দরজাটা খুলল পার্থ
দরজাটা খুলল পার্থ। সিঁড়িতে তুষার জমে আছে। থপ থপ করে চার্লি এগিয়ে আসছে। ওর জুতোর ধাক্কায় তুষার ছিটকে যাচ্ছে। মোজা ছাড়াই জুতোটা এর মধ্যে কখন পরে নিয়েছে পার্থ জানে না। হয়তো তাকে ডাকার সময়, তাহলে সে লোকটার কাছে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েই ছিল। দরজা পেরিয়ে কার্পেটের ওপর কোনোরকমে লোকটাকে নামিয়ে থপ করে বসে পড়ল চার্লি। তার বুক ওঠানামা করছে, মুখ হাঁ সেখান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। কথা বলতে পারছে না এই মুহূর্তে। দরজাটা বন্ধ করে লোকটার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল পার্থ। বিদেশি। চোখ বন্ধ, ঘাড়টা কাত হয়ে গেছে। সারা শরীরে প্রচুর গরম পোশাক কিন্তু সেগুলোর অর্ধেকই ভেজা। লোকটার পিঠে, তখনও রুকস্যাক আটকানো। শরীরে কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই, মড়ার মতো পড়ে আছে।
নিঃশ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসামাত্র চার্লি বললো, ও বেঁচে আছে, অন্তত আমি ওর বুকের শব্দ শুনেছি। হেল্প হিম, কিছু একটা করো। বলতে বলতেই চার্লি উঠেছিল। প্রথমে লোকটার রুকস্যাক শরীর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, দ্যাখো তো, এর মধ্যে শুকনো কিছু পাও কিনা। তারপর ওর জুতো মোজা খুলতে লাগল। ভিজে চপচপ করছে জুতোর চামড়া।
রুকস্যাক খুলে পার্থ বুঝতে পারল লোকটা বেশ শৌখিন। ব্রুট ফর মেন, ওল্ড স্পাইস সেভিং লোশন থেকে শুরু করে জামাকাপড়গুলো পর্যন্ত তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ওপরেরগুলো বেশ ভিজে গেছে চুঁইয়ে ঢোকা জলে। লোকটার রুকস্যাকের কাপড়টা খুব ভালো ওয়াটারপ্রুফে তৈরি। একটা মাঝারি সাইজের চামড়ার ব্যাগ এবং তার তলায় ঘুমোবার থলেও নজরে পড়ল। চার্লি ততক্ষণে লোকটাকে প্রায় নগ্ন করে ফেলেছে। শুধু অন্তর্বাস ছাড়া যা কিছু ভিজে তা খুলে চেয়ারের ওপর রেখে পার্থর দেওয়া কম্বলটা লোকটার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে ওর দুটো পায়ের তলা ঘষতে লাগলো সজোরে। পার্থ দেখলো ব্যাগের কোনায় সাদা অক্ষরে লেখা, মাইক ল্যাম্ব, লনডন। ব্যাগটা খুললো পার্থ। সে চার্লির দিকে তাকিয়ে বলল, লোকটার নাম মাইক ল্যাম্ব, ব্রিটিশ। তুমি একটা সাদা চামড়ার সেবা করছ!
চার্লি হঠাৎ পিচ করে একদলা থুতু ছুঁড়ে দিল ঘরের কোনায়, ওয়েল, হি ইজ হোয়াইট। ওকে যখন প্রথম দেখি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম।
তাহলে? তাহলে ওকে তুমি তুলে আনলে কেন? তুমি সাদাদের ঘেন্না করো বলছিলে।
ইয়েস আই হেট দেম। মাইকের দুটো পা ভাঁজ করে বারংবার পেটের কাছে নিয়ে গিয়ে আবার সোজা করে দিচ্ছিল চার্লি, কিন্তু মনে হলো লোকটা মরে যাবে। মরে গেলে, তুমি কখনও তিনদিনের বাসি লাশের চামড়া দেখেছ? সাদা থাকে না। আচ্ছা, তুমি ওখানে বসে কী করছ? ওর বুকটা ম্যাসেজ করে দাও তাতে সেন্স ফিরে আসতে পারে। চার্লির গলায় এবার ধমকের সুর। পার্থ কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও অস্বীকার করতে পারল না। লোকটাকে বাঁচানো দরকার। যদিও এই নামের লোকটা বেঁচে উঠবে বলে মনে হয় না তবু চার্লি যখন চেষ্টা করছে তখন তারও উচিত হাত দেওয়া। নইলে কাল সকালে নিজের কাছেই হয়তো খারাপ লাগবে।
মাইকের গালের চামড়া খুব মসৃণ, একটু মেয়েলি মেয়েলি। এই প্রথম কোনো ব্রিটিশের শরীর এভাবে স্পর্শ করলো পার্থ। এই শালারা দুশবছর ভারতবর্ষকে শাসন করেছে। সাতচল্লিশ সালের আগে কি ওকে এভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করত সে? মাইকের নাক, গাল, গলা, এখন বেশ ঠান্ডা। খুব জোরে কিন্তু অনভ্যস্ত হাতে ম্যাসেজ করছিল পার্থ। এমন সময় চার্লি ওর পা দুটোকে আবার সোজা করে রেখে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এসে পার্থকে থামতে বলে বুকে কান পাতল। পার্থর মনে হলো একটা সাদা কাগজের ওপর কয়লার চাঙর রাখা হয়েছে। মুখ তুলে চার্লি হাসলো, বেঁচে আছে। আগের থেকে এখন অনেক স্পষ্ট। তোমার কি মনে হয় ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়বে?
পার্থ কাঁধ নাচালো, কী করে বলব? আমি ডাক্তার নই।
চার্লি ভিতরের ঘরের দরজার দিকে তাকাল, তোমার কাছে আর যা কম্বল আছে নিয়ে এসো, কিছুক্ষণ চাপা দিলে ওর সেন্স ফিরে আসবে।
পার্থ উঠে দাঁড়াল, নো। আমার আর স্পেয়ার করার মতো কম্বল নেই।
চার্লি বোধহয় কী করবে বুঝতে পারছিল না। মাইকের দিকে তাকিয়ে বলল, একটু আগুনের তাপ পেলে, ও ঘরে তো আগুন জ্বালা যাবে না। তোমার মোমবাতিটাও ফুরিয়ে আসছে! এসো আমরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ওর জন্যে। কথাটা শেষ করেই লাফিয়ে উঠল সে, আই গট ইট। কাম অন। নিচে নামিয়ে আনল সে। তারপর এক হাতে মোমবাতি ধরে অন্য হাতে জুতোটাকে তার আগুনে পোড়াতে লাগল। একটু একটু করে উৎকট গন্ধে ঘরটা ভরে গেল। চামড়া চিড়বিড় করে ওঠামাত্র সেটা মাইকের নাকের তলায় ধরছিল চার্লি। একটু একটু করে মনে হলো, মাইকের মুখের পেশী নড়ছে। তারপর সে মুখ বিকৃত করতেই চার্লি লাফিয়ে উঠল, গড সেভ হিম। লুক পাতরো, ওর সেন্স ফিরেছে।
পার্থ দেখল মাইকেল ডানদিক থেকে বাঁদিকে মুখ নিয়ে গেল এবং ওর ঠোঁট থেকে কি একটা শব্দ অস্ফুট উচ্চারিত হলো।
ওকে একটু হুইস্কি খাইয়ে দাও।
যেন এই ঘরে আণবিক বিস্ফোরণ ঘটল। পার্থ দরজার দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেল। ওর কোনো বোধ কাজ করছিল না প্রথমে। তারপরে একই সঙ্গে ক্রোধ এবং হতাশা ওকে বিদ্ধ করল। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। চার্লি যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আশ্চর্যজনক ব্যাপার দেখছে এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে। ওর চোখ আরও ছোট হয়ে এসেছে, যেন দুশো পাউন্ডের একটা ঘুষি পড়েছে। মুখে, এমন ভঙ্গিতে চেয়ে আছে সে। পার্থ এবার চিৎকার করে উঠলো, তোমাকে আমি এই ঘরে আসতে নিষেধ করেছিলাম।
সেইসময় চার্লি যেন শিশুর গলায় বলে উঠলো, হা! অ্যা গার্ল।
দরজায় দাঁড়িয়ে অ্যান। হাতে পার্থর পিটার স্কটের বোতল, ওকে একটু একটু হুইস্কি খাইয়ে দাও। এটা ওকে সুস্থ করতে সাহায্য করবে। কথাটা বলে খুব নির্বিকার ভঙ্গিতে হুইস্কির বোতল টেবিলে রেখে আবার ঘরে ফিরে গেল সে। দুই মুহূর্ত বাদে একটা কম্বল যেন উড়ে এল ভেতর থেকে, এসে পড়লো মাইকের ওপরে, ওকে আর একটু উত্তাপ দাও। দরজাটা এখন খোলা।
ততক্ষণে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে চার্লি। দ্রুত পার্থর কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এতক্ষণ ওই ঘরে মেয়েটার সঙ্গে ছিলে? ইউ লাকি গাই।
ক্রোধ যেন সোচ্চার হলো। রাগত মুখে পার্থ বললো, তুমি যা করছিলে তাই করো।
ইয়েস ইয়েস আই উইল। কিন্তু মেয়েটা কে?
তাতে তোমার কী দরকার?
ইওর ফ্রেন্ড? ওয়াইফ?
না। আমি তোমাকে বলেছি এ বিষয়ে আর আলোচনা করবে না।
গুড গড! মেয়েটা কে এটুকু বলতে তোমার আপত্তি হচ্ছে কেন?
ট্রেকার। তোমার মতো সূর্য দেখতে এসেছে। কিন্তু আমি ওকে আশ্রয় দিয়েছি।
তুমি আমাকেও আশ্রয় দিয়েছ। কিন্তু আমি এখানে মেঝের ঠাণ্ডায় আর ও ভেতরে ঘরের খাটে, আরামে। ও তাই এতক্ষণ আমাকে তুমি ওই ঘরে ঢুকতে দিচ্ছিলে না। তুমি ওকে শেয়ার করতে চাও না। বাট শি ইজ সামথিং। দারুণ সেক্সি। ওঃ, আমি চিন্তাই করতে পারছি না এই রকম ঠাণ্ডার রাত্রে একটা জ্বলজ্যান্ত সেক্সি মেয়ে আমাদের মধ্যে রয়েছে। ওয়েল, তুমি কি আবিষ্কার করে ফেলেছ? চার্লির মুখ এখন গদগদ। পার্থর মনে হলো সেখানে অদৃশ্য লালা ঝরছে। আর তখনই একটা শিরশিরে ভয় ওকে ছুঁয়ে গেল। ওর মনে হলো খুব দ্রুত তার হাত থেকে অ্যান বেরিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ ধরে যে ধৈর্য নিয়ে সে অ্যানের সঙ্গে সময় কাটিয়েছে তা চার্লির মুখভঙ্গি অর্থহীন করে দিচ্ছে। উঃ! শালা হারামী মেয়েছেলেটাকে এত করে বলা সত্ত্বেও দরজায় এসে দাঁড়াল। হুইস্কি খাইয়ে জান ফেরাতে এসেছেন। সাদা চামড়া জেনে দরদ উথলে উঠল। এতক্ষণ ধরে এত ভদ্রতা করার কোনো দরকার ছিল না। পার্থ আফসোসে ঠোঁট কামড়াল। ঠিক তখনই চার্লি চিৎকার করে উঠলো, হায় ভগবান, তোমার ঘরের ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে আর তুমি আমাকে–।
পার্থ দেখল খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চার্লি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ওর মনে হলো ওই কালো দৈত্যটাকে সামলাতে হলে এই সায়েবটাকে চাঙ্গা করতেই হবে। সে গম্ভীর গলায় বলল, লুক চার্লি, আমাদের উচিত এই লোকটার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা। মানুষ হিসেবে সেটাই আমাদের কর্তব্য।
কথাটা কানে যেতেই চার্লি মুখ ফিরিয়ে দেহটাকে দেখল। তারপর একান্ত অনিচ্ছায় কাছে এগিয়ে এসে হাঁটু মুড়ে বসল, দাঁড়াও, ওকে ডাকা যাক। হেই ম্যান, হেই–।
আলতো করে মাইকের গালে চড় মারল চার্লি যদি তাতে সেন্স ফিরে আসে। তারপর একগাল হেসে বলল, সাদা চামড়ার গালে চড় মারতে খুব আরাম লাগে।
পার্থ অবাক হয়ে তাকাল! যে লোকটা নিজের জীবন বিপন্ন করে ইংরেজ বাঁচিয়েছে সেই কি আনন্দে এই কথা বলতে পারছে। কিন্তু চার্লিকে মাইকের সঙ্গে আটকে রাখা দরকার।
সে বলল, ঠিক আছে। ও সুস্থ হলে তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারো। কিন্তু আগে ও যাতে সুস্থ হয় সেই চেষ্টা করো। এই ঝামেলাটিকে তুমিই আমদানি করেছ।
চার্লি হাসল, এই হোয়াইটটা না এলে ওই সুন্দরীটিকে দেখতে পেতাম না আজ! ধরো, আমি যদি এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতাম তাহলে কি ও আসত, কক্ষনো না। বাই দ্য বাই, ওকে হুইস্কি খাওয়াতে বলেছিল, না? হাত বাড়িয়ে বোতলটা টেনে নিল চার্লি। লেবেলটা পড়লো, পিটার স্কট। ছিপি খুলে ঢকঢক করে নিজের গলায় অনেকখানি ঢেলে দিল সে। তারপর দুটো মোটা আঙুলে মাইকের ঠোঁট ফাঁক করে দাঁতের পাটি বিযুক্ত করল, এ শালা তিনদিন দাঁত মাজে নি।
হুইস্কির বোতলটা শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে ঝিম মেরে গিয়েছিল পার্থ। হঠাৎ মনে হলো দুটো বোতল নিয়ে এলে ভালো হতো। এই দৈত্যটাকে তাহলে মদ খাইয়ে অজ্ঞান করে রাখা যেত। চার্লি তখন খুব সতর্ক ভঙ্গিতে মাইকের মুখের ভেতরে হুইস্কি ঢালছে। মাইকের জিভ নড়তেই এক হাতেই ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো চার্লি। সামান্য প্রতিবাদের ভঙ্গি করে হুইস্কিটাকে গিলে ফেলল মাইক! সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল চার্লি, এই যে সুন্দরী, তোমার প্রেসক্রিপশন কাজে লেগেছে। শালা মাল গিলছে।
আবার জোর করে দাঁত ফাঁক করে খানিকটা হুইস্কি ঢেলে দিল চার্লি। এবার সেটাকে অনেকটা স্বচ্ছন্দে গিলে ফেলে মাইক স্পষ্ট উচ্চারণ করলো, আঃ।
চার্লি উঠে দাঁড়াল, ব্যস হয়ে গেছে। এর জ্ঞান ফিরে এসেছে।
সত্যি মাইকের চেতনা খুব দ্রুত ফিরে আসছিল। ওর পা ভাঁজ হলো, হাত নড়ল। মুখ থেকে আর কিছু শব্দ বের হলো। পার্থ কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, হ্যালো, কেমন লাগছে এখন? শুনতে পাচ্ছ!
দুটো চোখের পাতা ধীরে ধীরে খুলে গেল। মাইক যে কিছু দেখতে পাচ্ছে এমন মনে হলো না। দুটো হাত মুঠো পাকানো। পার্থ আবার জিজ্ঞাসা করল, কেমন লাগছে?
এবার মাইকের ঠোঁটের কোণে ভাঁজ পড়ল। গলা থেকে স্পষ্ট শব্দ বের হলো, ফাইন।
তারপর দুহাতের ওপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। কম্বলটা শরীর থেকে পড়ে যাচ্ছিল দেখে টেনে নিয়ে বলল, ওঃ গড! কি ঠান্ডা। আমার কী হয়েছিল?
তুমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। তোমার নাম মাইক ল্যাম্ব?
খুব শীর্ণ গলার স্বর, মাইক বললো, হ্যাঁ। হাউ ডু ইউ নো?
তোমার ব্যাগে নাম দেখেছি। তুমি ওই হোস্টেলের বারান্দায় পড়েছিলে। কখন এসেছ তুমি?
তোমার কি মনে হয় কথা বলতে পারবে? পার্থ জিজ্ঞাসা করল।
ও ইয়েস। আমি যখন এসেছি তখন খুব বৃষ্টি পড়ছিল। আমি যে কেন রাস্তায় পড়ে যাইনি আমি জানি না। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল বিদ্যুতের আলোয় আমি ইয়ুথ হোস্টেলের সাইনবোর্ডটা দেখতে পাই। তারপর আর খেয়াল নেই। তুমি কে? মাইক যখন কথা বলছিল তখন ওর শরীর মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছিল।
আমি এই বাংলোটা রিজার্ভ করেছি। তুমি তো কাল ভোরের সূর্য দেখতে এসেছ?
ওঃ, অফকোর্স। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ বলে ধন্যবাদ। কিন্তু আমার শীত করছে।
পার্থ বোতলটা তুলে দেখল সেখানে সিকি পেগও পড়ে নেই। তার মাইককে ভাল লাগছিল, তুমি কী করো?
আমি ছাত্র। রিসার্চ করছি। তুমি ইন্ডিয়ান? হুইচ প্রভিন্স?
আমি বাঙালি। ল্যান্ড অফ ট্যাগোর!
ট্যাগোর? হু ইজ হি?
পোয়েট। নোবেল প্রাইজ উইনার পোয়েট। মাইকের অজ্ঞতা দেখে অবাক হয়ে গেল পার্থ।
আই সি। এখন তো নোবেল প্রাইজ উইনারদের নিয়ে একটা বাজার খোলা যায়। তোমার নাম কী? সমস্ত শরীরে দু নম্বর কম্বলটা মুড়ে নিচ্ছিল মাইক।
পার্থ। ঠিক আছে, তুমি এখানে শুয়ে পড়ো। কাল সকালে দেখা হবে।
এখানে আমার খুব ঠাণ্ডা লাগছে। তোমরা আগুন জ্বালোনি?
পার্থ দ্বিধায় পড়ল। তারপর শান্ত গলায় বলল, সেখানে তুমি গেলে আমার অসুবিধা হবে।
কেন?
ওখানে আমি আমার বান্ধবীকে নিয়ে আছি। অতএব রাতটা কোনোমতে এখানেই কাটিয়ে দাও; সকালে দেখা হবে। তাছাড়া এখানে তোমার আর একজন সঙ্গী রয়েছে।
হাত বাড়িয়ে চার্লিকে দেখাল পার্থ। চার্লি এতক্ষণ ভেতরের দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল। তার অস্তিত্ব টের পায়নি মাইক। এবার পার্থর কথায় মুখ ফেরাতে সে চার্লিকে দেখেই তার কপালে ভাঁজ পড়লো, হু ইজ হি?
তুমিও যা আমিও তাই, সূর্য দেখতে এসেছি। আই অ্যাম চার্লি ফ্রম ইউ এস এ। একটুও না নড়ে চার্লি কথাগুলো বলল।
এবার মাইকের মুখের পরিবর্তন হলো। সে চাপা গলায় পার্থকে ডাকল, একটু কাছে এসো, প্লিজ!
পার্থ ওর বলার ভঙ্গিতে বুঝল সে চার্লিকে না শুনিয়ে কিছু বলতে চায়। একটু ঝুঁকে মাথা নামাল পার্থ, কী বলছ?
মাইক আড়চোখে আর এর চার্লিকে দেখে নিল। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, আমি ওই নিগ্রোটার সঙ্গে একঘরে শুতে পারব না।
পার্থ হেসে ফেলল। ওর এই প্রথম মজা লাগল। নিচু গলায় সে জবাব দিল, কিন্তু ওই নিগ্রোটাই তোমার জীবন বাঁচিয়েছে। ও না থাকলে তুমি এতক্ষণে–!
ইজ ইট? মাইক আবার চার্লির দিকে তাকল। চার্লি দরজা থেকে একটুও নড়েনি। এরা কী কথা বলছে তা শোনার বদলে তার চোখ এখন ঘরের ভেতরে।
মাইক বলল, তা হোক, তোমার এখানে স্পেয়ারেবল রুম নেই!
আমি জানি না। এই বাংলোটাকে এখনও ঘুরে দেখি নি আমি। যাক, আর বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। তোমার কিছু জামা-প্যান্ট বোধহয় শুকনো আছে, সেগুলো পরে ফেলে এখানেই রাতটা কাটিয়ে দাও। জিপের হ্যান্ডেলটাকে তুলে নিল পার্থ।
চকিতে মুখ ঘোরাল চার্লি, ওটা নিয়ে কী করতে চাও?
পার্থ চট করে কিছু বলতে পারল না। তার মুখের দিকে তাকিয়ে চার্লি দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। পার্থর মনে হলো এখন আর কিছুতেই নরম হওয়া যায় না। সে খুব শান্ত রাখতে চাইলো নিজেকে, এটা হাতে রাখলে আমার ভালো লাগে।
পেছন থেকে মাইক চিৎকার করে উঠল, এখানে থাকলে আমি মরে যাব।
কেন? পার্থ ঘুরে দাঁড়াল, তোমাকে তো কম্বল দেওয়া হয়েছে।
চার্লি হাত ওল্টালো, ওয়েল, আমি কী গায়ে দেব? আমি শুনেছিলাম ভারতীয়রা খুব অতিথিবৎসল, তুমি কি তাই করছ? তোমার ওই ঘরে ফায়ারপ্লেস জ্বলছে, আমাদের এখানে কী আছে? টেল মি, তুমি তো হোয়াইটি নও?
মাইক উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল, ফর গডস সেক, আমাকে একটু ফায়ারপ্লেসের সামনে নিয়ে যাও। দশ মিনিটের জন্যে, প্লিজ, আমি কথা দিচ্ছি তার বেশি থাকব না।
চার্লি এগিয়ে গেল মাইকের দিকে, হে ম্যান, কোনো ভদ্রমহিলার সামনে যেতে হলে একটু ভদ্রপোশাকে যেতে হয়। ইংরেজরা শুনেছি এসব ব্যাপার ভালো জানে কিন্তু তার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি। লক্ষ্মী ছেলের মতো বসো এখানে, আমি তোমাকে সাহায্য করছি পোশাক পরতে।
মাইক অসহায় চোখে পার্থর দিকে তাকাল। তারপর একহাতে সরিয়ে দিতে চাইল চার্লিকে, ঠিক আছে, ওটা আমি নিজেই পারব।
পার্থর হঠাৎ মনে হলো চার্লিকে ঠেকিয়ে রাখতে হলে মাইকের সাহায্য দরকার। মাইক চাইছে মিনিট দশেকের জন্যে ফায়ারপ্লেসের কাছে বসতে। সেটুকু অনুমতি দিলে যদি ওকে দলে পাওয়া যায় তাহলে বাকি রাতটা সে অ্যানের সঙ্গে কাটাতে পারে। অ্যান যা গোলমাল করার তা দেখা দিয়ে করে গেছে, কিন্তু এটা তো ঠিক আর এঘরে আসেনি। হয়তো সে আর তার অবাধ্য হতে চাইবে না। যতটুকু সম্ভব পোশাক পাল্টে কম্বল দুটো শরীরে জড়িয়ে মাইক দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। চার্লি পকেট থেকে কিছু একটা বের করে চিবোতে চিবোতে বললো, ওয়েল, এখন আর তুমি আমার সাহায্য চাও না, না? ফাইন।
মাইক ধীরে ধীরে দরজার সামনে চলে এল। ওর শরীরে এখনও কাঁপুনি রয়েছে। দরজায় দাঁড়িয়ে সে ফায়ারপ্লেস দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হলো, ফাইন। তারপর হুড়মুড় করে নিজের শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেল আগুনের সামনে। পার্থর মনে হলো লোকটা হয়তো আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেগ সামলে নিল মাইক। দুটো হাত ফায়ারপ্লেসের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল কিছুক্ষণ।
পার্থ দেখল তার পাশ কাটিয়ে চার্লি ঢুকলো এই ঘরে। তারপর ফায়ার প্লেসের একপাশে চেয়ার টেনে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসল, আমরা এখানেই রাত কাটিয়ে দিতে পারি, কী বলো?
না, কখনই না। দশ মিনিট বাদেই তোমাদের ওই ঘরে ফিরে যেতে হবে। পার্থ এগিয়ে এসে খাটের ওপর বসল। ওর হাতে তখনও হ্যান্ডেলটা ধরা রয়েছে।
ওটাকে মাটিতে রেখে দাও, দেখতে বিশ্রী লাগছে। চার্লি আঙুল তুলে দেখাল।
এ নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
কাঁধ নাচাল চার্লি, কি জানি, ওটা দেখলেই আমার মনে হচ্ছে তুমি হেঁটে আসোনি, গাড়িতে এসেছ। তার মানে তুমি আমাদের থেকে আলাদা। তারপর খাটের ওপর চোখ রেখে বলল, কেউ যখন আলাপ করিয়ে দিচ্ছে না তখন নিজেই আলাপ করছি। দিস ইজ চার্লি ফ্রম ন্যুয়র্ক। মাথা ঝুঁকিয়ে বললো সে।
আ–নুয়র্ক। আমার নাম অ্যান। সূর্য দেখতে এসেছি। বিছানায় উবু হয়ে বসা অ্যান মাথা নাড়লো। ওর বুক অবধি কম্বলে ঢাকা।
সঙ্গে সঙ্গে ফায়ারপ্লেসের সামনে উপুড় হয়ে বসা মাইক মুখ ফেরাল। এখন ওর শরীরে আর কাঁপুনি নেই কিন্তু দুই চোখে বিস্ময়, তুমি, তুমিও সূর্য দেখতে এসেছ?
হ্যাঁ। অ্যান মাথা দোলাচ্ছিল, আমি তোমাদের খানিক আগে এখানে এসেছি।
চার্লি সেই জিনিসটা এখনও চিবিয়ে যাচ্ছিল, গাড়িতে?
নো। আমি হেঁটে এসেছি। অ্যান প্রতিবাদ করলো।
তাহলে তোমাদের মধ্যে আগে আলাপ ছিল না? চার্লি পার্থর দিকে তাকালো।
না। কিন্তু এখানে আলাপ হওয়ার পর আমরা একটা বোঝাপড়ায় এসেছি। পার্থ বুঝতে পারছিল পুরো ব্যাপারটাই হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে মাইক উঠে দাঁড়াল। এখন ওকে অনেকটা সুস্থ দেখাচ্ছে। মুখের চামড়ার ফ্যাকাশে ভাবটা কেটে গিয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেন নিজেকে ফিরে পেল সে। তারপর দ্বিতীয় চেয়ারটা টেনে নিয়ে আরাম করে বসলো, আমি মাইক ল্যাম্ব ফ্রম লন্ডন।
গ্ল্যাড টু মিট ইউ। অ্যান হাসল, এখন কেমন বোধ করছ?
ভালো, অনেকটা ভালো। এই আগুন আমাকে ভালো করে তুলেছে।
চার্লি বলল, কিন্তু এই মহিলার কাছে তোমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। কারণ ওই হুইস্কির বোতলটা না পেলে তোমার জ্ঞান ফিরে আসত না।
হুইস্কি?
হ্যাঁ। তোমার মুখে ঢেলে দিতে তবে চোখ খুলেছে।
ইজ ইট? তাহলে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। মাইক বিনীত ভঙ্গিতে বললো।
এবার চার্লি উঠে দাঁড়াল, আমি তাহলে এই ঘরে আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে আসি।
কেন? পার্থর কপালে ভাঁজ পড়ল।
এখন তো আর আমাদের একসঙ্গে থাকতে আপত্তি থাকার কথা নয়। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের আলাপ হয়ে গিয়েছে। অতএব এই ঘরের আরাম আমরা ভাগ করে নিতে পারি, তাই না। তোমার ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভে আসছে।
চার্লি হাত তুলে দেখাল।
আর কাঠ নেই? মাইক জিজ্ঞাসা করল।
পার্থ বললো, ওই দরজা খুলে যে প্যাসেজটা পাওয়া যাবে তার শেষে স্টোর রুমে কাঠ রাখা আছে। চার্লি, তুমি নিশ্চয়ই নিয়ে আসতে পারো।
পারি। কিন্তু আমাকে কেউ একটা কম্বল দাও।
অ্যান নিজেরটা খুলে দিচ্ছিল কিন্তু মাইক বাধা দিল, না না, আমি দিচ্ছি।
কিন্তু তুমি অসুস্থ! অ্যান আপত্তি করল।
এখন আমি ভালো আছি। তাছাড়া ফায়ারপ্লেসের সামনেই বসে আছি যখন–। মাইক একটা কম্বল চার্লির দিকে ছুঁড়ে দিল। সেটাকে গায়ে জড়াতে জড়াতে চার্লি বলল, এইঘরে ঢুকেই তুমি সুস্থ হয়ে গেছ মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, এই ফায়ারপ্লেসটা আমাকে সাহায্য করেছে। আমার একটু আগুনের দরকার ছিল।
দরজা খুলে প্যাসজে পা বাড়াবার আগে চার্লি চিবোতে চিবোতে বললো, আগুন তো শুধু ফায়ারপ্লেসে ছিল না, কি বলো মিস?
প্যাসেজে ওর পায়ের শব্দ যখন শোনা গেল তখন এই ঘরে কোনো শব্দ নেই।
চার্লির ইঙ্গিত যেন কয়েক চাঙর বরফ ফেলে দিল তিনজনের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত মাইক যেন অনেকটা নিজের মনে বলে উঠল, এই লোকগুলো ভদ্রতা পর্যন্ত শেখেনি, এই ব্লাকিরা।
পার্থ দ্রুত বলে ফেলল, ঠিক বলছ মাইক। আমি এই লোকটাকে পছন্দ করছি না।
ও কি আমার অনেক আগে এখানে এসেছে?
হ্যাঁ। আমি দরজা খুলতে চাইনি, অ্যান বলল বলে খুলতে হলো।
মাইক অ্যানের দিকে তাকাল, তোমার মন মনে হচ্ছে খুব নরম। ওর সম্পর্কে সাবধানে থেকো। আমি কখনই ব্লাকিদের বিশ্বাস করি না।
কেন? অ্যান বাঁ হাতে ওর কপালে পড়ে থাকা চুল সরাল।
আমি জানি না কেন? শুধু আই ডোন্ট বিলিভ দেম।
এই সময় প্যাসেজে আবার পায়ের আওয়াজ উঠল। একগাদা কাঠ দু-হাতে তুলে নিয়ে চার্লি ঘরে ঢুকল, হেই ম্যান, এখানে আরও কয়েকটা ঘর রয়েছে।
মাইক এবার উঠে দাঁড়ালো, ইজ ইট? তাহলে চলো সেই ঘরগুলো আমরা দেখে আসি। যদি সেখানে খাট বিছানা থাকে তাহলে আর কাউকে কষ্ট করতে হবে না।
প্রস্তাবটা পার্থর পছন্দ হলো। দুটো খাট পেলে এই দুটোকে নিয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না। সে বললো, বেশ চলো, দেখে আসি।
কাঠগুলো ফায়ারপ্লেসের পাশে নামিয়ে চার্লি মাথা নাড়লো, আমি বাবা যাচ্ছি না।
যাচ্ছ না? কেন? পার্থ আবার বিরক্ত হলো।
বাইরে ভীষণ ঠাণ্ডা। তাছাড়া এরকম আরামের ঘর ছেড়ে পাগল না হলে কেউ যায়? চার্লি কথা শেষ করে অ্যানের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে হাসল।
মাইক সেটা দ্যাখেনি, বললো, আমরা সেই ঘরেও ফায়ারপ্লেস থাকলে আগুন জ্বালিয়ে নিতে পারি। কোনো অসুবিধে হবে না। এখানে আর কাঠ নেই?
পার্থ বলল, প্রচুর কাঠ আছে।
মাইক বললো, চমৎকার চলো দেখে আসি। তোমাদের কাছে টর্চ আছে? বাঃ, এই তো, এটা সঙ্গে নাও। একটা মোমবাতি নেবে নাকি? এই প্রশ্নটা পার্থর উদ্দেশে।
পার্থ মোমবাতি নিল, চার্লি, চলে এসো।
চার্লি চোখ বন্ধ করে সেই জিনিসটা চিবিয়ে যাচ্ছিল, আমি এখান থেকে গেলে ওই মহিলার অসুবিধে হবে। এরকম জায়গায় কোনো মহিলাকে একা রেখে যাওয়া উচিত নয়। ঘর খুঁজতে তিনটে লোকের যাওয়ার কী দরকার? মিস্, তুমি কী বলো?
অ্যান ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, ঠিকই। এটা পার্থকে আরও বিরক্ত করল। মেয়েটা কি চার্লির মতলব বুঝতে পারছে না! লেটস গো।
খুব খারাপ লাগছিল অ্যানকে চার্লির সঙ্গে একঘরে ছেড়ে যেতে কিন্তু মাইক যাচ্ছে দেখে যেতে বাধ্য হলো পার্থ। প্যাসেজটা এখন আরও কনকনে। যদিও বাইরে ঝড় কিংবা বৃষ্টি নেই তবু ঠাণ্ডা ওই ঘরের বাইরে আসতেই হাড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। পার্থ বলল, ওদিকে টয়লেট আর স্টোর ছাড়া আর কিছু নেই মাইক, এদিকে চলো। কথা বলার সময় ওর দাঁতের নাচন শুরু হয়ে গেল। ডানদিনের দরজাটা খুলতেই একটা ঘর। নিচে দড়ির ম্যাট্রেস, একটা তক্তপোষের ওপর জীর্ণ গদি। আর কোনো আসবাব নে, এই ঘরে।
মাইক বলল, এখানে চার্লি শুতে পারে, কী বলো?
পার্থ মাথা নড়াল, নিশ্চয়ই। কিন্তু আগুনের বায়না ধরতে পারে লোকটা।
মাইক বলল, ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে অন্য কোনো ঘরে যদি ফায়ারপ্লেস না থাকে তাহলে শোওয়ার ঘরটা মহিলাকেই ছেড়ে দেওয়া ভদ্রতা। তোমার সঙ্গে ওর আগে থেকে বন্ধুত্ব ছিল না?
না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমি এই বাংলো রিজার্ভ করেছি এবং অ্যানকে জায়গা দেওয়ার পর আমাদের চমৎকার বোঝাপড়া হয়ে আছে। খুব কর্তৃত্বের সঙ্গে জানাল পার্থ। এই ঘরের দ্বিতীয় দরজা দিয়ে মাইক এগোতেই পার্থ তাকে অনুসরণ করল। আর তখনই একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ কানে এল। মেঝের ওপর দিয়ে কিছু টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এরকম একটা ঘষটানির আওয়াজও কানে এল। বন্ধ দরজা খুলে এই ঘরে ঢুকতেই ওরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এটা বোধহয় চৌকিদারের ঘর এবং তার বাইরে যাওয়ার দরজাটা অর্ধেক খোলা। হালকা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে তার ফাঁক দিয়ে। মাইক চাপা গলায় গলায় বলল, দরজাটা খোলা। কোনো মানুষ থাকে নাকি এখানে?
পার্থ অনুভব করছিল ঠাণ্ডাটা চট করে খুব বেড়ে গেল। ওই আধখোলা দরজা দিয়েই হু হু করে ঠাণ্ডা ঢুকছে এই ঘরে। টর্চের আলো কাঁপা হাতে চারপাশে ফেলে কিছু জামাকাপড়, ছেঁড়া বিছানার ওপর গোটা তিনেক মোটা কম্বল আর ঘরের কোণে হাঁড়িকুড়ি দেখতে পেল সে। এই ঘরের মেঝেতে কোনো ম্যাট্রেস নেই। এইসময় মাইক জিভ দিয়ে একটা শব্দ করল, দ্যাখো, ওখানটায় দ্যাখো! ওর হাত যেখানটা ইঙ্গিত করছিল সেখানে টর্চের আলো ফেলল পার্থ। শুকনো কিছু জমাট বেঁধে রয়েছে বিছানার পাশে, বিছানায়। ওটা যে রক্ত ছিল তা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। ওরা এই ঘরে আসামাত্র সেই ঘষটানির শব্দটা থেমে গিয়েছিল। চারধার অসম্ভব শান্ত। কিন্তু এবার সেটা শুরু হলো। কোনো ভারী জিনিস যেন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রায় পা টিপে টিপেই মাইক দরজার কাছে চলে গেল। তারপর মাথাটা বের করে সন্তর্পণে দেখার চেষ্টা করল বাইরে কি হচ্ছে। এবং তখনই তার মধ্যে উত্তেজনা এলো। দ্রুত হাত নেড়ে সে পার্থকে ডাকল। টর্চ নিভিয়ে পার্থ নিঃশব্দে ও পাশে এসে দাঁড়াতেই মাইক চাপা গলায় বলল, লুক। পার্থর মনে হচ্ছিল ওর নাক ঠোঁট গাল সব খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। তবু সে মুখ বের করল। এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্তনাদ মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। শব্দটা কানে যাওয়ামাত্র ওরা মুখ তুলে তাকালো। প্রত্যেকের জ্বলন্ত চোখে এখন সতর্কতা। কান খাড়া করে এদিকে তাকিয়ে আছে। মাইক বাঁ হাতে দরজাটাকে শব্দ করে খুলে দিতেই ওরা কয়েক লাফে নিচে গিয়ে দাঁড়াল। সংখ্যায় অন্তত পাঁচটা হবে। দাঁড়িয়ে হিংস্র দাঁতে এদিকে তাকিয়ে একজন চিৎকার করে উঠল। পার্থর মনে হলো সে একা থাকলে এই চিৎকার শুনলেই রক্ত হিম হয়ে যেত। মাইক বলল, নেকড়ে। কিন্তু লোকটা কে? ততক্ষণে পার্থর নজরে পড়েছে। পেছন দিকে ছোট্ট একটা কাঠের বারান্দা রয়েছে। সেই বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা শরীর চিত হয়ে পড়ে আছে। লোকটার শরীর ছোটখাটো।
মাইক এবার দৌড়ে বারান্দায় চলে গেল, ও ভগবান, কি ঠাণ্ডা! এরা লোকটাকে খেয়ে ফেলেছে! তারপর সামান্য ঝুঁকে চিৎকার করল, এখানে এসো, লোকটাকে খুন করা হয়েছে। খুনের কথা শোনামাত্র পার্থ পা চালালো। লোকটা পড়ে আছে চিত হয়ে এবং তার বাঁ দিকের বুকের ভেতর কিছু একটা বিঁধে রয়েছে। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, লোকটাকে হত্যা করা হয়েছে। মাইক মুখ তুলে নেকড়েগুলোকে দেখলো তারপর দু-হাত তুলে মুখে শব্দ করে তাদের তাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু নেকড়েগুলো শুধু দুই-এক পা সরে গেল মাত্র, ভয় পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। মাইক বলল, এই লোকটাকে এখানে রেখে গেলে সকালে কিছুই পড়ে থাকবে না। চলো ওকে ঘরে নিয়ে যাই। পার্থ লোকটার মুখ দেখে শিউরে উঠেছিল। তার সন্দেহ ছিল, এই হলো বাংলোর চৌকিদার। কেউ ওকে হত্যা করে ঘরে ফেলে রেখে গিয়েছে। ঘরের দরজা নিশ্চয়ই খোলা ছিল তাই নেকড়েগুলো ঢুকতে পেরেছে। ঢুকেই ওর মুখ থেকে মাংস খুবলে খেয়েছে। শরীরের জামাকাপড় ছিঁড়ে কুচি কুচি করেছে, পেটের কাছে অনেকটা গর্ত। বোধহয় ওই ঘরের বাইরে নিয়ে আরাম করে বাকিটা সাবাড় করবে ভেবেছিল ওরা। কিন্তু এই বীভৎস শরীরটার দিকে তাকিয়ে পার্থর পেট গুলিয়ে উঠছিল। মাইক ততক্ষণে ওর জামার হাত ধরে টানতে শুরু করেছে। লোকটা এত হালকা যে পার্থকে সাহায্য করতেই হলো না। সড়সড় করে দেহটাকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল সে। পার্থ দেখল ওদের খাবার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে নেকড়েগুলো দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছিল সিঁড়ির দিকে। পার্থ হাত নাড়তেই তারা থমকে দাঁড়িয়ে তাদের বীভৎস দাঁতগুলো দেখাতে লাগল। হঠাৎ পার্থর মনে হলো ওরা যদি এখন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে তার কিছুই করার থাকবে না। সে পিছু হটতে লাগলো। যত দরজার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে তত নেকড়েগুলো বারান্দার ওপর উঠে আসছে। শেষপর্যন্ত দরজার গায়ে হাত রেখে নিশ্চিন্ত হলো। পার্থ চকিতে সামনের দিকে তাকাল। চারধারে কেমন ঘোলাটে ভাব। জ্যোৎস্নায় সেই ঘোলা রঙ মাখামাখি হয়ে রয়েছে। বাংলোর পেছনের মাটিতে ঝুরঝুর করে সেই ঘোলাটে সাদাটে রঙ ছড়ানো। তুষার পড়ছে। চট করে দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালল সে। মাইক লোকটার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে পকেট খুঁজছে। কিছুক্ষণ আগে যে মানুষটা ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিল, তাকেই এখন সচল হতে দেখে অবাক হচ্ছিল সে। একেই বলে সাহেবের রক্ত, সপ্রশংস চোখে তাকাল পার্থ, এইজন্যেই ওর জাত এতদিন গোটা পৃথিবীটাকে চাকর বানাতে পেরেছিল।
মাইক বলল, নাথিং, এর পকেটে এমন কিছু নেই যা থেকে ওর পরিচয় জানা যেতে পারে। কিন্তু এই ঘরেই ওকে খুন করা হয়েছে।
লোকটা এই বাংলোর চৌকিদার। ওর গায়ে খাকি পোশাক রয়েছে। তাছাড়া নিচে আমাকে বলা হয়েছিল যে এই বাংলোর চৌকিদার আছে। আমি এসে ওকে দেখিনি। আমি আসার আগেই–। পার্থ চুপ করল।
অন্তত দিন তিনেক। তুমি বাংলোয় ঢুকলে কী করে?
তালা ভেঙে। পার্থ টর্চটা আবার দেওয়ালে ঘোরালো। এবার তার চোখে পড়ল পেরেক ঝোলানো চাবির গোছাটা। চৌকিদারটা নিশ্চয়ই বাইরে থেকে সদর দরজায় তালা দিয়ে রাখত।
মাইক উঠে দাঁড়াল, এটা একটা খুনের কেস। পুলিশকে জানানো উচিত।
পুলিশ! পার্থ হাসল, এর ধারেকাছেও পুলিশ নেই। কাল নিচে নেমে গিয়ে ওদের অফিসে খবর দিতে হবে। এখন ওকে ওইভাবেই রেখে দাও, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
এইসময় বন্ধ দরজায় নখের শব্দ শুরু হলো। নেকড়েগুলো আঁচড়াবার চেষ্টা করছে। আর তখনই শোওয়ার ঘর থেকে অ্যানের গলা ভেসে এল, ওহো! নো! নো–সেইসঙ্গে চার্লির হাসি। পার্থ চমকে মাইকের দিকে তাকালে তারপর দৌড়ে শোওয়ার ঘরের দরজায় চলে এল। চার্লি বিছানায় বসে। তার দুটো হাত অ্যানের কাঁধে। অ্যান প্রাণপণে চেষ্টা করছে হাত দুটো সরিয়ে দিতে।
চার্লি! চিৎকার করে উঠলো পার্থ।
চার্লি মুখ ফিরিয়ে ওকে দেখল! তারপর কাঁধ নাচিয়ে অ্যানকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ওয়েল বস্! তোমাদের শোওয়ার ঘর পাওয়া গেল?
তুমি কী করছিলে? অ্যান, তুমি ঠিক আছ তো? মাইক পেছনে এসে দাঁড়াতে পার্থ জোর পেল।
অ্যান উত্তর দিল না। সে খাটের এক কোণে উবু হয়ে বসে রয়েছে। কম্বলটা পড়ে গিয়েছিল, একহাতে সেটাকে তুলে নিয়ে চোখ বন্ধ করল।
মাইক এগিয়ে এল ঘরের মধ্যে, কী হয়েছে? প্রশ্নটা চার্লির উদ্দেশে।
নাথিং। এ লিলবিট ফ্যান্। চার্লি লাল দাঁত বের করে হাসল।
মাইক চলে এল খাটের পাশে, তারপর ঝুঁকে বলল, আমাকে বলো, ওকি তোমাকে অপমান করেছে?
হেই মিস্টার। চার্লি চেঁচিয়ে উঠল, তোমার কি করে মনে হলো আমি অপমান করেছি?
পার্থ বলল, ও চেঁচাচ্ছিল, আমরা শুনতে পেয়েছি।
চেঁচাচ্ছিল! তা একটু আধটু তো চেঁচাবেই। যাক। তোমরা যখন ঘর খুঁজে পেয়েছ তখন আর নষ্ট কোরো না। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে চার্লি বসল।
তার মানে? পার্থ চমকে উঠল।
খুব সোজা। তোমরা চলে যাও সেখানে, আমরা এবার শুয়ে পড়ব। তাই না মিস?
হঠাৎ মাইকের কণ্ঠস্বর চড়ায় উঠল, এই ঘরে তোমাকে কে থাকতে দিচ্ছে!
কে আর দেবে? আমি নিজেই থাকছি।
নো। মাইক চিৎকার করল, এই ঘরে আমি থাকব।
পার্থর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। সে এগিয়ে এল মাঝখানে, কি আশ্চর্য! আমি বুঝতে পারছি না কোন্ অধিকারে তোমরা এইসব কথা উচ্চারণ করছ। যাও, এখনই এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাও, অনেক হয়েছে। এখানে আমি শোব।
মাইক যেন খুব অবাক হয়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, তুমি শোবে?
হ্যাঁ। এই বাংলো আমার। আমি তোমাদের দয়া করে থাকতে দিয়েছি। তা যদি না দিতাম তাহলে এতক্ষণে তোমরা ঠাণ্ডায় মরে যেতে। তাছাড়া অ্যানের সঙ্গে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে চার্লি হো হো করে হেসে উঠল, কী বোকার মতো কথা বারংবার শোনাচ্ছ এই বাংলো তুমি রিজার্ভ করেছ কিন্তু সেটা প্রমাণ করবে কে? কোনো অফিসার তো দূরের কথা একটা চৌকিদার তোমার দাবি সমর্থন করতে এগিয়ে আসবে না।
এবার মাইক অ্যানের দিকে তাকালো, ওই ইন্ডিয়ানটা যা বলছে তা ঠিক?
অ্যান তাকাল। চোখে জিজ্ঞাসা।
ও বলছে তোমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে!
মিথ্যে কথা। চার্লি চেঁচিয়ে উঠলো, একটু আগেই অ্যান আমাকে বলেছে পাতরো ওকে শেল্টার দেবার পর থেকেই বিছানায় নিয়ে যাওয়ার তাল করছে।
কথাটা কানে যেতেই পার্থ খুব কষ্ট পেল। সে অ্যানকে বললে, তুমি, তুমি ওকথা ওকে বলেছ?
অ্যান ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকাল, আমি কি খুব মিথ্যে বলেছি?
চার্লির হাসি কানে যেতেই পার্থ বলল, আমি তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করিনি?
করেছ। কিন্তু তোমার আসল উদ্দেশ্য তো একটাই। তুমি ঠিক সাহস পাচ্ছিলে না। আর তোমরা ওই ঘরে চলে যাওয়ামাত্র ও লাফিয়ে কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। আমি বাধা দিলাম। তখন ও তোমার কথা বলে ঠাট্টা করলো। তখন আমি বলেছি তোমরা দুজনেই সমান, কেউ আস্তে কেউ ধীরে।
অ্যান মুখ ফেরাল না।
হঠাৎ মাইক ওদের দুজনের মাঝখানে চলে এল, তোমরা দুজন মন দিয়ে শোনো, এই ঘরে আমি অ্যানের সঙ্গে থাকব। অতএব জলদি বিদায় হও।
পার্থ চার্লির দিকে তাকাল। চার্লি নড়ল না, শুধু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, কেন?
খুব সোজা কথা! আমার আর অ্যানের গায়ের চামড়া সাদা। একজন হোয়াইট উওম্যানের সঙ্গে রাত কাটাবার অধিকার তোমাদের নেই।
মাইক নির্বিকার মুখে কথাগুলো বলল।
পার্থ আঁতকে উঠল। তার বিরাট হাতের থাবা পার্থর কাঁধে রেখে চার্লি বলল, শোনো সাদা চামড়াদের কাছে আমরা সবাই ব্ল্যাকি। এতে এত ভেঙে পড়ার কী আছে!
মাইক এবার অ্যানের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরল, এখন থেকে আমরা বন্ধু। এই লোক দুটোকে বিদায় করে দিলেই রাতটা আমাদের। তুমি রাজি?
ধীরে ধীরে হাতটা সরিয়ে দিল অ্যান, ভগবানের দোহাই, আমাকে একটু একা থাকতে দাও। আমি আর পারছি না।
চার্লি শব্দ করে হাসল, ও তোমাকেও চাইছে না।
মাইক যেন কথাটায় উত্তেজিত হলো, কে চাইছে কি চাইছে না তা আমি বুঝব। একজন হোয়াইট ম্যান সবসময় হোয়াইট উওম্যানের সঙ্গে থাকবে। নাউ, ইউ গেট আউট।
তা তো হয় না। আমি এই ঘর থেকে নড়ছি না।
তার মানে? মাইক ঘুরে দাঁড়াল।
এই নির্জন পাহাড়ে আমি একটা সাদা চামড়ার মেয়েকে পেয়েছি। এ আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। আমার ওকে চাই। দুমিনিট সময় দিচ্ছি নইলে আমি তোমাদের বের করে দেব।
তুমি কি মারামারি করতে চাও? মাইক জানতে চাইল।
ওয়েল, যদি বাধ্য করো।
সঙ্গে সঙ্গে তিরের মতো ছিটকে এল মাইক। তার ডান হাত প্রচণ্ড জোরে চার্লির মুখে আঘাত করল। চার্লি যেন প্রস্তুত ছিল না তাই অনেকটা পিছু হটে গেল। তারপরেই বিকট শব্দ করে দুই হাতে মাইককে তুলে ধরল ওপরে। একটা তীক্ষ্ণ চীৎকার ফেটে পড়ল অ্যানের গলা থেকে। পার্থ কিছু বুঝে ওঠার আগে মাইকের শরীরটা আছড়ে পড়লো বিছানায়। এস্তে উঠে দাঁড়াল অ্যান। ভয়ে আতঙ্কে ওর দুই চোখ বিস্ফারিত। আর তখনি খাটটা সশব্দে ভেঙে পড়ল। পার্থ দেখলো মাইকের শরীরটা দুতিনবার পাক খেয়ে আস্তে আস্তে স্থির হলো। এবং হাতের ওপর ভর রেখে উঠে বসতে চাইল সে। চার্লি এগিয়ে গেল ওর দিকে, আর কিছু চাই?
মাইকের তখন কথা বলার মতো অবস্থা নয়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে চার্লির দিকে।
চার্লি বলল, আমার মুখে হাত তুলেছিলে, তোমার ভাগ্য যে আমি মেরে ফেলিনি। আজকের রাতটার জন্যে নিশ্চয়ই শিক্ষা হয়েছে।
তারপর ঘুরে দাঁড়াল সে পার্থর দিকে, নাউ ইন্ডিয়ান, তুই ওই সাদা চামড়াটার পা চাটছিলে কিন্তু ও তোমাকে ব্লাকি ছাড়া কিছু মনে করে না। আই ওয়ান্ট দিস গার্ল। এক হাত বাড়িয়ে সে অ্যানকে কাছে টেনে আনল, তোমার আপত্তি আছে?
পার্থ কী করবে বুঝতে পারছিল না। চার্লির শরীরের শক্তির যে পরিচয় একটু আগে পাওয়া গেল তারপরে গায়ের জোর খাটানো বোকামি। সে দেখলো অ্যান ছটফট করছে চার্লির আলিঙ্গনে। দুহাতে ঘুষি মারার চেষ্টা করছে চার্লির শরীরে কিন্তু চার্লি নির্বিকার, হাউ নাইস। আমার এইরকম দরকার। মেয়েরা বেড়াল না হলে খেলাটা জমে না। এরকম সাদা মেয়ে আমি জীবনে পাইনি।
পার্থ বলল, এটা খুব অন্যায়।
অন্যায়? অ্যানকে ছেড়ে দিয়ে এক পা এগিয়ে এল চার্লি, আমি কেন ওকে পাব না? একটা হোয়াইট উওম্যানকে ভোগ করার অধিকার আমার চেয়ে বেশি কারো নেই। আই হেট দেম সুতরাং আমার চাই। এতে কোনো অন্যায় নেই। আমি তোমাকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলব। বীভৎস মুখ করে চার্লি এগিয়ে আসছিল পার্থর দিকে।
খুব নার্ভাস ভঙ্গিতে পার্থ সরে গেল দেওয়ালের দিকে। তারপরেই তার নজর পড়ল হ্যান্ডেলটার ওপর। চকিতে সেটা তুলে নিল সে, তারপর শাসাল, আর এক পা এগিয়ে এলেই আমি তোমাকে খুন করব চার্লি।
চার্লি ছোট চোখে হ্যান্ডেলটাকে দেখল তারপরেই আচমকা একটা লাথি ছুঁড়ল পার্থর পেট লক্ষ্য করে। সামান্য সরে গিয়ে সজোরে হ্যান্ডেলটা দিয়ে আঘাত করলো ওর পায়ে। আর্তনাদ করে চার্লি মাটিতে বসে পড়ে দুহাতে পা চেপে ধরল। আর তখনি অ্যান ছুটে গেল প্যাসেজের দরজায়। কেউ কিছু বোঝার আগেই মিলিয়ে গেল ওপাশে।
চার্লিকে আঘাত করে নার্ভাসনেসটা আরও বেড়ে গিয়েছিল পার্থর। এই সময় চার্লি উঁচু হয়ে বসতেই তার মনে হলো নিগ্রোটাকে মারার এই সুযোগ। ওর মাথায় এখন স্বচ্ছন্দে আঘাত করা যায়। মাইক আঘাত পেয়েছে, চার্লি যদি আহত হয় তাহলে আর অ্যানকে পাওয়ার কোনো অসুবিধ নেই। সে হ্যান্ডেলটা তুলল। ওই মুহূর্তেই চার্লি মুখ ফিরিয়েছিল দরজার দিকে। অ্যান পালিয়ে যাচ্ছে এই বোধ তাকে সজাগ করেছিল। ফলে সে নড়ে উঠতেই পার্থর হ্যান্ডেলও লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। মাথার বদলে চার্লির কাঁধে পড়ল সেটা। কোঁক করে উঠল চার্লি। তারপরেই ওর শরীর মেঝেয় দু-তিনটে পাক খেল। পার্থর মুখে তখন হাসি ফুটেছে। সে মাইকের দিকে তাকাল। মাইক তখনও ভাঙা খাটের উপর আধশোওয়া। চোখাচোখি হতে মাইকের ঠোঁট নড়লো, থ্যাঙ্কু। তুমি ওই ব্ল্যাকিটাকে শেষ করেছ?
অলমোস্ট। পার্থ হ্যান্ডেলটা নিয়ে ভাঙা বিছানার পাশে এগিয়ে এল, এখন আমি যা বলবো তাই তোমাকে শুনতে হবে। ওর চোয়াল শক্ত।
ইয়েস। মাইক কোনোমতে বলল।
একটু আগে তুমি আমাকে ব্ল্যাকি বলেছ! তাই তো?
ওয়েল, আমি কি ভুল বলেছি?
অফকোর্স ভুল বলেছ। কী ভাব তোমরা নিজেদের?
আমি কিছুই ভাবি না। এখন তুমি কী চাও?
আমি ওই মেয়েটিকে নিয়ে রাত কাটাতে চাই।
রাত! রাতের আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে?
অনেক। তুমি কি উঠে দাঁড়াতে পারবে?
কেন?
তাহলে ওই নিগ্রোটাকে নিয়ে পাশের ঘরে যাও। আমি অ্যানকে ফিরিয়ে আনছি।
বাধ্য ছেলের মতো মাইক ওঠার চেষ্টা করছিল। পার্থ ঘুরে দেখলো চার্লি নিথর হয়ে পড়ে আছে দরজার কাছে। ওই বিশাল শরীরটাকে সে শুইয়ে দিতে পেরেছে–ভাবতেই নিজের ওপর খুব আস্থা বেড়ে যাচ্ছিল ওর। লম্বা লম্বা পা ফেলে চার্লির শরীরটা বাঁচিয়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল ও! তারপর হ্যান্ডেলটাকে দেখল। এটা নিয়ে অ্যানের সামনে যাওয়াটা খুব শোভন হবে না। আর তখনই প্রচন্ড আঘাত পেল সে হাঁটুর ওপরে। হুড়মুড়িয়ে দরজার পাশে পড়ে গিয়ে সে মুখ ফেরাতেই দেখলো চার্লি পা গুটিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ও তাহলে অজ্ঞান হয়নি। পার্থ হ্যান্ডেলটাকে আঁকড়ে ধরে উঠে বসতে চাইল কিন্তু তার আগেই আর একটা লাথি খেল মুখে। শরীরটা দেওয়ালের সঙ্গে ঘষটে যেতেই হ্যান্ডেলটা তুলে নিল চার্লি। মুখে চটচটে নোনতা স্বাদ, পার্থ অস্পষ্ট দেখলো, চার্লির হাত ওপরে উঠে যাচ্ছে। আর্তনাদ করে পার্থ কেঁদে উঠলো, মেরো না, আমাকে মেরে ফেলো না।
সে চোখ বন্ধ করলো অন্তিম আঘাতের জন্যে। এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ডে। তারপর ফায়ারপ্লেসের আগুন ছিটকে উঠল। হ্যান্ডেলটাকে সেখানে ছুঁড়ে ফেলে চার্লি থুতু ফেলল মেঝেয়। পার্থ চোখ বন্ধ করল আবার।
চার্লির দাঁড়াতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কাঁধ যেন ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে টলছিল। এবং সেই অবস্থায় প্যাসেজে পা বাড়াল। এবং তখনই তার খেয়াল হলো এই ঘরের বাইরেটা অন্ধকার। আবার ঘরে ঢুকল সে। মাইক তখন উঠে দাঁড়িয়েছে কিন্তু দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই বোঝা যায় যে সে অশক্ত। চার্লি সেটা যাচাই করে বলল, ওকে ধন্যবাদ দেওয়া হচ্ছিল, না? আমি শেষবার বলে দিচ্ছি আর আমি ছেড়ে দেব না। তারপর টর্চ তুলে নিয়ে প্যাসেজে চলে এল! কাঁধে যন্ত্রণা তার শীতবোধও কমিয়ে দিয়েছে সে থপ থপ করে স্টোরের কাছে গিয়ে ফেলে দেখল। টয়লেটটা খুঁজল। না, অ্যান এখানে নেই। কোথায় যাবে? এই ঠাণ্ডায় নিশ্চয়ই বাইরে বের হবে না। ওরা বলেছিল এখানে আর একটা ঘর আছে। প্যাসেজ ধরে এগিয়ে এল চার্লি। ওর চোখের সামনে একটি উলঙ্গ সাদা মেয়ে ছাড়া কিছু নেই।
দরজাটাকে খুঁজে পেল চার্লি। বুঝলো, ভেতর থেকে বন্ধ। অন্ধকারে নিঃশব্দে হাসল সে। তারপর কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে অন্য কাঁধে সজোরে আঘাত করল পাল্লায়। তিনবারের বার ছিটকে খুলে গেল দরজা। অন্ধকার ঘরের দিকে তাকিয়ে চার্লি ডাকলো, ওয়েল, অনেক হয়েছে, এবার চলে এসো মিস। আই ওয়ান্ট ইউ।
সামান্য অপেক্ষা করল সে। ভেতর থেকে কোনো শব্দ এলো না। এবার টর্চ জ্বেলে আলো ফেললো। ঘরটা ফাঁকা। কোনো মানুষ নেই। এমন কি লুকোবার জায়গা বলতে একটা তক্তাপোষ। নিচু হয়ে তার তলাটা দেখল সে। না, সেখানেও অ্যান নেই। মাথা গরম হয়ে গেল চার্লির। এবং তখন আলো পড়লো ভেতরের দরজার ওপরে। দৌড়ে সেখানে চলে এল সে। ওপাশেও তাহলে আর একটা ঘর আছে। দরজাটাকে বন্ধ করেছে অ্যান। চার্লি চিৎকার করল, দরজা খোলো। এইসময় তার কানে এলো কোথাও যেন আঁচড়ানোর শব্দ হচ্ছে। সে আর একবার চিৎকার করে ডাকতেই কয়েকটা জন্তু আচমকা চেঁচিয়ে উঠল। ডাকটা এমনই সাংঘাতিক যে চার্লি ঘাবড়ে গেল। এখানে জন্তু এল কোত্থেকে। সে পাগলের মতো বন্ধ দরজার ওপরে আছড়ে পড়লো। মিনিট তিনেক বাদে একটা পাল্লা ভাঙতেই মনে হলো বাইরের জন্তুগুলো প্রচণ্ড রেগে হল্লা জুড়ে দিয়েছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলল সে। দুটো দরজা ভাঙার পরিশ্রম জখম কাঁধটাকে আরও কাহিল করেছে। সে টর্চ জ্বালতেই অ্যানকে দেখতে পেল। ঘরের ডানদিকের কোণে জড়সড় হয়ে মেয়েটা বসে আছে। দুহাতে মুখ ঢাকা, সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। চার্লি হাসল, পারলে? আমাকে ঠেকাতে? নাউ, কাম অন। মাঝখানের ঘরে একটা তক্তাপোষ আছে।
অ্যান ধীরে ধীরে মুখ সরাল। তার চোখে টর্চের আলো স্থির হয়ে থাকায় সে ভালো করে তাকাতে পারছিল না। একটু একটু করে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, ও মাই গড!
নো, নো বডি উইল সেভ ইউ। তুমি এখন আমার জন্যে। চার্লি হাসল। হাসিটা কানে আসামাত্র অ্যান চিৎকার করে উঠলো, না, কক্ষনো না।
কক্ষনো না! ব্যঙ্গ করলো চার্লি, কেন, ওই ইন্ডিয়ানটা কি আমার চেয়ে খুব কাজের ছিল? বেশ তো দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলে! নাকি ওই হোয়াইটিকে দেখে– চলে এসো, আর ন্যাকামি ভালো লাগছে না।
চার্লি অ্যানের মুখ থেকে আলো না সরিয়ে দু তিন পা এগিয়ে এল।
ওপাশের দরজায় শব্দ করে জন্তুগুলো নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে। অ্যান পাগলের মতো সেদিকে ছুটে যেতেই হোঁচট খেল এবং শরীরের ভার রাখতে না পেরে একটা কিছুর ওপর দিয়ে ওপাশের মেঝেয় টলে পড়ল। অ্যান পালিয়ে যাচ্ছে ভেবে চার্লি এস্তে আলোটা দরজার গায়ে ফেলতেই মৃতদেহটাকে দেখতে পেল। অ্যান ওর গায়েই হোঁচট খেয়ে ওপাশে পড়েছে।
মৃতদেহ! সঙ্গে সঙ্গে সিঁটিয়ে গেল চার্লি। ওর হাত কাঁপতে লাগল।
আলোটাকে মৃতদেহের মুখের ওপর ফেলতেই নেকড়েদের আধখাওয়া মুখ বীভৎসভাবে যেন তার দিকে তাকাল। আর তখনই চার্লি একটা ভৌতিক আর্তনাদ করে দরজার কাছে ছিটকে সরে গেল। ডেড বডি, এখানে একটা ডেড বডি! চিৎকার করে উঠলো চার্লি। তার হাতের আলো তখন মৃতের ওপর কাঁপছে। চার্লির ভয় পাওয়াটা বুঝতে পারলো অ্যান। সে অবাক হয়ে মুখ তুলতেই দেখতে পেল কিছু একটা তার সামনে পড়ে আছে। ওটা ডেড বডি? ওটা দেখেই চার্লি ভয় পেয়েছে? সে অবাক হয়ে মৃতদেহের দিকে তাকাল। বীভৎস দৃশ্যটা দেখে ওর চোখ বন্ধ হয়ে গেল। এবং তখনই ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল এবং পালিয়ে যাওয়া চার্লির শব্দ কানে এল। পেছনের দরজায় তখনও নেকড়েগুলো আঁচড়ে যাছে। অ্যানের মনে হলো ওর হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে। সে আতঙ্কে উঠে দাঁড়াল। এবং তক্ষুনি আর একটা কথা তার খেয়ালে এল। এই মৃতদেহের জন্যে চার্লি ভয় পেয়ে পালিয়েছে। তার মানে, এই মৃতদেহ তাকে চার্লির হাত থেকে বাঁচিয়েছে। অতখানি আতঙ্কের মধ্যেও তার বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। তার মনে হলো, যাই হোক না কেন এই ঘরে থাকা তার পক্ষে নিরাপদ। একটা মৃতদেহ কয়েকটা জীবন্ত মানুষের লোভ থেকে নিশ্চয়ই বাঁচিয়ে রাখবে তাকে। কিন্তু তারপরেই চোখের সামনে সেই বীভৎস মুখটা ভেসে উঠতেই গলা থেকে গোঙানি ছিটকে এল। নখের আওয়াজ তার সমস্ত নার্ভকে ফালাফালা করে দিচ্ছিল।
অ্যান আর পারল না। এক দৌড়ে সে মাঝের ঘরে চলে এল। দরজাগুলো চার্লি ভেঙেছে। ঠাণ্ডা জড়িয়ে ধরছে অক্টোপাসের মতো। হাতড়ে হাতড়ে অ্যান তক্তাপোষটা খুঁজে পেল।
শোওয়ার ঘরে চার্লিকে কেউ যেন তাড়িয়ে নিয়ে এল। ঘরে ঢুকেই সে চিৎকার করে উঠলো, ডেডবডি! ওই ঘরে একটা ডেডবডি রয়েছে, কি ভয়ঙ্কর সেটা! তোমরা জানো?
পার্থ এবং মাইক তখন দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসে, পেছনে ফায়ারপ্লেসের আগুন কমে এসেছে। ওরা দেখলো চার্লির চেহারাটা নিমেষেই পাল্টে গেছে। শরীর কাঁপছে, চোখ বিস্ফারিত, বারংবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে সে। চার্লি ওদের সামনে চলে এল, তোমরা শুনতে পাচ্ছ? ওই ঘরে একটা ডেডবডি পড়ে রয়েছে। তার মুখের মাংস কেউ খেয়ে নিয়েছে!
মাইক ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো, জানি।
জানো? তোমরা জানো? ও গড। তোমরা জেনেও আমাকে বলো নি!
মৃতদেহ দেখে তুমি ভয় পেয়েছ? পার্থ এখনও তার মুখের যন্ত্রণাটাকে ভুলতে পারছিল না।
হ্যাঁ পাই। ওইরকম বীভৎস মুখ দেখলে যে কেউ ভয় পাবে। চার্লি ভাঙা খাটের একপাশে কোনোরকমে স্থির হয়ে বসবার চেষ্টা করলো। সে তখনও কাঁপছে।
মাইক জিজ্ঞাসা করলো, অ্যান কোথায়?
অ্যান! তোমাকে একটা খবর দিচ্ছি, মেয়েটা হয় ডাইনি নয় প্রেতিনী। খুব ভয়ঙ্কর মেয়ে! চার্লি চোখ বন্ধ করে যেন কোনো দৃশ্য কল্পনা করেই শিউরে উঠল।
মাইক চিৎকার করে উঠলো, কি যা-তা বলছো?
ঠিক বলছি ঠিক। নাহলে একটা অন্ধকার ঘরে ওইরকম মাংস ওঠা মৃতদেহের আড়ালে কেউ বসে থাকতে পারে? লাখ টাকা দিলেও আমি পারতাম না। চার্লি ফিসফিস করে বলল।
পার্থ উঠল। মাইককে এই মুহূর্তে অত্যন্ত ভীতু এবং সরল মনে হচ্ছে। এই লোকটাই যে কিছুক্ষণ আগে অত ভয়ানক চেহারার হয়ে উঠেছিল তা কে বলবে!
মাইক জিজ্ঞাসা করলো, কোথায় যাচ্ছ?
ওকে নিয়ে আসি, ওই ঘরে অ্যানের একা থাকা ঠিক নয়।
ওকে তুমি কোথায় নিয়ে আসবে?
পার্থ মাইকের মুখ দেখে বুঝতে পারল সে কী বলতে চাইছে। চটপট সিদ্ধান্ত নিল সে, মাঝখানের ঘরে। ওখানে একখানা তক্তাপোষ আছে।
না। মাইক মাথা নাড়ল, তুমি সেটা করতে পারো না।
কেন? পার্থ ওর মুখের যন্ত্রণা ভুলে গেল।
একমাত্র সাদা চামড়ার মানুষ হিসেবে আমারই সেই অধিকার আছে।
ভুলে যেও না, আমি তোমাদের আশ্রয় দিয়েছি।
মাইক কাঁধ নাচাল, তাহলে তো চার্লির গায়ের জোরের কাছে আমরা হার মেনেছিলুম। তাছাড়া তোমরা দুজনেই ওকে আলাদাভাবে চেয়েছ কিন্তু পাওনি। আমি সুযোগটা পেতে চাই।
মাইক উঠল। তারপর পার্থ পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। ওর যে হাঁটতে খুব সুবিধে হচ্ছে না তা বোঝা যাচ্ছিল। অন্ধকার প্যাসেজে দাঁড়িয়ে মাইক চিৎকার করলো, অ্যান। কোনো সাড়া এল না। শব্দটা বন্ধ দেওয়ালে ধাক্কা খেতে লাগল। মাইক আবার ডাকল, অ্যান! আমি মাইক বলছি, চলে এসো।
এবার অ্যানের গলা শোনা গেল, কেন?
তোমার আর কোনো ভয় নেই। আমি কথা দিচ্ছি।
আমি এখানে বেশ আছি।
তুমি একটা ডেডবডির সঙ্গে থাকতে পারো না।
ওখানে গিয়ে কী হবে? তোমরা আমাকে দয়া করে একা থাকতে দাও, প্লিজ।
মাইক অসহিষ্ণু হলো, ওঃ নো। তুমি মিথ্যে ভয় পাচ্ছ! এরা আর তোমাকে ভয় দেখাবে না।
অ্যানের গলা শোনা গেল, ওখানে গিয়ে আমি কি করব?
কী করবে? অ্যান, তুমি বুঝতে পারছ না কেন? যা হবার তা হয়েছে। এসো, এখন আমরা রাতটাকে এনজয় করি। তুমি আর আমি। অ্যান, চলে এসো। মাইকের গলায় আকুলতা।
কিন্তু অ্যান এ কথার জবাব দিল না। বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করে ব্যর্থ হলো মাইক। শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত পায়ে ফিরে এল সে ঘরে। পার্থ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, কি হলো? ওঘরে গিয়ে ওকে টেনে নিয়ে এলে না কেন?
চেয়ারে বসতে বসতে মাইক নিজের কোমরে হাত রাখল, এখানে ব্যথা হচ্ছে। ওর সঙ্গে বোধহয় শক্তিতে পেরে উঠব না এখন। চার্লি আমার বারোটা বাজিয়েছে।
তাহলে তোমার সুযোগ চলে গেল। পার্থ যেন কিছুটা স্বস্তি পেল। মাইক কথাটা শুনে পার্থর দিকে তাকালো, তুমি পারবে?
পার্থ নিজের মুখে হাত দিল। তার চোয়ালে এখনও চিনচিনে ব্যথা। ঠোঁটের ভেতরে কেটে গিয়েছিল তখন, রক্ত পড়েছিল, এখনও নোনতা স্বাদ লেগে রয়েছে। সে মাথা নাড়লো, না, জোরজবরদস্তি করে কোনো কাজ হবে না। আমি এবং তুমি একটু আহত হয়েছি, চার্লি যাক না, ওর গায়ে তো খুব জোর।
চার্লি দ্রুত মাথা নাড়লো, নো, নেভার। আমি একটা ডেডবডির কাছে ফিরে যেতে চাই না।
পার্থ বললো, তাহলে আমরা কেউ আজ রাত্রে আর অ্যানকে চাইছি না?
চার্লির মুখের চেহারা আবার পাল্টে গেল। সে মাইকের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মাইক সম্মতির ঘাড় নাড়ছে। অতএব চার্লি বলল, চাই, নিশ্চয়ই চাই। তুমি চাও না?
পার্থ বললো, চাই। কিন্তু কীভাবে পাব তাই জানি না।
কয়েক সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বলল না। নিভে আসা কাঠ-কয়লা থেকে ফুটফাট শব্দ হচ্ছিল। মাইক উঠল। হাত বাড়িয়ে কয়েকটা শুকনো কাঠ তুলে নিয়ে সে ফায়ারপ্লেসের ভেতর গুঁজে দিল। চার্লি কিছুক্ষণ সেই ধোঁয়াটে আগুনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, মেয়েটা নিশ্চয়ই ঠাণ্ডায় জমছে।
পার্থ উদাস গলায় বললো, ওখানে তো ফায়ারপ্লেস নেই।
মাইক খাটের দিকে তাকিয়ে বলল, ওর সঙ্গে তো একটার বেশি কম্বলও নেই।
পার্থ বলল, এভাবে ওঘরে থাকা যায় না!
চার্লি বলল, আর কিছুক্ষণ থাকলে অ্যান নিজেই মৃতদেহ হয়ে যাবে, ওঃ ভগবান।
মাইক বললো, অ্যান ডেডবডি হয়ে গেলে আমাদের কী লাভ হবে? তাই না?
চার্লি মাথা নাড়ল, নিশ্চয়ই। ওরকম একটা দারুণ চেহারার মেয়ে ডেডবডি হবে ভাবা যায় না।
পার্থ বললো, ঠিক ঠিক। আমাদের যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। কী করা যায়?
কয়েক সেকেন্ড আবার তিনজনেই চুপচাপ। ফায়ারপ্লেসের গুঁজে দেওয়া কাঠে নতুন আগুন ধরে যাওয়ায় সেটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। ঘরটা হয়ে গেছে আলোকিত। মাইকের মুখটা আরও লাল দেখাচ্ছে। পার্থ সেদিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের এক হতে হবে।
মানে? মাইক তাকালো ওর দিকে।
আলাদা আলাদা ভাবে আমরা অ্যানকে চাইছি। কেউ কাউকে ছেড়ে দিতে রাজি হই নি, তাই না? আমার অধিকার আছে, তোমার চামড়ার রঙ আছে আর চার্লির গায়ে শক্তি রয়েছে। আলাদা করে অ্যানকে দখল করতে চেষ্টা করে আমরা সফল হইনি। এখন তিনজনে যদি এক হই তাহলে বোধহয় ওকে পেতে অসুবিধে হবে না। পার্থ খুব ভেবে-চিন্তে কথাগুলো বললো।
সঙ্গে সঙ্গে চার্লি তার বিশাল হাত পার্থর দিকে বাড়িয়ে দিল, কীভাবে পাব সেটা নিয়ে আমি মোটেই ভাবি না। ওই সাদা চামড়ার মেয়েটাকে আধঘণ্টার জন্যে পেলেই আমি খুশি। আমি এক হতে রাজি আছি।
পার্থ মাইকের দিকে তাকাল। মাইক এক দৃষ্টিতে চার্লিকে দেখছে। ওর দুই ঠোঁট টান টান। পার্থ তার নাম ধরে ডাকতে সে মুখ ফেরালো, হোয়াই শ্যুড আই?
তুমি কি অ্যানকে চাও না?
চাই। কিন্তু কারো সঙ্গে শেয়ার করে নয়। কারো শব্দটা যেন ইচ্ছে করেই বেঁকিয়ে বললো সে।
তাহলে তুমি আজ কিছুতেই পাবে না ওকে। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো। পার্থ বলল।
কিছু বোঝার নেই। তিনটে ডিফারেন্ট টাইপের পুরুষ একসঙ্গে একটা মেয়েকে ভোগ করবে, এসব তোমাদের দেশে চলতে পারে, কিন্তু আমার রুচিতে বাধে।
পরিষ্কার জানিয়ে দিল মাইক। তারপর পা ছড়িয়ে দিল সামনে।
একসঙ্গে? একসঙ্গে কে বলল তোমাকে? পার্থ অবাক গলায় বলল।
একসঙ্গে নয়? তাহলে এক হতে বলার মানে কি?
কী আশ্চর্য! তোমাদের দেখছি মাথায় কিছুই নেই।
মাথায় কিছুই নেই? হুঁ! আমাদের মাথায় যদি কিছু না থাকত তাহলে দুশ বছর তোমরা আমাদের অধীনে থাকতে না। তাই না? কাঁধ নাচাল মাইক।
চার্লি থুক করে থুতু ফেলল, এসব কথা বলার সময় এখন নয়। তবু প্রসঙ্গ উঠল বলেই বলছি, ওরা যেই বুঝেছিল তোমরা শক্তিহীন, অমনি এদেশ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তোমাদের!
ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল? হো হো করে হেসে উঠলো মাইক, আমরা দয়া করে চলে না গেলে ওরা কী করতে পারত! এখন, এদের সো-কলড স্বাধীনতার পঁয়ত্রিশ বছর পরে এদেশে এসে আমি কী দেখলাম? সাধারণ লোক আমাকে দেখে সেলাম করে। আমার জন্যে তারা রাস্তা ছেড়ে দেয়। টিকিট চেকার অন্যদের নাজেহাল করে কিন্তু আমার টিকিট দেখতে চায় না। লোকে আমার দিকে তাকিয়ে সসম্ভ্রমে বলে সাহেব। আর তুমি বলছ আমার মাথায় কিছুই নেই। আমি ভেবেছিলাম তোমরা যৌথ যৌনখেলা খেলতে চাইছ।
পার্থ মাথা নাড়লো, না। মোটেই না। আমি বলতে চাইছি আমরা তিনজনে যদি খেয়োখেয়ি না করি তাহলে ওই মেয়েটাকে ভোগ করতে কোনো অসুবিধে হবে না।
মাইক একটু ভাবলো, অন্যসময় হলে আমি কী বলতাম জানি না তবে এই মুহূর্তে আমি ওকে চাইছি। যথেষ্ট অপমানিত হয়েছি। সুতরাং তোমাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছি।
চার্লির মুখে হাসি ফুটল, দ্যাটস লাইক এ গুড বয়।
পার্থ বলল, তাহলে এই ঠিক হলো, আমরা যা করবো তিনজনে এক হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই করব।
বাকি দুজন মাথা নাড়ালো, ডান।
পার্থ এবার উঠে দাঁড়াল, তাহলে চলে যাওয়া যাক।
চার্লির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, কোথায়? ওই ঘরে? নো, নেভার। আমি যেতে পারব না।
কিন্তু অ্যানকে ওখান থেকে নিয়ে আসতেই হবে। ঠাণ্ডায় ও জমে গেলে আমাদের কোনো লাভ হবে না। আফটারঅল, একটা ডেডবডির সঙ্গে ওসব করা যায় না।
কিন্তু ও একটা ডেডবডির সঙ্গে রয়েছে, ওঃ, কি ভয়ঙ্কর। চার্লি বিড়বিড় করল।
ও ঠিকই বলেছে চার্লি, অ্যানকে এই ঘরে ফিরিয়ে আনা দরকার। মাইক উঠল।
ঠিক আছে, ওকে ফিরিয়ে আনতে তিনজনের যাওয়ার কোনো মানে হয় না। তোমরা যাও, আমি ততক্ষণে কিছু একটা করি, এই ধরো, খাটটাকে ঠিক করে রাখি। চার্লি বলল।
না। পার্থ আপত্তি জানাল, আমাদের তিনজনকেই একসঙ্গে যেতে হবে। যা করব তা তিনজনে শেয়ার করে করব। তাছাড়া আমরা দুজনে ওর সঙ্গে পেরে নাও উঠতে পারি!
চার্লি হাঁ হয়ে গেল, তোমরা দুটো পুরুষ একটা মেয়ের সঙ্গে পারবে না।
পারতাম যদি তুমি আমাদের আহত না করতে। অতএব এ ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব অনেক বেশি। গায়ের জোরের প্রয়োজন হলে তোমাকে দরকার হবে। লেটস গো। মাইক পা বাড়াল।