Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট || Anish Deb » Page 7

তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট || Anish Deb

জোর করে হাসল রূপকথা। মাথা ঝাঁকিয়ে কফির কাপে চুমুক দিল। জিশানের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না। ও এখানকার কমপিটিশানে নাম দিয়েছিল। হাংরি ডলফিন। গেমটার নাম শুনেছেন তো?’

জিশান মাথা নাড়ল : হ্যাঁ, শুনেছে। শুধু শুনেছে নয়, গেমটার ভিডিয়ো রেকর্ডিংও টিভিতে দেখেছে।

‘…তো সেই গেমটায় হাঙরের পেটে চলে গেল। হাঙরটাকে ডলফিন ভেবে ভুল করল। ব্যস, এন্ড অফ দ্য গেম…।’

কিছুক্ষণ ওরা দুজনেই চুপ করে রইল। শুধু কফির কাপে চুমুকের শব্দ শোনা যেতে লাগল। সাউন্ড সিস্টেমের মিউজিকটাকে দু:খের সুর বলে মনে হচ্ছিল।

ধীরে-ধীরে পুরো গল্পটা শুনল জিশান।

অর্কপ্রভ ওল্ড সিটি থেকে এসেছিল। রিমিয়া তখনও এই অ্যানালগ জিমেই চাকরি করত। সেখানেই অর্কর সঙ্গে আলাপ।

অর্ক পড়াশোনা জানা ব্রাইট ইয়াং ম্যান ছিল। অনেক বিষয়ে খোঁজখবর রাখত। ওল্ড সিটিতে সাঁতারে বহুবার ফার্স্ট হয়েছে। ওর ভেতরে একটা চ্যালেঞ্জার পারসোনালিটি ছিল। আর সবচেয়ে বড় কথা, ওরা ছিল ভীষণ গরিব। তাই হাংরি ডলফিন।

জিপিসি-তে অর্কপ্রভ ছিল একমাস মতন। তার মধ্যেই রিমিয়ার সঙ্গে পরিচয়, দুরন্ত আলাপ—এবং বিয়ে।

ওকে বিয়ে করতে চেয়ে শ্রীধর পাট্টার কাছে অ্যাপিল করেছিল রিমিয়া। সিন্ডিকেটের অনুমতি না পেলে কোনও এমপ্লয়ির সঙ্গে কোনও পার্টিসিপ্যান্টের বিয়ে মানে একটা ক্রাইম। সোজা কথায় পারমিশান ছাড়া এ ধরনের বিয়ে অসম্ভব।

শ্রীধর অনুমতি দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে এও বলেছিলেন, অর্কপ্রভর নাম হাংরি ডলফিন গেম থেকে কিছুতেই উইথড্র করা যাবে না।

অর্কটা বোধহয় কিছুটা পাগল ছিল। কোনও নেগেটিভ ব্যাপারকে ও পাত্তা দিত না। সবসময় বলত, ‘রিমিয়া, আমি জিতব। জিতবই।’

প্রথম কয়েকটা ছোটখাটো গেম-এ জিতে প্রাইজ মানি পেয়েছিল অর্ক। সেইসব টাকা ও রিমিয়াকে দিয়েছিল। রিমিয়া আর ও মিলে রিমিয়ার কোয়ার্টার সাজাতে শুরু করেছিল সংসার পাতবে বলে।

অর্ক বলত, ‘হাংরি ডলফিন গেমটায় জিতলে বিশ লাখ টাকা! ভাবা যায়? বিশমিনিটে বিশলাখ। আর বিশমিনিটের আগে খাঁচা থেকে বেরিয়ে এলে একলাখ টাকা পার মিনিট। আমরা সত্যিকারের বড়লোক হয়ে যাব, রিমিয়া! ক্যান য়ু বিলিভ ইট?’

অর্ক খুব অপটিমিস্ট ছিল।

কিন্তু হাংরি ডলফিন গেম ওকে শেষ করে দিল। ডলফিনের ছদ্মবেশ নেওয়া টাইগার শার্কের ঝাঁক ওকে খতম করে দিল। একইসঙ্গে ওর স্বপ্নও খতম।

কথা বলতে-বলতে পকেট থেকে আবার রুমাল বের করল রিমিয়া। চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, ‘অর্ক চলে যাওয়ার পর থেকে আমি আরও বেশি করে স্বপ্ন দেখি। জোর করে স্বপ্ন দেখি। তাই ভালো না লাগলেও এই চাকরিটা আমি ছাড়িনি। সবসময় ভাবি, অর্ক আমাকে এই স্বপ্ন দেখার বিরাট দায়িত্বটা দিয়ে গেছে। আমাকে স্বপ্ন দেখতেই হবে। সব্বাইকে উইশ করতে হবে। সব্বাইকে জেতাতে হবে—শুধু ইচ্ছে দিয়ে জেতাতে হবে। আমি পারব না?’

শেষ প্রশ্নটা জিশানকে লক্ষ্য করে।

জিশানের খারাপ লাগছিল। অর্কপ্রভকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল ও। জিশান যেন পিট ফাইট-এ লড়ছে আর দর্শকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে অর্ক আর রূপকথা ওকে পাগলের মতো চিয়ার করছে, চেঁচাচ্ছে তারস্বরে : ‘জি—শান! জি—শান!’

‘আমি পারব না, জিশান?’ রূপকথা আবার জিগ্যেস করল।

জিশান ঘাড় হেলাল। আলতো করে বলল, ‘পারবেন। আপনি পারবেন।’

নাক টানল রিমিয়া। ছোট্ট করে কেশে নিয়ে বলল, ‘এই চাকরির যে কী অসুবিধে তা তো আপনি খানিকটা দেখেছেন। চিফের ওই হতচ্ছাড়া রিকোয়েস্ট। আমার হাজব্যান্ডের মৃত্যুতে উনি নাকি সাংঘাতিক মুষড়ে পড়েছেন। তাই ওঁর ফিলিং এক্সপ্রেস করতে আমার কোয়ার্টারে আসতে চান। আপনি বলুন তো, জিশান, আমি সবসময় কী নিয়ে ভাবি, আর ওই লোকটা কী নিয়ে ভাবে! ও ভাবে আমি সবার গায়ে পড়া। পার্টিসিপ্যান্ট দেখলেই আমার চোখ দিয়ে লালা ঝরে। থু:।’ মাথা ঝাঁকাল রিমিয়া। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আসলে সবাইকে আমি অর্কপ্রভ ভাবি। তাই সবাইকে আমি জেতাতে চাই। এটা কি চিফ কখনও বুঝতে পারবে? ওর চিন্তা এত নোংরা, এত ছোট…।’

জিশান নতুন চোখে রূপকথাকে দেখছিল। পিট ফাইটে জিততে হলে এইরকম একজন সাপোর্টার ভীষণ দরকার। জিশানের চোখে রূপকথার বাইরের সুন্দর আর ভেতরের সুন্দর একাকার হয়ে যাচ্ছিল।

ও এবার মিনির কথা বলল রিমিয়াকে। বলল ছোট্ট শানুর কথা।

রিমিয়া মন দিয়ে শুনল। বলল, ‘কাল আমাকে ওদের ফটো দেখাবেন?’

‘দেখাব।’ জিশান জানে মাইক্রোভিডিয়োফোন থেকে কীভাবে ছবি স্টোর করা যায়। তারপর ইউ. এস. বি. কেবল দিয়ে ওর ঘরে রাখা টার্মিনাল থেকে সহজেই তার প্রিন্ট বের করা যায়।

কথা বলার ফাঁকে-ফাঁকে হাতঘড়ির দিকে বারবার তাকাচ্ছিল রিমিয়া। হঠাৎই ও বলল, ‘আমাদের হাতে আর দেড়মিনিট আছে…।’ এবং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

ওরা স্পাইরাল বেয়ে নেমে এল। ক্যাশ কাউন্টারে এসে স্মার্ট কার্ড সোয়াইপ করে বিল মেটাল রিমিয়া।

ফুড প্লাজার দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় ও জিগ্যেস করল, ‘কবে আপনার পিট ফাইট?’

‘আর সাতদিন পর—এই রোববারের পরের রোববার।’

‘আমি ওটা দেখতে যাব। চিফ ইনস্ট্রাকটরকে বলে স্পেশাল লিভের ব্যবস্থা করব। চিফের রিকোয়েস্ট রাখব এই আশায় চিফ আমার অনেক রিকোয়েস্ট রাখে। বোধহয় ছুটি পেয়ে যাব।’

ওর দিকে তাকিয়ে হাসল জিশান। বলল, ‘আপনি দেখতে গেলে আমার খুব জিততে ইচ্ছে করবে।’

পিট ফাইটের গর্তটার কাছে পৌঁছে জিশান দৃশ্যটাকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করল।

এই সাতদিনে পিট ফাইট নিয়ে আরও অনেক কিছু জেনেছে ও। এখন সেই তথ্যগুলোর সঙ্গে বাস্তবটাকে মনে-মনে যোগ করছিল।

নানানজনের মুখে ও শুনেছিল পিট ফাইটের বাঁধাধরা কোনও সময় নেই—দিনের যে-কোনও সময় হতে পারে। কিন্তু এখন যখন ওর নিজের লড়াইয়ের পালা এসেছে তখন ও এই প্রথম জানল পিট ফাইট রাতেও হতে পারে। যেমন, ওর লড়াই শুরু হবে ঠিক রাত একটায়।

এই রাতটাকে জিশান অন্য চোখে দেখছিল।

পিস ফোর্সের গার্ডের দল রাত ঠিক বারোটায় ওকে গেস্টহাউস থেকে নিতে এল। গার্ডরা ওর ঘরের কম্পিউটার টার্মিনাল অ্যাক্টিভেট করে দিতেই শ্রীধর পাট্টার ছবি ফুটে উঠল। সেইসঙ্গে জিশানের প্রতি নির্দেশও শোনা গেল : ‘বাবু জিশান, কুইক। চটপট রেডি হয়ে নাও। কাম, কাম—ওয়েলকাম টু স্টেডিয়াম। পিট ফাইট। সি য়ু…।’

জিশানের ভেতরটা জ্বালা করে উঠল। কিন্তু ও ব্যস্তভাবে তৈরি হতে লাগল।

জিপিসি-র গেস্টহাউস থেকে কিউ-মোবাইলে রওনা হওয়ার সময় জিশান আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। সেই একই আকাশ। একই চাঁদ-তারা, ধূমকেতুর একই লাল-নীল রঙিন আলো। তবু আজকের রাতই ঠিক করে দেবে কাল সকালে সূর্য ওঠা জিশান দেখবে কি না।

পিট ফাইটের স্টেডিয়ামটা জিশানকে অবাক করল। ছোট মাপের আধুনিক স্টেডিয়াম। মেটাল-হ্যালোজেন ল্যাম্পের আলো রাতকে দিন করে দিয়েছে। স্টেডিয়ামের ঠিক মাঝখানে তিরিশ ফুট ব্যাসের একটা গর্ত। গর্তটা মোটেই আধুনিক নয়। গোল করে কবর খুঁড়লে যেরকম কাদা-মাটির জমি পাওয়া যায়, ব্যাপারটা ঠিক তাই।

স্টেডিয়ামে এখনও দর্শক ঢোকানো শুরু হয়নি। পিস ফোর্সের চারজন গার্ড ফাঁকা স্টেডিয়ামে জিশানকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সবকিছু দেখাচ্ছিল। তার মধ্যে যে নেতা গোছের সে জিশানকে গাইডের ট্যুরের ধারাবিবরণী শোনাচ্ছিল।

গর্তটা প্রায় দশফুট গভীর। তার ভেতরে নামার কিংবা বেরিয়ে আসার কোনও ব্যবস্থা নেই। আর খালি হাতে গর্তের খাড়া দেওয়াল বেয়ে ওঠার চেষ্টা করাটা স্রেফ বোকামি। তা সত্বেও যদি কেউ ভাগ্যের জোরে গর্তের কিনারায় হাত ছোঁয়াতে পারে তা হলে তার কপালে জুটবে ইলেকট্রিক শক—একহাজার ভোল্টের। কারণ, একটা সরু তার গর্তের কিনারায় ছোট-ছোট পোর্সিলেন বুশিং-এর ওপরে বসানো রয়েছে। ঠিক যেন একটা তারের পাঁচিল।

জিশান কমেন্টেটর গার্ডকে জিগ্যেস করল, ‘কার সঙ্গে আমার লড়াই?’

গার্ড বলল, ‘জানি না। ওটা শেষ মুহূর্তে সিন্ডিকেটের মার্শাল ঠিক করবেন।’

শ্রীধর পাট্টা ঠিক করবেন জিশানের প্রতিদ্বন্দ্বী!

জিশান একটু অবাক হল। এই যে গার্ডরা ওকে স্টেডিয়াম এবং যুদ্ধের জায়গাটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাচ্ছে, সেরকম তো দেখানো উচিত ওর প্রতিদ্বন্দ্বীকেও! তা হলে তাকে কখন দেখানো হবে?

সে-কথাই ও গার্ডকে জিগ্যেস করল।

উত্তরে হাসল গার্ড : ‘তোমার মতো আরও দুজনকে এরকম ঘুরিয়ে দেখানো হবে। একজন-একজন করে। অনেক সময় কী হয়, পিট ফাইটে নামার ঠিক আগে অনেকে ভয় পেয়ে যায়। প্যান্টে হিসি করে ফ্যালে। একবার তো একজন ফাইটার গর্তে নামার আগে পটি করে ফেলেছিল—’ জোরে হেসে ফেলল গার্ড। ওর তিনজন সঙ্গীও ছোট করে হাসল।

গার্ড বলে চলল, ‘তোমার বেশ কয়েকটা সাইকোলজিক্যাল টেস্ট হয়েছে না?’

জিশান মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, হয়েছে। তবে টেস্টের কারণ জিশানকে বলা হয়নি।

‘সেই টেস্টগুলো থেকে বোঝা যায় কার নার্ভ কতটা স্ট্রং। তুমি ওইসব টেস্টে ঠিকঠাক পাশ করে গেছ। তোমাকে নিয়ে কোনও প্রবলেম নেই। যারা পাশ-ফেলের বর্ডারে থাকে তাদের নিয়েই যত প্রবলেম। তবে তাদের কেউ-কেউ টিকে যায়। পিট ফাইটে নামে। অনেক সময় লাকের জোরে জিতেও যায়। আবার কারও-কারও ব্রেকডাউন হয়ে যায়। কান্নাকাটি করে। প্যান্টে ওইসব করে ফ্যালে। সেইসব ক্যান্ডিডেটকে নামালে লড়াই জমে না। তখন…।’

তখন কী হবে জিশান জানে।

স্টেডিয়ামে দর্শক হবে না। টিকিট বিক্রি হবে না। লাইভ টেলিকাস্ট জমবে না। বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া রেভিনিউ অনেক কমে যাবে।

তা হলে কে-কে নামবে জিশানের এগেইনস্টে? সাইকোলজিক্যাল টেস্টগুলোয় আর কে ঠিকমতো পাশ-টাশ করেছে?

জিশান স্টেডিয়ামটা ভালো করে দেখছিল। বড়জোর দশহাজার দর্শকের জায়গা হতে পারে সেখানে। স্টেডিয়ামের চারদিকে একইরকম ডিজাইনের শৌখিন চেয়ার জ্যামিতিক ঢঙে সাজানো। তবে স্টেডিয়ামের এক-এক অংশে চেয়ারের রং এক-একরকম। সাদা, নীল, কমলা, সবুজ, আকাশি আর লাল।

এখন সব চেয়ার খালি। তবে একটু পরেই ভরতি হয়ে যাবে। পিট ফাইট স্বচক্ষে দেখার জন্য নিউ সিটির বাসিন্দাদের আগ্রহ কম নয়। কারণ, সুপার গেমস কর্পোরেশনের এই একটিমাত্র খেলাই গ্যালারিতে বসে দেখা যায়, ঠিকমতো এনজয় করা যায়। এই খেলাটা দেখার জন্য মানুষের আগ্রহ যে ফেটে পড়ে তার কারণ, সবাই জানে এর পরের ধাপই হল কিল গেম। যে-গেম-এর প্রাইজ মানি একশো কোটি টাকা। সেই গেম-এর খেলোয়াড়কে আগাম দেখা, এবং খালি হাতে লড়তে দেখা, কিছু কম উত্তেজনার ব্যাপার নয়।

পিট ফাইট যাতে দর্শকরা ভালোভাবে দেখতে পায় তার জন্য স্টেডিয়ামের দুপাশে গ্যালারির মাথায় দুটো জায়ান্ট টিভি স্ক্রিন। এ ছাড়া স্টেডিয়ামের বাইরে ভিড় করে থাকা দর্শকদের জন্য আরও দুটো জায়ান্ট স্ক্রিনের ব্যবস্থা করা আছে।

সবমিলিয়ে সবাইকে উত্তেজনার শরিক করে তোলার ব্যাপারে সিন্ডিকেটের বন্দোবস্তের কোনও ঘাটতি নেই।

আলো-ঝলমলে ফাঁকা স্টেডিয়ামটা জিশান ঘুরে-ঘুরে দেখছিল আর কল্পনায় উত্তেজিত দর্শকদের হিংস্র উল্লাসের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল। আধুনিক প্রযুক্তি আর আদিম প্রবৃত্তির কী অদ্ভুত মিলন! একটু পরেই ওই কাদা-মাটির গর্তের মধ্যে একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে জিশানকে মরণপণ লড়তে হবে—জানোয়ারের মতো। যেমন করে হোক বেঁচে থাকতে হবে। তা হলে পাওয়া যাবে প্রাইজ মানি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা, আর একশো কোটি টাকার গেম-এ ঢোকার ছাড়পত্র।

বাইরে থেকে জমায়েত দর্শকদের চিৎকার ভেসে আসছিল। স্টেডিয়ামের গেট এখনও খোলা হয়নি বলে ওরা অধৈর্য হয়ে পড়েছে।

জিশানের গাইডেড ট্যুর শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই গার্ডরা ওকে ফিরিয়ে নিয়ে চলল পিট ফাইট প্যাভিলিয়নে।

প্যাভিলিয়নে এক-একজন পার্টিসিপ্যান্টের এক-একটা আলাদা এয়ারকন্ডিশানড ঘর। ঘরগুলো পার্টিশান ওয়াল দিয়ে এমনভাবে আলাদা করা যে, একজন খেলোয়াড় আর-একজনকে মোটেই দেখতে পাবে না। তবে প্রতিটি ঘরের দরজা দিয়ে বেরোলেই লম্বা করিডর। সাদা গ্রানাইট বসানো সেই করিডর চলে গেছে সোজা স্টেডিয়ামের ভেতরে—গর্তের কাছে।

প্যাভিলিয়নের তিন নম্বর ঘর জিশানের। অন্যান্য ঘরে কারা আছে ও জানে না। ওর ঘরে ফার্নিচার বলতে একটা সোফা, একটা টেবিল, একটা চেয়ার, একটা আয়না, একটা প্লেট টিভি, আর একটা ফ্রিজ। এ ছাড়া ঘরের এককোণে আছে আয়না বসানো একটা মিনি জিম—অনেকটা সোলো জিমের মতো। সেখানে পরীক্ষার আগে শেষ মুহূর্তের পড়ার মতো লড়াইয়ের আগে শেষ মুহূর্তের ব্যায়ামের জন্য হালকা কয়েকটা যন্ত্রপাতি রয়েছে। জিশান পনেরোমিনিটের জন্য গায়ের জামাটা ছেড়ে চেইন-পুলি আর বাটারফ্লাই ক্রাঞ্চ করে নিল। তারপর তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছে চলে গেল উলটোদিকের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা ফ্রিজের কাছে।

ফ্রিজ খুলে দেখতে পেল দু-গ্লাস হেলথ ড্রিংক—ফাইবারের গ্লাসে রাখা। একটা গ্লাস নিয়ে খেয়ে নিল জিশান। ওর পিট ফাইট কোচ খেলার আগে এই ড্রিংক একগ্লাস খেতে বলেছে। এসি থাকায় এই ঘরের মধ্যে গরম কম। বাইরে ওই কাদা-মাটির গর্তের মধ্যে গরম নিশ্চয়ই অনেক বেশি।

খালি গ্লাসটা ফ্রিজের ভেতরে ফিরিয়ে দিল জিশান। ফ্রিজের পাশেই টেবিলে রাখা ছিল একটা গোলাপি রঙের সিপিং ওয়াটার বটল। সিপারে ঠোঁট লাগিয়ে জল খেল ও। তারপর দেওয়ালে টাঙানো পাঁচকোনা আয়নায় নিজেকে একবার দেখল। ওর মনে হল আয়নার ওই পেশিবহুল চেহারাটা যেন অন্য লোকের। আর সেই অচেনা মানুষটার কাঁধের ওপরে জিশানের চেনা মুন্ডুটা বসানো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় বসে পড়ল জিশান। একটু পরেই লড়াই শুরু হবে। বুকের ভেতরে একটা চাপ টের পেল। দম যেন আটকে যেতে চাইছে। এ খেলায় হারলে খেল খতম। আর জিতলেও তাই। মাঝে শুধু কিল গেম-এর ছলনার ব্যবধান।

হঠাৎই হইহই আওয়াজ শুনে চোখ তুলল। তাকাল উলটোদিকের দেওয়ালে টাঙানো প্লেট টিভির দিকে। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে রিমোট তুলে নিল। ভলিয়ুমটা একটু বাড়িয়ে দিল।

স্টেডিয়ামে দর্শকরা ঢুকতে শুরু করেছে। লাউডস্পিকারে অদ্ভুত একটা মিউজিক বাজছে। একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা কমেন্টেটর তারই মধ্যে বকবক করে চলেছে।

‘…একদিকে রয়েছে জিশান পালচৌধুরী। হাই স্কোরিং ফাইটার। আগের সবক’টা গেম-এ জিশান যে শুধু কোয়ালিফাই করেছে তা নয়—দারুণ স্কোরও করেছে। স্পেশালিস্টদের ধারণা ওর মধ্যে ব্যাপক পোটেনশিয়াল রয়েছে। কিন্তু ওর সঙ্গে কে লড়বে? কে সেই সারপ্রাইজ ফাইটার?’

জিশানের মনে পড়ে গেল মালিকের কথা, ছুন্নার কথা, কার্তিকের কথা, খালধারের সেই অন্ধকার রাতের ফাইটের কথা। টিভির কমেন্টেটরদের কথাবার্তাগুলো যেন খালধারের সেই টিংটিঙে রেফারির সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল।

‘…আপনাদের একটা দারুণ খবর দিই। আজ স্টেডিয়ামে হাজির রয়েছেন আমাদের ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্টের সম্মানিত মার্শাল শ্রীধর পাট্টা…।’

টিভি ক্যামেরা শ্রীধর পাট্টাকে দেখাল। জোরালো আলো পড়েছে ফরসা ছিপছিপে মানুষটার মুখে। ঠোঁট জোড়া এতই লাল যে, মনে হয় এইমাত্র পান অথবা রক্ত খেয়ে এসেছেন।

‘…সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ!’ কমেন্টেটর উত্তেজিতভাবে বলল, ‘আমাদের মার্শালের অনারে আজ আসল ফাইটের আগে একটা সারপ্রাইজ ফাইট হবে। ডগ ফাইট।

‘এই ফাইটটার পরেই হবে পিট ফাইট। দুটো ফাইট দেখার পর আপনারা কমপেয়ার করতে পারবেন লড়াইয়ের ব্যাপারে মানুষ এবং কুকুরের মধ্যে কী-কী মিল, আর কী-কী তফাত। ব্যাপারটা কি দারুণ ইন্টারেস্টিং নয়?…তোমার কী মনে হয়, রাজশ্রী?’

মহিলা কমেন্টেটর—যার নাম রাজশ্রী—ধারাবিবরণীর খেই ধরে বলল, ‘ইট ইজ অ্যান একসিলেন্ট আইডিয়া, মণীশ। এরকম কমপ্যারিজন-এর স্কোপ আমরা আগে কখনও পাইনি, তাই না? সো লেট আস ওয়াচ, গাইজ…।’

ক্যামেরা গর্তটাকে বারবার দেখাচ্ছিল। দেখাচ্ছিল স্টেডিয়ামের দর্শকদেরও। এরপর মণীশ আর রাজশ্রী গর্তটার মেক্যানিক্যাল ডেটা টিভির দর্শকদের বলতে শুরু করল। তারই ফাঁকে-ফাঁকে পুরোনো পিট ফাইট-এর ভিডিয়ো ক্লিপিং দেখানো হতে লাগল। গত সাতদিন ট্রেনিং-এর সময় জিশানদের এইসব ফাইটের ভিডিয়ো দেখানো হয়েছে। পিট ফাইট কোচরা ফাইটার তৈরির কাজে সত্যিই আন্তরিক যত্ন নিয়েছেন।

বড় করে শ্বাস ফেলল জিশান। এখন যদি ডগ ফাইট হয় তা হলে বধ্যভূমিতে যেতে জিশানের এখনও কিছুটা দেরি আছে। একইসঙ্গে ওর মনে হল, ওল্ড সিটির জোড়াতালি দেওয়া ঘরে বসে মিনিও নিশ্চয়ই এই লাইভ টেলিকাস্ট দেখছে।

জিশানের হঠাৎ ইচ্ছে হল, এই ডগ ফাইটটা ও লাইভ টেলিকাস্ট-এ নয়—লাইভ দেখবে। কারণ, তার পরের ডিজিটাল লড়াইটার জন্য ওর মনটা আরও হিংস্র আরও নৃশংস হওয়া দরকার। নিজেকে তৈরি করার জন্য ডগ ফাইটের প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি টুকরো ওকে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিতে হবে। কিল গেম-এ মারা যাওয়াটা যদি ভবিতব্যও হয়, তা হলেও পিট ফাইটটা জিশান জিততে চায়। কারণ, এই লড়াইটা ও নিজের জন্য নয়—অনেকের জন্য লড়ছে, অনেকের হয়ে লড়ছে।

ডগ ফাইটটা স্বচক্ষে দেখার তেষ্টায় জিশানের বুক হঠাৎ শুকিয়ে গেল যেন। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। টেবিলে রাখা ওয়াটার বটল থেকে আবার অনেকটা জল খেল। তারপর দেওয়ালে গাঁথা কলিংবেলের পুশ বাটন-এ চাপ দিল।

কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই কোমরে শকার ঝোলানো একজন গার্ড ঘরে এসে ঢুকল। এই গার্ডকে জিশান আগে দেখেনি।

গার্ড বলল, ‘কী দরকার বলো?’

হঠাৎই হাসি পেয়ে গেল জিশানের। শকার ঝোলানো গার্ডটাকে কেমন জোকারের মতো লাগছে না? ইচ্ছে করলে জিশান লোকটাকে এখুনি স্রেফ একহাতে মেরে ফেলতে পারে। ওর হাত-পাগুলো পাটকাঠির মতো পটপট করে মটকে ভেঙে দেওয়াটাও তেমন কঠিন নয়—তবে তখন আর একহাতে হবে না, দু-হাত লাগবে। তারপর কোথায় শকার, আর কোথায় গার্ড! মেঝেতে সব টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকবে। অথচ গার্ড বেচারা এসব বুঝতেও পারছে না। ভাবছে, শকার কোমরে ঝুলিয়ে ও কত শক্তিশালী!

ওর ভেতরে যে শক্তি টগবগ করে ফুটছে তার বুড়বুড়ির শব্দ পেল জিশান। শক্তিকণাগুলো পাগলের মতো মাথা খুঁড়ছে। বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিজেদের ব্যবহার করতে চাইছে।

জিশানের পাগল-পাগল লাগছিল। ও গার্ডকে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি স্টেডিয়ামে বসে ডগ ফাইট দেখব—টিভিতে দেখব না।’

গার্ডটা জিশানের মুখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে। ‘দেখছি কী করা যায়—’ বলে চট করে চলে গেল।

পাঁচ থেকে দশসেকেন্ডের মধ্যেই গার্ড ফিরে এল। সঙ্গে একটি লম্বা রোগামতন মেয়ে। গায়ে সিন্ডিকেটের ইউনিফর্ম। হাতে একটা মোবাইল। কারও সঙ্গে কথা বলছে।

‘…হ্যাঁ, স্যার। নিয়ে যাচ্ছি। স্পেশাল এনক্লেভে সিট আছে। সেখানেই বসাচ্ছি, স্যার। ও. কে., স্যার…।’

ফোন কেটে দিয়ে জিশানকে লক্ষ করে বলল, ‘চলুন। পারমিশান গ্রান্টেড। লেটস গো—।’

জিশান শার্টটা আবার গায়ে চড়িয়ে নিল। মেয়েটির সঙ্গে ঘরের দরজার দিকে পা বাড়াল।

টিভির পরদায় তখন রাজশ্রী বলছে, ‘শুরু হচ্ছে ডগ ফাইট। দুটো গ্রেট ডেন কুকুরকে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। সঙ্গে তাদের ট্রেনার অভিজিৎ আর কমলেশ্বর। গ্রেট ডেন আসলে ম্যাস্টিফ আর আইরিশ উলফহাউন্ডের ক্রস। এই দুটো ব্লাডলাইন মিশিয়ে ব্রিড করার জন্যে গ্রেট ডেনের সাইজও যেমন বড়, শক্তিও অসাধারণ। সো উই এক্সপেক্ট আ গ্রেট ফাইট। আ গ্রেট সাইট। হোয়াট ডু য়ু সে, মণীশ?’

মণীশ কী বলল সেটা জিশানের আর শোনা হল না। ও আর মেয়েটি তখন নির্জন করিডরে প্রতিধ্বনি তুলে হেঁটে চলেছে।

স্পেশাল এনক্লেভে আকাশি রঙের সিটে জিশানকে বসানো হল। চারপাশের দর্শকদের উত্তেজনার শোরগোলটা যেন মাইকে শোনা মউমাছির গুঞ্জন। একবার চোখ বুলিয়েই জিশান বুঝল দর্শকে স্টেডিয়াম টইটম্বুর। অসম্ভব জেনেও ওর চোখ রিমিয়াকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। চেনার সুবিধের জন্য ও রিমিয়াকে বলেছিল লাল ড্রেস পরে আসতে।

রিমিয়াকে খুঁজে পেল না জিশান। চোখ ফিরিয়ে গর্তের দিকে তাকাল। ওর সিট থেকে গর্তটা ভালোই দেখা যাচ্ছে। আর যেটুকু জ্যামিতির জন্য আড়াল হচ্ছে সেটুকু ষোলোআনার বেশি পুষিয়ে দিচ্ছে জায়ান্ট টিভি স্ক্রিন।

গর্তের কিনারায় দুই বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে অভিজিৎ আর কমলেশ্বর।

অভিজিতের গায়ে টকটকে লাল রঙের ফুলহাতা শার্ট, আর পায়ে কালো প্যান্ট। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে ওর গ্রেট ডেন। লম্বা-চওড়া কুকুর। হালকা বাদামি রং। কান দুটো ভাঁজ হয়ে ঝুলছে। মুখের ডগাটা কালচে। চোয়ালের নীচে চামড়া সামান্য ঝুলে আছে।

কুকুরটার পেটের কাছে দু-দিকেই লাল রঙের একটা করে গোল ছাপ। মাপে টেনিস বলের মতো।

গর্তের ওপারে, অভিজিতের ঠিক বিপরীতে, দাঁড়িয়ে আছে কমলেশ্বর। গায়ে ক্যাটক্যাটে হলদে রঙের শার্ট আর পায়ে কালো প্যান্ট। ওর পাশে দাঁড়ানো গ্রেট ডেনটার পেটে গোল হলদে ছাপ।

লাউডস্পিকারে মণীশ আর রাজশ্রীর ধারাবিবরণী চলছিল। ওরা বলছিল, দুটো কুকুর যেহেতু একইরকম দেখতে সেহেতু কোনটা অভিজিতের আর কোনটা কমলেশ্বরের কুকুর সেটা স্পষ্টভাবে বোঝার জন্যই ওই লাল আর হলদে ছাপ।

দুটো কুকুরের গলাতেই চামড়ার কলার, সঙ্গে স্টিলের চেইন। দুজন ট্রেনারই চেইনটা হাতে পাকিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে। কুকুর দুটো চেইন টেনে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল। চাপা গর্জন করছিল।

মাইকে কুকুর দুটোর নাম-ধাম পেডিগ্রি শোনা যাচ্ছিল। হলদে ছাপওয়ালা কুকুরটার নাম ইয়েলো, আর অন্যটার নাম রেড। রং অনুযায়ী নাম, অথবা নাম অনুযায়ী রং। ওদের বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। যখনই নিউ সিটিতে কোনও ডগ ফাইটের ব্যবস্থা করা হয় তখন কুকুর আনা হয় বিদেশ থেকে। ফাইটের আগে এখানে ওদের অ্যাক্লাইমেটাইজ করা হয় এবং ট্রেনিং দেওয়া হয়। অভিজিৎ ও কমলেশ্বর খুবই নামি ট্রেনার। ওরা এ-বিষয়ে বিদেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে।

ধারাবিবরণী চলছিল আর টিভি ক্যামেরা বারবার ট্রেনার দুজন এবং কুকুর দুটোর ক্লোজ আপ দেখাচ্ছিল।

হঠাৎই স্টেডিয়ামের দুপাশের একটা ফোকর দিয়ে দুটো ক্রেনের ধাতব বাহু ধীরে-ধীরে বেরিয়ে এল। এসে থামল অভিজিৎ আর কমলেশ্বরের কাছে।

ক্রেনের বাহুর প্রান্তে একটা ছোট কেবিন। দুজন করে গার্ড ছুটে চলে এল কেবিনের কাছে। ট্রেনারকে কুকুরসমেত কেবিনে উঠতে সাহায্য করল। তারপর ক্রেন নিখুঁতভাবে ট্রেনার ও কুকুরকে নামিয়ে দিল গর্তের ভেতরে।

মাইকে তখন রাজশ্রীর গলা : ‘…শুনলে আপনাদের ভালো লাগবে—লড়াইটা যাতে থ্রিলিং হয়, এনটারটেইনিং হয় সেজন্যে ইয়েলো আর রেডকে আজ সারাদিন খেতে দেওয়া হয়নি। সো উই এক্সপেক্ট আ ভেরি থ্রিলিং ফাইট, আ ভেরি এনটারটেইনিং ফাইট, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন…।’

ট্রেনার দুজন কুকুর নিয়ে একইসঙ্গে কেবিন থেকে নেমে গেল গর্তের মাটিতে। কুকুর দুটোকে গর্তের দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড় করাল। গলা থেকে কলার খুলে নিল। খালি হাতে কুকুরটার ঘাড় ধরে রইল। তারপর মাইকে যেই শোনা গেল ‘ওয়ান, টু, থ্রি—স্টার্ট।’ ওমনি কুকুরটার গালে একটা থাপ্পড় মেরে ট্রেনার তার মুখটা সামনে ঘুরিয়ে দিল।

ইয়েলো আর রেড এখন মুখোমুখি। পরমুহূর্তেই দুই ট্রেনার লাফিয়ে উঠে পড়ল যার-যার কেবিনে। এবং ক্রেন কেবিনটাকে টেনে তুলে নিল শূন্যে।

শুরু হয়ে গেল ডগ ফাইট।

দুটো ক্রেন তখন দুজন ট্রেনারকে নিয়ে আগের জায়গায় ফিরে চলেছে।

ইয়েলো আর রেড মুখোমুখি ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু ওদের ধারালো দাঁতের কামড়গুলো মাংস পেল না—পেল বাতাস। তাই চোয়ালের শব্দ হল।

জিশান অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করল। কুকুর দুটো কোনও শব্দ করছে না। গরগর শব্দও নয়। নি:শব্দে লড়ছে। শব্দহীন যন্ত্রের মতো।

দ্বিতীয়বার যখন ইয়েলো আর রেড পরস্পরের দিকে ঝাঁপাল তখন ওদের মাথায়-মাথায় ঠোকাঠুকি লাগল। ইয়েলো চিত হয়ে ছিটকে পড়ল। রেড হাঁ করে ধেয়ে গেল। কামড় বসাতে চাইল ইয়েলোর গলায়। কিন্তু ইয়েলো ঝটিতি মাথা তুলে রেডের নাকে কামড় বসাল। এবারে মাংসে দাঁত বসেছে।

দর্শক হইহই করে উঠল। মণীশের ধারাবিবরণী থেকে জিশান বুঝল, রেড আর ইয়েলোর মধ্যে কে জিতবে তা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে বাজি ধরা শুরু হয়ে গেছে। অন্ধকার খালপাড়ের সেই লড়াই।

রেড তখন ইয়েলোকে ছেঁচড়ে টেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে গর্তের মধ্যে। ওর নাক থেকে কামড় ছাড়াতে চেষ্টা করছে। বারেবারেই মাথা ঝাঁকুনি দিচ্ছে। টিভির ক্লোজ আপে দেখা যাচ্ছে রেডের রক্তাক্ত নাক।

শেষ পর্যন্ত মারাত্মক এক ঝটকায় মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের নাক ছাড়াতে পারল রেড। তবে নাকের খানিকটা অংশ ওকে খোয়াতে হল।

ইয়েলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই রেডের ওপরে ঝাঁপাল। ওর হাঁ করা চোয়ালের কাছ থেকে চকিতে মাথা সরিয়ে নিল রেড। ইয়েলোর দাঁতে-দাঁতে ঠোকাঠুকি হল। লালা ছিটকে বেরোল শূন্যে।

টিভি স্ক্রিনের দৌলতে লড়াইয়ের বীভৎস খুঁটিনাটিও নিখুঁতভাবে দেখা যাচ্ছিল। দর্শকরা উত্তেজনায় পাগলের মতো চিৎকার করছিল। অভিজিৎ আর কমলেশ্বর গর্তের কিনারায় ছোটাছুটি করে ঘুরপাক খেয়ে যার-যার কুকুরকে চেঁচিয়ে নানান ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছিল।

রেড ইয়েলোর ডান কানটা কামড়ে ধরল। কামড়ে যে যথেষ্ট জোর ছিল সেটা বোঝা গেল প্রবল ঝাঁকুনির বহর দেখে। চুলের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো রেড ইয়েলোকে যক্ষ্মা-ঝাঁকুনি দিয়ে চলল। ইয়েলোর অতবড় শরীরটা ক্রেনের হুকে ঝোলানো ভেজা তুলোর বস্তার মতো অসাড় হয়ে রইল, লাট খেতে লাগল।

কয়েকটা প্রবল ঝাঁকুনির পর ইয়েলোর কান চলে এল রেডের মুখে। সেখান থেকে টুকরোটা ছিটকে পড়ল ভেজা মাটিতে।

জিশানের গা গুলিয়ে উঠল। মনে হল, এই বুঝি বমি পাবে ওর। ও লড়াই থেকে চোখ সরিয়ে নিল। পরপর কয়েকটা ঢোক গিলে বমির দমকটা সামলে নিল।

টিভির পরদায় ইয়েলোর কানের টুকরোটার ক্লোজ আপ দেখাচ্ছিল। কমেন্টেটরের গলা তখন উত্তেজনায় উঁচু পরদায় পৌঁছে গেছে। মণীশ বলছে, ‘…ওই দেখুন, ইয়েলোর কান। রেড ওর প্রতিদ্বন্দ্বীর কান ছিঁড়ে নিয়েছে। তা হলে বুঝে দেখুন, রেডের দাঁত কত ধারালো, ওর চোয়াল কত শক্তিশালী! গ্রেট ডেন কুকুর বলে কথা! এদের মধ্যে আইরিশ উলফহাউন্ডের জিন রয়েছে….।’

জিশানের মনে হচ্ছিল, ও নিজের লড়াইয়ের ধারাবিবরণী শুনছে। গর্তের মধ্যে যে-জিশান লড়ছে সে অন্য জিশান।

পাবলিকের চিৎকারে জিশানের কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। কুকুর দুটোর রক্তারক্তি লড়াই দেখে তারা সব উত্তেজনার তুঙ্গে। কখনও ‘রেড! রেড!’ চিৎকার শোনা যাচ্ছে, কখনও বা ‘ইয়েলো! ইয়েলো!’

পুরো ব্যাপারটা জিশানকে পুরোনো আদিম ইতিহাসে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। যখন মানুষ আগুন জ্বালতে শেখেনি, চাকা আবিষ্কার করেনি। যখন মানুষ সোজা হয়ে ঠিকঠাক দাঁড়াতেও পারত না।

গর্তের মধ্যে কুকুর দুটো তুলকালাম লড়াই করছিল। এখন ওরা আর চুপচাপ নয়। ওদের গর্জন চিৎকার ইত্যাদি শোনা যাচ্ছে। ওরা শূন্যে লাফিয়ে উঠছে, গায়ে-গায়ে ঠোকাঠুকি খাচ্ছে, গর্তের দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। ওদের শরীরের নানান জায়গায় কাদার ছোপ আর রক্তের দাগ।

অভিজিৎ আর কমলেশ্বর একনাগাড়ে উত্তেজিতভাবে ছোটাছুটি করছে। চিৎকার করে নিজের-নিজের কুকুরকে নির্দেশ দিচ্ছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ওরা গর্তের মধ্যে নেমে পড়বে।

হঠাৎই ইয়েলো প্রবল চিৎকার করে উঠল। জিশান চোখ ফেরাল গর্তের দিকে।

একমুহূর্তের সুযোগে রেড ইয়েলোকে চিত করে ফেলেছে। এবং অলৌকিক ক্ষিপ্রতায় ইয়েলোর পেটে এক ভয়ংকর কামড় বসিয়ে দিয়েছে।

ইয়েলো মাথা তুলে রেডের গলায় কামড় বসাতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওর চোয়ালে বোধহয় আর ততটা ক্ষমতা ছিল না। কামড়গুলো রেডের লোমের ওপরে পিছলে যাচ্ছিল।

ততক্ষণে রেড ওর কাজ সেরে ফেলেছে। ইয়েলোর পেটে আরও একটা গভীর কামড় বসিয়েছে এবং চোয়ালের এক হ্যাঁচকায় ইয়েলোর নাড়িভুঁড়ির অনেকটাই বাইরে বের করে ফেলতে পেরেছে।

ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। আর ইয়েলো যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল।

‘দে, দে—খতম করে দে!’ দর্শকের চিৎকার শোনা গেল।

‘আরে মাথামোটা, গলা কামড়ে ধর!’

‘শাবাশ, রেড! তুই কুত্তার বাচ্চা না—বাঘের বাচ্চা!’

এ ছাড়া সমবেত কণ্ঠে ‘রেড! রেড!’ বলে চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। গোটা স্টেডিয়াম যেন টগবগ করে ফুটছে।

জিশান দেখল, প্রতিটি দর্শক সামনে ঝুঁকে বসেছে। ওদের লালচে মুখে ঘামের বিন্দু। চোখ উত্তেজনায় যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। হিংস্র লালসা ছাপ ফেলেছে চোখে-মুখে। ওরা যেন কয়েকমুহূর্তের জন্য গর্তে নেমে পড়েছে। গ্রেট ডেন কুকুর হয়ে গেছে নিজেরাই। টান-টান উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ উপভোগ করছে—অথচ কোনও যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে না।

ইয়েলোর পাগুলো শূন্যে সাইকেল চালানোর চেষ্টা করছিল। ওর ছটফটানি নিভে আসছিল।

দর্শকদের সমবেত চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।

‘খতম কর! খতম কর! শেষ করে দে!’

‘কিল হিম! কিল হিম!’

ইয়েলোর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু রেড তখনও ওর ছেঁড়া পেটের ফাঁকে মুখ ঢুকিয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে।

হঠাৎই তীব্র এক হুইসল শোনা গেল। রাতের বাতাস ছুরি দিয়ে চিরে দিল যেন কেউ। তারপরই মাইকে ঘোষণা শোনা গেল, লড়াই শেষ। রেড জিতেছে।

তখনই ক্রেনের বাহু দুটো স্টেডিয়ামের দু-দিকের সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এল। দুটো কেবিনে উঠে পড়ল দুই ট্রেনার—কমলেশ্বর আর অভিজিৎ। কেবিন দুটো গর্তের ভেতরে নামতে শুরু করল।

ততক্ষণে টিভির পরদায় ডগ ফাইটের চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে। দুজন বিশেষজ্ঞ সুচিন্তিত মতামত দিচ্ছেন। একইসঙ্গে পরের লড়াইটা কার ফেবারে যেতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করছেন।

দর্শকদের চিৎকার এখন কমে গেছে। তার বদলে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা আর গুঞ্জন। মাথার ওপরে খোলা আকাশ থাকলেও কেমন যেন একটা গুমোট ভাব জাঁকিয়ে বসেছে। কে জানে বৃষ্টি হবে কি না।

জিশান জায়ান্ট টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছিল। না, কোনও ফাইটারের নাম ওঁরা বলছেন না। যা বলার জেনারেল টার্মস-এ বলছেন। যেমন, পিট ফাইট জেতার জন্য মেজর ফ্যাক্টরগুলো হল : বডি ওয়েট, স্পিড, হাইট, রিচ, স্কিল, মাসল পাওয়ার আর সাইকোলজিক্যাল স্টেবিলিটি। আর এগুলোর মধ্যে শেষেরটাই সবচেয়ে জরুরি।

টিভি ক্যামেরা এবার গর্তের ক্লোজ আপ দেখাল।

রেড এখনও ইয়েলোকে নিয়ে ব্যস্ত। অভিজিৎ ওর কাছে গিয়ে ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে একটু আদর করল। তারপর টেনে সরিয়ে নিয়ে এল। কমলেশ্বরকে বলল, ‘আপনার কুকুরটা এখনও বেঁচে আছে।’

কমলেশ্বর অভিজিতের কথার কোনও জবাব দিল না।

রেড অভিজিতের পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। সারা গায়ে দাঁত-নখের চিহ্ন, রক্তের দাগ। ওর দিকে একবার তাকাল কমলেশ্বর। তারপর নিজের হেরে যাওয়া গ্রেট ডেনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কার সঙ্গে যেন দশ-পনেরো সেকেন্ড কথা বলল।

কথা শেষ হতেই ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা রিভলভার বের করে নিল কমলেশ্বর। ডাবল অ্যাকশন 0.44 ম্যাগনাম। স্টেইনলেস স্টিলের লম্বা নল। স্যান্টোপ্রিন-ওয়ান-এর তৈরি কালো গ্রিপ।

ইয়েলোর মাথা তাক করে পরপর তিনবার গুলি করল। ইয়েলোর শূন্যে উঠে থাকা পাগুলো একটুও কাঁপল না—শুধু একপাশে কাত হয়ে গেল। আর একইসঙ্গে কুকুরটা পটি করে দিল।

রেড কী বুঝল কে জানে! চট করে চলে এল ইয়েলোর ডেডবডির কাছে। মাথার কাছে মুখ নিয়ে বারকয়েক কী শুঁকল। তারপর পিছনের এক পা তুলে ইয়েলোর মুখে পেচ্ছাপ করে দিল। পেচ্ছাপের রং টকটকে লাল।

অভিজিৎ ওর কুকুরকে ডেকে নিয়ে ক্রেনের কেবিনে ঢুকল। ক্রেন ওদের তুলে নিল গর্ত থেকে—নিরাপদ জায়গায় নামিয়ে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে কয়েকজন মেডিক রেডকে নিয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে চলে গেল। চিকিৎসা করে ওরা রেডকে সুস্থ করে তুলবে। অভিজিৎও তাদের সঙ্গে হাঁটা দিল।

কমলেশ্বরও কেবিনে চড়ে ওপরে উঠে এসেছিল। ও মোবাইল ফোন বের করে কাকে যেন ফোন করল। কথা বলতে-বলতেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরল।

সঙ্গে-সঙ্গে সুইপারদের ইউনিট এসে হাজির হল। ওরা দরকারি যন্ত্রপাতি নিয়ে ক্রেনে চড়ে গর্তে নেমে গেল। পাঁচমিনিটের মধ্যেই জায়গাটা সাফ করে দিল। মরা কুকুর আর নোংরা হয়ে যাওয়া মাটির সিলড প্যাকেট নিয়ে ওরা ওপরে উঠে এল। পিট এখন আবার লড়াইয়ের জন্য তৈরি। এবার লড়বে মানুষ।

বাইরে শান্ত থাকার চেষ্টা করলেও ভেতরে-ভেতরে জিশান উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। টের পাচ্ছিল ও ঘামছে। টেনশানটা কমানোর জন্য ও দর্শকের ভিড়ে আবার রূপকথাকে খুঁজল। ও বলেছিল, লাল ড্রেস পরে আসবে। এ-কথা ভাবতেই ওর রেডের কথা মনে পড়ল। আর তখনই মাইকে ঘোষণা করা হল : ‘এইবার শুরু হবে আজকের পিট ফাইট। লড়বে এমন একজন ফাইটার যে এর আগে অনেকগুলো গেম জিতেছে। কিল গেম-এর একজন মেজর পার্টিসিপ্যান্ট। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, প্লিজ ওয়েলকাম আওয়ার ফেভারিট পার্টিসিপ্যান্ট জিশান পালচৌধুরী—।’

টিভি ক্যামেরা জিশানের মুখে জুম করল। জায়ান্ট স্ক্রিনের পরদা জুড়ে এখন জিশানের মুখ।

জিশানকে দেখেই দর্শকরা হইহই করে উঠল। কারণ, জিশান নিউ সিটির রিয়্যালিটি শো-র খুব চেনা মুখ। অনেকগুলো গেম-এ জিতেছে। কিল গেম-এ পার্টিসিপেট করার দৌড়ে রয়েছে।

দর্শক আবার পাগলের মতো চিৎকার শুরু করে দিয়েছিল। আওয়াজ উঠছিল : ‘জি—শান! জি—শান!’

প্রথম থেকেই জিশান খেয়াল করেছিল আশপাশের দর্শকদের অনেকেই কৌতূহলী চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে। ওর দিকে গোপন ইশারা করে দেখাচ্ছে।

এতক্ষণ যেটা ছিল দর্শকদের দোলাচলে ঘেরা অনুমান, এখন সেটা সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে বদলে দিয়েছে জায়ান্ট টিভি স্ক্রিন।

জোরালো স্পট লাইট এসে পড়ল জিশানের ওপর।

নীল ইউনিফর্ম পরা একটি ভারি চেহারার মেয়ে কোথা থেকে যেন চলে এল জিশানের কাছে। বুকে কোড নম্বর লেখা স্টিকার।

মেয়েটি বলল, ‘জিশান, উড য়ু প্লিজ স্ট্যান্ড আপ ফর আ মিনিট?’

জিশান উঠে দাঁড়াল।

সঙ্গে-সঙ্গে দর্শকদের তুমুল চিৎকার কয়েক ধাপ বেড়ে গেল।

জায়ান্ট স্ক্রিন তখন জিশানের ছবির পাশে স্ক্রোল করে দেখিয়ে চলেছে জিশানের ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস : ওজন, উচ্চতা, বাহুর দৈর্ঘ্য, পায়ের দৈর্ঘ্য, বুকের মাপ, কোমরের মাপ ইত্যাদি। এবং তার সঙ্গে মণীশের ধারাবিবরণী।

তারপরই স্ক্রিনে দেখানো শুরু হল ওর নানান কমপিটিশানের ভিডিয়ো রেকর্ডিং-এর অংশ : শিবপদর সঙ্গে লড়াই, কোমোডোর সঙ্গে মোকাবিলা, স্নেক লেকের দৌড়। রেকর্ডিং-এর বিশেষ-বিশেষ অংশ আবার স্লো মোশানে দেখানো হচ্ছিল। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক্সপার্ট কমেন্টস।

জিশান অবাক হয়ে দেখছিল, টিভির ছবিগুলো ‘পশু’ জিশানকে কী নিখুঁতভাবেই না দর্শকদের সামনে পেশ করছিল।

জিশান বসে পড়ল।

তারপরই ওকে অবাক করে দিয়ে টিভিতে দেখানো হল ওর এলিভেটরের লড়াই—রণজিৎ পাত্রের সঙ্গে। এবং সেই ছবির পরই রোলারবল এপিসোড।

রোলারবল এপিসোড দেখানোর সময় রাজশ্রী বারবার জিশানের অলৌকিক সহ্যশক্তির প্রশংসা করছিল। বলছিল, বহুদিন পর নিউ সিটি এমন একজন পার্টিসিপ্যান্ট পেয়েছে যে শুধু মারতে জানে না, মার খেতেও জানে।

জিশানের অডিয়ো-ভিশুয়াল পরিচয়ের পালা আরও কিছুক্ষণ ধরে চলল। তারপর রাজশ্রী বলল, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, এইবার আপনাদের জানাব সেকেন্ড ফাইটারের নাম। এই নামটা এইমাত্র আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। নামটা সিলেক্ট করেছেন আমাদের ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্টের মার্শাল মাননীয় শ্রীধর পাট্টা…।’

সঙ্গে-সঙ্গে টিভির পরদায় চলে এল শ্রীধর পাট্টার ছবি।

‘…জিশানের সঙ্গে আজ পিট ফাইট যে লড়বে সেও কম নয়। এর আগে অনেকগুলো কমপিটিশানে সে জিতেছে। নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছে। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, লেট আস ওয়েলকাম দ্য গ্রেট ফাইটার মনোহর সিং…।’

জিশানের হাত থেকে একরাশ কাচের বাসন পড়ে গেল যেন। ওর সারা শরীর ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। একটা কান্নার দমক উথলে উঠল বুকের ভেতরে।

ও: ভগবান!

শেষ পর্যন্ত মনোহর সিং!

চোখের পলকে জায়ান্ট স্ক্রিনে মনোহর সিং-এর ছবি ফুটে উঠল। ক্যামেরা ওর হাত-পা-কাঁধের পেশির ক্লোজ-আপ দেখাতে শুরু করল। তারপর পৌঁছে গেল ওর মুখে।

কিন্তু এ কোন মনোহর সিং!

চাপ-চাপ লোহা দিয়ে তৈরি ওর শরীরের পেশি। মাথায় কদমছাঁট চুল। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। জীবনে অনেক দু:খ-কষ্ট থাকলেও মনোহরের সরল মুখে সবসময় হাসির ছোঁওয়া। ও অনেক কিছু পারে। এত অভাবের মধ্যে থেকেও ও প্রাইজ মানির পঞ্চাশহাজার টাকা জিশানের ছেলেকে উপহার দিতে পারে। নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য কোমোডো ড্রাগনের শরীরে কামড় বসাতে পারে।

সেই হাসিখুশি উদার অশিক্ষিত মানুষটা এখন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে জল। চোয়াল শক্ত করে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ছে। বলছে ‘নহি! নহি!’ কিন্তু অডিয়ো সিস্টেম লাগানো নেই বলে শুধু ওর ঠোঁট নাড়াটা দেখা যাচ্ছে।

মনোহরের ছবির সঙ্গে মণীশ আর রাজশ্রীর ধারাভাষ্য চলছিল। গেম সিটিতে আসার পর থেকে মনোহর সিং লড়াইয়ে কী-কী ক্যারিশমা দেখিয়েছে, কোন-কোন কমপিটিশানে কীভাবে জিতেছে, সেসব কথা ওরা অনর্গল বলে চলেছে।

‘…মনোহর সিং কোমোডো ড্রাগনের কামড় খেয়েছে, বিষধর সাপের ছোবল খেয়েছে—কিন্তু তাও ও হারেনি। হি ইজ আ বর্ন উইনার। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আপনারা…।’

জিশানের কানে টিভির ধারাবিবরণীর একটা শব্দও ঢুকছিল না। ও শুধু মনোহরের গাল বেয়ে নেমে আসা চিকচিকে জলের রেখা দেখছিল আর শ্রীধর পাট্টার সর্বনাশা বুদ্ধির শক্তি আঁচ করছিল। কিল গেম-এ যাওয়ার আগে শুধু গায়ের জোরের লড়াই নয়, মনের জোরের লড়াইও জিততে হয়!

জিশানের হাত-পাগুলো যেন রবারের হয়ে যাচ্ছিল। ও উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। ওর শরীরের শিরা-উপশিরায় তড়িৎপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। একটা চিনচিনে জ্বালা ছড়িয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি স্নায়ুতে।

জিশানের ভয় হচ্ছিল, ওর রবার হয়ে যাওয়া শরীর না গলে যায়! গলে কনডেনসড মিল্কের মতো গড়িয়ে যায় স্টেডিয়ামের মেঝেতে!

জিশান চিৎকার করে বলতে চাইল, ‘মনোহরের সঙ্গে আমি লড়ব না—কিছুতেই না।’ কিন্তু ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপল শুধু—কোনও শব্দ বেরোল না।

কিন্তু মনোহর সিং প্রতিবাদে ফেটে পড়ল।

ওর কোনও কথা শোনা যাচ্ছিল না, কিন্তু মূকাভিনয়ের মতো ব্যাপারটা জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল।

মনোহর পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছিল। টিভি ক্যামেরা খানিকটা পিছিয়ে যেতেই দেখা গেল চারজন গাঁট্টাগোট্টা সিকিওরিটি গার্ড মনোহরের দুটো হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মনোহর প্রবল শক্তিতে ট্যানাহ্যাঁচড়া করছে, ওদের বাঁধন ছাড়াতে চেষ্টা করছে। ওর গলার শিরা ফুলে উঠেছে।

স্টেডিয়ামের দর্শক মনোহরের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝতে পারছিল। ওরা হইহই চিৎকারে মনোহরকে ‘দুয়ো’ দিতে লাগল। দর্শকের ক্ষিপ্ত গর্জনে টিভির ধারাবিবরণী ডুবে গেল।

জিশানের মনখারাপ হয়ে যাচ্ছিল। একটা মানুষ জীবনের মূল্যবোধ বজায় রাখতে বলছে, ‘জিশানের সঙ্গে লড়ব না।’ আর সেই কারণে পাবলিক তাকে ‘দুয়ো’ দিচ্ছে!

নিউ সিটির মূল্যবোধের বিকৃত আকারটা জিশানকে আরও একবার ব্যথা দিল। মনোহরের করুণ অবস্থা দেখে ওর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। ওর চোখ যে জলে ভরে উঠেছে সেটা জিশান টের পাচ্ছিল, কিন্তু চোখের জল ফেললে চলবে না। টিভি ক্যামেরার চোখ যে-কোনও মুহূর্তে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তখন স্টেডিয়ামের দর্শকরা, নিউ সিটির আরামের ফ্ল্যাটে টিভির সামনে বসে থাকা দর্শকরা, দেখবে জিশান কাঁদছে—ফাইটার জিশান কাঁদছে।

জামার হাতা দিয়ে চোখের জল মুছে নিল। তারপর জোর করে রিমিয়ার কথা ভাবতে শুরু করল। কোথায় লাল ড্রেস পরা মেয়েটা? এই স্টেডিয়ামে ঠিক কোন জায়গাটায় বসে আছে ও? জিশানের দু:খ নিশ্চয়ই ওর চেয়ে বেশি নয়! স্টেডিয়ামের গিজগিজে দর্শকের ওপরে সন্ধানী চোখ বোলাতে লাগল। চোখজোড়া যে জ্বালা করছে সেটা ভুলতে চাইল।

হঠাৎই জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে চোখ গেল জিশানের। কারণ, এইমাত্র ও একটা অদ্ভুত অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতে পেয়েছে। মণীশ তখন বলছে, ‘সারপ্রাইজ, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, সারপ্রাইজ! এইমাত্র আমাদের কাছে একটা স্পেশাল ইনফরমেশান এসে পৌছেছে। মনোহর সিং পিট ফাইট থেকে ব্যাক আউট করেছে বলে আমাদের মাননীয় মার্শাল শ্রীধর পাট্টা এইমাত্র ওর শাস্তি ঘোষণা করেছেন—খুব সহজ শাস্তি—”হাউন্ড গেম”। নরম্যালি এই ধরনের ব্যাক আউটের কেসে সিন্ডিকেটের তরফ থেকে ”ডগ স্কোয়াড” শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু সেটাকে ইনজিনিয়াসলি মডিফাই করেছেন আমাদের মাননীয় মার্শাল। এবারে আপনারা তাঁর কথা শুনুন…।’

সঙ্গে-সঙ্গে জায়ান্ট টিভির পরদায় শ্রীধরকে দেখা গেল। তিনি চিবিয়ে-চিবিয়ে নিচু গলায় বলছেন, ‘ওকে শাস্তি দেব। আর-একটা খেলা খেলব। ও জিশানের সঙ্গে লড়বে না। তাই শেম, শেম। হাউন্ড গেম। ওই গর্তে নামবে ও একা। সেইসঙ্গে পাঁচটা হাউন্ড যাবে দেখা…।’

ছন্দবাণী শেষ করে অদ্ভুতভাবে হাসলেন শ্রীধর। ওঁর ঠোঁট সামান্য চওড়া হল, চোখের কোণে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। মুখের আর কোনও পেশি নড়ল না। মরা মানুষ হাসতে পারলে বোধহয় এইভাবেই হাসত।

কয়েকসেকেন্ড চুপ করে থেকে শ্রীধর ঠান্ডা গলায় আবার বললেন, ‘শেম, শেম! হাউন্ড গেম।’

সঙ্গে-সঙ্গে উত্তেজনার হিংস্র রসদ খোঁজা দর্শকের দল শ্রীধরের তালে তাল মিলিয়ে গর্জন করে উঠল, ‘শেম, শেম! হাউন্ড গেম।’

শ্রীধরের কথার মধ্যে পদ্যের লুকোনো ছন্দ জিশানের বুকে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু ও কেমন যেন শক পেয়ে স্থবির চোখে টিভির পরদার দিকে তাকিয়ে ছিল।

দর্শকদের উল্লাসের চিৎকার জিশানের ঘোর কাটিয়ে দিল। ও স্পষ্ট বুঝতে পারছিল হাউন্ড গেম-এ কী হতে চলেছে। আর ঠিক তখনই মণীশের উত্তেজিত কমেন্ট্রি শোনা গেল।

‘…একটা নতুন গেম। গর্তের ভেতরে পাঁচটা হাউন্ডের সঙ্গে লড়বে ফাইটার মনোহর সিং—ডাকাবুকো বর্ন ফাইটার মনোহর সিং…।’

লড়বে? নাকি মরবে? ভাবল জিশান।

ও দেখল, দুটো ক্রেন তাদের কাজ শুরু করেছে। কুচকুচে কালো রঙের পাঁচটা হিংস্র হাউন্ডকে একে-একে গর্তের ভেতরে নামিয়ে দিচ্ছে। ওদের সঙ্গে কোনও ট্রেনার নেই। একটা নিরস্ত্র মানুষকে ছিন্নভিন্ন করার জন্য কোনও ট্রেনারের দরকারও নেই।

ওরা গর্তের ভেতরে এলোমেলো ছুটোছুটি করতে লাগল।

শ্রীধর পাট্টার ছবি সরে গিয়ে জায়ান্ট স্ক্রিনে আবার ফিরে এসেছে মনোহর সিং-এর মুখ। এবার ওর অডিয়ো সিস্টেম কাজ করছে। শোনা যাচ্ছে ওর পাগলের মতো চিৎকার।

‘…জিশান ভাইয়াসে ম্যায় নহি লড়ুঙ্গা। তুম লোগ ইয়ে কাম মুঝসে নহি করা সকতে। নহি লড়ুঙ্গা ম্যায় মেরে জিগরি দোস্তসে। অওর কোই ভি ফাইটার হমে মনজুর হ্যায়, পর জিশানভাইয়া? কভি নহি…।’

জিশান অবাক হয়ে সহজ-সরল মানুষটাকে দেখছিল। লোকটা ওই গর্তের মধ্যে এক্ষুনি টুকরো-টুকরো হতে চলেছে, অথচ এখনও শুধু একটা কথাই বলে চলেছে : জিশানের সঙ্গে ও লড়বে না।

মনোহরকে এবার সরাসরি দেখা গেল। প্যাভিলিয়নের করিডর ধরে ও স্টেডিয়ামে চলে এসেছে। ওর গায়ে টকটকে লাল রঙের জিম ভেস্ট আর কালো রঙের বারমুডা। পায়ে সাদা-কালো-রুপোলি স্পোর্টস শু। আর কালো মোজা। মনোহরের দুপাশে দুজন সিকিওরিটি গার্ড।

একটা ক্রেনের কেবিন ওদের কাছে এসে থামল। গার্ড দুজন ওকে ঠেলে তুলে দিল কেবিনে। তারপর নিজেরা উঠে পড়ল। ক্রেনের লম্বা হাত কেবিনটাকে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে গেল গর্তের ওপর। গর্তের ঠিক কেন্দ্রে মনোহরকে নামিয়ে দিয়ে ক্রেন আবার উঠে গেল শূন্যে।

মনোহর অসহায় চোখে কুকুরগুলোর দিকে একবার তাকাল। সঙ্গে-সঙ্গে পাঁচটা কালো বিদ্যুৎঝলক চাপা গর্জন করে মনোহরের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

মনোহর চিৎকার করতে লাগল।

শুরুর দিকে ও হাত-পা ছুড়ছিল, শ্রীধর পাট্টার নাম ধরে গালিগালাজ করছিল। কিন্তু সেটা মাত্র কয়েকসেন্ডের জন্য।

কারণ, তারপরই ও হিংস্র কুকুরগুলোর আক্রমণ ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কুকুরগুলো এতই ক্ষিপ্র যে, পাঁচটা কুকুরকে দশটা বলে মনে হতে লাগল।

মনোহরের চিৎকার জিশানের কানে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। আর-একজন মালিক অথবা শিবপদকে ও দেখতে লাগল। মনোহরের কথা জায়ান্ট টিভির স্পিকারেও শোনা যাচ্ছিল। ও তখন জড়ানো গলায় কাটা-কাটাভাবে বলছে, ‘জিশান! জিশানভাইয়া! ইন হারামি লোগোঁকো ছোড়না নহি। ইনকো সবক জরুর সিখানা। ছোড়না নহি সালোকো…।’

চিৎকার করতে-করতে মনোহর পড়ে গেল। ওর চিৎকার থেমে গেল। কুকুরগুলোর শরীরে ওর শরীর ঢাকা পড়ে গেল। জন্তুগুলো মনোহরের ভেস্ট, প্যান্ট আর জুতো-মোজা নিয়ে ছেঁড়াছিঁড়ির হরির লুঠের খেলা খেলতে লাগল। তারপর শুরু হল ওর চামড়া আর মাংস নিয়ে খেলা।

জায়ান্ট স্ক্রিন মাঝে-মাঝেই জাম্প কাট করে শ্রীধর পাট্টার মুখ দেখাচ্ছিল। ভাবলেশহীন মুখ। চকচকে চোখ। সরু পাতলা লাল টুকটুকে ঠোঁট। দেখে মোটেই মনে হয় না, তিনি কারও নৃশংস মৃত্যু দেখছেন।

উত্তেজিত জনতা প্রবল চিৎকার করছিল। নানান মন্তব্য করছিল। কেউ-কেউ শূন্যে রঙিন বেলুন ওড়াচ্ছিল। আর কুকুরগুলোর আক্রমণের তালে-তালে জনতার চিৎকার সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ওঠা-নামা করছিল।

অসম লড়াইটা শেষ হতে কুড়ি সেকেন্ডের বেশি লাগল না।

কুকুরগুলো মনোহরকে ছেড়ে যখন সরে দাঁড়াল তখন মনোহরের শরীরের খুব একটা অবশিষ্ট নেই।

জায়ান্ট স্ক্রিনে সেই অবশেষের ক্লোজ-আপ দেখা গেল। অতিথি নেমন্তন্ন খেয়ে চলে গেলে পাতে এঁটোকাঁটা যেরকম পড়ে থাকে মনোহরের এঁটোকাঁটা ঠিক তেমনই গর্তের মাটির ওপরে পড়ে রয়েছে।

জিশানের চোখে জল এসে গেল আবার। গা গুলিয়ে উঠল। মনোহর আর নেই—এই সত্যিটা উপলব্ধি করার জন্য ও মাথার ওপরে কালো আকাশের দিকে তাকাল। ওপরওয়ালা এই মৃত্যুটা কি দেখতে পেয়েছেন? ওই অন্ধকার থেকে?

হা ঈশ্বর!

ওল্ড সিটিতে মালিক যখন ফাইটার কার্তিকের হাতে মারা যায় তখন ঘোলাটে চোখে জিশানের দিকে তাকিয়ে মালিক বিড়বিড় করে বলেছিল, ‘…তুই ওকে উড়িয়ে দে। ওই কার্তিক সালাকে না উড়িয়ে তুই জল খাবি না। গড প্রমিস।’

জিশান মনে-মনে শপথ নিয়েছিল। এবং কথা রেখেছিল।

এখনও তো এই একটু আগেই মনোহর বলল, ‘…জিশানভাইয়া! ইন হারামি লোগোঁকো ছোড়না নহি। ইনকো সবক জরুর সিখানা। ছোড়না নহি…।’

না, জিশান ছাড়বে না। এদের উচিত শিক্ষা অবশ্যই দেবে।

শরীরে যেন মন্ত্রশক্তি টের পেল ও। বিদ্যুতের হলকা ছুটে বেড়াতে লাগল ওর শরীরের শিরা-উপশিরায়। ও বিড়বিড় করে বলল, ‘মনোহর, সালোকো হম সবক জরুর সিখাউঙ্গা। তু আশমানসে দেখতে রহেনা।’

জিশান এবার উঠে দাঁড়াল। চোয়ালে চোয়াল চেপে নিজের মনেই বলল, ‘যদি এই পিট ফাইটে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে লড়তেই হয় তা হলে আমি এই গেমটার নাম দিলাম ”কিল গেম”—খতমের খেলা।’

টিভির বিশাল পরদায় শ্রীধর পাট্টাকে দেখা যাচ্ছিল। তিনি তখন সুপারগেমস কর্পোরেশনের কঠোর নিয়মকানুনের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত এবং জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখছিলেন। ওঁর কথা বলা শেষ হতেই আবার শুরু হয়ে গেল জিশানের কীর্তির পাঁচালি। তার সঙ্গে চলতে লাগল নানান গেমের মানানসই চলমান ছবি। অর্থাৎ, ব্যাপারস্যাপার একটু আগে দেখানো পিট ফাইটের প্রাোমোশনাল ট্রেলারের অ্যাকশান রিপ্লে বলে মনে হতে লাগল। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যেন মনোহর সিং-এর ঘটনাটা কখনও ঘটেনি। গর্তের মধ্যে মনোহর সিং নামে কেউ কখনও নামেনি, পাঁচটা কালো হাউন্ডও কেউ কখনও দ্যাখেনি।

জিশানের মাথার ভেতরে গরম তেল টগবগ করে ফুটতে লাগল।

মাইকে মণীশের কথা শোনা যাচ্ছিল। জিশানের ফাইটিং ক্যালিবার সবিস্তারে বুঝিয়ে বলার পর ও বলল, ‘…এখুনি আপনাদের সামনে আমরা নতুন একজন ফাইটারের নাম ঘোষণা করব। মাননীয় শ্রীধর পাট্টা নিজে সেই নাম আপনাদের জানাবেন। আর-একটু ধৈর্য ধরুন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন…।’

গর্তের ভেতর থেকে পাঁচটা কুকুরকেই ক্রেন-কেবিনে তুলে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গর্তের মাটি সাফ করে আবার ঠিকঠাকভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন দাঁত-নখ লড়াইয়ের জন্য গর্ত আবার তৈরি।

জায়ান্ট স্ক্রিনে শ্রীধর পাট্টার মুখ ভেসে উঠল। ওঁর চোয়াল নড়ছে। কিছু একটা চিবোচ্ছেন যেন। চোখজোড়া তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল। মনে হয়, কোনও কিছুর প্রত্যাশায় একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।

শ্রীধর হঠাৎই চিৎকার করে বললেন, ‘জিশান! বাবু জিশান! কোথায় তুমি? আর য়ু রেডি?’

অন্য আর-একটা ক্যামেরা তাক করল জিশানের দিকে। জায়ান্ট স্ক্রিনে ইনসেটে দেখা গেল জিশানের মুখ।

ওর ঠোঁট কাঁপছে। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। চোয়ালের হাড় শক্ত।

জিশানকে দেখানোমাত্রই জনতা তীব্র গর্জন করে উঠল।

শ্রীধর পাট্টা ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে তুললেন। তারপর চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্যে আমাদের প্রীতি উপহার/জাব্বার সঙ্গে তোমাকে মানাবে চমৎকার। হ্যাঁ, জিশান—এইবার দেখি কেমন করে ওড়াও তোমার নিশান। তোমার সঙ্গে পিট ফাইটে লড়বে জাব্বা, জাব্বা, জাব্বা। ওরে বাব্বা, বাব্বা, বাব্বা!’

শ্রীধরের ছড়া-কাটা ব্যঙ্গের খোঁচা শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই জায়ান্ট স্ক্রিনে জাব্বার ক্লোজ-আপ ভেসে উঠল। জিশান তাকাল সেই ভয়ংকর মুখের দিকে। শতকরা দুশো ভাগ একটা পোড়খাওয়া খুনির মুখ।

জিশানের মনে পড়ল, পিট ফাইটে জাব্বার হাতে পুনিয়া মারা গেছে—খিদিরপুরের পুনিয়া সরকার। এ ছাড়াও আর-একজন ফাইটারকে জাব্বা খতম করেছে। তার নাম জিশান জানে না।

মোট দুজন জান দিয়েছে। আজ কি সংখ্যাটা দুই থেকে তিনে যাওয়ার পালা?

টিভির পরদায় জাব্বার গুণকীর্তন চলছিল। ওর ওজন, উচ্চতা, বাহুর দৈর্ঘ্য, পায়ের দৈর্ঘ্য, বুকের মাপ ইত্যাদি জানানো হচ্ছিল। আর মাঝে-মাঝেই দেখানো হচ্ছিল ওর ক্লোজ-আপ।

জিশান লোকটাকে দেখছিল। এখনই জাব্বাকে পিট ফাইট চ্যাম্পিয়ন বলা যেতে পারে। দুজন ফাইটার ওর হাতে মারা গেছে। এ ছাড়া আর ক’জন হেরেছে জিশান জানে না। পিট ফাইটের এতগুলো রাউন্ড জাব্বাকে দিয়ে কেন লড়ানো হচ্ছে তাও জিশানের জানা নেই। হয়তো বাড়তি রাউন্ডগুলো সারপ্রাইজ রাউন্ড—কিংবা নিউ সিটির বাসিন্দাদের বাড়তি আনন্দ আর উত্তেজনা জোগান দেওয়ার জন্য।

জাব্বার গায়ের রং বেশ কালো। তবে তা থেকে একটা চকচকে আভা বেরোচ্ছে। মাথাটা বড়—প্রায় ফুটবলের মতো। মাথায় মিলিটারিদের মতো কদমছাঁট চুল। মুখে এত ব্রণ যে, মনে হচ্ছে ব্যাঙের চামড়া গ্রাফটিং করে লাগানো হয়েছে। চোখ গর্তে ঢোকানো কিন্তু জ্বলজ্বল করছে। ভুরু চওড়ায় ছোট, লোমশ। দাড়ি-গোঁফ চেঁছেপুঁছে কামানো। ডানকানের ঠিক পাশ ঘেঁষে একটা বড় আঁচিল। আর বাঁ-চোয়ালের ওপরে ইঞ্চিতিনেক লম্বা একটা কাটা দাগ।

সবমিলিয়ে কাউকে খুন করার ব্যাপারে বেশ সম্ভাবনাময় মুখ।

নীল ইউনিফর্ম পরা ভারী চেহারার মেয়েটি বোধহয় কাছাকাছিই ছিল—হঠাৎ চলে এল জিশানের কাছে।

‘জিশান, এবার প্যাভিলিয়ানে চলুন। আপনাকে পিট ফাইট গেমটার জন্যে খুব কুইকলি রেডি হয়ে নিতে হবে। প্লিজ।’

জিশান মেয়েটার সঙ্গে হাঁটা দিল। আর মনে-মনে ভাবল, কী চমৎকার! পিট ফাইট গেম! হাউন্ড গেম! কিল গেম! এই নিউ সিটিতে মৃত্যুও একটা খেলা।

কোনও নিয়মকানুনের বালাই না মেনেই ঘেন্নায় পায়ের কাছে একদলা থুতু ফেলল জিশান। মেয়েটি সঙ্গে-সঙ্গে ভুরু কুঁচকে তাকাল জিশানের দিকে। বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিশান বলে উঠল, ‘এটা থুতু ফেলার গেম, ম্যাডাম—।’

লাউডস্পিকারে তখন মিউজিক বাজানো শুরু হয়েছে। তার ঢং অনেকটা যুদ্ধের বাজনার মতো।

প্যাভিলিয়নে যাওয়ার টানেলে ঢোকার সময় স্টেডিয়ামের গ্যালারির দিকে তাকাল জিশান—রিমিয়ার লাল ড্রেসটা যদি ওর চোখে পড়ে। পড়ল না।

গর্তের ভেতরে মুখোমুখি দুজন।

একজন পুরুষ মাইকে নির্দেশ দিচ্ছিল। তার নির্দেশমতো জিশান আর জাব্বা গর্তের দুটো বিপরীত কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল।

জিশানের গায়ে কালো রঙের জিম ভেস্ট আর লাল বারমুডা। পায়ে স্পোর্টস শু আর কালো মোজা।

জাব্বার পোশাক ঠিক উলটো : লাল জিম ভেস্ট আর কালো বারমুডা—মনোহরের মতো।

জিশান বুঝল, লড়াইয়ের সময় প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠিকমতো চেনার সুবিধের জন্যই দুজনের পোশাক দুরকম।

জাব্বার শরীরের দিকে তাকিয়ে ওর শক্তি আঁচ করতে চাইছিল জিশান। ওর কালো শরীরের সর্বত্র শক্তিশালী পেশি ঢেউ খেলছে। নি:শব্দ চিৎকারে জানান দিচ্ছে, আমরাই সেরা, আমরাই পিট ফাইটের চ্যাম্পিয়ন।

জাব্বাকে দেখে মনে হচ্ছিল ও মানুষ নয়—কালো পাথরে খোদাই করা মূর্তি। কয়েকমাস আগে ও রক্ত-মাংসের মানুষ ছিল। কিন্তু একটানা ভয়ংকর ট্রেনিং করার পর ও পাথর হয়ে গেছে।

নিজের শরীরেও পাথর টের পেল জিশান। পাথর, নাকি স্টেইনলেস স্টিল? মাসের-পর-মাস অ্যানালগ জিমের ব্যায়াম, বালির ওপরে দৌড় প্র্যাকটিস, জলের তলায় কতক্ষণ ডুব দিয়ে থাকা যায় তার অভ্যাস, তিরিশ কেজি বালির বস্তা কাঁধে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দৌড়নো, দড়ি বেয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা-নামা করা, পায়ে ওজন বেঁধে দৌড়নো, লেকে ফ্রি স্টাইল সাঁতারে এককিলোমিটার পেরোনো—সেসব যাবে কোথায়?

তা হলে জিশান কি পারবে না তিরিশ ফুট দূরে দাঁড়ানো ওই লোকটার কালো ঘাড়টা মটকে দিতে? শানু, মিনি—ওদের সঙ্গে দেখা করার জন্য জিশানকে যে বেঁচে থাকতেই হবে!

ভগবান! ভগবান! তুমি মাথার ওপরে আছ তো?

মুখ তুলে ওপরদিকে তাকাল জিশান। চারপাশের উজ্জ্বল আলো ওর চোখ ধাঁধিয়ে দিল। তবু চোখে পড়ল উজ্জ্বল আলো দিয়ে ঘেরা একটা কালো গহ্বর। সেটাই আকাশ।

লাউডস্পিকারে হঠাৎই নতুন একটা গলা শোনা গেল। কোনও মেয়ের মিষ্টি গলা।

‘জিশান—জাব্বা—আমি এই গেমের রেফারি। নিয়মের কোনও ভুলচুক হলে আমি তোমাদের ইনস্ট্রাকশন দেব। তোমরা সেটা খেয়াল রাখবে…।’

জিশান জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে তাকাল। অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়েকে সেখানে দেখা যাচ্ছে। মিষ্টি গলায় সে-ই কথা বলছে।

‘জিশান—জাব্বা—তোমরা দুজনে ওপরদিকে হাত তুলে দেখাও যে, তোমাদের সঙ্গে কোনও লুকোনো অস্ত্র নেই…।’

জিশান আর জাব্বা রেফারির কথা শুনল। দু-হাত ওপরে তুলল। আঙুলগুলো তালপাতার শিষের মতো ছড়িয়ে দিল।

না, ওদের হাতে কোনও লুকোনো অস্ত্র নেই। তবে যে-অস্ত্র রয়েছে সেটা সরাসরি দেখা যাচ্ছে : ওদের শক্ত শক্তিশালী আঙুল—চামড়া আর মাংস দিয়ে আড়াল করা আঙুলের হাড়—লোহা দিয়ে তৈরি হাড়।

জাব্বা ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে লাফাতে লাগল, হাত-পা ঝাঁকাতে লাগল, আর মরা মানুষের চোখে জিশানকে দেখতে লাগল। হয়তো ভাবছিল, এই ছোকরাটাকে মটাস করে ঘাড় ভেঙে মারতে ও ঠিক কতটা সময় নেবে।

লাউডস্পিকারে রেফারির গলা শোনা গেল : ‘আর য়ু রেডি, জাব্বা?’

জাব্বা একটা হাত ওপরে তুলল। ওপর-নীচে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল যে, ও রেডি।

সঙ্গে-সঙ্গে দর্শকের দল পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল।

রেফারি এবার চেঁচিয়ে জিশানকে জিগ্যেস করল, ‘আর য়ু রেডি, জিশান?’

জিশান ডানহাতটা তুলে ধরল শূন্যে। মাথা নেড়ে জানাল, ‘হ্যাঁ, রেডি—।’

সঙ্গে-সঙ্গে স্টেডিয়ামে আবার তুমুল চিৎকার।

রেফারি বলল, ‘ওয়ান…টু…থ্রি…স্টার্ট।’

লাউডস্পিকারে শোনা গেল কানফাটানো রক মিউজিকের ঝলক।

জিশান আর জাব্বার পিট ফাইট শুরু হল।

ওরা দুজন কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দুটো হাত সামনের দিকে খানিকটা বাড়িয়ে গোল হয়ে পাক খেতে লাগল।

জাব্বা অদ্ভুত এক প্রশান্ত চোখে জিশানকে দেখছিল, আর মাঝে-মাঝেই দু-হাতের তালু ঘষছিল। কী এক কৌশলে ও যেন ওর জ্বলজ্বলে চোখের বাতি নিভিয়ে দিয়েছে।

বৃত্তাকার পথে ওরা দুজন পাক খাচ্ছিল আর অদৃশ্য এক টানে ওদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব কমছিল।

পনেরোসেকেন্ডের মধ্যেই দূরত্বটা ছ’ফুটে এসে দাঁড়াল। তখনই জাব্বা হিংস্রভাবে চাপা গর্জন করে বলে উঠল, ‘খতম!’ এবং জিশানের দিকে থুতু ছেটাল।

জিশান কোনও পালটা জবাব দিল না। শরীরের প্রতিটি শক্তিকণা ও সঞ্চয় করে রাখতে চায় লড়াইয়ের জন্য। ও মনে-মনে মিনির কথা ভাবল। ভাবল শানুর কথা। যদি এই পিট ফাইটে জাব্বার হাতে ও শেষ হয়ে যায় তা হলে আর কোনওদিনও মিনি আর শানুর সঙ্গে ওর দেখা হবে না।

জিশানের হঠাৎ মনে হল, জাব্বার সঙ্গে ও নয়—মিনি আর শানু লড়ছে। আর ও বাইরে থেকে দেখছে। যদি ওরা জাব্বার হাতে খতম হয়ে যায় তা হলে জিশানের সঙ্গে ওদের আর কখনও দেখা হবে না।

দুটো ব্যাপার জিশানের কাছে একই বলে মনে হল। ওর মনে হল, মিনি আর শানুকে জাব্বার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই ওকে লড়তে হবে। প্রাণপণ লড়তে হবে।

জিশানের নাকে গন্ধ আসছিল। মাটির গন্ধ, কুকুরের গন্ধ, রক্তের আঁশটে গন্ধ। হয়তো ওর আর জাব্বার লড়াই শেষ হওয়ার পর এই গর্তে মানুষের গন্ধও পাওয়া যাবে।

দর্শকের দল খ্যাপা নেকড়ের মতো চিৎকার করছিল। শূন্যে হাত-পা ছুড়ছিল। ওরা রক্ত দেখতে চাইছিল। হাতাহাতি শুরু হওয়ার এক-একসেকেন্ড দেরি ওদের কাছে এক-একঘণ্টা বলে মনে হচ্ছিল। ওদের ধৈর্যের সুতো ছিঁড়ে গেছে অনেকক্ষণ।

নানান সুরে গালাগালের টুকরো ছিটকে আসছিল জিশানদের দিকে। সেইসঙ্গে মাইকের ধারাবিবরণী। হিংসার চাহিদা যে এত তীব্র হতে পারে সেটা জিশান আগে কখনও ভাবেনি। ওর কান ভোঁ-ভোঁ করছিল। মনে হচ্ছিল, শরীরের কাঠামোয় বসানো কতকগুলো জ্যান্ত খুলি রক্তের পিপাসায় পরিত্রাহি চিৎকার করছে।

জিশান আর জাব্বার বৃত্ত এখন অনেক ছোট হয়ে এসেছে। এত ছোট যে, ওরা হাত বাড়ালেই একে অপরকে ছুঁয়ে ফেলতে পারবে।

জাব্বা কথা বলছিল। প্রায় ফিসফিস করে বিড়বিড় করছিল। কথাগুলো শুনতে না পেলেও জিশান অনুমান করতে পারছিল। জাব্বা খিস্তির ফোয়ারা ছোটাচ্ছে।

হঠাৎই জাব্বা চোখের ইশারা করল। জিশানের বাঁ-পাশ দিয়ে যেন জিশানের পিছনে কারও দিকে তাকাল। বলল, ‘দ্যাখ, কে এসেছে—।’

জিশান বুঝতে পারছিল এটা বহু পুরোনো লোকঠকানো প্যাঁচ। কিন্তু সেই মুহূর্তে কী যে হল! ও মাত্র পাঁচ কি দশ ডিগ্রি মাথাটা ঘুরিয়ে ছিল। তাও এক লহমার জন্য। তাতেই গন্ডগোল হয়ে গেল। জাব্বা ওর নেমন্তন্নের চিঠি পেয়ে গেল।

জাব্বার লাথিটা সপাটে এসে পড়ল জিশানের বুকে—ডানদিকে। জিশান ছিটকে পড়ল মাটিতে। একটা পাক খেয়ে হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে শরীরটাকে তুলে ধরল। ততক্ষণে জাব্বা ওর আরও কাছে চলে এসেছে। ফুটবল খেলার ফ্রি কিক শট নেওয়ার মতো পরপর তিনটে লাথি কষাল জিশানের মাথায় আর পাঁজরে।

জিশানের মনে হল বুকের ভেতরে পাঁজরের হাড়-টার বা কিছু একটা বোধহয় ভেঙে গেল। ছুঁচ ফোটানো ব্যথা টের পেল ও। তবু কোনওরকমে মাটিতে ভর দিয়ে মাতালের মতো হাঁচরপাঁচর করে টলতে-টলতে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

এই ওর লড়াইয়ের নমুনা! বাঁচা-মরার লড়াই লড়তে গিয়ে বস্তাপচা প্যাঁচে মাত হয়ে যাচ্ছে!

‘শাবাশ, জাব্বা! শাবাশ!’ একজন হিংস্র দর্শকের উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল।

‘অ্যাই, জিশান! তোর জুতোর ফিতে খুলে গেছে. তাকা—পায়ের দিকে তাকা, সালা! মাথামোটা আলুরদম কোথাকার!’ আর-একজন দর্শক। বোকা-বোকা লড়াই লড়ার জন্য জিশানকে ব্যঙ্গ করছে।

জিশান আন্দাজ করল, ওর আর জাব্বার লড়াই নিয়ে দর্শকদের মধ্যে নিশ্চয়ই বাজি ধরাধরি চলছে। আর সুপারগেমস কর্পোরেশন নিশ্চয়ই এ থেকে ভালো পয়সা লুটছে। এক ঢিলে দু-পাখি—বিনোদন আর ফায়দা।

জাব্বা কুঁজো হয়ে দু-হাত দুপাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর মরা মাছের চোখ জিশানের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে-চিবিয়ে ও বলল, ‘বাঁচতে চাস তো এই গাড্ডা থেকে ফুটে যা। নইলে পাঁচমিনিটে তোকে টুটা-ফুটা সও টুকরা করে দেব। দাঁতগুলো গোটা-গোটা হাথে দিয়ে দেব। সালা…সুয়ার কা বাচ্চা!’

জিশানের মাথা ঘুরছিল। ও যেন জায়ান্টস হুইলে পাক খাচ্ছিল। কপালের পাশ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। নাক বেয়ে নেমে এসে ফোঁটা-ফোঁটা করে ঝরে পড়ছিল ঠোঁটের ওপর। ঝাপসা চোখে দেখছিল জাব্বা ওর কাছে এগিয়ে আসছে।

হাতের পিঠ দিয়ে রক্ত মুছে নিল। মনে-মনে ভাবল, এই গর্ত থেকে ওর বোধহয় আর বেরোনো হবে না। গর্ত নয়, আসলে একটা কবরের মধ্যে ও লড়াই করছে—জিশান পালচৌধুরীর কবর।

দলাপাকানো কাগজের বল ছিটকে আসছিল গর্তের ভেতরে। সেইসঙ্গে কিছু পেপার কাপ আর প্লাস্টিকের হালকা কৌটো। না, নিউ সিটির খেলায় এ ধরনের ‘মিসাইল’ ছোড়া বারণ নয়। কারণ, সুপারগেমস কর্পোরেশনের কর্তাদের মতে এগুলো উত্তেজনাময় খেলার একটা অঙ্গ। তাই অঙ্গহানি যাতে না হয় তার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে দর্শকরা।

হঠাৎই লম্বা মোটা দড়ির মতো কী যেন একটা উড়ে এসে পড়ল গর্তের ভেতরে। জিনিসটা এসে পড়েছে জিশান আর জাব্বার কাছ থেকে প্রায় দশ-বারো ফুট দূরে। কিন্তু মেটাল ল্যাম্পের চোখধাঁধানো সাদা ঝকঝকে আলোর কৃপায় বস্তুটাকে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হল না।

প্রায় সাতফুট লম্বা একটা কালচে রঙের সাপ। নরম মাটিতে ছিটকে এসে পড়ার পর স্থির হয়ে রয়েছে।

সাপটা বোধহয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নড়াচড়া বন্ধ রেখেছিল। জিশান আর জাব্বারও তখন একই অবস্থা। কিন্তু চার-পাঁচসেকেন্ড পরেই সাপটা নড়ে উঠল। কিলবিল করে চলতে শুরু করল। তখন জিশান দুরকম শত্রুর ওপরে সতর্ক চোখ রেখে পায়ে-পায়ে সরতে লাগল। লক্ষ করল, জাব্বার নজরও দুই শত্রুর দিকে।

সাপটা হঠাৎ কোথা থেকে এল? কেন এল? সাপটা কি বিষধর?

জিশানের এইসব প্রশ্নের উত্তর দিল মণীশের ধারাবিবরণী।

‘সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ! এক্সাইটিং! এক্সাইটিং! এক্সাইটিং! পিটের মধ্যে উড়ে গিয়ে পড়েছে জ্যান্ত আফ্রিকান ব্ল্যাক মাম্বা। এবার দুই ফাইটারের সঙ্গে চলবে জ্যান্ত সাপের কিলবিল। তবে ভয়ের কিছু নেই। ব্ল্যাক মাম্বা সাংঘাতিক বিষধর সাপ হলেও এই সাপটার বিষ দুয়ে নেওয়া হয়েছে—কিন্তু ওর ধারালো বিষদাঁত জোড়া ইনট্যাক্ট রয়েছে। অ্যাজ আ রেজাল্ট, এই সাপটা যদি জিশান কিংবা জাব্বাকে কামড় বসায় তা হলে সেই বাইটটা পেইনফুল হবে, কিন্তু ডেডলি হবে না। জিশান আর জাব্বা—তোমাদের বলছি—এই সাপটার বিষ নেই বটে, কিন্তু তবু ওটা সাপ। সাপটা এখন তোমাদের লড়াইয়ের প্যাকেজে ঢুকে পড়েছে। সো, কাম অন ফোকস, লেটস নাউ ওয়াচ দিস সুপার এক্সাইটিং ভেনোমাস গেম। হো—য়া—!’

মণীশের উল্লাসের চিৎকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খ্যাপা দর্শকের দল ক্ষিপ্ত গর্জন করে উঠল।

কোনও গেমকেই সুপারগেমস কর্পোরেশন কখনও একঘেয়ে হতে দেয় না। তাই এইসব সারপ্রাইজ হচ্ছে ওদের আস্তিনের তাস। নতুন-নতুন ধরনের গেম আর নতুন-নতুন ধরনের সারপ্রাইজ ডিজাইন করার জন্য সুপারগেমস কর্পোরেশনের কোর ডিজাইনার গ্রুপ রয়েছে। সেই গ্রুপের হাই আই-কিউ এক্সিকিউটিভরাই হচ্ছে গেম ডিজাইনের থিংক ট্যাংক। এই খেলায় সারপ্রাইজ ফ্যাক্টর হিসেবে ওরা একটা নন-ভেনোমাস ব্ল্যাক মাম্বা অ্যাড করার কথা ভেবেছে।

ব্ল্যাক মাম্বাটা গর্তের কোণ ঘেঁষে সড়সড় করে চলে বেড়াচ্ছে। হয়তো জোরালো আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে বলে সরীসৃপটা অন্ধকার কোণ খুঁজে বেড়াচ্ছে।

লাউডস্পিকারের এবার শোনা গেল রেফারির গলা : ‘জিশান! জাব্বা! ওই সাপটা তোমাদের। তোমরা ওটা নিয়ে যা খুশি করতে পারো। যেমন তোমরা তোমাদের রাইভালকে নিয়ে যা খুশি করতে পারো। পিট ফাইটে কোনও রুল নেই। ফ্রি ফর অল। স্কাই ইজ দ্য লিমিট। সো ক্যারি অন। আর তোমাদের তো আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, পিট ফাইটের রাউন্ড একটাই—এবং তার কোনও টাইম লিমিট নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অ্যাট আ স্ট্রেচ লড়াই—একটাই রাউন্ড…।’

গর্তের ঠিক মাঝখানে জিশান আর জাব্বার আবার সংঘর্ষ হল।

জাব্বার ঘুসি তো নয়, যেন দু-দুটো কালো লোহার বল বারবার আছড়ে পড়ল জিশানের মাথার দুপাশে। গর্তটা ঘূর্ণিপাকে ঘুরতে লাগল। গর্তের দেওয়াল যেন এখুনি ধসে পড়বে, জিশানকে কবর দিয়ে দেবে মাটির তলায়। ওকে একটানে শুষে নেবে অন্ধকার পাতালে।

জিশান হাঁটুগেড়ে বসে পড়েছিল। সেই অবস্থাতেই মাথা ঝাঁকাল এপাশ-ওপাশ।

সাপটা কোথায়? কোথায় গেল ব্ল্যাক মাম্বাটা? ওটা শানুকে ছোবল মারবে না তো? শানু কোথায়? ওকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কোথায় আমার ছোট্ট শানু? ওকে দেখার জন্যে আমাকে বাঁচতে হবে…।

সেই তীব্র ইচ্ছেটাই জিশানের ডানহাত মুঠো করে একটা লোহার ঘুসি তৈরি করে দিল। সেটা ও সজোরে চালাল ওপরদিকে। অনেকটা আন্দাজে ও ঘুসিটা চালালেও সেটা লাগল গিয়ে জাব্বার তলপেটে।

জাব্বার মুখ দিয়ে ‘ওঁক’ শব্দ বেরিয়ে এল। ও কুঁজো হয়ে গেল। এলোমেলো পা ফেলে খানিকটা পিছিয়ে গেল।

পাবলিক কানফাটানো গর্জন করে উঠল।

হঠাৎই জিশান দেখল, কালো সাপটা ওর কাছে এসে গেছে। ওটার গা চকচক করছে। যেন সারা গায়ে ভেসলিন মেখে এসেছে।

সাপটা ছোবল মারার আগেই জিশান ছোবল মারল। সাপটাকে এক ছোবলে মাটি থেকে তুলে নিয়ে ছুড়ে দিল জাব্বার দিকে। সাপটা ওর বুকের ওপর গিয়ে পড়ল। চাবুক মারার মতো শব্দ হল। জাব্বা খপ করে সাপটার হিলহিলে শরীর চেপে ধরল। সাপটা চকিতে ছোবল মারল জাব্বার কাঁধে।

পলকের জন্য চোখ কুঁচকে গেলেও জাব্বা সাপটার দিকে ফিরেও তাকাল না। রোবটের মতো যান্ত্রিকভাবে ওটাকে সজোরে ছুড়ে দিল গর্তের এবড়োখেবড়ো দেওয়ালে।

সাপটা জাব্বার কালো চামড়া ফুটো করে দিয়েছিল। ওর কাঁধ থেকে সরু রক্তের রেখা গড়িয়ে পড়ছিল।

জিশান বিদ্যুৎঝলকের মতো লাথি চালাল।

লাথিটা ও চালিয়েছিল জাব্বার দু-পায়ের জোড় লক্ষ্য করে। আঘাতটা এড়ানোর জন্য জাব্বা ওর কোমরটাকে একঝটকায় পিছিয়ে নিল। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ওর মাথাটা ঝুঁকে পড়ল সামনে। ফলে লাথিটা যে-বৃত্তচাপ তৈরি করছিল সেটা থামল গিয়ে জাব্বার চোয়ালে।

জাব্বার শরীর হয়তো ইস্পাত দিয়ে তৈরি, কিন্তু জিশানের ইস্পাতও তো ফেলনা নয়! সুতরাং সংঘর্ষটা মেগাটন লেভেলের শোনাল। জাব্বার একটা দাঁত ছিটকে পড়ল মাটিতে। জাব্বা পিছনদিকে একটা ঝটকা খেয়েই সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

জিশান ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর ওপরে। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে দু-হাত মুঠো করে পাগলের মতো রদ্দা মেরে চলল জাব্বার কালো মোটা ঘাড়ে। যেভাবেই হোক, শত্রুকে ও মাটিতে পেড়ে ফেলতে চায়।

হয়তো সেই উদ্দেশ্যেই জিশান হঠাৎ একটু পিছিয়ে এল। একটা জোরালো লাথি কষানোর জন্য ডান পা-কে তৈরি করল। কিন্তু লাথিটা শুরু করার আগেই হাঁটুগেড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে থাকা জাব্বা ডানহাতে ছোবল মারল জিশানের দু-পায়ের ফাঁকে। ওর সবচেয়ে দুর্বল প্রত্যঙ্গ আঁকড়ে ধরল। তারপর ইস্পাতের আঙুল দিয়ে পাথর গুঁড়ো করার শক্তিতে চাপ বাড়িয়ে চলল।

জাব্বার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল জয়ের গর্জন। আর জিশান যন্ত্রণায় এমন এক ভয়ংকর চিৎকার করে উঠল যে, সে-চিৎকার শুনে ও নিজেও ভয় পেয়ে গেল।

গ্যালারির দর্শক একসঙ্গে গর্জে উঠল। গ্যালারি থেকে পঞ্চাশ-ষাটটা রঙিন বেলুন উড়ে গেল আকাশে।

জিশান প্রাণ বাঁচাতে জাব্বার মাথায় প্রাণপণে ঘুসি-বৃষ্টি করতে লাগল। তারপর দু-হাতে ওর গলা টিপতে চাইল। কিন্তু ঘাড়ের দিক থেকে গলা টেপার চেষ্টা করায় ও তেমন জুতসই বাঁধন পাচ্ছিল না। এদিকে যন্ত্রণার তীব্র স্রোত দু-পায়ের ফাঁক থেকে শুরু হয়ে কোমর-বুক বেয়ে জিশানের মাথায় পৌঁছে যাচ্ছিল। সেখান থেকে ফেটে পড়ছিল যন্ত্রণার তীব্র চিৎকারে। সেই চিৎকার অ্যানটেনা থেকে বেরিয়ে আসা অদৃশ্য তরঙ্গের মতো আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। জিশানের মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ও অজ্ঞান হয়ে যাবে।

সেই অবস্থাতেই জিশান টের পেল জাব্বা ওর শর্টস খামচে ধরা মুঠোটাকে ধীরে-ধীরে কাছে টানছে—ওর মুখের কাছে। ও কি মুঠোর বদলে এবার ওখানে কামড় বসাবে নাকি? একটা ভয়ের স্রোত মিশে গেল যন্ত্রণার স্রোতের সঙ্গে। বাঁচার ইচ্ছেটা জিশানের ভেতরে প্রবল হয়ে উঠল। ওর মনে পড়ল মালিকের কথা, মনোহর সিং-এর কথা। তারপরে মনে হল, জাব্বা ওর দুর্বল প্রত্যঙ্গ নয়, শানুর কচি গলাটা বজ্রমুঠিতে আঁকড়ে ধরেছে। এখন সেই নরম গলায় হিংস্র কামড় বসাতে চাইছে।

শানু আর মিনির ছবি পালা করে ঝলকে যেতে লাগল ওর চোখের সামনে।

সেই রাতটার কথা জিশান কোনওদিনও ভুলবে না।

যেমন ঝড়, তেমন বৃষ্টি। ঘরের ভেতর থেকে ঝড়-বৃষ্টির দাপট শুনলে মনে হয় প্রকৃতির দাঙ্গা চলছে। ঝোড়ো বাতাস পাগলের মতো ছুটে চলেছে। এ-রাস্তা সে-রাস্তায়, এ-বাড়ি ও-বাড়ি, কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর মাঝে-মাঝেই বাজ পড়ছে।

সকাল থেকে শানুর জ্বর ছিল। তখন কতই-বা বয়েস বাচ্চাটার? বড়জোর মাসদেড়েক হবে। কিছুতেই খেতে চাইছে না। চোখ-মুখ লালচে। গাল দুটো ফোলা-ফোলা লাগছে। মিনি অস্থির হয়ে উঠেছে। কান্নাকাটি করছে।

ডাক্তারের বাড়ি দৌড়োদৌড়ি করে হোমিওপ্যাথি ওষুধ এনে দিয়েছিল জিশান। সেটা খেয়ে জ্বরটা একটু কমেছিল। কিন্তু বিকেলের পর আবার বাড়তে শুরু করল।

যখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হল তখন মিনি জিশানকে বারবার বলতে লাগল, ‘চলো, ওকে হসপিটালে নিয়ে চলো। এরপর আরও দেরি করলে আমার শানু আর বাঁচবে না…আর বাঁচবে না…।’ কথা বলতে-বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছে মিনি।

জিশান যে একটু কিন্তু-কিন্তু করছিল তার কারণ তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তা ছাড়া সন্ধের পর মিনিকে নিয়ে রাস্তায় বেরোনোটা এ-শহরে মোটেই নিরাপদ নয়। তাই ও ভাবছিল যদি আজকের রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যায় তা হলে কাল সকালে…।

কিন্তু শানুর জ্বর ক্রমশ বাড়তেই লাগল। বাইরের পাগল করা ঝড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিনিও পাগল হয়ে উঠল। আর জিশান দোটানায় পড়ে অস্থিরভাবে ছটফট করতে লাগল।

শেষ পর্যন্ত ওরা যখন রাস্তায় বেরোল তখন প্রায় সাতটা। দুটো ছাতা নিয়ে ঘুমন্ত শানুকে পলিথিনে জড়িয়ে মাথা হেঁট করে ওরা সামনে এগোচ্ছিল। আর ট্যাক্সির খোঁজে উদভ্রান্তের মতো এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিল।

ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে অনেকটা পথ পেরিয়ে ওরা বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ভাঙাচোরা খানাখন্দে ভরা রাস্তার বেশিরভাগটাই পুকুরের চেহারা নিয়েছে। তারই মধ্যে দিয়ে কয়েকটা গাড়ি লাফাতে-লাফাতে ছুটে চলেছে। ওদের হেডলাইটের আলো সেই তালে-তালে ঝাঁকুনি খাচ্ছে।

না, একটাও খালি ট্যাক্সি চোখে পড়ল না।

তিনটে ছেলে কাকভেজা হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ওদের একজনের হাতে টর্চলাইট। জিশানদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওরা থমকে দাঁড়াল। টর্চের আলো ছুড়ে দিল মিনির মুখে। একজন বলে উঠল, ‘চলে এসো, মা-মণি। দুজনে মিলে একটু ঝড় তুলি—তারপর বৃষ্টি।’ বলেই খ্যা-খ্যা করে হেসে উঠল।

আর-একজন জড়ানো গলায় গান গেয়ে উঠল, ‘এই রাত তোমার আমার…।’

তৃতীয়জন চাপা গলায় দুই সঙ্গীকে ধমক দিল, ‘কী করছিস কী! দেখছিস না, কোলে একটা ছোট বাচ্চা রয়েছে! চল, চল—।’

সে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বাকি দুজনকে এগিয়ে নিয়ে চলল।

যেতে-যেতে একজন একটা হাত ওপরে তুলে মাতালের গলায় বলল, ‘সরি, হাজব্যান্ড। সরি…সরি…গুড বাই…।’

জিশান মিনিকে জড়িয়ে ধরে ছিল। সেইজন্যই টের পেল মিনি থরথর করে কাঁপছে। একইসঙ্গে ডুকরে কাঁদছে। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে ওর চাপা কান্না ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না।

‘মিনি, মিনি—’ ওকে আশ্বাস দিতে গাঢ় গলায় ডাকল জিশান, ‘ভয় পেয়ো না। এখুনি একটা ট্যাক্সি পেয়ে যাব। জানোই তো, এ-শহরটা কেমন বাজে হয়ে গেছে। এটার দিকে আর কেউ তাকায় না। এটার কথা কেউ আর ভাবে না। সবাই জানে শহরটা একেবারে গোল্লায় গেছে।’

জিশান অস্থির হয়ে পড়ছিল। ছাতা মাথায় দিয়েও বৃষ্টির দাপট আটকানো যাচ্ছে না। শানুর হয়তো আরও ঠান্ডা লাগবে, জ্বর বাড়বে, এখুনি ও হয়তো জেগে উঠবে।

ওদের পাশ দিয়ে দুটো গাড়ি পরপর চলে গেল। জিশান রাইড পাওয়ার আশায় প্রবলভাবে হাত নেড়েছিল কিন্তু একটা গাড়িও দাঁড়াল না।

জিশান রাস্তা বরাবর নজর চালিয়ে দেখতে চেষ্টা করছিল আর কোনও গাড়ি আসছে কি না। কিন্তু বৃষ্টির চিক ভেদ করে বেশিদূর নজর গেল না। তবে হেডলাইট জ্বেলে কোনও গাড়ি যদি এগিয়ে আসত তা হলে তার হলদে আভা আর বৃষ্টির ফোঁটার ঝিকমিক নিশ্চয়ই জিশানের চোখে পড়ত।

ঝোড়ো হাওয়ার বেগ হঠাৎ বেড়ে গেল। কড়কড় করে দূরে কোথাও বাজ পড়ল। নীল আলোর ঝলকানি দেখা গেল। তার পরেই কানফাটানো শব্দ। জিশান উদভ্রান্তের মতো এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিল। একটা ট্যাক্সি…ইস, একটা খালি ট্যাক্সি।

রাস্তার দুপাশের ফুটপাথ ঘেঁষে বেশ কয়েকটা ঝুপড়ি। ঝুপড়িগুলোর মাথায় পলিথিনের চাল—তার ওপরে ইটের টুকরো, কাঠের তক্তা আর বাঁশ চাপা দেওয়া। কয়েকটার পলিথিনের চালের কোনা হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে, অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে : ফটফট, ফটফট। রাস্তার ওপারে দাঁড়ানো দুটো বিশাল গাছ। গাছদুটো ঝোড়ো বাতাসে একটুও নড়ছে না। কারণ, গাছদুটোয় একটাও পাতা নেই। ধুলো-ময়লায় নোংরা এই শহরের বাতাস এতটাই নষ্ট প্রকৃতির যে, গাছের পাতা ক’দিন বাদেই ডাল থেকে খসে পড়ে।

আরও মিনিট-পনেরো-কুড়ি কেটে যাওয়ার পর মিনি কান্না-কান্না গলায় জিশানকে বলল, ‘চলো, বাড়ি ফিরে যাই। রাতটা কোনওরকমে কাটিয়ে দিই। তারপর কাল সকালে…।’

মিনির কথা শেষ হওয়ার আগেই হেডলাইট জ্বেলে ছুটে আসা একটা গাড়ি জিশানের নজরে পড়ল। গাড়িটা ট্যাক্সি কি না কে জানে! উত্তাল সাগরে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টার মতো জিশান একছুটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। পাগলের মতো ওর ছাতা আর হাত নাড়তে লাগল। ওর মনে হচ্ছিল, এ-গাড়িটা যদি না দাঁড়ায়, ওদের না সাহায্য করে, তা হলে শানুকে আর বাঁচানো যাবে না।

গাড়িটা জিশানের কাছে এসে দাঁড়াল। জলে ভেজা জিশান হেডলাইটের আলোয় মাখামাখি। ঠিকরে পড়া আলোয় ও বুঝতে পারল গাড়িটা ট্যাক্সি নয়—করসিকা-এইট—প্রাইভেট কার আর জিপের মাঝামাঝি একটা মডেল।

গাড়ির বনেট রং চটা, তোবড়ানো। বাকি চেহারাটাও তার সঙ্গে মানানসই। গাড়ির ভেতরে কতকগুলো ছায়া-ছায়া মানুষ। তাদেরই একজন নেমে পড়ল জল-কাদায় মাখামাখি রাস্তায়। হেডলাইটের আলোর পিছনে লোকটার অন্ধকার বিশাল চেহারা জিশানের চোখে পড়ল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *