয়ে গেল। চঞ্চল হাত তুলে বলল, “এখন থাম।”
অনু ইতস্তত করে বলল, “গর্তটা আরেকটু বড় কর।”
আমাদের মনে পড়ল অনু আমাদের তুলনায় বেশ নাদুস-নুদুস-আমরা ঢুকে যেতে পারলেও সে আটকে যাবে। টিটন তখন দুই পাশ থেকে আরো দুটি ইট খুলে ফেলল।
চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কে আগে ঢুকবি?” টিটন বলল, “আমি। আমার কাছে তাবিজ আছে, আমার কোনো ভয় নাই।”
আমি অনু আর চঞ্চল একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, টিটন যদি তার তাবিজের রহস্যটা জানত তা হলে সে কী করত কে জানে!
চঞ্চল বলল, “ঠিক আছে, তুই আগে ঢোক। তোর ব্যাগটা বাইরে থাকুক। টর্চ লাইটটা নিয়ে যা, ভেতরে গিয়ে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে চারদিক দেখে আমাদের জানা। যদি অস্বাভাবিক কিছু দেখিস তা হলে বের হয়ে আসবি।”
টিটন বলল, ঠিক আছে। তারপর তার হাতে বাঁধা তাবিজটা একবার চুমু দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী অবস্থা? ভিতরে কিছু আছে?”
টিটন বলল, “মাকড়শার জাল। আর বোঁটকা গন্ধ।”
“আর কিছু?”
“মাটিতে গাছ পাতা, মনে হয় এটা বেজির বাসা।”
“আর কিছু?”
“দুইটা বাদুর উড়ছে।”
চঞ্চল বলল, সাবধান, “বাদুর যেন না কামড়ায়। বাদুরের মাঝে র্যাবিজ ভাইরাস থাকে।”
“আমাকে কামড়াবে না। আমার তাবিজ আছে।”
“বাদুর তো জানে না, তোর তাবিজ আছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলামম, ”ভিতরে আর কী আছে?”
“সামনে একটা ঘোরানো সিঁড়ি। নিচে নেমে গেছে।”
চঞ্চল বলল, “গুড। আগে তোর ব্যাগটা ভিতরে ঢুকিয়ে দিই। নে ধর।”
আমরা ঠেলে টিটনের ব্যাগটা ঢুকিয়ে দিলাম।
আমি বললাম, “এবারে আমি ঢুকি?”
“ঠিক আছে।”
আমি প্রথমে আমার ব্যাগটা ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে নিজে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলাম। টিটন ঠিকই বলেছে ভেতরে একটা বোটকা গন্ধ। কীসের গন্ধ কে জানে। আমি টর্চ লাইট জ্বালিয়ে একটু এগিয়ে সিঁড়িটার দিকে তাকালাম। একটা লোহার সিঁড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচে অন্ধকার, কী আছে দেখা যায় না।
আমি আর টিটন যখন টর্চ লাইট জ্বালিয়ে নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়িটার দিকে তাকালাম-একটা লোহার সিঁড়ি পেঁচিয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচে অন্ধকার, কী আছে দেখা যায় না।
আমি আর টিটন যখন টর্চ লাইট জ্বালিয়ে নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়িটা দেখছি তখন ছোট গর্তটা দিয়ে প্রথমে কবুতর আর দুটি ব্যাগ ঢুকিয়ে দিল তারপর অনু আর চঞ্চলও ঢুকে গেল। আমরা চারজন এখন গাদাগাদি করে ছোট একটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সবার হাতেই একটা করে টর্চ লাইট, ছোট ঘরটাকে সেটা বেশ ভালোভাবে আলোকিত করে রেখেছে। বাদুরগুলো আলোর কারণে খুবই ঝামেলায় পড়েছে মনে হয়, খানিকক্ষণ উড়ে শেষে গর্ত দিয়ে বের হয়ে গেল।
চঞ্চল এবার তার কাজ শুরু করে দেয়। প্রথমে চিকন নাইলনের একটা দড়ি দিয়ে কবুতরের খাঁচাটাকে বাঁধল। তারপর সেই খাঁচাটা আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে দিতে থাকে। মাঝামাঝি যাবার পর হঠাৎ সেটা ডানা ঝাঁপটে ওঠে, আমরা সবাই চমকে উঠলাম। টিটন জিজ্ঞেস করল, “মরে গেছে না কি?”
আমি বললাম, “না।”
চঞ্চল আবার কবুতরটা নিচে নামাতে থাকে। সেটা আবার এক-দুইবার ডানা ঝাঁপটে উঠল, একবার মনে হয় ভয় পেয়ে একটু ডেকেও উঠল। কবুতরটা যখন একেবারে নিচে নামানো হল আমরা দেখলাম সেটা খাঁচার ভেতরে হাঁটাহাঁটি করছে। তার মানে এখানে বিষাক্ত কোনো গ্যাস নেই।
চঞ্চল বলল, “এবারে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে খুব আস্তে আস্তে নামাতে থাকি। যদি মিথেন গ্যাস থাকে তা হলে আগুন ধরে যাবে। তা হলে আমরা নিচে নামব না।”
আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিক আছে।”
আমরা একটা বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে তার মাঝখানে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিচে নামাতে শুরু করলাম। আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম, হঠাৎ যদি ভক করে আগুন ধরে একটা বিস্ফোরণ হয় তা হলে আমরা কী করব? ঐ ছোট গর্ত দিয়ে হাচড়-পাঁচড় করে বের হতে পারব?
কিন্তু কোনো বিস্ফোরণ হল না, মোমবাতিটা বেশ ভালোভাবেই জ্বলতে লাগল। চঞ্চল তখন সন্তুষ্টির ভান করে বলল, “ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নাই।”
আমি বললাম, “চল নামি।”
“চল।”
“কে আগে?”
টিটন বলল, “আমি।” তাবিজের কারণে এখন তার অনেক সাহস, অনেক মজা।
আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। প্রথমে টিটন তারপর চঞ্চল তারপর অনু সবার শেষে আমি। লোহায় মরচে ধরা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সেটা অল্প অল্প দুলতে থাকে, হঠাৎ করে সেটা ভেঙে পড়বে কী না সেটা নিয়ে আমার একটু দুশ্চিন্তা লাগতে থাকে। সাবধানে আস্তে আস্তে পা ফেলে আমরা যখন মাঝামাঝি এসেছি তখন আমার হঠাৎ মনে হল আমি যেন একটা শব্দ শুনতে পেলাম। মনের ভুল মনে করে আরো দুই পা নামার পর আমি আবার সেই শব্দটা শুনলাম, হাততালি দেবার মতো শব্দ। আমি চাপা গলায় বললাম, “চুপ! সবাই চুপ!”
আমার গলার স্বরে নিশ্চয়ই কিছু একটা ছিল–একসাথে সবাই চুপ করে গেল। চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কী?”
আমি কাঁপা গলায় বললাম, “একটা শব্দ।” আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথে সেই হাততালি দেওয়ার মতো শব্দটা আবার শোনা গেল। আমরা সবাই তখন একসাথে চমকে উঠি।
চঞ্চল বলল, “সবাই টর্চ লাইট নিভিয়ে ফেল।”
কেন টর্চ লাইট নিভাতে হবে আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু সবাই নিভিয়ে ফেললাম। সাথে সাথে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে পুরোটুকু ঢেকে গেল।
আবার হাততালির শব্দ শুনতে পেলাম তার সাথে মেয়ে কণ্ঠে একটু কান্নার শব্দ। টিটন কাঁপা গলায় বলল, “ইয়া মাবুদ।”
আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকি তখন আবার কান্নার শব্দটা শুনতে পেলাম। আমাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। আমার মনে হতে লাগল এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে প্যাঁচানো একটা লোহার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা আমরা চারজন ছাড়া আশে পাশে আরো কেউ আছে। আমরা তার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
হঠাৎ করে কে যেন খিলখিল করে হেসে উঠল, আর আমরা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। আমরা স্পষ্ট শুনতে পেলাম খিলখিল করে হাসতে হাসতে কিছু একটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, হঠাৎ করে লোহার সিঁড়িটা ঝনঝন শব্দ করে কাঁপতে থাকে। আমি ভয়ে চিৎকার করে আমার টর্চ লাইটটা জ্বালালাম এবং সাথে সাথে ভয়ংকর আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর জমে গেল।
বীভৎস কুৎসিত একটা মুখ লোহার সিঁড়িটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় চোখ, লাল ঠোঁটের ফাঁকে কালো জিব, লম্বা লম্বা দাঁত, মাথায় শনের মতো চুল। ভয়ংকর জীবটি খিলখিল করে হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগোতে থাকে। আমি আতঙ্কে চিৎকার করে অনুর গায়ের ওপর দিয়েই নিচে নামার চেষ্টা করতে থাকি। টিটন আর চঞ্চলও সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাবার চেষ্টা করে, ভয়াবহ আতঙ্কে একটা ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়।
ঠিক তখন উপর থেকে খিলখিল করে হেসে একজন পরিষ্কার গলায় বলল, “কী হল? তোরা এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?”
আমরা উপরে তাকালাম। টুনি উপরে দাঁড়িয়ে আছে, একটু আগে যে ভয়ংকর বীভৎস মুখটি দেখেছিলাম সেটা আসলে একটা মুখোশ, টুনি সেই মুখোশটা খুলে হাতে ধরে রেখেছে। শুধু টুনি নয় আমরা দেখলাম টুনির পিছনে মিথিলাও আছে। পাজী মেয়েটা মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসছে।
টুনির ওপর প্রচণ্ড রাগে আমাদের ফেটে পড়ার কথা ছিল কিন্তু আমরা কেউই রেগে উঠলাম না। এই ভয়ংকর আতঙ্কটা আসলে সত্যি নয় সেই জন্যেই আমরা সবাই টুনিকে মনে মনে মাফ করে দিয়েছি। কিন্তু সেটা তো আর বাইরে প্রকাশ করতে পারি না, তাই খুব রেগে যাবার ভান করে আমি বললাম, “এটা কী রকম ঠাট্টা?”
টুনি বলল, “আই অ্যাম সরি। এই দেখ আমি কান ধরছি-” সত্যি সত্যি সে নিজের কান ধরল তারপর মিথিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুইও ধর।” তখন মিথিলাও কান ধরল, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আর কখনো এরকম করব না! মোটেও বুঝতে পারিনি তোরা এত ভয় পাবি।”
টিটন বলল, “ভয় পাবার কী আছে? আমার কাছে তাবিজ আছে না? হঠাৎ দেখে শুধু একটু চমকে উঠেছিলাম।” পরিষ্কার মিথ্যা কথা, আমরা সবাই যা ভয় পেয়েছিলাম সেটা আর বলার মতো না। এখনো আমাদের সবার বুক ধুকধুক করছে।
টুনি বলল, “ভয় না পেলে ভালো। খুবই ভালো।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোরা এখানে এলি কেমন করে? কেমন করে বুঝতে পারলি আমরা এখানে?”
“আমরা হচ্ছি ব্ল্যাক ড্রাগন। আমরা সবকিছু পারি।”
“ফাজলেমি করবি না। সত্যি করে বল।”
টুনি খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, “খুবই সোজা! তোর ব্যাগে দেখ একটা মোবাইল টেলিফোন আছে। সকালবেলা যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিলি তখন মোবাইলটা আমার টেলিফোনে ডায়াল করে কানেকশন নিয়ে তারপর রেখে দেওয়া হয়েছে। সেই কাজে সাহায্য করেছে কমরেড মিথিলা। তারপর আমরা ঘরে বসে তোদর সব কথা শুনেছি। পানির মতো সোজা।”
টুনির বুদ্ধি দেখে আমি বেকুব হয়ে গেলাম। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। আমি বললাম, “তুই এসেছিস তো এসে গেছিস। সাথে ওই মিথিলাকে নিয়ে এসেছিস কেন? এখন এইখানে ভয় পাবে, কান্নাকাটি করবে।”
মিথিলা বলল, “কখনো ভয় পাব না। কান্নাকাটি করব না। তোমরা ভয় পেয়েছ?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ ভয় পেয়েছি। এরকম জায়গায় পড়লে যে কেউ ভয় পাবে।”
চঞ্চল বলল, “ব্যস! অনেক হয়েছে। চল আমরা নিচে নামতে শুরু করি।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে। তোমাদের দলে আমরা দুজনও আছি। কালা গুইসাপের সাথে ব্ল্যাক ড্রাগন!”
আমরা এখন আর সেটা নিয়ে নতুন করে ঝগড়া শুরু করলাম না। টুনি বলল, “তোরা চিন্তা করিস না। আমরা আমাদের ব্যাগে করে অনেক ভালো ভালো খাবার এনেছি।”
অনু জিজ্ঞেস করল, “কী খাবার?”
“কোল্ড ড্রিংকস, স্যান্ড উইচ, চিপস, চকলেট, আপেল।”
অনু হাতে কিল দিয়ে বলল, “ভেরি গুড।”
আমাদের ভয় দেখানোর জন্যে টুনির উপর যেটুকু রাগ ছিল খাবারের কথা শুনে সেই রাগটুকুও উবে গেল।
আমরা আবার নিচে নামতে শুরু করি। টুনি বলল, “তোদের কবুতর দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস আছে কী নেই সেটা দেখার বুদ্ধিটা একেবারে ফাটাফাটি।”
আমি বললাম, “আমাদের সব বুদ্ধিই ফাটাফাটি। সাথে থাক তা হলেই দেখবি।”
“আমরা তো সাথে থাকতেই চাই, তোরাই না হিংসুটের মতো আমাদের দলে নিতে চাস না।”
কথাটা সত্যি, তাই আমি আর কিছু বললাম না।
টিটন প্রথমে নিচে নামল, তারপর টর্চ লাইট দিয়ে চারদিক দেখে বলল, “খুবই আজব জায়গা।”
আমরাও যখন নিচে নেমে এসেছি তখন বুঝতে পারলাম আজব জায়গা বলতে সে কী বোঝাচ্ছে। আমাদের ধারণা ছিল আমরা বুঝি নিচে নেমে একটা হলঘরের মতো জায়গা পাব। কিন্তু আসলে নিচে কোনো ঘর নেই, নিচে একটা সুড়ঙ্গের মতো। সিঁড়ির নিচ থেকে সুড়ঙ্গটা শুরু হয়ে সেটা এদিক-সেদিক চলে গেছে। দেখে মনে হয় একটা গোলকধাঁধা।
চঞ্চল বলল, “আগেই কেউ রওনা দিস না। সত্যি যদি এটা গোলকধাঁধা হয় তা হলে একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসতে পারব না।”
টুনি বলল, “আমাদের কাছে দুইটা মোবাইল টেলিফোন আছে।”
চঞ্চল মাথা নেড়ে বলল, “মাটির তলায় নেটওয়ার্ক থাকার কথা না। তবু চেষ্টা করে দেখ।”
আমার ব্যাকপেকে লুকিয়ে রাখা মোবাইল ফোন আর টুনির মোবাইল ফোনটা বের করে পরীক্ষা করা হল, দেখা গেল চঞ্চলের অনুমান সত্যি। আসলেই নেটওয়ার্ক নেই।
টিটন জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কী করব?”
“এই সিঁড়িটার সাথে দড়িটা বেঁধে দড়ি ধরে ধরে এগিয়ে যাই, তা হলে যদি হারিয়েও যাই, দড়ি ধরে ধরে আবার ফিরে আসতে পারব।”
টুনি বলল, “গুড আইডিয়া।”
আমি বললাম, “এইখানে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে যাই তা হলে আলোটা দেখেও আসতে পারব।”
চঞ্চল বলল, “ঠিক বলেছিস।”
কাজেই লোহার সিঁড়িটাতে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে আমরা দড়ি ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে যাই। সরু একটা সুড়ঙ্গ একজন মানুষ কষ্ট করে যেতে পারে। মাথা নিচু করে যেতে হয়, মাঝে মাঝে উপরে মাথা লেগে যায়। সুড়ঙ্গের দেয়ালটা ইট এবং পাথরের, কষ্ট করে এটা তৈরি করা হয়েছে। মাঝে মাঝে চুন দিয়ে আঁকি-ঝুঁকি করা, রহস্যময় একটা পরিবেশ।
সুড়ঙ্গের মাঝে ঠাণ্ডা। বিচিত্র শ্যাওলার মতো একটা গন্ধ। আমরা নিঃশব্দে একজনের পিছনে আরেকজন হেঁটে যেতে থাকি। সুড়ঙ্গটা আসলেই গোলকধাঁধা, সোজা যেতে যেতে হঠাৎ দেখা যায় ডান ও বাম দিকে দুটো সুড়ঙ্গ। ডান দিকে কিছু দূর গেলে আবার সেটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ দিয়ে কিছু দূর গেলে দেখা যায় সেটা আবার কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তার কোনো একটা দিয়ে গেলে দেখা যায় আমরা হঠাৎ করে আগের জায়গায় ফিরে এসেছি। ভারী বিচিত্র একটা ব্যাপার। এটা কে তৈরি করেছিল, কেন তৈরি করেছিল কিংবা কীভাবে তৈরি করেছিল কে জানে!
সুড়ঙ্গ ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা যখন ধরেই নিয়েছি এখানে এই সুড়ঙ্গ ছাড়া আর কিছু নেই তখন হঠাৎ করে আমরা একটা খাড়া দেয়ালের সামনে হাজির হলাম। সেখানে একটা কাঠের দরজা। সেই দরজায় বিশাল একটা তালা ঝুলছে।
আমরা সবাই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, তালাটা দেখে একটু অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকালাম। তালাটা ধরে একটু টানাটানি করে আমরা হাল ছেড়ে দিই। এতো বড় তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকার কোনো উপায় নেই। কাঠের দরজাটাও একেবারে পাথরের মতো শক্ত। কতোদিন থেকে এটা এখানে আছে কিন্তু কিছু হয়নি। মনে হয় আরো শক্ত হয়েছে।
চঞ্চল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চাবি ছাড়া এই তালা খুলে ভিতরে ঢোকা যাবে না।”
মিথিলা তখন পিছন থেকে বলল, “এই যে চাবি।”
আমরা চমকে উঠে বললাম, “চাবি?”
“হ্যাঁ।” মিথিলা এগিয়ে এসে আমাদের দিকে দুইটা চাবি এগিয়ে দেয়, একটা একটু বড়, আরেকটা ছোট। আমি অবাক হয়ে বললাম, “চাবি কোথায় পেলি?”
“সুড়ঙ্গের মাঝখানে এক জায়গায় দেয়ালে ঝোলানো ছিল আমি খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছিলাম।”
টুনি মিথিলার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, “ভেরি গুড, কমরেড মিথিলা।”
আমরাও মাথা নাড়লাম, বললাম, “ফ্যান্টাস্টিক।” মিথিলা যে নাকি সুরে আম্মুকে নালিশ করা ছাড়াও অন্য কাজ করতে পারে এই প্রথম আমি তার একটা প্রমাণ পেলাম।
টিটন চাবি দুইটা নিয়ে তালার ভিতরে ঢোকায়। একটা বেশি ছোট অন্যটা ভিতরে ঠিকভাবে ঢুকে গেল। বহু বছর ব্যবহার না করার কারণে তালাটা প্রথমে খুলতে চাইল না। চঞ্চল তখন তার ব্যাকপেক খুলে সেখান থেকে একটা শিশি বের করে সেটা থেকে খানিকটা তেল তালাটার ভিতরে ঢেলে দেয় তারপর কয়েকবার তালাটা নাড়াচাড়া করে চাবিটা ভিতরে ঢুকিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করতেই সেটা ঘটাং করে খুলে গেল। বিশাল তালাটা দরজার কড়া থেকে খুলে নিচে রেখে আমরা দরজাটা ধাক্কা দিলাম, তখন কাঁচ কাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে যায়।
আমরা টর্চ লাইট দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম। ভেতরে বেশ বড় একটা ঘর। এর ছাদটাও বেশ উঁচু। ঘরটার দেয়ালটা নকশি কাটা। আমরা সামনের দিকে তাকালাম এবং হঠাৎ করে মনে হল আমরা সবাই পাথরের মতো জমে গেছি।
ঘরের মাঝখানে একটা বড় সিন্দুক। সিন্দুকের উপরে একটা কঙ্কাল। কঙ্কালটা ছোট, দেখে বোঝা যায় কম বয়সী কোনো বাচ্চার। শরীরের কাপড়টা এতো দিনে ক্ষয়ে গেছে, তবু বোঝা যায় এক সময়ে বাচ্চাটাকে লাল কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখা ছিল। কঙ্কালটার ছোট ছোট হাতে সোনার চুড়ি। পায়ে সোনার নূপুর। মাথায় সোনার একটা টিকলি। নাকের নাকফুল আর কানের দুলগুলো খুলে পড়ে আছে।
দৃশ্যটি এতো ভয়ানক যে আমরা চিৎকার করতে পর্যন্ত ভুলে গেলাম। শুধু মিথিলা আতঙ্কে একটা চাপা শব্দ করে টুনিকে জড়িয়ে ধরল। টুনি মিথিলাকে ধরে ফিসফিস করে বলল, “ভয় নাই। কোনো ভয় নাই মিথিলা।”
অনু আস্তে আস্তে বলল, “যক্ষ–”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বললি?”
“এই সিন্দুকে নিশ্চয়ই অনেক ধন-রত্ন আছে। এই ধন-রত্ন পাহারা দেবার জন্যে এই বাচ্চাটাকে খুন করে রেখে গেছে। সে যক্ষ হয়ে ধন-রত্ন পাহারা দিচ্ছে।”
মিথিলা ভয়ে ভয়ে বলল, “সত্যি?”
“রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে এরকম একটা গল্প আছে, সম্পত্তি-সমর্পণ। যক্ষ হয়ে ধন-রত্ন পাহারা দেয়।”
মিথিলা ভয়ে ভয়ে বলল, “এখন যদি কেউ এই ধন-রত্ন ধরে তা হলে কী হবে?”
“যক্ষ কাউকে ধরতে দিবে না। কেউ ধরলে যক্ষ তাকে মেরে ফেলবে।”
মিথিলা বলল, “চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই।”
আমরা সিন্দুকটি ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিথিলার মতো আমাদেরও মনে হচ্ছে এখান থেকে আমরা চলে যাই। সিন্দুকের উপর ছোট একটা বাচ্চার কঙ্কাল–এই দৃশ্যটি এতো ভয়ানক যে সেটার দিকে তাকানো যায় না। সবচেয়ে ভয়ানক তার হাতের ছোট ছোট সোনার চুড়ি। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় এই ছোট মেয়েটা বুঝি এক্ষুনি তার সোনার চুড়িগুলো নাড়িয়ে উঠে বসে আমাদের দিকে তাকাবে, বলবে, তোমরা এতোদিন পরে এসেছ? যখন এখানে আমাকে খুন করে সিন্দুকের উপর শুইয়ে রেখেছিল তখন কেউ আসতে পারলে না? আমাকে বাঁচাতে পারলে না?
চঞ্চল আস্তে আস্তে বলল, “আমাদের কাছে সিন্দুকটার চাবি আছে। ইচ্ছে করলে আমরা সিন্দুকটা খুলে দেখতে পারি ভিতরে কী আছে।”
মিথিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “না। দেখতে চাই না।”
আমরাও মাথা নাড়লাম, বললাম, “থাকুক। আমরা বাইরে গিয়ে বড় মানুষদের বলি, তারা এসে এটা খুলুক।”
চঞ্চল হাসার চেষ্টা করে বলল, “তোরা যক্ষের ভয় পাচ্ছিস?”
”না, ঠিক তা না। কিন্তু–” আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।
টুনি বলল, “আসলে ছোট একটা বাচ্চার কঙ্কাল দেখে খুব খারাপ লাগছে। সিন্দুকটা খুলতে হলে কঙ্কালটাকে সরাতে হবে। আমাদের কারো সেটা করতে ইচ্ছে করবে না।”
অনু মাথা নাড়ল, বলল, “টুনি ঠিকই বলেছে।”
চঞ্চল বলল, “ঠিক আছে। তা হলে ক্যামেরাটা দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে আমরা যাই।”
চঞ্চল ক্যামেরা বের করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল, তারপর সেটা ব্যাগের ভিতরে রেখে বলল, “চল যাই।”
আমি বললাম, “চল।”
ঠিক তখন কাঁচ কাঁচ করে দরজাটা খুলে গেল, ভারী গলায় একজন বলল, “আগেই চলে যেও না। দাঁড়াও।”
আমরা চমকে উঠে সামনের দিকে তাকালাম, দরজায় মানিক আর তার পাহাড়ের মতো ওস্তাদ দাঁড়িয়ে আছে। মানিকের হাতে একটা ছোট রিভলবার, সেটা আমাদের দিকে তাক করে রেখেছে। ওস্তাদের হাতে একটা শাবল, আমরা যেটা উপরে রেখে এসেছিলাম। ভারী শাবলটা সে এমনভাবে ধরেছে যেন এটা একটা পাঠকাঠি!