দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন : 06
পরদিন খুব সকালবেলা পেয়ারা গাছের উপরে আমাদের একটা জরুরি সভা বসেছে। সবাই হাজির হওয়ার পর আমি গম্ভীর গলায় বললাম, “আব্বু বলেছেন মিশকাত মঞ্জিল নিয়ে মামলা চলছিল, এখন কোর্টের রায় হয়েছে।”
চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কোর্টের রায় হলে কী হয়?”
“যারা মামলায় জিতেছে তারা এসে এখন মিশকাত মঞ্জিল ভেঙে ফেলবে। সেখানে মার্কেট বানাবে।”
অনু বলল, “মার্কেট? ছিঃ!”
চঞ্চল বলল, “মার্কেট বানালে আমাদের কী?”
“আমাদের কিছু না। কিন্তু মিশকাত মঞ্জিলটা ভেঙে ফেললে আমরা তো আর তার ভিতরে ঢুকতে পারব না! তাই আমাদের আগেই সেখানে ঢুকতে হবে।”
টিটন হাত নেড়ে বলল, “ইয়েস! তাবিজ লাগানোর পর আর আমার ভয় করছে না। চল আমরা এখনই যাই।”
চঞ্চল বলল, “যাওয়ার আগে আমাদের দেখতে হবে লিস্টের সবকিছু আছে কী না।”
আমি বললাম, “কালকে সবাইকে আমি লিস্ট দিয়েছি। সবাই কি তোদের লিস্টের জিনিসগুলো জোগাড় করেছিস?”
অনু মাথা চুলকে বলল, “আমার লিস্টটা খুবই কঠিন। এখনো সবকিছু জোগাড় হয়নি।”
“কী কী জোগাড় হয়নি?”
“যেমন মনে কর কবুতর—”
টিটন বলল, “আমরা কবুতর দিয়ে কী করব?”
চঞ্চল বলল, “বিজ্ঞানী হতে হলে প্রথমেই কী শিখতে হয় বল।”
টিটন বলল, “অঙ্ক মুখস্থ করা।”
চঞ্চল বলল, “না। প্রথমে শিখতে হয় সেফটি। যেন কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়। কেউ ব্যথা না পায়। ইলেকট্রিক শক না খায়। গ্যাস দিয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়।“
“মিথ্যা কথা বলবি না।” টিটন গর্জন করে বলল, “আমাকে তুই কাল ইলেকট্রিক শক দিয়েছিলি। আমি অনেক ব্যথা পেয়েছিলাম।”
“সেটা দিয়েছিলাম মজা করার জন্যে।”
“মজা করলে কি মানুষ ব্যথা পায় না?”
অনু বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে! যেটা জিজ্ঞেস করেছিস তার উত্তর আগে শুনি। কবুতর কেন?”
হলে আমি মাথা নাড়ল, বলল বুঝব অক্সিজেন আহত জ্বালিয়ে নামিয়ে রে
চঞ্চল বলল, “মিশকাত মঞ্জিলের গোপন কুঠুরির ভিতরে আমরা কী দেখেছিলাম মনে আছে? একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।”
আমরা মাথা নাড়লাম, “হ্যাঁ।”
“আমাদের সেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। তার মানে বুঝতে পেরেছিস?”
“কী?”
“নিচে বছরের পর বছর কেউ যায় নাই। হয়তো সেখানে বিষাক্ত গ্যাস জমা হয়ে আছে। আমরা নামতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব। সেই জন্যে যদি খাঁচায় ভরে একটি কবুতর সেখানে নামিয়ে দিয়ে দেখি সেটা মারা যাচ্ছে না তা হলে বুঝতে পারব সেখানে বিষাক্ত গ্যাস নাই।”
আমরা চঞ্চলের বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমি একটু চিন্তা করে বললাম, “কিন্তু কবুতর না পাঠিয়ে যদি একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নামিয়ে দেই, সেটা যদি জ্বলতে থাকে তা হলে বুঝব অক্সিজেন আছে, নিশ্বাস নিতে পারব।”
চঞ্চল মাথা নাড়ল, বলল, “না। অনেক সময় মিথেন গ্যাস জমা হয়। তা হলে আগুন জ্বালালেই ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়ে সারা মিশকাত মঞ্জিল উড়ে যাবে। সাথে সাথে আমরাও। কাজেই আগে কবুতর।”
টিটন বলল, “তোদের বাসায় তো কবুতর আছে। তুই একটা ধরিস না কেন?”
অনু বলল, “কবুতর রাত্রে ধরে রাখতে হয়। দিনের বেলায় সব উড়ে চলে যায়। এখন আর ধরা যাবে না।”
টিটন বলল, “ঠিক আছে। আজ রাত্রে ধরে রাখবি।”
অনু মাথা নাড়ল, “রাখব। ধরে রাখব।”
আমি বললাম, “তা হলে কাল ভোরে মিশকাত মঞ্জিল অভিযান।”
সবাই মাথা নাড়ল।
”আজকে সবাই লিস্ট ধরে সবকিছু জোগাড় করবি।”
সবাই আবার মাথা নাড়ল।
”কাউকে কেউ কিছু বলতে পারবি না।”
সবাই আবার আরো জোরে মাথা নাড়ল।
চঞ্চল বলল, “আয় আমরা এখন মিশকাত মঞ্জিলটা একটু দেখে আসি।”
টিটনের চোখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “কী দেখবি?”
“বাইরে থেকে ঘুরে দেখে আসি বিল্ডিংটা কতো বড়, কোনদিকে কতটুকু। আমরা যখন ভিতরে ঢুকব তখন যেন আন্দাজ থাকে কোথায়, কোনদিকে আছি।”
আমরা তখন গাছ থেকে নেমে মিশকাত মঞ্জিলের দিকে হেঁটে যেতে থাকি। কাছাকাছি পৌঁছে এদিক-সেদিক তাকালাম, যখন দেখলাম আশেপাশে কেউ নেই, কেউ আমাদের দেখছে না, তখন আমরা শুট করে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম। সকালবেলা বলেই হয়তো অনেক পাখি কিচিরমিচির করছে। আমরা মিশকাত মঞ্জিলটা ভালো করে দেখলাম, চঞ্চল একটু মাপজোক করল, টিটন বুক ফুলিয়ে বলতে লাগল সে আর ভূতকে ভয় পায় না। আমরা চাইলে সে এখন একাই ভিতরে ঢুকে যেতে পারে!
খানিকক্ষণ বিল্ডিংয়ের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে আমরা যখন বের হয়ে আসছি তখন দেখলাম গেটের কাছে একটা মোটর সাইকেল দাঁড় করানো সেখানে পাহাড়ের মতো বড় একজন মানুষ বসে আছে। মানুষটার ওজনে মোটর সাইকেলের চাকা যে ফেটে যাচ্ছে না, সেটাই আশ্চর্য। আরেকজন শুটকো মানুষ সেই একই মোটর সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে। মানুষগুলোর চেহারার মাঝে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গির মাঝে এমন একটা কিছু আছে যেটা দেখে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। দেখেই বোঝা যায় মানুষগুলো ভালো না।
যে মানুষটা কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল সে দাঁত খোঁচানো বন্ধ করে আমাদের দিকে তাকালো, তারপর পিচিক করে রাস্তায় থুতু ফেলে বলল, “এই যে খোকারা।”
আমরা মোটেও খোকা না, আমাদেরকে কেউ খোকা বলবে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু সেটা নিয়ে তর্ক করা যায় না, তাই তর্ক না করে আমরা দাঁড়ালাম। অনু বলল, “আমাদেরকে বলছেন?”
শুটকো মানুষটা হাসার ভঙ্গি করে বলল, “এইখানে তোমরা ছাড়া আর কে আছে? আর কাকে বলব?”
কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচানোর জন্যেই হোক আর অন্য কোনো কারণেই হোক মানুষটার দাঁতগুলোর মাঝে অনেক বড় ফাঁক। তার মাঝে দিয়ে জিবটাকে দেখা যায়–জিবের মাঝে কালো কালো ফুটকি, এরকম আমি আগে কখনো দেখিনি। মানুষটা তার ফুটকি ফুটকি জিব বের করে সেটা দিয়ে তার ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিয়ে বলল, “তোমরা এইখানে কেন ঢুকেছ?”
টিটন বলল, “ঢুকলে কী হয়?”
“এইখানে তো কেউ ঢুকে না, তাই জানতে চাচ্ছি। মানুষজন ভয় পায়। তোমরা তো পোলাপান মানুষ, তোমরা কেন ভয় পাও না?”
“মানুষজন কী ভয় পায়?”
“এই তো ভূত-প্রেত!”
টিটন তার শার্টের হাতা তুলে তার বিশাল তাবিজটা দেখিয়ে বলল, “এই যে আমার এই তাবিজটা আছে। ভূত আমার ধারেকাছে আসে না।”
“অ।” মানুষটা আবার কাঠি দিয়ে তার দাঁত খোঁচাতে শুরু করে, দেখে মনে হয় আমাদের সাথে তার কথা বুঝি ফুরিয়ে গেছে। আমরা যেই হাঁটতে শুরু করেছি তখন সে আবার থামাল, “কিন্তু তোমরা তো আমাকে বললে না কেন এইখানে ঢুকেছ।”
আমি একটু অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। এই মানুষটি কেন বারবার আমাদের জিজ্ঞেস করছে আমরা কেন ভিতরে ঢুকেছি? মানুষটাকে বিশ্বাস করানোর মতো উত্তর পাওয়া কঠিন। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই অনু মুখ খুলল, বলল, “ব্যাঙের ছাতা খুঁজতে।”
“কীসের ছাতা?”
“ব্যাঙের ছাতা।”
“ব্যাঙের ছাতা? কেন?”
“আমাদের বিজ্ঞান স্যার আমাদেরকে একটা সায়েন্স প্রজেক্ট দিয়েছেন। ব্যাঙের ছাতার উপর। সেই জন্যে আমাদের ব্যাঙের ছাতা দরকার। কয়দিন থেকে আমরা সব জায়গায় ব্যাঙের ছাতা খুঁজছি। শেষ পর্যন্ত এইখানে পেয়েছি।”
“অ।” মানুষটা আবার তার দাঁত খোঁচাতে থাকে।
“ব্যাঙের ছাতা আসলে এক ধরনের ফাংগাস!” এবারে চঞ্চল যোগ দিল, “আমাদের দেশে অনেক রকম ব্যাঙের ছাতা আছে। অনেক ব্যাঙের ছাতা খাওয়া যায়, যেরকম মাশরুম। সেগুলো চাষও করে। ব্যাঙের ছাতা হওয়ার জন্যে দরকার একটু অন্ধকার, একটু সঁাতসেঁতে জায়গা। অনেক ব্যাঙের ছাতা আছে। খুব বিষাক্ত, কেউ যদি একটু খায় তা হলেই মরে যাবে। অনেক ব্যাঙের ছাতা আছে যেগুলো খেলে মারা যাবে না, কিন্তু নেশা হবে। সেই জন্যে ব্যাঙের ছাতা চেনা দরকার। আমরা সেই জন্যে ব্যাঙের ছাতা নিয়ে গবেষণা করব…”
মোটর সাইকেলের সামনে পাহাড়ের মতোন যে মানুষটা বসে ছিল সে মনে . হয় চঞ্চলের বক্তৃতা শুনে বিরক্ত হয়ে গেল। সে বলল, “আবে মাইনকা। এই প্যাচাল শুনে লাভ নাই। আয় যাই।”
মানুষটি যে রকম মোটা তার গলার স্বর ঠিক সে রকম। শুধু মোটা না তার শরীরটা পাহাড়ের মতো, টাইট একটা টি-শার্ট পরেছে আর সেই টি-শার্টের ভিতর দিয়ে তার শরীরটা বোঝা যাচ্ছে। মনে হয় তার শরীরে মাংশপেশী জীবন্ত প্রাণীর মতো কিলবিল কিলবিল করছে। সে যদি হাত দিয়ে একটা ঝটকা দেয় তা হলে মনে হয় আমরা চারজন চারদিকে ছিটকে পড়ব।
মানুষটা তার গমগমে গলায় বলল, “এই মাইনকা, ওঠ, আয় যাই।”
“চল ওস্তাদ।” বলে মাইনকা, যার আসল নাম মনে হয় মানিক মোটর সাইকেলের পিছনে উঠল। পাহাড়ের মতো মানুষটা মোটর সাইকেল স্টার্ট করে চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ছেলে, শোন।”
চঞ্চল বলল, “কী হল?”
“কথা কম বলবা। বুঝেছ? কথা বেশি বললে মানুষ বিরক্ত হয়। আর মানুষ বিরক্ত হলে একদিন তোমারে ধরে পাটকান দিয়ে ফেলে দিবে। বুঝেছ?”
চঞ্চল বলল, “পাটকান মানে কী?”
“জিজ্ঞেস কর না। তা হলে যদি দেখায়া দেই তা হলে তোমার খবর হয়ে যাবে। যাও, বাড়ি যাও!” বলে মানুষটা একটা ধমকের ভঙ্গি করল।
লোক দুইজন মোটর সাইকেল চালিয়ে চলে যাবার পর চঞ্চল বলল, “দুইটা মানুষকে ইনডাকশন কয়েল দিয়ে ইলেকট্রিক শক দেওয়া দরকার। কত বড় বেয়াদপ।”
বেয়াদপ মানুষ দুইটা নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা ফিরে আসতে লাগলাম। বাসার কাছাকাছি এসে দেখি পেয়ারা গাছে টুনি আর মিথিলা পা ঝুলিয়ে বসে আছে। এর আগে মিথিলাকে কোনোদিন গাছে উঠতে দেখিনি, আজই প্রথম। টুনির সাথে থেকে থেকে তার অনেক উন্নতি হয়েছে মনে হয়। আমি বললাম, “মিথিলা, গাছে উঠেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“পড়ে ঠ্যাং ভাঙলে বুঝবি মজা।”
“ভাঙলে ভাঙবে।”
টুনি বলল, “আসলে এখানে ব্ল্যাক ড্রাগনের জরুরি মিটিং হচ্ছে।”
আমরা বললাম”অ।”
শুধু যে আমাদের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন দখল করে আছে তা না, আমাদের পেয়ারা গাছটাও দখল করে নিয়েছে। আমরা তাই হেঁটে হেঁটে চঞ্চলের বাসার দিকে যেতে থাকি। পিছন থেকে মিথিলা বলল, “কালা গুইসাপ! কালা গুইসাপ!!”
কথাটা শুনে চঞ্চলের কোনো ভাবান্তর হল না, অনু হেসে ফেলল, তার করা অনুবাদটা ব্যবহার হচ্ছে সেই আনন্দেই মনে হয়, টিটন একটা গর্জন করল আর আমার মনে হল মিথিলাকে আমি নিশ্চয়ই একদিন খুন করে ফেলব। পত্রিকায় খবর বের হবে, ‘মর্মান্তিক : বড় ভাইয়ের হাতে ছোট বোনের মৃত্যু।‘ শুধু আসল খবরটা কেউ জানতে পারবে না।
আমাদের বাকি দিনটা কেটে গেল পরের দিনের অভিযানের প্রস্তুতি নিতে নিতে। লিস্টটা বিশাল, সব মিলিয়ে তেপ্পান্নটা আইটেম। সবচেয়ে বড় আইটেম হচ্ছে শাবল আর সবচেয়ে ছোট হচ্ছে টুথপিক। চঞ্চল লিস্টের পাশে তারকা চিহ্ন দিয়েছে, কোনো কোনোটা তিন তারকা যার অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ–যেমন শাবল, হাতুড়ি, চাকু, দড়ি, টর্চ লাইট, ম্যাচ, মোমবাতি, কবুতর এইগুলো। কোনো কোনোটা তারকা চিহ্নবিহীন যার অর্থ কম গুরুত্বপূর্ণ। যেমন : কমিক বই, এফ এম রেডিও, এনার্জি সেভিং বাল্ব, আঠা আর রাবার ব্যান্ড। এগুলো কেন তালিকায় আছে আমরা সেটাই বুঝতে পারলাম না! চঞ্চলকে কিছু বলিনি কিন্তু শুরুতেই আমরা এগুলো বাদ দিয়ে দিয়েছি।
চঞ্চলের ল্যাবরেটরিতে বসে আমরা লিস্টটা দেখে একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, কাল ভোরে যখন আমরা এগুলো নিয়ে রওনা দিব তখন সবাই চোখ কপালে তুলে বলবে, তোরা এই বাক্স-প্যাটরা নিয়ে কোথায় রওনা দিয়েছিস? সবচেয়ে ঝামেলা হবে শাবলটা নিয়ে, ভারী একটা শাবল ঘাড়ে নিয়ে টেনে টেনে যাচ্ছি দৃশ্যটাই কাউকে বোঝানো যাবে না।
আমি বললাম, “কাল সকালের জন্যে না রেখে শাবলটা আজকেই মিশকাত মঞ্জিলে রেখে আসি।”
অনু মাথা নাড়ল, বলল, “গুড আইডিয়া।”
“যদি কেউ জিজ্ঞেস করে শাবল নিয়ে কই যাচ্ছি, আমরা কী বলব?”
টিটন বলল, “আমরা কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ ভেংচে দেব। আমাদের কী ঠ্যাকা পড়েছে যে সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে?”
আমাদের বাসা থেকে মরচেধরা শাবলটা নিয়ে যখন বের হয়েছি তখন মিথিলা জানতে চাইল, “ভাইয়া, শাবল নিয়ে কই যাও।”
আমি উত্তর না দিয়ে মুখ ভেংচে দিলাম, তখন মিথিলা নাকি সুরে আম্মুকে নালিশ করতে লাগল, “আম্মু ভাইয়া আমাকে মুখ ভাংচায়।”
আম্মু চলে আসার আগে আমি বের হয়ে গেলাম। ভারী শাবলটা নিয়ে যখন আমরা রাস্তা ধরে যাচ্ছি তখন অনেকেই সন্দেহের চোখে তাকাল কিন্তু কেউ কিছু প্রশ্ন করল না। মিশকাত মঞ্জিলের কাছে গিয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে যখন ভিতরে ঢুকে গেছি তখন চমকে উঠে আবিষ্কার করলাম সেখানে ফুটকি জিব মানিক আর তার পাহাড়ের মতো ওস্তাদ দাঁড়িয়ে আছে। শুধু যে আমরা চমকে উঠলাম তা নয়, তারাও আমাদের দেখে চমকে উঠল। ফুটকি জিব মানিক জিজ্ঞেস করল, “তোমরা এখানে কী কর?”
এক সেকেন্ড দেরি না করে চঞ্চল বলল, “ব্যাঙের ছাতা তুলে নিতে এসেছি।”
ছোট একটা ব্যাঙের ছাতা তুলতে এতো বড় একটা শাবল লাগে কী না তারা ইচ্ছা করলেই সেই প্রশ্নটা করতে পারত, কিন্তু করল না। এবারে আমি একটা সাহসের কাজ করে ফেললাম, জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা এখানে কী করছেন?”
আমি ভেবেছিলাম লোকগুলো ধমক দিয়ে বলবে, “তোমার সেটা জানার দরকার কী?” কিন্তু তা না করে তারা কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল, ফুটকি জিব বলল, “না, মানে ইয়ে আমরা তো রিয়েল স্টেটে কাজ করি, সেই জন্যে মানেইয়ে”
পাহাড়ের মতো মানুষটা তখন ধমক দিয়ে বলল, “আবে মাইনকা। প্যাচাল পারিস না। আয় যাই।”
মানিক বলল, “চলেন।” তারপর দুইজন বের হয়ে গেল। অনু বলল, “খুবই সন্দেহের ব্যাপার।”
আমি বললাম, “মনে নাই, আব্বু বলেছিলেন মিশকাত মঞ্জিল নিয়ে মামলা হয়েছে। এরা মনে হয় হারু পার্টি। মামলায় হেরে গিয়ে এখন কেমন করে দখল করবে সেটা চিন্তা করছে।”
চঞ্চল মাথা নাড়ল, বলল, “মনে হয় তাই হবে।”
টিটন বলল, “যারা মামলা করতে চায় করুক, আমরা আমাদের কাজ করি।”
“হ্যাঁ। আমরা আমাদের কাজ করি।”
“এই শাবলটা কোথায় লুকিয়ে রেখে যাবি?”
“দোতলার সেই ঘরটাতে রেখে এলেই হয়।”
টিটন বলল, “দে। রেখে আসি। তোরা অপেক্ষা কর।”
“তোর ভয় করবে না তো?”
টিটন দাঁত বের করে হাসল, “ধুর! ভয় করবে কেন?” তার বিশাল তাবিজটা দেখিয়ে বলল, “এই তাবিজ আছে না আমার?”
ভারী শাবলটা ঘাড়ে নিয়ে টিটন মিশকাত মঞ্জিলের ভিতরে ঢুকে যায়। চঞ্চল আমাকে আর অনুকে ডেকে বলল, “একটা জিনিস তোদের বলি। কাউকে বলবি না তো?”
“বলব না।”
“খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
“মনে আছে, টিটন আমাকে তার তাবিজটা দিয়ে গিয়েছিল, ধরে রাখলে গরম হয় সেটা পরীক্ষা করার জন্যে?”
আমি মাথা নাড়লাম, “মনে আছে।”
চঞ্চল বলল, “তাবিজটা মোম দিয়ে বন্ধ করা। গরম করে মোম গলিয়ে আমি ভিতরের সবকিছু বের করেছিলাম।”
“তাই না কি? কী আছে ভিতরে?”
“ছোট একটা কাগজে হাবিজাবি লেখা। আমি কী করেছি জানিস?”
“কী করেছিস?”
“হাবিজাবি কাগজটা ফেলে নতুন একটা কাগজ ঢুকিয়ে মোম দিয়ে ভরাট করে দিয়েছি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। কাগজটাতে কী লেখা জানিস?”
“কী?”
“আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র, ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার।”
আমি আর অনু হি হি করে হাসলাম। অনু বলল, “তোর বৈজ্ঞানিক তাবিজ আগের থেকে ভালো কাজ করছে!”
“হ্যাঁ। টিটনটা যে কী বোকা।”
আমরা দেখলাম আমাদের টিটন শাবলটা রেখে মিশকাত মঞ্জিল থেকে বের হয়ে আসছে তাই তাবিজ নিয়ে আলোচনাটা থামিয়ে দিলাম। টিটন এসে বলল, “কী অসাধারণ তাবিজ! এখন আর একটুও ভয় করে না।”
আমরাও মাথা নাড়লাম, বললাম, “অসাধারণ!”