পর্ব – ৭
‘কী ব্যাপার? গাড়ি আটকালে কেন?’ ভরাট গলা। শুনেই মনে হয়, এই মানুষটা সবসময় আদেশ দিতে অভ্যস্ত।
‘আমার…আমার বাচ্চাটার খুব জ্বর…’ হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল জিশান, ‘এখুনি হাসপাতালে না নিয়ে গেলে ছেলেটা মরে যাবে…’ কথা বলতে-বলতে জিশান কেঁদে ফেলল। ব্যস্তভাবে হাত নেড়ে মিনিকে কাছে ডাকল। তারপর কী মনে করে ও হাতজোড় করে বলে উঠল, ‘আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান, স্যার। আমাদের একটু হাসপাতাল পৌঁছে দিন। প্লিজ। নইলে ছেলেটা মরে যাবে। আমাদের বাঁচান, স্যার…।’
লোকটা গাড়ির ভেতরে কাকে যেন ইশারা করল। অমনি গাড়ির হেডলাইট নিভে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে লোকটার হাতে একটা টর্চ জ্বলে উঠল। জোরালো আলো ছিটকে এসে পড়ল জিশানের অসহায় মুখে, মিনির মুখে। মিনির মুখে আলোটা দু-চার সেকেন্ড বেশি রইল। তারপর ছায়ামানুষটা বলল, ‘ভয় নেই—আমরা পুলিশের লোক। এসো, গাড়িতে ওঠো। তোমাদের হাসপাতালে নামিয়ে দিচ্ছি—।’
জিশান আর মিনি প্রায় দৌড়ে চলে এল গাড়ির কাছে। জিশান আবেগ জড়ানো গলায় বলল, ‘থ্যাংক য়ু, স্যার…থ্যাংক য়ু…।’
লোকটা পিছনের দরজা খুলে ধরল। কোনওরকমে ছাতা দুটো বন্ধ করে পলিথিনে জড়ানো শানুকে সামলে ওরা গাড়িতে উঠে বসল। প্রথমে মিনি, তারপর জিশান। আর সবশেষে উঠে পড়ল লোকটা।
গাড়ির দরজা বন্ধ করার সঙ্গে-সঙ্গেই কানফাটানো শব্দে বাজ পড়ল। শানু কেঁপে উঠল মিনির হাতে। কঁকিয়ে কেঁদে উঠল।
হেডলাইট জ্বলে উঠল। গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। হেডলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি আর ভাঙাচোরা রাস্তা।
জিশানের পাশে বসা লোকটা জিশানকে জিগ্যেস করল, ‘কোন হসপিটাল?’
‘যেখানে হোক। আমার বাচ্চাটা যেন বেঁচে যায়, স্যার।’
‘ঠিক আছে। ”সোলাস মেডিকেল কলেজ” চলো।’ ড্রাইভারকে লক্ষ করে শেষ কথাটা বলল লোকটা।
মিনি লক্ষ করল, গাড়ির সামনের সিটে দুজন—তার মধ্যে একজন গাড়িটা চালাচ্ছে। আর পিছনের সিটে ওরা তিনজন।
এই প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এই তিনজন পুলিশের লোক কোন কাজে বেরিয়েছে?
মিনি কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছিল। শানুকে আরও কাছে টেনে নিয়ে দোলা দিয়ে ও ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করল। হাতের পিঠ দিয়ে বাচ্চাটার জ্বর দেখল। ভয়ে ওর প্রাণটা বারবার কেঁদে উঠছিল। শানু ওদের সঙ্গে থাকবে তো? নাকি আকাশে একটা তারা কম আছে? সেখানে শানুকে খুব দরকার?
শানুকে একটু শান্ত করার পর মিনি জিশানের বাহু আঁকড়ে ধরল। ওকে কাছে টানল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কীরকম বিচ্ছিরি একটা গন্ধ…।’
জিশান ওর ঊরুতে চাপ দিয়ে ওকে চুপ করতে ইশারা করল। কারণ, গন্ধটা ও চিনতে পেরেছে।
মদের গন্ধ।
জিশানের মনে একটা আশঙ্কা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু শানুকে বাঁচানোর মরিয়া দায় সেই আশঙ্কার গলা টিপে ধরছিল। মিনির ঊরু থেকে ও হাতটা সরাল না। ওর মনে হল, মিনিকে ছুঁয়ে থাকলে ওর মনে উথলে ওঠা ভয়টা কমে যাবে।
গাড়ি ঝাঁকুনি তুলে ছুটে যাচ্ছিল। ঝমঝম বৃষ্টি। নির্জন রাস্তা। রাস্তার দুপাশে কোথাও আলো আছে, কোথাও নেই।
জিশানের পাশে বসে থাকা লোকটা হঠাৎই জিগ্যেস করল, ‘কোথায় থাকো?’
জিশান মদের গন্ধের ঝাপটা টের পেল। লোকটার দিকে ফিরে তাকাল। বৃষ্টির ফোঁটা থেকে ঠিকরে আসা হেডলাইটের আলোর আভায় লোকটার আবছা মুখ দেখা যাচ্ছে।
জোরে শ্বাস টেনে জিশান বলল, ‘মালির বাগানের বস্তিতে। যেখানে গাড়িতে উঠলাম তার কাছেই…।’
লোকটা আর কোনও কথা বলল না।
গাড়িটা এ-রাস্তা সে-রাস্তা ধরে বাঁক নিয়ে ছুটে চলল। কতকগুলো রাস্তায় এমন জল দাঁড়িয়ে গেছে যে, গাড়িটাকে জল ঠেলে এগোতে হচ্ছিল। ড্রাইভার মাঝে-মাঝেই বিরক্তির শব্দ করছিল।
মিনি অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। ভাবছিল, সোলাস মেডিকেল কলেজ আর কতদূর। আর কতদূর? জিশানকে সে-কথা একবার জিগ্যেসও করল। জিশান চাপা গলায় বলল যে, সোলাস মেডিকেল কলেজ ও চেনে না।
একটু পরেই গাড়িটা একটা মাঝারি রাস্তায় ঢুকে পড়ল। রাস্তাটা নির্জন। দু-ধারে বড়-বড় ভাঙাচোরা পুরোনো বাড়ি। ফুটপাথে বেশ কয়েকটা রুগ্ন গাছ। তার নীচে দু-চারটে ঝুপড়ি।
রাস্তাটায় তেমন আলো নেই। গাড়ির হেডলাইটের আলোই একমাত্র ভরসা। সেই আলো জমে থাকা বৃষ্টির জলে নাচছে।
রাস্তার শেষে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে একটা বড় বিল্ডিং—চারতলা কি পাঁচতলা হবে। তার গায়ে একটা গ্লো-সাইন জিশানের নজরে পড়ল। নীল আর লাল আলোকরেখা দিয়ে লেখা ‘সোলাস মেডিকেল কলেজ’। তার মধ্যে বেশ কয়েকটা অক্ষর অন্ধকার—দাঁতের পাটি থেকে উধাও হয়ে যাওয়া দাঁতের মতো সেই রঙিন আলোর ভাঙাচোরা ছায়া রাস্তায় জমে থাকা জলে কাঁপছে।
মাঝারি রাস্তাটা শেষ হল সোলাস মেডিকেল কলেজে গিয়ে। জিশান দেখল, বিল্ডিং-এর দুপাশ দিয়ে দুটো সরু গলি অন্ধকারে ঢুকে গেছে।
গাড়িতে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে প্রায় কোনও কথাই বলেনি। শুধু জিশানের পাশে বসা লোকটা দু-চারবার ছোট্ট করে ড্রাইভারকে কী যেন বলেছে। সেইসব কথার মানে বুঝতে পারেনি জিশান। হয়তো সাদা পোশাকের পুলিশের কোনও সাংকেতিক ভাষা হবে।
হসপিটাল বিল্ডিং-এর দিকে তাকিয়ে জিশানের একটু অবাক লাগছিল। কারণ, বিল্ডিং-এর নানান তলার কয়েকটা জানলায় খাপছাড়াভাবে আলো জ্বলছিল। বাকি সব জানলা অন্ধকার।
এখন রাত বেশি হয়নি। হাসপাতালের ব্যস্ততা এসময় কিছু কম হওয়া উচিত নয়। তা হলে…।
জিশান একটু অস্থির হয়ে পড়ছিল। মিনিকে ছুঁয়ে থাকায় ওর অস্থিরতাও টের পাচ্ছিল। ওদের করসিকা-এইট গাড়িটা গতি কমিয়ে হসপিটালের গাড়িবারান্দার নীচে গিয়ে দাঁড়াল।
কোনও কথা না বলে সামনের সিটে বসা দুজন দুপাশের দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল।
জিশানের পাশের লোকটা জিশানকে বলল, ‘নেমে পড়ো। আমরা এসে গেছি।’ বলে গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল।
জিশান নীচু গলায় মিনিকে বলল, ‘এসো—।’ তারপর নিজে নেমে দাঁড়াল।
শানুকে ভালো করে মুড়ে জিশানের হাতে দিল মিনি। সাবধানে গাড়ি থেকে নামল।
গাড়ির দরজাগুলো শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। জিশানের পাশে দাঁড়ানো লোকটা ওর পিঠে হাত রেখে চাপ দিল : ‘চলো—।’
ওরা সবাই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ওদের পা ফেলার ছপছপ শব্দ বেশ জোরে শোনা গেল। ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটায় জিশানের হঠাৎ শীত-শীত করে উঠল।
ওরা ভেতরে ঢোকার পর কেউ একজন সদর দরজাটা বন্ধ করে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে ঝড়-বৃষ্টির আওয়াজের মুখে কেউ যেন রুমাল চেপে ধরল।
ভেতরের দৃশ্যটা জিশান আর মিনিকে অবাক করে দিল। এতটাই যে, ওরা হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চারপাশটা দেখতে লাগল। একইসঙ্গে দেখতে লাগল তিনটে মানুষকেও—যারা এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে দেবতা হয়ে ওদের উপকার করেছে।
যে-ঘরটায় ওরা ঢুকেছে সেটা হসপিটালের রিসেপশান লাউঞ্জ। তবে এককালে ছিল—এখন আর নয়।
স্পেসটা মাপে বিশাল। দেখেই বোঝা যায়, বহুবছর ধরে অবহেলায় পরিত্যক্ত। দেওয়ালে তিনটে জানলা, দুটো দরজা। সবগুলোই বন্ধ। সদর দরজার মুখোমুখি দেওয়ালে একটা করিডর ভেতর দিকে চলে গেছে।
সারাটা ঘর ধুলোয় ধুলোময়। চেয়ার, টেবিল, সোফা, রিসেপশান কাউন্টার সব এলোমেলোভাবে ঘরের নানান দেওয়াল ঘেঁষে ডাঁই করা। তার ওপরে কয়েকটা চেয়ার আর সোফা উলটো করে চাপানো। কয়েকটা আসবাবপত্র সাদা পলিথিন শিট দিয়ে ঢাকা। শিটের ওপরে ধুলোর পুরু আস্তরণ।
ঘরের দেওয়ালে অন্তত গোটাদশেক টুইন টিউবলাইটের ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফিটিং। তাই পরিত্যক্ত ঘরটা আলোয় ঝলমল করছে। বাঁ-দিকের দেওয়ালে একটা ডিজিটাল ঘড়ি। তার উজ্জ্বল লাল এল. ই. ডি. বাতিগুলো ভুল সময় দেখাচ্ছে।
রিসেপশান স্পেস-এ একটাও লোক নেই। জিশানের মনে হল, ঘরটা এতদিন ধরে পরিত্যক্ত যে, তা থেকে আরশোলা আর ছাতা-ধরা গন্ধ বেরোচ্ছে। তার সঙ্গে মিশে গেছে ধুলোর গন্ধ আর মদের গন্ধ।
এর নাম হসপিটাল! আর এরাই-বা কেমন পুলিশ!
অবাক হওয়া ভয়ের চোখে মিনির দিকে তাকাল জিশান। কী এক অদৃশ্য সংকেতে সাড়া দিয়ে মিনিও সেই মুহূর্তে তাকিয়েছে স্বামীর দিকে। চোখে-চোখে ওদের কী কথা হল কে জানে! মিনি কেঁদে ফেলল। ছোট্ট শানুকে জিশানের হাত থেকে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে আঁকড়ে ধরল বুকে। বাচ্চাটা বোধহয় ঘুমিয়ে ছিল—এই ঝটকায় জেগে গিয়ে কঁকিয়ে উঠল।
জিশান খুব ধীরে-ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। তাকাল তিন দেবতার দিকে। ওদের ঠান্ডা পাথরে তৈরি মুখগুলো এখন অপদেবতার মতো লাগছে।
মুখগুলোকে খুঁটিয়ে দেখল জিশান।
ওদের পোশাক জলে ভেজা। মাথার ভেজা চুল লেপটে রয়েছে কপালে, গালে। মুখের চেহারায় তিনজনের মিল না থাকলেও ওদের চোখজোড়া একইরকম : মরা মাছের চোখ।
ওদের তিনজনের দুজন বেঁটে, একজন বেশ লম্বা। উচ্চতার হিসেবেই জিশানের মনে হল, লম্বা লোকটাই গাড়িতে জিশানের পাশে বসেছিল।
প্রথম বেঁটে লোকটার মাথায় টাক। রোগা। রং কালো। মুখে গোঁফ-দাড়ির বালাই নেই। ফলে একটা বাচ্চা-বাচ্চা ভাব ফুটে উঠেছে। লোকটা বড়-বড় শ্বাস ফেলছিল। মিনির দিকে তাকিয়ে ছিল।
দ্বিতীয় বেঁটে লোকটা বেশ মোটা, গোলগাল লালটু মুখ। ফরসা। ঠোঁটের ওপরে পাতলা গোঁফ। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। দেখে মনে হয়, বয়েস ছাব্বিশ কি সাতাশের বেশি হবে না। চোখ দুটো ছোট-ছোট। ভেতরে ঢোকানো। বারবার নাক টানছে। বোধহয় জলে ভিজে ঠান্ডা লেগেছে।
লম্বা লোকটাকে দেখে মনে হয় এটাই পালের গোদা। কখন যে সে একটা সিগারেট ধরিয়েছে জিশান টের পায়নি। হয়তো রিসেপশান স্পেসের জরিপে ওর মন ব্যস্ত ছিল বলে সিগারেটের গন্ধ নাকে আসেনি।
লোকটার রং তামাটে। জলে ভেজা মুখ যেন কাঠখোদাই ভাস্কর্য। চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে আছে। দু-গালে ব্রণের দাগ। কপালের ওপরে ভেজা চুল লেপটে আছে। সিগারেটের ধোঁয়া ছুড়ে দিচ্ছে জিশানের দিকে। ওর কালচে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দাঁত দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটের ভাঁজে সামান্য হাসির ছোঁওয়া থাকলেও চোখে তার লেশমাত্র ছিল না।
জিশানের বুকের ভেতরে দুরমুশ পড়ছিল। মিনির আতঙ্কের গোঙানি আর শানুর মিহি গলার কান্না ওর চিন্তা ওলটপালট করে দিচ্ছিল। কী করবে এখন? কী করবে?
জিশান লম্বা লোকটাকে প্রশ্ন করল, ‘এটা…এটা হসপিটাল?’
লম্বা হাসল। সিগারেটে ছোট মাপের হ্যাঁচকা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। সোলাস মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল। এককালে হেভি নাম ছিল। ভালো-ভালো ব্রেনি ছেলেমেয়েরা এখানে পড়ত। এখন আমরা পড়ি—।’ সঙ্গী দুজনের দিকে আড়চোখে তাকাল সে। ছোট্ট করে হাসল। ধোঁয়া ছাড়ল আবার।
অস্বাভাবিক জোরে বাজ পড়ার শব্দ হল। আলো ঝলসে গেল জানলায়। গোটা বিল্ডিংটা থরথর করে কেঁপে উঠল।
‘আমাদের ছেড়ে দিন। বাচ্চাটা মরে যাবে।’ ওর গলা কান্নায় ভেঙে পড়ছে দেখে জিশান নিজেই অবাক হয়ে গেল : ‘আপনারা তো পুলিশের লোক। দয়া করুন…।’
‘হ্যাঁ, পুলিশের লোক। তবে আমরা দু-দিকেই আছি।’ বলে হ্যা-হ্যা করে হেসে উঠল লম্বা লোকটা।
মিনি গোঙানি মেশানো গলায় বলে উঠল, ‘আমাদের একটা হসপিটাল কি নার্সিংহোমে নিয়ে চলুন। বাচ্চাটার আবার জ্বর এসে গেছে।’
লম্বা লোকটা সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে টুকরোটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিল। ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে মাথা নড়ল : ‘হ্যাঁ, নিয়ে যাব, নিয়ে যাব। কোনও চিন্তা নেই। আধঘণ্টার মধ্যেই তোমাদের ছেড়ে দেব।’
জিশান ভয়ের চোখে মিনির দিকে তাকাল।
টাকমাথা বেঁটে লোকটার দিকে তাকিয়ে লম্বা লোকটা কী একটা যেন ইশারা করল। ইশারা বুঝতে পেরে বেঁটে রিসেপশান কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। তার পিছনে ঝুঁকে পড়ে কী যেন খুঁজতে লাগল।
লম্বা লোকটা ফুসফুসে লুকিয়ে রাখা সিগারেটের ধোঁয়া একটু-একটু করে ছাড়ছিল। সেই কাজ করতে-করতেই জিশানকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
‘জিশান।’
হাসল লোকটা : ‘ও. কে., জিশান। বাচ্চাটাকে এবার তুমি কোলে নাও। তোমার বউকে ফ্রি করে দাও।’
জিশান পাগলের চোখে লম্বার দিকে তাকাল। এসব কথার মানে কী? তোমার বউকে ফ্রি করে দাও! কেন?
লম্বাকে সে-কথাই জিগ্যেস করল ও।
‘কেন?’
‘কোশ্চেন কোরো না। যা বলছি তাই করো।’ কথা শেষ করেই আর-এক সঙ্গীকে ইশারা করল লম্বা।
সঙ্গে-সঙ্গে বেঁটে-লালটু লোকটা মিনির পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।
লম্বা লোকটার দিকে অপলকে তাকিয়ে জিশান মনে-মনে একটা হিসেব কষছিল। ও কি পারবে না তিন ঘুষিতে এই লোকটাকে মাটিতে পেড়ে ফেলতে? যদিও-বা পারে, তারপর? আরও তো দুজন বাকি থাকবে।
জিশান হিসেব করে দেখল, ও পেরে উঠবে না। ও যখন লম্বার সঙ্গে লড়বে তখন বাকি দুজন ওকে পিছন থেকে আক্রমণ করবে। অথবা, আরও সহজ—ওরা মিনি আর শানুর দখল নিয়ে নেবে।
জিশান লম্বা লোকটার দিকে তাকিয়ে হিসেব কষছিল। তাই টাকমাথা বেঁটে লোকটার দিকে নজর রাখতে পারেনি। যদি পারত, তা হলে হিসেব কষার ব্যাপারটা ও মাঝপথেই থামিয়ে দিত।
লম্বার ইশারায় ও ঘাড় ঘুরিয়ে টাকমাথার দিকে দেখল। সঙ্গে-সঙ্গে ওর শরীরের ভেতরে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল।
টাকমাথা লোকটার ডানহাতে একটা দু-ফুট লম্বা ঝকঝকে চপার। ওটা হাতে ঝুলিয়ে ও জিশানদের কাছে এগিয়ে আসছে।
মিনি অসহায়ভাবে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল।
লম্বা হেসে বলল, ‘জোরে চেল্লালেও কোনও প্রবলেম নেই। এখানে আমরা ছাড়া শোনার মতো আর কোনও পাবলিক নেই।’ জিশানের দিকে চোখের ইশারা করল : ‘নাও। ঝটপট বাচ্চাটাকে নিয়ে বউকে ফ্রি করো। কাজের সময় এসব ক্যাওড়া কিচকিচ ভাল্লাগে না।’
টাকমাথা লোকটা তখন দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে চপারটা শূন্যে তুলে বাতাস কেটে শ্যাডো প্র্যাকটিস করছে আর হাসছে।
জিশানের চোখের সামনে একটা দু:স্বপ্ন ভেসে উঠল। লালে মাখামাখি দু:স্বপ্ন। ও তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে শানুকে কোলে নিল। সঙ্গে-সঙ্গে মিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
লম্বা লোকটা জিশানকে বলল, ‘গুড বয়। এবার ছেলেকে নিয়ে ভেতরের ঘরে যাও।’ বেঁটে-লালটু লোকটাকে লক্ষ করে সে বলল, ‘যা, বসকে খবর দে। বল মাল রেডি। কত নম্বর ঘরে ডেলিভারি দেব জিগ্যেস কর…।’
বেঁটে-লালটু রিসেপশান স্পেসের ডানদিকের একটা দরজার দিকে হাঁটা দিয়েছিল। আর টাকমাথা লোকটা তরোয়াল খেলা থামিয়ে চপার তুলে জিশানকে ভেতরের করিডরের দিকে এগোতে ইশারা করল। মুখে বলল, ‘জলদি। কুইক।’
মিনি বুকের কাছে দু-হাত জড়ো করে গুঙিয়ে কাঁদছিল। আর জিশানের বুকের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। ওদের তিনজনের মামুলি জীবনে এরকম ভয়ংকর ঘটনা কখনও ঘটবে ও ভাবতে পারেনি। আজ রাতেই কি শেষ হয়ে যাবে ওদের তিনজনের জীবন?
তখনই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেল জিশান। কোনও একটা সিঁড়ি ধরে একটা ভারী শরীর ধীরে-ধীরে নেমে আসছে।
জিশান থমকে দাঁড়াল। আওয়াজটা কোনদিক থেকে আসছে বুঝতে চেষ্টা করল।
কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই ও চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল, বেঁটে-লালটু লোকটা যে-দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটা ও খোলার আগেই দরজার ওপাশ থেকে পাল্লায় প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিল কেউ।
সেই ধাক্কায় বেঁটে-লালটু ছিটকে পড়ল মেঝেতে। পড়েই রইল। দড়াম শব্দ করে দরজার পাল্লা দুটো হাট হয়ে খুলে গেল। দু-দিকের দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে আধাআধি ফিরে এল, কাঁপতে লাগল।
যে-লোকটি ঘরে ঢুকল তাকে লোক না বলে পাহাড় বললেই মানায় ভালো।
লম্বায় অন্তত সাড়ে ছ-ফুট। মাথার চুল কীর্তনিয়াদের মতো ঘাড় ছাপিয়ে নেমে এসেছে। কপালের ওপরেও চুলের ঝালর। তারই ফাঁকফোকর দিয়ে ছলছলে চোখ নজরে পড়ছে। ঈগলপাখির মতো নাক। তার নীচে মোটা গোঁফ। গোঁফের পরেই তামাটে রঙের পুরু ঠোঁট। ঠোঁটজোড়া সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। তীক্ষ্ণ চিবুকে একখাবলা দাড়ি।
রিসেপশান স্পেস-এ কয়েক পা ঢুকে পাহাড়ের মতো লোকটা থমকে দাঁড়াল। পলকে চোখ বুলিয়ে পাঁচজন মানুষকে চেটে নিল।
লোকটার গায়ে একটা ছেঁড়া টি শার্ট। তার রং কালো। পায়ে নীল রঙের জিনস। জিনসের পায়া দুটো দেড়ফুট করে ছিঁড়ে বাদ দেওয়া। তাই হাঁটুর নীচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত লোমশ পা দেখা যাচ্ছে। তারপরই গাঢ় নীল রঙের স্নিকার—মোজার কোনও বালাই নেই।
লোকটার দু-হাতে নীল রঙের রিস্ট ব্যান্ড। আর ডানহাতে দুলছে একটা বাদামি রঙের বোতল।
এতক্ষণ যে-লোকটাকে জিশান পালের গোদা ভেবেছিল সে পাহাড়ের কাছে এগিয়ে গেল। মিনমিনে গলায় বলল, ‘বস, নিয়ে এসেছি…।’ কথা শেষ করার সঙ্গে-সঙ্গে মিনির দিকে দেখাল।
পাহাড় মিনির দিকে দেখল। মিনির সারা গা বৃষ্টিতে ভেজা। পাতলা ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। ঘন-ঘন চোখের পলক পড়ছে। ওর ভয়ার্ত মুখটাকে জলরঙে আঁকা ছবি বলে মনে হচ্ছে।
‘হুঁ-উ-উ…।’ মুখে অদ্ভুত এক শব্দ করল বস। মিনির দিকে পা বাড়াল। এবং সঙ্গে-সঙ্গেই বেঁটে-লালটুর বডিতে হোঁচট খেল।
বেঁটে-লালটুকে ভয়ংকর এক লাথি কষাল বস। ‘ওঁক’ শব্দ করে বেঁটে-লালটুর বডিটা কয়েক পাক গড়িয়ে গেল।
বিরক্তিতে গালাগাল দিল পাহাড়। শূন্যে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল : ‘এ লালিপপের বাচ্চাটা এখানে পড়ে কেন?’ যেন দরজার ধাক্কা খেয়ে বেঁটে-লালটু যে পড়ে গেছে সেটা পাহাড় খেয়ালই করেনি।
প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে বাকি দুজন দৌড়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল বেঁটে-লালটুর ওপর। ওর অজ্ঞান বডিটাকে চটপট টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে দিল রিসেপশান কাউন্টারের দিকে।
ততক্ষণে বস মিনির দিকে আরও কয়েক পা এগিয়ে এসেছে।
মদের গন্ধটা এখন আর লুকোচুরি খেলছিল না—বরং সরাসরি নাকে এসে ধাক্কা মারছিল।
মিনির খুব কাছে এসে বস থমকে দাঁড়াল। ছলছলে মাতাল চোখে মিনিকে অনেকক্ষণ ধরে দেখল। তারপর ফিসফিস করে উচ্চারণ করল, ‘বিউটিফুল!’
মিনির মুখে মদের বাষ্পের হলকা এসে লাগল। ও ঝটকা মেরে মুখটা একপাশে সরিয়ে নিল।
পাহাড় হাসল। বাঁ-হাতের তর্জনি মিনির চিবুকে ছোঁয়াল। তারপর তর্জনির চাপে মিনির মুখটা ধীরে-ধীরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। অনেকক্ষণ ধরে মিনিকে দেখল। শেষে ভরাট গলায় বলল, ‘যা কান্নাকাটি করার করে নাও। পরে আর প্যানপ্যান কোরো না যেন।’
রিসেপশান স্পেসের শেষ প্রান্তে জিশান পলিথিন মোড়া বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। ও যেন এখানকার কেউ নয়। ও যেন বহু দূরে দাঁড়িয়ে একটা মর্মান্তিক সিনেমা দেখছে। ও দর্শক। ওর কিছু করার নেই।
পাহাড় থেমে-থেমে বলল, ‘একে তিননম্বর ঘরে ডেলিভারি দে। ওটা পেয়িং বেড-এর ঘর। কন্ডিশন ভালো।’
জিশান আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠল : ‘না—।’
জিশান চায়নি, কিন্তু ওকে অবাক করে অবাধ্য চিৎকারটা কীভাবে যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
বস ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল জিশানের দিকে। এক ঝটকায় ডানহাতের বোতলটা ছুড়ে দিল দেওয়ালে। প্রচণ্ড শব্দে চুরমার হয়ে গেল বোতলটা। বোতলের তরল ছিটকে পড়ল। মদের বিশ্রী গন্ধে চারিদিক ম-ম করে উঠল।
আচমকা এই কাণ্ডে মিনি চমকে কঁকিয়ে উঠেছিল। বস ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। মাথা দুলিয়ে জিগ্যেস করল, ‘ও কে রে? হাজব্যান্ড? হাজব্যান্ড? না বয়ফ্রেন্ড?’
না, উত্তরের অপেক্ষা করল না। পাহাড় পায়ে-পায়ে জিশানের দিকে এগোতে লাগল। ঘরের প্রত্যেকে আশঙ্কায় পাথর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
টাকমাথা সঙ্গীর হাত থেকে এক হ্যাঁচকায় চপার ছিনিয়ে নিল। জিশানের আরও কাছে এগিয়ে এল। ওর শরীরে জিশানের শরীর মিনির চোখে ঢাকা পড়ে গেল।
জিশানের খুব কাছে এসে বাঁ-হাতে ওর চিবুক উঁচিয়ে ধরল পাহাড়। তারপর গলাটা যথাসম্ভব মিষ্টি করে জিগ্যেস করল, ‘কীসের ”না” রে? কী ”না” বলছিস?’
জিশান কাঁপছিল। ওর মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছিল না।
পাহাড় চপারটা শূন্যে তুলল। ওটার ফলাটা আশীর্বাদের ভঙ্গিতে জিশানের মাথায় পেতে রাখল। তারপর ফিসফিসে গলায় বলল, ‘আমি বলছি। আজ কোনও ”না” শুনব না। সব হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ—।’
এমন সময় জোরে বাজ পড়ল। অসহায় চূর্ণবিচূর্ণ জিশান মদের বাষ্পের বিষবাতাসে শ্বাস নিতে-নিতে কেঁদে ফেলল। আর ওর কোলে ছোট্ট শানুও কেঁপে উঠে কেঁদে ফেলল।
পাহাড় চমকে উঠল। চপারটা নামিয়ে বাচ্চার কান্নার উৎস আঁচ করে জিশানের কোলের দিকে তাকাল। কিন্তু পলিথিন আর কাপড়চোপড়ের আড়ালে শানুকে ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছিল না।
‘কে রে? কে কাঁদছে?’
‘আমাদের বাচ্চা।’ কান্না ভাঙা গলায় জিশান বলল।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাঁ-হাত বাড়াল পাহাড়। পলিথিন আর কাপড়ের আড়াল সরাল। পুঁচকে শানুকে দেখা গেল এবার। চোখ কুঁচকে কাঁদছে।
হাত থেকে চপার খসে পড়ে গেল। শানুর ওপর ঝুঁকে পড়ল পাহাড়। আঙুল দিয়ে ওর লালচে গাল ছুঁল।
‘কাঁদে না, বাবু, কাঁদে না। লক্ষ্মী ছেলে। লক্ষ্মী সোনা আমার—।’
জিশান অবাক চোখে কাছের মানুষটাকে দেখতে লাগল। তারপর বলল,—’আমার ছেলেটার ভীষণ জ্বর। এখুনি হসপিটালে না নিয়ে গেলে মরে যাবে…।’
পাহাড় যেন বিদ্যুতের শক খেল। তাড়াতাড়ি শানুর কপাল ছুঁয়ে দেখল। তারপর নিজের মাথার চুলে হাত চালিয়ে আপনমনেই বলল, ‘আমার…আমার বউটা মরে গেল। তারপর…তারপর…মা-কে না পেয়ে এইটুকুন ছেলেটাও মরে গেল। তারপর…।’
মিনি প্রায় ছুটে চলে এল শানুর কাছে। নিষ্ঠুর পাহাড়কে ভ্রূক্ষেপ না করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। পিঠ চাপড়ে দোলা দিয়ে ওর কান্না থামাতে চেষ্টা করল।
জিশান জিগ্যেস করল, ‘আপনার ওয়াইফের কী হয়েছিল?’
পাহাড় মিনির কোলে শানুকে দেখছিল। বলল, ‘সবই কপাল! এই জানোয়ার শহর। চারদিকে জংলি জানোয়ার ঘুরছে।…বউটাকে তুলে নিয়ে গেছিল। তারপর…ও ফিরে এসে সুইসাইড করল। তারপর বাচ্চাটা মরে গেল। ব্যস…সব খতম…শুধু আমি বাকি রয়ে গেছি।’
বাইরে বাজ পড়ল আবার।
পাহাড় ওর লম্বা শাগরেদের কাছে ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল। নোংরা খিস্তি দিয়ে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় দু-হাতে ওর দু-গালে একসঙ্গে চড় কষিয়ে দিল। ছোটবেলায় কাগজের ঠোঙা ফুলিয়ে হাতের চাপড়ে ফাটাত জিশান। এখন ঠিক সেইরকম কানফাটানো শব্দ হল। যমজ চড় খেয়ে লোকটা মেঝেতে খসে পড়ল। তারপর স্থির হয়ে গেল। বোধহয় বেঁটে-লালটুর মতো অজ্ঞান হয়ে গেল।
টাকমাথা লোকটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে একইরকম পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু পাহাড় ওর কাছে এগিয়ে গেল না। শুধু হুকুম ছুড়ে দিল, ‘এক্ষুনি এদের গাড়ি করে নিয়ে যা। ”ক্যাপিটাল নার্সিংহোম”-এ পৌঁছে দে। দেরি করলে বাচ্চাটার বিপদ হয়ে যাবে। জলদি বেরিয়ে পড়—।’
টাকমাথা বুলেটের গতিতে সদর দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেল।
পাহাড় মিনির কাছে এগিয়ে এল। বাঁ-হাতের পিঠ দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিয়ে ছোট্ট করে বলল, ‘সরি। ভুল হয়ে গেছে।’
জিশানের দিকে তাকাল পাহাড় : ‘জলদি যাও। ছেলেটাকে বাঁচাও।’
জিশান আর মিনি তাড়াতাড়ি পা বাড়াল।
কিন্তু পাহাড় পিছন থেকে ডাকল : ‘শোনো—।’
জিশান থমকে দাঁড়াল। ঘুরে তাকাল।
পাহাড় লম্বা পা ফেলে ওর কাছে এগিয়ে এল। জিনসের পকেট থেকে খাবলা মেরে কী যেন তুলে নিয়ে জিশানের জামার পকেটে গুঁজে দিল।
জিশান তাকিয়ে দেখল। একগাদা টাকা।
ওর কান্না পেয়ে গেল। কিছু একটা বলতে গেল, কিন্তু পারল না। ঠোঁট কাঁপল শুধু।
মিনি জলভরা চোখে বিশাল মানুষটাকে দেখছিল।
পাহাড় জিশানকে ঠেলা মারল : ‘দেরি কোরো না। ছেলেটাকে বাঁচাও।’
জিশান আর মিনি সোলাস মেডিকেল কলেজ থেকে বাইরের ঝড়-বৃষ্টিতে বেরিয়ে এল।
সেই ঝড়-বৃষ্টির রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল শানু আর মিনি। তার সঙ্গে জিশানও। আজও শানু আর মিনিকে রক্ষা করতে জিশানকে অলৌকিক কিছু একটা করতে হবে—করতেই হবে।
জিশানের ভেতরে একটা মরিয়া রাগ তৈরি হল। শ্রীধর পাট্টা আর নিউ সিটির সিন্ডিকেটের প্রতি তীব্র ঘৃণা আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের মতো গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল ওর সারা শরীরে। বজ্রের শক্তি নিয়ে ওর ডানহাঁটু আছড়ে পড়ল জাব্বার মুখে। জিশান জাব্বার মাথাটা শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে ছিল। তাই সংঘর্ষটা হল মারাত্মক।
জাব্বার নাক থেবড়ে গেল। রক্ত ছড়িয়ে গেল ঠোঁটে, দাঁতে। ওর শক্তিশালী তীব্র মুঠি পলকে ঢিলে হয়ে গেল। ও একঝটকায় কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
জিশান সোজা হয়ে দাঁড়াতে চাইছিল, কিন্তু ওর মাথা টলছিল। সারা গায়ে নানারকম জ্বালা-যন্ত্রণা। নাকের পাশে যেখান দিয়ে রক্তের রেখা গড়িয়ে পড়েছে সেখানটা চুলকোচ্ছে। মাথার ওপরে চক্রাকারে উজ্জ্বল আলো, মাইকে দ্রুতলয়ের ধারাবিবরণী, দর্শকদের উন্মত্ত ক্ষুধার্ত চিৎকার—সব মিলিয়ে কেমন একটা ঘোর তৈরি হয়ে যাচ্ছিল।
সেই অবস্থাতেই দর্শকদের আসনগুলোয় অনুসন্ধানী চোখ বুলিয়ে নিল জিশান। অসম্ভব জেনেও লাল রঙের পোশাক পরা একটা মেয়েকে খুঁজল। কিন্তু পেল না।
জাব্বা কাদা-মাটিতে পড়ে গিয়েছিল বটে কিন্তু ও নি:শেষ হয়ে যায়নি। যাওয়ার কথাও নয়। ও একপাক গড়িয়ে শরীরটাকে চিত করে নিয়েছিল। তারপর সেই অবস্থাতেই ভয়ংকর এক গর্জন করে অদ্ভুত এক লাফ দিয়েছে। এবং জোড়াপায়ের প্রচণ্ড লাথি জিশানের তলপেটে বসিয়ে দিয়েছে।
জিশান ছিটকে উঠল শূন্যে। প্রায় উড়ে গিয়ে ছ’হাত দূরে আছড়ে পড়ল মাটিতে। তারপর পক্ষাঘাতের রুগির মতো অসাড় শরীরে চিত হয়ে পড়ে রইল। ওর শূন্য চোখ চেয়ে রইল ওপরের কালো আকাশের দিকে। উজ্জ্বল আলোর ঝলসানি পেরিয়ে তারাগুলো এমনিতে চোখে পড়ার কথা নয়, কিন্তু জিশানের চোখের সামনে প্রচুর তারা নাচানাচি করছিল। শরীরের কোনও যন্ত্রণাই ও আর টের পাচ্ছিল না।
জাব্বা তখন যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গিতে মুঠি উঁচিয়ে গর্তের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর উল্লাসে পশুর মতো হুঙ্কার ছাড়ছে। গ্যালারিতে উত্তেজনা টগবগ করছে। আকাশে বাতাসে শব্দের খই ফুটছে।
প্রচুর শব্দ জিশানের কানে ঢুকে পড়ছিল। দর্শকদের মধ্যে যারা জিশানকে সমর্থন করছিল তারা ওর নাম ধরে গলা ফাটাতে লাগল। উঠে দাঁড়িয়ে জাব্বাকে খতম করার জন্য হিংস্র গলায় ওকে উৎসাহ দিতে লাগল। কেউ-কেউ ওকে কাপুরুষ বলে দুয়ো দিতে লাগল। আর ওর বিরোধী পক্ষ জাব্বার নাম ধরে অদ্ভুত তালে চিৎকার করতে লাগল। তার সঙ্গে স্লোগান তুলল : ‘জিশান—খতম! জিশান—খতম!’
জায়ান্ট টিভির পরদায় বিভিন্ন দর্শকের ক্লোজ-আপ দেখানো হচ্ছিল। মাঝে-মাঝে ভেসে উঠছিল শ্রীধর পাট্টার মুখ। তার সঙ্গে উত্তেজিত গলায় মণীশ আর রাজশ্রীর ধারাবিবরণী।
টিভিতে দেখা গেল, গ্যালারিতে জাব্বা আর জিশানের সমর্থক দু-দল দর্শকের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেছে। সিকিওরিটি গার্ডের দল শকার হাতে সেই লড়াই নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। টিভির ধারাবিবরণী আর ছবি পিট ফাইটের জীবন্ত উত্তেজনা নিউ সিটির ঘরে-ঘরে নিখুঁতভাবে পৌঁছে দিচ্ছিল।