দরজার ওপাশে – ০৭
বেল টিপতেই মোবারক হোসেন সাহেব নিজেই দরজা খুলে দিলেন। সহজ গলায় বললেন,এস হিমু। যেন তিনি আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।
সাধারণ মানুষ থেকে মন্ত্রী পর্যায়ে উঠা খুব কঠিন, কিন্তু নেমে আসাটা অত্যন্ত সহজ। মোবারক সাহেবকে দেখে তাই মনে হচ্ছে। উনার পরণে সাদা লুঙ্গি। খালি গা। কাঁধে ভেজা গামছা।
তিনি সহজ গলায় বললেন, শরীরটা তেতে আছে। ভিজে গামছা দিয়ে রাখলাম। এতে শীরর ঠাণ্ডা থাকে। কোন খবর আছে হিমু?
‘না কোন খবর নেই। আপনার খবর নিতে এসেছি।’
‘আমার খবর নেবার জন্যে তো বাড়িতে আসার দরকার পড়ে না। পত্রপত্রিকায় রোজই কিছু না কিছু বেরুচ্ছে। পত্রিকা পড় না?’
‘মাঝে মাঝে পড়ি।’
‘আমার খবর সব আপ-টু-ডেট জান তো?’
‘কিছু কিছু জানি।’
‘ব্যাংক একাউণ্ট ফ্রীজ করা হয়েছে, এটা জান?’
‘না।’
‘ব্যাংক একাউণ্ট ফ্রীজ করা হয়েছে। বুদ্ধিমান লোক মাঝে মাঝে প্রথম শ্রেণীর বোকার মত কাজ করে, আমিও তাই করেছি। টাকা-পয়সা অনেক ব্যাংকেই ছিল। ছিল আমার নিজের নামে। কিছু যে অন্যের নামে রাখা দরকার, কিছু ক্যাশ দরকার, এটা কখনো মনে হয়নি।’
‘আপনার ব্যাংকে কত টাকা আছে?’
জবাব দেবার আগে মোবারক সাহেব কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, পাঁচ কোটি টাকার মত।
আমার ঠিক আগের মত বারান্দায় বসলাম। মোবারক হোসেন সাহেব ইজিচেয়ারে শুয়ে মোড়ায় পা তুলে দিলেন। তিতলীকে ডেকে বললেন টক দৈ দিতে।
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
‘পাঁচ কোটি টাকা আছে জানার পরেও তুমি দেখি তেমন অবাক হওনি। পাঁচ কোটি টাকা যে কত টাকা সে সম্পর্কে বোধহয় তোমার ধারণা নেই।’
‘অনেক টাকা বুঝতে পারছি।’
‘পারছ বলে মনে হয় না। অনেক তো বটেই । সেই অনেকটা কত অনেক তা কি জান? পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে কি করা যায় বল তো?’
‘পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে দিয়াশলাই কেনা যায়। একটা দেয়াশলাইয়ের দাম এক টাকা। তবে একসঙ্গে এত টাকার দেয়াশলাই কিনলে কিছুটা বোধহয় সস্তায় দেবে। আট আনা পিস পাওয়া যেতে পারে। তাহলে দশ কোটি দেয়াশলাই পাওয়া যাবে। এই জীবনে আর দেয়াশলাই কিনতে হবে না।’
‘তুমি ব্যাপারটাকে ফানি সাইডে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছ। ফানি সাইডে নেবার দরকার নেই—পাঁচ কোটি টাকা যে কি পরিমাণ টাকা আমি অন্যভাবে তোমাকে ধারণা দেই। ধর, টাকাটা তুমি যদি শুধু ব্যাংকে রেখে দাও তাহলে কি হবে? ফিফটিন পারসেন্ট রেটে ইন্টারেস্ট কত আসে? মনে মনে হিসেব করতে পার। ফাইভ টাইমস ফিফটিন, ডিভাইডেড বাই….’
আমি তাকিয়ে আছি । মোবারক হোসেন সাহেব চোখ বন্ধ করে হিসেব করে যাচ্ছেন। তিতলী যখন এসে বলল, বাবা দৈ নাও, তখন বিরক্ত মুখে চোখ মেললেন। তাঁর হিসেবে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। অসময়ে আসার জন্যে তিনি মেয়ের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। তিতলী বলল, বাবা, আমি তোদের সঙ্গে বসব?’
‘আমাদের সঙ্গে বসার দরকার কি?’
‘বারান্দায় চা দিতে বলেছি এই জন্যেই বসতে চাচ্ছি।’
সে আমার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসল। বাবাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমাকে বলল, ভাইয়ার কোন খোঁজ পেয়েছেন?
‘না।’
‘খোঁজার চেষ্টা করেছেন?’
‘না, তাও করিনি।’
‘এই সত্যি কথাটি যে বললেন, তার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। এসেছেন কি জন্যে? আমাদের দুর্দশা দেখতে?’
আমি সহজ গলায় বললাম, আমি আসলে একটা সুপারিশ নিয়ে এসেছি। একজনের চাকরি-বিষয়ে একটা সুপারিশ। আমার এক বন্ধুর চাকরি চলে গেছে। পুরোপুরি এখনো যায়নি, সামান্য সুতায় ঝুলছে। আপনার বাবার সুপারিশে হয়ত তার চাকরিটা হবে।
তিতলী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। মোবারক হোসেন সাহেব কৌতুহলী গলায় বললেন, তুমি কি সত্যি সুপারিশ নিতে এসেছ?
‘জ্বি স্যার। সবাই তো মন্ত্রীত্ব থাকাকালিন সময়ে নানান সুপারিশ নিয়ে আসে, আমি এসেছি যখন আপনার মন্ত্রীত্ব নেই। কিছুই নেই।’
‘তুমি তাহলে জেনেশুনেই এসেছ আমার সুপারিশে কাজ হবে না?’
‘তা নয় স্যার। আমি জানি, আপনার সুপারিশে এখন অনেক বেশি কাজ হবে। কারণ সবাই জানে, আপনি আবার স্টেজে আসবেন। আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যদিও এখন আপনি কেউ না—নো বডি; তবু ভবিষৎতের কথা ভেবে তারা আপনাকে খুশি রাখবে।’
‘যার সুপারিশ করতে এসেছে তার নাম কি? সুপারিশ কার কাছে করতে হবে?’
আমি পকেট থেকে কাগজ বের করতে করতে বললাম, সব এখানে লেখা আছে স্যার। ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর নাম রফিক।
‘তুমি বস, আমি টেলিফোন করে দেখি। তোমার কথা সত্যি কি-না পরীক্ষা হয়ে যাক।’
আমি চুপচাপ বসে রইলাম। তিতলী নামের রাগী এবং অহংকারী মেয়েটি আমার সামনে বসে আছে। তার ঠোঁট হাসির ক্ষীণ আভাস। কি মনে করে সে হাসছে কে জানে। আমি বললাম, আপনার মা কেমন আছেন?
‘ভাল না।’
‘উনার ঠিকানাটা আমাকে দেবেন,উনাকে একটু দেখতে যাব?’
‘কেন?’
‘এম্নি যাব।’
‘আপনি বিনা উদ্দেশ্যে কিছু করেন না। আপনার কোন একটা উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা বলুন। তারপর ঠিকানা দেব।’
উদ্দেশ্য বলার সময় হল না। মোবারক হোসন সাহেব ফিরে এসেছেন। তিনি ইজিচেয়ারে বসতে বসতে বললেন, হিমু,তুমি তোমার বন্ধুকে আগামীকাল চাকরিতে জয়েন করতে বল। আমি কথা বলেছি।
‘ধন্যবাদ স্যার, আমি তাহলে উঠি?’
‘বোস, চা খেয়ে যাও। চা আনছে।’
এদের বাড়ির বড়বুবু চা দিয়ে গেছে। মোবারক হোসেন সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তিতলী চায়ের কাপ মুখের কাছে নিয়ে নামিয়ে রেখেছে। মনে হচ্ছে কিছু বলবে, কি বলবে তা গুছাতে সময় লাগছে। সে বাবার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। মোবারক সাহবে বললেন, তোর কি হয়েছে?
‘কিছু হয়নি।’
‘এরকম করে তাকাচ্ছিস কেন?’
‘যেভাবে আমি তাকাই সেই ভাবেই তাকাচ্ছি।’
‘তুই এখান থেকে যা। আমি হিমুর সঙ্গে কথা বলব।’
‘যা বলার আমার সামনেই বল। আমি কোথাও যাব না।’
সে আবারো চায়ের কাপে মুখের কাছে নিল, আবারো নামিয়ে রাখল। মেয়েটির এই হঠাৎ পরিবর্তনের কোন কারণ ধরতে পারছি না। আমি চা শেষ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, স্যার আজ যাই। অন্য আরেক দিন আসব। তিতলী বলল, অন্যদিন টন্যদিন না। আপনি আর এ বাড়িতে আসবেন না। আর কেউ জানুক না জানুক আমি জানি ভাইয়া নিখোঁজ হয়েছে আপনার কারণে। আপনাকে আমি এত সহজে ছাড়ব না।
আমি আবার বসে পড়লাম। মোবারক সাহেব বললেন, কটা বাজে দেখতো হিমু।
‘স্যার আমার সঙ্গে ঘড়ি নেই।’
মোবারক সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর ঘড়িতে কটা বাজ মা? তিতলী জবাব না দিয়ে উঠে পড়ল। তেজী ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে গেল। মোবারক সাহেব বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মেয়েটা দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ছে। টেনশান নিতে পারছে না। ঘন ঘন ইমোশনাল আউটবাস্ট হচ্ছে। সুখের কথা হচ্ছে এইসব আউটবাস্টের স্থায়িত্ব অল্প। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নিজেকে সামলে নেবে। হিমু ঐ শোবার ঘরে ঢুকে দেয়াল ঘড়িতে সময় কত হয়েছে দেখ তো?’
আমি ঘড়ি দেখলাম, ন’টা একুশ। তিনি আবার র্দীঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। নিজের মনে কথা বলছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, তিতলীর মা’কে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্যে নেয়া দরকার। ব্যাংককের আমেরিকান হাসপাতাল ভাল চিকিৎসা করে সেখানেই নেয়ার কথা, নিতে পারছি না। টাকার সমস্যা তো আছেই, তার চেয়েও বড় সমস্যা আমাকে বাইরে যেতে দেবে না। একজনের কাছে টাকা চেয়েছিলাম, রাত আটটায় তার দিয়ে যাবার কথা। মনে হয় সে আর আসবে না। তোমার কি মনে হয়?
‘না আসার সম্ভাবনাই বেশি।’
‘মানুষকে চেনা বড়ই মুশকিল। যার টাকা নিয়ে আসার কথা সেও বলতে গেলে কোটিপতি।
তাকে কোটিপতি করেছি আমি। প্রয়োজনীয় পারমিটগুলির আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি। হিমু. তোমার কি ধারণা এই পৃথিবীতে কত ধরনের মানুষ আছে?
স্যর. পৃথিবীতে মাত্র দু’ ধরনে মানুষ আছে।’
’দু’ ধরনের?’
’জ্বি. আমি সমস্ত মানুষকে দুভাগে ভাগ করেছি। প্রথম ভাগে আছে ‘হ্যাঁ- মানুষ ।’ এরাই দলে ভারী। বলতে গেলে সবাই এই দলে। মানুষের সব গুণ তাদের মধ্যে আছে, আবার দোষও আছে। কোনটাই বেশি না। সমান সমান। প্রকৃতি সাম্যাবস্থা পছন্দ করে। একটা পরমাণুর কথাই ধরুণ না কেন, পরমাণুতে নেগেটিভ চার্জের যতগুলি ইলেকট্রন আছে পজিটিভ চার্জের ঠিক ততগুলিই প্রোটন আছে।
‘হ্যাঁ মানুষ’গুলি পরমাণুর মত।
দ্বিতীয় দলে আছে, ‘না-মানুষ।’ মানুষের কোন কিছুই তাদের মধ্যে নেই, তারা শুধু দেখতেই মানুষের মত। আসলে এরা পিশাচ ধরনের। প্রকৃতির সাম্যাবস্থা নীতি এদের মধ্যে কাজ করে না। এদের মনে কোন রকম মমতা নেই। একটা খুন করে এসে হাত মুখ ধুয়ে ভাত খাবে, পান খাবে, সিগারেট টানতে টানতে দু’একটা মজার গল্প করে ঘুমুতে যাবে। তাদের ঘুমের কোন সমস্যা হবে না। কারণ ‘না-মানুষ’রা সাধারণত স্বপ্ন দেখে না। আর দেখলেও দুঃস্বপ্ন কখনো দেখে না।’
‘এই জাতীয় মানুষ তুমি দেখেছ?’
‘জ্বি দেখেছি, এই জাতীয় মানুষদের সঙ্গে আমি অনেকদিন ছিলাম। আমরা মামারা সবাই এই জাতীয় মানুষ।’
‘‘বল কি?’
‘‘আমার বড় মামা নিজে খুন হয়েছিলেন। কিন্তু লোকজন মাছ মারার বড় থোর দিয়ে তাঁকে এফোড় ওফোড় করে ফেলেছিল। এই অবস্থাতেও তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ ডেথ বেড কনফেসন করে চারজন নির্দোষ মানুষকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেলেন। বললেন এরাই তাকে মেরেছে। ডেথ বেড কনফেসনের কারণে ঐ চারজনের যাবজ্জীবন হয়ে গেছে।’
‘আশ্চার্য।’
‘আমার মেজো মামা গোটা পাঁচেক খুন করেছেন। অতি ধুরুন্দর ব্যক্তি। তাকে কেউ ফাঁসাতে পারেনি। বহাল তবিয়তে এখনো বেঁচে আছেন—সত্তুরের উপর বয়স। চোখে দেখতে পান না। কেউ কাছে গিয়ে বসলে খুনের গল্প করেন। এই গল্প বলতে পারলে খুব আনন্দ পান। তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি মানুষ জবেহ করলে কণ্ঠনালী দিয়ে ফুস করে বাতাস বের হয়।’
‘চুপ কর।’
আমি গল্প থামিয়ে মোবারক সাহেবের মতই পা নাচাতে লাগলাম। মোবারক সাহেব আধশোয়া অবস্থা উঠে বসলেন, তিক্ত গলায় বললেন, ‘অবলীলায় তুমি এই গল্প করলে। তোমার খারাপ লাগলনা?’
‘না।’
‘ওদের রক্ততো তোমার শরীরেও আছে।’
‘ তা আছে। আমার বাবা দেখে শুনে ঐ পরিবারে বিয়ে করেছিলেন যাতে আমি মায়ের দিক থেকে তেইশটি ভয়াবহ ক্রমোজম নিয়ে আসতে পারি।’
‘আনতে পেরেছ?’
‘ঠিক ধরতে পারছি না।’
‘না-মানুষদের কথা শুনলাম। সাধু সন্ন্যাসীরা কোন শ্রেণীর? যারা মহাপুরুষ তাদের দলটা কি?’
‘তারাও না-মানুষ। পিশাচ এবং মহাপুরুষ সবাই এক দলে। এরা মানুষ নন।’
‘এই জাতীয় কথাবার্তা কি তুমি সব সময় বল, না আজ আমাকে বলছ?’
‘সব সময় বলার সুযোগ হয় না। সুযোগ হলে বলার চেষ্টা করি। আমার কিছু শিষ্য আছে। এরা আগ্রহ করে আমার কথা শুনে, বিশ্বাসও করে।’
‘তুমি নিজেকে কোন দলে ফেল?’ না-মানুষে’র দলে?’
‘জ্বি না। তবে ‘না-মানুষ’ হবার চেষ্টা করছি,যদিওবা জানি চেষ্টা করে ‘না-মানুষ’ হওয়া খুব কঠিন। জন্মসুত্রে হতে হয়। আপনি যেমন জন্মসূত্রে না-মানুষ।’
‘পিশাচ অর্থে বলছ নিশ্চয়ই।’
‘জ্বি পিশাচ অর্থেই বলছি। তবে পিশাচ ‘না-মানুষ’দের একটা বড় সুবিধা হচ্ছে এরা খুব সহজেই মহাপুরুষ ‘না-মানুষ’ হতে পারে। ‘হ্যাঁ-মানুষ’রা তা কখনোই পারবে না।’
‘তুমি কি আমাকে ‘প্রীচ’ করার জন্যে এসব কথা বলছ?’
‘জ্বি-না, আমি ধর্ম প্রচারক না। আমি একজন সাধারণ ‘হ্যাঁ-মানুষ’, যে একজন বন্ধুর চাকরির জন্যে মন্ত্রীর কাছে ছোটাছুটি করে। মহাপুরুষরা এই কাজ কখনো করবেন না। তাঁদের মমতা কখনো একজনের জন্যে না—অনেকের জন্যে। তাঁরা ব্যক্তিকে দেখেন না, তাঁরা সমস্টিকে দেখেন।’
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
‘যাও বাড়ি যাও। একটা কথা তোমাকে বলি—তুমি অতিশয় ধুরন্দর ব্যক্তি। সূঁচ হয়ে ঢোকার চেষ্টায় আছ। আমার ব্যাপারে এই চেষ্টা করবে না। শিষ্য হবার বয়স আমার না। এই বয়সে তোমার শিষ্য হবে এরকম মনে করার কোন কারণ ঘটেনি। আল্লা,খোদা, পাপ, পুণ্য এসব নিয়ে আমি কোন দিনই মাথা ঘামাইনি। ভবিষ্যতেও ঘামাব না। যাবার আগে আরেকটি কথা শুনে যাও—তুমি যে কাজে এসেছিলে সে কাজ হয়ে গেছে—বন্ধুর চাকরি হয়েছে। কাজেই এ বাড়িতে আর আসবে না।’
‘জ্বি আচ্ছা স্যার। জহিরের কোন খোঁজ যদি পাই তাহলে কি আসব?’
‘না। তাহলেও আসবে না। ভাল কথা জহিরও কি তোমার শিষ্য?’
‘জ্বি না। এ পর্যন্ত মাত্র দু’জন শিষ্য পেয়েছি। আমার ফুফাতো ভাই বাদল, তার তরঙ্গিনী ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরের সেলস-ম্যান আসাদ।’
‘উপদেশ দেয়া আমার স্বভাব না। তবু একটা উপদেশ দেই, শিষ্যের সংখ্যা আর বাড়িও না।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘তুমি কর কি? কাজকর্মের কথা বলছি না। কাজকর্ম যে কিছু কর না তা বুঝতে পারছি—তারপরেও মানুষ কিছু করে, সেটাই জানতে চাচ্ছি।’
‘আমি ঘুরে বেড়াই। ইন্টারেস্টিং কোন কিছু চোখে পড়লে আগ্রহ নিয়ে দেখি।’
‘একটা ইন্টারেস্টিং জিনিসের কথা বল, তাহলে বুঝতে পারব কোনটা তোমার কাছে ইন্টারেস্টিং কোনটা নয়।’
‘সব কিছুই আমার কাছে মোটামুটি ইন্টারেস্টিং লাগে। তবে একটা দৃশ্য একবার দেখলেই ইন্টারেস্ট নষ্ট হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার দেখতে ইচ্ছে করে না। সেই অর্থে সব ইন্টারেস্টিং জিনিসই মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। দু’একটা বাকি। সেগুলি দেখা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
‘আমাকে বল,দেখি আমি পারি কি না।’
‘একটা মানুষকে যখন ফাঁসি দেয়া হয় তখন সে কি করে তা আমার খুব দেখার শখ। অর্থাৎ ফাঁসির মঞ্চে উঠবার আগে সে কি করে তাকায়, কিভাবে নিঃশ্বাস নেয়। অবধারিত মৃত্যুর কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু মৃত্যুক্ষণ জানি না বলে ব্যাপারটা বুঝতে পারি না। যদি মৃত্যুক্ষণটা জেনে যাই তখন কি হয় সেটাই আমার দেখার বিষয়।’
‘মানুষদের যে দু’টি শ্রেণীর কথা বললে তার বাইরেও একটা শ্রেণী আছে—উণ্মাদ শ্রেণী। তুমি সেই শ্রেণীর। এমন উণ্মাদ যা চট করে বোঝা যায় না। আমার আগে কি তোমাকে এই কথা কেউ বলেছে?’
‘আমার ফুপা প্রায়ই বলেন?’
‘তাঁকে আমার রিগার্ডস দেবে। তিনি নিশ্চয়ই তাঁর বাড়িতে তোমাকে ঢুকতে পাঁচশ টাকা পাই।’
‘শুনে ভাল লাগল। আচ্ছা তুমি যাও। তুমি আমার যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছ, আর না।’
রাস্তায় নেমে অনেকক্ষণ চিন্তা করলাম কোথায় যাব। রফিককে চাকরির খবরটা দেয়ার জন্যে নারায়ণগঞ্জ যাওয়া দরকার। যেতে ইচ্ছে করছে না, মাথায় চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে। ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে ভয়ংকর ব্যথা আবার আসছে। ব্যথাটা পথের মধ্যে আমাকে কাবু করার আগেই বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার। দরজা জানালা বন্ধ করে ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকতে হবে। মাথা ঢেকে রাখতে হবে ভেজা গামছায়। কিছু খেয়ে নেয়াও দরকার। একবার ব্যথা শুরু হলে চব্বিশ ঘণ্টা কিছু মুখে দিতে পারব না। কড়া কিছু ঘুমের অষুধ খেয়ে নিলে হয়? এমন ডোজ খেতে হবে যাতে চব্বিশ ঘণ্টা মরার মত ঘুমিয়ে থাকি। ঘুম ভাঙ্গলে দেখব মাথায় যন্ত্রণা নেই। বড় দেখে একটা ফার্মেসীতে ঢুকে পড়লাম।
‘কড়া কিছু ঘুমের অষুধ দিতে পারবেন?’
‘ফামের্সীর মাঝবয়েসী কর্মচারী নির্লিপ্ত গলায় বলল, ডাক্তারের প্রেক্রিপসন ছাড়া পারব না।’
‘ডাক্তার এখন কোথায় পাব বলুন। বিরাট সমস্যা—আমার এক ছোটভাই আছে মেটাল কেইস। খুব তাড়াতাড়ি করলে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। এখন খুব বাড়াবাড়ি করছে অথচ ঘরে অষুধ নেই।’
‘উনার প্রেসক্রিপসনটা নিয়ে আসেন।’
‘ছুটে বের হয়ে এসেছি, প্রেসক্রিপসনের কথা মনে ছিল না ভাই। কি যে যন্ত্রণা করছে—লম্বা লাঠি নিয়ে সবাইকে তাড়া করছে। এই সময় কি আর প্রেসক্রিপসনের কথা মনে থাকে?’
‘তাকে কোন অষুধ দেয়া হয় সেটা জানা দরকার না?’
‘এতদিন ফার্মেসী চালাচ্ছেন, আপনি কি ডাক্তারের চেয়ে কম জানেন নাকি? এমন একটা কিছু দিন যাতে চব্বিশঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকে।’
‘হিপনল নিয়ে যান। দশ মিলিগ্রামের চারটা ট্যাবলেট খাইয়ে দেন। চব্বিশ ঘণ্টা নড়াচড়া করবে না।’
‘মরে যাবে নাতো?’
‘আরে না। মানুষ মরা কি এত সহজ?’
‘খাওয়ার কতক্ষণ পর এ্যাকশন হয়?’
‘আধ ঘণ্টার মধ্যে এ্যাকশন শুরু হবে।’
‘দিন তাহলে চারটা হিপনল।’
চারটা হিপনল ফার্মেসীর কর্মচারীর সামনেই মুখে দিয়ে গিলে ফেললাম। হাসি মুখে বললাম, একগ্লাস পানি দিন—মুখ তিতা লাগছে।
ভদ্রলোক কোন উচ্চবাচ্চ্য করলেন না। তার চোখ অবশ্যি বড় বড় হয়ে গেল। পানি এনে দিলেন। আমি এক চুমুকে পানি খেয়ে হাই তুলতে তুলতে বললাম, একটা টেলিফোন করব। টেলিফোনটা দিন। ভয় নেই, কল পিছু পাঁচটা করে টাকা দেব। আমার বন্ধুকে একটা খবর দিতে হবে। ওর চাকরি হয়েছে সেই খবর। অবশ্যি বন্ধুর বাড়িতে টেলিফোন নেই। ওদের পাশের বাসায় একটা টেলিফোন আছে—অন রিকোয়েষ্ট। অর্থাৎ বিনীত গলায় বললে ওরা ডেকে দেয়।
‘টেলিফোন তালাবন্ধ।’
‘তালাবন্ধ থাকলে খোলবার ব্যবস্থা করুন। যত তাড়াতাড়ি করবেন ততই ভাল। বেশি দেরি হলে আপনার দোকানে ঘুমিয়ে পড়ব। আমার হার্ট খুবই দুর্বল। যে কড়া ঘুমের অষুধ খাইয়েছেন—এখানেই ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যেতে পারে। তখন আপনি বিপদে পড়বেন। ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন ছাড়া ওষুধ দিয়েছেন।’
ভদ্রলোক শংকিত ভঙ্গিতে টেলিফোন বের করে দিলেন। তালাও খোলা হল। আমি ডায়াল করতে করতে বললাম, মিথ্যা কথা বলবেন না ভাই। ছোটখাট মিথ্যা বলতে বলতে পরে অভ্যাস হয়ে যাবে। একদিন দেখবেন ক্রমাগত মিথ্যা বলছেন। এই যে নাম্বারটা ডায়াল করছি ওদের যখন বলব পাশের বাসার রফিককে একটু ডেকে দিন ওরা বলবে এখন সম্ভব হবে না। বাসায় কাজের লোক নেই। ওরা একটা মিথ্যা কথা বলবে, যে কারণে ওদেরকে রাজি করানোর জন্যে আমাকে একটা মিথ্যা কথা বলতে হবে। মিথ্যা নিয়ে আসি মিথ্যা । সত্য জন্ম দেয় সত্যের। বুঝতে পারছেন তো ভাই সাহেব?
‘হ্যালো?, হ্যালো।’
ও পাশ থেকে অল্প বয়সী মেয়ের গলা পাওয়া গেল। রিণরিণে মিষ্টি গলা, আপনি কাকে চাচ্ছেন?
‘তোমাদের পাশের বাড়ির রফিককে যার মা মারা গেছেন।’
‘উনাকে তো এখন ডাকা যাবে না। আমাদের বাসায় এখন কাজের লোক নেই।
‘কাজের লোক কখন আসবে? অর্থাৎ কখন টেলিফোন করলে রফিককে ডেকে দেয়া যাবে?’]
‘আমাদের কাজের লোকতো ছুটিতে দেশে গেছে। কবে আসবে কে জানে?’
‘তাহলে তো তোমাদের খুব সমস্যা হল।’
‘আপনি কে?’
‘আমি একজন অকাজের লোক। শোন খুকি, এই বয়সেই মিথ্যা কথা বলা শুরু করেছ কেন? রফিককে ডাকা যাবে না এটা সরাসরি বলে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়। মাঝখান থেকে মিথ্যা করে কাজের লোকের কথা বলছ।’
‘আমি তো মিথ্যা বলছি না।’
‘বেশ ধরে নিলাম মিথ্যাবলছ না—সত্যি তোমাদের বাসায় কাজের লোক নেই, তাহলেওতো তুমি চট করে তাকে খবরটা দিতে পার। পার না?’
‘না পারি না। কারণ চিকেন পক্স। আমাকে মশারির ভেতর থাকতে হয়।’
‘খুকী, আবার মিথ্যা কথা বলছ? একটা মিথ্যা বললে দশটা মিথ্যা বলতে হয়। কাজের লোক দিয়ে শুরু করেছ—এখন চলে এসেছো জল বসন্তে। আরো খানিকক্ষণ কথা বললে আরো মিথ্যা বলবে।’
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে ফেলল। হাসিটা শুনে ভাল লাগল। এত আন্তরিক ভঙ্গির আনন্দময় হাসি অনেকদিন শুনিনি। সঙ্গে সঙ্গে মন ভাল হয়ে গেল। মাথার যন্ত্রণা চট করে খানিকটা কমে গেল। আমি কোমল গলায় বললাম, হাসছ কেন খুকী?
‘আপনার পাগলামী ধরনের কথাবার্তা শুনে খুব মজা লাগল। এই জন্যে হাসছি। আপনি ধরুন, আমি রফিক ভাইয়াকে ডেকে দিচ্ছি।’
মেয়েটি আরো খানিকক্ষণ হাসল। হাসতে হাসতে বলল, আমাকে খুকী খুকী করছেন এই জন্যেও খুব মজা লাগল। আমি মোটেই খুকী না। মেডিক্যাল কলেজে ফিফথ ইয়ারে পড়ি। এবং আমার সত্যি সত্যি চিকেন পক্স। বাসায় শুধু যে কাজের লোক নেই তাই না, কেউই নেই। সবাই বিয়ে বাড়িতে গেছে। আমার খালাত বোনের বিয়ে। আমার কথা কি সত্যি বলে মনে হচ্ছে?
‘হ্যাঁ হচ্ছে।’
‘ধরে থাকুন, আমি ভাইয়াকে ডাকছি।’
‘তাকে ডাকতে হবে না। তাকে শুধু একটা খবর দিয়ে দেবেন যে, তার চাকরির ঝামেলা মিটেছে। সে যেন কালই অফিসে যায়। আর আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন।’
‘আপনাকে ক্ষমা করা হল।’
মেয়েটা আবারো হাসছে। আমি টেলিফোন রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। মাথার যন্ত্রণা পুরোপুরি চলে গেছে। আমি ফার্মেসীর কর্মচারীর দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। সে শিউরে উঠল। আমি বললাম, কই ঘুম তো আসছে না। আরো দু’টা হিপনল দিন। এক গ্লাস পানি আনুন। আরেকটা কথা ভাই সাহেব, আপনার দোকানেই আজ ঘুমাব বলে স্থির করেছি। আপনি কি কোন বেঞ্চ-টেঞ্চ দিতে পারেন? ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান ছাড়া ওষুধ দেয়ার বিপদ দেখলেন?