Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিমির বিদার || Bani Basu » Page 15

তিমির বিদার || Bani Basu

জুন থেকে ভারী বর্ষা নেমে গেছে। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় পয়লা জুন। ঘ্যানঘ্যানে প্যানপেনে টাইপটা অবশ্য এখনও হয়নি। মেঘমেদুর মরসুম হয়, নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জ ছায়ায় ভরে যায় চতুর্দিক। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া ওঠে। তার সঙ্গে থেকে থেকে গরম-ভাপ বেরোয়। মণি কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে, হাসিও শুনলাম হয়েছে। শামুই নাকি ভর্তি করে দিয়েছে নিজে গিয়ে। জুলাই থেকে ক্লাস শুরু হবে। প্রায়ই দেখি বউদির সঙ্গে গুলতানি করতে আসে। যেহেতু কেউ কোনওদিন সেভাবে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়নি, আমি হাসির দিকে চাই না। কথা বলা তো দূরের কথা। মেয়ে-ক্যাংলা ছেলেদের দেখলে আমার কেমন ঘেন্না হয়। আমিও লুকিয়ে-চুরিয়ে ওইরকম বাথরুমে-উঁকি-মারা টাইপ ভাবিসনি বাবা! তা ছাড়া ওরা আমাকে কেন জানি না একটু এড়িয়েই চলে। আমি যখন থাকি না, তখনই আসে। কোনও কোনওদিন হয়তো ট্যুইশন থেকে বাড়ি ফেরবার সময়ে দেখি অন্ধকারে দুটি মেয়ে বেরিয়ে গেল। রিন্টি দরজার চৌকাঠ থেকে আব্দার করল —কালকেও আসবে। আসবে তো?

—দেখি! মণির গলা।

কোনওদিন হয়তো বলবে—রুণুদা ভাল তো!

আমি বলব—তুমি ঠিক আছ তো!

—আমরা কম্পুটার শিখছি। কলেজে আছে। মাইনের বাইরে আর খরচ লাগে না। রুণুদা আমি দুটো ট্যুইশন করছি।

—বাঃ খুব ভাল, আমার অন্ন মারিসনি আবার!

অন্ধকারে হাসির আওয়াজ।

মণি বলে—দেখে দেখে বাচ্চাদের নিচ্ছি তো ওইজন্যেই।

এইচ এস পাশ করবার পর মণিমালার মধ্যে একটা চটুলতা এসেছে যেন। আগে ছিল কেমন গম্ভীর, বিষণ্ণ-বিষণ্ণ, ভীষণ সিরিয়াস, আমার অনেক সময়ে মনে হত বলি—ঈশ্বর সার্কামস্টান্স যাই দিয়ে থাকুন, মগজটা এক্সেলেন্ট দিয়েছেন। অমন রামগরুড় হয়ে থাকিস কেন রে?

তো এখন, রামগরুড় ভাবটা পুরোপুরি কেটে গেছে। চলার ভঙ্গিতে যেন একটা দোলা, একটু ছটফটানি, হাসি। যাক মেয়েটার মনের ভেতর থেকে একটা বিশাল ভার নেমে গেছে। সংসারে হয়তো সামান্য সচ্ছলতাও এসেছে। দীপু যাই তোক হাজার বারোশো কামাচ্ছে। ওর ভাই ভুতো কবে ড্রাইভিং শিখল জানি না, সন্তোষপুরের দিকে কাদের গাড়ি ড্রাইভিং-এর চাকরি পেয়েছে, উপরন্তু একটা থাকার ঘর, সেখানেই থাকে, মনিবের বাড়ি থেকে খাবার পায়, মুক্তারও নিশ্চয় উন্নতি হয়েছে। আজকাল দেখি নিজেও খুব ভুরু-টুরু প্লাক করে ছোট চুলে লক-ফক কেটে ফিটিং সালোয়ার-কামিজ পরে ঘুরে বেড়ায়। ‘লা-বেল’ আজকাল ইউনিফর্ম দিচ্ছে, লাল রঙের। সেটা পরে মাঝে-মাঝে দোকানের বাইরেও বেরোতে দেখেছি। একদিন জিজ্ঞেস করলাম—কোথায় চললি—এই দুপুরে?

একবার মুখ ঝামটা দেবার চেষ্টা করল অবশ্য—তোমার জেনে কী হবে?

—না, তোর এই লাল রঙের ফ্রকটা বেশ। তাই বলছিলাম।

—ইয়ার্কি মারবে না রুণুদা, এটা ফ্রক নয়। ড্রেস।

—ওই হল, আমরা ভেতো বাঙালি, ট্যুইশন-মাস্টার অতসব জানব কোত্থেকে বল! তা তোর যদি কোনও সিক্রেট অ্যাপো-ট্যাপো থাকে তা হলে না-ই বললি।

—বলে আমি বত্রিশ দাঁত বার করে হাসি। মুক্তা বলে, ভাল হবে না কিন্তু।

—এই তো পথে এসেছিস! ‘ভাল হবে না কিন্তু’টা টিপিক্যাল মেয়ে মেয়ে। এবার বোধহয় বলবি—দূর অসভ্য।

মুক্তা রাগতে গিয়ে হেসে ফেলে বলে— বিয়ে বাড়িতে সাজাতে যাচ্ছি। আঙুলে টুসকি মেরে বলল—মালকড়ি আসবে।

চুল ঝাঁটানো থেকে বিয়ে-বাড়িতে সাজাতে যাওয়ায় প্রোমোশন হয়েছে মুক্তামালার। ভাল ভাল। আমারই খালি শুধু যাওয়া-আসা, শুধু স্রোতে ভাসা। একটু-একটু ঈর্ষার হুলও যেন ফুটতে থাকে বুকে। কিছু না অন্তত যদি ঠেলে একটু ওপর দিকে উঠতে পারতাম। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি কতদিন। সেই বাইনোমিয়্যাল থিয়োরি, সেই কুয়েত থেকে পরিশোধিত খনিজ তৈল রপ্তানি হয়। সেই আটাশের থিয়োরেম। সেই সন্ধি-সমাস, সিংগুলার হ্যাভ লিখো না ধন, শব্দটা প্রোনাউনসিয়েশন নয় চাঁদ। সেই লেজার, জার্নাল আর বুক-কীপিং-এর বিরক্তিকর খুঁটিনাটি। একমাত্র দুপুর একটা দুটো নাগাদ বাড়ির ভাত মেরে গুহ প্যালেসের ভূতের বাড়িতে গিয়ে দীপুর সঙ্গে সময়টা ভাল কাটে।

একদিন দীপু বলল, ওরা একদম আসা বন্ধ করে দিল কেন বল তো!

—কারা!

—ওই তোর গুহক মিতা?

—ওহ! ওরা হতাশ হয়ে গেছে।

—শোন রুণু একটা কাজ করবি? তুই তো কিছু করবার জন্যে ছটফট করছিস।

—কী করব বল। নিজের পায়ে কুড়ল মারা ছাড়া আর যা বলবি!

দীপু একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। —নিজের পায়ে কুড়ল মারা কিনা জানি না। কিন্তু কুড়ুল কোথাও একটা আছে। ভয়েস বলছে।

—আবার তোর ভয়েস?

—শিওর ভয়েস। ভয়েস না থাকলে কে আমায় এই ভূতের বাড়িতে আগলে রাখত!

—আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। কী তোর মতলব বল।

—রুণু, গুহমজুমদাররা আসে না, জগাদা ইলেকশন নিয়ে ব্যস্ত। এসব ভাবার আর সময় পাচ্ছে না। চাকলাদার শালা বহোৎ ধড়িবাজ আছে। ও শালা আসে। চারদিক ঘুরে ঘেরে দেখে, ম্লিচ ম্লিচ শব্দ করে। আর চলে যায়। ভয়েস বলছে—পেছনে কিছু আছে। ডিপ, ডিপার, ডিপেস্ট।

—থাকতে পারে। আমরা কী করব?

—তুই সে-দিন বলছিলি না, দেবল গুহ নাকি বলেছে ওর দুই খুড়ো কম্প্রোমাইজ করছে না কিছুতেই! একদিন যাবি খুড়োদের কাছে?

—কী কম্মে? কম্প্রোমাইজ করাতে?

—ধর তাই। আমি ঠিকানাটা জোগাড় করেছি। মতিলাল নেহরু রোড, সাতের দুই।

—যার বিয়ে তার মনে নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই। আমরা কে যে যাব? আমাদের ইন্টারেস্ট কী? কী ক্যাপাসিটিতে যাব? রমেন গুহ কি আমাদের উকিল রেখেছে? না চাকলাদার!

—আহা রাগ করছিস কেন? চলই না। একটু কেসটা শুনে আসব। ধর একটু বুঝিয়ে আসব। কতটা ক্ষতি ওঁদের হচ্ছে। ধর না কেন, চাকলাদারের লোকই সাজলুম। ইন এনি কেস, আমরা তো চাকলাদারের লোকই। ওর কাছেই তো আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

—আমার নয়।

—আহা আজ নয়। একদিন তো ছিল। চল না রুণু। লক্ষ্মীটি, আমার মনটা কেমন করছে। ভয়েস বলছে কিছু কর। কিছু কর!

দীপের পাগলামিতেই সুতরাং এসেছি।

প্রিয়া সিনেমার পাশ দিয়ে ঢুকি। মতিলাল নেহরু মোটামুটি চওড়া রাস্তা। কিন্তু তার থেকে ডালপালা যেগুলো বেরিয়েছে সেগুলো যথেষ্ট সরু। গায়ে গায়ে বাড়ি। অর্থাৎ এই সব পুরনো কলকাতার তলানি। দোতলা তিনতলা বাড়ি সব দাঁড়িয়ে আছে সলিড। ক্ষয় ক্ষতি নেই এমনি সলিড। আমাদের একালের পাঁচ ইঞ্চি দেওয়ালের বাড়িগুলো ভূমিকম্প-টম্প হলে একেবারে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। কিন্তু এসব বাড়ির স্বাস্থ্য টসকাবে না। খুঁজে খুঁজে অবশেষে গেট পাই। সরু গেট, সরু প্রাইভেট গলি। কিছুটা গিয়ে তবে ডানদিকে সদর দরজা সেও তেমন চওড়া নয়। খুঁজে পেতে বেল টিপি। অনেকক্ষণ বাজতে থাকে বেল। কেউ নেই না কি? ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে, এমন সময়ে দরজাটা খুলে গেল। মানে আধখোলা, ওদিকে চেন, একটা রুক্ষ বুড়োটে গলা শোনা গেল— আমরা চাঁদা দিই না। অসময়ে বিরক্ত কোরো না।

আর একটা লেস-রুক্ষ গলা বলল— কোনও কোম্পানির কোনও জিনিস-মিনিস কেনবার ইচ্ছেও আমাদের নেই। বিদেয় কর, বিদেয় কর…

বাপ রে!

আমি বললাম— আমরা আপনাদের মাল্টিস্টোরিড-এর ওখান থেকে আসছি।

—কী দরকার?

—দরকার এপার থেকে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না। ভেতরে যেতে হবে।

—কে পাঠিয়েচে? রমেন? ও সব হবে না। যে টাকা নিইনি সে টাকা দেব না।

—আজ্ঞে না। দীপ্ত টিপিক্যাল ঘটি ভঙ্গিতে বলল—, আমরা ঠিকেদার চাকলাদারের লোক।

—সে তো একটা পাঁঠা।

যাক লোকটা যে একের নম্বরের খচ্চর সেটা এই দুই বুড়ো এখনও বুঝতে পারেনি। পাঁঠা ভেবেই ক্ষান্ত আছে।

যাই হোক, এইবারে দরজা খুলে গেল। অন্ধকার প্যাসেজে একটা ধোঁয়া-কালি মাখানো আবছা বালব জ্বলছে। বাইরে থেকে এসে ভাল করে কিছু দেখা যায় না। এইটুকু দেখলাম যে-বৃদ্ধ দরজা খুললেন তিনি খটখটে রোগা, একটা আধময়লা ফতুয়া আর একরঙা লুঙ্গি পরা, পেছনের দিকে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি হৃষ্টপুষ্ট থপথপে মতো, তাঁর পরনে গামছা, মানে বেঁটেদার সেই অব্যর্থ নিদান— চেড়ি।

বাঁ পাশে একটি দরজার তালা খুলল। ভেতরে টিউব লাইট জ্বলল, পাখা চলল। একটি তক্তপোশ, একটি পড়ার টেবিল আর তিনটি চেয়ার। আচ্ছা কিপটে বুড়ো তো! গুহ মজুমদারদের বাড়ির দুই শরিক। আবার নিঃসন্তান! এসব লোকের আসলে একটা বাতিক হয়ে যায়। টাকা খরচ করবে না, কাউকে দেবে না, পচাবে, আর যখন অক্কা পাবে তখন সেই টাকা নিয়ে ভাইপো, ভাগ্নে ইয়ার বেরাদরদের সঙ্গে আগে মাইকেল যেত, এখন ডিস্কো যাবে। সারা জীবনের সঞ্চিত, ভোগ না-করা ধন দু’-চার বছরে স্রেফ হাওয়া হয়ে যাবে। পাঁঠা আর কাকে বলে!

আমরা আহ্বান ছাড়াই ভেতরে ঢুকি এবং তক্তপোশের ওপর বসি। একটা কেঠো চেয়ারে মুখোমুখি বসে কেঠো বুড়ো। বলে, আগে সেজদাকে আসতে দাও, তারপর কতা হবে।

তা মিনিট কয়েকের মধ্যেই প্রথম বুড়োর মতোই একরঙা লুঙ্গি আর আধময়লা ফতুয়া পরে দ্বিতীয় বুড়োর আবির্ভাব হল। থপ থপ করে তিনি আর একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। সেজদা। যিনি নাকি একটি মাল, কুচুটেমির রাজা— অ্যাকর্ডিং টু দেবল।

ছোটজন বললেন— এবার বলো চাকলাদার কী বলছে।

—এতদিন ধরে বাড়িটা পড়ে রয়েছে। কাজও হতে পারছে না। আর কবে আপনারা ভোগ করবেন দাদু, চাকলাদারের সঙ্গে একটা রফা করে নিতে কী দোষ।

দীপু বেশ গুছিয়ে-গাছিয়ে বলল। পাগলা-খ্যাপা ভাবটা একদম নেই। একটা চাকরি, নিয়মিত চাকরি ও বেতন, সে যত কমই হোক মানুষের মধ্যে কী আমূল পরিবর্তন আনতে পারে তা দীপুকে দেখে বুঝছি। আজকে ও সেই আমার কিনিয়ে দেওয়া চেক শার্ট আর কালো জিনস পরে এসেছে। পায়ে স্ট্র্যাপ দেওয়া স্যান্ডাল। চুল-ফুল তেমন ভাল করে আঁচড়ায়নি। কিন্তু ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলে, চশমায়, কালো ধারালো মুখ দেখাচ্ছে অন্যরকম।

—রফার শত্ত যদি অমনি গলাকাটা হয়, কী করে রফা করব?

—একটু বুঝিয়ে যদি বলেন, —আমি বলি।

—কেন? চাকলাদার, রমেন এরা তোমাদের বলে-কয়ে পাঠায়নি।

—দাদু ওঁরা যা-ই বলুন, কিছু সূক্ষ্ম পয়েন্ট তো আমাদের না জানাও থেকে যেতে পারে! তাই…কথাগুলো দীপে বলল। দীপে!

—সূক্ষ্ম তোমার মাতা! কী? না সিক্সটি পার্সেন্ট ফর্টি পার্সেন্ট ভাগ হয়েছিল, এখন চারটে ফ্ল্যাট কমে গেচে, কার ভাগে কত পড়বে তার ক্যালকুলেশন নতুন করে হবে। তা হোক না! খুব শক্ত অঙ্ক? চার ছয়ে চব্বিশটা ফ্ল্যাট এখন। ন’ খানা ফ্ল্যাট আর কিছু টাকা আমরা পাই। তো সেটা করে দিলেই তো হয়। হচ্চে না কেন!

—কেস এখন সাব-জুডিস তো! জগাদা কেস তুলে না নিলে,… মানে জগাদাকে কিছু কমপেনসেশন দিলেই তো…

—তাই বলো। তোমরা জগা মিত্তিরের লোক। ভাল, জগা টাকা চায়। তা সে-টাকা আমরা দুই বুড়ো দেব কেন? ঘাটের দিকে পা, দেখবার-শোনবার বেলায় কেউ নেই, দেবার বেলায় সেজ-ছোট টাকা বার করবে, কেমন?

—আজ্ঞে সাততলার ফ্ল্যাট বুকিং-এর শেয়ার তো কিছু আপনারাও পেয়েছেন, সেই…

হাঁ হাঁ করে উঠলেন দু’জনে, —চাকলাদার তোমাদের এই বুঝিয়ে পাঠিয়েচে? একটা কানাকড়িও পাইনি! সব ওই রমেন গাপ করেচে। নিজের ভাইপোকে তো আর খচ্চর, গর্ভস্রাব বলে গালাগাল দিতে পারি না। ও থুতু ছুড়লে নিজেরই গায়ে এসে পড়বে। কেমন কি না? ওই হতভাগা সমস্ত সম্পত্তি গ্রাস করবার চেষ্টায় আচে, কী দাদা?

সেজদাদু বললেন— খুবই দুঃখের কতা। বিবাহ করিনি। ভাইপোদের কোলে পিঠে করে আপন সন্তানের ন্যায় মানুষ করিচি। তার এই প্রতিদান।

ছোটদাদু বললেন— মেজদার ফ্যামিলি সিঙ্গাপুরে। মেজদা নেই আর। তার ছেলে-মেয়েরা এখন আধা-সায়েব। কে অস্ট্রেলিয়ায়, কে আমেরিকায় সেটল করেচে। তাদের এই ইন্ডিয়ান রুপি ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাটে কোনও আগ্রহ নেই। লেখাপড়া করে সব কাগজপত্তর রমেন-দেবলকে পাটিয়ে দিয়েচে। আমাদের এক দিদি কোনকাল থেকে দেরাদুনে পোস্টেড, জামাইবাবু মিলিটারিতে ছিলেন। দু’জনেই এখন রিটায়ার্ড। দিদি শয্যাশায়ী। জামাইবাবু তাকে দেখাশুনা করেন। মিলিটারির স্টার পাওয়া লোক ওদের এসব ছেঁদো ফ্ল্যাটে কোনও ইন্টারেস্ট নেই। একটি মাত্র মেয়ে। ডাক্তার। তার বরও ডাক্তার। ইংরেজ সায়েব। তারা লন্ডনের কাচে থাকে। খুঁজেপেতে তাদের কাচ থেকেও দানপত্তর বার করে নিয়েচে। পথের কাঁটা আমরা এই দুই ঘাটের মড়া। ওয়েট করচে। তাই বাড়ির কাজ বন্ধ। সাব-জুডিস না ছাই। কর্পোরেশনে তো ভেঙে দিয়ে গেচে— শুনতে পাই, জগার সমাদান তো হয়ে গেল। আবার সাব-জুডিস কীসের?

আমি বলি— সবটা ভাঙেনি, একটা ভেঙেছে।

—তাই নাকি? তা’লে তো এর মধ্যে আরও কতা আচে! শরীরটা গেচে মাতা তো যায়নি। মিলিটারি অ্যাকাউন্টস-এ চল্লিশ বচর! ঘাসে মুক দিয়ে তো আর চলি

সেজ বললেন, আমি তো পা বাড়িয়ে বসে আচি। একটা জব্বর স্ট্রোক হয়ে গেছে। কিন্তু ওদের জব্দ কেমন করে করতে হয় আমি জানি।

ছোট সতর্ক গলায় বললেন— এ ছোকরা দুটিকে এত কথা বলচ কেন সেজদা! এরা কার লোক তা-ই তো এখনও বুঝতে পারলুম না।

সেজদা বললেন— কতার হাঁড়ি তো তুমিই হাট করে দিলে খোকন। বলো না, বলো না। কিন্তু মুক খুললেই তোমার হলহল গলগল।

দু’জনে ঝগড়া লেগে যায় আর কী!

দীপু উঠে দাঁড়িয়ে বলল— আপনারা ভয় পাবেন না, আমাদের ভুলও বুঝবেন না। আমরা ওখানকার পাড়ার ছেলে। চাকলাদার আমাদের সাইটে সুপারভাইজার রেখেছিল। ভেতরের কথা আমরা কিছুই জানি না। অথচ কতকগুলো ঘটনা ঘটে চলেছে দেখতে পাই যেগুলোর কোনও মানেই হয় না। দেখতে দেখতে মনে হল ইনভেস্টিগেট করি।

—ভাল, তা ইনভেস্টিগেট হল? এখন কাকে রিপোর্ট করবে? চাকলাদারকে না জগা মিত্তিরকে না রমেন গুহকে?

—বললুম তো, কারও সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক নেই। স্বাধীনভাবে জিনিসটা বোঝবার-জানবার চেষ্টা করছি।

—করে কী করবে?

—হয়তো কিছু করব, হয়তো কিছুই করব না।

—শুদু জানার আহ্লাদেই আটখানা, না কী? —ছোট শ্লেষের গলায় বললেন।

দেখুন দাদু— এবার আমি আসরে নামি— আপনারা তো পাড়ায় থাকলেও একটু স্বতন্ত্র থাকতেন। পাড়ার ছেলেরাও একটা শক্তি! একটা ফোর্স! যদি আর একটু কম রিজিড হতেন, মেলা-মেশায় আর একটু— মানে উদার আর কী… তা হলে পাড়ার ছেলেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আপনাদের হেল্‌প্‌ করত!

—বটে! কোন পাড়ার ছেলের সঙ্গে দাদুগিরি করব বল তো! ওখানে তো সব হয় গুণ্ডা, আর নয় বাঙাল, রিফিউজি।

আমি বলি— তাই? আমিও রিফিউজি দাদু, এখন আর নই অবশ্য, উদ্বাস্তুদের ছেলে, আর এই দীপু এ কিন্তু কোনওকালেই বাংলাদেশ থেকে আসেনি, তবু উদ্বাস্তু, এরকম, মানে আমাদেরই মতো আরও অনেক আছে।

—রাগ-ঝাল করো না বাপু। রেখে-ঢেকে কথা বলতে আর এ বয়সে পারি না।

—আচ্ছা আসি।

প্রণাম ট্রনাম করি না।

বাইরে বেরিয়ে বলি— কথা বলে গলা শুকিয়ে গেছে, আয় একটু ঠাণ্ডা খাই। দীপু ব্ল্যাঙ্ক চোখে পা বাড়াল। ওর চোখে আবার সেই শূন্যতা। কী করে একই মানুষের চোখ এভাবে রং পাল্টায়, তল পাল্টায় এ এক অষ্টম আশ্চর্য! একটু আগেই তো আপনি আজ্ঞে করে দিব্যি দুই বুড়োর কাছ থেকে কথা বার করে নিল। এক্ষুনি আবার দেখছি চোখে যেন চোখ নেই। বা চোখে দীপু নেই। আমিও ন্যাচার‍্যালি নেই। ও একা। কী ধরনের অন্যমনস্কতা এটা? সারা পৃথিবীর সমস্ত লোকের থেকে যেন ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বা সব মানুষেরই মাঝে মাঝে যে একাকিত্ববোধ হয়, সেই সমস্ত একাকিত্ব ওর চোখ থেকে দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে।

দু’জনে দুটো ঠাণ্ডা খাই। যান্ত্রিকভাবে ও স্ট্র চুষে যায়।

—দীপু পান খাবি? যতটা না পানের লোভে তার চেয়ে বেশি ওকে কথায় ফেরাতে আমি বলি। কোনও জবাব আসে না।

—দীপু? এই দীপু!

—প্রথম যেদিন রমেন গুহ আর তার ছেলে সাইটে এসেছিল, তোকে কী বলেছিলুম মনে আছে?

—না, বিরক্ত হয়েছিলি।

—হ্যাঁ, কেন না স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম কিনকিন করে বেল বাজছে। আজ কথাটার সত্যতা প্রমাণ হল। হল তো? ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না এমনি ভাব! কথা বলে, চেহারা দেখে কেউ বুঝবে আসলে কত ধড়িবাজ, কত নিষ্ঠুর? দে আর ওয়েটিং ফর দি ডেথ অব দেয়ার গ্র্যান্ডফাদারস। ওই দু’জনই শুধু পথের কাঁটা।

আমারও মনের মধ্যে প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছিল। যখন গদা মাফিয়া হয়ে গেল, শামু গুণ্ডা হয়ে গেল তখনও লেগেছিল। গুহদের বেলায় তার সঙ্গে মিশে ছিল বিস্ময়। যাদের টাকা পয়সার অভাব নেই, তারা কেন জোচ্চুরি করবে? পরক্ষণেই মনে হয়— কী আশ্চর্য! চুরি-জোচ্চুরির কি ধনী-দরিদ্র আছে। কত ধনী লোকই তো শরিকি বিবাদ করে মরছে আরও দুটো ঘর, আরও চাট্টি ইটের জন্য, যাদেরই অনেক থাকে, তারাই তো প্যাঁচ কষে, কীভাবে অন্যকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা যায়। সারা পৃথিবী জুড়েই তো এই চলছে! জার্মানি ইহুদিদের বঞ্চিত করেছিল, ইহুদিরা প্যালেস্তানীয়দের বঞ্চিত করছে। জাপান দীর্ঘদিন চিনকে বঞ্চিত করেছে, চিন বঞ্চিত করছে তিব্বতিদের। আমেরিকা লেগেছে ইরাকের পেছনে, ইরাক লেগেছিল কুয়েতের পেছনে, রক্তনদী বইয়ে ভারত টুকরো করে পাকিস্তান হল, আবার রক্তসাগর বইয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হল। নেহরু বললেন ভারতের গদি চাই, গদি পেয়ে বললেন ইন্টারন্যাশন্যাল ফিগার হওয়া চাই, ইন্টারন্যাশন্যাল ফিগার হয়ে বললেন ডাইনাস্টি চাই। এইভাবে খুড়োর কল অদৃশ্য সুতো দিয়ে পৃথিবীর তাবৎ দেশকে, পার্টিকে, মানুষকে টানছে। দেবলটা আমার চেয়ে সামান্য কিছু বড়, আমারই মতো কমার্সের ছাত্র। এম-কমটা করেছে অবশ্য। বাড়ির অবস্থা ভাল। চার্টার্ড করছে, সেও দুই নিঃসন্তান বৃদ্ধের সম্পত্তি ছলে-বলে-কৌশলে হাতাতে চায়? এমনিই তো পেত। পরিবারহীন দুই বৃদ্ধের হাড়ির হাল তো দেখে এলাম। ওঁদের দেখা-শোনা করতে কতটুকু শ্রম, সময় খরচ হত ওদের?

দু’জনে একরকম চুপচাপ বাড়ি ফিরি। দীপু একেবারে অপরিচিত। আমার মনটা ভীষণ খারাপ। এর চেয়ে দেবলরা ভাল আর ওর খুড়োরা খারাপ বেরোলে আমি খুশি হতাম। কিংবা হয়তো রমেন গুহ প্যাঁচগুলো কষছেন। দেবল জানে না। আমাদের বয়সি একটা ছেলে, যে এখনও ছাত্র, সে তার দাদুদের ঠকাবার জন্যে বাবার পাতা জালের খুঁটো ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কেমন যেন ভাবা যায় না। আমার চোখে খালি ভেসে উঠছে ওর কফি-হাউজে দেখা মুখটা। আমাকে দেখেই কেমন পাঙাশ মতো হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য নিজেকে সামলে নেয়। কিন্তু ওই পাঙাশ হয়ে যাওয়াটা অপরাধীর চিহ্ন। ও আমাকে কফি হাউজে এক্সপেক্ট করেনি। বাড়িটা যে কেন এগোচ্ছে না, তার কতটা আমি জেনে ফেলেছি, এটা ও বুঝতে পারছিল না। ওর বাবা পাকা খেলুড়ি। কিন্তু দেবল এখনও কাঁচা—এই ধরা পড়লাম, ইস ধরা পড়লে এরা কী ভাববে— এই জাতীয় সংকোচ ওর এখনও আছে। আর বছর পাঁচেকের মধ্যে ঘাগু হয়ে যাবে। ঘাগু এবং ঘুঘু।

বাস থেকে নেমে দীপু নিচু গলায় বলল— এতক্ষণ কেন কথা বলছিলুম না বল তো!

—কেন আর! ভয়েস শুনছিলি!

—অত সোজা নয় রে রুণু। ভয়েস আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা কিনকিন শোনাবে অত তালেবর আমি এখনও হইনি।

—তা হলে?

—আরে বুঝতে পারছিস না? শত্রু তো চতুর্দিকে। জগাদা, চাকলাদার রমেন গুহ, শামু… সব্বাই তো জড়িয়ে আছে! কে কার লোক, কোথায় কখন লোক লাগিয়ে রেখেছে— কে বলতে পারে? শুনে ফেললে? তুই কি মনে করেছিস মতিলাল নেহরুতে ওদের কোনও স্পাই নেই? আমাকে কেউ নজরে রাখছে না?

—সর্বনাশ। এ তো খেপবার দিকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল! এতদিন শুধু ভয়েস ছিল। এখন আবার পেছনে স্পাই সন্দেহ শুরু হয়েছে। আমার বি কম ক্লাসের এক বন্ধুর হয়েছিল বলেই আমি জানি। —জানো রণধীর, সব সময়ে কেউ আমাকে ফলো করে যাচ্ছে।

—সে কী? কেন?

—আরে আমার নোটস, আমার মস্তিষ্কের ঘিলু, এসব তো সুপার ক্লাস। খবরটা চাউর হয়ে গেছে, ব্যাস, লোক লাগাও স্টার্ট করে গেছে।

—শোনো অতনু ওসব ছাড়ো। পড়াশোনা একটু কম করো তো! অত পড়লে মাথা গরম হয়ে যাবে। ভাল করে মাথায় তেল ঘষে স্নান করবে।

—পড়াশোনা কে করছে? ওসব আমার মগজের মাইক্রো চিপস-এ কবে ভরা হয়ে গেছে। ফটোগ্রাফিক মেমারি কথাটা শুনেছ? হরিনাথ দে-র ছিল। ওই মাইক্রো চিপসগুলোই মুশকিল বাধিয়েছে। নোটসগুলো না হয় দিয়ে দিলুম। কিন্তু ওরা তো তাতে থামবে না, মগজ ঘেঁটে মাইক্রো-চিপসগুলো নিয়ে যাবে।

একে বলে প্যারানইয়া। দীপুকে চাকরি দিয়ে তো তার খুব উপকার করেছি দেখছি!

—দীপু প্লিজ।

—কেন? কী হল?

—বাজে বকিস না।

—বাজে কীরে? এখানে এসে আশেপাশে কেউ নেই দেখে মুখ খুললুম। তুই-ই বল— এত বড় একটা ফাঁদ যারা ফেঁদেছে, জগাদাকে দিয়ে অবজেকশন, ইনজাংশন, কর্পোরেশনের বাড়ি ভাঙা, আমাদের, পাড়ার বেকার ছেলেদের একগাদা পয়সার লোভ দেখিয়ে আধ-খাওয়া বাড়ি পাহারায় রাখা, শামুর মতো নামকরা গুণ্ডাকে রাত-পাহারায় রাখা, তারা তাদের খুড়োদের ওপর নজর রাখবে না? আমরা ওখানে গেলে আমাদের পেছনেও স্পাই লাগাবে না!

—তা হলে গেলি কেন? এতই যদি জানিস! সেই বলে না, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তাঁতির এঁড়ে গোরু কিনে।

—রুণু। তোকে কেউ ভেল্টু বানাচ্ছে, বানিয়ে দাবার বোড়ের মতো ব্যবহার করছে। তুই চুপ করে থাকবি? রাজা-মন্ত্রীর দান উল্টে দেবার চেষ্টা করবি না? শ্‌শালা। দীপন চক্কোত্তির সঙ্গে মাজাকি!

আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করি— দ্যাখ দীপু, যা জেনেছিস, জেনেছিস। ওই দাদুরাও তো এদের জব্দ করবে বলছে। তোর আমার আর এর ভেতরে মাথা গলাবার দরকার নেই। আফটার অল— আমরা কর্পোরেশনের ক্যানডিডেট কি পেছনের বাড়ির অংশীদার নই। এ বাড়ির শরিকও নই। প্রোমোটার-ঠিকেদার কিচ্ছু নই। আমাদের কোনও রাইট, কোনও স্টেটাসই নেই নাক গলাবার। এক কাজ কর, নেহাতই যদি ঘেন্না করে, চাকরিটা ছেড়ে দে। সাড়ে বারোশো কি একটা টাকা হল না কি? তোর ভাই ড্রাইভারি করে এর চেয়ে বেশি রোজগার করছে।

অন্ধকারে দীপু হাসল, বলল— তুই কি ভাবছিস চাকলাদার এখন আমায় অমনি অমনি ছেড়ে দেবে? সব জেনে গেছি না? এখন ছাড়তে চাইলে, লোক দিয়ে আমায় খুন করিয়ে দেবে।

আমি শিউরে উঠি।

—একেবারে খুন? নাঃ দীপু তোর একটা খোপড়ি আছে বটে!

—শোন রুণু, হঠাৎ একদিন শুনবি নির্মীয়মাণ গুহ প্যালেসের ওপর থেকে দীপন চক্কোত্তি ঝাঁপ খেয়েছে। পাড়ার সবাই বলবে— হ্যাঁ এরকম একটা ফ্যামিলি-হিস্ট্রি ওদের আছে বটে। চাকলাদার তোকে দিয়ে বলাবে— হ্যাঁ দীপুটা ডিপ্রেশনে ভুগত, আধ-পাগলা মতো ছিল, কখন কী করবে, কী বলবে ঠিক নেই। বাস, এস্ট্যাব্লিশড হয়ে যাবে এটা স্রেফ আত্মহত্যা। বাবা ছারপোকা মারার ওষুধ খেয়েছিল। ছেলে সাততলা থেকে ঝাঁপ খেয়েছে। কারণ এক। ডিপ্রেশন। রোজগার না থাকার ডিপ্রেশন।

আমার হঠাৎ কীরকম ভয় ধরে যায়। দীপু যা বলছে তার মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আমি, আমিই ওর সর্বনাশের উপলক্ষ হতে যাচ্ছি। যদি চাকরিটা ওর সঙ্গে ভাগ করে না নিতাম, তা হলে এই মতিলাল নেহরুর ঠিকানা বার করা, সেখানে যাওয়া, দাদুদের সঙ্গে কথা বলা এসব আমার মাথাতেই আসত না। বসতে বলেছে বসেছি। কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, ঠিক আছে বাবা, অল্প টাকায় করেছি। পোষাচ্ছে না, ছেড়ে দিচ্ছি। মিটে গেল। আমার এই চরিত্র। কিন্তু দীপুর চরিত্র আমার থেকে আলাদা। এটা আমি বুঝিনি।

আমি বলি— যথেষ্ট করেছিস। যা জানার সব জানা হয়ে গেছে। ফার্দার আর কিচ্ছু করতে যাবি না দীপু। অন গড।

—খুব ঘাবড়েছিস, না? ভাবছিস দীপুটাকে এই বিপদের মুখে তুই-ই ঠেলে দিলি! ভাগাভাগির চাকরিটাতে দীপুকে না ডাকলেই হত। এত দূর যাবার শখ তোর নেই।

আমার কেমন গা-ছমছম করতে লাগল। অবিকল যা ভাবছিলাম সেগুলোই অবলীলায় বলে গেল দীপু।

আমি রাগ দেখাই— দীপু আমি সিরিয়াসলি বলছি, ইটস নান অব ইয়োর বিজনেস। তুই এ সবের মধ্যে থাকিস না। তোর মা রয়েছেন, বোনেরা, ভাই, বাবা নেই, একটা অসহায় স্ট্রাগলিং পরিবার। এগুলো ভুলিস না। ভুলতে নেই।

—ঠিক —দীপু বলল, আমরা এভাবেই ভাবি। ওরা মরছে, আমি তো ঠিক আছি। ওরা তলিয়ে যাচ্ছে, আমি তো ভেসে আছি, ওরা চুরি-জোচ্চুরি করছে আমি তো করছি না। এ ভাবেই…তবে একটা কথা ঠিক বললি না দীপু, আমাদের চক্কোত্তি ফ্যামিলি স্ট্রাগলিং হতে পারে, কিন্তু অসহায় নয়। সব্বাই, ইচ অ্যান্ড এভরিওয়ান সেন্ট পার্সেন্ট ইন্ডিপেন্ডেন্ট। এক সময়ে আমরা সবাই বাবার ওপর ভূত-পেতনির মতো ভর করেছিলুম। মানুষটা পারল না। ছারপোকা মারার ওষুধ খেল। তার পর থেকে আমরা সবাই সামহাউ ব্যাপারটা বুঝে গেছি, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি মরে গেলে ওদের কারও একটুও অসুবিধে হবে না। আমরা সব্বাই মরে গেলে এমন কি মা-ও নিজেরটা ঠিক চালিয়ে নিতে পারবে।

—উফ, দীপু তুই থামবি?

—নাউ ইউ আর রিভোল্টিং। কিন্তু রুণু আমি শুধু টিকে থাকার কথা বলেছি, যেটা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্ট্রং ইনস্টিংকট। তার মানে দুঃখ, বেদনা, দয়া-মায়া এসব নেই তা বলছি না। আমরা, চক্কোত্তি বাড়ির কেউ অসহায় না। আমিও না। এটুকুই। যাঃ বাড়ি যা।

আমার পথ দীপুর পথের থেকে অন্য দিকে বেঁকে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress