Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিমির বিদার || Bani Basu » Page 8

তিমির বিদার || Bani Basu

বউদি বলল—মুখখানা কেলে-হাঁড়ি করে ঘুরছ কেন বলো তো? মা আনাজ কুটছে। বউদি বোধহয় চুল শ্যাম্পু করেছে, মাথায় গামছা বাঁধা, দাদা বাজারে গেছে। রিন্টি তার ঘরের মেঝেতে একগাদা পেনসিল, ক্রেয়ন সব ছড়িয়ে বড় বড় হাতি, জেব্রার ঝাঁক, মিকি মাউস, টেডি-বিয়ার সব রং করছে। স্কুলের কাজ। বউদি হরসুন্দরীতে পড়ায়, সেখানে ক্লাস ফোর অবধি বাচ্চা ছেলেদেরও নেয়। কিন্তু রিন্টিকে বউদি ওই স্কুলে দেয়নি। হরসুন্দরী কিন্তু খুব ভাল স্কুল, নামটা ওরকম জগত্তারিণী-মার্কা হলে কী হবে। রাস্তা পার হয়ে বেশ খানিকটা রিকশা করে গিয়ে তবে রিন্টিদের সাহেবি স্কুল। আমাদের সাধ্যের অতিরিক্ত মাইনে আর সাজসজ্জা। অবশ্য, রিন্টি যখন ছোট্ট গলায় নীল টাই পরে, জুতো-মোজা পরে পিঠে ব্যাগ হাতে জলের বোতল, স্কুলে যায়, বেশ দেখায়। কিন্তু ও আজকাল মাকে মাম্মি বলছে প্রায়ই। যে-ই বলে— বউদির চোখ দুটো আনন্দে গর্বে চকচক করে ওঠে। আশে-পাশে যে যেখানে ওর মাসি-পিসি সব আন্টি, দাদার বন্ধুদের আগে ও আমার অনুকরণ করে বিজনদা, স্বপনদা বলত। এখন ওরা সব আংক্‌ল হয়ে গেছে। আংক্‌ল শুনে ওদেরও কেমন হরষিত দেখায়। খালি আশপাশের বাড়ির বুলুদি রত্নাদিরা খুঁতখুঁত করে, বলে—এই রিন্টি খবর্দার আন্টি আন্টি বলবি না। কেমন বুড়ি-বুড়ি লাগে। আমার সঙ্গে যখন বেরোয় তখনই আমি শাসাই—রিন্টি খবর্দার আমাকে আংক্‌ল বলবি না, বললে সচিন পাবি না। রিন্টি আশ্বাসের সুরে বলে, তুমি তো কাকু।

—ভ্যাট, বিজনদা, স্বপনদা ওরা তোর কাকু ছিল না?

—ওরা তো দাদা।

—না, দাদা নয়, আমার দেখাদেখি দাদা বলতিস, যেমনি তোর মাকে ‘টুকু’ ডাকতিস বাচ্চাবেলায়।

—আচ্ছা, আর বলব না। না বললে মিষ্টি মশলা দেবে তো!

এই বাচ্চাগুলোকে চিরকাল আমরা এমনিভাবে নষ্ট করে এসেছি। লক্ষ্মী হয়ে খেয়ে নাও তা হলে চকলেট দেব, দুধটা হাঁ ঢোঁক করে গিলে ফেলো, কী সুন্দর লজেন্স আনবে তোমার বাবা। এরাও কম সেয়ানা নয়, সব সময়ে কিছু না কিছু প্রাপ্তির আশা করে হাত পেতে আছে। মহা মুশকিল!

সুতরাং আমি লজিকের পথ ধরি, দেখি খোকাটাকে বিপথগামিতা থেকে যদি রক্ষা করতে পারি।

বলি—মিষ্টি মশলা তোকে আমি এমনিই খাওয়াব। কিন্তু যেগুলো করতে বলছি সেগুলোই ঠিক কাজ, তাই করবি। কিছুর লোভে করবি না।

—আমি লুভি নই—রিন্টি গোঁজ মুখে বলে।

—তা হলে বললি কেন মিষ্টি মশলা দিলে আর কাকুদের আংক্‌ল বলবি না।

—আমাদের ক্লাসে সবাই তো বলে, আন্টি, আংক্‌ল, মাম্মি, ড্যাডি…

—ঠিক আছে স্কুলে যা বলছিস বলবি, বাড়ি এসেই—পিসি-মাসি, জেঠু, কাকু, মা, বাবা বলবি।

রিন্টি একটু ভেবে-চিন্তে বলল—আচ্ছা।

সত্যি কথাই, হরসুন্দরী আর রিন্টির ‘ম্যাজিক মিরর’-এর মধ্যে তফাত অনেক। হরসুন্দরীর বইপত্রগুলো কেমন ফ্যাতা মতো৷ কাগজ বাজে, মলাট বাজে, অক্ষরগুলোও তেমনই বাজে লাগে সেই জন্যে। ভাষাটাই যেন বাজে মনে হয়। অপর দিকে ‘ম্যাজিক মিরর’-এ যে-সব টেক্সট বই তাদের বাঁধাই, কাগজ, রং—এ সবের বাহারই আলাদা। দেখলে পড়তে ইচ্ছে করবে, খুলে পাতা উল্টোতে ইচ্ছে করবে। খাতা সব স্কুলের। লাইন টানা, ডবল-লাইন, মলাটের ওপর সুন্দর লেবেল, আবার কোণে একটা করে মিকি-মাউস, কি ডোনাল্ড ডাক কি স্কুবিডু, মোটিফের মতো ছোট্ট করে একটা জলছবি ছাপ৷ পুরো গেট-আপটাই আলাদা। এই গেট-আপে যে ভাষা আসে সে ভাষাটাও ম্যাজিক। এই স্কুলে পড়লে অন্যদের প্রতি একটা ‘ছোঃ’ মনোভাব, নিজের প্রতি একটা ‘সাবাশ’ মনোভাব তৈরি হবেই। আচ্ছা মানলাম স্কুলগুলো ধনীদের স্কুল, চারশো-পাঁচশো টাকা টিউশন ফি। কিন্তু সরকারও তো ফট করে সব অবৈতনিক করে না দিয়ে এই পাঠ্য-বই খাতার স্ট্যান্ডার্ডটা উঁচু করে দিতে পারত। ঠিক আছে যে পারবে না তার জন্য বিবেচনা থাকবে আলাদা, যেমন ধরুন আমার দাদা যখন এইরকম একটা লোক্যাল স্কুলে পড়েছে, মাস গেলে দশ টাকা মাইনে দেবারও তার সামর্থ্য ছিল না। বইগুলো কিছুটা চেয়ে-চিন্তে চলে যেত। মাইনে কিন্তু প্রায়ই বাকি পড়ে যেত। আমাদের মতো ছেলেদের জন্য একটু কনসেশন থাকল, হাই-ইনকাম গ্রুপের বা মিডল-ইনকাম গ্রুপের জন্য যা ন্যায্য মাইনে হওয়া উচিত তাই হল। এটা কি খারাপ? বুঝি না বাবা। রিন্টির বইগুলো দেখলে আমারই লোভ হয়। যেন চকলেটের মোড়ক একেকটা। ভেতরের জ্ঞানগুলো চকলেট, একটু হয়তো ধৈর্য ধরে খেতে হয়, কিন্তু খাবার রুচিটা থাকে। সেই স্কুল, সেই বই আর সেই সিস্টেম থেকে যা শিখবে তা ঠিক হোক, ভুল হোক, ভাল হোক, মন্দ হোক, বিদেশি হোক এ দেশি হোক—ওরা মানতে চেষ্টা করবে—এটাই স্বাভাবিক।

আর দাদা বা আমি যখন কলেজে পড়তাম! আরিব্বাস কী মজা! বারোটা টাকা খরচ করে এক এক ডিপার্টমেন্টের সাতটা আটটা এম এ, এম এ পিএইচ ডি-র কাছ থেকে শিখছি। মেয়েগুলো তো এন্তার সিল্কের শাড়ি পরে আসত, পার্ফুম লাগাত আচ্ছা করে। তার পরেও, ইচ্ছে হলে জাস্ট বেড়াতে আসত কলেজে। যদি বলেছি… কী রে এত ফাঁকি মারছিস?

—কে বললে ফাঁকি মারছি। কলেজে কী এমন লেকচার হয় যে শুনতে হবে? খালি লেকচার, লেকচার আর লেকচার। বারো টাকার লেকচার শুনে কী করব?

বাড়িতে ওরা বারোশো টাকার লেকচার আর নোটস-এর বিলি ব্যবস্থা করত। আমরা গরিবের ছেলে কে জানে বাবা, আমরা তো ক্লাস লেকচার সম্বল করেই পরীক্ষা-সাগর পার হয়েছি। খারাপ তো কিছু হয়নি। তবে? যে টিচারকে বারো টাকার ১/১২ টিচার মনে করে অগ্রাহ্য করছে তার কাছেই প্রাইভেট পড়বার জন্যে হত্যে দিচ্ছে পাঁচশো থেকে আটশো টাকা দিয়ে! জিজ্ঞেস করলে বলবে—ক্লাসে ওঁরা কিছু পড়ান না, বাড়িতে গিয়ে করকরে নোটগুলো হাতে তুলে দিলে তবে আসলি চিজ বেরোয়। আসলি চিজ মানে কী বলুন তো! নোটস। অপরের করা নোটস উগরে উগরে শেষ পর্যন্ত ওরা কতটুকু শেখে আমার বিস্তর সন্দেহ আছে। আমাদের যে কখনও অসুবিধে হয়নি তা নয়, কিন্তু সেক্ষেত্রে ক্লাসের ফাঁকে স্যারেদের কাছে গেছি! লাইব্রেরিতে গেছি!

যাকগে বাবা, —আমি আদার ব্যাপারি, জাহাজের খোঁজে আমার কাজ কী? এ সব হাই-ফাই ব্যাপারে আমার নাক-গলানোর একটাই কারণ। আমার ভাইপোটা। রিন্টিটা স্কুলে একটা অলীক জগতে বাস করে। সে জগতের রহন-সহন, সে জগতের বাস্তব সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারের। এখানকার বাস্তব নয়। নীলকমল-লালকমল ছেড়ে ওরা ব্যাটম্যান-স্পাইডারম্যান হাতে তুলে নিচ্ছে। ‘আনি মানি জানি না’র খেলা ভুলে—রিংগা রিংগা রোজেস পকেট ফুল অব পোজিস্‌ —খেলছে। রাম দুই সাড়ে তিন বললে হাঁ করে চেয়ে থাকে, বলতে হবে—ইনি মিনি মাইনি মোও। রিন্টিরা অলীক জগতের অলীক মানুষ। কোনওদিন চারপাশের বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারবে না। যদি সেরকম করিৎকর্মা হয়, বিদেশে চলে গিয়ে বাঁচবে, আর তা নয়তো এখানে বাস করবে বিদেশির মতো। খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না, সব কিছু ঘেন্না করবে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের যেমন স্বাধীনতার পর মনে হয়েছিল তাঁরা এ-দেশের নন, ইংল্যান্ড তাঁদের হোম, সেই হোমে গিয়ে সেখান থেকে অবজ্ঞা-তাচ্ছিল্য খেয়ে তবে বুঝেছিলেন আসল সত্যটা, এই রিন্টিরাও তেমনি এ দেশের মাটিতে বিদেশি হবে, বিদেশের মাটিতে হবে না ঘরকা না ঘাটকা। আরেক রকমের ঘেটো— হ্যাঁ, ঘেটোই তো।

দূর ছাতার! সেই মোটর-পার্টস-এর দোকানের লোকটা বলেছিল বটে— ভাইপোকেই সামলাতে পারছেন না? ছেলে হলে কী করবেন? তা ছেলে আমার আর হয়েছে! ছ’হাজার টাকার চাকরি পেলাম, দানশীল উদার-মহৎ সেজে বন্ধুর সঙ্গে সেটা ভাগ করে নিলাম, এখন সেটাও ওয়ান-থার্ড হয়ে গেল। হায়!

কেলে-হাঁড়ি মুখ আমার হবে না তো কি বউদির হবে? বিএ অনার্স বিএড ভালই স্কেল পাচ্ছে, দাদার সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কাজ, রেলে। পাস পায়। সংসার চালাচ্ছে, মাকে দেখছে, ভাইকে দেখছে। বউদির মুখ ঝলমল করবে বই কী!

আমি বিরক্ত হয়ে বলি—তুমি নিজের চরকায় তেল দাও না!

—দিচ্ছি তো! —গামছা বাঁধা মাথাটা এগিয়ে দিয়ে বউদি বলে, নিজের চরকায় দিয়েও আমার কিছু তেল বাঁচে। সেইটা তোমাকে ধার দিতে চাইছি। যা ক্যাঁচ কোঁচ করছ!

আমি সোজাসুজি মাকে বলি—মা, তোমাকে আর এ মাস থেকে তিন হাজার করে দিতে পারছি না। বাড়িটাতে হেভি ঝামেলা লেগে গেছে। এক হাজার দেব।

মা বলল—আমি তখনই বলেছিলাম! লোকটা আটঘাট বেঁধেই নেমেছে।

—তোমাদের মতো ভবিষ্যদ্দর্শী তো আমি নই! কী আর করা যাবে, তা ছাড়া আমি যা পাই, যতটুকুই পাই, তা-ই আমার লাভ। ও তোমরা বুঝবে না।

মা আমার দিকে একটু চেয়ে থেকে বলল—বুঝব না কেন? আমাদেরও তো তাই। যতটুকু পাই ততটুকুই লাভ।

আজকে বাজারে খয়রা মাছ পেয়েছি। এমনিতেই বউদি আর রিন্টি ছাড়া আমরা কেউ ওই গোদা-গোদা কাটা পোনা পছন্দ করি না। আজকাল ইনসেকটিসাইডের চল হয়ে ছোট মাছের খুব আকাল। ধান খেতের চিংড়ি খলসে, চুনো-চানা সব মরে যাচ্ছে। আজকে খয়রাটা পেয়ে গেলাম। চান করে আসতে মা বলল—তোর বউদি তোর জন্যে বসে আছে, আমরা তিনজনেই বসে খাই। আয়।

তিন-চারটে খয়রা মাছ আমার পাতেই ফেলে দিল। খানিকটা গরম সর্ষের তেল সেই সঙ্গে। গরম ভাতে খয়রা ভাজা তেলসুষ্ঠু খেতে একেবারে ইলিশের মতো লাগে। ডাল, আলু ভাতে, আর শাকের চচ্চড়ি। মেনু এই। ও মা, দেখি মা আরও দুটো খয়রা আমার পাতে তুলে দিল।

—এ কী? কী করছ? তোমাদের কই?

মা অম্লানবদনে বলল—খেয়েছি দুটো। আজকাল খয়রার গন্ধটা আমার ঠিক ভাল লাগে না। আর টুকুকে তো পোনাও দিয়েছি।

—দাদার জন্যে রাখলে না?

—আরে এসব গরম গরমই খেতে ভাল। রাতে ভাল লাগবে না। তপুকে ডিম ভেজে দেব এখন।

আমার ভুরুটা কুঁচকে থাকে। খয়রা মাছে মায়ের কোনওদিন অরুচি দেখিনি। বউদি অনেক কুচো মাছ খায় না, কিন্তু খয়রা কড়া করে ভেজে দিলে বেশ তারিয়ে তারিয়েই খায়। দাদারগুলো ঝাল করে রেখে দেওয়া যেত। একেবারে শুকনো করে, সর্ষে লংকা দিয়ে! এসব আমাকে ভোলাবার চেষ্টা, আমি বুঝি। যেন দুটো খয়রা মাছ ভাজা পেলেই আমার তিন হাজারের দুঃখ চলে যাবে। এদের ছেলেমানুষি আর যাবে না। যেমন ইম্‌ম্যাচিওর, তেমনি সেন্টিমেন্টাল!

বউদি উঠে গেল। রিন্টি না হলে ঘুম থেকে উঠে পড়বে। আচ্ছা মা-ন্যাকরা ছেলে হয়েছে বটে! মা বলল —হ্যাঁ রে রুণু, গ্যারেজটাতে দোকান দেওয়ার কথা কিছু ভাবলি? ছোট করে একটা মনোহারি…

—অনেক টাকা ক্যাপিটাল লাগবে।

—তোর দেওয়া টাকা সব আমি জমিয়ে রেখেছি। আট হাজারের চেয়ে কিছু বেশিই হবে। বাকিটা তোর দাদা পি এফ থেকে ধার করে দেবে বলেছে।

—ব্যবসা-ট্যাবসায় হেভি ঝুট-ঝামেলা মা। তোমাকে আগেও বলেছি।

—ওই কর। ঝুট-ঝামেলা কোথায় নেই! এই যে গুহদের বাড়ি হচ্ছে, এখানে ঝুট-ঝামেলা হল না? তোর যদি তোর দাদা বা বউদির মতো নিশ্চিন্তির চাকরি ভাগ্যে না থাকে, তুই একটু সাহস করে ব্যবসা-ট্যাবসার কথা ভাবতে পারবি না? কে বলতে পারে ওর থেকে তুই-ই হয়তো একদিন…

—গোদরেজ হয়ে যাব?

—আলমারি? আলমারি হবি কেন?

—যাচ্চলে, গোদরেজ একটা ফ্যামিলির পদবি, যাদের ওইসব আলমারি ফালমারি।

—তাই বল। তা হতেও তো পারিস। শুধু একটু সাহস কর। আর দ্যাখ, বেশ ঘটা করে একটা ওপনিং হবে। নিতাইকে ফিতে কাটতে ডাকবি। বিশু প্রেসিডেন্ট। রমরম করে চলবে তোর দোকান। তোর বাবা যে কী বুদ্ধি করে এই গ্যারেজটা করে গিয়েছিল। আমি তখন বলেছিলাম—হেসে বাঁচি না, কবে তোমার ছেলেদের গাড়ি হবে… তোর বাবা বলেছিল—কত কাজে লাগবে। ওপরে একটা নিচু হোক, যা-ই হোক, এক্সট্রা ঘরও তো পেলে? তা এখন দেখছি সে ঠিকই…

বাবার বুদ্ধির কথা বলতে গেলে মায়ের আর জ্ঞান থাকে না। কোথায় যে থামবে! আমি বলি—ওটা তুমি ভুলে যাও মা।

—কেন। পরের গোলামির চেয়ে দোকানদারিটাই তোর সম্মানে লাগছে?

—না মা না। ওর ভেতর অনেক হ্যাঁপা আছে। ধরো একদিন কিছুর মধ্যে কিছু না। দোকানটা লুঠ হয়ে গেল। তখন? এরকম তো হামেশাই হচ্ছে আজকাল!

—আশ্চর্য তো! শাটার থাকবে, ভেতরে কোল্যাপসিবল থাকবে। লুঠ অমনি হলেই হল? মগের মুলুক না কি?

—এইবার একটা খাঁটি কথা বলেছ মা, নির্ভেজাল সত্য। মগেরই মুলুক। একেবারে খাপে খাপ। বছরে তিনবার জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, চাল-গম গুদামে পচছে, অথচ না খেতে পেয়ে মানুষ চোর ডাকাত হয়ে যাচ্ছে, কিংবা ফ্যামিলিক্কে ফ্যামিলি আত্মহত্যা করছে এমন শুনেছ কখনও? এ হতে পারে? কারখানার পর কারখানা দুমদাম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়নের লিডাররা দেখো তো চমচম খাচ্ছে হাত চেটে, শ্রমিকরা মাসের পর মাস বেরোজগার, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে, কারও ভ্রূক্ষেপ নেই দায় নেই, মন্ত্রী-আমলা সব নিশ্চিন্তে বিজনেস ক্লাসে স্পেশ্যাল চার্টার্ড প্লেনে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভাবতে পারো? ‘এক দেহ, এক প্রাণ, একতা—’এই স্লোগান গর্জে গর্জে সব স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করছে।

ধর্ম-নিরপেক্ষ দেশ? মাই ফুট! ধর্মের মতো ফ্যানাটিসিজম আর কোনও কিছুই পয়দা করতে পারে না, আসলে ধর্ম-নিরপেক্ষ নয়। ধর্ম মুখাপেক্ষী দেশ এটা। মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বার বেড়ে যাচ্ছে, মানুষের থাকবার জায়গা নেই। এদিকে লাউডস্পিকার যদি গীতা আওড়ায়, ওদিকে আর একটা লাউড-স্পিকারে আজান শুরু হয়ে যায়, গ্রন্থসাহেব পাঠই বা বাকি থাকবে কেন? এক পাড়ায় তিনটে সর্বজনীন দুর্গাপুজো, কালীঠাকুর একটু বেঁড়ে করবার অর্ডার হলে নেতাদের মাথায় হাত পড়ে, নিজের পাড়ার কালী বেঁড়ে হয়ে গেলে মান যাবে। ঈদের নামাজ রাস্তায় রাস্তায় উপছে পড়ছে। আজকাল ছট পুজোর সময়েও ট্র্যাফিক জ্যাম হচ্ছে। ভিড়ের চোটে কতজনের সলিল সমাধি হচ্ছে গঙ্গায়। সেকুলার মানে কী? না, যে কোনও দেবতা, যে কোনও পরব, সব সরকারকে সাধারণ মানুষকে মানতে হবে। জ্যাম হবে, স্ট্যাম্পিড হবে, মৃত্যু হবে। হোক।

—তুই কি খেপে গেলি না কি? মা হাত ধরে আমাকে থামায়! দোষের মধ্যে গ্যারেজে একটা দোকান দিতে বলেছিলাম। তো এক কাঁড়ি বক্তৃতা শুনিয়ে দিলি!

—নাঃ, তুমি ওই ‘মগের মুলুক না কি’ না কী একটা বললে না! তাইতেই ফ্লোটা এসে গেল। আমি নিশ্বাস ফেলে বলি।

—পলিটিকস করছিস না কি আজকাল? ওইজন্যে বিশু মল্লিকের কাছে যাওয়া বেড়ে গেছে।

—মা পলিটিকস যারা করে তারা এসব বলে না! তারা সব জানে। খুব ভাল করে জানে কীসে ভাল আর কীসে মন্দ। ভাল-মন্দের পরোয়া তাদের নয়। তারা শুধু দেখে কতটা কী বললে, কী বলে মানুষকে খ্যাপালে বোকা বানালে ভোট সাগরটা পার হওয়া যায়। পারের খেয়া অবশ্য আছেই, সত্যি ভোটের ওপর নির্ভর করবার দরকার পড়ে না। তবু একটা বাইরের ঠাট বজায় রাখতে তো হয়! বলতে হয় এসো এসো ভোটারগণ, শুনে যাও— ধান বুনলে ধান দেব, কালো গোরুর দুধ দেব, কাতলা মাছের মুড়ো দেব আর দেব কী? দেশ জুড়ে ছাপ্পা ভোটের জাল রেখেছি। লাস্ট সেন্টেন্সটা অবশ্য উহ্য।

—একটু ভেবে দেখিস রুণু। এখনও পর্যন্ত টাকাটা আর তোর দাদার অফারটা আছে। তুই যে-সব কথা বললি, ঠিক কথাই বলেছিস। কিন্তু তবু তার মধ্যে দিয়েই তো মানুষ খাচ্ছে পরছে, রুজি-রোজগার করছে, জন্ম-মৃত্যু হচ্ছে, কারও খুব ভাল, কারও খুব খারাপ হচ্ছে। বাইরের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, জীবিকার চেষ্টা তো। আমাদের করতেই হবে! অর্থাৎ মা আমার কথাগুলো গ্রাহ্যই করল না।

বলতে পারতাম— মা, এই তোমাদের এই আমাদের দোষ। চারপাশে যা-ই ঘটে যাক আমরা একটা ক্ষুদ্র গেরস্থালি জীবন কাটিয়ে যাবার জন্যে আপ্রাণ করি। এতে করে আমাদের অদম্য টিকে থাকবার শক্তিও যেমন প্রমাণ হয়, তেমন আমাদের পাহাড়-প্রমাণ অসচেতনতা, অজ্ঞতা, অসাড়তাও প্রমাণ হয়। আর যদি সইতে না পারি? তা হলে একদিকে আছে গলায় দড়ি, ছারপোকা মারার ওষুধ, বহুতলের ছাত। আর অন্যদিকে পরিকল্পনাহীন, পরিচালনাহীন, আবেগ-সর্বস্ব জ্বলে ওঠা। মাঝখানে আমরা হলাম পিঁপড়ে, লক্ষ লক্ষ বছর বিবর্তনহীন বেঁচে আছি।

বললাম না। মা বেচারি ভাবছে মায়ের কথায় ছেলে যদি একটু সৎসাহস পায়। পাবেই, নিশ্চয় পাবে। ভাবুক, কয়েকটা দিন ও রাত মায়ের তৃপ্ত, টেনশনহীন কাটুক না, আমি কিছুতেই গদা-র খপ্পরে পড়ব না। গদাকে মাস-মাস তোলা দিয়ে যদি আমায় ব্যবসা করতে হয় তো তার থেকে আমার মৃত্যুই ভাল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress