Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন || Muhammad Zafar » Page 3

দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন || Muhammad Zafar

বিকেলের দিকে আমরা মিঠুদের বাসার দিকে রওনা দিলাম। মিশকাত মঞ্জিলের গোপন ঘরটার ভিতরে কীভাবে ঢোকা যায় সেটা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। টিটনের বুদ্ধিটাই সহজ, একটা শাবল নিয়ে দেয়ালে ঘা মেরে ইটগুলো ভেঙে ভিতরে ঢুকে যাওয়া। কিন্তু চঞ্চল রাজি হচ্ছে না, সে একেবারে খাঁটি বৈজ্ঞানিক উপায়ে বাইরে থেকে আগে ভিতরে উঁকি দিতে চায়, কাজেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বিজ্ঞানের এরকম একটা কেরানি দেখানোর সুযোগ সে কিছুতেই ছাড়বে না। আমরাও দেখলাম তার এতো আগ্রহ তাই আর না করলাম না। তা ছাড়া আজকে মাত্র আমাদের ছুটি শুরু হয়েছে–প্রথম দিনেই যদি সবকিছু করে ফেলি তা হলে কেমন করে হবে? ছুটির অন্য দিনগুলোর জন্যেও তো কিছু রাখা দরকার।

মিঠুদের বাসায় গিয়ে দেখি সেখানে দাঁড়ানো ট্রাকগুলো নেই। ভেতরে মনে হয় মানুষজন আছে, তাদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। আমাদের বয়সী ছেলে আছে কী নেই খোঁজটা কেমন করে নেওয়া যায় চিন্তা করছিলাম। টিটন বলল, “এতো ধানাই-পানাই করার কী আছে? গিয়ে জিজ্ঞেস করি। যদি থাকে ডেকে কথা বলব। যদি না থাকে তা হলে এবাউট টার্ন করে চলে আসব।”

আমরা রাজি হলাম। টিটন বাসার দরজা ধাক্কা দিল, দরজাটা খোলা। ইচ্ছে করলে আমরা ভিতরে ঢুকে যেতে পারি। মিঠু যখন ছিল তখন-যখন তখন ঢুকে গেছি। এখন ঢোকা উচিত হবে কি না বুঝতে পারলাম না। টিটন বলল, “আয় ঢুকে যাই! আমরা তো আর ডাকাতি করতে যাচ্ছি না।”

টিটনের পিছু পিছু আমরা ঢুকে গেলাম। ঘরের সব জায়গায় ফার্নিচার, বাক্স, মালপত্র ছড়ানো ছিটানো। একজন ভদ্রমহিলা তার মাঝে ছোটাছুটি করছেন। আমাদের ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকালেন। টিটন মুখ খুললে একেবারে বেখাপ্পা কোনো একটা কথা বলে ফেলবে সে জন্যে আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “খালাম্মা আমরা এই পাড়ায় থাকি। আপনারা নতুন এসেছেন তাই দেখতে এসেছি।”

“হাউ সুইট। এসো বাবারা–দেখেছ ঘরের অবস্থাটা?”

অনু বলল, “আমাদের বাসাটা সবসময়ই এরকম থাকে।”

“তোমাদেরকে বসতে বলারও জায়গা নেই। কোনো একটা বাক্স-টাক্স খুঁজে তার ওপর বসে পড়।

চঞ্চল বলল, “আমাদের বসতে হবে না খালাম্মা।”

টিটন ধানাই-পানাই ছেড়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলো, “খালাম্মা আমরা জানতে চাচ্ছিলাম আপনার আমাদের বয়সী ছেলে-টেলে আছে কি না!”

আমি তাড়াতাড়ি যোগ করলাম, “এই পাড়ায় আমরা একসঙ্গে থাকি, খেলাধুলা করি।”

অনু বলল, “দেয়াল পত্রিকা বের করি।” পুরো মিথ্যা কথা কিন্তু আমরা এখন সেটা প্রকাশ করলাম না।

ভদ্রমহিলা খুশি হয়ে উঠলেন, বললেন, “অবশ্যিই তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়ে আছে। হাউ সুইট। আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে। একজন ছোট, একজন তোমাদের বয়সী। এসে থেকে ঘ্যান ঘ্যান করছে। ঢাকার সব বন্ধু বান্ধব ছেড়ে চলে এসেছে তো, তাই মন খারাপ। তোমরা ধরে নিয়ে যাও, তা হলে মন ভালো হয়ে যাবে।”

শুনে আমাদেরও মন ভালো হয়ে গেল। ভদ্রমহিলা এতো ভালো, ছেলেটাও ভালো হবার কথা।

ভদ্রমহিলা ডাকলেন, “এই টুনি-টুটুল দেখে যা, কে এসেছে।”

প্রথমে এলো টুটুল-ছেলে। তাকে দেখেই আমাদের বুক ধড়াস করে উঠল কারণ তার বয়স চার থেকে পাঁচ বছর, তার মানে আমাদের বয়সী যে, সে হচ্ছে মেয়ে! আমরা ছেলের খোঁজে এসেছি মোটেই মেয়ের খোঁজে আসিনি। মেয়েদের নিয়ে আমাদের জীবনে ভয়ংকর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আছে। আমরা মেয়েদের থেকে একশ হাত দূরে থাকি। আমার বাসায় মিথিলা একা আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে, সারাক্ষণ আম্মুর কাছে নালিশ। সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান। বাইরের কথা স্কুলের কথা ছেড়েই দিলাম।

আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। চোখের দৃষ্টি দিয়ে টিটন বলল, “চল পালাই।”

কিন্তু সত্যি সত্যি তো পালানো যায় না। তাই আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম আর তখন টুনি বের হয়ে এলো। আমাদের বয়সী, শুকনো কিন্তু মনে হয় আমাদের থেকে একটু লম্বা। শ্যামলা, মাথার চুল ছোট করে কাটা। একটা জিনসের প্যান্ট আর ঢলঢলে টি-শার্ট পরে আছে। মেয়েটার কাপড়, চেহারা, সাইজ–যেরকমই হোক তার চোখ দুটি দেখেই আমরা বুঝে গেলাম এই মেয়েটার কারণে আমাদের কপালে দুঃখ আছে।

ভদ্রমহিলা বললেন, “এই দ্যাখ টুনি, এরা কতো সুইট। নিজেরা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে ওদের বয়সী ছেলেমেয়ে আছে কি না। আর তুই বলছিলি তোকে জঙ্গলে নিয়ে এসেছি! এখানে কথা বলার কেউ নাই।”

টিটন দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে আমাকে বলল, “ছেলেমেয়ে বলি নাই। শুধু ছেলে বলেছি।” কথাটা অবশ্যি আমি ছাড়া আর কেউ শুনল না।

মেয়েটি আমাদের দিকে আর আমরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রমহিলা বললেন, “যা টুনি, এদের সঙ্গে ঘুরে আয়। সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, পরিচয় করে আয়।”

মেয়েটা হ্যাঁ না কোনো কথা বলল না, ঘরে ঢুকে পায়ে স্যান্ডেল পরে বের হয়ে এলো। ভদ্রমহিলা আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের নাম তো জানা হল না!”

আমরা আমাদের নাম বললাম, ভদ্রমহিলা একবার করে উচ্চারণ করে বললেন, “যাও বাবা তোমরা এই মেয়েটাকে একটু ঘুরিয়ে আন। দেখো ওর মনটা একটু ভালো হয় কী না।”

মেয়েটা আমাদের পিছু পিছু বের হয়ে এলো, বাইরে বের হয়ে আমার মনে হল ভুলটা এখনই ভেঙে দেওয়া ভালো। আমরা যে মোটেও কোনো মেয়ের খোঁজে যাইনি, ছেলের খোঁজে গিয়েছি সেটা মেয়েটাকে এখনই জানিয়ে দেওয়া দরকার। আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, “ইয়ে মানে, টুনি, একটা জিনিস আগে একটু বলে নিই।”

টুনি আমার দিকে তাকাল, চোখের দৃষ্টিটা একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা। আমি বললাম, “আসলে একটা ভুল হয়ে গেছে। আমরা আসলে তোমার আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের বয়সী কোনো ছেলে আছে কি না। ছেলে, বুঝেছ তো?”

টুনি মাথা নেড়ে জানাল যে সে বুঝেছে। আমি তবুও ঝুঁকি নিলাম না, আরো পরিষ্কার করে দিলাম, “আমরা কিন্তু, মানে, ইয়ে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করি নাই। তাই তোমার কষ্ট করে আমাদের সাথে সাথে যাবার কোনো দরকার নাই। তুমি ইচ্ছে করলে এখন বাসায় চলে যেতে পার।”

“আর যদি না যাই?” এই প্রথম মেয়েটা কথা বলল, গলার স্বরটাও বরফের মতো ঠাণ্ডা।

আমি কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। আমতা আমতা করে বললাম, “মানে না যেতে চাইলে আসতে পার। কিন্তু তুমি যদি চাও তা হলে আমরা আমাদের পরিচিত মেয়েদের তোমার কথা বলতে পারি, তারা মনে করো বিকালের দিকে আসতে পারে–”

ঠিক তখন টেলিফোনের শব্দ হল, আর মেয়েটা পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে ফোনটা ধরল। এইটুকুন পুঁচকে মেয়ে তার আবার মোবাইল টেলিফোন আছে! মেয়েটা বলল, “হ্যালো। টুশি। তোকে পরে ফোন করব। এখন খুবই একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। খুবই আজিব।”

অন্য পাশ থেকে যে ফোন করছে, টুশি না কে সে মনে হয় জানতে চাইল ‘আজিব’, ঘটনাটা কী? মেয়েটা তখন সেটা একটু ব্যাখ্যা করল, “আজিব মানে হচ্ছে কী, আমাদের বাসায় চারটা ছেলে এসেছে। তিনটা টিংটিংয়ে একটা একটু ভোটকা। এসে আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছে–” মেয়েটা তখন টিটনের গলার স্বরটা নকল করে নাকি গলায় বলল, “খালাম্মা আপনাদের বাসায় কী কোনো ছেলে

চেঁলে আছে? আমি কিন্তু শুনেছি ছেলেমেয়ে বলে নাই বলেছে ছেলে-টেলে। আম্মু তো বোকা-সোকা মানুষ ধরেই নিয়েছে ওরা বলেছে ছেলেমেয়ে। তাই আমাকে জোর করে ওদের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি ওদের সাথে হাঁটছি। খুবই আজিব ব্যাপার। মনে হচ্ছে ওরা কোনোদিন কোনো মেয়ে দেখে নাই কথা বলা তো দূরের কথা! চারজনেই চূড়ান্ত নার্ভাস, একেবারে ঘেমে-টেমে যাচ্ছে। তোকে পরে সব বলব।”

মেয়েটা লাইন কেটে দিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে আমাদের দিকে তাকাল, বলল, “হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে?” ভাব-ভঙ্গি একেবারে বড় মানুষের মতো।

মেয়েটার কথা শুনে রাগের চোটে আমার কানের গোড়া পর্যন্ত গরম হয়ে গেছে। আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, “তুমি মেয়ে সেই জন্যে আমরা মোটেও নার্ভাস না। আমরা অনেক মেয়ে দেখেছি।”

চঞ্চল বলল, “আমাদের ক্লাসের অর্ধেকের বেশি মেয়ে।”

অনু বলল, “আর আমরা যে মেয়েদের চিনি তারা খুবই ভালো। তারা খুবই সুইট। তারা কাউকে টিংটিংয়ে ডাকে না, কাউকে ভোটকাও ডাকে না।”

টিটন বলল, “তুমি মেয়ে বলে বেঁচে গেছ। ছেলে হলে এই রকম খারাপ খারাপ কথা বলার জন্যে পিটিয়ে তক্তা করে দিতাম। নতুন এসেছ বলে খাতির করতাম না।”

মেয়েটা খুবই মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনল তারপর মাথা নেড়ে বলল, “তা হলে দোষটা আমার? আমিও তা হলে বলতে পারি আমি অনেক ছেলেদের চিনি তারা কেউ আমাকে ডেকে এনে বলে না তুমি মেয়ে, তোমাকে আমাদের দরকার নেই। তুমি চলে যাও।”

আমি বললাম, “আমি ঠিক এইভাবে বলি নাই।”

“বলেছ।”

“আমি অনেক ভদ্রভাবে বলেছি।”

“খারাপ কথা ভদ্রভাবে বললে ভালো হয়ে যায় না। খারাপই থাকে।”

অনু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “তুমি আমাকে ভোটকা বলেছ।”

মেয়েটাকে এই প্রথমবার একটু কাচুমাচু দেখাল, বলল, “আমি সরি। তোমরা শুনে ফেলবে আমি বুঝি নাই। আর বলব না। আর মনে রাখ তোমরাও বলেছ আমাকে পিটিয়ে তক্তা বানাবে। আমি সেটা শুনে ভয় পাই না, কিন্তু তোমরা সেটা আমাকে বলেছ।”

চঞ্চল এবারে বড় মানুষের মতো বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে। দুই পার্টিই ভুল করেছে। ভুলে ভুলে কাটাকাটি।”

টুনি নামের মেয়েটা রাজি হল। বলল, “ঠিক আছে ভুলে ভুলে কাটাকাটি।”

চঞ্চল বলল, “তুমি চাইলে আমাদের সাথে আসতে পার। আমার আপু আছে, রাতুলের বোন মিথিলা আছে তাদের সাথে তোমাকে কথা বলিয়ে দেই। তুমি তাদের সাথে গল্প করতে পারবে, খেলতে পারবে।”

“আগে হলে হয়তো তাই করতাম। এখন দেরি হয়ে গেছে।”

চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কীসের দেরি হয়ে গেছে?”

“এই যে তোরা আমাকে খসানোর চেষ্টা করছিস! আমি খসব না। আমি চিনে জোঁকের মতো তোদের সাথে লেগে থাকব।”

মেয়েটার কথা শুনে আমরা এতো অবাক হলাম যে, সে আমাদের তুই করে বলতে শুরু করেছে সেটা পর্যন্ত খেয়াল করলাম না। আমি আমতা আমতা করে বললাম, “চি-চিনে জোঁকের মতো?”

“হ্যাঁ। আমি অবশ্যি কখনো চিনে জোঁক দেখি নাই। শুধু বইয়ে পড়েছি যে মানুষ চিনে জেঁকের মতো লেগে থাকে। এখানে কি চিনে সেঁক আছে?”

চঞ্চল মাথা নাড়ল, “আছে।”

“ঢাকা শহরে কোনো চিনে জোঁক নাই। আসলে ঢাকা শহরে তেলাপোকা আর মশা ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী নাই।”

আমি লক্ষ করলাম মেয়েটা অন্য কথা বলে আসল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছে। আমি তাকে আসল বিষয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম, “তুমি আমাদের সাথে চিনে জেঁকের মতো লেগে থাকবে?”

“হ্যাঁ।”

“আমরা ছেলেরা যেগুলো করি সেইগুলো তোমার ভালো না লাগলেও তুমি আমাদের সাথে থাকবে?”

“হ্যাঁ।”

“আমরা যদি তোমাকে দলে নিতে না চাই তা হলেও তুমি আমাদের দলে ঢুকতে চাইবে?”

“হ্যাঁ।”

“আমরা যদি তোমাকে এড়িয়ে চলি? তোমার কথার উত্তর না দেই? তোমাকে পাত্তা না দেই? খারাপ ব্যবহার করি? অপমান করি? তা হলে? তা হলে কী করবে?”

“অনেক কিছু করার আছে। সোজাটা বলব না কঠিনটা বলব?”

“সোজাটা শুনি।”

মেয়েটা তার পকেট থেকে টেলিফোন বের করে সেটাকে একটু টিপাটিপি করে একটা নম্বর বের করে আমাদের দেখাল। বলল, “এখানে কী লেখা আছে? পড়।”

আমরা পড়লাম, ইভটিজিং হট লাইন। মেয়েটা বলল, “আমি এই নম্বরে ফোন করে বলব চারটা ছেলে আমাকে ইভটিজিং করছে। তখন তারা পুলিশকে ফোন করবে। পুলিশ ফোন করবে র‍্যাবকে। তারপর পুলিশ আর র‍্যাব মিলে এসে তোদের কাঁক করে ধরে নিয়ে যাবে।” মেয়েটা দাঁত বের করে হাসল, আর আমরা দেখলাম সে যখন হাসে তখন তাকে দেখতে বেশ ভালো মানুষের মতোই দেখায়। এরকম একটা ডেঞ্জারাস মেয়ে এরকম ভালো মানুষের মতো হাসতে পারে আমার সেটা নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস হতে চাইল না। আমি বললাম, তুমি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছ, তাই না?”

“যতক্ষণ ঠাট্টা ততক্ষণ ঠাট্টা। যখন সিরিয়াস তখন সিরিয়াস।”

কথাটার মানে কী আমরা কেউই ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমরা হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাসার কাছে যে পেয়ারা গাছটা আছে তার কাছে চলে এসেছি। মেয়েটাকে খুব ভদ্রভাবে খসিয়ে দেওয়ার উপায় হচ্ছে পেয়ারা গাছটাতে উঠে বসে থাকা। মেয়েটা তখন তো আর নিচে থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমাদের সাথে কথা চালিয়ে যেতে পারবে না। খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে চলে যাবে। তাই আমরা আর কথা না বাড়িয়ে পেয়ারা গাছে উঠে গেলাম। আমি টিটন আর চঞ্চল সহজেই গাছে উঠতে পারি। অনুকে নিচে থেকে একটু ঠেলতে হয়। টুনি নামের মেয়েটাকে দেখানোর জন্যে আজকে অনু নিজেই হাচর-পাঁচর করে উঠে গেল।

মেয়েটা নিচে থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখ দুটোতে কেমন যেন আনন্দের ছায়া পড়ল। খুশি খুশি গলায় বলল, “কী মজা! তোরা সত্যিকার গাছে উঠে বসে থাকিস! এটা কী গাছ? আম গাছ না কি?”

মেয়েটা পেয়ারা গাছ পর্যন্ত চেনে না। আমি বললাম, “না, এটা পেয়ারা গাছ।”

“কী মজা! ঢাকা শহরে কোনো গাছ নাই। খুব বেশি হলে লাইটপোেস্ট আছে। আমি উঠি?”

আমরা চমকে উঠলাম, বলে কী মেয়েটা? চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “তুমি আগে কখনো গাছে উঠেছ?”

“উঠি নাই তো কী হয়েছে? সবকিছুরই তো প্রথমবার আছে।”

আমি বললাম, “পড়ে ব্যথা পেলে কিন্তু আমাদের দোষ দিও না।”

“ভয় নাই। দিব না।” বলে মেয়েটা গাছটা ধরে বেশ তরতর করে বানরের মতো গাছে উঠে গেল। উপরে উঠে সে একেবারে বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে ওঠে, “একদম সোজা! আমি চিন্তাও করি নাই গাছে উঠা এতো সোজা! আর গাছের উপর থেকে সবকিছু দেখতে কী মজা লাগে দেখেছিস?”

আমরা চারজন মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের এতো সুন্দর পরিকল্পনাটা এভাবে মাঠে মারা যাবে একবারও চিন্তা করিনি। শুধু যে মাঠে মারা গেছে তা না বরং উল্টো দিকে কাজ করেছে। লাভের বদলে হয়েছে ক্ষতি।

টুনি গাছে পা ঝুলিয়ে বসে বলল, “তোদের সাথে যখন প্রথম দেখা হল তখন ভেবেছিলাম তোদের যখন মেয়েদের নিয়ে এতো এলার্জি তা হলে তোরা থাক তোদের মতো। আমি থাকব আমার মতো। পরে মনে হল কেন এতো সহজে তোদের ছেড়ে দিব? জোর করে তোদর মাঝে ঢুকে যাব। এটা হবে আমার একটা প্রজেক্ট।”

“প্রজেক্ট?” চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কীসের প্রজেক্ট?”

“মনে কর আমি ব্লগ লিখতে পারি আমি মেয়ে বলে কীভাবে চারজন ছেলে আমাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে কিন্তু আমি চিনে জোঁকের মতো লেগে থেকে এক সময় তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছি!”

আমি আপত্তি করে বলতে চাইলাম যে আমরা”ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি, কথাটা ঠিক না। টিটন বলতে চাইল যে টুনি নেতৃত্ব গ্রহণ করবে বিষয়টা এতো সোজা না, অনু বলতে চাইল যে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলতে হলে সেখানে চিনে জোঁকের উদাহরণ দেওয়া ঠিক না কিন্তু চঞ্চলের মতো শান্ত-শিষ্ট মানুষ প্রায় চিৎকার করে বলল, “তুমি ব্লগ লিখ?”

“মাঝে মাঝে লিখি।”

চঞ্চল প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, “তোমার কম্পিউটার আছে?”

“পুরান-ধুরান ভাঙাচুরা একটা ডেস্কটপ আছে। মাঝে মাঝে হার্ড ড্রাইভ থেমে যায় তখন জোরে লাথি দিতে হয়, তখন আবার চলে। ভাইরাসে ভাইরাসে বোঝাই।”

চঞ্চল চোখ বড় বড় করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, আমরা বুঝতে পারলাম যে টুনির সবকিছু মাফ করে দিয়েছে! কয়দিন পর দেখা যাবে চঞ্চল আমাদের ফেলে দিয়ে টুনির বাসায় তার কম্পিউটারের সামনে পড়ে আছে। আমি টিটন আর অনু বোকার মতো তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারা কী নিয়ে কথা বলছে সেটাই বুঝতে পারছি না। বেইজ্জতি আর কাকে বলে!

চঞ্চলের কম্পিউটার না থাকতে পারে কিন্তু তার ঘর বোঝাই যে কতো রকম যন্ত্রপাতি সেটা টুনিকে বলা দরকার, তা না হলে সে মনে করতে পারে আমরা সবাই বুঝি আলতু-ফালতু মানুষ। অন্যের কম্পিউটারের দিকে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকি। আমি তাই বললাম, “আমাদের চঞ্চল কিন্তু অনেক বড় সাইন্টিস্ট!

টুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “সাইন্টিস্ট।”

চঞ্চল লজ্জা পেয়ে বলল, “ধুর! ফাজলেমি করবি না!”

“মোটেও ফাজলেমি করছি না। চঞ্চলের অনেকগুলো আবিষ্কার আছে। তুই যদি তার ল্যাবরেটরি ঘরটা দেখিস ট্যারা হয়ে যাবি।”

কথাটা শেষ করেই আমি বুঝতে পারলাম আমিও এখন টুনিকে তুই বলা শুরু করেছি!

অনু আর টিটন দুইজনই মাথা নাড়ল। অনু বলল, “একটা টেলিস্কোপ তৈরি করেছে সেটা দিয়ে চাঁদ দেখলে মনে হবে তুই চাঁদটা ছুঁতে পারবি! এতো কাছে।”

টিটন বলল, “প্রত্যেক মাসে চঞ্চল কিছু না কিছু আবিষ্কার করে।“ সে উৎসাহের চোটে বলেই ফেলল, “আমাদের গুপ্তধন খোঁজার জন্যে একটা যন্ত্র বানাবে, সেটা দিয়ে বাইরে থেকে ভিতরের জিনিস দেখা যাবে। তাই নারে?”

আমি কনুই দিয়ে টিটনকে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “এইটা গোপনীয় কথা। কাউকে বলার কথা না। গাধা কোথাকার।”

টিটনের মনে পড়ল এবং জিবে কামড় দিল। টুনি কিছু না বুঝে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে? গুপ্তধন? কীসের গুপ্তধন?”

আমরা সবাই একসাথে মাথা নাড়লাম, “কিছু না। কিছু না।”

টুনি বুঝে গেল আমরা বলতে চাচ্ছি না তাই সে আমাদের চাপ দিল না, কিন্তু মুখ দেখে বোঝা গেল তাকে বলিনি দেখে তার একটু মন খারাপ হয়েছে। আমি কথাটা ঘোরানোর জন্যে বললাম, “আর আমাদের অনু হচ্ছে বিশাল সাহিত্যিক। লক্ষ লক্ষ বই পড়েছে।”

টিটন বলল, “ওদের বাসার বিড়ালটাও বই পড়তে পারে।”

চঞ্চল বলল, “যে কোনো জিনিসের বানান জিজ্ঞেস করলে বলে দিতে পারে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিংবা মাগৃতিবিকৃতি”

অনু বলল, “মাগৃতিবিকৃতি কোনো শব্দ নাই।”

“ঐ হল! বোঝানোর জন্যে বলেছিলাম।” আমি বললাম, “অনুর সব কবিতা মুখস্থ। পৃথিবীর সব কবিতা।” অনু লজ্জা পেয়ে বলল, “ধুর! মিথ্যা কথা বলবি না।”

“মিথ্যা কথা?” আমি বললাম, “ঐ যে ভীত কুকুর পালিয়ে যায় সেই কবিতাটা পুরাটা তোর মুখস্থ না?”

“এবার ফিরাও মোরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পুরাটা মুখস্থ নাই।”

টুনি বলল, “শোনাও দেখি কতোটুকু মুখস্থ আছে?”

অনু বলল, “গাছের ডালে বানরের মতো ঝুলে ঝুলে কবিতা আবৃত্তি করা যায় না কি!”

টুনি বলল, “আবৃত্তি করতে হবে না–মুখস্থ বলে যাও।”

অনু জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

টুনি বলল, “দেখব কতোটুকু মুখস্থ।”

অনু বলল, “খুব তাড়াতাড়ি বলি?”

“বল।”

অনু তখন ঝড়ের মতো এক নিশ্বাসে কবিতাটা মুখস্থ বলতে থাকে। বেচারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি এটা দেখতেন তা হলে মনে হয় একটু মন খারাপ করতেন। তার কবিতাটা একজন এভাবে সাপের মন্ত্রের মতো টানা বলে যাচ্ছে–মন খারাপ তো হতেই পারে। এই কবিতাটার মাঝে যখন অনু ধামকি দিয়ে পথকুকুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে” অংশটুকু বলেছে তখন টুনির টেলিফোনটা আবার বাজল, ফোনটা ধরেই টুনি চিৎকার করে বলল, “টুশি তুই চিন্তাও করতে পারবি না আমি এখন কোথায়!”

টুনি নিশ্চয়ই অনুমান করে বলার চেষ্টা করেছে সে কোথায়, কিন্তু কোনোটাই হল না, তখন টুনি চিৎকার করে বলল, “আমি একটা গাছের উপর! সত্যিকারের গাছ! চারদিকে ছোট ছোট বিন্দি বিন্দি পেয়ারা। ইচ্ছা করলেই ছিঁড়তে পারি!”

এই জিনিসটা কেন এতো উত্তেজনার আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মনে হল টুনি এবং টুশি দুজনেই এটা নিয়ে খুব উত্তেজিত। একটু পরেই টুশি নিশ্চয়ই টুনির কাছে জানতে চাইল”আজিব” ছেলেগুলোর কী খবর, কারণ শুনলাম টুনি বলছে, “ও হ্যাঁ। আজিব ছেলেগুলো আছে আমার কাছেই, আমি ওদের সাথেই গাছে বসে আছি! হা হা, ওরা আসলেই আজিব। তবে খারাপভাবে আজিব না ভালোভাবে আজিব। একজন হচ্ছে সায়েন্টিস্ট খালি আবিষ্কার করে। আরেকজনের পুরা সঞ্চয়িতা মুখস্থ। একেবারে গুলির মতো মুখস্থ বলে যায়। টুশি তুই বিশ্বাস করবি না জায়গাটা কতো সুন্দর, চারদিকে গাছপালা, সেইখানে.আবার সত্যিকারের পাখি। আমাদের বাসার সামনে বিশাল মাঠ, এক মাথা থেকে অন্য মাথা দেখা যায় না এতো বড়! এখানে কোনো গাড়ি নাই, ট্রাফিক জ্যাম নাই। বাতাস পরিষ্কার। নিশ্বাস নিলে মনে হয় পরিষ্কার বাতাস দিয়ে ফুসফুসটা ধুয়ে ফেলছি। তুই একবার আয়, দেখলে ট্যারা হয়ে যাবি?”

টুনি অনেকক্ষণ ফোনে কথা বলে শেষ পর্যন্ত ফোনটা রাখল, রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটার ঢাকার জন্যে মন খারাপ হচ্ছে। টেলিফোনে বন্ধুর কাছে বানিয়ে বানিয়ে এই জায়গাটা নিয়ে ভালো ভালো কথা বলছে, কিন্তু আসলে যারা বড় শহরে থাকে তারা কখনো ছোট জায়গায় এসে ভালো থাকে না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “টুশি তোর বন্ধু?”

“ওর নাম টুশি না। ওর নাম তাসনুভা। আমি আমার নামের সাথে মিলিয়ে টুশি ডাকি।”

“ও।“

আমরা আরো কিছুক্ষণ গাছে বসে রইলাম। একটু পর আরো বাচ্চা-কাচ্চারা বের হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল তখন আমরা গাছ থেকে নেমে এলাম। টুনিকে একজন নতুন মানুষ দেখে সবাই আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মিথিলাও ছুটতে ছুটতে এলো, বলল, “আপু, তুমি ভাইয়াদের সাথে গাছে উঠে বসেছিল? সর্বনাশ! তুমি জান ভাইয়ারা কি করে? আর কখনো ওদের সাথে মিশবে না! তোমার মাথার উপরে বিষ পিঁপড়া দিয়ে দিবে। আমার নাম মিথিলা। ক্লাস সিক্সে পড়ি। পি. কে. গার্লস স্কুল। তুমি কোন ক্লাসে পড়? আগেই বল না, আমি আন্দাজ করি। ক্লাস সেভেন। হয়েছে? কোন স্কুলে পড়বে তুমি? প্লীজ প্লীজ তুমি আমাদের স্কুলে ভর্তি হবে। প্লীজ প্লীজ। তোমার নাম কী আপু? দাঁড়াও দাঁড়াও আগেই বল না, আমি আন্দাজ করি। তোমার নাম নিতু। হয় নাই? তা হলে প্রিয়াংকা? হয় নাই? মিলি? হয় নাই? লীনা? হয় নাই?”

আমার টুনির জন্যে মায়া লাগতে থাকে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *