Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তীর্থযাত্রার চম্পূ || Bani Basu

তীর্থযাত্রার চম্পূ || Bani Basu

ওরা কিছুতেই যাবে না এবং আমরা প্রবল চেঁচামেচি করছিলাম। দৃশ্য, যমুনার ঘাট। ওরা মানে মাঝিরা, প্রয়াগগামী নৌকার মাঝিরা। মাথায় ফেট্টিবাঁধা এবং না বাঁধা জোরালো চেহারার প্রচুর মাঝি। ভালো ছইওলা মজবুত নৌকাগুলো সাতশো আটশো দরও হাঁকছিল, অথচ গলা নিখাদে চড়িয়ে সুদেষ্ণা বলল, ও আর অঙ্কুর জাস্ট ছদিন আগেই … দুশো আরও কিছু উটকো যাত্রী অবশ্য ছিল, কিন্তু পঁয়তাল্লিশ দুগুণে নব্বইয়েই ঘুরে এসেছে। আসল কথা ওরাই এসেছে প্রথম। ওদেরই নেশা বেশি। পায়ের তলায় সরষে। এসেই সম্মেলনের ইকড়ি মিকড়ি না শুনে ওরা বেরিয়ে পড়েছে। সব সময়েই যেন পরস্পরের থেকে পালাতে চেয়ে ওরা দিগদর্শনে মাতোয়ারা হয়। কাঁধে ক্যামেরা, চোখে বাইনোকুলার। কোমরে জিনস। তখন ডিমান্ড ছিল কম। কিছু দেহাতি যাত্রী ছাড়া তেমন শাঁসালো কেউ ছিল না। এখন সম্মেলনও শেষ। হাজারখানেক অতিরিক্ত লোক এখন ওদের খদ্দের। এ দিকে মাঘী মেলার সময়ও হয়ে এল। এখানকার সবচেয়ে বড়ো মেলা। বিখ্যাত। যমুনার দিকে আসতে আসতে বিস্তীর্ণ সব জায়গায় তাঁবু খাটানো হচ্ছে

আমরা দেখতে দেখতে এসেছি। শুনে এলাম কেমন সাজো সাজো রব চারদিকে। দেখলাম নানান পসরা সাজানো হচ্ছে অস্থায়ী দোকানঘরে। কাঠের জিনিস। পাথরের জিনিস। হাওয়ায় এখনও কেমন মোচ্ছবের গন্ধ।

এই মেলাই তো ছ ছ বছর অন্তর অর্ধকুম্ভে দাঁড়ায়। আধ হাঁড়ি অমৃত। বারো বছর বাদ পূর্ণকুম্ভ। পুরো হাঁড়ি অমৃত। অমৃত লাভের জন্য কী হুড়োহুড়ি। তাই হাওয়ায় দুর্ঘটনার গন্ধও পেতে থাকি। কেমন একটা শীত-শীত। লক্ষ লক্ষ লোক মিলতে আসে, খুঁজতে আসে, পেতে আসে, নানা অর্থের অমৃত। তাই দিতেও হয়। ভাবলেই কেমন ছমছম করে ওঠে গা।

আপাতত যমুনার জল ঠাসাঠাসি নৌকার গায়ে ছোটো ছোটো হাইফেন। ছলাত ছলাত। সবুজ জলীয় আঘ্রাণে মস্ত করে দিচ্ছিল আমাদের। অমৃত এবং মৃত্যুর কথা মনে থাকছিল না। রুক্ষ আকবর ফোর্ট আর টিপি-চাপা দেবতার দল। কড়ির সাজ পরানো রোগা গোরু, উঃ। তার পরেও আমরা রিলিফ চাইব না?

আমরা মানে অঙ্কুর সরসীরঞ্জন।

রমিতা সুদেষ্ণা।

অনীশ মনামি। এবং আমি।

সরসীরঞ্জন এক সময়ে আমাদের মাস্টারমশাই ছিলেন। বেশ উঁচুদরের। সুদেষ্ণার সঙ্গে দীর্ঘদিন ফাটাফাটি প্রেম করে, হঠাৎ কীসের থেকে কী হল রোমিকে বিয়ে করলেন। আগে ওঁকে দুর্দান্ত কিছু ভাবতাম। কিন্তু সেই বিয়ের আসর থেকেই ওঁর মাস্টারমশাইত্ব বেমালুম গায়েব হল। জাত হারালেন, নেহাতই রাম-শ্যাম, যদু-মধু-হরি গোছের, নেহাতই গোলে হরি বোল, নেহাতই ফ্যালিবল মর্টাল বলে ওঁকে মেনে নিই আমরা সেই থেকেই। পাণ্ডিত্য, ফান্ডা ইত্যাদিকে পাত্তা না দিয়ে, অ্যাদ্দিনের অভ্যেস ছেড়ে, সরসী করে ডাকতে থাকি। সরসী! সরসী!

সুদেষ্ণা অবশেষে মাকাল বলে ডাকলেও, হেলা-ফ্যালা করলেও অঙ্কুর চাইছিল বলে অঙ্কুরকেই। সেই সূত্রে ও মাকালী। আমরা মাকালী মাকালী করে খ্যাপাই। ও বেচারির দ্বিতীয় পছন্দ ছিল অনীশ। মুখে কেউ কাউকে না বললেও মনে মনে আমরা জানতাম অনীশ বরাবর মনামিতে আতত। ওর ধারণা মনামিও তাই। ওদের অন্তত মিউচুয়াল হয়েছে। কিন্তু মনামি আসলে অঙ্কুরকে চাইত। ছোটোবেলা থেকে ভাবের সূত্রে। কেমন যেন কাজিনও ওরা। কিন্তু ও তো মাকাল! মাকাল। মাকালকে আর কে শেষ পর্যন্ত চায়!

আমাদের মেজাজ চড়ে যাচ্ছিল। বেলাও চড়ছিল। নেহাত শীত বলেই সইছিল। এ দিকে নৌকাঅলারাও গনগনে চোখে, ঝনঝন করে কথা বলছিল।

থাক পুণ্য করে দরকার নেই—রোমি ঝাঁঝায়, আমাদের পুণ্য না হোক গে, তুমারি যমনামায়ি তুমলোগকো শাঁপ দেগা, শাঁপ। … তর্জনী নাচছিল রমিতার।

তো আইয়ে না মেমসাব। পুন কি সওয়াল হ্যায় তো, পৈসা কি জরুরত নহি। আইয়ে, আপ সব কো মুফত হি ঘুমাউঙ্গা।

মুফত হি, মুফত হি ঘুমা দুঙ্গা, কোরাস গেয়ে ওঠে সবাই। অবশেষে বালিতে বড়ো বড়ো ইয়েতি ছাপ ফেলে, বিশাল বপু আমাদের জেনারেল মানেকশ বঢ়োরস্ক বৃষস্কন্ধ অটোঅলা এগিয়ে আসতে থাকে। হাতের তিন আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে থাকে ঘাটের কিনারায়। মুখে কথা নেই। ভিরকুটি। হিন্দুস্তানি চার্চিল আর কী! কেউ যেন বলল।

আইয়ে আইয়ে—একজন সঙ্গে সঙ্গে রাজি। পুরো নৌকা তিনশোয়। মন্দ কী? ছিপছিপে গৌরাঙ্গর পেছন পেছন আমরা হুড়মুড় করে এ নৌকোর আগ-গলুই থেকে ও নৌকার পাছ-গলুই টপকে টপকে ভাসমান ছকে এ ক্কা দোক্কা, তে ক্কা চৌকোটাল খেতে খেতে গৌরাঙ্গ-নৌকার পাটাতনে পৌঁছে যাই।

এইবার শুরু হয় আসল খেলা।

বাঘের খেলা।

কে কার পাশে বসবে না, সেই খেলা।

পরস্পরের প্রতিমার খড় বেরিয়ে গেছে এখন। প্রেম-ট্রেম সব ভোঁতা। তবু… তবু খড়ের কাঠামো এক আদি-অন্তহীন রৌরব। ঘুরে ঘুরে হয়রান সবাই। বেরোতে পারছে না। ছিড়ছে, ভাঙছে, কাটছে। কিংবা কে জানে, এদের সবার বেরোবার ইচ্ছেটাই হয়তো মরে গেছে। ইচ্ছের পেছনে ইচ্ছে থাকে। তার পেছনে আরও ইচ্ছে। এ সব কথা কবুল করাটা দুঃসাহস! ইচ্ছের পেছনে দুঃসাহস থাকা চাই। এই টলোমলো নৌকায় তা আর কারই বা আছে।

ফলত, প্রত্যেকে যেন প্রত্যেকের দিকে পেছন ফিরে বসতে চায়। সে এক অদ্ভুত নেগেটিভ হুড়োহুড়ি। শেষ পর্যন্ত উদ্যোগী হয়ে মুখোমুখি করে দিই ওদের।

কেননা শেষ পর্যন্ত তো আমাদের বাস্তবের মুখোমুখি হতেই হয়।

পউষের দুপুরের রোদে কুকরি ঝলসায়। তেরছা হয়ে রোদ এসে পড়ে একেবারে অঙ্কুরের মুখের ওপর। ও রোদ আড়াল করবার চেষ্টা করে না। ওকে দেখায় ঠিক দোলের দিনের লালচে মঠের মতো, অনেক ফুটকড়াই আর চিনির মুড়কির মাঝখানে লোভনীয়, রসালো, সলিড …।

কিন্তু সুদেষ্ণা মুখ ঝামটে বলল, বাবারে বাবা, পুণ্য করতে যাচ্ছি। তখনও তুমি আমার সামনে বসবে?

আমি কি তবে মূর্তিমান পাপ-টাপ নাকি?

মুখটাকে একটু আড় করে অঙ্কুর ক্যামেরাটা রমিতার দিকে তাক করল। সরসী, এক্স-মাস্টারমশাই, সেই বিয়ের রাতে যাঁর জমানত জব্দ হয়ে গিয়েছিল, রমিতার সঙ্গে যুগদ্ধ ছবি, আগে নিশ্চয় অনেক তুলেছেন, আজ যেন আদপেই তুলতে চাইলেন না। অঙ্কুরের ক্যামেরার দিকে পেছন করে, তিনি জলের দিকে মুখ ফিরিয়ে ঝুঁকে বসে রইলেন। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, চশমার কাছে বড্ড রোদ ঝলসায়।

রমিতা আর মনামি দীর্ঘদিনের শত্রু বন্ধু পাশাপাশি হতে অথবা না হতে গিয়ে এবং অনীশ ওদের মুখোমুখি অথবা পিঠোপিঠি হতে গিয়ে নৌকা এমন হেলায়। বিপজ্জনক কৌণিক বিপর্যয় থেকে বাঁচতে সবাই একত্র হয়। হাঁ হাঁ করে ওঠে গৌরাঙ্গ, অ্যায়সা মত কিজিয়ে, মত কিজিয়ে অ্যায়সা।

উরি বাবারে! রোমি চেঁচিয়ে ওঠে, এ ভাই হাম সবকো লওট দেগা তো?

দেখিস বাবা পানি কি অন্দর গোর দিসনি—মনামি হাসবার চেষ্টা করে।

মওত সে ডরনা মৎ—গৌরাঙ্গ গম্ভীর গলায় চাপা গর্জন করে। তার মানে কী? কী বলতে চায় লোকটা। এটা কি ওর ফিলজফি অফ লাইফ। না মৃত্যু সত্যি সত্যিই আশেপাশেই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?

আপাতত অথই জল। সবাই নীল বললেও আমরা দেখি সবুজ। একেবারে সবুজ। বঙ্গোপসাগরে এই সবুজ দেখা যায়। তার সঙ্গে নুন গন্ধ থাকে।

যমুনা কখনও নিজে নিজে সাগরে পৌঁছতে পারেনি। তবু সাগরেরই রং মেখেছে। যতই এগোই, রোদ ততই ভিজে যায়, হাওয়া ততই জলে-ভেজা তালপাতার পাখার বীজন।

জলের মাতোয়ালা রক্তের গলিতে ঢুকে যায়। জলের রঙিন পিচকিরি ছেটাতে থাকে, কেমন একটা উল্লাস উঠে আসে নাভিপদ্ম থেকে, সোজা উঠে লক লক করে উল্লাসটা, যার ঝোঁকেই হয়তো অনীশ কাব্যি করে বসে :

হে দিন, সোনালি দিন,
যার জন্যে গভীর দুপুর
সোঁদা মাটি টুপুর-টাপুর
যার জন্যে অছিন-অভিন
তুমি কি দেখেছ সেই সোনার হরিণ?
দেখেছ সে সোনার হরিণ?

স্বর্ণমৃগী তোর সঙ্গে খেলতে চাইবে কেন? রমিতা জলের ওপর গলা তুলে বলল। অনীশ কিন্তু কবিতার শিখর থেকে নামতে পারছে না এখনও। দেখেছ কি, দেখেছ কি, করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। এদিকে অদূর-নীলে সাদার ডট। ঘন ঘন সজল ডট। বুটিদার রেশমি শাড়ি নীল যমুনা। পাখি পাখি পাখি। কী বলে ওদের? মাঝি ভাই? পংখি! পংখি। যাযাবর ম্যাটাডর কনডর, কত দূরের শরীর সব, কত্ত দূরের মন, মেজাজ। শীতে আসে, গ্রীষ্মে যায়। কোথায় যায়? যেখানে তুষার গলে রিমঝিম তৃণ। বালিহাঁস হয়ে নামে আলিপুরে, প্রতি শীতে, ত্রয়োদশীর চাঁদ সাঁকোয়। মরাল হয়ে, শামুক খোল হয়ে ঝুপ ঝুপ, ঝুপল, ঝুমল—করে নামে, নামতে থাকে জলে—জলায়, বিলে-ঝিলে।

শীতই ওদের বসন্ত।

অনীশ এখন অচিন হরিণ থেকে অচিন পাখির প্রসঙ্গে এসে গেছে। সত্যিই সে স্বর্ণমৃগীর জন্য হন্যে না পাখির জন্যে নাকি দুটোই এক, এখন সম্পূর্ণ গুলিয়ে গেছে।

অঙ্কুর বলে উঠল, সরসী! আপনার দিকের পাড়টা খানিকটা মরুভূমির মতো দেখেছেন? কমপ্লিট উইথ উট বালিয়াড়ি অ্যান্ড অল।

সত্যিই পাড়টা দু-তিনটে টাল খেয়ে উঠে গেছে। ঝকঝকে ইস্পাত আকাশের কোলে একটি চিত্রার্পিত উট। লাগাম ধরে সামনে একজন পেছনে আরও তিন। বালির ভাঁজ স্পষ্ট। ভাঁজে পুতুলগাড়ির মতো একটা ল্যান্ডরোভার। চিক করে একটা শব্দ। অর্থাৎ অঙ্কুর ফটো তুলল।

সুদেষ্ণা প্রায় ভেঙিয়ে বলল, তুমি কি কিছুই মনে রাখতে পার না? সবকিছুরই রেকর্ড…।

—রাখতে না ব্রেক করতে? রমিতা চিৎকৃত হাসিতে বলল, ধিক্কার জানিয়ে বিকৃত গলায়।

চিক—আরেকটা।

আমি নড়ে গেছি, আমরা নড়ে… উঠবে না। উঠবে না।

উঠবে, ভেংচি সমেত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে উটটার সওয়ার নেই কেন?

সত্যিই তো! সওয়ার নেই। গলায় ঝোলা বাইনোকুলারটা তুলে মনামি, সামনে পেছনে লোক, এ তো দেখছি গ্রিসিয়ান আর্ন!

ওটা ইদের উট!

তাই জল পড়ছে চোখ দিয়ে অঙ্কুর।

সুদেষ্ণা ঝুঁকে উঠবে? চোখের জলটা উঠবে?

উঠতে পারে—চোখের জলটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট, উটের চোখের…

খোলাখুলি কমিট করতে চাইছে না অঙ্কুর। মনামির ছেলের ছবি তুলেছিল মুখের নালসুদ্ধ। কিন্তু… চোখের জল? উটের চোখের।

পাশ দিয়ে ওদের দ্বিগুণ ভরতি একটা খোলা নৌকা। রোদে জ্বলছে দেহাতি মেয়ে পুরুষ। কেউ কেউ এ নৌকার যাত্রীদের দিকে চেয়ে দাঁত বার করে হাসছে।

হাসিটার মানে কী?—সুদেষ্ণা বিরক্ত, উড়ন্ত ট্রেন দেখে যেমন দুরন্ত ছেলেরা হাত নাড়ে?

শহুরেরা গাঁওয়ার দেখে হাসে। গাঁওয়াররা শহুরে দেখে।

সত্যিকার নাগরিক হলে শহুরেরা হাসে না।

মনে মনে হাসে। ভুরু কুঁচকোয়।

আরও একটা নৌকা ভেসে যায়। ভর-ভরতি। নৌকাডুবি হল বলে। নারকোল, ফুল, ধূপ প্রায় প্রত্যেকের হাতে। ভাবছিল ডুববে না। কেননা ধূপ, ফুল…। এরাও হাসছিল। খুব।

সরল-সরল চাকর-চাকর দেখতে। কে যেন বলল মেয়ে-গলায়। চা

কর খাটতে গিয়ে এই লোকগুলোই গোড়ার দিকে সরল-সরল, খুব খাটে পেটে।

… হাঁ-জি হাঁ-জি কথায় কথায়। উঠতে বসতে মাজি মাইজি। বিনয়ের অবতার একেবারে। কিছুদিন পরেই চুরিচামারি। ছিচকে ছিচকে, তারপরে শেয়ানা সিঁদেল, তারপর ডাকাত দলের দালালগিরি, ভেতর থেকে দরজা খুলে দেওয়া, সুলুক সন্ধান, চপার, হাতুড়ি, মায় ধর্ষণ-টর্ষণ পর্যন্ত…

এখন দেখাচ্ছে খুব নিষ্পাপ।

কে বলল?

নিষ্পাপ না হাতিরমিতা, এসব হদ্দ বোকা, কিন্তু মিটমিটে।

সুদেষ্ণার দিকে চেয়ে কীভাবে হাসছে! এরা চাউনি দিয়েই, হাসি দিয়েই … জঘন্য।

ওদের দলে একটি বৃদ্ধ লোক, বুড়ো হনুমানজির মতো, কাঁধগুলো এখনও কী চওড়া! পাকা গোঁফদাড়িতে মুখ ঝুলে পড়েছে। কিন্তু হাতগুলো লোল নয়, জলের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে কী বকছিল, মনে হল বলছে, গঙ্গা বিটিয়া যমনা বিটিয়া গঙ্গা বিটিয়া যমনা বিটিয়া গঙ্গা যমনা গঙ্গা যমনা গঙ্গা যমনা।

দেখতে দেখতে ঢেউয়ের দোলে হাজার হাঁস ভেসে আসে। খাদ্যসামগ্রী নিয়ে নৌকা যায়। পাঁপর, নিমকি, খাজা।

তিলে খাজা আছে?—মনামি খাবে,

তোর কি মাথা খারাপ?-অঙ্কুর। বইঠা হাতে মাঝি হাঁকে,

পংখিকো খিলাইয়ে মেমসাব, খিলাইয়ে না!

এঃ পাখির খাবার? মনামি হতাশ।

কেন খা না। চিড়িয়াখানার গেটে বাঁদরের ছোলা-বাদাম কিনে তো নিজেই খাস।

তোর বরাদ্দ আমি খেয়ে নিয়েছি? কখন?

এঃ এসব পুরোনো জোক, এখন কেউ হাসবে না।

অঙ্কুর হাঁসেদের দিকে ক্যামেরা তাক করছে। মনামি কিনেছে তিলে খাজা, সুদেষ্ণা পাঁপর টুকরো করে ছুড়ে দিচ্ছে শূন্যে। পাখিগুলো ঝাঁপ দিচ্ছে।

রোমি চেঁচায়, আমাকে দে, আমাকে… আমিও খাওয়াব।

ছাই রঙের সিল্ক লাগানো ডানায় ভরন্ত, নিটোল, কেমন একটা আভাযুক্ত সাদা যেন ফ্রস্টেড ঝালর একেকটা বড়ো বড়ো।

মনামি বলল, উঃ আমারগুলো একেবারে খাচ্ছে না। রমিতা আমার থেকে ধার নিল, অথচ ওরগুলোই …

বলতে বলতে সে বিপজ্জনক ঝুঁকে খোলামকুচি খেলার মতো খাজার টুকরো ছুড়ে দিল। ছুড়ে দেবার অভিঘাতে নৌকা হেলছে। প্রচণ্ড হেলছে। রোমিকে জড়িয়ে মনামি, মনামিটা… সরসী চেঁচাচ্ছে। আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে পণ্ডিতি চোখ।

নৌকা সোজা হয়ে যায় আবার।

গৌরাঙ্গ এখন মাঝদুপুরের রোদে সোনার গৌরাঙ্গ, এইসা মত করো মেমসাব এইসা মত।

নারকোল বাড়িয়ে ধরে ভাসমান দোকান, নারিয়ল লে যাইয়ে মাজি, সঙ্গমপে পূজা চঢ়াইয়ে।

গৌরাঙ্গ দু-হাতে বইঠা চালায়। দু-হাতের পেশি ফুলে ফুলে ওঠে আর তালে তালে সে বলে চলে, বিটিয়াকো কুছ দেনে পড়েগা মেমসাব, লিজিয়ে, নরিয়ল লিজিয়ে, মিঠাই লিজিয়ে মু মিঠা কর দিজিয়ে বিটিয়াকো। বিটিয়া দুবলি হো জায়েগি।

সরসী চোখ থেকে চশমা নামিয়ে বলল, আরে বাবা, সব লোগ নারিয়ল, মিঠাই, রুপেয় পানি মে ডালেগা তো পানি বহোত গন্ধা হো যায়েগা। নদীকি তন্দুস্তিকে লিয়ে পূজা উজা চঢ়ানা বন্দ করো ভাই। নদীকো বুরা হোগা।

চুপ করে বইঠা বায় মাঝি, মুখে প্রত্যাখ্যানের রেখাভঙ্গ। সরসীর কথাকে ও পাত্তা দেয় না আদৌ।

ওই যে ওই যে দেখো সবাই… সংগম… সংগম… সংগম দেখি।

যমুনার নীলচে সবুজ গঙ্গার গৈরিক ধারার পাশাপাশি চলেছে। নীল সোনালি।

যমুনে! তুমি কি সেই যমুনে! অঙ্কুর হাঁকে।

উতরোল কোলাহল জলে জলে, মানুষে মানুষে, কোমর জলে দাঁড়িয়ে মাথায় জল ঢালছে নারী-পুরুষ।

পানি কমর তক হোগা, যাইয়ে না মেমসাব। আস্নান কিজিয়ে।

সরসী নীচু হয়ে একমুঠো জল তুলে আমাদের মাথার ওপর ছিটিয়েছে।

ওম শান্তিহি, শান্তিহি, শান্তিহি।

সুদেষ্ণা গান ধরে :

ওরে নীল যমুনার জল
বল রে মোরে বল
কোথায় ঘনশ্যাম…

মাঝি গানে কান না দিয়ে বলে, সঙ্গম তিরথ হ্যায়, হঁহাপে আস্নান সে পুন হোগা, পুন। শান্তি মিলেগি।

ওং শান্তিহি, শান্তিহি, শান্তিহি, অঙ্কুর নিবিষ্টচিত্তে ফোটো তুলে যাচ্ছে।

দূরে মিলিয়ে গেছে ফ্রস্টেড পাখিদের ঝটাপটি। গঙ্গার দিকের পাড়ে একটা শাড়ি রোদে মেলে দু-কোণ থেকে দু-খুঁট ধরে চলেছে গোটা পরিবার। মা বাবা, ছাগলছানা, ছেলে, হাওয়ায় ফটাফট উড়ছে শাড়ি।

আমার কৃষ্ণ ঘনো ও-ও শ শ্যাম
ও পারে নিয়ে চলো না মাঝিভাই—

রমিতা অনুনয় করে। গ্রাহ্য করে না মাঝি। কখন নৌকো ঘুরিয়েছে বুঝতেই পারিনি।

সরসী সান্ত্বনা দেয়… তোমরা সংগম অব্দি আসবে বলেছ, তার বেশি ঘোরাতে ওর বয়েই গেছে, ঠিক যতটার কড়ার ততটাই… যে কোনো যাত্রাই কড়ার অনুযায়ী হয়।

আহা হা হা, একটুও ফাউ পাওয়া যাবে না—এতই কৃপণ?

কৃপণ বলো কৃপণ, কড়ার বলো কড়ার, প্রোগ্রামিংও বলতে পারো…

অঙ্কুর বলল, পাওয়া কি আর যায়নি কিছু? সব আমার ক্যামেরার ধরা আছে।

কী? সুদেষ্ণা জিজ্ঞেস করে, নীল? আর সিল্ক-মসৃণ? আর কলনা?

তীরের কাছাকাছি দিয়ে চলেছে নৌকা, পাড়ের খাঁজে সাপের খোলস। চান করতে নেমেছে বেশ কিছু লোক। হঠাৎ দেখি জল নেই, চারদিকে খালি মোষ আর মোষ আর মোষ। মোষেদের পিঠের ওপর দিয়েই নৌকা চলেছে। এ আর জলের নদী নয়। মোষের নদী।

এ কী? এ কী? মোষ অতি ভয়ঙ্কর জীব!

এক্ষুনি নৌকা উলটে দেবে।

তুমি গৌরাঙ্গ বাবাজি বেশ সাঁতরে পালাবে… না?

চেনা লোককে মোষ তো কিছু বলবে না!

আমাদের একেবারে কুঁড়ে ফেলবে।

আমরা কেউই কি সাঁতার জানি না?

জানি।

কিন্তু সে শৌখিন সাঁতারে এ মোষসংকুল যমুনা পার হওয়া যায় না।

বইঠা বাইতে বাইতে ক্লান্ত স্বরে সে বলল, মওত সে ডরো মত, ডরো মত।

খোলা নদীতে এসে পড়েছে নৌকা। অদূরে ফেলে-আসা তীরভূমি। মানেকশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। সিগারেট খাওয়া বিপজ্জনক। মওত সে ডরো মত।

সুদেষ্ণা জলের দিকে মুখ, মরিয়ার মতো বলে উঠল–

মানুষের দলা তীর্থে তীর্থে। তার মধ্যে তোকে খুঁজে ফিরি রুপোর মানুষ।
আনত মধ্যাহ্নে জলের মধ্যে দেখি তোর বিম্ব। কফিখানার খয়েরি ধোঁয়া
থেকে চুল্লুর গেলাসে ফাটা বালব, রকবাজির গড়পার থেকে
লোকনাথোৎসবের পঞ্চাননতলা। যুব-ক্রীড়ার তাতা বালি থেকে সেলিমপুরের
ব্রিজ, গলি… সব ঘুরতে ঘুরতে—শেষ পর্যন্ত নীল গেরুয়ার সঙ্গমে, দূর থেকে
তোকে দেখেও হারিয়ে ফেলেছি।

এটা কি কবিতা? অনীশ বলল।

আর কেউ কিছু বলল না।

কিছু না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress