ঊর্মিমর্মর
দক্ষিণ ভারতে বাক্য প্রচলিত আছে : গঙ্গার জলে স্নান, তুঙ্গার জল পান। অর্থাৎ গঙ্গার জলে স্নান করিলে যে পুণ্য হয়, তুঙ্গার জল পান করিলেও সেই পুণ্য। তুঙ্গার জল পীযূষতুল্য, মৃত-সঞ্জীবন।
সহাদ্রির সুদূর দক্ষিণ প্রান্তে দুইটি ক্ষুদ্র নদী উখিত হইয়াছে, তুঙ্গা ও ভদ্রা। দুই নদী পর্বত হইতে কিছুদূর অগ্রসর হইবার পর পরস্পর মিলিত হইয়াছে, এবং তুঙ্গভদ্রা নাম গ্রহণ করিয়া প্রবাহিত হইয়াছে। তুঙ্গভদ্রা নদী স্বভাবতই তুঙ্গা বা ভদ্রা অপেক্ষা পুষ্টসলিলা, কিন্তু তাহার পুণ্যতোয়া খ্যাতি নাই। তুঙ্গভদ্রা অনাদৃতা নদী।
তুঙ্গভদ্রার যাত্রাপথ কিন্তু অল্প নয়। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে যাত্রা আরম্ভ করিয়া সে ভারতের পূর্ব সীমায় বঙ্গোপসাগরে উপনীত হইতে চায়। পথ জটিল ও শিলা-সঙ্কুল, সঙ্গিসাথী নাই। কদাচিৎ দুই-একটি ক্ষীণা তটিনী আসিয়া তাহার বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া নিজেকে হারাইয়া ফেলিয়াছে। তুঙ্গভদ্রা তরঙ্গের মঞ্জীর বাজাইয়া দুর্গম পথে একাকিনী চলিয়াছে।
অর্ধেকেরও অধিক পথ অতিক্রম করিবার পর তুঙ্গভদ্রার সঙ্গিনী মিলিল। শুধু সঙ্গিনী নয়, ভগিনী। কৃষ্ণা নদীও সহাদ্রির কন্যা, কিন্তু তাহার জন্মস্থান তুঙ্গভদ্রা হইতে অনেক উত্তরে। দুই বোন একই সাগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিয়াছিল; পথে দেখা। দুই বোন গলা জড়াজড়ি করিয়া একসঙ্গে চলিল।
তুঙ্গভদ্রার জীবনে স্মরণীয় ঘটনা কিছু ঘটে নাই, তাহার তীরে তীর্থ-সিদ্ধাশ্রম মঠ-মন্দির রচিত হয় নাই, তাহার নীরে মহানগরীর তুঙ্গ সৌধচূড়া দর্পণিত হয় নাই। কেবল একবার, মাত্র দুই শত বৎসরের জন্য তুঙ্গভদ্রার সৌভাগ্যের দিন আসিয়াছিল। তাহার দক্ষিণ তীরে বিরূপাক্ষের পাষাণমূর্তি ঘিরিয়া এক প্রাকারবদ্ধ দুর্গ-নগর গড়িয়া উঠিয়াছিল। নগরের নাম ছিল বিজয়নগর। কালক্রমে এই বিজয়নগর সমস্ত দাক্ষিণাত্যের উপর অধিকার বিস্তার করিয়াছিল। বেশি দিনের কথা নয়, মাত্র ছয় শতাব্দীর কথা। কিন্তু ইহারই মধ্যে বিজয়নগরের গৌরবময় স্মৃতি মানুষের মন হইতে মুছিয়া গিয়াছিল। তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণ তটে বিজয়নগরের বহুবিস্তৃত ভগ্ন্যুপের মধ্যে কী বিচিত্র ঐতিহ্য সমাহিত আছে তাহা মানুষ ভুলিয়া গিয়াছিল। কেবল তুঙ্গভদ্রা ভোলে নাই।
কোনো এক স্তব্ধ সন্ধ্যায়, আকাশে সূর্য যখন অস্ত গিয়াছে কিন্তু নক্ষত্র পরিস্ফুট হয় নাই, সেই সন্ধিক্ষণে কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রার সঙ্গমস্থলে ত্রিকোণ ভূমির উপর দাঁড়াও। কান পাতিয়া শোনো, শুনিতে পাইবে তুঙ্গভদ্রা কৃষ্ণার কানে কানে কথা বলিতেছে; নিজের অতীত সৌভাগ্যের দিনের গল্প বলিতেছে। কত নাম—হরিহর বুক কুমার কম্পন দেবরায় মল্লিকার্জুন—তোমার কানে আসিবে। কত কুটিল রহস্য, কত বীরত্বের কাহিনী, কত কৃতঘ্নতা, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম বিদ্বেষ কৌতুক কুতূহল, জন্মমৃত্যুর বৃত্তান্ত শুনিতে পাইবে।
তুঙ্গভদ্রার এই ঊর্মিমর্মর ইতিহাস নয়, স্মৃতিকথা। কিন্তু সকল ইতিহাসের পিছনেই স্মৃতিকথা লুকাইয়া আছে। যেখানে স্মৃতি নাই সেখানে ইতিহাস নাই। আমরা আজ তুঙ্গভদ্রার স্মৃতিপ্রবাহ হইতে এক গণ্ডূষ তুলিয়া লইয়া পান করিব।