Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দরজার ওপাশে – ১০

মাথার যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পেলাম। এই যন্ত্রণা দীর্ঘ দিন আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। দিন এবং রাত্রির ব্যবধান মুছে গেল। মনে হত সব সময় ‍দিন, সব সময় রাত। মেস থেকে তারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে ‍দিল। হাসপাতালের ওয়ার্ডটি বিশাল। রুগীরা শুয়ে আছে। আমিও তাদের সঙ্গে শুয়ে আছি। স্থান কাল সম্পের্কেও বিভ্রমের মত হল। এই মনে হয় হাসপাতাল , এই মনে হয় হাসপাতাল নয় স্টীমারের খোলা ডেক। সিটি বাজিয়ে স্টীমার চলছে। আমরা খুব দুলছি।
ক্রমাগতই লোকজন আসছে আমাকে দেখতে। এগুলি মনে হয় বিভ্রম। মস্তিষ্ক কল্পনা করে নিচ্ছে। বড় মামাকে একদিন দেখলাম। তিনি আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বিড় বিড় করে বলছেন—একি সমস্যা বাধালি তো। এই দূশ্য অবশ্যই বিভ্রম। বড় মামা মারা গেছেন অনেকদিন আগে।
এক গভীর রাতে রূপাকে দেখলাম। সে রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে—কত কষ্ট করে তোমার ঠিকানা বের করেছি তা কি তুমি জান? আমি তোমাকে হাসপাতালে রাখব না, বাড়িতে নিয়ে যাব।
‘তোমার বাবা-মা—তাঁরা কি বলবেন?’
‘যা বলার বলুক।’
একদিন সেতু এল এক হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে। তার মুখ শুকানো। সে লজ্জিত ও বিব্রত। মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ বসে রইল। তারপর বলল, আপনার টাকাটা নিয়ে এসেছি। এটা কি বালিশের নিচে রাখব?
‘রাখ?’
‘আমি যদি খানিকক্ষণ আপনার বিছানার কাছে বসে থাকি তাহলে কি আপনি রাগ করবেন?’
‘না।’
এই সব দূশ্যের সবই কি কল্পনা? বোঝার কোন উপায় নেই। এক সময় তিতালী এসে উপস্থিত। তার পরণে আকাশী রঙের শাড়ি। হাত ভরতি সবুজ চুড়ি। সে হাতের চুড়ির টুনটুন শব্দ করতে করতে বলল,
‘আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’
‘পারছি। আপনি তিতালী।’
‘আপনি কেমন আছেন?’
‘আমি ভাল নেই।’
‘তাই তো দেখেছি। কি রোগা হয়ে গেছেন! কি হয়েছে আপনার?’
‘জানি না কি হয়েছে। সম্ভবত মারা যাচ্ছি। প্রায়ই প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হয়। ইদানীং এর সঙ্গে জ্বর হচ্ছে।’
‘কে দেখছে আপনাকে?’
‘সবাই দেখছে। মেসের একজন ঝি—সে তার দেশ থেকে মাথায় মাখার একটা তেল এনে দিয়েছে। ঐটা মাথায় মাখি। মাথায় মাখলে খুব আরাম হয়।’
‘আপনার আত্মীয়-স্বজনরা আপনাকে দেখছেন না?’
‘দেখছে। সবাই দেখছে। মৃত আত্মীয়স্বজনরাও নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছেন। আমার বড় মামা তো প্রায়ই রাতে আমার সঙ্গে ঘুমান। ছোট বিছানা, দু’জনের চাপাচাপি হয়। উপায় কি? শুধু বাদল আসছে না। অসুখের সময় ও পাশে থাকলে ভাল লাগতো।’
‘ও কোথায়?’
‘ও আমেরিকা গিয়েছে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।’
‘আমি যদি বিছানায় আপনার পাশে কিছুক্ষণের জন্যে বসি আপনি কি রাগ করবেন?’
‘না রাগ করব কেন?’
‘আমার বাবারও মাথা ধরার রোগ আছে। মাথায় যন্ত্রণায় উনি যখন ছটফট করতেন আমি হাত বুলিয়ে দিতাম। বাবার ধারণা, আমি হাত বুলালেই বাবার মাথা-ধরা সেরে যেত। আমি কি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?’
‘না।’
‘আপনি কি আমার বাবার খবর জানেন?’
‘না।’
‘স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার হয়েছে। ফাঁসির আদেশ হয়েছে।’
‘আপনার বাবা কি আপিল করেছেন?’
‘আপিল করেছেন।?’
‘আপনি যে খুব শান্ত ভঙ্গিতে ব্যাপারটা গ্রহণ করেছেন তা দেখে আমার ভাল লাগছে।’
‘আমার বাবা আমাকে শান্ত থাকতে বলেছেন। আমি শান্ত হয়ে আছি।’
‘ভাল। খুব ভাল।’
‘আমার ধারণা, আমার বাবা একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ।’
‘আপনার ধারণা ঠিক আছে। পৃথিবীতে অশ্রেষ্ঠ মানুষ বলে কিছু নেই। সব মানুষই শ্রেষ্ঠ।’
‘বাবা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনি কি যাবেন? আপনার শরীর এত খারাপ। আমার বলতে লজ্জা লাগছে।’
‘আমি যাব। অবশ্যই যাব।’
স্বপ্নদৃশ্যগুলিতেও কিছু সত্যি থাকে?’
কারণ পুরোপুরি সুস্থ হবার পর শুনলাম—আসলেই স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে মোবারক হোসেন সাহেবের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আপিল করেছেন, অতে লাভ হয়নি। মার্সি পিটিশন করেছেন। তার ফলাফল এখনো জানা যাচ্ছে না।
একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
মোবারক হোসেন সাহেব খুশি খুশি গলায় বললেন,হিমু কেমন আছ?
‘ভাল।’
‘শুনেছ নিশ্চয় আমাকে ওরা ঝুলিয়ে দিচ্ছে।’
‘শুনেছি।’
‘দিনক্ষণ এখনো ঠিক করেনি। কিংবা কে জানে হয়ত ঠিক করেছে, আমাকে কিছু বলছে না। ও, ভাল কথা, পরে আবার জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাব। তোমার বন্ধুর চাকরিটা কি হয়েছে?’
‘জানি না। আমি খোঁজ নেইনি।’
‘কিছুই জান না?’
‘জ্বি না।’
‘তুমি শুনলে অবাক হবে আমি তোমার ঐ বন্ধুকে একদিন স্বপ্নে দেখলাম? সে আমাকে বলছে—স্যার, একটু দোয়া করবেন আমাদের একটা বাচ্চা হবে। তোমার বন্ধুর সঙ্গে খুব সুন্দর মত একটি মেয়ে। মেয়েটা স্বামীর কথায় খুব লজ্জা পাচ্ছে। আমি তোমার ঐ বন্ধুকে কোনদিন দেখিনি, কিন্তু স্বপ্নে সঙ্গে চিনে ফেললাম।’
মোবারক হোসেন সাহেব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি বললাম, আপনি কেমন আছেন?’
মোবারক হোসেন সাহেব কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, বুঝতে পারি না। কিছুই বুঝতে পারি না। হিমু!
‘জ্বি।’
‘আমার মাথাটা বোধহয় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে—আমাকে যে সেলে রাখা হয়েছে সেখান থেকে একশ’গজ দুরে জেলখানার ফাঁকা মাঠ। মাঝে মাঝে কয়েদীরা সেই মাঠে ফুটবল খেলে। একরাতে কি হয়েছে জান? হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানলার শিক ধরে মাঠটার দিকে তাকালাম। দেখি কি জান? মাঠটার মাঝখানে একটা গাছ। বেশ বড় একটা গাছ। চারদিক ধু ‍ধু করছে। আর কিছুই নেই। গাছ কোথেকে এল বল তো?’
তিনি আমার জবাবের জন্যে অপেক্ষা করলেন না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিছু গলায় বললেন, তোমাকে কয়েকটা জরুরী কথা বলার জন্যে ডেকেছিলাম। জরুরী কথাগুলি একটাও এখন মনে পড়ছে না।জহির সম্পর্কে কি যেন বলতে চাচ্ছিলাম মনে করতে পারছি না। জহির তোমার ভাল বন্ধু ছিল, তাই না হিমু?’
‘জ্বি।’
‘সে ছেলে কেমন ছিল বল তো?’
‘সে অসাধারণ একটি ছেলে।’
মোবারক হোসেন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, অতি খারাপ মানুষ হয়েও অসাধারণ একটি ছেলের জন্ম দিয়েছি। এই তো কম কথা না, কি বল?
‘তা তো ঠিকই।’
‘তুমি চলে যাও হিমু বেশিক্ষণ কথা বলতে ভাল লাগে না।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মোবারক হোসেন সাহেব বললেন, তোমার স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গেছে হিমু। স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রাখবে। রোদে বেশি ঘোরাঘুরি করবে না।
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘আমি জেল কর্তৃপক্ষকে বলে রেখেছি ফাঁসির দিন-তারিখ হলে তোমাকে যেন জানানো হয়, যেন তোমাকে এই দৃশ্যটা দেখার অনুমতি দেয়া হয়। তুমি একবার বলেছিল তোমার খুব শখ এই দৃশ্য দেখার। এরা আমার এই অনুরোধ হয়ত রাখবে।’
আমি ‍চুপ করে রইলাম। তিনি নিচু গলায় বললেন, তোমার জন্যে সামান্য কিছু হলেও করতে পারছি এই জন্যে একটু ভাল লাগছে। তুমি কি চলে যাবার আগে কিছু বলবে? সান্ত্বনার কোন বাণী?
আমি নিচু গলায় বললাম, Dust we will be.
‘কি বললে?’
‘কিছু বলিনি চাচা।’
‘আচ্ছা যাও। তোমাকে অনুমতি দিলে চলে এসো, কেমন? আচ্ছা হিমু, আজ কি পূণিমা? তুমি তো আবার চন্দ্র-সূর্যের হিসাব খুব ভাল রাখ।’
‘আজ পূণিমা না।’
‘শুনেছি এরা ফাঁসি দিনের বেলায় দেয়। ভোরবেলা। ক’দিন ধরে মনে হচ্ছে ওদের যদি বলি—আমার বেলায় নিয়মের ব্যতিক্রম করে যদি রাতে করে তাহলে কেমন হয়। ভরা পূণিমার রাতে। তাহলে কি ব্যাপারটা আরেকটু ইন্টারেস্টিং হবে না?’
‘চাচা যাই?’
‘আচ্ছা যাও। আমার কতাবার্তায় কিছু মনে করো না। আজকাল কি বলি না বলি তার হিসাব রাখতে পারি না।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *