ত্রিধারা-19
অর্ধেক পথ পৌঁছে গেলে গো বৌদি।
আমারও তাই মনে হয়েছিল।ছেলে তো অস্থির
ঘোড়ায় চড়ার জন্য।
সীতাপুর থেকেই ঘোড়ায়?
পরদিন সকালে সীতাপুর থেকে গৌরী কুন্ডে বাসেই যাত্রা করেছিলাম। কিছুটা পথ যাবার পর বাস থেমে গেল । Law and order – one way হওয়ার জন্য বাস ঘোরানোর জায়গা নেই গৌরীকুন্ডে হেঁটেই গেলাম। অনেকেরই মুখ শুকিয়ে গেল । গলদঘর্ম হয়ে একসময়ে গৌরীকুন্ডে পৌছলাম ।
তোমরা তো ক্লান্ত হয়ে গেলে। ওখানে থেকে গেলে
সেদিন?
কি যে বল তুমি। থাকব কোথায়?
তবে চটিতে বিশ্রাম নিলে?
গৌরীকুন্ড পৌঁছে মনে হয়েছিল, হয়ত রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। জলে থিকথিকে কাঁদা তাতে ঘোড়ার পুরীশ আর প্রস্রারের উৎকট দুগর্ন্ধ । দেখলাম ঘোড়া , খচ্চর , ডান্ডি কান্ডি ডুলি নিয়ে নানান্ ভাষায় নানান সুরে দরকষাকষি চলছে। চিৎকার চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা । ম্যানেজার ভদ্রলোক আমাদের ঘোড়া ঠিক করে দিলেন । সহিস সব বাচ্চা ছেলে। আমার ছেলে ঘোড়ার পিঠে চড়ে খুব খুশি। উঠেই বলল এগুলি ঘোড়া নয় মা। ঘোড়ার চাইতে অনেক ছোট আর বড় বড় কান। আমি বললাম -এগুলিকে খচ্চর বলে । সবাই রওনা দিলাম ছেলে সামনে, আমি পিছনে । সহিসকে বললাম , পারবে তো আমাদের নিয়ে যেতে ? ওরা খুব ভাল ভাবেই আমাদের বুঝিয়ে দিল কিভাবে বসতে হবে । ওদের নির্দেশমত চড়াইয়ের সময়ে একহাত দিয়ে পিছনের আংটা ধরে চিৎ হয়ে আর উৎরাইয়ের সময় দুহাতে সামনের আংটা ধরে সামনে ঝুঁকে ঘোড়ার শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছিলাম ।
এতো খুব কষ্টকর যাত্রা বৌদি। কি করে গেলে তুমি?
ডুলিতে উঠতে পারতে।
দেখলাম সাথীদি ঘোড়ায় আর আমি ডুলি?
কয়েকবার পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। দোষটা আমার আমি পথের দিকে মোটেই খেয়াল রাখছিলাম না। বিশাল বিশাল পাহাড় বন আকাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম । আমার বাহনটি হাড় জিরজিরে অতি দুর্বল প্রাণী । মার খেয়ে একটু তাড়াতাড়ি চলছে বটে তারপরেই আবার ঝিমিয়ে চলছে । আর চড়াই ,উৎরাই-এর পথ দুইহাতে শক্ত করে লোহার আংটা ধরে থাকতে হয়েছিল।
এখানে দুধারে বিশাল আকারের বনময় পাহাড় তার মাঝখানে দিয়ে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী আর তারই পাশে সঙ্কীর্ণ পাহাড়ী পথে আমরা চলেছি ঘোড়ায় চড়ে। কত লোক হেঁটে লাঠি ঠুকে চলেছে পথে।
পৌঁছলাম রামওয়াড়া সেখানে মিনিট খানেক বিরতি।কেননা এখানে ঘোড়াদের খাবার ও বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিতে হয়।এরপর মান্দাকিনি নদী পার হতে হল। এদিকের দৃশ্যও অপরূপ। এখান থেকে শুরু হলো চড়াই রাস্তা। অত্যন্ত খাড়াই পথ।যেসব যাত্রী হাঁটা পথে কেদারনাথ যেতে চায় তাদের জন্য এই পথটা সত্যিই খুব কঠিন।
কতো ছোটো বড়ো ঝর্ণা দেখলাম। পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করলো।বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। মন ভরে ছবি তুললাম।
কেদারেশ্বরের পা ছুঁতে মন্দিরের দিকে অগ্রসর হলাম।
মন্দিরের পাশেই গায়েত্রীভবনে আমাদের রাতের আশ্রয়ের কথা, আর কেউ যেন পিছনে না তাকায় , কেননা পেছনে তাকালেই পড়ে
যাওয়ার বিপদ বলেছিলেন ম্যানেজার ।
গরুর চটির বাঁদিকে পেছনে মন্দিরের স্বর্ণকলস দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলাম । ‘ জয় কেদারনাথের জয়’ ধ্বনি দিয়ে বাকী পথটুকু সতর্ক হয়ে চলতে লাগলাম । ঘোড়া থামিয়ে সহিস বলল – “ আ গেয়ী উৎরাইয়ে বলে সকলের পায়ের বাঁধন খুলে দিতেই নেমে মন্দিরের দিকে সবাই এগোলাম। এই জায়গাটা বেশ চড়াই, উঁচু ধাপে বড় বড় সিঁড়ি । সামান্য হেঁটেই খুব ক্লান্ত লাগছিল পা তুলতে পারছিলাম না । অবাক হলাম সাথীদির অসম্ভব এনার্জী দেখে। পথের ধারে আমি বসে পড়লাম । সামনেই মন্দাকিনীর সেতু ।