Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন || Muhammad Zafar » Page 4

দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন || Muhammad Zafar

সকালে আমি গপ গপ করে নাস্তা করছি তখন আম্মু বললেন, “কী হল? তোর এতো তাড়াহুড়া কীসের? ট্রেন ধরবি না কি? আস্তে আস্তে খা।”

আমি বললাম, “আস্তে আস্তেই তো খাচ্ছি।” বলে আবার গপ গপ করে খেতে থাকি।

।মিথিলা বলল, “আমি জানি ভাইয়া কেন এতো তাড়াতাড়ি খাচ্ছে।”

আমি সোজা হয়ে বসে বললাম, “তুই কী জানিস?”

মিথিলা তখন সুর করে বলল, “ব্ল্যাক-ড্রা-গ-ন!”

আমি রেগে বললাম, “তুই আমার কাগজগুলো দেখেছিস? কেন তুই আমার কাগজ দেখবি? আমার পারমিশন না নিয়ে তুই কেন আমার কাগজ দেখলি?”

মিথিলা খুব বোকা বোকা চেহারা করে বলল, “আমি তো বুঝি নাই এটা দেখা যাবে না। তুমি তো কাগজের উপর লিখে রাখ নাই এটা দেখা যাবে না।”

“তুই যদি কাউকে এটার কথা বলিস তা হলে আমি তোর মাথা ভেঙে ফেলব।”

“আমাকে তোমাদের ব্ল্যাক ড্রাগন দলে নাও তা হলে কাউকে বলব না!”

“কী?” আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “তুই ব্ল্যাক ড্রাগন হবি? ইশ! সখ দেখে বাঁচি না।”

“তা হলে আমি সবাইকে বলে দেব!”

“বলে দেখ, আমি তোর মাথা ভেঙে ফেলব।”

মিথিলা তখন নাকি সুরে কান্নার ভঙ্গি করে বলল, “আম্মু দেখ ভাইয়া আমাকে মারবে!”

আম্মু দুইজনকেই ধমক দিলেন। বললেন, “ব্যস অনেক হয়েছে। দুইজনই থাম–তোদের যন্ত্রণায় আমাদের পাগল হয়ে যাবার অবস্থা।”

আমি নাস্তা করে টেবিল থেকে কাগজগুলো নিয়ে বের হলাম। কালকে রাত জেগে আমি ব্ল্যাক ড্রাগন দলের কাজকর্ম কীভাবে চালানো হবে, সদস্য হতে হলে কীভাবে ফর্ম ফিল-আপ করতে হবে সেগুলো তৈরি করেছি। পুরো কাজটা করেছি গোপনে, কেউ যেন দেখতে না পারে আর পাজী মিথিলাটা সবকিছু পড়ে ফেলেছে। কোনো একদিন আমি মনে হয় মিথিলাকে খুনই করে ফেলব।

চঞ্চলের বাসা আমাদের বাসার খুব কাছে। দোতলায় চিলেকোঠার ঘরটা চঞ্চলের ল্যাবরেটরি, আমি নিচতলায় তাকে খোঁজ না করে সোজা দোতলায় উঠে গেলাম, কারণ আমি জানি চঞ্চল এখন এখানেই থাকবে।

চঞ্চলের দরজাটা খোলা, আমি দেখলাম সে আমার দিকে পিছন ফিরে কাজ করছে। আমার পায়ের শব্দ শুনে মুখ না ঘুরিয়েই বলল, “রাতুল তুই আজকে লাল রঙের শার্ট পরে এসেছিস!”

আমি বললাম, “আমার দিকে না তাকিয়ে কেমন করে বলছিস?”

“এই দেখ।”

আমি কাছে গিয়ে দেখলাম একটা রঙিন টেলিভিশন সেখানে রাতুলের বাসার সিঁড়িটা দেখা যাচ্ছে। আমি যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছি তখন নিশ্চয়ই আমাকে এখানে দেখেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “টেলিভিশন কোথায় পেলি?”

“বাসার।”

“তোদের বাসার টেলিভিশন তোকে দিয়ে দিয়েছে?”

“দেয় নাই। ঠিক করতে দিয়েছে।”

“তোকে টেলিভিশন ঠিক করতে দিয়েছে?”

চঞ্চল মুখ বাঁকা করে হেসে কী একটা জিনিস টেলিভিশনের উপরে রাখল। সাথে সাথে টেলিভিশনের ছবিটা পেঁচিয়ে কেমন যেন বিদঘুঁটে হয়ে গেল। চঞ্চল আমাকে সেটা দেখিয়ে বলল, “টেলিভিশনের কাছে পাওয়ারফুল চুম্বক ধরলে ছবিটা এরকম হয়ে যায়। আমি তাই করেছি–সবাই ভেবেছে টেলিভিশন নষ্ট হয়ে গেছে! টিভি মেকানিকের কাছে পাঠাবে-” চঞ্চল চোখ নাচিয়ে বলল, “আমি বলেছি আমি ঠিক করে দেব। সেই জন্যে আমাকে দিয়েছে!”

চঞ্চল টেলিভিশনের উপর থেকে চুম্বকটা সরাতেই আবার ছবিটা ঠিক হয়ে গেল। চঞ্চল সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি বলেছি মেকানিককে যত টাকা দিতে হত আমাকে তার অর্ধেক দিলেই হবে। জানি না দিবে কি না!”

চঞ্চলের ফিচলে বুদ্ধি দেখে আমি অবাক হলাম। বৈজ্ঞানিকদের বিজ্ঞানের বুদ্ধির সাথে সাথে নিশ্চয়ই ফিচলে বুদ্ধিও থাকে!

চঞ্চল বলল, “বাইরে থেকে ভিতরের জিনিস দেখার জন্যে যন্ত্রটা তৈরি করেছি–কিন্তু মুশকিল হল এটা আমরা মিশকাত মঞ্জিলে কেমন করে নিব? এতো বড় টেলিভিশন যদি নিয়েও যাই সেখানে তো ইলেকট্রিসিটি নাই। কেমন করে দেখব?”

“তা হলে উপায়?”

“একটা জেনারেটর হলে হত। কিংবা ব্যাটারি দিয়ে চলে সেরকম একটা টেলিভিশন।”

“জেনারেটরের কত দাম!”

“অনেক। আর সেটা চালালে যেরকম ভটভট শব্দ করবে তখন সবাই জেনে যাবে কিছু একটা হচ্ছে।”

“তা হলে?”

চঞ্চল মাথা চুলকে বলল, “আরেকটা হতে পারে একটা রিমোট ক্যামেরা। একটা গাড়ির উপর বসিয়ে সেটা ভিতরে পাঠালাম, সেটাকে বাইরে থেকে কন্ট্রোল করে ছবি তুলোম, তারপর বাইরে নিয়ে এসে ছবিগুলো দেখলাম।”

আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, “গুড আইডিয়া!”

“সেটাই এখন তৈরি করছি। সমস্যা হচ্ছে–”

“কী সমস্যা?”

“ক্যামেরাটা আব্বুর–যদি কিছু একটা হয় তা হলে আব্বু আমাকে খুন করে ফেলবে!”

“ক্যামেরার কী হবে?”

“মনে কর ভিতরে একটা গর্ত, আমার রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি গর্তের ভিতর পড়ে গেল তা হলে তো আর গর্তের ভিতর থেকে বের হতে পারবে না।”

“তা হলে?”

চঞ্চল মুখ কালো করে বলল, “এরকম হাইফাই যন্ত্র ব্যবহার না করে খুব সোজাভাবে দেখা যায়, একটা আয়না আর একটা টর্চ লাইট দিয়ে! কিংবা একটা ছোট পেরিস্কোপ তৈরি করলাম, সেটা দিয়ে ভিতরে দেখলাম। কিন্তু—”

“কিন্তু কী?”

“সেটা তো সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক উপায় হল না! আমি চাচ্ছিলাম খুবই ফাটাফাটি ইলেকট্রনিক্স রিমোট কন্ট্রোল ওয়ারলেস এইরকম কিছু একটা তৈরি করতে!”

এই হচ্ছে আমাদের চঞ্চল–যে কাজটা সোজাভাবে করা যায় সেই কাজটাও কঠিনভাবে করবে! কে জানে বৈজ্ঞানিকেরা মনে হয় এ রকমই হয়। আমি চঞ্চলকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যে বললাম, “এইবারে সোজাভাবে করে ফেল। আয়না আর টর্চ লাইট দিয়ে। পরেরবার ফাটাফাটি ইলেকট্রনিক্স দিয়ে করিস।”

চঞ্চল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে।”

এরকম সময়ে আমরা টেলিভিশনে দেখলাম টিটন আর অনু সিঁড়ি দিয়ে আসছে। তাদের হাতে একটা চিপসের প্যাকেট, আমরা দেখলাম তারা দুজন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পুরো প্যাকেটটা খেয়ে শেষ করল তারপর চিপসের প্যাকেটটা ফেলে দিয়ে মুখ মুছে উপরে উঠতে শুরু করল। কতো বড় নিমকহারাম, আমাদের যেন দিতে না হয় সে জন্যে পুরোটা খেয়ে শেষ করে উপরে উঠছে!

একটু পরেই আমরা তাদের দুজনকে দরজায় দেখলাম। টিটন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাতুল! তোদের বাসায় গিয়েছিলাম। খালাম্মা বললেন তুই এইখানে।”

“হ্যাঁ। আমি এইখানে। ব্ল্যাক ড্রাগনের কাজ করার জন্যে সকালবেলা চলে এসেছি।”

দুইজনে ভিতরে ঢুকে টেলিভিশনটা দেখে অবাক হয়ে বলল, “টেলিভিশন? নাটক দেখাচ্ছে না কি?”

আমি বললাম, “না। এটা চঞ্চলের যন্ত্র। এটা দিয়ে ঘরে বসে সিঁড়িতে কী হচ্ছে দেখা যায়। আমরা এক্ষুণি দেখলাম তোরা দাঁড়িয়ে রাক্ষসের মতো দুজনে পুরা চিপসের প্যাকেটটা খেয়ে শেষ করেছিস। আমাদেরকে যেন দিতে না হয় সেই জন্যে।”

একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে দুজনের মুখেই একটু লজ্জার ভাব ফুটল। টিটন অবশ্যি সাথে সাথেই লজ্জা কাটিয়ে বলল, “অল্প কয়টা চিপস-এতোজন মানুষ, সবার ভাগে কম পড়বে। সেই জন্যেই তো!”

আমি বললাম, “মোটেও অল্প কয়টা চিপস ছিল না। বিরাট বড় প্যাকেট ছিল।”

চঞ্চল বলল, “আর খালি প্যাকেটটা ফেলেছিস সিঁড়িতে। পরিবেশ দূষণ।”

অনু বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে, পরেরবার তোদের নিয়ে খাব।”

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “আমাদের ব্ল্যাক ড্রাগনের কী কী উদ্দেশ্য সব আমি কাগজে লিখে এনেছি। এই দেখ, প্রথমেই লেখা আছে একজন ব্ল্যাক ড্রাগন অন্য ব্ল্যাক ড্রাগনকে সহযোগিতা করবে। একজন বিপদে পড়লে আরেকজন বুকের রক্ত দিয়ে হলেও তাকে রক্ষা করবে। আর তোরা দুজনে চিপসের প্যাকেটটা খেয়ে ফেললি?”

অনু বলল, “ঠিক আছে, বললাম তো আর খাব না। এখন আমাকে দেখা কী কী লিখেছিস।”

আমি কাগজগুলো বের করলাম। প্রথম কাগজটা হচ্ছে ব্ল্যাক ড্রাগন হবার আবেদনপত্র। ডান দিকে ছবি লাগানোর জায়গা, উপরে একটা কালো ড্রাগনের ছবি। নাম-ঠিকানা, নিচে একটা অঙ্গীকারনামা। একজন ব্ল্যাক ড্রাগন কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না তার একটা লম্বা তালিকা। তা ছাড়াও যারা ব্ল্যাক ড্রাগন হবে তাদের জন্যে একটা ছোট কার্ড। সেটা আবার লেমিনেট করা হবে। সব ব্ল্যাক ড্রাগনকে সবসময় সাথে এই কার্ড রাখতে হবে।

চঞ্চল বলল, “সবই ঠিক আছে। কিন্তু পুরো জিনিসটা আসলে কম্পিউটারে টাইপ করে প্রিন্টারে প্রিন্ট করলে ভালো হত।”

আমি একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বললাম, “কেন আমার হাতের লেখা কি খারাপ?”

টিটন বলল, “যথেষ্ট খারাপ। হাত দিয়ে লিখিস না পা দিয়ে লিখিস বোঝ যায় না।”

“বাজে কথা বলবি না।” আমি রেগে বললাম, “তোর নিজের হাতের লেখাটা কোনোদিন দেখেছিস? বাংলা লিখেছিস না চাইনিজ লিখেছিস সেটাই বোঝা যায় না!”

টিটন রেগে উঠে আরেকটা কী বলতে চেয়েছিল কিন্তু হঠাৎ করে আমরা সবাই থেমে গেলাম। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে টুনি আর মিথিলা উঠে আসছে। দুজন সিঁড়ির মাঝখানে থেমে গেল, নিজেরা হাত নেড়ে কী যেন কথা বলল। কথা শেষ করে দুজনেই মুখে হাত দিয়ে খানিকক্ষণ হাসল। তারপর টুনি হাত দিয়ে তার চুলগুলো ঠিক করল, মনে হল মিথিলাকে জিজ্ঞেস করল তাকে কেমন দেখাচ্ছে। মিথিলা নিশ্চয়ই বলল ভালোই দেখাচ্ছে তখন দুজনেই আবার উপরে উঠতে শুরু করল।

একটু পরেই আমরা তাদের দুজনকে দরজার সামনে দেখতে পেলাম। আমরা অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। টুনি বলল, “আমি আর মিথিলা এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মিথিলা বলল, তোরা এখানে আছিস! তাই ভাবলাম তোদর একটু দেখে যাই!”

ডাহা মিথ্যা কথা! নিশ্চয়ই অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে, সেই আসল কথাটা শোনার জন্যে আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম। টুনি ভান করল হঠাৎ যেন তার কিছু একটা মনে পড়েছে, তখন সে হাতের একটা প্যাকেট থেকে কিছু কাগজ বের করে বলল, “ও আচ্ছা! আমি আর মিথিলা কথা বলছিলাম। আমরা ঠিক করেছি আমরা একটা ক্লাব করব।”

আমরা একসাথে বললাম, “ক্লাব?”

“হ্যাঁ। নাম দিয়েছি ব্ল্যাক ড্রাগন। যারা মেম্বার হবে তাদেরকে বলা হবে ব্ল্যাক ড্রাগন! ব্ল্যাক ড্রাগন হবার আবেদনপত্র তৈরি করেছি, এই দেখ!”

আমরা দেখলাম কম্পিউটারে টাইপ করা আবেদনপত্র। উপরে একটা কালো রঙের ড্রাগনের ছবি। ডান পাশে টুনির রঙিন ছবি। অন্যটাতে মিথিলার। ঠিক আমরা যেরকম আলোচনা করেছিলাম। আবেদনপত্রের নিচে অঙ্গীকারনামা, ব্ল্যাক ড্রাগনেরা কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না তার একটা লম্বা তালিকা। দেখে আমরা এতো অবাক হলাম যে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।

টুনি প্যাকেট থেকে দুইটা ছোট ছোট কার্ড বের করে বলল, “আর প্রত্যেক ব্ল্যাক ড্রাগনের থাকবে এই কার্ড। লেমিনেট করা। সবসময় সাথে রাখতে হবে। একজন ব্ল্যাক ড্রাগন এটা দেখালেই অন্য সব ব্ল্যাক ড্রাগন তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করবে। দরকার হলে বুকের রক্ত দিয়ে রক্ষা করবে। তাই না রে মিথিলা?”

মিথিলা কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়ল।

তখন টিটন একটা গর্জনের মতো শব্দ করল। আমি বললাম, “ব্ল্যাক ড্রাগন হচ্ছে আমাদের ক্লাবের নাম। আমাদের।”

টুনি শুনে খুবই খুশি হওয়ার ভান করল, বলল, “তা হলে তো আরো ভালো। হয় তোরা আমাদের ক্লাবে যোগ দিবি। না হয় আমরা তোদের ক্লাবে যোগ দিব। ছয়জন ব্ল্যাক ড্রাগন! ফ্যান্টাস্টিক!”

টিটন আবার গর্জনের মতো শব্দ করল।

টুনি বলল, “কী হল? হ্যাঁ, না কিছু বলছিস না কেন? শুধু নাক দিয়ে শব্দ করছিস কেন?”

আমি আবার চিৎকার করে বললাম, “ব্ল্যাক ড্রাগন আমাদের।”

টুনি বলল, “আমিও তো তাই বলছি! ব্ল্যাক ড্রাগন আমাদের। তোরা চারজন আর আমরা দুইজন–সব মিলিয়ে আমাদের ছয়জনের।”

আমরা কী বলব বুঝতে পারছিলাম না, তখন টুনি বলল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে কোনো তাড়াহুড়া নেই। তোরা চিন্তা-ভাবনা করে আমাদেরকে বলিস!”

তারপরে আমাদের কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমরা তখন আমাদের টেলিভিশনের দিকে তাকালাম, দেখলাম টুনি আর মিথিলা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে! কী বলছে শুনতে পাচ্ছি না–শুধু দেখতে পাচ্ছি। সেটা দেখেই আমাদের তালু গরম হয়ে গেল। এইটুকুন মেয়ের কী ফিচলে বুদ্ধি, বাবারে বাবা!

আমাদের কিছুক্ষণ লাগল শান্ত হতে, সবার আগে শান্ত হল টিটন, সে মেঝেতে থাবা দিয়ে বলল, “খুন করে ফেলব আমি। আমাদের ক্লাব হাইজ্যাক করে নিয়ে যাবে? এতো বড় সাহস?”

চঞ্চল কম্পিউটার দিয়ে কম্পোজ করে ছাপানো ফর্মটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, “দেখেছিস! কী সুন্দর ফর্মটা তৈরি করেছে?”

অনু বলল, “রাতুলেরটাতে কতো বানান ভুল এইটাতে একটা বানান ভুল নাই।”

আমি গরম হয়ে বললাম, “শুধু বানান ভুল না থাকলে আর সুন্দর হলেই হল? আমাদের ক্লাবটা চোট্টামি করে দখল করে নিবে?”

চঞ্চল বলল, “দখল তো করে নাই। তারা তো বলেছে আমরা সবাই মিলে করব–”

টিটন বলল, “কখনো না। ব্ল্যাক ড্রাগনে আমরা ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবে না।”

আমি বললাম, “আমি আগে থেকে বলে রাখলাম, যদি ব্ল্যাক ড্রাগনে মিথিলা এসে ঢুকে তা হলে আমি সেখানে নাই। বাসায় আমার জীবন নষ্ট করে ফেলেছে এখন বাইরেও আমার জীবনটাকে নষ্ট করবে? তোরা জানিস মিথিলা কি করে? আমার আম্মুর কাছে দিনরাত কী রকম নালিশ করে তোরা সেটা কোনোদিন শুনেছিস?”

অনু বলল, “ছোট বোনেরা সবসময়েই একটু আহাদী হয়।”

“আহ্লাদী মোটেই না। ডেঞ্জারাস। দেখছিস না ব্ল্যাক ড্রাগনের সবকিছু টুনিকে বলে দিয়েছে? মিথিলা না বললে টুনি কি জানতে পারত?”

“মিথিলা জানল কেমন করে?”

“আমি যখন লিখেছিলাম তখন চুরি করে পড়েছে।”

চঞ্চল ফর্মটার দিকে তাকিয়ে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কী সুন্দর ফর্মটা তৈরি করেছে দেখেছিস? কম্পিউটার হচ্ছে একটা ম্যাজিক! ইশ! আমার যদি একটা কম্পিউটার থাকত!”

চঞ্চল তার পেরিস্কোপ তৈরি শেষ করল বিকেলের দিকে। পেরিস্কোপের সাথে একটা টর্চ লাইট নিয়ে তখন আমরা মিশকাত মঞ্জিলের দিকে রওনা দিলাম। বাচ্চারা বাইরে ছোটাছুটি করছে, তাদের মাঝে মিথিলাও আছে। আমরা টুনিকেও দেখলাম, সে পেয়ারা গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোরা কোথায় যাচ্ছিস?”

আমরা প্রথমে না শোনার ভান করলাম, যখন আবার জিজ্ঞেস করল তখন বললাম, “এই তো ওই দিকে!”

আমরা ভয় পাচ্ছিলাম টুনি হয়তো এখন আমাদের সাথে রওনা দেবে, কিন্তু আমাদের খুব কপাল ভালো যে ঠিক তখন তার একটা ফোন এসে গেল। মনে হল জরুরি ফোন কারণ দেখলাম সে হাত-পা নেড়ে কথা বলতে শুরু করেছে আমরা তখন পা চালিয়ে সরে গেলাম। এখন চেষ্টা করলেও আমাদের পিছু নিতে পারবে না।

মিশকাত মঞ্জিলের কাছাকাছি এসে টিটন আবার ঘ্যানঘ্যান শুরু করল, বলল, “আমাদের কী ভেতরে যেতেই হবে? অন্য কোথাও যেতে পারি না?”

“অন্য কোথায়?”

“এই ধর নদীর ধারে কোথাও, না হলে পুকুর ধারে।”

চঞ্চল বলল, “কিন্তু গোপন কুঠুরি তো খালি এখানেই আছে!”

“গোপন কুঠুরি ছাড়া কি অ্যাডভেঞ্চার হয় না?”

“এটা শেষ করে নেই, তারপর দেখা যাবে।”

কাজেই টিটন খুব বিরস মুখে আমাদের পিছু পিছু এলো। আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন সময়টা ছিল দুপুর, আলো ছিল অনেক বেশি। আজকে বিকেল হয়ে গেছে তাই গাছের লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে। চারদিকে এক ধরনের ছমছমে ভাব। শুধু টিটন না, আমাদেরও কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকে। আমরা নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে সেই ঘরটাতে যাই। আগের দিন একটা বেজি বের হয়ে এসেছিল, আজকেও কিছু বের হবে কি না বুঝতে পারছিলাম না। আমি দেয়ালটাতে দুটো লাথি দিলাম, যদি কিছু বের হতে চায় তা হলে যেন আগেই বের হয়ে যায়। কিছু বের হল না। তখন চঞ্চল উবু হয়ে ছোট গর্তটা দিয়ে টর্চ লাইটটা ঢুকিয়ে দেয়, ভেতরটা নিশ্চয়ই এখন আলোকিত হয়ে উঠেছে, আমাদের মনে হল ভেতরে ডানা ঝটপট করে কিছু উড়তেও শুরু করেছে।

চঞ্চল তখন সাবধানে তার পেরিস্কোপটা ঢুকিয়ে দেয়, তারপর চোখ লাগিয়ে দেখে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী দেখা যায়।”

“একটা ঘর।”

“কী আছে ঘরের ভেতর?”

“কিছু নাই। বাদুর উড়ছে।”

“বাদুর ছাড়া আর কিছু নাই?”

“দাঁড়া দেখি।” চঞ্চল খানিকক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। তারপর বলল, “মনে হচ্ছে এখান থেকে একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।”

“সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে? সত্যি?”

“হ্যাঁ।”

আমি চঞ্চলকে সরিয়ে বললাম, “দেখি, আমাকে দেখতে দে।”

পেরিস্কোপে চোখ লাগিয়ে ভেতরে দেখা যায় সত্যি কিন্তু কোনটা সোজা কোনটা উল্টো বুঝতে সময় লাগে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে আমার মনে হল চঞ্চল ঠিকই বলেছে। সত্যিই একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। তার মানে এই গোপন কুঠুরিটাতেই রহস্য শেষ না! এখান থেকে রহস্য শুরু। কী সাংঘাতিক ব্যাপার।

টিটন সারাক্ষণ উশখুশ করছিল, “এবারে বলল, অনেক হয়েছে। চল যাই।”

আমরাও তখন উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, “চল।”

যখন মিশকাত মঞ্জিল থেকে বের হয়েছি তখন বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। এখন কী করা যায় সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা হেঁটে হেঁটে ফিরে আসছিলাম, বাসার কাছে এসে দেখি টুনি তখনো পেয়ারা গাছে বসে আছে।

আমাদের দেখে বলল, “কোথায় গিয়েছিলি?”

আমি বললাম, “এই তো!”

“এই তো মানে কোথায়?”

“এই তো মানে এইখানে।”

টুনি তখন গাছ থেকে নেমে আসে। আমাদের কাছে এসে বলল, “আমি কি বলেছিলাম মনে আছে?”

“কী?”

“আমি তোদের সাথে চিনে জোঁকের মতো লেগে থাকব।”

“মনে আছে।”

“আমি কিন্তু লেগে আছি। তোরা টের পাচ্ছিস?”

টিটন বলল, “না।”

টুনি হাসির মতো ভঙ্গি করে বলল, “পাবি! টের পাবি।” তারপর সে হেঁটে হেঁটে তার বাসার দিকে চলে গেল। তাকে দেখে মনে হল তার বুঝি কোনো কিছু নিয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *