আমি স্রুরা
কে?
আমি স্রুরা ভেতরে আসতে পারি?
এস।
ঘরে হালকা নীল রঙের বাতি জ্বলছিল। মাথুর টেবিলে ঝুঁকে কী যেন পড়ছিলেন, স্রুরার দিকে চোখ তুলে তাকালেন।
এত রাতে আপনার ঘরে আসার নিয়ম নেই, কিন্তু—
স্রুরা চেয়ার টেনে বসলে না। তাঁর স্বভাবসুলভ উদ্ধত চোখ জ্বলতে লাগল। মাথুর বললেন, এখন কোনো নিয়ম-টিয়ম নেই স্রুরা। তুমি কি কিছু বলতে এসেছ?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমি এখন কিছু শুনতে চাই না। চার রাত ধরে আমার ঘুম নেই। আমি ঘুমুতে চাই। এই দেখ আমি একটা প্রেমের গল্প পড়ছি। মন হালকা হয়ে সুনিদ্রা হতে পারে, এই আশায়।
স্রুরা কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসলেন। আমিও ঘুমাতে শারি না, তার জন্যে আমি রাত জেগে জেগে প্রেমের গল্প পড়ি না। অবসর সময়টাও আমি ভাবতে চেষ্টা করি।
সিডিরির রিপোর্ট তো দেখেছ?
হ্যাঁ দেখেছি। ধ্বংস রোধ করার কোনো পথ নেই।
যখন নেই, তখন রাতে একটু শান্তিতে ঘুমুতে চেষ্টা করা কি উচিত নয়? চিন্তা এবং পরিকল্পনার জন্যে তো সমস্ত দিন পড়ে রয়েছে।
থাকুক পড়ে। আমি একটা সমাধান বের করেছি।
মাথুর প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, তুমি বলতে চাও পৃথিবী রক্ষা পাবে?
না।
তবে? স্রুরা কথা না বলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মাথুরের দিকে। ঠান্ডা গলায় বললেন, আপনার এ সময় উত্তেজনা মানায় না। আপনি অবসর গ্রহণ করুন।
তুমি কী বলতে চাও, বল।
আমি একটি সমাধান বের করেছি। পৃথিবী রক্ষা পাবার পথ নেই, কিন্তু মানুষ বেচে থাকবে। লক্ষ লক্ষ বৎসর পর আবার সভ্যতার জন্ম হবে। ফিহার মতো, মাথুরের মতো, স্রুরার মতো মহাবিজ্ঞানীরা জন্মাবে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
স্রুরা তুমি নিজেও উত্তেজিত।
দুঃখিত। আপনি কি পরিকল্পনাটি শুনবেন?
এখন নয়, দিনে বলো।
আপনাকে এখনি শুনতে হবে, সময় নেই হাতে।
স্রুরা ঘরের উজ্জ্বল বাতি জ্বেলে দিলেন। মাথুর তাকিয়ে রইলেন স্রুরার দিকে। দুর্লভ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এই যুবকটিকে হিংসা হতে লাগল তাঁর। স্রুরা খুব শান্ত গলায় বলে যেতে লাগলেন–শুনতে শুনতে মাথুর এক সময় নিজের রক্তে উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলেন।
বছর ত্রিশেক আগে মীটস নামে একটা মহাশূন্যযান তৈরি করা হয়েছিল! আদর করে তাকে ডাকা হত। দ্বিতীয় চন্দ্র বলে। আকারে চন্দ্রের মতো এত বিরাট না হলেও সেটিকে ছোটোখাটো চন্দ্র অনায়াসে বলা যেত। মহাজাগতিক রশিল্পী থেকে সংগৃহীত শক্তিতে একটি কল্পনাতীত বেগে চলবার মতো ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দুটি পূর্ণাঙ্গ ল্যাবরেটরি ছিল এরই মধ্যে। একটি ছিল মহাকাশের বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জে প্রাণের বিকাশ সম্পর্কে গবেষণা করার জন্যে। বিজ্ঞানী মীটসের তত্ত্বাবধানে এই অসাধারণ যন্ত্রযান তৈরি হয়েছিল–নামকরণও হয়েছিল তাঁর নাম অনুযায়ী। এটি তৈরি হয়েছিল তাঁরই একটি তত্ত্বের পরীক্ষার জন্যে।
মীটস দেখলেন নক্ষত্রপুঞ্জ NGC 1303 আলোকের চেয়ে দ্রুত গতিতে সরে যাচ্ছে। আলোর কাছাকাছি গতিসম্পন্ন নক্ষত্রপুঞ্জের সন্ধান পাওয়া গেছে অনেক আগে, এই প্রথম তিনি বিজ্ঞানের সূত্রে সম্ভব নয় এমন একটি ব্যাপার পরখ করলেন। তিনি অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন এবং খুব অল্প সময়ে এর ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন, আলোর গতি ধ্রুব নয়। এটি ভিন্ন ভিন্ন পরিমন্ডলে ভিন্ন।–স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতির নিয়মাবলীও ভিন্ন ভিন্ন পরিমন্ডলে ভিন্ন। মীটস এটা ব্যাখ্যা করেই চুপ করে গেলেন। তৈরি করলেন মহাশূন্যযান–মীটস, যা পাড়ি দেবে এড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ ছাড়িয়েও বহুদূরে NBP203 নক্ষত্রপুঞ্জে। সেখানে পৌঁছুতে তার যুগের পর যুগ লেগে যাবে, কিন্তু পৌঁছুবে ঠিক। সঙ্গে সঙ্গে মীটসের ধারণা সত্য বা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। তাঁর দুর্ভাগ্য মহাশূন্যযানটি প্রস্তুত হবার পরপর তিনি মারা যান। তাঁর পরিকল্পনাও স্থগিত হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা তখন প্রতি-বস্তুর ধর্মকে বিশেষ সূত্রে ব্যাখ্যা করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
স্রুরার পরিকল্পনা আর কিছুই নয়, পৃথিবীর একদল শিশু মীটসে করে সরিয়ে দেওয়া। শিশুরা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র মহাশূন্যযানের ভিতর শিক্ষা লাভ করবে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র মাইক্রোফিল্ম করে রাখা হবে মহাশূন্যযানের এক লাইব্রেরি কক্ষে। এই সব শিশু বড় হবে। তাদের ছেলেমেয়ে হবে, তারাও শিখতে থাকবে, তারাও বড় হবে–
থাম থাম বুঝতে পারছি। মাথুর হাত উঁচিয়ে স্রুরাকে থামালেন। বললেন, কতদিন তারা এ রকম ঘুরে বেড়াবে?
যতদিন বসবাসযোগ্য কোনো গ্রহ না পায়। যতদিন মহাশূন্য থাকবে, ততদিন তো খাদ্যের কোনো অসুবিধা নেই!
তা নেই–তা নেই। কিন্তু—
আবার কিন্তু কিসের? মহাশূন্যধান তৈরি আছে, কাজ যা করতে হবে তা হল ল্যাবরেটরি দুটি সরিয়ে মাইক্রোফিল্ম লাইব্রেরি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বসান, তার জন্যে তিন মাস সময় যথেষ্ট। এ দায়িত্ব আমার!
মাথুর চুপ করে রইলেন। স্রুরা অসহিষ্ণু হয়ে মাথা ঝাকালেন, আপনার চুপ করে থাকা অর্থহীন। মানুষের জ্ঞান এভাবে নষ্ট হতে দেয়া যায় না।
তা ঠিক। কিন্তু সিরানদের মতামত–
কোনো মতামতের প্রয়োজন নেই। এ আমাকে করতেই হবে, আমি কম্পিউটার সিডিসিকে নির্দেশ দিয়ে এসেছি মহাশূন্যযানটির যাত্ৰাপথ বের করতে। সিডিসিকে মহাশূন্যযানে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। মহাশূন্যযান নিয়ন্ত্রণ করবে। সে।
তুমি নির্দেশ দিয়ে এসেছ?
হ্যাঁ, আমি সমস্ত নিয়ম-কানুন ভেঙে এ করেছি। আমি আপনাকেও মানি না–আপনার মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটেছে। গত একমাস আপনি প্রত্যেক মীটিং-এ আরোল-তাবোল বিকেছেন। আপনি বিশ্রাম নিন।
স্রুরা উজ্জ্বল বাতি নিভিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
মাথুর হতভম্ব হয়ে বের হয়ে এলেন ঘরের বাইরে। অন্ধকারে কে যেন ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ দেখলে পাথবের মুর্তি মনে হয়। মাথুর ডাকলেন, কে ওখানে?
আমি ওলেয়া।
ওখানে কী করছেন?
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছি। আমার একটি ছেলে চাঁদে এ্যাকসিডেন্ট করে মারা গিয়েছিল। আপনার হয়তো মনে আছে।
আছে। কিন্তু এত দূরে এসে চাঁদ দেখছেন? আপনার ঘর থেকেই তো দেখা যায়।
তা যায়। আমি এসেছিলাম আপনার কাছে। এসে দেখি স্রুরা গল্প করছেন। আপনার সঙ্গে, তাই বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম।
বলুন কী বলবেন।
আমাকে ছুটি দিন আপনি। বিজ্ঞানীরা তো কিছুই করতে পারছেন না। শুধু শুধু এখানে বসে থেকে কী হবে? মরবার আগে আমি আমার ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে থাকতে চাই।
তা হয় না ওলেয়া।
কেন হয় না?
আপনি চলে গেলে অন্য সবাই চলে যেতে চাইবে। সিরান-পল্লীতে কেউ থাকবে না।
নাই-বা থাকল, থেকে কী লাভ?
শেষ মুহূর্তে আমরা একটা বুদ্ধি তো পেয়েও যেতে পারি।
আপনি বড় আশাবাদী মাথুর।
হয়তো আমি আশাবাদী। কিন্তু আপনি নিজেও তো জানেন, পৃথিবী আরো একবার মহাসংকটের সম্মুখীন হয়েছিল। সৌর বিস্ফোরণে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। অথচ দু, শ বছর আগের বিজ্ঞানীরাই সে সমস্যার সমাধান করেছেন। আমরা তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি জানি, আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।
ওলেয়া অসহিষ্ণুভাবে মাথা নাড়লেন। শুকনো গলায় বললেন, আমি কোনো ভরসা পাচ্ছি না। এই মহাসংকট তুচ্ছ করে ফিহা বেড়াতে চলে গেলেন। আপনি নিজে এখন পর্যন্ত কিছু করতে পারেন নি। স্রুরার যত প্রতিভাই থাকুক, সে তো শিশুমাত্র, এ অবস্থা–?
কথা শেষ হওয়ার আগেই দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল, স্রুরা উত্তেজিতভাবে হেটে আসছেন। হাত দুলিয়ে হাঁটার ভঙ্গিটাই বলে দিচ্ছে একটা কিছু হয়েছে।
মহামান্য মাথুর।
বল।
এইমাত্র একটি মেয়ে এসে পৌঁচেছে। তার হাতে মহামান্য ফিহার নিজস্ব পরিচয়-পত্র রয়েছে।
সে কী!
মেয়েটি বলল, সে একটি বিশেষ কাজে এসেছে, কী কাজ তা আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বলবে না।
কিন্তু ফিহার পরিচয়-পত্র সে পেল কোথায়?
ফিহা নিজেই নাকি তাকে দিয়েছেন।
আশ্চর্য!
লী নিজেও বেশ হকচাকিয়ে গিয়েছিল। সিরান এলাকায় এমন অবাধে ঘুরে বেড়াবে তা কখনো কল্পনা করে নি। ফিহার ত্রিভুজাকৃতি কার্ডটি মন্ত্রের মতো কাজ করছে। অনেকেই যে বিস্ময়ের সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে আছে, তাও সে লক্ষ করল। বুড়োমতো এক ভদ্রলোক বিনীতভাবে লীর নামও জানতে চাইলেন।
মাথুর বললেন, শুনেছি আপনি ফিহার কাছ থেকে আসছেন?
জ্বি।
আপনি কি তাঁর কাছ থেকে কোনো খবর এনেছেন?
জ্বি না।
তবে?
আমি একটা বই নিয়ে এসেছি, আপনি সে বইটি আশা করি পড়বেন!
কী নিয়ে এসেছেন?
একটি বই।
লী তার ব্যাগ থেকে বইটি বের করল।
কী বই এটি?
পড়লেই বুঝতে পারবেন। আশা করি আজ রাতেই পড়তে শুরু করবেন।
মাথুর হাত বাড়িয়ে বইটি নিলেন। বিস্ময়ে তাঁর ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছিল। লী বলল, আমার বড় তৃষ্ণা পেয়েছে। আমি কি এক গ্লাস পানি খেতে পারি?