Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তীর্থযাত্ৰী || Samaresh Majumdar » Page 4

তীর্থযাত্ৰী || Samaresh Majumdar

চার্লি গালাগাল দিচ্ছিল

চার্লি মনে মনে বোধহয় গালাগাল দিচ্ছিল। তারপর হঠাৎ ফায়ারপ্লেসের আগুনের দিকে হাঁটু মুড়ে বসে বিড়বিড় করে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করল। শব্দগুলো উচ্চারণ করার সময় ওর বিশাল মাথা বারংবার ঝুঁকে পড়ছিল। মাইক এবং পার্থ অসহিষ্ণু চোখে এই দৃশ্য দেখছিল। চার্লির যেন মন্ত্র পড়া আর শেষ হচ্ছিল না। পার্থ বিরক্ত-গলায় ডাকল, চার্লি! ইশারায় তাকে অপেক্ষা করতে বলে জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা লোহার লকেট বের করে তাতে কয়েকবার চুমু খেয়ে নিল চার্লি। তারপর সেটাকে সযত্নে আবার বুকের ভেতরে চালান করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। পার্থ দেখল এখন আর চার্লির মুখে সেই অসহায় ভাবটা নেই। চোখাচোখি হতে হেসে বললে, চল।

তিনটে কম্বল এবার তিনজনে জড়িয়ে নিল। তারপর একে একে প্যাসেজে চলে এল। চার্লি বলল, এই ঘরের ওপাশে আর একটা ঘর আছে। সেখানেই ডেডবডি আর অ্যান, পাশাপাশি। পার্থ টর্চ জ্বালল। দরজার পাল্লা ভেঙে হেলে রয়েছে। খুব সন্তর্পণে পা ফেলা দরকার। আলো নিভিয়ে ফেলল সে। মাইক বললো, ও যেন টের না পায় আমরা যাচ্ছি। বুঝলে?

পার্থ বললো, টের পেলেই বা কী এসে যায়। এই বাংলো থেকে তো আর পালাতে পারবে না।

মাইক বলল, কিছুই বলা যায় না। ওপাশের দরজা দিয়ে যে কেউ নেমে যেতে পারবে।

তুমি পাগল হয়েছ? বাইরে এখন মাইনাস তিন-চার ডিগ্রি হবে। ওখানে পা দিলেই মৃত্যু। তাছাড়া, ওই শয়তান নেকড়েগুলোর নখের শব্দ শুনতে পাচ্ছ না? অ্যান ওই দরজা দিয়ে গেলে ওরা ছেড়ে দেবে?

তবু আমাদের চুপচাপ যাওয়া উচিত। চার্লি তুমি মাঝখানে এস। ওকে গায়ের জোরে আনতে হবে। শব্দ না করে ওরা মাঝখানের ঘরটা পেরিয়ে এল। এঘরের পাল্লাও ভেঙেছে চার্লি। পার্থ তা দেখে নিচুস্বরে বললো, গায়ের জোরে যে কাজ হয় না তার প্রমাণ তো দেখতে পাচ্ছ।

কাজ হতো, কাজ হতো। শুধু ওই বীভৎস ডেডবডিটা যদি না থাকত!

চার্লি ফিসফিস করল। দরজায় দাঁড়িয়ে টর্চের আলো ফেললো পার্থ। চারপাশে একবার বুলিয়ে নিয়ে মৃতদেহের ওপর আলোটাকে স্থির রাখল। চার্লি সঙ্গে সঙ্গে একটা শব্দ করে চোখ বন্ধ করেছে। ওরা দুজন অবাক হয়ে দেখলো মৃতদেহটা একা, অ্যানের কোনো চিহ্ন নেই। মাইক ফ্যাসফেসে গলায় বললো, ও পালিয়েছে!

পার্থ মরিয়া হয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল। চৌকিদারের মুখের হাড় দেখা যাচ্ছে। সে ঘরটাকে দেখে নিয়ে বলল, না, পালাতে পারে না। অ্যান নিশ্চয়ই এই বাংলোয় আছে।

মাইক হাত নাড়ল, কিন্তু আমরা তো ভেতর থেকেই এলাম, থাকলে দেখতে পেতাম না?

চার্লি চোখ বন্ধ করেই বলল, শি ইজ উইচ। ওই মৃতদেহটা ওকে হেল্প করছে নিশ্চয়ই। চল, এঘর থেকে বেরিয়ে যাই। আমাদের এখন আগুনের পাশে থাকা উচিত, বি কুই।

পার্থ চিৎকার করে উঠল, তোমরা ভীতু, ভীষণ ভীতু। মেয়েটা কক্ষনো পালাতে পারে না। ওর চিৎকার শুনে নখের শব্দগুলো আচমকা থেমে গেল। পার্থ দৌড়ে মাঝখানের ঘরে চলে আসতেই বাকি দুজন তাকে অনুসরণ করলো। খাটের ওপর সেই জীর্ণ গদিটা নেই। টর্চের আলো ফেলে সেটাকে খাটের নিচে আবিষ্কার করল পার্থ। সে আর মাইক যখন প্রথম এইঘরে ঢুকেছিল তখন গদিটা খাটের ওপরে ছিল। নিশ্চয়ই অ্যান এটাকে নিচে নামিয়েছে। তার অর্থ হলো ওরা যখন এইঘর দিয়ে নিঃশব্দে পাশের ঘরের দরজায় গিয়েছিল তখন অ্যান ওই তক্তাপোষের নিচে গদি পেতে লুকিয়েছিল। ওরা ওপাশের ঘরে ঢুকে যেতেই সে লুকোন জায়গা ছেড়ে পালিয়েছে। সঙ্গীদের এতো বিশদ না বুঝিয়ে পার্থ ঝটপট প্যাসেজে চলে এল। মুখে বললো, ও নিশ্চয়ই এখানে আছে। তার টর্চের আলো প্যাসেজের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেল। তিনটে লোক বিজয়দর্পে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হল। পার্থ ডাকল, অ্যান, আমরা এসেছি। ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। পার্থ চার্লিকে বলল, স্টোরটা ভালো করে খুঁজে দ্যাখো। এখানে অনেক হাবিজাবি জিনিস রয়েছে। মেয়েটাকে এখানেই খুঁজে পাবে।

চার্লি কথাটা শুনে মাইকের দিকে তাকাল। স্পষ্টতই তার ভেতরে ঢোকার একটুও ইচ্ছে নেই। তাকে ইতস্তত করতে দেখে পার্থ বললো, কী হলো? তুমি কি অ্যানের ওপর তোমার দাবি ছেড়ে দিচ্ছ?

তৎক্ষণাৎ কাজ হলো। স্টোর রুমের ভেতরে ঢুকে গেল চার্লি পার্থর হাত থেকে টর্চটা ছিনিয়ে নিয়ে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। জিনিসপত্র সরানোর শব্দ হলো। তারপর বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এল সে। বিড়বিড় করে বললো, মেয়েটা নির্ঘাৎ ডাইনি নইলে ডেডবডি ওকে হাওয়া করে দেয়!

পার্থ জিজ্ঞসা করলো, কী হলো? কী বলছ অমন করে!

সেইসময় বাইরে নেকড়েগুলো একসঙ্গে ডেকে উঠল। পার্থর মনে হলো ওর সমস্ত শরীরে কাটা ফুটেছে। মাইক চাপা গলায় বলল, নেকড়েগুলো বোধহয় ওকে পেয়ে গেছে। অত সুন্দর মেয়েটাকে নেকড়েগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। ওঃ।

মাইকের কথায় চার্লি মাথা নাড়ল, নো। হতেই পারে না। নেকড়েগুলো আমাদের পেছনে লেলিয়ে দেবে। নিশ্চয়ই প্রতিহিংসা নিতে চাইবে। নেকড়েরা ডাইনিদের অনুচর হয়, আমি শুনেছি, বিলিভ মি।

পার্থ কী করবে বুঝতে পারছিল না। সত্যি সত্যি নেকড়েগুলো এতক্ষণে ওপাশের দরজা ছেড়ে ঘুরে এদিকে চলে এসেছে। যেন কানের কাছেই ওরা চিৎকার শুরু করেছে! না, ভূতপ্রেতে সে বিশ্বাস করে না। মৃতদেহের স্বাদ পাওয়ায় এরকম খেপে উঠেছে জন্তুগুলো। অ্যানের সঙ্গে সে সমস্ত বিকেল পাশাপাশি কাটিয়েছে। এক বিছানায় গা লাগিয়ে থেকেছে। ও যদি ডাইনি হতো তাহলে–না, চার্লির বোকামিকে প্রশ্রয় দেবার কোনো মানে হয় না। সে টয়লেটে আলো ফেলল। কেউ নেই ওখানে। তাহলে মেয়েটা গেল কোথায়? আর এই প্রথম পার্থর শরীর সিরসির করে উঠলো। মাইকের গলা শোনা গেল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। চার্লির কথা যদি ঠিক হয় তাহলে আমাদের আগুনের পাশে ফিরে যাওয়া উচিত। অন্তত শরীর গরম হবে।

নেকড়েগুলো বোধহয় এবার এপাশের দরজা আঁচড়াচ্ছে। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে ওদের সংখ্যা এখন আরও বেড়ে গিয়েছে। তিনজন ক্লান্ত পায়ে প্যাসেজটা অতিক্রম করে শোওয়ার ঘরের দরজায় এসে পাথর হয়ে গেল। ফায়ারপ্লেসের দিকে পিঠ দিয়ে অ্যান তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

মাইক এবং পার্থ একসঙ্গে বলে উঠলো, আরে, তুমি!

চার্লির হাত কাঁপতে লাগল। সে কোনোমতে পার্থকে আঁকড়ে ধরলো, যেও না, যেও না।

পার্থ ঝাঁকুনি দিয়ে ওর হাত ছাড়িয়ে নিল। ওরা যখন চৌকিদারের ঘরে ছিল তখনই অ্যান সোজা এখানে চলে এসেছে। অ্যান যে তাদের দেখে একটুও খুশি হয়নি তা ওর মুখের অভিব্যক্তিতেই বোঝা যাচ্ছে। মাইক সন্দেহের গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোথায় ছিলে তুমি?

অ্যানের ঠোঁট সামান্য ফাঁক হলো কিন্তু সে কোনো শব্দ উচ্চারণ করল না। ওরা তখনও ঠিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চার্লি হঠাৎ ওদের সরিয়ে এক পা এগিয়ে গেল, দোহাই অ্যান, যথেষ্ট হয়েছে। তুমি ওই নেকড়েগুলোকে সরিয়ে নাও, আমি প্রমিস করছি।

আর তখনই সেই বিকট চিৎকারগুলো বন্ধ হয়ে গেল। যেন সুইচ টিপে কেউ শব্দ থামিয়ে দিল। আর নখের আওয়াজও। তারপর একটু দূরে, আরো দূরে শব্দগুলো উঠে উঠে মিলিয়ে গেল। চার্লি বড় বড় চোখে ওদের দিকে ফিরে তাকাল। ভাবখানা যেন, কী বলেছিলাম এখন বিশ্বাস করছ তো! কিন্তু পার্থ লক্ষ্য করেছিল চার্লি বলামাত্র অ্যানও খুব অবাক হয়েছে। সে ও কান পেতে শব্দটা শুনতে চেয়েছে যেন। চেয়ারে বসে দুহাত কোলে নিয়ে এখন স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছে। পার্থ কিছু বলার আগে মাইক এগিয়ে গেল, যতসব বুজরুকি! অ্যান; ওরা তোমাকে ডাইনি ভাবছে। তুমি কি ডাইনি?

অ্যান এবার মুখ ফেরাল। ফায়ারপ্লেসের আগুনে ওর মুখের একাংশ লালচে দেখাচ্ছে। সামান্য হাসির রেখা ফুটল কি ফুটল না, ডাইনি, এখন আমি ডাইনি হতে পারলে খুশি হতাম। গলার স্বর কাঁপছিল ওর। মাইক আরো কয়েক পা এগিয়ে ওর সামনে দাঁড়াল, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না ওকথা, আমি জানি তুমি রক্তমাংসের মানুষ।

তুমি আমাকে চাও? ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল অ্যান। ওর শরীরে তখনও কাঁপুনি।

হ্যাঁ, চাই। দুহাতে অ্যানের কাঁধ আঁকড়ে ধরল মাইক, প্রথম দেখার পর থেকেই আমি তোমাকে চাইছি।

কী ভাবে চাও? ওই দুটো লোক ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকবে আর তুমি আমাকে ভোগ করবে? অ্যানের চোখ মাইকের মুখের ওপর স্থির, গলার স্বরে কি অভিমান?

মাইক মাথা নাড়ল। না, না হতে পারে না। সে মুখ ফেরাল। এক হাতে অ্যানকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে এসে বললো, কী দেখছ তোমরা? এখন আমাদের একা থাকতে দাও!

পার্থ বললো, মাইক! তা হয় না। আমাদের মধ্যে যে কথা হয়েছে তা তুমি ভুলে যাচ্ছো!

মাইক চিৎকার করল, আমি কোনো কথা শুনতে চাই না, তোমরা যাও, প্লিজ।

কথাটা শেষ হওয়ামাত্র মাত্র চার্লি চাপা গলায় বলে উঠলো, শুনলে, শুনলে ওর কথা! মেয়েটা নিশ্চয়ই ওকে বশ করেছে। এতে কোনো ভুল নেই। যেই ওর শরীরে হাত দিতে যাবে অমনি ও পাখি হয়ে যাবে।

প্রচন্ড বিরক্তিতে পার্থ চার্লির হাতে আঘাত করল, তুমি কি অন্ধ! তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না ও একটা সাধারণ মেয়ে। মাইক তোমার কুসংস্কারের সুযোগ নিচ্ছে। আঘাত খেয়ে চার্লির মুখে ক্রোধ জমেছিল। সে এবার অ্যানের দিকে তাকাল, তুমি বলছ ও ডাইনি নয়?

না। মাইক, তুমি ওখান থেকে চলে এসো। পার্থ আদেশের ভঙ্গিতে বললো। অ্যানের মাথায় গাল ছোঁয়াল মাইক। তাই দেখে পার্থ দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে এল, মাইক!!

ও অ্যান, তুমি কি সুন্দর। কি নরম তোমার দেহ! পাগলের মতো অ্যানের শরীরে হাত বোলাচ্ছিল মাইক। হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধ ধরে টানলো পার্থ, মাইক। তুমি চুক্তি ভাঙতে পারো না।

এক হাতে পার্থকে ঝটকা মারল মাইক, কোনো চুক্তি আমি মানি না। গেট আউট আই সে।

পার্থর হাত উঠল। সজোরে মাইকের চোয়ালে গিয়ে আঘাত করল সেটা। পড়ে যেতে যেতে মাইক অ্যানকে ধরে কোনোরকমে সামলাতে চাইল। দুহাতে সেইমুহূর্তে অ্যানকে কাছে টেনে নিল পার্থ। মার খেয়ে চোখ খুলতেই মাইক দেখল পার্থ অ্যানকে জড়িয়ে ধরেছে। ক্ষিপ্ত মোষের মতো সে তেড়ে গেল সামনে। আর তখনই চটপট চার্লি মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাইককে ঠেকাল।

নো নো। এনাফ ফাইটিং! তার আগে আমি দেখতে চাই মেয়েটা সত্যি মেয়ে কিনা। পাতরো, তুমি ভালো করে মেয়েটাকে জড়িয়ে থাকবে। বাধা পেয়ে মাইক চার্লির দিকে তাকাল। চার্লি তখন অতি সন্তর্পণে অ্যানের দিকে এগোচ্ছে।

একটা আঙুল তুলে চার্লি প্রথম অ্যানের গালে ছোঁয়ালো। বিরক্তিতে অ্যান মুখ ফেরাতে চার্লি মাথা নাড়লো, মেয়েমানুষ বলেই মনে হচ্ছে। পাতরো, তুমি আরও শক্ত করে ধরো, ওর বুক ছুঁয়ে দেখতে হবে। ডাইনিদের বুক থাকে না।

তৎক্ষণাৎ অ্যান চিৎকার করে উঠলো, নো, নো, পাতরো, আমাকে বাঁচাও।

পার্থ চোখ বড় করল, চার্লি! ডোন্ট ডু দিস। শি ইজ পারফেক্টলি অলরাইট।

অলরাইট? বিশ্বাস করতে যেন বাধ্য হচ্ছিল চার্লি।

হ্যাঁ। ও একটা পুরোদস্তুর মেয়ে। অ্যানকে জড়িয়ে ধরতে পার্থর খুব আরাম লাগছিল। কিন্তু চার্লি বোধহয় ওই কথায় সন্তুষ্ট হলো না। অ্যানের বুকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। ছটপট করতে লাগল অ্যান। এবং সেইসঙ্গে ঝুঁকে পড়ে দাঁত বসিয়ে দিল চার্লির হাতে।

মেরে ফেললো, মেরে ফেললো। প্রচণ্ড আর্তনাদ করে হাত সরিয়ে লাফাতে লাগল চার্লি। আর সেইসময় বোধহয় কিছুটা ভয়ে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে পার্থ অ্যানকে ছেড়ে দিতেই সে ডিমঘরের দরজায় বসে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। চার্লির হাতের চামড়ায় বিন্দু বিন্দু করে রক্ত ফুটে উঠলো। রক্ত দেখতে দেখতে হঠাৎ চার্লির মুখে হাসি ফুটলো, লুক। হিয়ার ইজ মাই ব্লাড। ডিপ অ্যান্ড রেড। তারপর হঠাৎ মাইকের দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠলো, তোমার রক্ত কি রকম? এই রকম ঘন আর লাল?

মাইক বোধহয় কোনো মতলব ভাঁজছিল, প্রশ্নটা শুনে মুখ বেঁকালো, মানুষের রক্ত একই রকম।

মানুষ! চার্লি চেঁচিয়ে উঠলো, লুক মিস। ওই সাদা চামড়াটা শেষপর্যন্ত স্বীকার করল আমি মানুষ। সুতরাং তোমার আর আপত্তি থাকার কথা নয়। এক হাতে সে খামচে ধরল অ্যানকে।

পার্থ সঙ্গে সঙ্গে হ্যান্ডেলটা তুলে ধরল, নো, এভাবে তুমি ওকে পেতে পারো না।

চার্লি ঘাড় ঘুরিয়ে হ্যান্ডেলটাকে দেখল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তাড়াতাড়ি বলো কীভাবে পেতে পারি।

অ্যানের শরীরটা ধীরে ধীরে ডিমঘরে পা রাখল। ওরা তিনজন হুমড়ি খেয়ে ওর পেছনে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ অ্যান ঘুরে দাঁড়াল, কী চাও তোমরা?

তোমাকে। তিনটে মুখ একসঙ্গে উচ্চারণ করলো।

তিনজনে? একসঙ্গে? কাঁপছিল অ্যান।

ওরা তিনজন পরস্পরের দিকে তাকাল। পার্থ মাথা নাড়লো, নো, আমিই প্রথম।

সঙ্গে সঙ্গে চার্লি বাধা দিল, না, আমিই প্রথম।

মাইক চিৎকার করলো, হতেই পারে না, আমিই প্রথম।

পার্থ দাঁত ঘষল, কেন? তুমি প্রথম হবে কেন? সাদা চামড়া বলে?

চার্লি হাসলো। যেন লালা ঝরছিল তার হাসিতে, কিন্তু চামড়ার তলার রক্ত একরকম।

এইসময় অ্যান কেঁদে উঠলো হাউমাউ করে, তোমার যা করার করো, আমি আর পারছি না। কান্নাটা ঘরের ভেতর পাক খেতে লাগল।

চার্লি বললো, এইসব কান্নাকান্না থামাও মিস।

অ্যান টলতে টলতে দরজার গায়ে গিয়ে সেখানে গাল চেপে ধরল, ওঃ, আমি আর পারছি না। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল সে।

চার্লি এগোতে যাচ্ছিল কিন্তু বাকি দুজন তাকে বাধা দিল। পার্থ বলল, লেটস ডিসাইড, কে আগে ওকে পাবে? সে ধীরে ধীরে কার্পেটের ওপর বসল। তাকে দেখে অন্য দুজন হাঁটু গেড়ে মুখোমুখি হলো, কী ভাবে?

পার্থ বলল, আমি টস করব। প্রথমে আমি আর চার্লি যে জিতবে তার সঙ্গে মাইকের ভাগ্য ঠিক হবে।

সজোরে হাত নাড়ল চার্লি, ইস্পসিবল। দুবার লাক ট্রাই করতে আমি রাজি নই। আর মাইক একবারেই ওকে পেয়ে যাবে? কি বুদ্ধি তোমার?

তাহলে? পার্থর মাথায় কিছুই ঢুকছিল না।

এবার মাইক বলল, তাহলে ওকেই দায়িত্ব দাও। ও বলুক কাকে প্রথমে চায়।

চার্লি মাথা নাড়ল, না, তা হয় না। পাতরো ওর সঙ্গে বিকেলবেলায় শুয়েছিল। ন্যাচারেলি ও পাতরোকে চাইতে পারে। বেটার, একটা কাজ করো। ছটা কাগজের টুকরো নাও। তার তিনটেতে ওয়ান টু থ্রি লেখ। কাগজগুলো গোল্লা পাকিয়ে এখানে ফেলে দাও। আমরা তিনজনে একটা করে গোল্লা তুলে দেখি কার ভাগ্যে কি পড়ল। বুঝতে পারলে তোমরা?

পার্থ হাসল, গুড আইডিয়া। সে উঠে কাগজ খুঁজতে লাগল। তারপর বিস্কুটের প্যাকেট থেকে কাগজ ছিঁড়ে আবার সেখানে ফিরে এসে বাবু হয়ে বসল, কলম আছে কারো কাছে।

মাইক হাত বাড়িয়ে রুকস্যাকটা টেনে এনে কলম বের করে এগিয়ে দিল। চার্লির যেন তর সইছিল না। পার্থ কাগজের ওপর লিখতে চেষ্টা করছিল কিন্তু ভিজে কাগজ বলে অসুবিধে হচ্ছিল। হঠাৎ মাইক বলল, যদি আমরা তিনজনে তিনটে সাদা কাগজ তুলি? যদি নম্বর দেওয়া তিনটে কাগজ পড়ে থাকে?

সমস্যাটা মাথায় আসতেই পার্থ মুখ তুলে অ্যানকে দেখলো, তাহলে ওকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে। আমাদের ভাগ্যে ও নেই।

নো। চার্লি বাধা দিল, ছয়টা কাগজ নয়, তিনটেতে লেখ। আমি কোনো চান্স নিতে চাই না। কি বলো মিস? শেষ প্রশ্নটা ঠাট্টায় জড়ানো।

কাগজে লেখা হয়ে গেলে গোল্লা পাকাচ্ছিল পার্থ। বাকি দুজন সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল গোল্লার মধ্যে কোনো সংকেতে রেখে দিচ্ছে কি না। হঠাৎ মাইক বলল, আমার মনে হয় ওকে একবার জিজ্ঞাসা করা উচিত।

কী জিজ্ঞাসা করবে?

ওর কিছু চাই কি না?

পার্থ হাসল, তুমি কি ওর ফাঁসি দিচ্ছ?

মাইক বলল, অনেকটা তো সেইরকম। অন্তত চার্লির হাতে পড়লে।

ওকে ওকে। চার্লি ওদের থামাল, হেই মিস, তুমি কি কিছু চাও?

অ্যান কোনো সাড়া দিল না। চার্লি আবার প্রশ্ন করল।

এবার অ্যান মুখ তুলল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

বলে ফেল কী চাও। এই ঘরে বসে আমরা তোমাকে যা দিতে পারি দেব। তার বদলে তোমার কাছে সুখ চাই, খুব কড়া ডোজের সুখ। চার্লি হাসল।

ফ্রেস এয়ার। অ্যান চোখ খুললো, একটু টাটকা বাতাস নিতে দাও।

টাটকা বাতাস? পার্থ অবাক হলো।

এখানে টাটকা বাতাস কোথায় পাবে? চার্লি জিজ্ঞাসা করল।

আমাকে একটু দরজাটা খুলতে দাও; এক মিনিটের জন্যে। মিনতি করল অ্যান ওদের দিকে তাকিয়ে।

মাথা খারাপ। ও পালাতে চায়। পার্থ চেঁচিয়ে উঠলো।

কোথায় পালাবে? চারধারে নিশ্চয়ই এতক্ষণে বরফ জমেছে। ও কোথায় পালাতে পারে? চার্লি উত্তর দিল।

কিন্তু ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকবে। মাইক আপত্তি করল।

তা ঢুকুক। আমাদের শরীর এখন যথেষ্ট গরম। চার্লি উদার হলো, এই যে মিস, নট মোর দ্যান এ মিনিট। যত পারো তার মধ্যে টাটকা বাতাস বুক ভরে নিয়ে তৈরি হও।

ধীরে ধীরে দরজাটার ছিটকিনি এবং হুড়কো খুললো অ্যান। চার্লি ইশারা করতেই পার্থ গোল্লাগুলোকে সামনে গড়িয়ে দিলো। ওরা তিনজনে চিলের মতন সতর্ক চোখে গোল্লাগুলোকে ঠাওর করতে চেষ্টা করছিলো। ওর মধ্যে কোনটাতে এক নম্বর লেখা? ওই তিনটে গোল্লার বাইরে সমস্ত জগৎ ওদের কাছে মুছে গেল এক পলকে।

দরজায় পিঠ দিয়ে অ্যান ওদের দেখল। তিনটে মানুষ বন্যজন্তুর মতো ঝুঁকে আছে। তিনরকম চামড়ার তিনটে মানুষ। নিজের অধিকার অর্জন করার জন্যে তিনটে শকুন ওৎ পেতেছে। সে নিঃশ্বাস ফেলল। আমি মেয়ে, আমি কেন মেয়ে? এই তিনটে শকুনকে ঠেকাবার সাধ্য তার নেই। যতক্ষণ এদের মুখে মুখোশ ছিল ততক্ষণ সে কিছুতেই হয়তো আপত্তি করত না। কিন্তু এখন তার ঘেন্না করছে। এদের হাত থেকে সে পালাবে কোথায়। চারধারে বরফ আর বরফ। তিনটে পুরুষের মিলিত শক্তির হাত তাকে ঠিক টেনে নিয়ে আসবে। দখল চাই, ক্ষমতা চাই। পৃথিবীর যেখানেই যা কিছু নরম তাই দখল করার জন্যে হাত বিস্তৃত হচ্ছে। আর আশ্চর্য, শরীরের চামড়ার রঙ ভিন্ন হলেও ওদের তিনটে হাতের রঙ এক, কুচকুচে কালো।

অ্যান ফিরল। তারপর ধীরে ধীরে দরজার পাল্লা খুলল। একঝলকা হিম বাতাস তার শরীর ভিজিয়ে দিল যেন। কিন্তু চোখের সামনে গভীর অন্ধকারের বদলে নরম আলোয় মাখামাখি হয়ে গেছে পৃথিবীটা। অ্যান বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চমকে উঠল। ওটা কী? বেথেলহেমের সেই তারা? যা জ্ঞানীদের পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল একটা আস্তাবলে? কিন্তু এ তো তারার চেয়ে বড়। লাল বল, গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে আকাশের গায়ে। তারপরে দূরের এক পাহাড়ের চূড়োয় বলটা স্থির হলো। পরমুহূর্তেই এক আশ্চর্য রক্তরঙা চেহারা নিয়ে নিল সারা আকাশ। এপাশে তখন মাথা তুলেছে সোনার তাল। ওপাশের সেই লাল বল ক্রমশ লক্ষ মণিমুক্তাখচিত মুকুট হয়ে গেল আচমকা। ওটা কি কাঞ্চনজঙ্ঘা? অ্যান পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল।

তিনটে হাত তখন কাগজের গোল্লাগুলো মুঠোয় ধরেছে। চিৎকারটা শুনতেই তারা কেঁপে উঠল। এটা যেন ঠিক কোনো মানুষের গলা থেকে স্বাভাবিকভাবে আসেনি। অবাক হয়ে কার্পেটের ওপর বসা তিনজন মুখ তুলতেই দেখল দরজা জুড়ে অ্যানের শরীর। সেই শরীর সমস্ত পৃথিবী থেকে তাদের আড়াল করে রেখেছে। সেই শরীরের পাশ দিয়ে নরম সোনার আলো ঝিকমিকিয়ে এই ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। দুহাত মাথার ওপর ছড়িয়ে অ্যান প্রবল আনন্দে আবার চিৎকার করে উঠল। এই চিৎকারে কোনো ভয় নেই, কোনো জাগতিক দুঃখ নেই, ঘৃণা নেই। পরম সুখে আপ্লুত না হলে মানুষের শরীরে এই শব্দ জন্ম নেয় না।

অ্যান কি দেখছে তা ওরা জানল না। কিন্তু এদের মুঠো শিথিল হওয়ায় কাগজের গোল্লাগুলো পড়ে গেল। ওদের চোখের সামনে অ্যানের শরীর এখন সিল্যুটের চেয়েও ঝাপসা। নবীন সূর্যরশ্মি ওদের যেন অন্ধ করে দিচ্ছিল। শুধু ওরা শুনল অ্যান মন্ত্রোচ্চারণের মতো বলছে, ও, ভগবান, আমার ভগবান।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress