থ্যাঙ্ক ইউ
— মৌ মৌ দরজাটা খোল…
— আসছি মা, কি হলো এতো রাতে ডাকাডাকি করছ কেন? এ বাবা পড়ে গেলে কি করে? উঠ উঠ আমার হাতটা শক্ত করে ধর। নমিতা দেবীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মৌ ভোলিনি মলমটা কোমরে আস্তে আস্তে লাগিয়ে দিল।
প্রায় চারটে বাজে মৌ দরজাটা খুলে আস্তে আস্তে প্যাসেজে নেমে এল। ভোরের আকাশ দেখতে দেখতে ভাবনায় আঁকিবুঁকি কাটছিল। তার ছেলেবেলা, ভোরবেলা আর ঠাকুরদা একই দৃশ্য পটে আঁকা। মনে পড়ে ঠাকুরদা রোজ ভোরে ফুল তুলতেন, বাড়ির পেছনের বাগানে, সে ছিল নিত্য সঙ্গী। টগর, ,জবা,শিউলি,আকন্দ, নীলকন্ঠ, সন্ধ্যামালতি, মাধবী হরেক রকমের ফুল। ছিল তার প্রিয় গন্ধরাজ ফুল আর জামরুল গাছ। মজা আরো ছিল ঠাকুমার সাথে বৃষ্টি ভেজা সকালে আম কুড়নোর। উঠনেই ছিল আম গাছ। স্মৃতির পাতায় ডুব দিতে মৌ’র বড্ড ভালো লাগে। একটা অবশেসান আচ্ছনতা ঘেরা ভোর তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তিরিশ বছর আগে,তখন উঠোনটা ছিল মাটির। ঠাকুমা নিজের হাতে গোটা বাড়িটা ঝাঁট আর গোবর ছড়া দিত। একটা স্বচ্ছ পবিত্র পবিত্র ভাব আনাচে-কানাচে উপলব্ধি হতো। স্কুলে যেতে মৌ’এর মোটেই ভালো লাগতো না; তবে না যাওয়ার কোন অজুহাতই তার খাটতো না, দাদু ছিলেন কড়া ধাতের দ্বায়িত্বশীল মানুষ নাতনিকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করছিলেন। মৌ’র যখন দুবছর তখন তার মা স্বামীর কর্মস্থলে পাকাপাকি ভাবে থাকতে যান,তিনি তখন দ্বিতীয় অন্তঃসত্ত্বা । শাশুড়ি, ছোট ননদ আর দেওরের একান্ত অনুরোধে মেয়ে ‘কে ভিটে বাড়িতে তাদের কাছে রেখে দেন। কয়েক বছর পরে অবশ্য মৌ ফিরে আসে বাবার কর্মস্থল গৌহাটিতে।
মৌ দরজাটা ফাঁক করে দেখলো মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ফ্লাক্স থেকে গরম জল কফিমগে ঢেলে তাতে আধা চা চামচ নেক্স কফি আর গোটা একটা পাতিলেবুর রস চিপে নিলো। খবরের কাগজ উল্টাতে উল্টাতে আরামের চুমুক হেলদি কফিতে। এভাবে কফি পান করলে নাকি পেটের চর্বি কমে! দেখা যাক কি হয়!
— মা তুমি উঠে পড় আস্তে আস্তে। ব্যথা করছে কি কোমরে? পায়ে চোট লাগেনি তো মা? আমাকে একটু হেঁটে দেখাও। আমি অফিসে পৌঁছেই ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা নিয়ে নেব।ডাক্তার দেখানো দরকার তাহলো টেস্টগুলো আবার রিপিট হবে।
মৌ অফিসের জন্য রওনা দিলে নমিতা দেবী ধীরে ধীরে দরজা অব্দি এগিয়ে এসে দুগ্গা দুগ্গা বলে তিনবার কপালে হাত ঠেকালেন।
আজও আবার আর কে সনস্ এর ফাইলটা টেবিলে। মৌ আড়চোখে দেখে ফাইলটা সরিয়ে রাখলো। সেকেন্ড হাফে দেখবে। ম্যানেজারকে বলে মা’র ডাক্তার দেখানো সারতে হবে। প্রয়োজনে এবেলাটা ছুটি নিতে হতে পারে।
— মা, মালতীর সাথে তুমি ঘরে চলে যাও, আমি সোজা অফিস যাব।এক্সরে রিপোর্ট একদম ঠিক। তুমি মেডিসিনগুলো ঠিক মতো খাও আর রেস্ট কর। ডাক্তার বাবু তো বললেন চিন্তার কোন কারণ নেই। মালতী বাড়ি ফিরে তুই আর মা লেবুর সরবত খেয়ে নিস মনে করে।
হ্যালো রাজা,,,মৌ বলছি, ফ্রী থাকলে বেরিয়ে এসো ক্যান্টিনে, কফি খাব মাথাটা বড্ড ধরেছ গো।
তুমি কিছু খেলে অর্ডার দিতে পারো, আমি শুধু কফিই নেব।
—- শুধু কফিই, তোমার শরীর খারাপ লাগছে কি মৌ? খুব টায়ার্ড মনে হচ্ছে তোমাকে!
— কাল রাতে মা আবার পড়ে গেছিলেন, একটা টেনশন সবসময় মা’কে নিয়ে হয়।
— মৌ; তিস্তাকে মনে হয় ব্যাঙ্গালোরে যেতে হবে খুব শিগগিরই, পি ডাব্লিউ সি ‘ র চাকরিটা হয়ে গেছে।
— দারুণ খবর রাজা! যাক ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন।
রাজা আমি একবার ফোন করে ওকে কংগ্রাচুলেশনস জানাব?
— নিশ্চয়ই। নাও কথা বল, নম্বরটা ডায়াল করে দিয়েছি।
— হ্যালো বাবাই, তুমি ফেরার সময় রিপোজ থেকে ব্ল্যাক ফরেস্ট নিয়ে এস মনে করে।
— তিস্তা ; আমি মৌ আন্টি বলছি, তোমার বাবাইকে এখনি ফোনটা দিচ্ছি , তোমরা কথা বলো। আর শোন কংগ্রাচুলেশনস ফর ইওর নিউ জব।
— থ্যাংকস মৌ আন্টি। আমি যাবার আগে একবার প্লিজ এসো আমাদের বাড়িতে।
— ওকে বেটা। তোমার বাবাইকে ফোনটা দিচ্ছি কথা বল তোমরা।
— তিস্তা মা ; আমার মনে আছে সব ঠিক চলে আসবে তোমার ব্ল্যাক ফরেস্ট, বাবাই কখনো ভুলতে পারে প্রিন্সেসের অর্ডার!
— লাভ ইউ বাবাই। আমি যাবার আগে আন্টিকে বাড়িতে আসার রিকুয়েষ্ট করবে। টা টা….।
— হ্যালো রাজা, তিস্তা একটু আগে ফোন করে আজই আসতে বলছে তোমার বাড়িতে, আমার বড়ো ভয় করছে রাজা। মেয়েটা কি আমাদের সম্পর্কের কিছু আভাস পেয়েছে, কি বা রিয়্যাক্ট করে!
— এতো কিছু ভেবোনা মৌ। চলে এস, লাঞ্চে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।
স্কুটিটা মাতৃভিলায় দাঁড় করিয়ে মৌ কলিং বেল টিপে অপেক্ষা করলো। চিনুদি দরজা খুলে দিলো।
— এসো এসো দিদিমনি। খুব রোদ্দুর, বাইরে তাকানো যাচ্ছে না। বসো জল এনে দি।
—- হাই আন্টি, কেমন আছো বল? দিদা পড়ে গেছিলেন বাবাই বলল। কেমন আছেন উনি?
— মেডিসিনের উপরে মা চলছেন। রোজ কিছু না কিছু লেগেই আছে। তোমার গোছগাছ কমপ্লিট তিস্তা? আমি তোমাকে হেল্প করে দিতে পারি প্যাকিং- এ। পরশু ফ্লাইট ক’টায়?
— সন্ধ্যা সাতটায়। তুমি রিলাক্স হয়ে বস আর আমাদের সাথে গল্প কর। গোছানো প্রায় শেষ। দুমাস পরে আবার আসবো ভিসার জন্য কিছু কাজ আছে।
— এটা খুব ভালো খবর। রাজার ভালো লাগবে।তোমাকে ছেড়ে মনে হয় এই প্রথম একা থাকবে রাজা?
— হাঁ আন্টি, মা চলে যাবার পড়ে এটাই প্রথমবার। আন্টি বড়ো চিন্তা হয় বাবাই’এর জন্য। কাল রাতে ব্যালকনিতে লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছি বাবাইকে।
— চিন্তা করোনা তিস্তা আমরা সবাই আছি তো। তোমার বাবাইকে অফিসের সবাই খুব ভালোবাসে। আমরা সবসময় খোঁজখবর রাখবো।
— তা জানি আন্টি, কিন্তু ঘরে ফিরে তো বাবাই সম্পূর্ণ একা। আমিও শান্তি পাচ্ছি না জানো!
— মৌ ; স্নানে ঢুকেছিলাম দেরি হয়ে গেল সরি। তিস্তা মা; চল আন্টিকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে, খেতে খেতে গল্প করা যাবে।
— চল আন্টি
— চিনুদি, দারুণ রান্না করেছ। অনেক দিন বাদে মুড়িঘণ্ট খেলাম। তিস্তা তুমি চিকেনটা আরো একটু নাও… তোমার তো ফেবারিট ডিস্। রাজা এতো ভাজা খেও না, তোমার কলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে আছে।
— তিস্তা কিছু বলবে?
— হুম আন্টি
— বল তিস্তা
— আন্টি, তুমি কি আমাদের বাড়িতে আসবে একেবারে চিরদিনের জন্য, বাবাই-এর জন্য, আমার জন্য?