ত্রিধারা -18
রূপম জানতে চেয়েছিল আমি কোথায় বেড়াতে
গিয়েছি।বললাম তোমার অসমাপ্ত যাত্রা পথে এবার আমি।
তার মানে বৌদি তুমিও হিমালয়ে গিয়েছিলে?
বললাম কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ দর্শনের ইচ্ছে ছিলো অনেকদিন।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত উত্তরাখণ্ড রাজ্যের প্রাচীনতম শিবমন্দির কেদারনাথ মন্দিরে মানত করেছিলাম যে ছেলের পা ভালো হলে পুজো দেব।
ভারত তীর্থ দর্শন’-এর সঙ্গে অবশেষে আমাদের কেদারনাথ বদরীনাথ গঙ্গোত্রী,যমুনোত্রী – এই চার তীর্থ দর্শনের সুযোগ এলো । মনের গোপন বাসনা অবশেষে বাস্তবে রূপান্তরিত হলো ।
সে’বছর সেপ্টেম্বর মাসে হাওড়া থেকে নির্দিষ্ট সময়ে দুন এক্সপ্রেস উঠলাম। ট্রেনে উঠেই যাটোর্ধ বয়সী এক মহিলার সাথে আমাদের আলাপ হল। যিনি বললেন, পুরাণ থেকে জানা যায় সুর-নদী ধূর্জটির জটাজাল ভেদ করে স্বর্গ হতে নেমেছিলেন পৃথিবীতে । বেগ সংহত করার জন্য গঙ্গা হিমবাহের আকার ধারণ করে প্রবাহিত হয়েছিল ত্রি-ধারায়। একধারা ভাগীরথী গঙ্গা , অন্য দু’ধারা মন্দাকিনী ও অলকানন্দা। শতপন্থ হিমবাহ থেকে এই তিন ধারা তিনদিকে প্রবাহিত হয়ে চলেছে ।
মহিলার নাম সাথী। সাথীদির স্বামীর শ্বাসকষ্ট আছে তাই তিনি তার সঙ্গী হতে পারেনি। তবে মেয়ে আর বাবা অনেক চিন্তা ভাবনা করে একাই যাবার অনুমতি দিয়েছে তাকে। তাদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ ।
যাত্রাপথে আবার সঙ্গীও জুটিয়ে ছিলে?
বয়স হলেও সাথীদি বেশ সাহসী মহিলা।
যাইহোক , রাতের খাবার খেয়ে আমরা ট্রেনে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে হিমালয়ের প্রবেশদ্বার হরিদ্বারে পৌঁছালাম।
স্টেশন লাগোয়া শিবমূর্তি , হোটেলে উঠলাম ।
নিজের নিজের ঘর আর লাগেজ বুঝে নিয়ে স্নান সেরে নিলাম। প্রাতঃরাশ শেষ করে একটু ঘুমিয়ে উঠে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহরের কিছু ছবি তোলার জন্যে। হোটেলে ফিরে দুপুরে গরমভাত , আলু – উচ্ছে ভাজা , আলুপটলের তরকারি , মাছের ঝোল এবং চাটনি বেশ ভালই খেলাম ।
বাঃ বেশ সুন্দর খাবার দিয়েছিল তোমাদের। টেস্ট কেমন ছিল?
মন্দ নয়। চলে যায়। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় গরম গরম খাবার খেতে বেশ লাগছিলো।
তোমার সাথীদি নিশ্চয়ই খুব কথা বলে?
হ্যাঁ গো উনি বক্তা আর আমি শ্রোতা।
আমার স্বভাব তো জানা তোমার। আমি খুব কম কথা বলি । বিকেলে অবশ্য সাথীদি ও আমরা তিনজন একসাথে গঙ্গা দর্শনে গেলাম । আরতি দেখে ফিরলাম ।
পরদিন সকালে রওনা হলাম সীতাপুরের উদ্দেশে। দেবপ্রয়াগে এসে দশ মিনিটের জন্য বাস থেকে নেমে সঙ্গম দেখতে গেলাম। মন্দাকিনী ও অলকানন্দার মিলিত ধারায় ভাগীরথীর মিলন ঘটেছে দেবপ্রয়াগে । অপূর্ব সে সৌন্দর্য । উদার উন্মুক্ত পরিবেশে দুই পাহাড়ী নদীর সঙ্গম যে কি অপরূপ তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।আমি মুগ্ধ ও স্তব্ধ বিস্ময়ে দুচোখ ভরে দেখলাম ।
বিশাল খাড়া পাহাড়ের গাঁ-ঘেষে আমাদের বাস চলেছে । অপরদিকে গভীর খাদ । দুটো বাস পাশাপাশি উঠতে নামতে পারে এতটা চওড়া পথ ভালো , ভাঙ্গা চোরা নয় । ভয় হচ্ছিল যদি চাকা পিছলে যায় তাহলে আর রক্ষে নেই ।
চা খেয়ে বাসে উঠলাম, থামল রুদ্র প্রয়াগে যেখানে স্বর্গের মন্দাকিনী মিলিত হয়েছে অলকানন্দার সাথে । তাদের মিলিত ধারা বয়ে চলেছে কলকল ছলছল অনুপম ছন্দে । পাহাড়ের বুকে যে কোন দু’টো পাহাড়ী নদীর মিলনদৃশ্যই অপূর্ব । পাহাড়ের বুক চিরে আকাশ কাঁপিয়ে নদী উৎস থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুটে চলেছে বাঁধনহারা বন্যতায় ছন্দময়। পিছনে ফেলে রুদ্রপ্রয়াগের মিলনস্থল আমাদের বাস চলেছে মন্দাকিনীর উৎসের দিকে । বহুক্ষণ ধরে মন্দাকিনীকে দেখতে দেখতে চলেছি । অবশেষে বিকেল ছ’টায় আমরা পৌঁছলাম সীতাপুর।