Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট || Anish Deb » Page 17

তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট || Anish Deb

হঠাৎই মোবাইল ফোন বেজে উঠল। চমকে উঠল সুখারাম।

তাড়াতাড়ি উঠে বসল। থলের ভেতরে হাতড়ে মোবাইল ফোনটা বের করে নম্বরটা দেখল।

মা ফোন করেছে।

‘অ্যাকসেপ্ট’ বোতাম টিপে ‘হ্যালো’ বলতেই চোলির গলা শুনতে পেল।

‘দাদাভাই!’

‘হ্যাঁ—বল।’ চাপা গলায় বলল সুখারাম।

‘তুই ঠিক আছিস তো?’

‘হ্যাঁ, ঠিক আছি। কিন্তু ফর নাথিং আমাকে ফোন করিস না। বিপদ হবে—।’

‘মা ফোন করতে বলল। বলতে ভুলে গেছি…থলের মধ্যে ছ’টা রুটি, একটু আলুভাজা আর চিনি আছে—খেয়ে নিস। তার সঙ্গে দুটো জলের বোতলও আমি দিয়ে দিয়েছি…।’

অবাক হয়ে গেল সুখারাম। চোখে জল এসে গেল। এত তাড়াহুড়ো আর টেনশানের মধ্যেও মা ওর রাতের খাবারটা গুছিয়ে দিতে ভোলেনি!

হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছল। চোলিকে বলল, ‘হ্যাঁ, খেয়ে নেব। তোরা চিন্তা করিস না…।’

‘তুই সাবধানে থাকিস, দাদাভাই…।’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল চোলি। তারপর কান্না-কান্না গলায় বলল, ‘যেখানেই থাকিস না কেন…।’

‘তোরাও সাবধানে থাকিস। রাখছি—।’

ফোন কেটে দিল সুখারাম।

আর ঠিক তখনই দূরে তিনটে হেডলাইটের আলো দেখতে পেল। সঙ্গে সাইলেন্সারের ফটফট শব্দ শোনা গেল।

এবড়োখেবড়ো রাস্তায় লাফাতে-লাফাতে তিনটে মোটরবাইক এগিয়ে আসছে। রাস্তার নানান গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির জলে হেডলাইটগুলোর ছায়া থেকে-থেকেই ঝলসে উঠছে। তিনটে আলো সংখ্যায় চারটে, পাঁচটা কিংবা ছ’টা হয়ে যাচ্ছে।

সুখারাম নস্করের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল।

বদনোয়ার দল নিশ্চয়ই খবর পেয়েছে, সুখারাম ওর ঝুপড়িতে নেই। তাই ওরা মোটরবাইকে করে সব রাস্তায় টহল দিতে বেরিয়েছে। খ্যাপা নেকড়ের মতো সুখারামকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

ভয়ে সুখারামের মুখ শুকিয়ে গেল। ভীষণ জল তেষ্টা পেল ওর। ঝটপট সাইকেল ভ্যান থেকে নেমে লোহালক্কড়ের স্তূপের আড়ালে চলে গেল। বোতাম টিপে মোবাইল ফোনটা সুইচ অফ করে দিল। নইলে ফোনটা আচমকা বেজে উঠলেই সর্বনাশ।

জং ধরা লোহালক্কড়ের গায়ে গা ঠেকিয়ে দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল সুখারাম।

মোটরবাইকের আলোগুলো নাচতে-নাচতে ওর দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছিল।

সুখারাম ভয় পেল। না, শুধু এভাবে লুকিয়ে থাকলে চলবে না,—আরও কিছু করতে হবে। কারণ, ওর পায়ে রানিং শু, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, আর হাফপ্যান্ট। এগুলো ওর মাঠের পোশাক। এগুলো দেখলেই ওরা চিনে ফেলতে পারে।

সঙ্গে-সঙ্গে মোবাইল ফোনটা লোহালক্কড়ের খাঁজে গুঁজে দিল সুখা।

চটপট পায়ের জুতো খুলে ফেলল। জুতো জোড়া ছুড়ে দিল গাঢ় অন্ধকারের দিকে। একটানে খুলে ফেলল স্যান্ডো গেঞ্জি। ওটা তালগোল পাকিয়ে রাস্তার গর্তে জমে থাকা জলে ডুবিয়ে দিল। তারপর হাফপ্যান্টটার বোতাম খুলে কোমরের খানিকটা নীচে টেনে নামিয়ে দিল। এবং উপুড় হয়ে শুয়ে পড়াল নোংরা রাস্তায়। ঠিক যেন চালচুলোহীন কোনও ভবঘুরে পথে মদ-টদ খেয়ে পড়ে আছে।

সুখারাম মনে-মনে ভগবানকে ডাকছিল। মোটরবাইকে ছুটে আসা শয়তানগুলো যেন ওকে দেখতে না পায়। ওর বস্তির ঘরে এককোণে ছোট্ট ঠাকুরের আসন রয়েছে। সেখানে মা কালীর ফটো রয়েছে। মা সকাল-সন্ধে ধূপকাঠি জ্বেলে নকুলদানা আর জল দিয়ে ঠাকুরের পুজো করে। এখন দু-চোখ বুজে সেই ফটোটাকেই দেখতে চাইছিল ও। আর আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছিলও। ওই তো মা কালী—নৃমুণ্ডমালিনী!

বাইকগুলো ওর পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। ও আড়চোখে দেখল, দুটো বাইকে পাঁচজন ছেলে বসে আছে। তার মধ্যে প্রথম বাইকটায় বসে আছে বদনোয়া। একা।

আবছা আলোতেও ওর মুখটা সুখারাম চিনতে পারল।

ভারী চেহারা। খানিকটা ভুঁড়ি রয়েছে। গালে চাপদাড়ি, মোটা গোঁফ। মাথার লম্বা চুল ব্যাকব্রাশ করা। ডানহাতে চকচকে সোনার বালা।

যেতে-যেতে একেবারে পিছনের বাইকটা হঠাৎই একটা গর্তে পড়ে টাল খেয়ে গেল। বাইকের আরোহী দুজন তাড়াতাড়ি রাস্তায় পা ফেলে পুরোপুরি পড়ে যাওয়াটা সামলে নিল। আচমকা এই দুর্ঘটনায় ওদের মধ্যে একজন গালাগাল দিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল। সেটা কানে যাওয়াতে সামনের বাইক দুটো থেমে গেল। পিছনের বাইকটা তখন সুখারামের খুব কাছাকাছি।

পিছনে তাকিয়ে একজন বলল, ‘দেখে চালা। রাস্তা তো নয় সালা—যেন গুটি বসন্তের ছল্লা লেগেছে—।’

কাত হয়ে যাওয়া বাইকটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেটা স্টার্ট দিয়ে আরোহী একদলা পিক ফেলল রাস্তায়। চেঁচিয়ে বোধহয় বদনোয়াকে উদ্দেশ করে বলল, ‘বস, সুখারাম হারামির বাচ্চাটা কোথায় সেঁধিয়ে গেল বলো তো! ব্যাটা একেবারে লাপাতা হয়ে গেল দেখছি…।’

সামনের বাইক থেকে বদনোয়া হিংস্র গলায় বলল, ‘লাপাতা হোকে জায়েগা কাঁহা! পাতালে গিয়ে ঢুকলেও শুয়োরের বাচ্চার চুলের গোছা ধরে টেনে তুলে আনব। মদনোয়ার দাম সুদে-আসলে চুকতা করব।’

ওদের বাইকের কাছ থেকে ছ’-সাত ফুট দূরে অন্ধকারে পড়ে থাকা সুখারামের বুক ঢিপঢিপ করছিল। মায়ের জন্য, চোলির জন্য ওর বুক কেঁপে উঠল।

ঠিক তখনই ওদের একজন হেসে বলল, ‘সুখারাম পালালে কী হবে? ওর ঘর-বাড়ি তো আর জায়গা ছেড়ে পালাতে পারবে না! ওর মা আর ফুলটুসি বোনটাই বা কোথায় পালাবে?’

কথাটা শুনে সুখারামের শীত-শীত করে উঠল। ওর মনে হল, ও বিশাল এক বরফের স্ল্যাবের ওপরে শুয়ে আছে।

বাইক তিনটে আবার চলতে শুরু করল। শেষের বাইকটার চাকা আবার জল জমা গর্তে পড়তেই কাদাজল ছিটকে এল সুখার গায়ে। ওর মনের ভেতরে তখন স্টিম রোলার চলছিল।

বাইকগুলো চলে যেতেই মা কালীকে ডাকাডাকি করা থামিয়ে উঠে বসল। এখন ও কী করবে? কী করা উচিত?

মা আর চোলির কথা ভেবে ওর ভয় করতে লাগল। ওর ভেতরে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন শুরু হল। ওর ভেতরে একটা সুখারাম বলতে লাগল, ওর এখন অন্ধকারে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা উচিত। কিন্তু একইসঙ্গে আর-একটা সুখারাম বলতে লাগল, ওর এখন বাড়ি যাওয়া উচিত—মা আর চোলির ওকে ভীষণ দরকার।

আকাশে বিদ্যুৎ ঝিকিয়ে উঠল। তারপরই মেঘের বাঘের ডাক।

মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল সুখা। হে মা কালী, আমাকে বলে দাও আমি এখন কী করব। আমি কি মায়ের কাছে যাব?

অমনই আকাশ থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। সঙ্গে-সঙ্গে সুখারাম নস্করের মনে হল, এক মা ওকে বলছে আর-এক মায়ের কাছে যেতে। এই বৃষ্টি তারই সংকেত।

উঠে দাঁড়াল সুখা। প্যান্টটা ঠিকঠাক করে পরে নিল। সারা গায়ে কাদাজল লেপটে আছে। বৃষ্টি ওর গা ধুয়ে দিচ্ছে। সেই অবস্থাতেই ও এগিয়ে গেল অন্ধকারের দিকে। উবু হয়ে বসে ওর রানিং শু খুঁজতে লাগল।

একটু পরেই সেগুলো হাতে ঠেকল। রাস্তায় লেপটে বসে জুতো জোড়া তাড়াতাড়ি পরে নিল। তারপর উঠে দাঁড়াল। মোবাইল ফোন। সাইকেল ভ্যান। ছুট, ছুট, ছুট।

ভ্যান চালাতে-চালাতেই মা-কে ফোন করল।

ফোন ধরল চোলি।

‘দাদাভাই! বল….।’

‘শিগগির মা-কে ফোন দে।’

চোলি ঘাবড়ে গেল। কাঁপা গলায় জিগ্যেস করলে, ‘কেন রে?’

‘ও:, শিগগির মা-কে দে—।’

এক সেকেন্ড পরেই মায়ের গলা পাওয়া গেল।

‘কী হয়েছে, সুখা?’

‘মা, তুই আর চোলি এক্ষুনি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যা—।’

‘সে কী! কেন?’

‘মা, বদনোয়ার গ্যাং আমাকে পাগলের মতো খুঁজছে। আমাকে হাতে না পেয়ে ওরা ঘরে গিয়ে তোদের অ্যাটাক করার কথা ভাবছে— তোকে আর চোলিকে। আমি নিজের কানে শুনেছি…।’

‘কিন্তু এখন আমরা কোথায় পালাব? পালিয়ে কোথায় যাব?’ হতভম্ব গলায় মা বলল।

‘যেখানে হোক যা—’ অধৈর্য গলায় বলল সুখারাম, ‘গিন্টিদের ঘরে কি আর কারও ঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাক। আমি ভ্যান নিয়ে এখুনি আসছি…।’

ফোনের লাইন কেটে দিল। পাগলের মতো সাইকেল ভ্যানের প্যাডেল ঘোরাতে লাগল। বৃষ্টি, খানা-খন্দ—কিছুই ও টের পাচ্ছিল না।

মনে পড়ল, কয়েক ঘণ্টা আগে চোলি ওকে কাঁদতে-কাঁদতে জিগ্যেস করেছিল, ‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’

উত্তরে সুখা বলেছিল, ‘জানি না। জানলেও বলতাম না। বদনোয়ার গ্যাং…।’

তখন ও একরকম টরচারের কথা ভেবেছিল—আর এখন অন্যরকম।

সাইকেল ভ্যানটা বস্তির কাছাকাছি চলে এসেছিল। এখানটায় রাবিশের চাপান দেওয়া কাঁচা রাস্তা। তার একপাশে সরু নালা মতন। নালার ঢাল বেয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে নামছে।

একপাশে দুটো ভাঙাচোরা ঘর চোখে পড়ল। যারা থাকত তারা মাসকয়েক আগে আস্তানা ছেড়ে চলে গেছে। তাদের ফেলে যাওয়া ঘরের বাঁশ, চাটাই, ছেঁড়া পলিথিন—যে যা পেরেছে হাতিয়ে নিয়েছে। এখন ঘর দুটো যে-অবস্থায় পড়ে আছে তাকে ঘরের ‘কঙ্কাল’ বললেও অনেকটা বাড়িয়ে বলা হয়। সুখারাম ওর সাইকেল ভ্যানটা সেই দুটো ঘরের একটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে খুব সাবধানে ওর ঘরের দিকে পা বাড়াল।

বস্তির গলিপথে অন্য অনেক কিছুর মতোই আলোরও অভাব। তাই বৃষ্টি যে পড়ছে সেটা দেখা যাচ্ছিল না, তবে বস্তির ঘরগুলোর চাল থেকে হালকা শব্দ উঠছিল, আর গায়েও টের পাওয়া যাচ্ছিল।

ধীরে-ধীরে এগোতে-এগোতে সুখারাম হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। না, তখনও ও কিছু দেখতে পায়নি—কিন্তু শুনতে পেয়েছে।

কারা যেন চিৎকার করছে। এবং সে-চিৎকারের যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তার বেশিরভাগটাই নোংরা গালিগালাজ।

ব্যাপারটা যে কী হচ্ছে সেটা আঁচ করতে পারল। তাই একটু তাড়াতাড়ি পা চালাল।

ওদের ঘরে পৌঁছনোর বাঁকটার মুখে একটা ফুটপাঁচেক চওড়া খাঁজ আছে। সেখানে ভাঙাচোরা ইটের টুকরো আর নানান আবর্জনা। তার একপাশে সাইকেল আর সাইকেল ভ্যানের বাতিল টায়ার-টিউব, সিট কভার ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। সুখা জানে, ওজনদরে বিক্রি হয় এমন কোনও মেটাল পাটর্স সেখানে নেই। শীতের সময় ওইসব টায়ার-টিউব টেনে নিয়ে বস্তির লোকরা ধুনি জ্বালিয়ে শীত তাড়ায়।

ওই খাঁজটাকে বস্তির সবাই বারোয়ারি বাথরুম হিসেবেও ব্যবহার করে। ফলে ওর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নাকে হাত চাপা দেওয়াটা নেহাতই প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলা যেতে পারে।

তাই সুখারামও রোজকার অভ্যাসমতো বাঁকটা ঘোরার সময় নাকে-মুখে হাত চাপা দিয়েছিল।

ভাগ্যিস দিয়েছিল, নইলে বাঁক ঘুরেই যে-দৃশ্য ওর চোখে পড়ল তাতে ওর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা জান্তব চিৎকারটা বদনোয়ার গ্যাং-এর কেউ না কেউ হয়তো শুনে ফেলত। কিন্তু নাক-মুখ হাতে ঢাকা থাকায় ওর চিৎকারটা ডুকরে ওঠা চাপা কান্নার মতো শোনাল। সুখরাম চট করে দুর্গন্ধময় খাঁজটায় ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে উঁকি মেরে ওর ঘরের সামনের দৃশ্যটা দেখতে লাগল। ওর মনে হচ্ছিল, ও যা দেখছে সেটা বাস্তব নয়—কোনও সিনেমার দৃশ্য। কিন্তু সেই সিনেমা দেখতে-দেখতে ওর বুকটা নিংড়ানো ভেজা গামছার মতো বারবার মুচড়ে উঠছিল। দম আটকে আসছিল। রাগ আর কান্না বুকের ভেতরে দাপাদাপি করছিল।

মা আর চোলি তা হলে পালাতে পারেনি!

সুখারামদের ঘরের সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে কয়েকটা বাঁশের খুঁটি পুঁতে নাইলনের দড়ি টাঙানো। বস্তির কয়েকঘর মানুষ ওই দড়িতে জামাকাপড় শুকোতে দেয়।

সেই জায়গাটায় বদনোয়াদের তিনটে মোটরবাইক দাঁড়িয়ে আছে। সুখারামদের ঘরের দরজা তাক করে তিনটে বাইকের হেডলাইট জ্বালানো। ফলে জায়গাটায় বেশ আলো ছড়িয়ে আছে। বাইকগুলোর দুপাশে একরকম সার বেঁধে বদনোয়ারা পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে। আলোর আওতার বাইরে থাকায় সুখারাম ওদের সিলুয়েট ছায়া দেখতে পাচ্ছিল। আর হেডলাইটের আলোয় আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ওর স্পষ্ট নজরে পড়ছিল।

আরও নজরে পড়েছিল যে, ওদের ঘরের দরজাটা বন্ধ এবং সেই বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সুখারামের মা কান্না ভাঙা গলায় হাহাকার তুলে চিৎকার করছে।

মায়ের ওই ছোটখাটো রোগা শরীরে এত তীব্র চিৎকারের তেজ জমা থাকতে পারে তা সুখারাম স্বপ্নেও ভাবেনি। মা চিৎকার করছিল, কাঁদছিল, বদনোয়ার দলকে গালাগালিও দিচ্ছিল।

‘দূর হ, হারামজাদার দল! সুখা কাউকে কিচ্ছু করেনি। ও খুব নেক আর সাচ্চা মানুষ। মদনোয়া অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। যা এখান থেকে। দূর হ! দরকার হয় থানায় যা! বলছি না, সুখা বাড়িতে নেই! ও কোনও মার্ডার করেনি। তোরা মার্ডারার—তোরা! যত্তসব ক্রিমিনালের হাড্ডি।’

মা চিৎকার করছিল। কিন্তু মায়ের চিৎকার ছাপিয়ে ওই পাঁচটা শয়তানের অন্তত দুজন তোড়ে খিস্তির ফোয়ারা ছোটাচ্ছিল। সেই গালিগালাজের মধ্যে সুখার মা-বাবা-ভাই-বোন কেউই রেহাই পাচ্ছিল না। ওর কোনও ভাই নেই। বাবা মারা গেছে সাড়ে চারবছর আগে। কিন্তু বদনোয়াদের তাতে কী!

সুখারামের ভেতরে আগুন জ্বলতে শুরু করল। ওর বাঁ-হাতটা থরথর করে কাঁপতে লাগল—যেন পিনাকেতে মহাদেব টংকার দেওয়ার পর তার তারে অনন্ত কাঁপন লেগেছে। কিন্তু ও কিছু করতে পারছিল না। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছিল। বুকের ভেতরে কষ্ট হচ্ছিল।

সুখারাম যে কিছু করার কথা ভাবেনি, শুধু স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, তার কারণ, বদনোয়ার দল ওর দিকে পিছন ফিরে থাকলেও ও ওদের হাতের অন্তত দুটো অস্ত্র দেখতে পাচ্ছিল।

বদনোয়ার হাতের মুঠোয় ধরা একটা মোটা নলওয়ালা রিভলভার।

আর ওর এক শাগরেদের হাতে ঝোলানো দেড় হাত লম্বা একটা ঝকঝকে সোর্ড।

এই দুটো জিনিস সুখারামকে আটকে দিয়েছিল।

অস্ত্রধারী দুজনেই তাদের হাতের অস্ত্রগুলোকে বেপরোয়াভাবে নাচাচ্ছিল, আর তার সঙ্গে এই বলে শাসাচ্ছিল যে, এক্ষুনি সুখারামকে ওদের হাতে না তুলে দিলে ওরা ‘নাকের বদলে নরুন’ নিয়ে চলে যেতে পারে।

সুখারাম স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, সেই ‘নরুন’ এখন ওদের বন্ধ দরজার ওপিঠে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া কবুতরের মতো কাঁপছে, বুক উঠছে, নামছে। পাগল-করা ছন্দে ধড়ফড় করছে।

বস্তির ভেতরে এত প্রবল চিৎকার, চেঁচামেচি—অথচ পাড়াপড়শিদের কোনও সাড়া নেই। সব ঘরেরই জানলা-দরজা বন্ধ। এখানে এত লোক গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে, অথচ এখন সুখারাম, ওর মা আর চোলি একেবারে একা। হেডলাইটের জোরালো আলোয় সুখার মা হাত-পা নেড়ে চিৎকার করছিল, তড়বড় করে লাফাচ্ছিল। শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য যতরকম ভাবভঙ্গি আর আস্ফালন করা সম্ভব সবই করছিল। সেটা দেখতে-দেখতে হঠাৎ সুখার মনে হল, কোনও সিনেমার যেন শুটিং চলছে। সেখানে ওর মা স্পটলাইটের আলোয় শট দিচ্ছে। আর অন্ধকারের আড়ালে থেকে পরিচালক-সহ-পরিচালকের দলবল তাদর নির্দেশনামা শুনিয়ে চলেছে।

অসহায় সুখারাম কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। মা আর চোলিকে বাঁচাতে না পাবার কষ্টটা ওকে ধীরে-ধীরে অবশ করে দিচ্ছিল।

ঠিক তখনই শুটিং শুরু হল।

আওয়াজটা তেমন জোরে হয়নি, কিন্তু সুখারাম সেটাকে গুলির আওয়াজ বলে ভালোই চিনতে পারল।

চেনার আরও একটা কারণ, মায়ের প্রতিবাদের ফুলঝুরি আচমকা থমকে গেল, আর একইসঙ্গে ও দেখতে পেল মায়ের ময়লা শাড়ির বুকের কাছটা হঠাৎই লাল রঙে ভিজে উঠেছে, আর ওর মায়ের ছোট্টখাট্টো রোগা শরীরটা ভাঁজ হয়ে পড়ে যাচ্ছে।

সুখার ঝাপসা চোখের সামনে সেই পলকা তেজি শরীরটা পড়তেই লাগল। পড়তেই লাগল।

বদনোয়ার দল উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। ওদের একজন চিৎকার করে বলল, ‘সালা, আমাদের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া! গোটা ফ্যামিলিকে চুরচুর করে দেব!’

ওরা পাঁচজন বন্ধ দরজাটার দিকে এগোতে শুরু করল। অন্ধকার থেকে আলোর বৃত্তে ঢুকে পড়ল। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। এ ওর দিকে তাকাচ্ছিল, বন্ধ দরজাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে অঙ্গভঙ্গি করছিল।

সুখারাম এবার ওদের দেখতে পাচ্ছিল। চিনে নিতে পারছিল চেহারাগুলো। মনের মধ্যে সেগুলো গেঁথে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।

বদনোয়াকে ও চেনে। ভারী চৌকো, হিংস্র মুখ। কিন্তু বাকি চারটে মুখ ও নতুন দেখছে।

ওরা সবাই বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে অনায়াসে সুখারামের মায়ের দেহটাকে পাশ কাটিয়ে গেল। তারপর খিস্তির পঞ্চব্যঞ্জন তারস্বরে উগরে দিয়ে ঘরের পলকা দরজাটা পিটতে শুরু করল।

ঘরের ভেতর থেকে এই প্রথম একটা ভয়ের চিৎকার শোনা গেল। একটা কোণঠাসা মেয়ের চিৎকার।

চোলি।

সুখা এখন কী করবে? ছুটে যাবে ওই রিভলভার আর সোর্ডের মুখে? মায়ের মতো বেঘোরে প্রাণ দেবে?

তা হলে বদলা নেবে কে? ওপরওয়ালা?

না, সব কাজের দায়িত্ব ওপরওয়ালার ওপরে চাপাতে পারবে না সুখারাম।

এইসব ভাবছিল, থরথর করে ওর গোটা শরীর কাঁপছিল, ভয়ে মুখে কুলুপ আঁটা, কিন্তু দু-চোখ জল।

মা! মা রে! ওরা আসার আগে তোরা ঘর ছেড়ে পালাতে পারলি না? হা ভগবান!

সুখারামের মাথা ঘুরছিল, চোখে ঝাপসা দেখছিল। জীবনটা হঠাৎ করে কী থেকে কী হয়ে গেল!

অসহ্য টেনশানে মাথার ভেতরে যন্ত্রণা হচ্ছিল। বদনোয়ার দলবলের দরজা পেটানোর আওয়াজ ওর কানে বোমার মতো ভয়ংকর এবং তীব্র শোনাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি চোখে অন্ধকার নেমে আসবে, মাথার শিরাগুলো পটপট করে ছিঁড়ে যাবে।

এবং তাই হল।

ওদের ঘরের দরজাটা প্রথমে চিড় ধরে তারপর ভেঙে গেল। চোলির কানফাটানো আর্ত হাহাকার আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ভিজিয়ে দিল। আর সুখারামের চোখের সামনে একটা ভারী কালো পরদা নেমে এল।

ও আচমকা আবর্জনা, ইট, খোয়া আর রাবিশের ওপরে লুটিয়ে পড়ল। একটা শক্ত কিছুতে ওর মাথা ঠুকে গেল। নাকে এল জনতা-বাথরুমের ঝাঁজালো কটু গন্ধ।

তারপর সুখারাম নস্করের আর কিছুই মনে নেই।

জ্ঞান যখন ফিরল তখন ও কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে। সেখান থেকে বৃষ্টির ফোঁটা একঘেয়েভাবে নেমে আসছিল ওর মুখে, চোখে, শরীরে।

মাথায় অসহ্য ব্যথা, নাকে নোংরা গন্ধ।

হঠাৎই বমির ওয়াক বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। ওর শরীরটা প্রবল দমকে ঝাঁকুনি খেল।

উঠে বসল সুখারাম। মাথার পিছনটা টনটন করছে। সেই অবস্থায় ওয়াক উঠল আরও কয়েকবার। শব্দ চাপা দিতে মুখে হাত উঠে গেল ওর।

একটু পরে হাত সরিয়ে হাঁ করে দু-চারবার শ্বাস নিল। তারপর ভালো করে চারপাশে তাকাল। মাথা ঝাঁকিয়ে চোখের দৃষ্টি সড়গড় করতে চাইল।

আরে! তিনটে বাইকের হেডলাইট তো এখনও জ্বলছে!

তা হলে বদনোয়া আর ওর দলবল গেল কোথায়?

উত্তর পেয়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গেই।

সুখারাম দেখল, ওদের ঘরের ভাঙাচোরা দরজা দিয়ে শত্রুরা একে-একে বেরিয়ে আসছে।

প্রথমে বদনোয়া—আর ওর পিছনে-পিছনে বাকি চার শাগরেদ। হেডলাইটের আলোয় ওদের মুখগুলো স্পষ্টভাবে চোখে পড়ছিল।

মুখে অশ্লীল হাসি, তার সঙ্গে খিস্তিখেউড়, আর এলোমেলো পা ফেলে হাঁটা।

ঘরের ভেতর থেকে কোনওরকম চিৎকার-টিৎকার আর শোনা যাচ্ছে না।

সুখারাম হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল। যাতে শব্দ না হয় সেইজন্য দু-হাতের তালু চেপে ধরল মুখে। অসহায় বোবা মানুষের মতো গোঙাতে লাগল।

বসা অবস্থাতেই ও আরও অন্ধকার কোণে সরে গেল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল সামনের একটা জোড়াতালি দেওয়া ঘরের দিকে।

ও কী করবে এখন? বাঁচবে? না মরবে?

আধো অন্ধকারের মধ্যেও ও দেখল সামনের ঘরটার একটা খুপরি জানলা অর্ধেকটা খুলে গেল। সেখানে উঁকি মারছে একজোড়া ভয় পাওয়া চোখ।

সুখারামের মনে হল, বস্তির অনেক ঘরের জানলা থেকেই হয়তো এরকম ভয় পাওয়া কৌতূহলী চোখ আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। কিন্তু সাহস করে কেউ বেরিয়ে আসতে পারছে না। ওরা হয়তো বদনোয়ার গ্যাঙের এখনকার কীর্তিকলাপ অনেকটাই শুনেছে বা দেখেছে, কিন্তু আতঙ্ক ওদের সামনে আসতে দেয়নি, প্রতিবাদ করতে দেয়নি।

এমন সময় একটা ফায়ারিং-এর শব্দ শোনা গেল।

আড়াল থেকে উঁকি মারল। দেখল, বদনোয়ার রিভলভার শূন্যে উঁচিয়ে ধরা রয়েছে। আর ওর দুজন সঙ্গী খিস্তি দিয়ে সুখারাম এবং বস্তির লোকদের চেঁচিয়ে শাসাচ্ছে। একজনের হাতের সোর্ড শূন্যে আস্ফালন করে বৃষ্টির ফোঁটাকে ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা করছে।

ওরা চলে যাচ্ছে! চলে যাচ্ছে ওরা! যুদ্ধ জয় করে ওরা সিনা ফুলিয়ে চলে যাচ্ছে—পোড়া বস্তির দিকে, ওদের ঠেকের দিকে।

মোটরবাইকগুলো স্টার্ট দেওয়ার শব্দ শোনা গেল। বাইকের হেডলাইটের আলো এলোমেলোভাবে নানান দেওয়াল আর গাছপালার ওপরে পড়ল। ফিরে যাবে বলে ওরা বাইকের মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে।

কান্নার গোঙানি সুখারামকে চৌচির করে দিচ্ছিল। একটা অস্ত্র! একটা অস্ত্র যদি ও হাতে পেত তা হলে….।

ও পাগলের মতো আধখোলা জানলাটার ওপরে হামলে পড়ল।

বুঝতে পারল, জানলার চোখ দুটো একটা মেয়ের।

সুখারামকে হঠাৎ করে জানলার কাছে চলে আসতে দেখে মেয়েটি ভয় পেয়ে জানলা থেকে সরে যাচ্ছিল, কিন্তু সুখরাম কান্না মেশানো গলায় ডুকরে উঠল, ‘বোন—যেয়ো না…।’

মেয়েটা থমকে গেল। ওর ঘরের ভেতরটা অন্ধকার থাকায় ওকে ভালো করে ঠাহর করা যাচ্ছে না।

‘বোন…শোনো…প্লিজ…।’ সুখারাম চাপা গলায় কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘শিগগির কিছু একটা আমাকে দাও….ছুরি-কাটারি-বঁটি…যা হোক। শয়তানের বাচচাগুলো আমার…আমার মা আর বোনকে…।’ আর কোনও কথা বলতে পারল না—শুধু কাঁদতে লাগল।

দুবার ঢোক গিলে বলল আবার, ‘প্লিজ…বোনটি আমার…।’

ছায়া-ছায়া মুখটা চট করে জানলার কাছ থেকে সরে গেল।

সুখারাম ভয় পেয়ে গেল। মেয়েটা গেল কোথায়? মোটরবাইকের আলো তো আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওর গায়ে এসে পড়বে!

ও একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে অন্ধকার জানলাটার দিকে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎই চোখ দুটো আবার দেখা গেল। জানলার কাঠের গরাদের ফাঁক দিয়ে ‘ঠং’ শব্দে কী একটা গলির রাবিশের ওপরে পড়ল।

সেদিকে তাকিয়ে আধোআঁধারির মধ্যেও সুখারাম দেখতে পেল, কিছু একটা চকচক করছে।

জানলার চোখদুটো কয়েকপলক ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চাপা ‘খট’ শব্দ করে জানলার পাল্লা বন্ধ হয়ে গেল।

সুখারাম ঝাঁপিয়ে পড়ে জিনিসটার দিকে হাত বাড়াল। ওটাকে ব্যস্ত মুঠোয় ধরে একরকম ডিগবাজি খেয়ে গড়িয়ে গেল নিজের আশ্রয়ে। দেওয়াল ঘেঁষে উবু হয়ে বসল।

আবর্জনা, বাথরুমের দুর্গদ্ধ, ছেঁড়া-ফাটা পুরোনো টায়ার-টিউব।

বৃষ্টির মধ্যেই মুঠোটা চোখের কাছে নিয়ে এল।

প্রায় সাত-আট ইঞ্চি ফলার একটা জং ধরা ছুরি। তার কাঠের হাতলের বেশ খানিকটা ভাঙা।

সোর্ড এবং রিভলভারের সঙ্গে মোকাবিলায় এই ছুরি নিতান্তই একটা বিন্দু!

কিন্তু তা সত্বেও এই বিন্দু থেকেই একটা প্রতিঘাতের লড়াই শুরু করা যেতে পারে।

মোটরবাইকের আলোগুলো এগিয়ে আসছিল। তার ঠিক পিছনেই বসে আছে খতম স্কোয়াডের পাঁচজন সদস্য। ওদের দুজনের কাছে অস্ত্র রয়েছে। সেই দুজনকে নিয়েই সুখারামের বেশি দুশ্চিন্তা।

মায়ের কথা ভাবছিল সুখারাম। ভাবছিল চোলির কথা। এই দু:সময়ের মধ্যে আপাদমস্তক নিমজ্জিত থেকেও ওর সুসময়ের কথা মনে পড়ছিল। অনেক অভাবের মধ্যেও মায়ের শাসন আর স্নেহ মাখানো দিনগুলো মনে পড়ছিল।

‘সুখা, বৃষ্টিতে ভিজবি না। ঠান্ডা লাগলে জ্বর হবে, তারপরই ঝামেলা। ডাক্তার দেখাও, ওষুধ খাও…সে-পয়সা কোথায়? যা, ঘর যা!’

‘এই নে, সুখা, এই রসগোল্লাটা খা।’ তারপর সুখারামের অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে: ‘আজ তোর জন্মদিন রে পাগলা! তাই তিনটে রসগোল্লা কিনে এনেছি—আমাদের তিনজনের…।’

‘দাদাভাই, দশটা টাকা দে তো—।’

‘কেন রে?’

‘খরচ করব—।’

‘তার মানে? কীসে খরচ করবি?’

‘কেন, সব কি তোকে বলতে হবে?’

‘মা, শোন—চোলির কথা শোন—।

‘ও ঠিকই তো বলেছে! ও বড় হয়েছে। ও নেলপালিশ কি কিরিম কিনবে সব তোকে বলতে হবে! শিগগির দশ টাকা দে! ও তোর ছোটবোন—তোর কাছে চাইবে না তো কার কাছে চাইবে?’

সুখারাম শুনতে পাচ্ছিল চোলির গলা : ‘কী রে, দাদাভাই, বদলা নিবি না?’

চোলি বদলা চাইছে।

‘ও তোর ছোটবোন—তোর কাছে চাইবে না তোর কার কাছে চাইবে?’ মায়ের গলা।

সুখারামের ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল ঘরের দিকে, মায়ের দিকে, চোলির দিকে। ওরা কি এককণাও বেঁচে আছে? আছে?

থাক বা না থাক, সুখারামের খুব ইচ্ছে করছে ওদের কাছে যেতে। কিন্তু চোলি যে আবার আবদার করছে…কী যেন চাইছে…।

বাইকের আলোগুলো সুখারামের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।

ছুরিটা শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরল সুখারাম। হে ভগবান! একটা সুযোগ দাও। একটা সুযোগ! তা হলে বাকি কাজটার দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে না—আমিই নিতে পারব। তাতে বাঁচি-মরি কোনও দু:খ নেই। কারণ, বেঁচে থাকার আর কোনও মানে নেই।

ওই দু-এক লহমার মধ্যেই নিয়তি একটা সুযোগ তৈরি করে দিল।

তিনটে মোটরবাইক ওকে পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎই একেবারে শেষের বাইকটা দাঁড়িয়ে পড়ল। বাইক চালাচ্ছিল যে-ছেলেটা সে একটা হাত শূন্যে তুলে চেঁচিয়ে বলল, ‘বস, একবার লিক না করলে হবে না—তলপেট সালা বাস্ট করবে…।’

সামনের দুটো বাইক থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে জবাব দিল, ‘সালা পেটে মাল পড়লেই জামিয়ার খালি এমার্জেন্সি হিসি পায়। যাকগে, আমরা ঠেকে যাচ্ছি, তুই লিক করে আয়। খাওয়াদাওয়া সেরে ওই হারামির বাচ্চাটাকে আবার পাত্তা করতে বেরোব…।’

পিছনের বাইকটা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তার সামনের সিট থেকে শূন্যে পা ঘুরিয়ে নেমে পড়ল জামিয়া। তারপর সুখারামের অন্ধকার খুপরির দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

বৃষ্টি আর আলো-আঁধারির মধ্যে ওকে ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছিল না সুখা। শুধু বুঝতে পারছিল, জামিয়া লম্বা এবং ওর হাতে সোর্ডটা নেই।

জামিয়ার সঙ্গী বাইকের দুপাশে পা ছড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছিল। বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ হয়নি, তাই ফটফট আওয়াজ হচ্ছিল, আর বাইকের হেডলাইটটা একবার উজ্জ্বল হচ্ছিল আর একবার মলিন হচ্ছিল।

না, ওই ছেলেটার কাছেও সোর্ডটা আছে বলে মনে হচ্ছে না। ওটা মনে হয় মাঝের বাইকের কারও কাছে আছে।

জামিয়া যেন ওকে লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি পা ফেলছে। প্রকৃতির চাপ আর সইতে পারছে না।

হাতল ভাঙা ছুরিটা শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরল। ওর আঙুলের হাড় ব্যথা করতে লাগল। আসুক জামিয়া—আরও কাছে আসুক। একজন-একজন করেই নিপাতের কর্মকাণ্ড শুরু হোক।

বাথরুম করার দুর্গন্ধ মাখা ছোট্ট এলাকাটায় ঢুকে পড়ার আগেই ব্যস্ত হাতে প্যান্টের ‘জিপ’ খুলে ফেলেছিল জামিয়া। তারপর ব্যস্তভাবে ঢুকে পড়েছে অন্ধকার খুপরিতে।

ভাঙাচোরা দেওয়াল আর ডাঁই করা আবর্জনার মধ্যে ঘাপটি মেরে কুঁকড়ে বসেছিল সুখারাম। নিয়তির অদ্ভুত খেলা দেখে ও হতবাক হয়ে গিয়েছিল। গুহা থেকে বেরিয়ে ওকে আর দৌড়ে শিকার ধরতে হবে না। শিকার নিজেই চলে এসেছে গুহায়।

জামিয়া দু-পা ফাঁক করে পজিশন নিয়ে দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতেই সুখরামের ছুরি শঙ্খচুড়ের ঢঙে ওকে ছোবল মেরেছে। ছুরির জং ধরা ফলাটা জামিয়ার ‘লেটার বক্স’-এর ভেতর দিয়ে সরাসরি ঢুকে গেছে অন্ধকারে। সজোরে আঘাত হেনেছে।

ছুরির ফলাটা কোনও বাধা পেল না দেখে সুখারাম খানিকটা আশ্চর্য হল। মনে হল, ও যেন একতাল মাখনের মধ্যে ছুরি চালিয়েছে।

জামিয়া যে-‘ওঁক’ শব্দটা করল সেটার ধরন অনেকটা মুরগির শেষ চিৎকারের কাছাকাছি। আর ওর দেহটা সামনে ভাঁজ হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সুখারামের গায়ের ওপরে।

কিন্তু সেসব তেমন মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করার মতো অবস্থা সুখারামের ছিল না। কারণ, ওর ডানহাত তখনও একই কাজে ব্যস্ত ছিল। টিভিতে একঘেয়ে অ্যাকশন রিপ্লে দেখানোর মতো ও বারবার মাখনের তালে জং ধরা ছুরিটা বসিয়ে যাচ্ছিল। আর মনে-মনে বলছিল, ‘মা-চোলি। মা-চোলি, মা-চোলি…।’

জামিয়ার চাপা আর্তনাদ ওর সঙ্গীর কানে পৌঁছয়নি। কারণ, আর্তনাদের তীব্রতা যথেষ্ট কম ছিল—আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাইক থেকে জামিয়ার দূরত্ব, বাইকের ইঞ্জিনের শব্দ এবং আশপাশের টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম।

কিন্তু জামিয়ার দেরি দেখে সে চেঁচিয়ে জামিয়ার নাম ধরে ডাকল। পরপর তিনবার। তাঁর মধ্যে শেষবারের ডাকটা যথেষ্ট অধৈর্য ভাব আর বিরক্তি মেশানো।

সুখারাম হাঁপাচ্ছিল। ওর বুকের ভেতরে ধকধক আওয়াজ হচ্ছিল। মনটা পাগলের মতো ছটফট করছিল। কিন্তু তাই বলে ওর বুদ্ধিভ্রংশ হয়নি। নিশাচর চিতার মতো ও ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছিল। ওর হাত, মুখ, বুক—সব ভিজে চটচটে হয়ে গিয়েছিল। এখন বৃষ্টির ফোঁটায় সেই চটচটে ভাবটা ধুয়ে যাচ্ছিল।

ও দেখল, বাইকে বসা ছেলেটা এবার সামনে ঝুঁকে পড়ে বাইকের হাতল দুটো ধরল। অ্যাথলিটের ভঙ্গিতে পা ঘুরিয়ে বাইক থেকে নেমে পড়ল। তারপর বাইকটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে ও জামিয়ার নাম ধরে ডাকতে-ডাকতে সুখারামের আশ্রয়ের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

আয়—এগিয়ে আয়। আরও কাছে আয়…।

সুখা মনে-মনে ওকে আর ভগবানকে ডাকতে লাগল।

ছেলেটা অকুস্থলের কাছাকাছি এসেই জামিয়াকে দেখতে পেল। নোংরা আর আবর্জনার মধ্যে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে।

ও জামিয়াকে কয়েকবার নাম ধরে ডাকল। ওর গলার স্বর আলতো, স্তিমিত। তার মধ্যে অল্পস্বল্প সর্তকতা ঢুকে পড়েছে।

অন্ধকারে দম বন্ধ করে উবু হয়ে বসে রয়েছে সুখারাম। যেন একটা নিথর গোটানো স্প্রিং। যে-কোনও মুহূর্তে ছিটকে লাফিয়ে পড়বে শত্রুর ওপরে।

কিন্তু শত্রু আরও কাছে আসছে না কেন?

ছেলেটা আর-একটু কাছে এল। ঝুঁকে পড়ে হাত লম্বা করে জামিয়াকে ছুঁল। তারপর ‘জামিয়া। আবে জামিয়া!’ বলে ডাকল। ওর অসাড় শরীরটাকে কয়েকবার ঠেলা মারল।

ব্যস! তার পরই ও অনুসন্ধানী চোখে চারপাশে নজর চালাল। ওর চঞ্চল চোখ অন্ধকার খুপরির প্রতিটি আনাচকানাচ এক ঝলকে দেখে নিল।

আর তখনই দেখতে পেল কুঁকড়ে বসে থাকা শিকারি সুখারামকে।

দু-নম্বর জগতের অলিগলি ছেলেটার জানা। নানান ধরনের কাজিয়া, লড়াই, খুনোখুনির মধ্যে ও বড় হয়েছে। বদনোয়ার দলে থাকার মতো যোগ্যতা ওর যথেষ্ট আছে। তাই ও তক্ষুনি পরিস্থিতি আঁচ করে নিল। বুঝল, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালানোটাই এই মুহূর্তে সেরা স্ট্র্যাটেজি। তাই উলটোদিকে ছুট লাগাল।

ছেলেটা যেভাবে মোটরবাইকটাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল তাতে বোঝা গেল ও বাইক চালাতে জানে না।

চোখের পলকে গোটানো স্প্রিং-টা খুলে গেল। ছিটকে লাফিয়ে পড়ল গলির সিমেন্ট বাঁধানো জমির ওপরে। এবং ক্ষিপ্র পায়ে ছুটে পালানো ছেলেটার পিছু নিল।

সুখারাম নস্করের খুব আনন্দ হচ্ছিল। কারণ, শত্রুকে এখন ও বাগে পেয়ে গেছে। ছেলেটা সুখার সঙ্গে রেসে নাম দিয়ে ফেলেছে। আর ওর ফেরার পথ নেই।

সুখারাম দৌড়চ্ছিল। খালি গা। হাফপ্যান্ট। আর পুরোনো রানিং শু।

বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় ছুটতে ওর খুব একটা অসুবিধে হচ্ছিল না। তবে ওর বরাট স্যারের কথা মনে পড়ছিল। এই দৌড়টা জিততে হবে। জিততেই হবে!

বস্তির গলির ভাঁজগুলো পেরিয়েই বড় রাস্তা। রাস্তাটা গলির চেয়ে চওড়া বলেই এর নাম ‘বড়’ রাস্তা। কিন্তু আসলে ওল্ড সিটির অন্যান্য রাস্তার মতো এই রাস্তাটাও শতচূর্ণ।

রাস্তার শুরুর দিকটা সাপের মতো—আঁকাবাঁকা। তারপর খানিকটা অংশ সোজা—নাকবরাবর। সেই সোজা রাস্তায় এসে পড়তেই ছুটন্ত ছেলেটাকে দেখতে পেল সুখারাম। ওর সামনে—পঁচিশ কি তিরিশ মিটার দূরে—দৌড়চ্ছে।

সুখার ভেতরে তেজের ঝলকানি ঠিকরে বেরোল। ওর প্রতিটি স্নায়ুতে তেজস্ক্রিয় কণার স্রোত ছড়িয়ে পড়ল। ট্র্যাক খারাপ হলেও ও মনের মতো করে দৌড়তে পারছিল। বেশ বুঝতে পারছিল। দুজনের মধ্যে দূরত্ব কমছে।

রাস্তার বাঁ-দিকে অবহেলায় পড়ে থাকা জমি। সেখানে ভাঙাচোরা বড়-বড় যন্ত্রপাতি, পুরোনো গাড়ি, দেওয়াল কিংবা ছাদ ভেঙে পড়া ঘর, আর গাছপালা তো আছেই! এ ছাড়া ডানদিকে ছোট-বড়-মাঝারি বিল্ডিং—আর তার লাগোয়া অসংখ্য ঝুপড়ি।

সুখারাম একমনে দৌড়চ্ছিল, মুখ দিয়ে টুঁ শব্দও বেরোচ্ছিল না। শুধু ওর নিশ্বাসের শব্দ আর হৃৎপিণ্ডের ধকধক শোনা যাচ্ছিল।

সামনের ছুটন্ত ছেলেটা কোনও আওয়াজ করেনি—শুধু প্রাণপণে ছুটছিল। একবার ও পিছনে তাকিয়ে সুখারামকে দেখেছিল—তারপর আর মুখ ফেরায়নি।

সাহায্যের জন্য কোনওরকম চিৎকারও করেনি ছেলেটা। কারণ, ও জানে চিৎকার করে কোনও লাভ নেই। এত রাতে এই বৃষ্টিতে কেউই ওকে সাহায্য করতে ছুটে আসবে না। অবশ্য বৃষ্টিহীন বিকেলবেলা হলেও কেউ আসত না। শুধু বিনিপয়সার মজা দেখত। এটাই ওল্ড সিটির দস্তুর।

সামনের ছুটন্ত ছেলেটা কী করে যেন বুঝতে পারল সুখারামের সঙ্গে ওর দূরত্বটা বিপজ্জনকভাবে কমে এসেছে। তাই ও ছুটতে-ছুটতেই ডানদিকে বাঁক নিল। হয়তো ভেবেছে ঝুপড়িগুলোর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার চেচামেচি করে সাহায্য চাইলে একটা হট্টগোল তো অন্তত হবে! তাতে যদি পিছন-পিছন ছুটে আসা কমবখত পাগলা কুত্তাটাকে রুখে দেওয়া যায়।

ছেলেটার ভাবনাটা ভাবনাই রয়ে গেল। কারণ, সেটা বাস্তবে অনুবাদ করার আগেই সুখারাম ওকে হাতের নাগালে পেয়ে গেল এবং এক ধাক্কা দিল।

ছেলেটা ছিটকে পড়ল রাস্তায়। পড়ে কয়েক পাক গড়িয়ে চলে গেল রাস্তার ধারে মাটিতে।

সুখারাম ওর কাছে গিয়ে পড়তেই ছেলেটা শরীর বাঁকিয়ে সুখার পা চেপে ধরল। গোঙানির সুরে বলল, ‘ছোড় দে, ভাইয়া, হমে ছোড় দে। ইয়ে সব বদনোয়াকা কাম হ্যায়। হাম কুছ নাহি কিয়া। আমি কিচ্ছু করিনি—বিশ্বাস কর…।’

ওপরদিকে তাকিয়ে কথা বলার সময় ছেলেটার মুখে বৃষ্টির জল ঢুকে যাচ্ছিল—তাই ও বারবার ঢোক গিলছিল।

সুখারামকে প্রেতের মতো দেখাচ্ছিল। বৃষ্টি ভেজা খালি গা। মাথার চুল কপালে লেপটে আছে। কাদা মাখা ভেজা হাফপ্যান্ট। আর ডানহাতের মুঠোয় হাতল ভাঙা জং ধরা ছুরি।

ছেলেটাকে এক ধাক্কা মেরে পিছনে ঠেলে দিল সুখা। তারপর ওর গায়ের ওপর ‘ছপাৎ’ শব্দে বসে পড়ল। ছুরি ধরা হাতটা শূন্যে উঁচিয়ে।

দাঁতে দাঁত ঘষে ও হাঁপাতে-হাঁপাতে জিগ্যেস করল, ‘বল, বাকি তিনটে হারামি কোথায় গেছে…।’

সুখারামের হাতের ছুরির চেহারাটা চটপট উত্তর পেতে সাহায্য করল।

‘ওরা…ওরা পোড়া বস্তির ঠেকে গেছে—।’

ঘোড়ায় চড়ার মতো দুপাশে দু-পা রেখে ছেলেটার ওপরে সওয়ার হয়ে ছিল সুখা। চারপাশে ভিজে কাদা-মাটি। ছেলেটা হাঁপাচ্ছে। অসহায়ের মতো ওপরদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

সেই অবস্থাতেই ও বলতে লাগল পোড়া বস্তির ঠেকটা ঠিক কোথায়। বাংলা হিন্দি মিশিয়ে গোঙানির সুরে কথা বলছিল ছেলেটা। আর তার ফাঁকে-ফাঁকেই বলছিল যে, ও নির্দোষ। সবকিছুর জন্য বদনোয়া দায়ী।

সুখরামের মাথার ভেতরে আগুন জ্বলছিল, উথালপাথাল চলছিল। কিন্তু তা সত্বেও ছেলেটার বলা জরুরি তথ্যগুলো ও স্মৃতিকোশে ঠিকঠাক গেঁথে নিতে পারছিল। ওর মনে হল, পোড়া বস্তির ঠেকটা ও অল্প-অল্প চিনতে পারছে। এই রাতের অন্ধকারে, এই বৃষ্টির মধ্যেও, সেটা চিনে নিতে ওর তেমন একটা অসুবিধে হবে না।

সুখরামের শরীরের নীচে ছেলেটা শান্তভাবে শুয়ে ছিল—শুধু বড়-বড় শ্বাস টানছিল। ওর চোখ সুখার হাতের ছুরিটার দিকে স্থির। ও বুঝতে পারছিল, ও বাঁচা-মরার সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আছে। তাই ভয়ার্ত চোখে শুধু অপেক্ষা করছিল।

ওকে বারবার জেরা করে সুখারাম একসময় নিশ্চিন্ত হল যে, ছেলেটা সত্যি কথাই বলছে। তখন ও বুঝল, ছেলেটাকে আর বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই। একইসঙ্গে ওর মাথার ভেতরে চোলি আর মা যেন চিৎকার করে কিছু একটা করতে বলছিল।

কিছুক্ষণ ধরেই বৃষ্টিটা কমে আসছিল। এখন হঠাৎই থেমে গেল।

সুখারাম মুখ তুলে আকাশের দিকে একবার দেখল। তারপর ছেলেটার দিকে।

এই ছেলেটা আরও অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারত।

আচমকা ছুরিটা ওর গলার পাশে চেপে ধরল সুখা। ছেলেটা ভয়ার্ত জন্তুর মতো আওয়াজ করে উঠল।

সুখা হিংস্র গলায় বলল, ‘হাঁ কর!’

ছেলেটা অবাক হয়ে গেল। সুখার দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল।

‘হাঁ কর সালা। নইলে নলি ফাঁক করে দেব!’

ছেলেটা ধন্দে থাকলেও চটপট হাঁ করল এবার।

সুখা ছুরিটা ওর গলার পাশ থেকে সরিয়ে এনে গলার নলির ওপর চেপে ধরল।

ছেলেটা ভয়ে কঁকিয়ে উঠল।

ওর মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ল সুখারাম। ছেলেটা চুপ করে সিঁটিয়ে আছে। বোধহয় বুঝতে পারছে সুখারাম এখন মানুষ নয়—কিলার রোবট। যে অকাতরে এক ছোবলে জামিয়াকে খতম করে দিয়েছে।

চোখের পলকে সুখারাম একটা কাণ্ড করে বসল। বাঁ-হাতে এক খাবলা কাদা-মাটি তুলে নিল। এবং সেটা থাবড়ে ঢুকিয়ে দিল ছেলেটার হাঁ করা মুখে।

ছেলেটা হাত-পা ছুড়ে হাঁসফাঁস করতে লাগল। সুখার হাত আঁকড়ে ধরল। ওর নখের আঁচড়ে সুখার হাত ছড়ে গেল। কিন্তু ততক্ষণে সুখা দ্বিতীয়বার মাটির খাবলা তুলে নিয়ে ছেলেটার মুখের ওপরে চাপড়ে দিয়েছে। আর একইসঙ্গে ছুরির কাঠের হাতলের ডগাটা হাতুড়ি পেটার মতো সজোরে বসিয়ে দিয়েছে শত্রুর বাঁ-রগে।

ছেলেটা এলিয়ে গেল। ওর ঝটাপটি স্তব্ধ হয়ে গেল। বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেল।

সুখারাম ওর নাক টিপে ধরল। ছুরি ফেলে দিয়ে আর-এক খাবলা মাটি ঠেসে দিল ওর মুখে। ঝটকা দিয়ে একবার কেঁপে উঠল ছেলেটার দেহ। তারপর আর নড়ল না—মৃতদেহ হয়ে গেল।

সুখারাম টের পায়নি, কখন যেন ও কাঁদতে শুরু করেছিল। ওর গাল গড়িয়ে চোখের জল নামছিল। ও ছেলেটার চুলের মুঠি ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাতে শুরু করল। আর কান্না ভাঙা গলায় আর্ত হাহাকার করে উঠল, ‘মা! মা রে! চোলি! আমার চোলি…।’

বৃষ্টি ভেজা রাত ছাড়া আর কেউ সুখারাম নস্করের বুক ফাটা কান্না শুনতে পেল বলে মনে হল না। কিন্তু সুখারাম কেঁদেই চলল।

একসময় ও মৃতদেহটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ছুরিটা হাতের মুঠোয়।

ওর মনে হল, প্রতিশোধের দুইয়ের পাঁচ অংশ শেষ হয়েছে—তিনের পাঁচ অংশ এখনও বাকি।

সুখারামের নিজের ওপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। একটা জিন ঢুকে পড়েছিল ওর শরীরের ভেতরে। সে-ই যেন অন্তর থেকে নির্দেশ দিয়ে ওকে নানান কাজ করতে বলছিল, ওকে দিয়ে যা খুশি করাচ্ছিল।

সেই জিনের নির্দেশেই সুখারাম এখন দৌড়চ্ছিল। ছুরিটা হাফপ্যান্টের হিপ পকেটে গোঁজা। চোয়াল শক্ত। চোখে মরিয়া এক প্রতিজ্ঞা। ওর পায়ের প্রতিটি পেশি সেই প্রতিজ্ঞার শরিক হয়ে একমনে নিজেদের কাজ করে চলেছে।

বৃষ্টি-ভেজা রাস্তায় ওর ছুটন্ত পায়ের শব্দ হচ্ছিল। সেই শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিধ্বনির মতো শব্দ শোনা যাচ্ছিল। যেন আরও একজন সুখার সঙ্গে-সঙ্গে সমান তালে দৌড়চ্ছে।

সুখারামের মনে হল, সেটা বরাট স্যার।

এ-কথা মনে হতেই ওর শিরা-উপশিরায় নতুন তেজের স্রোত বয়ে গেল। ও আরও জোরে ছুটতে লাগল। ওর নাক দিয়ে ফোঁসফোঁস করে শব্দ বেরোতে লাগল।

ছুটতে-ছুটতে সুখারাম খালধারের রাস্তায় চলে এল। আর একটু, আর একটু—তারপরই চলে আসবে পোড়া বস্তির এলাকা, তারপর বদনোয়াদের ঠেক। তারপর…

সুখারামের বুক লক্ষ্য করে বাতাস ছুটে আসছিল। বৃষ্টি ভেজা বাতাসে খাল থেকে ভেসে আসা দুর্গন্ধ।

খালের দিকে চোখ গেল ওর। কালো তেলচিটে জল। পাঁক আর যত রাজ্যের তরল আবর্জনায় অনেক ঘন আর ভারি হয়ে গেছে। রাস্তার কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট থেকে আলো ছিটকে পড়েছে সেখানে। চকচক করছে। সুখারামের মনে হল, খালটা যেন একটা মোটা কালো অজগর—ধীরে-ধীরে এঁকেবেঁকে গুড়ি মেরে এগিয়ে চলেছে। একটু পরেই শিকারকে ওটা গিলে নেবে।

ছুট, ছুট, ছুট।

পোড়া বস্তির এলাকায় ঢুকে পড়ল। এইবার বাঁ-দিকে, তারপর ডানদিকে পরপর দুবার।

ওই তো, সামনেই অন্ধকার বাতাবরণের মধ্যে একটা টিনের চালাঘর! মাপে বড়সড়। তবে তার দরজায় কোনও পাল্লা নেই। ভেতরে আলো জ্বলছে। কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তার সঙ্গে হাসির শব্দ। ফুর্তির মজলিশ বসেছে। বদনোয়া আর তার খুচরো চামচামণ্ডলী।

মরণাপন্ন অসহায় ছেলেটা যেমন-যেমন বলেছিল তার সঙ্গে দিব্যি মিলে যাচ্ছে। আর তার ওপরে আগমার্কা সিলমোহর বসিয়ে দিয়েছে ঘরের বাইরে হেলিয়ে দাঁড় করানো দুটো বাইক।

পা টিপে-টিপে ঘরের কাছে এগিয়ে গেল। আশেপাশে কেউ কোথাও নেই। কোনও শব্দ নেই। শুধু ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা ওদের কথাবার্তা—আর সঙ্গে হিন্দি ঝিনচ্যাক গান। বোধহয় মোবাইলে বাজছে।

দরজার ফোকর দিয়ে উঁকি মারতেই কয়েকটা গ্লাস আর দুটো বোতল দেখতে পেল। সেইসঙ্গে কয়েকটা হাত-পা। কিন্তু কারও মুখ দেখতে পেল না।

বুকের ভেতরে নানান শব্দ টের পাচ্ছিল সুখারাম। একটা ঢিপঢিপ শব্দ। তার সঙ্গে চোলির গুঙিয়ে ওঠা কান্না আর মায়ের চিৎকার করা তেজি প্রতিবাদের বিনুনি।

এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে বদনোয়ার গলা শোনা গেল।

‘জামিয়া আর পিল্লের কী হল রে? ওরা কি আনচাক্কা খোপে আশনাইয়ে লটকে গেল?’

ওই ছেলেটার নাম তা হলে পিল্লে! ভাবল সুখারাম।

বদনোয়ার এক শাগরেদের গলা শোনা গেল : ‘বারবার ফোন করছি—শুধু রিং হয়ে যাচ্ছে। মনে হয়, সালারা বিজি। যাকগে, যখন আসে আসবে। এসে দেখবে সব মাল খতম। তখন সালারা বোতল চাটবে।’

তারপরই খ্যা-খ্যা করে হাসি। আর কাচের গ্লাস কিংবা বোতলের ঠোকাঠুকির আওয়াজ।

ওরা কি কেউ ঘরের বাইরে আসবে না? যদি একজন-একজন করে শয়তানগুলো বাইরে আসে তা হলে খুব ভালো হয়। সুখারাম একে-একে ওদের মোকাবিলা করবে, একে-একে ওদের খতম করবে।

কিন্তু যদি না আসে?

দ্বিধা দ্বন্দ্বে কয়েক মিনিট কাটতে না কাটতেই দরজায় এসে দাঁড়াল ওদের একজন। চোখের ওপরে হাতের আড়াল দিয়ে দূরের রাস্তার দিকে তাকাল ছেলেটা।

ওর রোগা চেহারা। চুলগুলো খাড়া-খাড়া। ডান হাতে তিনটে জ্যোতিষী আংটি। বাঁ-হাতটা কনুইয়ের কাছে ধনুকের মতো কিছুটা বাঁকা। চোখ ঢুলুঢুলু। চোখের নীচে ছোট-ছোট পাউচ।

দেখেই বোঝা যায়, ছেলেটা কমপক্ষে শতকরা আশি ভাগ মাতাল হয়ে গেছে।

বেশ কিছুক্ষণ ফাঁকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা চেঁচিয়ে বলল, ‘নহী, বস—কোই নহী। না কোনও বাইক, না কোনও মানুষ!’

সুখারাম চালাঘরটার দেওয়াল ঘেঁষে ছেলেটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। হিপ পকেটের ছুরিটা কখন যেন ওর হাতে উঠে এসেছে। বুকের ভেতরের বিচিত্র শব্দগুলো আরও জোরালো হয়ে উঠেছে, আর একইসঙ্গে বিকৃত শোনাচ্ছে।

সুখার কান ভোঁ-ভোঁ করছিল। চোখের নজর ঝাপসা হয়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু ও মনের জোরে সেটাকে ঝাপসা হতে দিল না—ছেলেটার ওপরে ফোকাস করে রাখল।

বাইরের অন্ধকার সুখাকে সাহায্য করছিল, কিন্তু টিনের ফাঁকফোকর দিয়ে আলোর কয়েকটা বর্শা অন্ধকারকে অল্পবিস্তর চিরে দিয়েছিল।

সুখা চেয়েছিল, ছেলেটার সামনে আচমকা গিয়ে মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে উঠবে—কিন্তু বাস্তবে সেটা অল্পের জন্য হল না। ছেলেটার ছ’নম্বর ইন্দ্রিয় ওকে সাহায্য করল। শেষ মুহূর্তের ঠিক আগের মুহূর্তে ছেলেটা সুখারামকে দেখতে পেয়ে গেল।

সুখারামের হাত তখন শূন্যে। বুকের মধ্যে লকলকে আগুন। ঠোঁট সরে গিয়ে ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে এসেছে। ওর হাতে ছুরিটা ধরা না থাকলে মনে হত, ও বোধহয় দাঁত দিয়েই প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করবে। দাঁতই ওর প্রাকৃতিক ধারালো অস্ত্র। ভ্যাম্পায়ারের মতো।

ছেলেটা অবাক হয়ে যাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠল : ‘কওন হ্যায় বে তু?’

সুখারামের ছুরি ছেলেটার শেষ প্রশ্নের উত্তর দিল। বিদ্যুৎঝলকের মতো ছেলেটাকে বুকে ছোবল মারল। একবার—দুবার—তিনবার।

সুখার ছুরি ধরা হাতের সঙ্গে বুকের সংঘর্ষের দাপটে ছেলেটা যেন স্লো মোশানে পিছনদিকে হেলে পড়তে লাগল। তারপর একসময় চিত হয়ে পড়ে গেল চালাঘরের মেঝেতে। ওর আঁকুপাঁকু হাতের ধাক্কায় একটা গ্লাস আর বোতল ছিটকে গেল। মদের গন্ধের ঝাপটা ছড়িয়ে গেল বাতাসে।

ঘরের ভেতর থেকে বিকট চিৎকার শোনা গেল। তারপরই হুড়মুড় করে খসে পড়া ছেলেটার ওপরে ঝুঁকে পড়ল বদনোয়া আর ওর শাগরেদ।

সুখারাম দরজার বাইরে থেকে ওদের দেখতে পেল।

বুকে গাঁথা ছুরির বাঁটটা দেখেই বদনোয়া পলকে গল্পটা বুঝতে পারল। সঙ্গে-সঙ্গে পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের রিভলভারটা খামচে ধরল ও। তারপর ওরা দুজনে দরজা লক্ষ্য করে পা ফেলতেই সুখারাম ছুটতে শুরু করল। শুধু ছুট নয়—একেবারে হরিণের দৌড়। চালাঘরটার সঙ্গে ওর দূরত্ব প্রতি মুহূর্তে বেড়ে যাচ্ছিল।

সুখারাম বুঝতে পারছিল এখন কী হবে। বদনোয়া আর ওর শাগরেদ ছুটে এসে বাইকে উঠবে। বাইক স্টার্ট দিয়ে সুখারামকে ধাওয়া করবে। গুলি ছুড়বে। তারপর একসময়…।

ব্যাপারটা অনেকটা তাই হল।

দরজার কাছ থেকেই সুখারামের ছুটন্ত শরীরটা লক্ষ্য করে রিভলভার ফায়ার করল বদনোয়া। বোতলের কর্ক-ছিপি খোলার ‘প্লপ’ শব্দ হল। কিন্তু রাতের আড়ালে থাকা ‘মুভিং টারগেট’ সুখারাম নস্করকে সে-গুলি ছুঁতে পারল না।

বদনোয়া ছুটে গিয়ে বাইকে চড়ে বসল। বাইক স্টার্ট দিল। উৎকট শব্দ আর ধোঁয়ার ভলক। বাতাসে পোড়া গন্ধ। বাইকটা গুলতি থেকে ছোড়া গুলির মতো ছিটকে বেরিয়ে গেল।

বদনোয়ার সঙ্গী এক ঝটকায় ঘরের ভেতরে ঢুকেই আবার বেরিয়ে এল। ওর হাতে এখন অস্ত্র। প্রায় দেড়হাত লম্বা একটা সোর্ড। বোঝা গেল, এই অস্ত্রটা ব্যবহারেই ও অভ্যস্ত এবং দক্ষ।

বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বাইকের কেরিয়ারে সোর্ডটা কীভাবে যেন আটকে দিল ছেলেটা। তারপর বাইক স্টার্ট দিয়ে দৌড়। ও বুঝতে পেরেছে কে এই আততায়ী। এই খ্যাপা কুত্তাটাকে নিকেশ না করে নিস্তার নেই। যেভাবেই হোক শুয়োরের বাচ্চাটাকে এখুনি খতম করতে হবে।

ভাঙাচোরা রাস্তা। যেখানে সেখানে খানাখন্দ। জল জমে আছে। আকাশে থমথমে মেঘ। কোথাও কালো, কোথাও লালচে, কোথাও বা গাঢ় ছাই রঙের। মেঘের স্তর ভেদ করে চাঁদ কিংবা তারা চোখে পড়ছে না। মনে হচ্ছে, যে-কোনও সময় আবার বৃষ্টি নামতে পারে।

এবড়োখেবড়ো রাস্তায় বদনোয়ার বাইক লাফিয়ে-লাফিয়ে ছুটছিল। বাইকের হেডলাইট ওল্ড সিটির রাস্তায় সুখারামকে খুঁজছিল। কিন্তু ছুটন্ত কাউকে ও দেখতে পাচ্ছিল না।

রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। যে দু-একজনকে চোখে পড়ছে তারা নিশ্চয়ই সহজে-ভয়-পাওয়া ছাপোষা লোক নয়। কারণ, এত রাতে ওল্ড সিটির অলিগলি রাজপথে ছাপোষা লোকরা ঘুরে বেড়ায় না। যারা ঘুরে বেড়ায় তারা না-পোষা, বুনো, ভয়-দেখাতে-চাওয়া মানুষ।

বাইকের গর্জন এই নিশুতিতে খ্যাপা বাঘের গর্জনের মতো শোনাচ্ছিল। আর সেই গরজানো বাঘের পিঠে আরও একটা হিংস্র বাঘ বসে ছিল। বদনোয়া।

ওর রিভলভারটা প্যান্টের বাঁ-দিকের কোমরে গোঁজা। ওটা থেকে একটু আগে ফায়ার করা হয়েছে বলে এখনও গরম।

বেশ কিছুক্ষণ এ-রাস্তা সে-রাস্তায় ঘোরাঘুরির পর বদনোয়া একটা দেশি মদের ঠেকের কাছে বাইক থামাল।

তিনজন খদ্দের দোকানের বাইরে দেওয়াল ঘেঁষে বসে ছিল। তিনজনের মধ্যে দুজনের অবস্থা আলুথালু, নিয়ন্ত্রণহীন। হাত-পা এদিক-সেদিক ছড়ানো, মাথা একপাশে হেলে আছে।

আর-একজনের অবস্থা তুলনায় অনেক উন্নত। হাতে বোতল এবং গ্লাস। সে মাঝে-মাঝে রোবটের ঢঙে বোতল থেকে গ্লাসে তরল ঢালছে এবং গ্লাসটা একদম ঠিকঠাক নিজের ঠোঁটে পৌঁছে দিচ্ছে।

তার কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল বদনোয়া। কাঁধ ধরে রীতিমতো ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে সজাগ করল। তারপর হিন্দিতে সুখারামের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে ওর খোঁজ-খবর করতে লাগল। কিন্তু ছেলেটা বদনোয়ার সব প্রশ্নের উত্তরেই এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়তে লাগল।

একসময় বদনোয়া সোজা হয়ে দাঁড়াল। ডানপকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে নম্বর লাগাল।

‘ঝামসা, তু কঁহা হ্যায় রে?’

‘তেজানি মোড়ে এসেছি, বস…।’ ঝামসা জবাব দিল। ফোন বাজতেই ও বাইক থামিয়ে ফোন ধরেছিল। কিন্তু ওর চোখ চঞ্চলভাবে এদিক-ওদিক নড়ছিল। সুখারাম নস্কর নামে কুত্তাটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

‘কোনও খবর পেলি?’

‘না, বস। তবে এদিকটায় আসতে পারে। এখানে ছুপে যাওয়ার অনেক খোপ-খোপানি আছে। আমি ছানবিন করে রিপোর্ট দিচ্ছি—।’

বদনোয়া আপনমনে একটা খিস্তি দিল। ওর ভেতরে রাগ গরগর করছিল। এত বড় সাহস! বদলা নিতে বাঘের মুখের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে চাম্পুর বুকে ছুরি গেঁথে দেয়!

জামিয়া আর পিল্লের কথা ভেবে বদনোয়ার মনে কাঁটা খচখচ করে উঠল। ওরা এখনও ফিরল না কেন? এতক্ষণ ধরে একটাও ফোন করল না কেন? বদনোয়া আর ঝামসা যতবারই ফোন করেছে ওদের ফোন শুধু রিং হয়ে গেছে—কেউ ধরেনি।

‘ঝামসা, শোন, তুই মালটাকে দেখতে পেলেই আমাকে ফোন লাগাবি। আমি ঝটসে স্পটে চলে যাব। তারপর দুজনে মিলে যা করার করব। তুই একা কোনও রিস্ক নিবি না, সমঝা? মালটা খতরনাক আছে—।’

ঝামসা হাসল—আত্মবিশ্বাসের হাসি। তারপর বলল, ‘বেফিকর রহো, বস। সুখারামকে পেলে আমার দেড়-ফুটিয়া সোর্ড দিয়ে ওকে প্রথমে কিমা বানাব। তারপর তোমাকে তোফা দেব…।’

বদনোয়া হাসল না। আবেগহীন গলায় বলল, ‘সে যা-ই কর—আমাকে ফোন করবি…।’

চাপদাড়িতে আঙুল ঘষতে-ঘষতে বদনোয়া বাইকের দিকে এগোল। একটা ঢেঁকুর তুলল। একঝলক মদের গন্ধ বেরিয়ে এল। এই গন্ধ ওর খুব চেনা হলেও এখন গন্ধটাকে একটু অচেনা মনে হল।

মনে হল, এর মধ্যে মৃত্যুর গন্ধ মিশে আছে।

ঝামসা বাইক নিয়ে তেজানি মোড়ে ধীরে-ধীরে চক্কর কাটছিল। আর মনে-মনে হিসেব কষছিল, ও যদি সুখারাম হত তা হলে কোথায় গিয়ে গা-ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করত।

ঝামসা ঠান্ডা মাথার ছেলে—বদনোয়ার মতো রগচটা নয়। ও এ পর্যন্ত যা কিছু করেছে সবই ঠান্ডা মাথায় করেছে। লড়াইয়ের সময় সোর্ডটা যখন ও হাতে নেয় তখন ওর মনে হয়, সোর্ডটা কোনও আলাদা অস্ত্র নয়—বরং ওর ডানহাতটা যেন কোন এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় আরও দেড়-ফুট লম্বা হয়ে গেছে। যখন ঝামসা সোর্ড চালায়, তখন ওর মনে হয় ও হাত চালাচ্ছে। ব্যাপারটা ওর কাছে এতটাই সহজ আর স্বাভাবিক।

তেজানি মোড় থেকে দুটো চওড়া রাস্তা ‘ওয়াই’-এর মতো দু-দিকে এগিয়ে গেছে। তার মধ্যে একটা রাস্তা চলে গেছে ট্রাক টার্মিনালের দিকে। কী মনে হওয়াতে ঝামসা সেই রাস্তায় বাইক ছুটিয়ে দিল।

একটু এগোতেই রাস্তাটার চরিত্র পালটে গেল। ছেঁড়াখোড়া পিচের বদলে ইটের মাপের কালো পাথরের টুকরো শুরু হল। যেহেতু এ-রাস্তায় বেশিরভাগ সময় ভারী-ভারী ট্রাকের আনাগোনা, তাই এই ব্যবস্থা।

রাত দেড়টা বেজে গেছে। রাস্তায় লোকজন কেউ নেই। লাইটপোস্টের নিস্তেজ আলোয় ফাঁকা রাস্তাটা আরও বেশি ফাঁকা লাগছে।

ঝামসা বাইকের গতি কমাল। ধীরে-ধীরে এগোতে লাগল। আর একইসঙ্গে চারপাশে চোখ বোলাতে লাগল।

রাস্তার ধারে নানান ধরনের ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। কোনওটা খালি, কোনওটা ভরতি। লোড করা মালের ওপরে তেরপলের ছাউনি আর নাইলন-দড়ির বাঁধুনি। ট্রাকগুলোর ফাঁকফোকরে অন্ধকার।

চালাঘর থেকে বাইক নিয়ে রওনা হওয়ার পর থেকে সুখারামের খোঁজে ঝামসা এর মধ্যে অনেক এলাকাতেই ঘুরে বেড়িয়েছে। যেটা ওর জানা ছিল না, সুখারামও ওকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অথবা বদনোয়াকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

সুখারাম একসঙ্গে ওদের দুজনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে চায়নি। কারণ, তা হলে প্রতিশোধের দুইয়ের পাঁচ অংশ অপূর্ণ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই সুখারাম একের পাঁচ অংশের ইনস্টলমেন্টে কাজটা শেষ করতে চাইছিল। তবে ইনস্টলমেন্ট হিসেবে বদনোয়া কিংবা ঝামসা নিয়ে ওর মধ্যে কোনও বাছবিচার ছিল না।

এ ছাড়া কিছুটা সময়ও সুখারাম হাতে চাইছিল—আর চাইছিল একটা অস্ত্র।

ঝামসা রাস্তা ধরে আরও এগোচ্ছিল। চোখে সতর্ক অনুসন্ধানী দৃষ্টি। ও জানে, সুখারামের কাছে রিভলভার নেই। তাই চাম্পুকে ও দূর থেকে গুলি করেনি। ছুরি হাতে নিয়ে নিতান্ত দু:সাহসে বিপদসীমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

সেই ছুরিটাও গেঁথে আছে চাম্পুর বুকে। সুতরাং, ছেলেটার কাছে এখন কোনও অস্ত্র নেই।

এইসব অঙ্ক কষতে-কষতেই ঝামসা একটা ঘেরা এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

বারো ফুট উঁচু লোহার জাল দিয়ে ঘেরা বিশাল এলাকা। তার কোথাও-কোথাও জাল জং ধরে ছিঁড়ে গেছে। দরজা হয়তো এককালে ছিল—এখন সেখানে বিশ ফুট চওড়া হাঁ—কোনও পাল্লা নেই।

ঘোরা এলাকার একপ্রান্তে, অনেকটা দূরে, কয়েকটা ভাঙাচোরা ট্রাক দাঁড়িয়ে। তার পাশে টিনের চালে ছাওয়া কয়েকটা তালিমারা ঘর। ছিরিছাঁদহীন ঘরগুলো এ-ওর গায়ে হেলে আছে। কোনওটার চাল ভাঙা, কোনওটার বা দেওয়াল নেই।

ঘরগুলোর পাশে টিনের ড্রামের পাহাড়। তাদের তিনটে চূড়া দূর থেকেই চোখে পড়ছে।

ঝামসা ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জাল ঘেরা এলাকাটা দেখতে-দেখতে পেরিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎই পিছন থেকে কে ওকে ডাকল।

‘এই সালা, সুয়ার কা বাচ্চা!’

বাইক থামাল ঝামসা। শব্দ লক্ষ্য করে মাথা ঘোরাল।

সুখারাম নস্কর।

বাইকের ইঞ্জিনের আওয়াজ সুখারাম একটু আগেই শুনতে পেয়েছে। তখনই ওর এলোমেলো খোঁজ শেষ হয়েছে। বুঝতে পেরেছে, ঘটনাচক্রে ওরা দুজন শত্রু কাছাকাছি চলে এসেছে।

এবার একের পাঁচ অংশের যুদ্ধ।

সুখারামের হাতে একটা ইট। আরও ভালো করে বলতে গেলে ইটের মাপের একটা পাথর। এটাই ওর অস্ত্র। পাথুরে রাস্তার পাশ থেকে ও কুড়িয়ে নিয়েছে।

ঝামসা সুখারামের ছায়া-ছায়া কালো চেহারাটা ভালো করে ঠাহর করে ওঠার আগেই সুখারাম হাতের ইটটা উঁচিয়ে ঝামসাকে লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করেছে।

ঝামসা বাইক থামালেও ইঞ্জিন বন্ধ করেনি। সুখারাম কী করতে চলেছে আঁচ করে ও এক হ্যাঁচকায় বাইকটাকে সামনে এগিয়ে দিল, আর একইসঙ্গে মাথা নীচু করল। কারণ, ছুটন্ত অবস্থাতেই সুখা হাতের অস্ত্রটাকে ছুড়ে দিয়েছে।

ইটটা ঝামসার গায়ে লাগল না। লোহার জালে গিয়ে লাগল। তারপর পাথুরে জমিতে ছিটকে পড়ল। শব্দ করে দুবার লাফিয়ে তারপর থামল।

সুখারামের ভেতরে একটা অপার্থিব রাগ গরগর করছিল। ঝামসাকে যেমন করে হোক বাইক থেকে ফেলে দিতে পারলেই ওর অর্ধেক কাজ হাসিল হয়ে যাবে। তারপর…।

সুখা ছুটতে শুরু করল। এখন কী করবে ও? কী করবে?

পিছনে বাইকের আওয়াজ পেল। ঝামসা তাড়া করে আসছে। কিন্তু সামনেই লোহার জালের দেওয়াল। ডানদিকে ঘুরে দৌড়তে পারলে বোধহয় ভালো হত। ওই ভাঙাচোরা ট্রাকগুলোর কাছে পৌঁছতে পারলে হয়তো কোনও অস্ত্র খুঁজে পাওয়া যেত—লোহার কোনও রড বা গাড়ির পার্টস।

তাই ডানদিকে বাঁক নিল সুখারাম। আর তখনই দেখতে পেল ঝামসা দূরে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বাইকের ইঞ্জিন গরগর করছে।

ঝামসার কোনও তাড়া ছিল না। ও বুঝতে পারছিল, সুখারাম নস্কর জাল ঘেরা খাঁচায় বন্দি—তা সে-খাঁচা যতই বড় হোক না কেন। এই খাঁচা থেকে বেরোতে হলে ঝামসার বাইকের পাশ দিয়েই ওকে বেরোতে হবে।

ঝামসার ফোন বাজছিল। পকেট থেকে ফোন বের করে নম্বরটা দেখল ও।

বদনোয়া।

হাসল ঝামসা। ওর হাতে এখন খুব জরুরি কাজ। ওই হারামির পিল্লাটাকে কিমা বানাতে হবে। এখন কেউ ওকে ডিসটার্ব করুক ঝামসা চায় না।

বদনোয়ার কল কেটে দিয়ে মোবাইল ফোনের সুইচ অফ করে দিল ঝামসা। আগে কাজ পরে ফোন।

সুতরাং, বাইকের কেরিয়ার থেকে সোর্ডটা ডান হাতে তুলে নিল। শরীর এবং হাত ঝুঁকিয়ে সোর্ডের ডগাটা মাটিতে ঠেকাল। তারপর বাইক ছুটিয়ে দিল সুখারামকে লক্ষ্য করে।

ঝামসার সোর্ডের ডগাটা পাথরে ঘষা খাচ্ছিল। ছুরিতে শান দেওয়ার সময় শানপাথর থেকে যেমন আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরোয়, ঝামসার সোর্ডের ডগা থেকে ঠিক সেরকম আগুনের ফোয়ারা ছিটকে বেরোচ্ছিল। আর শিকার ধরার আনন্দে ঝামসার চোখে-মুখে নৃশংস উল্লাসের জ্যোতি ধকধক করছিল।

সুখারাম দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ওই তো, ঝামসার মোটরবাইক ওর দিকে ধেয়ে আসছে! তার পাশে-পাশে আগুনের ফুলকির রেখা এঁকে দিচ্ছে ঝামসার সোর্ড! এখন কী করবে সুখা?

বাইকটা যখন খুব কাছে এসে পড়েছে তখন সুখারাম জাল লক্ষ্য করে বনবেড়ালের মতো লাফ দিল। জালের তার আঁকড়ে ধরে টিকটিকির মতো ক্ষিপ্রতায় তরতর করে কয়েক ফুট ওপরে উঠে গেল।

আর ঠিক তার পরের মুহূর্তেই ঝামসার বাইক তারের জালে এসে ধাক্কা খেল। সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়ায় ঝামসা বাইকসমেত ছিটকে পড়ল। নেহাত কপালজোরে বাইকের নীচে ওর পা চাপা পড়ল না।

ছিটকে পড়ে গেলেও সোর্ডের হাতল ঝামসার শক্ত মুঠোয় ধরা দিল। পাথুরে মেঝেতে শোওয়া অবস্থাতেই ও দেখতে পেল, সুখারাম জাল ছেড়ে লাফিয়ে পড়েছে নীচে। তারপর তাড়া খাওয়া ইঁদুরের মতো ছুট লাগাল।

ঝামসার পাশ দিয়ে সুখা ছুটে পালানোর সময় পেশাদার খুনি ঝামসা শুয়ে-শুয়েই সোর্ড চালিয়ে দিল—যদি শুয়োরের বাচ্চাটাকে নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়।

না, পাওয়া গেল না।

তাই ঝামসা লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। কাত হয়ে পড়ে থাকা বাইকটার পিছনের চাকা তখনও ধীরে-ধীরে ঘুরছিল। সেটাকে টান মেরে তোলার জন্য হাতের সোর্ডটা আড়াআড়িভাবে দাঁতে কামড়ে ধরল। তারপর বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে তাতে সওয়ার হয়ে বসল।

স্টার্ট। গর্জন। ছুট।

সুখারাম তখন টিনের ড্রামের পাহাড়ের দিকে ছুটেছে। ওর শরীর ক্লান্ত, নাক দিয়ে ফোঁসফোঁস করে শ্বাস বেরোচ্ছে, খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। কিন্তু বুকের ভেতরের জ্বালা, রাগ, আর জেদ সবকিছু চাপা দিয়ে দিয়েছে।

তাই সুখারাম, লং ডিসট্যান্স রানার, দৌড়চ্ছে।

ঝামসার বাইক গোঁ-গোঁ করে ছুটে আসছিল। সোর্ডের ইস্পাতের ফলা পাথরে ঘষা খেয়ে আগুনের ফুলকির রেখা এঁকে চলেছে। অন্ধকারে সেটাকে ছুটন্ত তারাবাজি বলে মনে হচ্ছে।

সুখারাম ড্রামগুলোর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। তারপর পাগলের মতো একটা হাতিয়ার খুঁজছিল।

ড্রামগুলো সার বেঁধে শোয়ানো। একটা সারির ওপরে আর-একটা। তার ওপরে আবার একটা। সারিগুলো যত ওপরে উঠছে ততই একটা করে ড্রাম কমছে। সবমিলিয়ে একটা প্রকাণ্ড ত্রিভুজের চেহারা নিয়েছে।

জায়গাটা তেলচিটে, পিছল। ড্রামগুলোও তাই। বোধহয় ওগুলো পোড়া মোবিল চালানের কাজে ব্যবহার করা হয়।

জাল ঘেরা এলাকার বাইরে দুটো ল্যাম্পপোস্টে বালব জ্বলছে। সেই আলোর সামান্য ছটা নেহাতই দয়া করে ড্রামগুলোর আশেপাশে ছিটকে এসে পড়েছে। সেই আলোকে আঁকড়ে ধরে সুখারাম মাথা ঝুঁকিয়ে নজর চালাচ্ছিল।

কোথায় হাতিয়ার? কোথায়?

তাড়াহুড়োয় ইটের মাপের একটা কালচে পাথর খুঁজে পেল সুখা। কিন্তু ওটা হাতে তুলে নেওয়ার আগেই ঝামসার বাইক কাছে চলে এল।

সুখারাম বাইকের আওয়াজ পাচ্ছিল, চোখের কোণ দিয়ে আলোর ফুলকি দেখতে পাচ্ছিল, আর ছুটন্ত বাইকটাকে কীভাবে যেন অনুভবও করতে পারছিল।

ও চকিতে ড্রাম বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। তিনটে ড্রামের জোটে একটা করে ছোট ত্রিভুজের মতো ফাঁক তৈরি হয়েছে। সেইসব খাঁজে থাবা আঁকড়ে, পায়ের পাতা ঢুকিয়ে ও সরীসৃপের মতো ওপরে উঠে গেল। আর ঝামসা ওকে লক্ষ্য করে সোর্ড চালাল।

সুখার পিঠে কেউ যেন আগুনের রেখা টেনে দিল। জ্বালা-পোড়া যন্ত্রণায় ওর পিঠের প্রতিটি পেশি কুঁকড়ে গেল। মুখ দিয়ে আহত জন্তুর গোঙানি বেরিয়ে এল। ঝামসার সোর্ড ওর নাগাল পেয়ে গেছে।

কিন্তু একইসঙ্গে ড্রামের পাহাড় নড়ে উঠল।

কারণ, সুখারামকে কিমা বানানোর নেশার ঘোরে ঝামসা এতই মাতাল ছিল যে, বাইকের সঙ্গে ড্রামের পাহাড়ের দূরত্ব যে বিপজ্জনকভাবে কমছে সেটা আর খেয়াল করেনি।

তাই ড্রামের স্তূপের সঙ্গে ওর ছুটন্ত বাইকের জোরালো সংঘর্ষ হল। বাইকের ধাক্কায় খালি ড্রামগুলোয় শুধু যে প্রচণ্ড শব্দ হল তা-ই নয়, তিনটে ড্রামকে সঙ্গে নিয়ে ঝামসার বাইক ড্রামের পাহাড়ের নীচে গুঁতিয়ে ঢুকে গেল। ফলে ওপরের ড্রামগুলো হুড়মুড় করে নীচে পড়তে লাগল। মেঘ ডাকার মতো গুড়গুড় শব্দ হতে লাগল।

একটা ড্রামের ঢাকনার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঝামসার মুখ থেঁতলে গিয়েছিল। ওর কপালটা বাড়ি খেয়েছিল ড্রামের শক্ত গোল কানায়। ফলে ও যখন বাইক থেকে ছিটকে পড়ল তখন ওর কপাল ফেটে বীভৎসভাবে রক্ত পড়ছে। নাক-মুখ থেবড়ে গেছে। একটা দাঁত খসে গিয়ে মাড়ি থেকে কাঁচা রক্ত বেরোচ্ছে।

ঝামসা কোনও যন্ত্রণা টের পাচ্ছিল না, কারণ সংঘর্ষের সঙ্গে-সঙ্গেই ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। ওর মুখ-চোখ লাল রঙে মাখামাখি। ও চিত হয়ে তেলচিটে জমির ওপরে পড়ে ছিল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে দেড়ফুট সোর্ডটা তখনও ওর হাতের মুঠোয় ধরা।

সংঘর্ষের পর সুখারাম কাত হয়ে পড়তে-পড়তেও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ওর হাতের থাবা সেরকম কিছু আঁকড়ে ধরতে পারেনি। তাই হাঁচোড়-পাঁচোড় করে কোনওরকমে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করতে-করতে ও নীচে খসে পড়ল। অল্পের জন্য ওপর থেকে গড়িয়ে পড়া ড্রাম সরাসরি ওর মাথায় এসে লাগল না।

সুখারাম চিতপাত হয়ে পড়েছিল পাথুরে জমিতে। তারপর কিছুক্ষণ ওর আর কিছু মনে নেই।

একটু পরে চোখ যখন খুলল তখন ওর নজর গেল কালো আকাশের দিকে। আবার সেখানে মেঘ জমছে। তারারা একে-একে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

মাথার পিছনটা ব্যথা করছিল। দপদপ করছিল। একইসঙ্গে ডানহাতের ডানার কাছটায় ব্যথা। ডান পায়েও ব্যথা টের পাওয়া যাচ্ছে। গায়ে ড্রামের তেল-কালি লেগে আছে।

ভগবানকে মনে-মনে ধন্যবাদ দিল সুখারাম, কারণ তিনি বেশিক্ষণের জন্য ওকে অজ্ঞান করে রাখেননি। সেটা হলে যে-কাজটা এখন ওর করার কথা সেই কাজটা বাকি থেকে যেত : আরও একের পাঁচ অংশের সেটলমেন্ট।

শুয়ে-শুয়েই পাশ ফিরে তাকাল।

ঝামসা পড়ে আছে—রঙিন ন্যাকড়া দিয়ে তৈরি পুতুলের মতো। কপাল-মুখ সব রক্তে মাখামাখি। অস্ত্রটা হাতের মুঠোয় ধরা।

সুখারাম উঠে বসল। তখন বুঝল, ওর শরীরের ব্যথাগুলো গ্রাহ্য করার মতো বিরাট কিছু নয়। তার ওপর মা আর চোলির ডাক শুনতে পেল ও। একটা ধাতব টানেলের মধ্যে দিয়ে ওদের ফাঁপা চিৎকার প্রতিধ্বনি তৈরি করতে-করতে ছুটে আসছে।

সুখারাম উঠে দাঁড়াল। ভূতগ্রস্ত রোবটের মতো ঝামসার কাছে এগিয়ে গেল। ঝুঁকে পড়ে দেড়ফুট সোর্ডটা ঝামসার অসাড় হাতের মুঠো থেকে এক হ্যাঁচকায় ছাড়িয়ে নিল। তারপর সোর্ডটাকে শূন্যে তুলে ঝামসার দেহটা নেই ভেবে ওটা সোজা গেঁথে দিল পাথরের জমিতে। একবার নয়—চার বার।

ঝামসা অজ্ঞান হয়ে ছিল বলে মরণ-ঝাটকা দিতে পারল না, কিন্তু সুখারাম বুঝল, একের পাঁচ অংশের সেটলমেন্ট হয়ে গেছে।

ঝামসার পকেট হাতড়ে মোবাইল ফোনটা বের করে নিল। ওটা একবার দেখে নিয়ে পকেটে ঢোকাল। এবার মোটরবাইকটা দরকার।

তাই হাতের সোর্ড মেঝেতে নামিয়ে রেখে বাইকটার দিকে নজর চালাল সুখারাম। ড্রামের জটলার ভেতরে বাইকটা কাত হয়ে আটকে আছে। বাইকের ইঞ্জিন এখনও চাপা গর্জনে গরগর করছে।

একটা-একটা করে ড্রাম সরিয়ে বাইকের কাছে গেল। ঝুঁকে পড়ে বাইকের হাতল চেপে ধরল। সঙ্গে-সঙ্গে পিঠের জ্বালাটা চারগুণ হয়ে গেল। কিন্তু সুখারাম সেটা ভ্রূক্ষেপ করল না। কারণ, বুকের জ্বালাটা এখনও এর শতগুণ।

অনেক কসরত করে বাইকটাকে বাইরে টেনে নিয়ে এল। এর আগে বারকয়েক ও বন্ধুবান্ধবের বাইক চালিয়েছে। সাইকেল চালানো দিয়ে ওর বালক-জীবন শুরু হয়েছিল। তারপর সময়ে-সময়ে বাইক চেখে দেখার সুযোগ হয়েছে। একসময় শখ করে পাঁউরুটি-বিস্কুটওয়ালাদের সাইকেল-ভ্যান দুষ্টুমি করে চালিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ওপরওয়ালার দুষ্টুমিতে সেই সাইকেল-ভ্যান চালানোটাই পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজ আবার ও একটা গোটা মোটরবাইক হাতে পেয়েছে। এবার শুধু বদনোয়াকে হাতে পাওয়া বাকি।

সোর্ডটা বাইকের কেরিয়ারে আটকে দিয়ে বাইকে চড়ে বসল। তারপর কয়েক সেকেন্ড কী চিন্তা করে ঝামসার মোবাইলটা অন করে খুটুর-খাটুর করতে লাগল। বদনোয়ার ফোন-নম্বরটা ওর দরকার।

দু-চারবার বোতাম টিপতেই ফোন-নম্বরটা মোবাইল ফোনের পরদায় ভেসে উঠল।

সুখারামের রগের কাছে একটা শিরা দপদপ করছিল। রক্তের কণাগুলো পাগলের মতো ছুটোছুটি করছে। ওদের খিদে পেয়েছে, তেষ্টা পেয়েছে।

‘ডায়াল’ বোতামটা টিপল সুখা। ‘কলার টিউন’-এর ঝিনচ্যাক হিন্দি গান বেজে উঠল। গান দু-লাইন বাজতে না বাজতেই বদনোয়া ফোন ধরল।

‘কেয়া রে? সালে কা কুছ পতা চলা?’

‘হাঁ, বস—।’ মুখের কাছে কয়েকটা আঙুল রেখে একটু চাপা গলায় জবাব দিল সুখা। আঙুলের গরাদে ধাক্কা খেয়ে সুখারামের গলার স্বর খানিকটা বদলে গেল। তা ছাড়া গলা চেপে কথা বলায় বদনোয়া ওকে ঝামসা বলে ভুল করল।

‘কাঁহা? কাঁহা হ্যায় উও গিদ্ধর কি আওলাদ?’ বদনোয়ার গলা থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরোচ্ছে।

‘সালে কো জিন্দা লেকে আ রহা হুঁ—’ জড়ানো চাপা গলায় বলল সুখা। কায়দা করে তার সঙ্গে একটু হাঁপানির হাঁসফাঁস জুড়ে দিল। তারপর : ‘তুম কাঁহা হো, বস?’

‘আমি টাওয়ার কোম্পানির গোডাউনের কাছে—খালধারে…।’

জায়গাটা সুখারামের চেনা।

পোড়া বস্তি থেকে খালধার বরাবর দেড় কি দু-কিলোমিটার উত্তরদিকে টাওয়ার নামে একাট বিয়ার কোম্পানির অফিস ছিল। তার পাশেই ছিল ওদের বিশাল গোডাউন।

সবই ‘ছিল’, কারণ এখন আর কিছুই নেই। বছর দশেক আগে ওই গোডাউনে আগুন লাগে। সেই দাউদাউ আগুন সব গিলে ফেলেছিল। তারপর থেকে শুধু গোডাউনটার পোড়া কংকাল পড়ে আছে। শোনা যায়, গোডাউনের ওই কংকালের ভেতরে মানুষের কয়েকটা পোড়া কংকাল থাকলেও থাকতে পারে। রাতে ওটার পাশ দিয়ে গেলে নাকি এখনও আগুনে পোড়া মানুষের চিৎকার শোনা যায় আর মাংস পোড়া কটু গন্ধ পাওয়া যায়।

‘ও. কে., বস—।’ বলে ফোন কেটে দিল সুখারাম। বাইকে স্টার্ট দিয়ে ক্লাচ চেপে গিয়ার দিল। বাইক ছুটতে শুরু করল।

সুখারামের বড় অদ্ভুত লাগছিল। মুখে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা, পিঠে জ্বালা, মাথায় আগুন, বুকে প্রতিশোধের বিষ, অথচ মনটা ঠান্ডা ইস্পাতের মতো শান্ত।

শরীরটা ক্লান্ত হলেও সুখারাম রোবটের মতো একগুঁয়েভাবে শরীরটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

কোথায় তুই, বদনোয়া? কোথায়?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *