Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দরজার ওপাশে – ০৪

ঘুম ভেঙ্গে কেউ যদি দেখে তার মুখের ঠিক ছ’ইঞ্চি উপর একটি অচেনা মেয়ের মুখ ঝুঁকে আছে, যার চোখ টানা টানা, বয়স অল্প,
তাহলে তার ছোটখাট ধাক্কা খাওয়ার কথা। আমি তাই খেলাম। প্রথম কয়েক সেকেণ্ড মাথা ফাঁকা হয়ে থাকল। তারপর শুনলাম, অচেনা মেয়েটি বলছে—‘আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’
আমি হ্যাঁ না কিছুই বললাম না। কোন মেয়ে যদি জিজ্ঞেস করে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন, তাহলে তার মুখের উপর না বলা যায় না। কেউ বললে আদালতে তার জেল জরিমানা দুই-ই হবার বিধান থাকা উচিত।
‘চিনতে পারছেন তো আমাকে? এর আগে দু’বার দেখা হয়েছে। আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারিনি। দাড়ি গোঁফ কেটে ফেলেছেন কেন? আপনাকে সুন্দর লাগতো। আমি ঘরে ঢুকে প্রথম একটু চমকে গেলাম। ভাবলাম, কার না কার ঘরে ঢুকেছি। আচ্ছা, আপনি এমন দরজা খোলা রেখে ঘুমান? চোর এলে তো সর্বনাশ হয়ে যেত।’
আমি মেয়েটিকে চিনলাম। কথা বলার ভঙ্গি থেকে চিনলাম। এই মেয়ে একনাগাড়ে কথা বলছে। খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছে। আমার চেনার মধ্যে এরকম আন্তরিক ভঙ্গিতে একজনই কথা বলে—রফিকের বউ। কিন্তু রফিকের বউয়ের স্বাস্থ্য বেশ ভাল ছিল—এই মেয়েটিকে দারুণ রোগা লাগছে।
‘আমি কতক্ষণ আগে এসেছি বলুন তো? কাঁটায় কাঁটায় দেড় ঘণ্টা। বেশ কয়েকাবার আপনার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করেছি। দরজায় ঠক ঠক করেছি, খক খক করে কেশেছি। দিনের বেলায় কারো এমন গাঢ় ঘুম হয় আমি জানতাম না। শেষে কি হল জানেন? একটু ভয় লাগল।’
‘কিসের ভয়?’
‘হঠাৎ মনে হল কেউ হয়ত আপনাকে খুনটুন করে গেছে। দরজা খোলা তো, তাই এ রকম মনে হল। নিঃশ্বাস পড়ছে কি-না দেখার জন্যে আপনার মুখের উপর ঝুঁকে ছিলাম।’
আমি উঠে বসতে বললাম, রফিক ভাল?
‘সেটাই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছি।’
‘আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছেন কেন? আপনি জানেন না? দেখা হয় না?’
‘রোজই দেখা হয়। ও রোজ একবার আসে। ঠিক সন্ধ্যার দিকে আসে। ভাইয়ার বসার ঘরে ঘণ্টাখানিক বসে থেকে চলে আসে।’
‘আপনার সঙ্গে কথা হয় না?’
‘না। ভাইয়া আমাকে বলে দিয়েছে আমি যেন কথা না বলি। তারপরেও বলতাম। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা আবার ভাইয়া বাসায় থাকে।’
‘আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন কেন? চেয়ারটায় বসুন।’
‘আমার নাম কি আপনার মনে আছে?’
‘মনে আছে। আপনার নাম যূথী।’
‘অনেক চন্দ্রবিন্দু দিয়ে যূথী লেখে। আমিও আগে লেখতাম। এখন লিখি না। আচ্ছা শুনুন, আপনার চিঠি এসেছে। নিচে পড়ে ছিল,আমি টেবিলে রেখে দিয়েছি। নিন।’
‘চিঠি পরে পড়ব। এমন কিছু জরুরী চিঠি না। আমার বাড়ির চিঠি। প্রতি মাসের শেষের দিকে তাঁরা একটা চিঠি পাঠান।’
‘আপনি একটা র্শাট গায়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ভদ্র হয়ে আসুন—কথা বলি। আপনার সঙ্গে খুব জরুরী কথা আছে। আর শুনুন, আপনার এখানে চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। যেন এটা তারই বাড়িঘর। আমি চৌকিতে বসতে বসতে বললাম, বলুন কি ব্যাপার?
‘আপনার বন্ধুর চাকরির কি কিছু হয়েছে? ভাইয়া ওকে জিজ্ঞেস করছিল। ও বলল—হিমুকে বলেছি। হিমু সব ঠিক করে দেবে। ভাইয়ার ধারণা ও কাউকেই কিছু বলেনি।’
‘আমাকে বলেছে।’
‘আমি জানি বলেছেন। ও কখনো মিথ্যা কথা বলে না। আমি ভাইয়াকে সেটা বললাম, ভাইয়া আমার উপর রেগে গেল। ভাইয়া ওকে দু’চোখে দেখতে পারে না।বলে সাব-হিউমেন স্পেসিস। ভাইয়া বলে—ওর শুধু চেহারাটা আছে।কোল বালিশের খোলটা শুধু ঘুরে, ভেতরে বালিশ নেই।
‘আপনার ভাইয়া কি রফিকের চাকরির কোন চেষ্টা করছেন?’
‘না। করবেও না। বললাম না ওকে দেখতে পারে না। ওর নাম শুনলেও রেগে যায়। তার উপর এখন বলছে—ওকে ডিভোর্স দিতে।’
‘তাই না-কি?’
‘হ্যাঁ। এটা আপনাকে বলার জন্যই এসেছি। ভাইয়ার বাসায় ওকে কেউ দেখতে পারে না। আমার ভাবী বলছিল—যূথী,তুমি যে ঐ ছেলের সঙ্গে থাকতে চাও—ওর তো মাথা খারাপ। কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না। কোন সুস্থ ছেলে এই কাজ করবে না। একদিন দেখবে ঘুমের মধ্যে তোমাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। তার পর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে দড়িতে ঝুলিয়ে বলবে আত্মহত্যা। পাগলদের বাস্তব বুদ্ধি আবার ভাল থাকে। আমি ভাবীর কথায় গুরুত্ব দেই নি—এখন আপনি বলুন, দিনের পর দিন কেউ যদি কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে—ডিভোর্স দাও, ডিভোর্স দাও, তাহলে কি ভাল লাগে?’

‘ভাল লাগার তো কথা না।’
‘আচ্ছা আপনি কি ওর চাকরির কোন ব্যবস্থা করতে পারবেন?’
‘পারব।’
‘সত্যি পারবেন?’
‘হ্যাঁ।;’
‘তাহলে একটু তাড়াতাড়ি করবেন। ও চাকরি পেলেই আমি ওর কাছে চলে যাব। তখন আর ভাইয়া বলতে পারবে না—চাকরি-বাকরি নেই। ও তোকে খাওয়াবে কি? আজ তাহলে উঠি।’
যূথী ঝট করে উঠে দাঁড়াল। আর তখনি আমার মনে হল ঐ মেয়েটা রূপার মত। যদিও এরকম মনে হবার কোন কারণ নেই। আমরা পছন্দের মানুষের মধ্যে অতি প্রিয়জনদের ছায়া দেখি। এটাই মূল ব্যাপার।
‘হিমু ভাই, আমাকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিন। আসার সময় দেখেছি কতগুলো বখা ছেলে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। আমায় দেখে একজন বলল, শুঁটকি রাণী, শুঁটকি রাণী।’
আমি যূথীকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে আবার ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। আজ আমার পরিকল্পনা সারাদিন ঘুমানো। সাইকেলটা বদলে দেয়া। সারাদিন ঘুমুব, রাতে জেগে থাকব। আমার বাবার অনেক উপদেশের একটি হচ্ছে—

‘ঘুমাইয়া রাত নষ্ট করিও না। দিনে নিদ্রা যাইবে। রাত কাটাইবে অনিদ্রায়। কারণ রাত্রি আত্ম-অনুসন্ধানের জন্য উত্তম। জগতের সকল নিশিষাপন করে। পশু মাত্রই নিশাচর। মানুষ এক অর্থে পশু। নিশিযাপন তার অবশ্যকর্তব্যের একটি।”
বিছানায় অনেকক্ষণ গড়াগড়ি করার পরও ঘুম আনা গেল না। ঘরে খবরের কাগজ নেই, পুরানো ম্যাগাজিন নেই যে চোখ বুলাব। মামার বাড়ি থেকে আসা চিঠিটা অবশ্যি পড়া যায়, পড়তে ইচ্ছে করছে না। চিঠিতে কি লেখা না পড়েই বলে দিতে পারি। একই ভাষায়, একই ভঙ্গিতে একটি শব্দ এদিক-ওদিক না করে ছোট মামা দীর্ঘ দিন ধরে চিঠি লিখছেন। চিঠির মাথায় আরবীতে লেখা থাকে ইয়া রব। তারপর গুটি গুটি হরফে লেখেন—
দোয়া গো,
পর সমাচর এই যে, দীর্ঘদিন তোমার কোন পত্রাদি না পাইয়া বিশেষ চিন্তাযুক্ত আছি। আশা করি আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন তোমাকে সুস্থ দেহে রাখিয়াছেন। আমাদের এদিকের সংবাদাদি মঙ্গল। তুমি কোন চিন্তা করিবে না। আল্লাহপাকের ইচ্ছার এইবার ফসল ভাল হইয়াছে। ব্যবসাপাতিও ভাল। তোমাকে মাসিক যে টাকা পাঠানো হয় তাহাতে তোমার চলে কিনা। জানি না। প্রয়োজন হইলেই জানাইবা। এই বিষয়ে কোন রকম লজ্জা বা সংকোচ করিবে না। তোমাকে যে কি পরিমাণ স্নেহ করি একমাত্র আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন জ্ঞাত আছেন।
শরীরের যত্ন নিবা পথে পথে ঘোরার অভ্যাস ত্যাগ করিবা। মনে রাখিও, ভিক্ষুকরাই পথে পথে ঘুরে। তুমি ভিক্ষুক নও। কারণ আমরা এখনও জীবিত আছি। আল্লাপাকের ইচ্ছায় তোমার অন্নের অভাব কখনো হইবে না। কোন কারণে আমার মৃত্যু ঘটিলেও চিন্তাযুক্ত হইও না। কারণ আমি তোমার নামে আলাদা সম্পত্তি লেখাপড়া করিয়া দিয়া রাখিয়াছি। তাহাতে কেহ হাত দিবে না। দোয়া নিও। ইতি তোমার ছোট মামা।

বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে মনে হল—অনেকদিন মামার বাড়ি যাওয়া হয় না। কোন এক গভীর রাতে হঠাৎ উপস্থিত হলে কেমন হয়?
চার বছর আগে মামার বাড়ি গিয়েছিলাম। ঠাকরোকোণা স্টেশনে নেমে সাত মাইল হেঁটে রাত একটার সময় উপস্থিত হলাম। ছোট মামা ঘুম ভেঙে উঠে এলেন। প্রথমে খানিকক্ষণ হতভম্ভ চোখে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আনন্দে কেঁদে ফেললেন। গোসলের জন্যে গরম পানি করা হল। মামা গম্ভীর গলায় হুকুম দিলেন। মুরগী জবেহ করে যেন পোলাও কোরমা করা হয়। রান্না হতে হতে রাত তিনটা বেজে গেল। মামা বললেন, ছেলেটা একা একটা খাবে না-কি—দেখি ওর সাথে আমাকেও দাও।
মাঝের ঘরে আমার শোবার ব্যবস্থা। সেই ঘরের খাট মামার পছন্দ না। খাট খুলে নতুন খাট পাতা হল। বিশাল খাট। জানা গেল, এই নতুন খাট আমার জন্যেই মামা বানিয়ে রেখেছেন। একজন মানুষের প্রতি অন্য একজনের ভালবাসা যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে আমার মামাদের না দেখলে তা জানতে পারতাম না। অথচ আশ্চার্যের ব্যাপার, মানুষ হিসেবে মামার পিশাচ শ্রেণীর! তাঁদের সমস্ত ভালবাসা নিজের মানুষদের জন্যে, বাইরের কারোর জন্যে নয়।
মামার বাড়িতে সেবার দু’মাস কাটিয়ে দিলাম। তারপরেও যখন চলে আসার জন্যে ব্যাগ গুটাচ্ছি, ছোট মামা দুঃখিত গলায় বললেন, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি? আর দু’টা দিন থেকে যা, সিঁদুর গাছের আমগুলি পাকুক। তোকে যেতে দিতে ইচ্ছা করে না রে হিমু। ইচ্ছে করে মোটা একটা শিকল দিয়ে তোকে বেঁধে রাখি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *