পর্ব – ১১
জিপিসির গেস্টহাউস থেকে নীচে নেমে এল জিশান। তিনজন গার্ডের সঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে গেল একটা কিউ-মোবাইলের দিকে।
গাড়িতে একজন পাইলট স্টিয়ারিং-এর সামনে বসেছিল। তার পাশে জিশানকে বসিয়ে একজন গার্ড জিশানের বাঁ-পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল। আর বাকি দুজন পিছনে। ওরা সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ির চারটে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি চলতে শুরু করল।
জিপিসি-র ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে কিউ-মোবাইল ছুটে চলল। গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ইলেকট্রনিক প্যানেলের দিকে তাকাল জিশান। ডিজিটাল ঘড়িতে দুটো দশ। তার পাশেই বসানো ছোট টিভির পরদায় রক ব্যান্ডের লাইভ শো দেখানো হচ্ছে।
গন্তব্যের খুব কাছাকাছি এসে পড়ার পর জিশান বিল্ডিংটাকে চিনতে পারল : সিন্ডিকেট হেডকোয়ার্টার। এত রাতেও বহুতল বিল্ডিংটার নানান ফ্লোরে আলো জ্বলছে। আগেই জিশান শুনেছিল, এখানে প্রায় সব অফিসেই নাইট শিফটে কাজ হয়।
গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এর দিকে এগোল ওরা।
রাতের বাতাস কেটে শিসের শব্দ শুনতে পেল জিশান। মাথা তুলে ওপরে তাকাল।
দুটো শুটার বাঁক নিয়ে ছুটে গেল আকাশে। বোধহয় রাতে ওরা নিউ সিটির আকাশে টহল দেয়। নজরদারির কাজ করে। হয়তো ওই শুটার থেকেই কোনও টহলদার গার্ড জিশানের নাইট সাফারির কথা জানতে পেরেছে—তারপর শ্রীধর পাট্টাকে খবর দিয়েছে।
বিল্ডিং-এর ভেতরে ঢুকে পড়তেই শীতাতপ পরিবেশে উষ্ণতা বেশ কয়েক ডিগ্রি নেমে গেল। অথচ গ্রানাইট, কাচ, প্লাস্টিক আর স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি আধুনিকতম সব ঘর আর বারান্দার নকশা। অথচ চারপাশে তাকালে কেমন যেন নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক ভাব।
জিশান লক্ষ করল, করিডরে লোক চলাচল দিনের তুলনায় বেশ কম। তবে যে-ক’জন গার্ডকে নজরে পড়ল তারা সকলেই একইরকম স্মার্ট এবং ওদের কোমরে ঝোলানো শকার একইরকম সক্রিয়।
প্রথমে ভার্টিকাল এলিভেটর। তারপর হরাইজন্টাল এলিভেটর। তাতে ওঠার পর একজন গার্ড ডিজিটাল প্যানেলে কো-অর্ডিনেট পাঞ্চ করল। এক্স-ওয়াই স্থানাঙ্ক পাওয়ামাত্রই মসৃণ এলিভেটর নি:শব্দে গন্তব্যে ছুটে চলল।
জিশান কোনও কথা বলছিল না। গার্ড তিনজনও চুপচাপ। ঠিক যেন কারও মৃত্যুশোকে নীরবতা পালন চলছে। বোধহয় শোকের ঘটনার আগেই স্মরণসভা শুরু হয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত জিশানকে যেখানে নিয়ে আসা হল বেশ বড় মাপের একটা দরজার সামনে। গার্ড তিনজন দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ল। ইশারায় জিশানকে ভেতরে ঢুকতে বলল।
কপালে-যা-থাকে-থাক ভেবে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল জিশান।
একটা বিশাল হলঘর। ঘরের একপ্রান্তে অদ্ভুত জ্যামিতিক চেহারার একটা কনফারেন্স টেবিল। তাকে ঘিরে পাঁচটা চেয়ার।
একটা চেয়ারে বসে আছেন অবশ্যই শ্রীধর পাট্টা। পরনে ধবধবে সাদা পোশাক। সোনালি বোতাম। বুকপকেটের ওপরে জ্বলজ্বলে নীল হলোগ্রাম।
এই রাত আড়াইটের সময়েও মানুষটার শরীর চাবুকের মতো টান-টান, গিরগিটির মতো সজাগ।
জিশানকে দেখামাত্রই উঠে দাঁড়ালেন শ্রীধর। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললেন, ‘ওয়েলকাম, জিশান—ওয়েলকাম…।’
জিশান মানুষটার দিকে একবার তাকাল শুধু—কোনও কথা বলল না। লোকটার ফরসা মসৃণ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সাদা মার্বেল পাথরে খোদাই করা এক কুৎসিত ভাস্কর্য।
শ্রীধরের দুপাশের দুটো চেয়ারে বসেছিল দুজন পুরুষ। ডানদিকে যে বসেছিল তার বয়েস পঞ্চাশ-টঞ্চাশ গোছের হবে। তামাটে রং, মাথায় টাক, চোখে চশমা, ভাঙা চোয়াল, থুতনিতে সামান্য দাড়ি।
আর শ্রীধর পাট্টার বাঁ-দিকের লোকটির বয়েস প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। মাঝারি রং, অসম্ভব রোগা, মাথার সাদা চুলগুলো এলোমেলো—দেখে মনে হয় চিরুনির সঙ্গে ওদের বহুকাল দেখা নেই। লম্বা খাড়া নাক, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা, নাকের নীচে পাতলা সাদা গোঁফ।
দুজন মানুষকে দুরকম দেখতে হলেও ওদের মধ্যে একটা মিল খুঁজে পেল জিশান : দুজনের চোখেই ঘুম-ঘুম ভাব।
হঠাৎই হাততালি দিলেন শ্রীধর—পরপর দুবার। হাসলেন। ছড়া কেটে বললেন, ‘এসো, জিশান—গুড বয়/করো এদের সঙ্গে পরিচয়।’
হাততালির শব্দেই শ্রীধরের দিকে মুখ ফিরিয়েছিল জিশান। শ্রীধর টাকমাথা লোকটির দিকে হাতের ইশারা করে বললেন, ‘গণপত আচারিয়া। আমাদের সিন্ডিকেটের দু-নম্বর সায়েন্টিস্ট। গ্রেট ইনভেন্টর। তবে…’ এবার বাঁ-দিকের মানুষটার দিকে ইশারা করে : ‘ইনি হলেন আমাদের এক নম্বর সায়েন্টিস্ট। মনসুখ চক্রপাণি। গ্রেট, গ্রেটার, গ্রেটেস্ট ইনভেন্টর। নিউ সিটির বিজ্ঞানদেবতা।
‘এই দুজনের কাছে, জিশান, সবরকম কোশ্চেনের আনসার রয়েছে। তাই ডক্টর আচারিয়াকে আমি ”কোশ্চেন” বলে ডাকি, আর প্রফেসর চক্রপাণির আমি নাম দিয়েছি ”আনসার”। ওঁরা দুজন যদি একজোট হন তা হলে সব কোশ্চেনেরই আনসার পাওয়া যায়। তাই সংক্ষেপে ওঁদের আমি ”কিউ” আর ”এ” বলে ডাকি…।’