Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিলে তিলে তিলোত্তমা || Ashutosh Mukhopadhyay

তিলে তিলে তিলোত্তমা || Ashutosh Mukhopadhyay

আজব শহরের আজব বাহার!

ঘড়ি ধরে সন্ধ্যা ছটায় খোলে, নটায় বন্ধ হয়। আশেপাশে প্রায় সকাল ছটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত যাদের দোকান খোলা, তারাও তখন ওদিকপানে চেয়ে থাকে আর বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে। প্রাসাদোপম এই অট্টালিকায় অনেক ব্যবসায়ী অনেক রকমের ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। কিন্তু বিউটি হাউসের তিন ঘণ্টা ওদের তিরিশ ঘণ্টা।

সব রাস্তা রোমের দিকে। এখানে সব আগন্তুক বিউটি হাউসের দিকে। সসঙ্গিনী তিনঘণ্টা সিনেমায় কাটানো যায়, লাভার্স পার্কের আবছা আলোয় নিরিবিলিতে বসে তিন মিনিটে তিন ঘণ্টার অবসান হতে পারে, হাত-ধরাধরি করে শিথিল চরণে মার্কেট প্লেসের শো-কেইস দেখেও ঘণ্টাতিনেক উতরে দেওয়া যায়। কিন্তু এখানকার এই তিন ঘণ্টার স্রোত একেবারে অন্য খাতে বইছে। এই তিন ঘণ্টায় মনো-বৈচিত্র্যের নিখুঁত নক্সা আঁকতে পারে, এমন লিপি-বণিক জম্মায়নি বোধ হয়।

রূপচর্যার জীবন্ত মিছিল। বিধাতার মার হার মেনেছে বিউটি হাউসের মার প্যাঁচের কাছে। খোদার ওপর খোদকারীর নমুনা দেখাচ্ছে বিউটি হাউস। বিউটি হাউস মুশকিল-আসান।

নারীপুরুষের বিচ্ছিন্ন সমাগম। সঙ্গী বা সঙ্গিনী নিয়ে বড় কেউ আসে না এখানে। অন্যের চোখে নিজেকে অভিরাম করে ভোলার তাগিদে কোঅপারেশন অচল।

প্রকাণ্ড হল। শাদা আলোয় মেঝেতে পুরু কার্পেটের রোঁয়া পর্যন্ত দেখা যায়। একদিকে সারি সারি শো-কেইসএ রঙ-বেরঙের প্রসাধনসামগ্রী সাজানো। সেসবের উপযোগিতা আর ব্যবহার বুঝিয়ে দেবার জন্য আছে এক্সপার্ট সেলসম্যান। অন্যদিকে ছোট ছোট চেম্বার। হাতে-কলমে কলাকৌশল শেখানোর মহড়া চলেছে সেখানে।

বয়সের ভারে কোঁচকানো চামড়ায় যৌবনের জলুস আনা যেতে পারে।…কালোর চেকনাই ছোটানো যেতে পারে শাদা চুলে।…তোবড়ানো গাল ভরাট দেখাবার উপকরণ পেতে হলে এখানে আসতে হবে। …এখানে আসতে হবে প্লাস্টার-পালিশে বাঁকাচোরা বিকৃত দাঁতে কুন্দ-দন্তের শোভা আনার কৌশলটি জানতে হলে। পটলচেরা চোখ বা কোকড়ানো চুল চাই তো এসো বিউটি হাউসে।–শুধু এখানকার উপকরণ আর পনের দিনের ট্রেনিং-এর পরে মুখের ওপর সার্চলাইট ফেললে প্রসাধন যদিও বা ধরা পড়ে, আসল রঙটি ধরা যাবে না। শোনা যায়, এ বিদ্যে শেখানোর জন্য প্যারিস থেকে ট্রেইনার ধরে এনেছে দোকানের মালিক ভাটনগর। নিরুৎসুক-জনের খটকা লাগতে পারে, যে-দেশে কালো রঙের সমস্যা নেই, সে-দেশে অমন এক্সপার্ট গজায় কি করে? কিন্তু নিরুৎসুক-জনকে নিয়ে কারবার নয় বিউটি হাউসের।

চটপটে ছটফটে মানুষ ভাটনগর। হাসছে গল্প করছে তদবির-তরক করছে। নতুন খদ্দের দেখলেই বিলিতি কায়দায় মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানায়, সাদরে নিয়ে গিয়ে বসায় নিজের নিরিবিলি বসবার জায়গাটিতে। গভীর সহানুভূতিতে সমস্যা শোনে, মাথা নাড়ে। সম্ভাব্য সমাধান বাতলে দিয়ে আশ্বস্ত করে তারপর। সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের গায়ে লাগানো বোতাম টেপে। প্যাক করে শব্দ হয় একটা। বেয়ারা দৌড়ে আসে।

–সাবকো (অথবা মেমসাবকো ) …নম্বর কামরা দেখাও।

পুরানো বা চেনা-জানা খদ্দেরের সঙ্গে তার হাসি-খুশি-ভরা অন্তরঙ্গতায় ব্যবসায়ীর দূরত্ব নেই এতটুকু। কোনো ভদ্রলোকের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে সোচ্ছাসে বলছে, গ্রোইং ওয়ানডারফুলি ইয়ং স্যার! উত্তরতিরিশ কোনো মহিলাকে সবিনয় অভিবাদনে স্তুতি জানাচ্ছে, ইউ লুক হার্ডলি টুয়েন্টি মাদা!

যার রূপ আছে সেও আসে। যতটুকু আছে তার থেকে বেশি একটু থাকতে আপত্তি কি! আর যার নেই তার তো কথাই নেই। কিন্তু সবাই যে এখানে এসে একেবারে রূপচয়নে বসে যায় বা তেমনি কোন সমস্যা নিয়ে হাজির হয় এমন নয়। সাধারণ প্রসাধনসম্ভারও হরদম বিক্রি হচ্ছে এখানে, যা আজকাল ঘরে ঘরে লাগে। সেব কেনার ছুতোয় কৌতূহল মেটাতে আসে অনেকে।

কিন্তু আরো একটা আকর্ষণ আছে বিউটি হাউসের।

স্বপ্না বোস।

দীপশিখা যেমন পতঙ্গ টানে, তেমনি ওরও অমোঘ একটা আকর্ষণ আছে। পিছনের দরজা দিয়ে গটগট করে ঢোকে যখন, মনে হয় এত বড় হল্টা ঝলমলিয়ে হেসে উঠল।

বিউটি হাউসের প্রধান আপ্যায়িকা স্বপ্না বোস।

কিন্তু অন্তরঙ্গ সকলেরই বিশ্বাস, শুধু কর্মচারিণী নয়, ব্যবসায়ের কলকাঠিও এই মহিলাই আগলে বসে আছে। আর ধারণা, স্বপ্না বোস ছাড়া ভাটনগরের জীবন জোয়ারেও চড়চড় করে ভাটা নেমে আসবে। অনেকের ইঙ্গিত আরো স্পষ্ট। বোস পদবীটা এখনো রেখেছে ব্যবসায়ের আবহাওয়ায় রোমান্স ছড়াবার জন্য, নইলে, ইত্যাদি।

আশ্চর্য, মেয়েদের সঙ্গে পর্যন্ত ভারি সহজ একটা হৃদ্যতা ওর যা হবার কথা নয়। তারা আসে রূপচয়ন করতে। এ নারী রূপেরই জীবন্ত উৎস। ঈর্ষা হবার কথা, কিন্তু হয় না। বরং সলা-পরামর্শ নির্দেশ-উপদেশের জন্য ওরই কাছে মন খুলে দেয়। তারা। ওকে দেখে আপন অভিলাষ ব্যক্ত করতে নবাগতদের হয়ত একটু সঙ্কোচ হয়, হয়ত বা ওর দিকে চেয়ে চেয়ে চাপা নিঃশ্বাসও পড়ে দুই-একটা। কিন্তু যাদু জানে স্বপ্না বোস। হেসে, জড়িয়ে ধরে, কানে কানে কথা বলে, নিরিবিলি চেম্বারে টেনে নিয়ে গিয়ে মনের কথা শুনে আর মনের মত কথা শুনিয়ে বৈষম্যের অনুভূতিটুকু পর্যন্ত ধুয়ে-মুছে দেয়।

পুরুষদের সঙ্গে অবশ্য স্বপ্না বোসের রীতিনীতি ভিন্ন। এদের মধ্যে সমস্যা নিয়ে যারা আসে, তারা আর যাই হোক ওর কাছে আসে না। তারা সোজা যায় ভাটনগরের কাছে, নয়ত তার অন্য কোনো পুরুষ সহকারীর কাছে। কিন্তু স্বপ্না বোসের সঙ্গ অভিলাষী আগন্তুকের সংখ্যাও কম নয়। বারো মাস তিরিশ দিনের প্রসাধনসামগ্রীই হয়ত কিনতে আসে তারা। একের জায়গায় তিন গছিয়ে দেয় স্বপ্না বোস। কৃত্রিম বিপন্ন ভাবটি ফুটিয়ে তুলে তারা হয়ত বলে, বাঃ রে, এত কি হবে?

নিয়ে যান, বউ খুশি হবে।

বউ খুশি হোক না হোক, আর কেউ যে খুশি হবে সেটা জেনেই ওরা খুশি।

কাউকে বা স্বপ্না বোস ছদ্মকোপে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, আপনারা না নিলে আমাদের দোকান চলে কি করে?

ওদের দোকান সচল রাখতে গিয়ে নিজে অচল হচ্ছে কিনা, সেটা তখনকার মত অন্তত অনেকেরই মনে থাকে না।

বাড়িগাড়িঅলা সুপরিচিতদের ছদ্ম-ত্রাস-জড়িত অন্তরঙ্গতার সুরও বৈচিত্র্যহীন নয়।–বাঃ রে, এলেই এককাঁড়ি জিনিস নিতে হবে তার কি মনে আছে? গরীব মানুষ, অত টাকা কোথায় পাব?

স্বপ্না বোস কখনো একঝলক হেসে ফস করে জবাব দেয়, তবে দোকানে আসেন। কেন? কখনো বা তেমনি ছদ্ম-গাম্ভীর্যে বলে, সত্যি কথাই তো, টাকার এত টানাটানি আপনার–আচ্ছা নিয়ে যান, জিনিসগুলো আমার নামে লিখিয়ে রাখবখন।

সানন্দে হার মেনে জিনিস নেয় তারা।

হল-এর এক প্রান্তে ভিজিটাদের জন্য দামী সোফা সেটি কৌচ পাতা। অন্তরঙ্গজনদের নিয়ে সেখানে দিব্বি আড্ডা জমে যায়। প্রায়ই চা আসে, সিগারেট আসে। ভাটনগরের সেদিকে একটুও কার্পণ্য নেই। সপ্রগম্ভ আড্ডার মাঝেই স্বপ্না বোস এক এক সময়ে সকলকে সচেতন করে দেয়। বেচারী ভাটনগর ভ্যাব-ড্যাব করে দেখছে দেখুন, আপনাদের ব্যাপার দেখে-হার্টফেল না করে বসে।

জোড়া জোড়া চোখ ছোটে অদূরে মালিকের দিকে। দুহাত তুলে ভাটনগর একটা হতাশার ভাব দেখায়। কখনো বা স্বপ্না বোসের দিকে চেয়ে হাসে মৃদু-মৃদু। আবেশ জড়ানো হাসি। আর এদিক থেকে সে হাসির নীরব প্রত্যুত্তরও বোধ করি সবারই চোখে পড়ে। বুকের ভেতরটা খচখচ করে ওটে অনেকেরই। কিন্তু ভাটনগরের কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনা সম্ভব নয় কোনমতে, এও এতদিনে সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। অবাঙ্গালী ভাটনগরের ভাগ্য দেখে তারা ঈর্ষা করাও ছেড়ে দিয়েছে। এখন সেটা সরস হাস্য-কৌতুকের ব্যাপার।

স্বপ্না বোস শত্রুমুখে রসালাপের ছোট্ট বড়েটা এগিয়ে দেয় যেন। চাকরিটা আমার আপনারাই খাবেন দেখছি!

হাঁ-হাঁ করে ওঠে তারা।–নিশ্চয় খাবো, আলবৎ খাবো, কবে খাবো বলুন ভাটনগর চাকরি খেতে দেরি করছে বলেই তো আমাদের অমন খাওয়াটা মাটি!

বলে বটে। কিন্তু ভাটনগর সত্যিই যদি তার চাকরি খেয়ে এদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করে, বিউটি হাউস দুদিনেই তাহলে মরুভূমি হয়ে যাবে এও বোঝে। খাওয়া তাদের একদিন জুটবেই, তবে ভাটনগরের গৃহস্বামিনী হলেও শুধুই ঘরের বউ হয়ে থেকে স্বপ্না বোস ব্যবসা মাটি করবে না, এটুকুই ভরসা।

অবকাশকালে ভাটনগরও সহাস্য বদনে এদের হালকা ফুর্তিতে যোগ দেয়। বিভিন্ন পেশার লোক আছে স্তাবকদলের গুঞ্জন-সভায়। ভাটনগর ডাক্তারকে লক্ষ্য করে বলে, একবার স্টেথসকোপটা লাগান দেখি বুকে, ঠিক চলছে কিনা দেখি! কখনো বা নব্য ব্যারিস্টারের উদ্দেশে বলে, আপনি রেডি থাকুন স্যর, ওর এগেইনসট-এ হয়ত শীগগিরই কেইস ঠুকতে হবে! ওর মানে স্বপ্না বোসের। কখনো বা অসহায় মুখে প্রোফেসার নামখ্যাত লোকটির স্মরণ নেয়। কিসের প্রোফেসার, কোথাকার প্রোফেসার জানে না (জানে না বোধ হয় কেউ-ই), তবু বলে, আপনার কাছে আমি দর্শন পড়ব প্রোফেসার-এ জীবনে আর কি সুখ!

হাসাহাসি পড়ে যায়। স্বপ্না বোসের পাশের জায়গাটা আপনিই খালি হয়ে যায়! জায়গাটা কে ছেড়ে দিলে ভালো করে খেয়াল না করেই ওর গা-ঘেঁষে বসে পড়ে ভাটনগর। স্বপ্না বোস তাকায় আড়চোখে। সে কটাক্ষ-বাণে ভাটনগর কতটা বিদ্ধ হয় বলা শক্ত। কিন্তু আর যারা বসে, তাদের দৃষ্টিপথে সে কটাক্ষ একেবারে মর্মে গিয়ে কাটা-ছেঁড়া করতে থাকে। হাসি-বিদ্যুৎ-প্রেম–এ তিনের একখানি ঝকঝকে ছুরি যেন। চোখের দুকোণে একটু লালিমা, চোখের তারার তড়িত-ঝলক আর চোখের গভীরে কাজল-দীঘির নিবিড়তা। আঁখি-কোণের ওই লালিমা অবশ্য তারা যখন-তখন দেখে দেখে পাগল হয়। কিন্তু এই তিনের ট্রায়ো সব সময়ে বড় চোখে পড়ে না।

আর, এই দৃষ্টি-মাধুর্য দর্শন থেকেই হয়ত সকলে এরা মনে মনে উপলব্ধি করেছিল, ভাটনগরের কাছ থেকে স্বপ্না বোসকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা স্বপ্নের মতই ব্যর্থ হবে। কারণ মানুষটা তার এই বিচিত্র আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়েই এই নারীর প্রসন্নতার শতকরা সবটুকুই দখল করে বসে আছে।

তবু কিন্তু চেষ্টার কসুর হয়নি।

চায়ের নেমন্তন্ন, সিনেমার আমন্ত্রণ, পিকনিক পার্টির আহ্বান–এমনি অনেক কিছুর সাদর এবং সাগ্রহ আকুতি সলজ্জ বিব্রত মুখে একের পর এক প্রত্যাখ্যাত করেছে। স্বপ্না বোস। খুব যে একটা জোরালো কারণ দেখাতে পেরেছে এমন নয়। পারেননি। বলে বিব্রত হয়েছে, লজ্জিত হয়েছে আরো বেশি। নিরুপায় হয়ে রূপ-রসিকের দল। যুগ্ম আহ্বান জানিয়েছে ওদের। ভাটনগর খুশিতে ডগমগ। পারলে তক্ষুনি আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ছোটে। হাঁক-ডাক করে স্বপ্না বোসকে ডেকে সুসংবাদ শোনায়।

জবাবে আবার সেই কটাক্ষ-বাণ। ভ্রূকুটি করে স্বপ্না বোস শেষে এমন একটা কিছুর ওজর দেখায়, যাতে করে আমন্ত্রণকারীদের সামনেই ভাটনগরের সকল উৎসাহে যেন ঠাণ্ডা জল পড়ে একপ্রস্থ। বলে, অমুক জায়গার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ভুলে বসে আছ এরই মধ্যে?

বলে, মিস্টার আর মিসেস অ্যাডভানিকে কি কথা দিলে যে সেদিন?

বলে, সেদিন আমাকে নিয়ে কোথায় যাবে বলে নাকে খত দিয়েছিলে?

অথবা কিছু না বলে একেবারে হতাশার দৃষ্টিতে শুধু চেয়েই থাকে, যার অর্থ –এমন লোককে নিয়ে তো আর পারিনে!

ভাটনগরের তাতেই পূর্ব কোন প্রতিশ্রুতি বা তেমনি কিছু একটা মনে পড়ে যায়। মাথা চুলকে বিব্রত মুখে মাপ চায় আমন্ত্রণকারীদের কাছে।

এই কবছরে সকলেই সখেদে উপলব্ধি করেছে, বিউটি হাউসের এই তিন ঘন্টা ছাড়া স্বপ্না বোসের মনের আঙ্গিনায় আর পলকের ঠাই হবে না কারো। কিন্তু স্বপ্না বোস যাদু জানে। এই তিন ঘণ্টার সপ্রগম্ভ সান্নিধ্য-প্রাচুর্যের মোহও ভক্তজনেরা কাটিয়ে উঠতে পারে না শেষ পর্যন্ত। পারতে চায়ও না। কিন্তু এর পরে কোথায় থাকে স্বপ্না বোস, কোন জগতে তার গতিবিধি, তার অবকাশকালের কতটা দখল করে আছে ভাটনগর–এসব প্রচ্ছন্ন জিজ্ঞাসার জবাব মেলেনি কিছু। মিলেছে এক টুকরো হাসি, এক লাইন কাব্য বা একটু কিছু হেঁয়ালি। শেষ পর্যন্ত ভাটনগরের ভাগ্যের ওপর ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছেড়ে কৌতূহলে ক্ষান্ত দিয়েছে সকলেই।

বিউটি হাউসের আর এক বিপরীত আকর্ষণ ভূতনাথবাবু।

ভূতের যিনি নাথ তিনি আর যাই হোন, নিজে ভূত নন। কিন্তু এ ভূতনাথের নামের সার্থকতা ষোলকলায় পূর্ণ। হল এর একটা কোণের দিকে ছোট টেবিল পেতে বসে একমনে একের পর এক ক্যাশমেমো কাটে। টাকা লেনদেনের জন্য আলাদা ক্যাশ কাউন্টার আছে। যে যাই কিনুক, সেলসম্যান অথবা সেগার্লকে মাল নিয়ে আগে ওর টেবিলে ফেলতে হবে। এই তিন ঘণ্টায় মুখ তোলার অবকাশ থাকে না বেচারীর। তবু এরই মধ্যে ওকে নিয়ে প্রায়ই একটু-আধটু হাস্য-কৌতুকের প্রহসন ঘটে যায়।

মানুষটার চেহারার মধ্যে যেন বেপরোয়া কারুকার্য চালিয়ে গেছেন বিধাতা। গায়ের রঙ আবলুস কাঠকে হার মানায়। ছোট ছোট চোখ দুটোয় এতটুকু জীবনের সাড়া নেই- একেবারে নিরাসক্ত, নিষ্প্রাণ। নাকটা হঠাৎ যেন সামনের দিকে তুবড়ে গেছে। পুরু ঠোঁট, প্রকাণ্ড মাথা আর মাথাবোঝাই অবিন্যস্ত কোকড়ানো চুল। গায়ের রঙে চুলের রঙে মিশে গেছে। চোখধাঁধানো বিউটি হাউসের ঝকমকানি একাই যেন ব্যালান্স করেছে ভূতনাথ। ভাটনগরের রসজ্ঞানের তারিফ করে খদ্দের বন্ধুরা। সেলসম্যান, সেৰ্গার্লরা একতরফাই হাসি-তামাসা করে ভূতনাথের সঙ্গে। একতরফা কারণ, ভূতনাথ কোন কথার জবাব দেয় না, মুখ তুলে মড়া-চোখে তাকায় একবার, মাথা নিচু করে মেমো কাটায় মন দেয় আবার।

ওর সঙ্গে স্বপ্না বোসের অন্তরঙ্গতাটুকু সব থেকে বেশি উপভোগ্য। এ অন্তরঙ্গতাও একতরফাই। অর্থাৎ স্বপ্না বোসের তরফ থেকে। ভূতনাথকে নিয়ে কেউ কিছু বললেই সে প্রতিবাদ জানায় তৎক্ষণাৎ বলে, রাহু ছাড়া চাঁদ মানায় না, ভূতনাথ ছাড়া বিউটি হাউস মানায় না। মেমো লেখাতে গিয়ে হাল্কা চাপল্যে তার মাথার ওই ঝাকড়া চুলের মুঠি ধরে দুই-একবার ঝাঁকুনি দেওয়াটা প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে ওর।

কোন রসিক ভক্ত ঠাট্টা করে।–এও যেন রাহুর সঙ্গে চাঁদের মিতালি!

মুচকি হেসে স্বপ্না বোস জবাব দেয়, একমাত্র রাহু ছাড়া চাঁদের কাছে আর ঠাই। কার?

মাঝে মাঝে আরো বেশ খানিকটা গড়ায়। এখানকার সর্বজনজ্ঞাত একটা বড় তামাসার কথা হল যে, ভূতনাথবাবু নাকি স্বপ্না বোসের প্রেমে পড়েছে। কার মাথায় যে প্রথম এই রসিকতাটুকু এসেছিল, সে আর কারো মনে নেই। কিন্তু কথাটা থেকে গেছে। কালোর সঙ্গে আলো মেশে না বলেই হয়ত এ ধরণের রসিকতা জমে ভালো। ভাটনগরও সানন্দে যোগ দেয় এসব হাসি-ঠাট্টায়।

স্বপ্না বোস হয়ত বলে, মিথ্যে ওকে দোষ দেওয়া কেন, আমিই বরং ওর প্রেমে পড়ে গেছি!

শোনামাত্র ভাটনগরকে সচেতন করে দিতে চায় কেউ, বলে, সাবধান ভাটনগরজী, ওই ভূত বাবাজীই কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন আপনার ঘাড় থেকে

মনোমত কথাটা আর হাতড়ে পায় না।

স্বপ্না বোস আলতো করে জুড়ে দেয়, পেত্নী ছাড়াবে!

সমস্বরে হেসে ওঠে সকলে। ভাটনগর একবার সস্নেহ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দূরে কর্মরত মূর্তিটির দিকে। বলে, ভূতনাথ ইজ এ জুয়েল–এ ব্ল্যাক জুয়েল-রত্নের প্রতি আর লোভ না থাকে কোন মেয়ের!– তবু মুখে যে যত হাসি-তামাশাই করুক, একমাত্র ভাটনগর ছাড়া স্বপ্না বোসকে যখন-তখন তরল হাস্যে ওই ভূতনাথের গায়ে-পিঠে হাত বুলোতে দেখে বা ঝাকড়া চুলের গোছায় বেপরোয়া চাপাকলি আঙুল চালাতে দেখে বুকের ভেতরটা চড়চড় করে ওঠে অনেকেরই।

রাত নটা বেজে গেছে।

বিউটি হাউসের গেট বন্ধ। কর্মচারী-কর্মচরিণীরা বিদায় নিয়েছে। কোমর-উঁচু ঝকঝকে কাঠঘেরা গণ্ডীর মধ্যে মালিকের নির্দিষ্ট গদি-আঁটা-আসনে বসে গভীর মনোযোগে হিসেব দেখছে ভাটনগর।

হল এর অন্য প্রান্তে নিজের জায়গায় বসে সেদিনের বিক্রির মেমো ওলটাচ্ছে ভূতনাথ। মাঝে এক-আধবার চোখ যাচ্ছে তার বিপরীত কোণের দিকে, যেখানে ক্রেতা অভ্যাগতদের জন্য সৌখীন সোফা-সেটি পাতা। কৌচের ওপর দেহ এলিয়ে দিয়েছে স্বপ্না বোস। শুধু এখন নয়, কাজের মধ্যেও আজ একাধিকবার নিবিষ্ট-চিত্ততায় ছেদ পড়েছে ভূতনাথবাবুর। ওই নারীমুখের হাস্যলাস্যের মাত্রাটা আজ বেড়েছিল, একটু একটু করে বেড়েই যাচ্ছে যেন। ছোট ছোট ঘরে নিরিবিলি সান্নিধ্যে আজ দুবার দুটো লোকের সঙ্গে গল্প করে কাটিয়েছে বেশ খানিকক্ষণ ধরে, তাও লক্ষ্য করেছে। মেমো লেখা ছেড়ে ভূতনাথ মুখ তোলে না বড়। কিন্তু চোখ এড়ায় না কিছু, ভূতনাথবাবু সব দেখে।

কৌচের ওপর স্থাণুর মত পড়ে আছে স্বপ্না বোস। শ্রান্ত, ক্লান্ত। প্রায় নির্জীব যেন। ভালো লাগছে না কিছুই ভালো লাগছে না। কান্নার মত একটা বিষাদের তরল স্রোত বইছে সর্বাঙ্গে। ভাবছে, কিছু ভাববে না, ভাবলেই তো ভাবনার বিভীষিকা বাড়ে। ভাবছেও না কিছু, তবু দুর্বোধ্য বোঝার মত কি যেন বুকে চেপে আছে।

অদ্ভুত নীরবতা বিউটি হাউসে। সবগুলো আলো জ্বলছে তেমনি। তেমনি ঝকঝক করছে শো-কেইসের দ্রব্যসম্ভার। কোথাও টু-শব্দটি নেই। শুধু তিন কোণে তিনটি প্রাণী। সামনের দরজা বন্ধ। পিছনের পথ দিয়ে বেরোয় তারা। প্রাসাদ-সৌধের পিছনদিকেও একাধিক নির্গমনের ব্যবস্থা আছে। সেদিক দিয়ে বেরুলে বাড়ির মধ্যেই দশ দিকে দশ পথ।

ঠং করে ঘড়িতে শব্দ হল একটা। সাড়ে নটা বাজল। কৌচ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। স্বপ্না বোস। অলস মন্থর গতিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো ভূতনাথবাবুর কাছে।

মুখ না তুলেই ভূতনাথ বলল, বোসো।

–হয়নি তোমার?

–হয়েছে। মেমো-বইয়ের ওপর পেপারওয়েট চাপা দিয়ে চোখে চোখ রাখল। তার। তেমনি মড়া-চোখ, ভাবলেশহীন, নির্বিকার। সে চোখে এতটুকু আগ্রহ নেই।

সামনের চেয়ারে বসে পড়ল স্বপ্না বোস। বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, কি দেখছ?

–কিছু না,খুব ক্লান্ত?

–নাঃ, ভালো লাগছে না কিছু।

–লাগবে না তো!

–কেন? কণ্ঠস্বরে তিক্ততা প্রকাশ পায় আবার।

ভূতনাথ শান্ত কণ্ঠে বলল, এখন শুধু ভালো লাগছে না, আর কিছুদিন বাদে তিলে তিলে জ্বলতে হবে। জেনে-শুনে নিজে দুঃখ সৃষ্টি করলে দুঃখের শেষ কোথায়?

–থামো, থামো! অস্ফুটকণ্ঠে প্রায় গর্জে ওঠে স্বপ্না বোস। চাপা কর্কশ স্বরে বলে ওঠে, খুব সাহস দেখি যে?

-হ্যা-ল-লো! ডোন্ট ফাইট মাই ডিয়ার!

শশব্যস্তে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল দুজনেই। মেঝেতে পুরু কার্পেট পাতা, পায়ের শব্দ শোনা যায় না। ভাটনগর কখন এসেছে দুজনের কেউ খেয়াল করেনি।

–সিট ডাউন, সিট ডাউন প্লীজ!

বসল দুজনেই।

এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ভাটনগর একটা শূন্য চেয়ারে এক পা তুলে দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ডাকল, স্বপ্না?

-ইয়েস স্যার!

— –তোমাকে কিছু বলবার আছে।

–ইয়েস স্যার…

ভাটনগর তীক্ষ্ণ চোখে তাকে নিরীক্ষণ করল আবার একটু।-ইউ সিম টু ফরগেট ইওরসেলফ..অপরকে ভোলানো আর নিজে ভোলা এক কথা নয়…ডোন্ট রিসিভ ইনডিভিজুয়াল অ্যাটেনশান অ্যান্ড ইনভাইট ট্রাবলস…আণ্ডারস্ট্যাণ্ড?

শুষ্ককণ্ঠে স্বপ্না বোস জবাব দিল, ইয়েস স্যার…।

–গুড নাইট!

পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ভাটনগর। আর হিংস্র শ্বাপদের মত জ্বলে উঠেছে স্বপ্না বোসের দুই চোখ। সে অদৃশ্য হবার পরেও সেই দিকে চেয়ে নিঃশব্দে আগুন ছড়ালো আরো খানিকক্ষণ।

পরে মাথা রাখল ভূতনাথের টেবিলের ওপরেই।

চেয়ার ছেড়ে ভূতনাথ উঠে দাঁড়াল। এক দিকের কাঁচের আলমারি খুলে একটা আরকের শিশি বার করল। ড্রপারে করে সাদা জলের মত আরক তুলে নিল কয়েক ফোঁটা। কাছে এসে বলল, ওঠো রাত হয়েছে, এর পরে তো আরো কতক্ষণ লাগবে ঠিক নেই!

স্বপ্না বোস মাথা তুলল। কিছুটা সংযত, কিছুটা শান্ত। নিজেই দুহাতের আঙুলে করে একটা চোখের ওপর নিচ টেনে ধরে আলোর দিকে মুখ ফেরালো। ভূতনাথ ড্রপ ফেলল চোখে। একে একে দুই চোখেই।

নীরবে উঠে গেল স্বপ্না বোস। এক কোণের আড়াল থেকে একটা পেটমোটা ভারী চামড়ার হাতব্যাগ তুলে নিয়ে পাশের দরজা দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

ভূতনাথ বসে আছে। নীরব, নিস্পন্দ। যেন ঘুমিয়ে আছে। কোন তাড়া নেই। কোন চাঞ্চল্য নেই। সময় কেটে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ বাদে ওই ব্যাগ হাতে নিয়েই আবার দেখা দিল যে নারী, তাকে চিনবে না বিউটি হাউসের অতি পরিচিত কোন খদ্দেরও।

ঘড়ির দিকে তাকালো ভূতনাথ। এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। হবার কথা। রোজ ঘণ্টাতিনেক লাগে যে প্রসাধন সম্পূর্ণ হতে, সেটা তুলতে কম করে এক ঘণ্টা তো লাগবেই। এমনিতে ওঠে না, ওই হাতব্যাগে আছে নানা রকম রাসায়নিক নির্যাস– সেটা যথাস্থানে রেখে ভূতনাথের মুখোমুখি বসল আবার।

সদ্যস্নাতা। আটপৌরে বেশবাস। সর্বাঙ্গের চাপাহলুদ পেলবতা ধুয়ে-মুছে গেছে। শ্যামাঙ্গী। কুৎসিত। চোখের ড্রপে নেত্রকোণের সেই মন-মাতানো লালিমার আভা কেটে গেছে। দাঁতের নিখুঁত প্লাস্টার-পালিশ উঠেছে। নিশ্চিহ্ন হয়েছে অধর-কোণের কামনা জাগানো তিলটাও।

অবসন্ন, বিষাদক্লিষ্ট দুই চোখ মেলে স্বপ্না বোস তাকালো ভূতনাথের দিকে।

ভূতনাথও তাকেই দেখছিল।

তার সেই মড়া-চোখের দৃষ্টি যেন বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। নিস্পৃহতার আবরণটুকুও সরে যাচ্ছে। কোমলতার আভাস আসছে যেন। চেয়েই আছে ভূতনাথ।

ভারী সহজ লাগছে তার বিধাতার গড়া ওই নারীমূর্তি।

কুৎসিতের মধ্যেও কোথায় যেন সুন্দরের সন্ধান পেয়েছে সে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress