পর্ব – ৪
ছুটতে-ছুটতে তেতো হাসি পেল জিশানের। সিমুলেশানের নকল ছবি দেখে এবার ওরা আসল কাজটা করছে। নকলের সিমুলেশান!
জিশান লাফিয়ে একটা গাছে উঠল। ওর পা থেকে ঠিক দু-ফুট দূরে চোয়ালে-চোয়াল ঠোকার শব্দ হল। একটা কোমোডো অল্পের জন্য জিশানের পায়ের নাগাল পায়নি।
জিশান হাঁপাচ্ছিল। গাছের গোড়ায় এসে পৌঁছনো কোমোডোটার দিকে নজর রাখছিল। ওটা বারবার ওর চেরা জিভ বাইরে বের করছে আর ঢোকাচ্ছে। ওটা কি এখন গাছ বেয়ে উঠতে চেষ্টা করবে?
জিশানের সারা গায়ে মাথায় কাদা-মাখা। মিনি এই অবস্থায় ওকে দেখলে নিশ্চয়ই হেসে গড়িয়ে পড়ত। আর শানুও নির্ঘাত ভয়ে ওর কোলে আসতে চাইত না।
মাথার ওপরে গনগনে সূর্য। গোটা পার্কে কড়া রোদের আলো-ছায়া। একটু দূরেই একটা জলার ঘোলাটে জল চিকচিক করছে। জলার ধারে তিনটে কোমোডো মাথা ঝুঁকিয়ে জল খাচ্ছে।
হঠাৎই পাখির শিস শুনতে পেল জিশান। কিন্তু এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে পাখিটাকে কোথাও দেখতে পেল না। গাছের গোড়ায় ওত পেতে থাকা কোমোডোটার কথা খেয়াল হতেই আবার তাকাল নীচের দিকে। জন্তুটা সবে ওর সামনের দুটো পা গাছের গুঁড়িতে তুলেছে।
কী করা যায় এখন? জিশানের মাথার ভেতরে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। অনেক ভেবেও মাথা থেকে কিছু বের করতে পারছিল না। কেমন যেন পাগল-পাগল লাগছিল ওর।
কোমোডোটা ধীরে-ধীরে উঠে আসছে ওপরে।
জিশানের গায়ে কাঁটা দিল। এরপর কী হবে?
গাছের ওপরের দিকে তাকাল জিশান। দু-তিনফুট ওপর থেকেই শুরু হয়ে গেছে সরু ডাল। ওগুলো জিশানের ভার সামলাতে পারবে না। তা ছাড়া এই কমব্যাট পার্কে সব গাছই ছোট মাপের—কোনওটাকেই মহীরুহ বলা যায় না। এরকমটা যেন ইচ্ছে করেই করেছে সিন্ডিকেট। এটা কমপিটিশানের ডিজাইনের একটা অংশ। মানুষ মারার নকশা।
তা হলে এখন বাঁচার জন্য কী করবে জিশান?
নিরস্ত্র জিশান মরিয়া হয়ে একটাই পথ দেখতে পেল। ডালপালা ধরে কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল ও। তারপর প্যান্টের জিপ খুলে কোমোডোটার মুখে পেচ্ছাপ করতে লাগল।
চকিতে অচেনা গন্ধের ঢেউ কোমোডোটাকে ভাসিয়ে দিল। হিংস্র প্রাণীটার নখের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। ওটা খসে পড়ল মাটিতে। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রবলভাবে এপাশ-ওপাশ মাথা ঝাঁকাতে লাগল।
জিশান আর দেরি করল না। প্যান্টের চেন লাগিয়ে নিয়ে কী ভেবে গাছের একটা মাঝারি মাপের ডাল সজোরে আঁকড়ে ধরল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মাটিতে।
ও যা ভেবেছিল তাই হল। পাঁচ-ছ’ফুট লম্বা ডালটা সটান মটকে গিয়ে চলে এল জিশানের হাতে। ডালটাকে কয়েকটা জোরালো মোচড় দিল ও। ডালটা গাছের গা থেকে খুলে এল—হয়ে গেল হাতের লাঠি। আপাতত এটাই অস্ত্র হোক। ক্ষুধার্ত সরীসৃপগুলোর সঙ্গে লড়াই করার জন্য এই আঁকাবাঁকা লাঠিটা কম কী!
বিভ্রান্ত কোমোডোটাকে পিছনে ফেলে জিশান ছুটতে শুরু করল।
প্রতিযোগীদের সুবিধের জন্য কমব্যাট পার্কের নানান জায়গায় বেরোনোর পথের নিশানা দেওয়া আছে। সেইসব সাইনবোর্ড দেখে-দেখে জিশান উদভ্রান্তের মতো ছুটতে লাগল। শরীরের বহু জায়গায় ছড়ে গেছে, নুনছাল উঠে রক্ত বেরোচ্ছে, জ্বালা করছে—কিন্তু থামার কোনও উপায় নেই।
ছুটতে-ছুটতে ও শুনতে পেল অন্য কোনও খেলোয়াড়ের আর্তচিৎকার। শব্দ লক্ষ করে কয়েকটা গাছের আড়াল পেরিয়ে খানিকটা এগোতেই জিশান দৃশ্যটা দেখতে পেল।
একজন হাট্টাকাট্টা জোয়ান অসহায়ভাবে পড়ে আছে পার্কের মাটিতে। ছোট-বড় মাপের প্রায় সাত-আটটা কোমোডো লোকটাকে ছেঁকে ধরেছে। লোকটা চিৎকার করছে, হাত-পা ছুড়ছে। আর প্রাণীগুলো ধারালো দাঁত-নখে তাকে ছিন্নভিন্ন করছে। একইসঙ্গে নিজেদের মধ্যেও খেয়োখেয়ি করছে।
জিশান ছুটতে লাগল। একটা জলা জায়গা পেরোতেই দুটো কোমোডো দুপাশ থেকে ওর দিকে ছুটে এল। পাগলের মতো গাছের ডাল চালাল ও। একবার, দুবার, বারবার। ভোঁতা সংঘর্ষের শব্দ হতে লাগল। সংঘর্ষের তীব্রতায় ওর কবজি আর কনুই ঝনঝন করে উঠল।
ছুটতে-ছুটতে ও পৌঁছে গেল বেরোনোর গেটের কাছে। সেখানে একলহমা থমকে দাঁড়াল।
সিমুলেশানে যেমন দেখানো হয়েছিল বেরোনোর পথটা একটা ঢালের ওপরে। সেখানে বেয়ে ওঠার সরু শ্যাওলা-মাখা পথে দুজন খেলোয়াড় তখন হাঁকপাঁক করে ওপরে উঠতে চাইছে। পা পিছলে গেলে পথের দুপাশের আগাছার ঝুঁটি ধরে সামলে নিচ্ছে।
বেয়ে ওঠার পথের নীচেই অপেক্ষা করছে ছোট মাপের তিনটে কোমোডো। ওরা তাকিয়ে আছে ওপরদিকে—কখন প্রতিযোগী দুজন পা পিছলে পড়ে।
জিশানের চোখ মনোহরকে খুঁজছিল—কিন্তু খুঁজে পেল না। মনোহর কি আগে বেরিয়ে গেল, নাকি পিছনে পড়ে আছে?
আর ভাবার সময় পেল না জিশান। একটা কোমোডো ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল। চেরা জিভ মুখের বাইরে বেরোচ্ছে আর ঢুকে পড়ছে।
জিশান আর দেরি করল না। পিছনদিকে ছুট লাগল। অনেকটা গিয়ে তারপর থামল। এবং ঘুরে দাঁড়াল।
হাতের লাঠিটা উঁচিয়ে ধরে এবার গেট লক্ষ করে ছুটতে শুরু করল। ওর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, ও পোলভল্ট প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছে।
জিশান সত্যিই তাই করল। ছুটতে-ছুটতে ঢালের কাছাকাছি এসে পড়ল। তারপর গাছের ডালটাকে লাঠির মতো ব্যবহার করে মাটিতে ভর দিয়ে শূন্যে লাফ দিল।
সময় মতো লাঠিটা ছেড়ে দিল জিশান। আকাশে একটা বৃত্তচাপ তৈরি করে ও একেবারে গেটের মুখে এসে আছড়ে পড়ল। মাটিতে কয়েকবার পাক খাওয়ার পর ওর শরীরটা থামল।
সামনেই খোলা গেট। মুক্তি। এবারের মতো চ্যালেঞ্জ রাউন্ড শেষ। লাইভ টেলিকাস্ট শেষ।
জিশান উঠে দাঁড়াল। প্রায় টলতে-টলতে এগিয়ে গেল খোলা গেটের দিকে। এতক্ষণ ও যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। এখন ঘোর কাটতেই দুনিয়ার ক্লান্তি ওকে জড়িয়ে ধরল। একইসঙ্গে ক্ষতবিক্ষত শরীরের জ্বালা-পোড়া তীব্রভাবে টের পেল।
ও: ভগবান! চরম পরীক্ষার আগে আর কত পরীক্ষা দিতে হবে ওকে!
গেটের বাইরে মেডিক্যাল ইউনিটের লোকজন অপেক্ষা করছিল। তারা জিশানকে দেখামাত্রই ছুটে এল। অ্যালুমিনিয়াম আর পলিমারের তৈরি স্ট্রেচারে ওকে চটপট শুইয়ে দিল। তারপর ওকে নিয়ে ঢুকে পড়ল একটা ছোট দোতলা বাড়িতে।
বাড়িটার নাম ‘পোস্টগেম কেয়ার’। জিশান বুঝল, ব্যাপারটা অনেকটা নার্সিংহোম টাইপের। চ্যালেঞ্জ রাউন্ড শেষ হওয়ার পর প্রতিযোগীদের শুশ্রূষা এবং চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছে এরা।
স্ট্রেচারে চিত হয়ে শুয়ে এগিয়ে চলার সময় জিশান নার্সিংহোমের সাদা ধপধপে সিলিং আর দেওয়াল দেখতে লাগল। একইসঙ্গে ও মনোহরের কথা ভাবতে লাগল। মনোহর এখন কোথায়? কমব্যাট পার্কে, নাকি এই পোস্টগেম কেয়ার বিল্ডিং-এ?
জিশানকে একটা বড় এসি রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। ঘরটার সবক’টা দেওয়ালই কাচের। ধপধপে সাদা আলোয় ঝকঝক করছে। ঘরে প্রায় কুড়ি-বাইশটা বেড। তার কয়েকটায় পেশেন্ট শুয়ে আছে। মেডিকরা তাদের তদারকি করছে।
জিশানকে একটা বেডে শুইয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে-সঙ্গে দুজন ডাক্তার আর একজন সিস্টার ওকে ঘিরে ধরল। ওর যত্ন নিতে লাগল।
জিশানের তেমন মারাত্মক কোনও চোট ছিল না। তবে একজন ডাক্তার ওকে বলল যে, কোমোডোর কামড় খাওয়ার পর ইনফেকশানের হাত থেকে রেহাই পেতে একটা অ্যান্টিডোট সব কমপিটিটরকেই ইনজেক্ট করা হয়। ইনজেকশানটা নেওয়ার সময় একটু ব্যথা লাগবে। জিশান যেন কিছু মনে না করে।
হাসি পেয়ে গেল জিশানের।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ও একের-পর-এক মরণখেলা খেলে চলেছে। এইমাত্র ও ভয়ঙ্কর কোমোডো ড্রাগনের ধারালো দাঁতের আক্রমণ থেকে রেহাই পেয়ে প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছে। আর ইনজেকশানটা দেওয়ার সময় একটু ব্যথা লাগবে বলে আগেভাগেই ডাক্তার বিনীতভাবে ক্ষমা চাইছে! আশ্চর্য!
মিনিট-কুড়ি পরেই বেডে উঠে বসল জিশান। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে, তবে একটু ঘুম-ঘুম ভাব লেগে রয়েছে। হয়তো ডাক্তারদের দেওয়া ওষুধপত্রের জন্য, কিংবা ওই অ্যান্টিডোট ইনজেকশানের জন্য।
জিশান দেখল, ওকে নিয়ে ঘরে মোট পাঁচজন পেশেন্ট। তার মানে এই রাউন্ডটায় এই পাঁচজন কোয়ালিফাই করেছে। এরপর আর-একটা রাউন্ড। আর তারপরই পিট ফাইট।
হঠাৎই ঘরে ঢুকল দুজন ইনস্ট্রাকটর। জিশান তটস্থ হয়ে তাদের দিকে তাকাল। একজন ইনস্ট্রাকটর ল্যাপটপের বোতাম টিপে এলসিডি স্ক্রিনে ফুটে ওঠা লেখা দেখে বলতে লাগল, ‘এই রাউন্ডে কোয়ালিফাই করেছে পাঁচজন পার্টিসিপ্যান্ট। তাদের প্রত্যেকের জন্যে পুরস্কার পঞ্চাশহাজার টাকা। কনগ্র্যাচুলেশানস…। আর ফর ইয়োর ইনফরমেশান, বাকি ছ’জনের কয়েকজন মারা গেছে—আর কয়েকজন ইনডিসপোজড… মানে, অকেজো হয়ে গেছে।’
জিশান একটা ধাক্কা খেল। খবর পড়ার মতো নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে কী সহজেই না আহত-নিহতদের পরিসংখ্যানটা জানিয়ে দিল লোকটা! বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে পড়ল। জিশানরা ফেরার সময় পাঁচের বেশি ওকে গুনতে হবে না।
ইনস্ট্রাকটর তখন বিজয়ী পাঁচজনের নাম বলছিল। তারপর বলল, ‘থ্যাংক য়ু ফর ইয়োর পার্টিসিপেশান। উইশ য়ু অল দ্য বেস্ট। ঠিক আধঘণ্টা পর আমরা জিপিসি-র গেস্টহাউসের দিকে রওনা হব। য়ু প্লিজ গেট রেডি বাই দেন…।’ ইনস্ট্রাকটর দুজন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
জিশান ইনস্ট্রাকটরের শেষদিকের কথাগুলো আর শুনছিল না। ও বেডে শুয়ে থাকা অন্য চারজন পেশেন্টের দিকে দেখছিল। কোথায় মনোহর? কারণ, ইনস্ট্রাকটরের বলা পাঁচজনের নামের মধ্যে মনোহর সিং-এর নাম আছে।
হঠাৎই একটা বেডে একজন পেশেন্ট সোজা হয়ে বসল। জিশানকে লক্ষ করে ডেকে উঠল, ‘এ জিশান ভাইয়া!’
জিশান চমকে সেদিকে ফিরে তাকাল।
মনোহর সিং। মুখে একগাল হাসি। কালচে ছোপধরা দাঁত দেখা যাচ্ছে। একপায়ে হাঁটুর নীচে ব্যান্ডেজ।
জিশান বেড থেকে নেমে ওর কাছে এগিয়ে গেল। পায়ের ব্যান্ডেজের দিকে আঙুল দেখাতেই মনোহর উঠে বসল। কোমরের নীচে ইনজেকশানের জায়গাটা হাত দিয়ে ঘষতে-ঘষতে বলল, ‘একটা গিরগিটি আমার পায়ে কামড়ে দিয়েছে—।’
জিশান মনোহরকে দেখে খুব খুশি হয়েছিল। হেসে বলল, ‘গিরগিটি নয়—কোমোডো।’
‘ওই একই হল। সালা আমিও একটা গিরগিটিকে কামড়ে দিয়েছি…।’
জিশান আঁতকে উঠল। মনোহর বলে কী! একটা কোমোডো ড্রাগনকে ও কামড়ে দিয়েছে!
সে-কথা জিগ্যেস করতে মনোহর বলল, ‘হাঁ, জিশান ভাইয়া। আমার পায়ে কামড় দিয়ে জানোয়ারটা ছাড়ছিল না। তখন আমি লড়তে-লড়তে ওটার লেজে কামড় দিয়েছি। ও:, কী বাজে টেস্ট!’ নাক কুঁচকে ঘেন্নায় মাথা ঝাঁকাল মনোহর।
জিশান আবার হেসে ফেলল। তবে সেই হাসির মধ্যে কিছুটা দু:খ মেশানো ছিল। সুপারগেমস কর্পোরেশন কী চমৎকারভাবেই না মানুষকে ধীরে-ধীরে পালটে দিচ্ছে পশুতে! একটা মানুষ পশুর গায়ে কামড় বসিয়ে লড়াই করছে—পশুর মতো!
অন্যান্য বেডের বাকি তিনজন তখন বিছানায় উঠে বসেছে। নিজেদের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। পঞ্চাশহাজার টাকার প্রাইজ মানি কে কীভাবে খরচ করবে তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলছে।
সেদিকে একবার তাকিয়ে মনোহর সিং বলল, ‘জিশান ভাইয়া, তোমার তো মোট প্রাইজ মানি হল আশিহাজার টাকা। তুমি এই টাকাটা নিয়ে কী করবে ঠিক করেছ?’
জিশান বলল, আজ রাতে অন-লাইন নেটওয়ার্কে বোতাম টিপে বলে দেব টাকাটা আমার ওয়াইফের কাছে পাঠিয়ে দিতে। মিনি ঠিক করবে এই টাকা দিয়ে ও কী করবে। আমার তো এখান থেকে ফিরে যাওয়ার কোনও ঠিক নেই…বুঝতেই পারছ…।’
‘ফিরতে তোমাকে হবেই, জিশান ভাইয়া। তোমার বিবি-বাচ্চার সঙ্গে মিলতে হবে। ওরা ওয়েট করছে…।’
জিশানের মনটা পলকে উড়ে গেল ওল্ড সিটিতে। মিনি আর শানুর কাছে। ওদের কাছে যদি ও আর কখনও ফিরতে পারে তখন কি আর ও মানুষ থাকবে? ফিরে গিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্তটার কথা ভেবে ভয় পেল জিশান।
মনোহর তখন হাসিমুখে বলছে, ‘আমার টাকাটা নিয়ে কী করব সেটা আমিও ভেবে ফেলেছি।’
‘কী করবে?’
‘তিরিশহাজার আমি রাখব, আর বাকিটা আমার ভাতিজাকে দেব—।’
‘ভাতিজা?’ অবাক হয়ে বলল জিশান, ‘এই যে বলো, তোমার আগে-পিছে কেউ নেই!’
‘আগে ছিল না—এখন আছে।’ মুচকি হেসে বলল মনোহর, ‘একজন দাদা আছে, একজন ভাবী আছে, আর একজন ভাতিজা আছে।’
‘মানে?’
মনোহর ঝুঁকে পড়ে জিশানের হাত চেপে ধরল : ‘জিশান ভাইয়া, তুমি আমার দাদা আছ। আর শানু মেরা ভাতিজা। আমার আগে তো রিশতেদার কেউ ছিল না—এখন আছে। ওই পঞ্চাশহাজার টাকা আমি ভাতিজা শানুর জন্যে রাখব। তোমার কোনও ”না” শুনব না। তুমি আজ আমার ঘরের কম্পিউটার থেকে টাকাটা ট্রান্সফারের বেওস্থা করে দেবে। ওয়াদা?’
জিশানের চোখে জল এসে গিয়েছিল। ও চাপা গলায় বলল, ‘পাক্কা ওয়াদা।’
ও মনে-মনে চাইছিল, পিট ফাইটে কিছুতেই যেন ওকে মনোহরের মুখোমুখি না পড়তে হয়। যদি পড়ে, তা হলে জিশান লড়বে না—কিছুতেই না। তার জন্য শ্রীধর পাট্টা যে-শাস্তিই দিক জিশান মেনে নেবে। হোক সে রোলারবল, কিংবা প্রাইজ মানি আর লাইভ টেলিকাস্ট ছাড়া হাংরি ডলফিন কি ম্যানিম্যাল রেস—অথবা ডগ স্কোয়াড।
মনোহরের হাতে চাপ দিয়ে জিশান ধরা গলায় বলল, ‘আশ্চর্য, মনোহর, আমরা এখনও ইনসান আছি—পুরোপুরি জানবর হয়ে যাইনি।’
আর পাঁচ-দশমিনিটের মধ্যেই ইনস্ট্রাকটর দুজন ঘরে ঢুকে পড়ল। চেঁচিয়ে বলল, ‘ও. কে. গাইজ—লেটস গো।’
ওরা পাঁচজন চটপট লাইন দিয়ে দাঁড়াল। তারপর ঘর থেকে রওনা হল।
মনোহর জিশানের ঠিক সামনেই ছিল। সামান্য খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। ও জিশানের দিকে মুখ ফিরিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘বহত ভুখ লাগছে, জিশান ভাইয়া—।’
‘আমারও—। তবে চিন্তা নেই, গেস্টহাউসে গিয়েই মহাভোজ পেয়ে যাবে।’
‘এর পরের রাউন্ডের আগে আমাদের রেস্ট দেবে তো? আমার পায়ের যা অবস্থা…।’
‘নিশ্চয়ই দেবে। কিন্তু পরের রাউন্ডে কী গেম রেখেছে কে জানে!’
‘আমি শুনেছি, জিশান ভাইয়া। পরের রাউন্ডের গেমটার নাম ”স্নেক লেক”। তার পরে লাস্ট রাউন্ডের ”পিট ফাইট”…।’
‘স্নেক লেক?’
‘হ্যাঁ। জহরিলা সাপে কিলবিল করছে এমন একটা লেকের মধ্যে দিয়ে আমাদের ছুটতে হবে…।’
‘লেকের মধ্যে দিয়ে ছুটতে হবে মানে?’ জিশান অবাক হয়ে জানতে চাইল। লক্ষ করল, লাইনের বাকি তিনজন গলা বাড়িয়ে ওদের চাপা কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছে।
‘লেকে বেশি জল নেই। আধহাঁটু জল। আমি ফকিরচাঁদের কাছে শুনেছি। ওর ভাই আমিরচাঁদ স্নেক লেকে ছুটতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা গেছে…।’
জিশান আর কোনও কথা বলল না। আজকের কমব্যাট পার্ক রাউন্ডেও হয়তো দু-চারজন মারা গেছে। এই মৃতদেহগুলো কোথায় যায়? সিন্ডিকেট কি এই ডেডবডিগুলো সৎকার করার চেষ্টা করে?
হঠাৎই জিশানের মনে হল, এটা খুবই মামুলি প্রশ্ন। যারা নিয়মিত মনুষ্যত্বের সৎকার করে চলেছে তাদের কাছে ডেডবডির নিয়মিত বন্দোবস্ত করাটা কোনও ব্যাপারই নয়।
আজ রাতে মিনির সঙ্গে কথা বলবে জিশান। প্রাণভরে দশমিনিট ধরে কথা বলবে। বলবে, কীভাবে ও আজ জিতেছে। কীভাবে মানুষ থেকে জানোয়ারের দিকে আরও একধাপ এগিয়েছে। বলবে মনোহর সিং-এর কথাও।
পড়ন্ত বেলায় জিশানরা যখন লাইন করে হেঁটে ফিরছে তখন দেখল পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ডুবে যাচ্ছে।
জিশানের বুক থেকে একটা লম্বা নিশ্বাস বেরিয়ে এল। সূর্য ডুবে যাওয়ার ব্যাপারটা ওর ভালো লাগল না।
মাইক্রোভিডিয়োফোনে মিনির ছবি ভেসে উঠতেই জিশান কেমন যেন হয়ে গেল। ওর মনের ভেতর থেকে নিউ সিটির ছবি মিলিয়ে গেল পলকে। ও ভুলে গেল নিউ সিটির ‘সিটিজেন’-দের অফুরন্ত ভোগ আর আহ্লাদের কথা, সুপারগেমস কর্পোরেশনের বিপজ্জনক এবং হিংস্র খেলাগুলোর কথা, শ্রীধর পাট্টার কথা, এমনকী কিল গেম-এর কথাও।
ওর মন সিনেমার জাম্প কাটের মতো একলাফে পৌঁছে গেল ওল্ড সিটিতে—ওর সস্তা, ভাঙাচোরা, নোংরা ঘরে। ও মিনির গায়ের গন্ধ পেল। একইসঙ্গে নাকে এল ছোট্ট শানুর হিসি করে ভিজিয়ে দেওয়া প্যান্টের গন্ধও।
‘কেমন আছ, মিনি?’ ধরা গলায় জানতে চাইল জিশান।
‘যেমন থাকা যায়—তোমাকে ছেড়ে।’ মিনির চোখে জল এসে গেল।
‘শানু কেমন আছে? ওকে একবার দেখাও—।’
‘ও তো বাচ্চা, তাই আমার চেয়ে ভালো আছে। একমিনিট ওয়েট করো—ওকে নিয়ে আসছি—।’
একটু পরেই এমভিপিতে শানুকে দেখতে পেল জিশান। ছোট-ছোট জীবন্ত চকচকে চোখ, মুখে হিজিবিজি শব্দের টুকরো, বারবার এমভিপির স্ক্রিনের দিকে থাবা বাড়াচ্ছে।
জিশানের মুখে খুশির ছোঁয়া লাগল। ও অর্থহীন ভাষায় ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল।
শানুকে রেখে এল মিনি। চোখ নামিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না…।’
জিশান বলল, ‘মন খারাপ কোরো না। আমি তো এখানে লড়াই করছি…তোমাকেও ওখানে লড়াই করতে হবে।’ কথা বলতে-বলতে চোখ মুছল জিশান: ‘আজ আমাদের কমব্যাট পার্কে সারপ্রাইজ রাউন্ড ছিল। আমরা পাঁচজন জিতেছি—পঞ্চাশহাজার টাকা করে…।’
‘হ্যাঁ—প্লেট টিভিতে দেখেছি। জন্তুগুলো যা বীভৎস দেখতে—উফ, ভাবা যায় না।’ মিনি শিউরে উঠল।
‘মনোহরভাইয়াও জিতেছে। ও ওর প্রাইজ মানি শানুকে গিফট করবে। আমার কোনও বারণ শুনছে না।’ বলে মনোহরের সঙ্গে আজ পোস্টগেম কেয়ার বিল্ডিং-এ যা-যা কথা হয়েছে সব জানাল।
জিশানের কাছে মনোহর সিং-এর কথা আগে শুনেছে মিনি। এখন এইসব কথা শোনার পর ওর ঠোঁটে একচিলতে হাসির রেখা ফুটল। ও নরম গলায় বলল, ‘জিশান, সিন্ডিকেট দেখছি এখনও তোমাদের পুরোপুরি অমানুষ করতে পারেনি! যার তিনকুলে কেউ নেই—মনোহরদা—তার মধ্যেও দ্যাখো, এখনও কেমন স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা রয়েছে।’
বরাদ্দ দশমিনিট সময় ক্রমশ কমে যাচ্ছিল। জিশান আজকের সারাদিনের গল্প শোনাতে লাগল মিনিকে। শোনাল ছোট্ট মেয়েটার কথা—যে জিশানদের হাসিমুখে ‘টা-টা’ করছিল। জিশান বলল, এর পরের রাউন্ডে স্নেক লেক। আর তারপর পিট ফাইট। ও ইচ্ছে করেই জাব্বার কথা চেপে গেল। এখন ওসব শঙ্কা-আশঙ্কার কথা মিনিকে বলে ওর দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। যখন মিনি ওসব গেম-এর লাইভ টেলিকাস্ট দেখবে তখন যা দেখার দেখবে।
বাড়ির খবর নেওয়া ছাড়াও পাড়াপড়শিদের খবর নিল জিশান। তারপর দশমিনিটের কোটা শেষ হয়ে আসছে দেখে তাড়াতাড়ি কথা শেষ করতে চাইল।
মিনির চোখে জলের ফোঁটা। সেই অবস্থাতেই পুরোনো কথাটা আবার বলল।
‘জিততে তোমাকে হবেই। এখানে আমরা সবাই খুব আশা করে আছি। তবে শুধু জেতা নয়—তুমি জিতলে এই জঘন্য ব্যাপারটা একেবারে বন্ধ করার ব্যবস্থাও করতে হবে তোমাকে। তোমাকেই।’
‘পারব কি না জানি না—তবে চেষ্টা তো একবার করবই।’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল জিশান। ওর মালিকের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল শিবপদর কথা। কষ্ট করে ঢোঁক গিলল দুবার। তারপর নিচু গলায় মিনিকে বলল, ‘এবার আসি। কাল কথা বলব আবার। লাভ য়ু…।’
মিনির সঙ্গে কথা শেষ হলে চুপচাপ বিছানায় বসে রইল জিশান। ও চোখ বুজে ভাবতে চাইল যে, ও ওল্ড সিটিতে নিজের ঘরে মিনি আর শানুর কাছে বসে আছে। কিন্তু কয়েকসেকেন্ড পরেই কল্পনার ছবিটা নড়েচড়ে ঘেঁটে গেল। ওর মাথার মধ্যে পরের রাউন্ডের বিপজ্জনক গেমগুলোর কথা ঘুরতে লাগল। সঙ্গে-সঙ্গে মুখে একটা বিরক্তির শব্দ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল জিশান। সামনের ছোট টেবিলে পড়ে থাকা গোল বলের মতো চেহারার রিমোট ইউনিটটা তুলে নিল। বোতাম টিপে ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিল। এখন ওর অন্ধকারে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করছে।
ডিজিটাল ঘড়ির দিকে চোখ গেল জিশানের। রাত বারোটা দশ। অন্ধকার ঘড়িতে শুধু ডিজিটাল অক্ষরগুলো জ্বলজ্বল করছে—পাশে উজ্জ্বল নকল চাঁদের ছবি।
জিশানের আসল চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করল। ও উঠে চলে বারান্দায়। রেলিং-এ হাত রেখে আকাশের দিকে তাকাল। প্রাণপণে অস্থির মনটাকে শান্ত করতে চাইল।
কালো আকাশময় ছোট-ছোট তারার ছিটে। মিটমিট করে জ্বলছে। সেই পটভূমিতে তুলির টান দিয়েছে লাল এবং নীল ধূমকেতুর আলো।
হঠাৎই একটা শুটারের আলো চোখে পড়ল জিশানের। ওটার হেডলাইটের তীব্র সাদা বর্শা সামনের অন্ধকারকে চিরে দিয়ে ছুটে চলেছে। আবছা শিসের শব্দ জিশানের কানে আসছে। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
একই আকাশ ছেয়ে আছে ওল্ড সিটিকে। অথচ আকাশের নীচের ছবিটা কী বিশ্রীভাবে দুরকম। ওল্ড সিটিতে অভাবের অভাব নেই, আর নিউ সিটিতে অভাব খুঁজে পাওয়াই মুশকিল।
কিন্তু অভাব নেই বলেই কি নিউ সিটির স্বভাব বিগড়ে গেছে? অবাক হয়ে ভাবল জিশান। ওর মনে হল, সব মানুষের জীবনেই কিছুটা অভাব জড়িয়ে থাকা ভালো। তা হলে স্বভাবটা বোধহয় আর ততটা খারাপ হবে না।
হঠাৎই একটা চাপা কান্নার শব্দ কানে এল জিশানের।
বহুদূর থেকে ভেসে আসা শব্দটা শুনে মানুষের কান্না বলেই মনে হল। কিন্তু কে কাঁদছে এত রাতে?
বারান্দার রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে নীচের দিকে তাকাল জিশান। জিপিসি-র গেস্টহাউসের চারপাশটা আলোয় আলো। কিন্তু উনতিরিশ তলার উচ্চতা থেকে নীচের চাতালে কাউকে নজর করাটা সহজ নয়। তবুও কালো ফুটকির মতো একটা মানুষের মাথা দেখতে পেল। কান্নাটা বোধহয় সেদিক থেকেই আসছে।
জিশানের মনে হল, অস্থির মনটাকে শান্ত করতে কোনও একটা কাজ নিয়ে মেতে ওঠা দরকার। কারণ, এখন ওর মনের যা অবস্থা তাতে বিছানায় গিয়ে শুলেও ঘুম আসবে না। তাই কান্নার শব্দটা তলিয়ে দেখাটাকেই ও ‘কাজ’ হিসেবে বেছে নিল।
ঘরে এসে পোশাক পালটে নিল জিশান। একটা বাদামি রঙের টি-শার্ট আর নীল জিনসের প্যান্ট পরে নিল। মাথার চুলে দুবার চিরুনি চালাল। তারপর সোজা ঘরের বাইরে এসে পা বাড়াল অটো-এলিভেটরের দিকে।
শুনশান করিডর। সামনে-পিছনে তাকালে কাউকে চোখে পড়ে না। শুধু পিস ফোর্সের দুজন গার্ড করিডরের দুটো বাঁকের মুখে বসে আছে। হঠাৎ করে দেখলে ওদের পাথরের মূর্তি বলে ভুল হতে পারে।
জিশানকে দেখে ওরা একচুলও নড়ল না। তাতে জিশান অবাক হল না। কারণ, ওর রেজিস্ট্রেশান কিটের ভেতরে জিপিসি-র ‘রুলস অ্যান্ড রেগুলেশানস’-এর একটা বই ছিল। তাতে ইংরেজি, হিন্দি এবং বাংলায় গেমস পার্টিসিপ্যান্টস ক্যাম্পাসের সবরকম নিয়মকানুন লেখা ছিল। জিশান সেগুলো পড়ে দেখেছে। তাতে বলা আছে, ডেইলি রুটিনের মধ্যে যে-সময়টা প্রতিযোগীর নিজের—মানে, যখন তার অবসর সময়—তখন সে ক্যাম্পাসের মধ্যে যখন খুশি যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে। তবে জিপিসি-র কোনও নিয়ম ভাঙা যাবে না।
হাসি পেয়ে গেল জিশানের। খাঁচার মধ্যে স্বাধীনতা!
সত্যি, সুপারগেমস কর্পোরেশনের কাজকর্ম এত নিখুঁত যে, যেসব প্রতিযোগী লেখাপড়া জানে না, তাদের জন্য ওরা মাইনে করা লোক রেখেছে। তারা নিয়মিত রুলস অ্যান্ড রেগুলেশানস-এর ক্লাস নেয়। জিপিসি-র নিয়মকানুনের প্রতিটি ধারা বুঝিয়ে দেয়। প্রতিযোগীরা ইচ্ছে করলে সেই ক্লাস করতে পারে। ফলে কোনও প্রতিযোগীই কোনও ‘বেআইনি’ কাজ করে বলতে পারবে না যে, সে নিয়ম জানত না। শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
অটো-এলিভেটরে ঢুকে পড়ল জিশান। সেখানেও পিস ফোর্সের একজন গার্ড বসে আছে—হাতে নীল রঙের শকার।
গার্ডটা ঝিমোচ্ছিল। জিশান ঢুকতেই নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। ঠোঁটের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়া লালা মুছে নিল। শকারের হাতলে হাত রেখে জিশানের দিকে সতর্ক নজরে তাকিয়ে রইল—কিন্তু কোনও কথা বলল না।
জিশান বোতাম টিপতেই এলিভেটর নীচে নামতে শুরু করল।
একটু পরেই গেস্টহাউসের সদর দরজায় পৌঁছে গেল ও। কাঠের ফ্রেমে লোহার গ্রিল আর বুলেটপ্রুফ কাচ দিয়ে তৈরি বিশাল শৌখিন দরজা। পকেট থেকে স্মার্ট কার্ড বের করে দরজার ফ্রেমের পাশে বসানো যন্ত্রে সোয়াইপ করল জিশান। ‘বিপ’ শব্দ হল। একটা সবুজ এল. ই. ডি. বাতি জ্বলে উঠল। তারপর হাতের চাপ দিতেই দরজার পাল্লা খুলে গেল। এবং কান্নার শব্দটা জোরালোভাবে শোনা গেল।
শীতাতপের এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরোতেই প্রকৃতির উষ্ণ বাতাস জিশানকে জড়িয়ে ধরল। বাতাসে একটা অদ্ভুত গন্ধ পেল জিশান। বোধহয় রাত-ফুলের গন্ধ।
বিল্ডিং-এর বাইরে সাদা মার্বেল বাঁধানো চাতাল। ভেপার ল্যাম্পের আলোয় ঝকঝক করছে। চাতালের দুপাশে সুন্দর বাগান আর ঘাসে ছাওয়া লন। আর মাঝখানে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু এক বিমূর্ত ভাস্কর্য। তাকে ঘিরে লাল-নীল-হলদে-সবুজ রঙিন জলের ফোয়ারা।
ফোয়ারার রঙিন জলের ধারা এসে পড়ছে পাদদেশের জলাশয়ে। সেখানে সব রং মিলেমিশে তৈরি হয়েছে এক বিচিত্র গাঢ় রঙের জল।
জলাশয়ের চারদিকে প্রায় দু-ফুট উঁচু মার্বেল পাথরের পাঁচিল। পাঁচিলের গায়ে নানান কারুকাজ করা, আর তাকে ঘিরে ছোট-ছোট মার্বেল পাথরের টবে সুন্দর-সুন্দর গাছ।
কিন্তু জিশান এসব ভালো করে দেখছিল না। ও তাকিয়ে ছিল জলাশয়ের পাঁচিলের ওপরে ভিজে ন্যাকড়ার মতো শিথিলভাবে শুয়ে থাকা লোকটার দিকে।
লোকটা উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। গায়ে নীল হাফশার্ট আর ছাই রঙের প্যান্ট। পায়ের চটি খসে পড়ে আছে মার্বেল পাথরের মেঝেতে। ওর একটা হাত জলাশয়ের জলের ভেতরে ডোবানো, অন্য হাতটা পাঁচিলের এপাশে ঝুলছে। দেখে হঠাৎ করে মনে হতে পারে ও আর বেঁচে নেই। কিন্তু কান্নার আওয়াজটা জানিয়ে দিচ্ছে ও বেঁচে আছে—অন্তত এখনও।
এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে পিস ফোর্সের দুজন গার্ডকে দেখতে পেল জিশান। ওরা টান-টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে শকার ঝুলছে। ওদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল না যে, সামনে পড়ে থাকা মানুষটার অস্তিত্ব ওরা টের পাচ্ছে।
জিশান গার্ড দুটোর দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ফোয়ারার কাছে এগিয়ে গেল। দুটো টবের মাঝে দাঁড়িয়ে লোকটার শরীরটাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করল।
জিশানের হাতের ছোঁয়া পেয়েই লোকটা কান্না থামিয়ে চট করে উঠে বসল। ঘুরে তাকাল জিশানের দিকে—চোখেমুখে লড়াকু ছাপ। কিন্তু জিশানকে দেখেই ওর ভাবভঙ্গি নরম হল। ‘ও—’ বলে জলাশয়ের পাড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে অবসন্নভাবে বসে রইল। ওর গলা দিয়ে কান্নার মিহি গোঙানি বেরিয়ে আসতে লাগল। শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল।
লোকটাকে ভালো করে দেখল জিশান।
লম্বাটে মুখ। পোড়খাওয়া তামাটে রং। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। ছোট কিন্তু চওড়া ভুরু। চোখ দুটো নরম—ভালোবাসার কবিতার মতো। সেই চোখে জল।
লোকটার মুখে আলোছায়ার খেলা। চোখের দৃষ্টি বিভ্রান্ত।
‘তুমি কাঁদছ কেন?’ লোকটার পিঠে হাত রেখে জিশান জিগ্যেস করল।
লোকটা কোনও উত্তর দিল না। এমনকী জিশানের দিকে তাকাল না পর্যন্ত।
জিশান আবার জিগ্যেস করল, ‘কী হয়েছে?’
লোকটা এবার কান্না থামাল। দু-হাতে চোখ মুছে জিশানের দিকে তাকাল। ওর চোখে লালচে আভা, চোখের কোল ফোলা। ভাঙা গলায় পালটা প্রশ্ন করল, ‘তোমাকে বলে কী ফায়দা?’
জিশান ওর পাশে বসে পড়ল। বলল, ‘তেমন লাভ কিছু হবে কি না জানি না, তবে তোমার দু:খ একটু কমতেও পারে…।’
‘হুঁ:!’ বলে তাচ্ছিল্যের একটা শব্দ করল লোকটা : ‘দু:খ কমলেও আমার ভাই তো আর ফিরবে না…।’
‘তোমার ভাইয়ের কী হয়েছে?’
‘ও মারা গেছে। ”স্নেক লেক” গেমটায় নাম দিয়েছিল। সাপের কামড়ে মারা গেছে—।’
‘কবে?’
‘আটদিন আগে। দুটো সাপ পায়ে কামড়েছিল।’ আবার ফুঁপিয়ে উঠল লোকটা। হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নিল : ‘…আসলে ও রেসটা শেষ করেছিল। সেকেন্ড হয়েছিল। তখনও বুঝতে পারেনি ওকে সাপে কেটেছে। কয়েকমিনিট পর ছটফট করতে-করতে পড়ে গেল। এদের ডাক্তার নার্স আসতে-আসতেই সব শেষ। ভাইয়া চলে গেল…আমাকে ছেড়ে চলে গেল….।’
জিশান একটু অবাক হল। আটদিন আগে যে-ভাই মারা গেছে তার জন্য লোকটা আজ হাপুস নয়নে কাঁদছে! সবাই জানে, সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেম শো-তে নাম দিলে সাধারণত প্রাণের ঝুঁকি থাকে। ফলে প্রিয়জন হারানোর শোকটা কখনও আচমকা আসে না—তার একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকে। তার ওপর দু:খের ঘটনাটা ঘটেছে আটদিন আগে। তাই কোথায় যেন একটা খটকা লাগছিল জিশানের।
ও লোকটাকে বলল, ‘চলো ভাই, আমরা মেন গেটের কাছে যাই। ওখানে ঘাসের ওপরে বসে একটু গল্প করি। আমিও এখানকার গেম-এ নাম দিয়েছি। টেনশানে ঘুম আসছিল না। তোমার কান্না শুনে নীচে নেমে এলাম। চলো…দু:খ তো লাইফে থাকবেই…।’ কথা বলতে-বলতে জিশান উঠে দাঁড়াল।
লোকটা জিশানের দিকে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে। দু-হাতে ঘষে-ঘষে চোখ মুছল। ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল।
ওরা পাশাপাশি পা ফেলে মেন গেটের দিকে এগিয়ে চলল। জিশান লোকটাকে নিজের কথা বলতে লাগল। বলল, কীভাবে ও নিউ সিটিতে এসে পৌঁছেছে। কীভাবে ব্ল্যাকমেল করে ওকে কিল গেম-এ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নিজের কাহিনি শেষ করে জিশান জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
লোকটা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘ফকিরচাঁদ।’
জিশানের মনে পড়ল মনোহরের কথা। আজ বিকেলে ‘কমব্যাট পার্ক’ থেকে ফেরার সময় মনোহর তা হলে এর কথাই বলছিল!
মেন গেটের দুপাশে সবুজ লন। একটু দূরে সুন্দর জ্যামিতিক কায়দায় সাজানো ঝাউগাছ আর পামগাছ।
এদিকটায় আলো কম। তাই অনেকটা যেন খোলামেলা পার্কের কোমল আবহাওয়া। সবুজ ঘাসের মোলায়েম আসনে বসে জিশানের মনেই হল না ও আর ফকিরচাঁদ আসলে নিউ সিটির ‘বন্দি’।
ওরা দুজনে কথা বলতে লাগল।
জিশান লক্ষ করল, মেন গেটের বাইরে দুজন গার্ড পাহারা দিচ্ছে। ওরা জিশানদের দিকে একপলক তাকিয়েই নজর সরিয়ে নিল। মেন গেটের বাইরে না আসা পর্যন্ত ওদের কাছে জিশানদের কোনও গুরুত্ব নেই।
বুক ভরে বাতাসের গন্ধ নিচ্ছিল জিশান। রাতের প্রকৃতিকে দু-চোখ ভরে দেখছিল।
ফকিরচাঁদ ওর ভাই আমিরচাঁদের কথা বলছিল।
অভাবের তাড়নায় খারাপ পথে চলে গিয়েছিল আমির। বুড়ো মা-বাপ আর ছোটবোন জেবার কষ্ট সইতে না পেরে ও নিয়মিত চুরি-ছিনতাই করতে শুরু করেছিল। তারপর একদিন দু-চারজন বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ‘স্নেক লেক’-এ নাম দেয়।
ছোটভাইকে দারুণ ভালোবাসত ফকির। তাই ভাইয়ের দেখাদেখি ও-ও নাম দেয় ‘হাংরি ডলফিন’ গেম-এ। ওরা দু-ভাই একসঙ্গে এই নিউ সিটিতে আসে। কম্পিটিশানের দুটো রাউন্ডে পরপর জিতেও যায় দুজনে। তারপর…তারপর আসে আমিরচাঁদের গেম-এর পালা : স্নেক লেক।
বাঁ-হাতে ঘাসের ওপরে হাত বোলাচ্ছিল ফকিরচাঁদ। কথা বলতে-বলতে কখন যেন ওর গলা ভারি হয়ে গিয়েছিল।
এতক্ষণ ধরে না-করা প্রশ্নটা এইবার উচ্চারণ করল জিশান : ‘…আটদিন আগে ভাই মারা গেছে…সেজন্যে আজও তুমি কাঁদছ?’
জিশানের দিকে মুখ ফেরাল ফকিরচাঁদ। কয়েকসেকেন্ড অপলকে তাকিয়ে রইল। তারপর ডানহাতে মাথার চুলে আঙুল চালাল। থেমে-থেমে বলল, ‘আমি কাঁদছি আমিরের ডেডবডির জন্যে, জিশানভাইয়া…।’
‘ডেডবডির জন্যে?’ অবাক হয়ে গেল জিশান।
‘হ্যাঁ, জিশানভাইয়া। অনেক চেষ্টা করে দুজন সিকিওরিটি গার্ডকে প্রাইজ মানির টাকা থেকে ঘুষ দিয়ে ভাইকে দেখার একটা বন্দোবস্ত করেছিলাম…।’ ওরা চোখে পটি বেঁধে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে…ভাইয়ের কাছে…।’
‘তার মানে? তোমার ভাই তো মারা গেছে—।’
‘হ্যাঁ—মারা গেছে। কিন্তু মারা যাওয়ার পর তো ভাইকে আর আমি দেখিনি—।’
আঙুল দিয়ে চোখের কোণ মুছল ফকিরচাঁদ : ‘তাই মরা ভাইকে ফুল দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু…কিন্তু সেই…সেই কবরস্তানে গিয়ে…যা দেখলাম তাতে মনটা ভেঙে গেল। আমিরচাঁদ যে এত বদনসিব ছিল বুঝতে পারিনি। সে-কথা মনে পড়লেই আমার কান্না পায়।’
হঠাৎই কোথা থেকে দুজন গার্ড এসে হাজির হল জিশানদের সামনে। একজন লম্বা, একজন বেঁটে। লম্বা গার্ডটা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘অর্ডার এসেছে। তোমরা যার-যার রুমে চলে যাও। এখুনি।’
জিশান হকচকিয়ে গেল। তা হলে কি পার্টিসিপ্যান্টদের অসময়ে কথাবার্তা বলার সময় বাঁধা আছে? নাকি ওরা কোনও ওপরওয়ালার নজরে পড়ে যাওয়ায় এই দুজন গার্ডের কাছে ‘অর্ডার’ এসেছে?
জিশান আর ফকিরচাঁদ উঠে দাঁড়াল। জিশান দেখল গার্ড দুজনের দিকে। ভাবলেশহীন পাথরের মুখ। দেখে মনে হয় যন্ত্রেরও অধম। কিন্তু খেলার মাঠে আলাপ হওয়া নাহাইতলার সেই গার্ড বলেছিল, ‘…এরা সবকিছু পয়সা দিয়ে মাপে।’ তা হলে জিশান কি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে? ওর হাতে আছে প্রাইজ মানির আশিহাজার টাকা। এ ছাড়া মনোহরের কবুল করা গিফট পঞ্চাশহাজার টাকা।
টাকা খরচ হয় হোক, জিশান ওই কবরস্থানটা একবার দেখতে চায়। আজই না জিশান ভাবছিল, কম্পিটিশানে ‘খরচ’ হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে নিয়ে সিন্ডিকেট কী করে? সেটা নিজের চোখে একবার দেখা যায় না?
লম্বা গার্ডটা ফকিরচাঁদকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। ভাঙাচোরা মানুষটা চাপা গলায় কাঁদতে-কাঁদতে চলে গেল।
জিশান আর দেরি করল না। বেঁটে মতন গার্ডটাকে বলল, ‘ভাই, কবরস্থানটা আমাকে একবার দেখাতে পারো? আমার কাছে প্রাইজ মানির অনেক টাকা আছে। কাল তোমাকে তার থেকে দশ হাজার টাকা দেব…।’
গার্ডটা জিশানের কবজি ধরতে যাচ্ছিল—থমকে গেল। নিচু গলায় জিগ্যেস করল, ‘কী বললে? দশহাজার?’
জিশান ওর চোখে লোভের ঝিলিক দেখতে পেল। একইসঙ্গে ওর মুখ থেকে মদের গন্ধ পেল। তাই ঝুঁকি নিয়ে ওর দু-হাত চেপে ধরল। অনুনয় করে বলল, ‘ভাই, একটিবারের জন্যে কবরস্থানটা আমাকে দেখাও। দশহাজার দেব। কাউকে বলব না। প্লিজ…।’
গার্ডটা এদিক-ওদিক তাকাল। ওর মুখ দেখে বোঝা গেল ওর ভেতরে লোভের সঙ্গে ভয়ের লড়াই চলছে। শ্রীধর পাট্টাকে সবাই যমের চেয়েও বেশি ভয় পায়।
কয়েকবার ঢোঁক গিলল গার্ডটা। তারপর বলল, ‘না, না—উইদাউট পারমিশানে ওখানে যাওয়াটা খুব রিসকি। তার চেয়ে আমি একটা সাজেশান দিই। তুমি যদি ওই দশহাজার টাকাটা দাও তা হলে পারমিশান করিয়ে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে জান লড়িয়ে দেব…।’
চোখে প্রশ্ন নিয়ে জিশানের দিকে চেয়ে রইল প্রহরী। জিশান এই প্রস্তাবে রাজি হলে তবেই ও পরের ধাপে এগোবে।
দু-চারসেকেন্ডের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল জিশান। বলল, ‘তাই হবে। আজ রাতে যদি কবরস্থানটা আমাকে দেখাও তা হলে কাল ক্যাশ দশহাজার টাকা তুলে তোমাকে দিয়ে দেব—।’
তখনই জিশান দেখল, ফকিরচাঁদকে পৌঁছে দিয়ে দ্বিতীয় গার্ডটা ফিরে আসছে।
প্রথম গার্ড সঙ্গে-সঙ্গে চলে গেল সঙ্গীর কাছে। দুজনে মিলে কিছুক্ষণ কীসব আলোচনা করল। তারপর প্রথমজন জিশানের কাছে এসে বলল, ‘তোমার পার্টিসিপ্যান্ট আই-ডি নাম্বারটা বলো—।’
জিশান বলল।
পকেট থেকে ছোট ওয়্যারলেস সেট মতন কী একটা যন্ত্র বের করে নম্বরটা স্টোর করে নিল গার্ড। তারপর হাতের ইশারা করে বলল, ‘তুমি এখানে ওয়েট করো। আমরা পারমিশানের ব্যাপারটা ট্রাই করতে যাচ্ছি। আমাদের ইন-চার্জকে এ-কথা বলব যে, তোমার এক বন্ধুর কবরে তুমি ফুল দিতে যাবে। যদি পারমিশান পেয়ে যাই তা হলে আমরা জেনারেল স্টোর থেকে সাদা ফুল নিয়ে আসব। চিন্তা কোরো না…আমরা কুড়িমিনিট কি বড়জোর আধঘণ্টার মধ্যে আসছি। তুমি ওয়েট করো। অন্য কোনও গার্ড কিছু জিগ্যেস করলে বলবে, তোমার এখানে ওয়েট করার অর্ডার আছে। ও.কে.?’
জিশান সায় দিয়ে মাথা নাড়ল।
সঙ্গে-সঙ্গে গার্ডটা চলে গেল তার সঙ্গীর কাছে। তারপর নিজেদের মধ্যে কথা বলতে-বলতে ঢুকে পড়ল গেস্টহাউস বিল্ডিং-এর ভেতরে।
জিশান চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ওর মনে হল, ফকিরচাঁদকেও সঙ্গে নিলে হত—যদি অবশ্য অনুমতি পাওয়া যায়।
মিনিটকুড়ি কি পঁচিশ পর গার্ড দুজন ফিরে এল। ওদের ঠোঁটের হাসি দেখেই জিশান বুঝল, অনুমতি মিলেছে। সেই ধারণাটা নিশ্চিত হল একজনের হাতে একটা সাদা ফুলের তোড়া দেখে।
প্রথমজন নিচু গলায় জিশানকে বলল, ‘পারমিশান পাওয়া গেছে। মেন গেট খোলার অথরাইজড স্মার্ট কার্ড দিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া একটা কিউ-মোবাইল-এরও ব্যবস্থা করা গেছে। আমাদের সময় দিয়েছে একঘণ্টা।’ হাতঘড়ি দেখল : ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেন গেটে একটা কিউ-মোবাইল এসে দাঁড়িয়ে যাবে—।’
দ্বিতীয় গার্ড ফুলের তোড়াটা জিশানের হাতে দিয়ে বলল, ‘দশহাজার টাকাটা কাল মনে করে দিয়ো কিন্তু। চাইতে যেন না হয়।’
জিশান বলল, ‘দেব। চাইতে হবে না। তবে একটা রিকোয়েস্ট আছে…।’
‘আবার কী রিকোয়েস্ট?’ রুক্ষভাবে জানতে চাইল দ্বিতীয়।
‘ফকিরচাঁদকে নিয়ে এসো। ওকে আমার সঙ্গে নেব। ও ওর মরা ভাইকে যদি দেখতে চায়…।’
গার্ড দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর ওরা ফকিরচাঁদকে সঙ্গে নেওয়া অনেক ঝামেলার বলে জিশানের সঙ্গে রীতিমতো তর্ক জুড়ে দিল। কিন্তু জিশান গোঁ ধরে রইল। এ-কথাও শুনিয়ে দিল যে, দশহাজার টাকা নেহাত কম নয়।
প্রায় পাঁচমিনিট তর্ক-বিতর্কে খরচ হওয়ার পর ওরা নিমরাজি হল। একজন গার্ড জিশানের কাছে দাঁড়িয়ে রইল, আর-একজন গেল ফকিরচাঁদকে নিয়ে আসতে।
ফকিরচাঁদ এলে ওরা চারজন মেন গেটের দিকে হাঁটা দিল। ফকিরচাঁদকে দেখে ক্লান্ত অবসন্ন মনে হল। ওর হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল ও নেশা করেছে। ও ক্লান্ত গলায় বিড়বিড় করে বলছিল, ‘আমিরের ওই ডেডবডি আমি আর দেখতে চাই না…দেখতে চাই না…।’
কেন এই ডেডবডি দেখার আতঙ্ক জিশান বুঝতে পারল না। তা ছাড়া, এতদিন পরও ডেডবডি দেখবে কেমন করে?
মেন গেটে পৌঁছে একজন গার্ড স্লটে স্মার্ট কার্ড সোয়াইপ করল। যন্ত্রে ‘বিপ’ শব্দ হল। সবুজ বাতি জ্বলে উঠল। হাতের চাপ দিতেই কম্পাউন্ডের গেট খুলে গেল। জিশানরা বেরিয়ে এল গেস্টহাউস বিল্ডিং-এর বাইরে।