Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তুলির ছোঁয়া || Mallik Kumar Saha

তুলির ছোঁয়া || Mallik Kumar Saha

তুলির ছোঁয়া

মেলা শেষ করিয়া বাড়ীতে ফিরার পালা। কালবিলম্ব না করিয়া একহাতে ব্যাগ আর অপর হাতে লণ্ঠন লইয়া যদুনাথ ধীর পায়ে রওনা দিলেন। দিনের বেলায় এই পথে দ্রুত পা ফেলিয়া যাইতে পারিলেও রাত্রের এই অন্ধকারে তাহা মোটেও সম্ভবপর নয়। উঁচুনীচু পাহাড়ের সংকীর্ণ পথ ধরিয়া ধীরভাবে চলাই শ্রেয়। নির্জন পথে জোনাকী পোকার আলোকে পথের অন্ধকার কিঞ্চিত পরিমানে দূর হইলেও বুকের ভিতর এক অজানা সংশয় বিরাজমান। এইভাবে দীর্ঘপথ অতিক্রম করার পর পথের ধারে কয়েকটি কুটির দেখিতে পাইলেন। সেই কুটিরের সম্মুখে কয়েকজন লোককে একত্রে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া যদুনাথের বুকে একটু সাহসের উদয় হইল। মনে ভাবিলেন গ্রীষ্মকালের প্রচন্ড তাপে তাহারা বোধকরি গাছের নীচে বসিয়া শীতল বাতাসে শরীর স্নিগ্ধ করিতেছে।

এমন সময় এক পুরুষ মানুষের কণ্ঠস্বর তাহার কানে আসিল — “এত রাত্রে এই নির্জন পথে আপনি কে?”

যদুনাথ একটু কাছে আসিয়া লোকটির মুখমন্ডলে দৃষ্টি রাখিয়া নিজের পরিচয় দিলেন এবং সেই সঙ্গে এই নির্জন পথ চলার কারণও জানাইলেন।

যদুনাথের সরল হৃদয়ের পরিচয় পাইয়া লোকটি তাহাকে নিজের কুটিরে রাত্রিযাপন করার জন্য আহ্বান জানাইলে তিনি প্রথমত একটুখানি সঙ্কোচ বোধ করিলেন বটে, কিন্তু পর মুহূর্তেই দরিদ্রের এই কুটিরে রাত্রিযাপন করিতে মনস্থির করিলেন। কুটিরে প্রবেশ করিবামাত্রই লোকটিকে আর দরিদ্র বলিয়া মনে হইল না। সমস্ত ঘরখানি নানাবিধ আকর্ষণীয় শিল্পকলায় খচিত। কি আশ্চর্য! একে একে সব যেন মিলিয়া গেল। গাছের ডালে বসিয়া থাকা টিয়াপাখীটি, দরজার উপরে গণেশ ঠাকুরের ছবিটি, সবুজ পাতার আবরণে সুদীর্ঘ কালো চুলের সেই পাহাড়ী মেয়েটির ছবি যেন তুলির ছোঁয়ায় একেবারে জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে। তাহা হইলে কি উত্তরা এই বাড়ীর বউ হইয়া আসিয়াছে ? না অন্য কেউ এইসব আঁকাইয়া রাখিয়াছে? জলের মাছটি যেমন বাধা পরিয়া ছটফট্ করিতে থাকে তেমনি কল্পনার সাগরে যদুনাথের মনটি উথল – পাথল করিতে লাগিল।

সেই কবেকার কথা— গ্রাম্য বালিকা উত্তরার রূপ ও গুণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ যদুনাথ এক প্রকার তাহার গলায় মালা পড়াইয়া গৃহবধূ করিতে উদ্যোগী ছিল। হঠাৎ কোথা হইতে এক প্রবল ঝটিকা আসিয়া নিমেষেই সব কিছু ছিন্নভিন্ন করিয়া চলিয়া গেল। আশার ক্ষীণ আলোটুকু ফুৎকারে নিভিয়া গেল।

আজ বহুদিন অতিবাহিত হইবার পর এক অচেনা শয়নকক্ষে নিশিযাপন করিতে যাইয়া পুরাতন ভাবনা যেন তাজা হইয়া উঠিল। হাত বাড়াইয়াও যাহাকে কাছের করিতে পারে নাই আজ সেই যদুনাথ অদৃষ্টের আহ্বানে তাহারই কুটির মধ্যে আশ্রিত। কি করিয়া সে উত্তরার সান্নিধ্য হইতে নিজেকে আড়াল করিয়া চলিয়া যাইতে পারিবে তাহারই ফন্দি আটিতে লাগিলেন। হৃদয়ের আঙ্গীনায় এতদিন যাহাকে স্থানদিতে মন উদগ্রীব ছিল, আজ তাহার আঙ্গীনায় আসিয়া দুই দণ্ড স্থির হইয়া বসিবার আবেগটুকু আর রহিল না। অনুরূপ সুযোগ পাইলেও সময়ের বিবর্তনে তাহার প্রভাব অনেকাংশেই স্বলিত হইয়া পরে।

অনেক ভাবিয়া অবশেষে গৃহস্বামীর আতিথ্যকে সম্মান জানাইবার জন্য শেষরাত্রে একটু তন্দ্রা গেলেন। প্রভাতকালে সূর্যের কীরণ আসিয়া তাহার চোখে পড়িলে সহজেই নিদ্রা ভঙ্গ হইল। অতঃপর পোষাক পরিয়া বাড়ী যাইবার জন্য উদ্যোগী হইলে গৃহস্বামী আসিয়া জলযোগ গ্রহণ করিতে বলায় তিনি স্থির হইয়া বসিলেন। কিন্তু তাহার মানসিক অস্থিরতা ক্রমেই বাড়িয়া চলিল। এমন সময় তাহার সম্মুখের টেবিলে শাঁখাচুড়িতে ভর্তি দুইখানি হাত আসিয়া পরায় স্তম্ভিত হইয়া দেখিলেন যে একখানা কাসার থালায় পরিপূর্ণ জলখাবার। থালাটি টেবিলে রাখিয়া গৃহিনী অতিথিকে জলযোগ করিতে বলিলেন। তৎক্ষণাৎ যদুনাথ অত্যধিক স্তম্ভিত হইয়া গৃহীনীর মুখপানে স্থির দৃষ্টি রাখিলেন। এতক্ষণ পর্যন্ত গৃহিনীকে উত্তরা ভাবিয়া মনের মধ্যে যে ভ্রম সঞ্চিত ছিল তাহা ঘুচিয়া গেল। পরিচয় জানিয়া বুঝিলেন যে এই নববধূ উত্তরার কোন জ্ঞাতিও নহে। তাহাদের এই বৈবাহিক সম্বন্ধের কয়েকটি মাস হইয়াছে মাত্র। যদুনাথ একটু একটু করিয়া গৃহিনীর নিকট হইতে নানাবিধ শিল্পকলার তথ্য জানিতে চাহিলে তিনি বলিলেন, “তুলির ছোঁয়ায় আঁকা যে সমস্ত কলাকৃতি দেখতে পাচ্ছেন তা আমার নয়। আমি এ ঘরে পা রাখার পূর্বেই এগুলো এভাবেই সজ্জিত ছিল।”

—তাহলে এগুলো কার হাতের? না, মানে আমি জানতে চাইছি যিনি এই শিল্পকলা তৈরী করেছেন তার প্রতিভার প্রশংসা না করে উপায় নেই।

স্বরূপা মুখ তুলিয়া একবার সমস্ত ছবি গুলি চাহিয়া অতিথিকে বলিলেন, “এই ছবিগুলো এঁকেছেন আনন্দবাবুর প্রথমা স্ত্রী— উত্তরা। কিন্তু তিনি এখন আর বেঁচে নেই। আমাকে জানানো হয়েছিল যে ঘাটপারের এক পিচ্ছিল সিঁড়ি থেকে পা ফোসকে পড়ে গিয়ে ভীষণ ভাবে মাথায় ব্যথা পাওয়ার দরুণ তার দুর্ঘটনা ঘটে।”

—তবে কি উত্তরা আর বেঁচে নেই?
আপনি কি দিদিকে জানতেন?

যদুনাথবাবু এই প্রসঙ্গে আর বিশেষ কিছু না বলিয়া খুব কম কথায় ইতি টানিলেন। পুরাতন স্মৃতিকে রোমন্থন করিয়া যে দুঃখটুকু বুকের ভিতর জন্মিল তাহা বোধকরি অচিরেই ঘুচিবার নহে। তিনি সেখানে আর কাল বিলম্ব না করিয়া প্রাতঃরাশ সমাপনান্তে বিদায় লইলেন।

সময়ের মতো সময় পার হইয়া হেমন্তের সোনালী ধানে মাঠ ভরিয়া উঠিল। গৃহস্থের আঙ্গীনায় পাকাধানের গোলায় খোকাখুকির ছোটাছুটির রবে চারিদিক মাতিয়া উঠিল। আনন্দের এই মরশুমে যদুনাথের পরিবার পিতৃকূলে যাইবার জন্য বায়না ধরায় তিনি সকলকে শ্বশুরালয়ে লইয়া উপস্থিত। দীর্ঘদিন পর শ্বশুরবাড়ী যাওয়ায় তাহার পক্ষে চট্‌ করিয়া ফিরিয়া আসা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। উপরন্তু কাননপুরে পৌষমেলার আকর্ষণ তাহাকে সেখানে থাকিতে বাধ্য করিল। দূরদূরান্ত হইতে উপস্থিত হইয়া বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের দল, নৃত্য শিল্পীবৃন্দ এমনকি খুদে শিল্পীবৃন্দ হস্তকলায় প্রতিযোগিতা করিয়া থাকে। তিনদিন ব্যাপী এই মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আকর্ষণ সকলের মন জয় করিয়াছে। অঙ্কন প্রদর্শনীর পুরস্কার ঘোষণা করিতেই যে নাম ভাসিয়া তাহার কানে আসিল সে হইল এক ক্ষুদে শিল্পী। যদুনাথ এই শিল্পীর প্রদর্শনী দেখিয়া আশ্চর্য না হইয়া থাকিতে পারিলেন না। অবিকল তাহার ঘরের সেই সব শিল্পকলা। তিনি কিছুতেই বুঝিতে পারিলেন না কি করিয়া সেই ক্ষুদে শিল্পী অজান্তেই তাহার ঘরের সমস্ত ছবি আঁকিয়া সকলকে মুগ্ধ করিয়াছে? উত্তরার তুলির ছোঁয়ায় যাহা কিছু আঁকাছিল মনে হইল সেইসব আবার জীবন্ত হইয়া ফুটিয়াছে। সংশয় দূর করিতে তিনি মরিয়া হইয়া খোঁজ লইলেন। যাহা জানিলেন তাহাতে বিস্মিত না হইয়া পারিলেন না। সেই ক্ষুদে শিল্পী উত্তরার ভাগ্যহীনা কন্যা— শ্যামলী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *