Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিমির বিদার || Bani Basu » Page 11

তিমির বিদার || Bani Basu

প্রায়ই দেখি মণির সঙ্গে একটি অচেনা মেয়ে আমাদের বাড়ি ঢুকছে। কিংবা বেরোচ্ছে। মণি একটু হাসে—বউদির সঙ্গে দরকার ছিল। ভাল রে ভাল। আমি বরাবর তোর অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা দেখিয়ে দিচ্ছি। আমার মাধ্যমিকের বিদ্যেয় যেটুকু কুলোয় সায়েন্সও। হতে পারিস তুই ভাল মেয়ে, চট করে বুঝে নিস। আজকাল আর দরকার হচ্ছে না। তা বলে ‘বউদির সঙ্গে দরকার ছিল’ বলে মুখ মুছে চলে যাবি? অন্য মেয়েটি কেমন মুখ ফিরিয়ে থাকে, খুব চকচকে কালো। কিন্তু চুলের বেণী ছাড়া মাথার আর কোনও অংশ দৃশ্যমান হয় না। যাক গে বাবা, যা করছে করুক। আমার কী? ঘাড় থেকে নামলে আমি বাঁচি, বিনি পয়সার টিউশনি যত!

বউদিকে বললাম—আজকাল কোচিং ধরেছ না কি?

—বাঃ পয়সার দরকার না? বাড়ির একজন মেম্বার যদি শাশ্বত বেকার হয়।

—আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে, তবে এ তো পয়সা-দেওয়া পার্টি নয়?

—মহানুভবতার কি মনোপলি নিয়েছ না কি?

যাব্বাবা, একবার বলছে পয়সার দরকার কোচিং করছে আরেকবার বলছে মহানুভবতার কেস। মহিলা বলতে চায়টা কী! এত কমপ্লিকেটেড এই মহিলা— কোনটা এর ফাজলামি, আর কোনটা সিরিয়াস আজও বুঝতে পারি না। ‘শাশ্বত, বেকার’ অন্য যে কোনও বউদির মুখে শুনলে যে কোনও বেকার দেবর রাগে খাওয়া-দাওয়া পরিত্যাগ করত। উল্টে দু’কথা শুনিয়ে দিত। আমার এই বউদিটি কিন্তু এই সব টার্ম খুব অভিসন্ধিমূলক ভাবে ব্যবহার করে। আমাকে এইভাবে গারাজে সুধা স্টোর্সের দিকে ও নিরন্তর ঠেলে। পরিষ্কার বুঝতে পারি। অফারটা নিচ্ছি না বলে ওর সমূহ দুশ্চিন্তা, আপত্তিও।

আরেকটু সন্ধে হলে রিন্টিকে নিয়ে বেরিয়েছি। আজ টুইশনি নেই। অনায়াসে ছেলেটাকে নিয়ে দু’-এক চক্কর ঘুরে আসা যায়। রিন্টিকে নিয়ে প্রবলেম হল, বেরোলেই কিছু না কিছু একটা ওর চাই। ওর ধারণা কাকা মানেই দোকানে যাওয়া, দোকানে যাওয়া মানেই ওর ধনী কাকার পকেট থেকে মালকড়ি বেরোবে, এবং ওর কিছু প্রাপ্তিযোগ হবে। দোকানপাতি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? বেরিয়ে এক চক্কর গিয়েছি কি না গিয়েছি দেখি পুলিশে পুলিশ। পিল পিল পিল করে পুলিশ বেরোচ্ছে। আমি শাঁ করে কেটে বেরিয়ে যাই, বড় রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়েছি, দেখি বেঁটেদা আসছে। আমি সাইকেল থামাই। —বেঁটেদা ও বেঁটেদা অত পুলিশ কেন গো এ দিকটায়?

—শনিতলায় বোধয় ওদের আর ঘুরতে ইচ্ছে করছে না। বুঝলি না? তাই এ দিক ও দিক রোঁদে বেরিয়েছে।

—নাঃ একে নিয়ে পারা যাবে না।

—তোমার বেওসা কেমন চলছে?

—চলে যাচ্ছে, একদিন আসিস, ভ্যারাইটি বাড়িয়েছি।

—যেমন?

—এই ধর সেপ্‌টিপিন, পাতলুনে লাগাবার দড়ি, কাপড় শুকুতে দেবার কিলিপ, গোলাপখাস আম…..

—যাব্বাবা সেপটিপিনের সঙ্গে গোলাপখাস আম?

—তাতে কী হয়েছে! তোরা এই জাতি-বিভেদটা মোটে ভুলতে পারিস না। আরে দুটোই তো মানুষের দরকার, তাই না? তা ছাড়া গোলাপখাস আমের বন্ন দেখেছিস তো? টুকটুক করছে একবারে! দেখে লোকের অ্যাটাক হবে, তা’ পরে কাছে এসে দেখবে—শুধু তো আম নয়, পাতলুনের দড়ি, কোমরের গামছা, সেপটিপিন স-ব রয়েছে। ওয়ান ডোর পলিসি যাকে বলে। এক দিন আয় না, সিগ্রেটও রাখছি, তবে বাক্সের মধ্যে। নইলে নেতিয়ে যায়।

বেঁটেদার খুব তাড়া, সে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যায় তুরতুরিয়ে।

রিন্টি জিজ্ঞেস করে— কাকু বেঁটেদা ছোট অথচ বড় কেন?

—ওই রকমই। তুই যেমন লক্ষ্মী অথচ দুষ্টুও।

রিন্টি কী বলতে যাচ্ছিল। নিমকি-শিমকি দুই সুন্দরী দেখি সন্ধেবেলার সাজ, হাওয়াই শাড়ি, আর খড়ির মতো পাউডার, কাজল, রুজ, লিপস্টিক মেখে বেরিয়ে পড়েছে।

—রিন্টিবাবু। রিন্টিবাবু—দুই বোনে দাঁড়িয়ে গেল। ভ্যালা জ্বালা। ওদের বাচ্চা-প্রেমে বিস্তর খাদ আছে—আমি বুঝতে পারি। পেরেও কিছু করতে পারি না।

রিন্টি বলে—শিমকিদি চারদিকে এত পুলিশ ঘুরছে কেন? পাড়ায় চোর ঢুকেছে না কি?

নিমকি বললে—তুমি জানো না বুঝি? মহাজনদের বাড়ির কে একজন গায়েব হয়ে গেছে। সক্কাল থেকে!

রিন্টি গায়েব মানে জানে না, কিন্তু জিজ্ঞেস করতেও ওর ইগোতে লাগে। ও প্রাণপণে বোঝাবার চেষ্টা করছে গায়েব মানে মৃত্যু না খুন। মৃত্যুতে পুলিশ আসার কথা নয়। তবে বোধহয় খুন।

আমি অবাক।—সত্যি? ঠিক জানেন?

দুই বোনে এ এদিক থেকে ও ওদিক থেকে আঙুলে শাড়ির আঁচল পাকিয়ে, সারা শরীরে রবিনা ট্যান্ডনের মতো ঢেউ-ফেউ জাগিয়ে বললে—আপনি জানেন না? সকালের দিকে ওরা চুপচাপ ছিল, কাউকে খবর দেয়নি। বোধয় নিজেরাই খোঁজ খবর করছিল, এখন…..

আমি আর দাঁড়াই না। শাঁ শাঁ করে সাইকেল বাই। ব্যাপারখানা কী? কে গায়েব হল? মহাজনদের বাড়ি আমাদের বাড়ির পেছন দিকে। কিন্তু এনট্রান্স অন্য রাস্তা দিয়ে। দুর্গের মতো বাড়ি। ছাতে কোনওদিন কাউকে উঠতে দেখিনি। কাজের লোকেদের ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। কিন্তু পরিবারের লোকেরা কালো কাচঅলা গাড়ি ছাড়া বিশেষ বেরোয় না। তিন খানা গাড়ি ওদের গারাজে। কিছু দূরে ডাক্তার আনোয়ারের গারাজেও ওদের একখানা জগদ্দল টয়োটা স্টেশন ওয়াগন আছে। ব্যাপারখানা কী দেখতে হচ্ছে তো! কাকে সেফলি ধরা যায়। দীপুকে? সে-পাগলাকে এখন কোথায় পাব? জগাদাকে? সে আজকাল খুব ইমপর্ট্যান্ট লোক হয়ে গেছে। ওই বাড়ি ভাঙানোর পর থেকে। পার্টিতে তার খুব কদর, আর স্লিপিং নেই বেশ জাগিং জাগিং একটা ভাব এসেছে। সব সময়ে জগাদাদের পার্টি অফিসে গুচ্ছের লোক। বিশুদাকে সন্ধেবেলা পাওয়া যায় না। দুষ্ট লোকে বলে বিশুদা সন্ধেবেলায় আর স্বজ্ঞানে থাকে না। পুরো রঙিন স্বপ্ন-দেখা ভাবুক গোছের হয়ে যায়। এই সময়ে যদি কেউ বিশেষ ক্ষমতা-সূত্রে বিশুদার দেখা পায়ও বিশুদা তাকে রঙিন ভারতবর্ষের সূত্রাবলি বোঝাতে থাকে। এক নম্বর স্বাস্থ্য, দু’নম্বর শিক্ষা, তিন নম্বর খাদ্য, চার নম্বর জন্ম-নিয়ন্ত্রণ, পাঁচ নম্বর বেকার, ছ’ নম্বর জবরদখল উচ্ছেদ ও পুনর্বাসন, সাত নম্বর রাস্তাঘাট পুকুর-খাল-বিল নদী-সমুদ্দুর। আট নম্বর—ডিফেন্স, ন’ নম্বর….। নম্বরের নাকি আর শেষ থাকে না, ইনফিনিট সিরিজ। সব বিশুদা করে দেবে, একবার ওকে পেধান মন্ত্রী করে দাও তোমরা, বাস। এই সামান্য খবর জানবার জন্যে নিতাইকাকার কাছে অদ্দূরে যাবারও কোনও মানে হয় না। সে এম পি মানুষ কখন দিল্লিতে থাকে, কখন এখানে থাকে তারই নেই ঠিক। তারপর অবসর সময়ে, নেই অবসর, তবু যেটুকু থাকে, বাথরুম, ভোজন, শয়ন, স্বপন…সব সময়েই নিতাইকাকা জ্বালাময়ী ভাষণ অভ্যেস করে যায়। তার জ্বালাময়ীর জন্যে তার বিশেষ সুখ্যাতি। পার্লামেন্টের অধিবেশন চলার সময়ে টি ভি খুলে একটু ধৈর্য ধরে বসলেই নিতাইকাকার সংক্ষিপ্ত জ্বালাময়ী শোনা যায়।

দীপু এখন আমার বন্ধুও বটে, কলিগও বটে। দু’জনেই চাকলাদারের টেম্পোরারি জব করছি মন-প্রাণ দিয়ে। দীপুর বাড়ি যাই।

—দীপু, দীপু-উ!

—কে?—মাসিমা বেরিয়ে আসেন।

—দীপু নেই?—বলেই খেয়াল হয় আরে, মাসিমাই তো মহাজনদের হাঁড়ির খবর জানবেন!

—দীপু কি কোনওদিন রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরে বাবা!

—মাসিমা, মহাজনদের বাড়ি কী হয়েছে? খুব পুলিশ দেখছি?

—মহাজনদের বাড়ি? পুলিশ? কী হয়েছে? আমি জানি না তো!

—আপনি আজ সকালে যাননি?

—হ্যাঁ-অ্যা। বারোটা নাগাদ আমার কাজ হয়ে গেছে তারপরই চলে এসেছি।

—তার মানে আপনি আসার পর হয়েছে ব্যাপারটা। কেউ অপহৃত হয়েছে শুনতে পাচ্ছি। কে, কী বৃত্তান্ত, কিছুই জানি না।

—বলো কী? পুলিশ! পুলিশ পর্যন্ত এসেছে?

এই সময়ে ধূলিধূসরিত দীপুকে দূর থেকে আসতে দেখতে পেলাম।

আমাকে দেখে দীপু থমকে গেল। তারপরই অবশ্য মায়ের দিকে ফিরে কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি বললাম মাসিমা কিছু জানেন না, সকালে কাজ সেরে ফিরে এসেছেন। তখনও সব নর্ম্যাল।

দীপু বললে—মহেন্দ্র হাপিশ। ডায়মন্ডহারবার থেকে ফেরবার পথে তারাতলা রোডে কোথায় কাছি দিয়ে গাড়ি আটকেছে। মহেন্দ্রকে কালো অ্যামবাসাডর তুলে নিয়ে গেছে, ড্রাইভারের কবজিতে গুলি, গাড়িতেও দু’ চারটে ছ্যাঁদা। ওই লান্সারটা রে।

ডায়মন্ডহারবারে ওদের ফ্যাকটরি। শো-রুম একটা হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটের কাছে, থিয়েটার রোডে, আর একটা শুনেছি দমদম ক্যানটনমেন্টের কাছাকাছি। সল্ট লেকে আর একটা তৈরি হচ্ছে।

দীপুর মা বললেন—প্রতিদিন হয় মহেন্দ্র নয় জগদিন্দ্র ফ্যাক্‌টরি যায়। ওদের জন্যে কত যত্ন করে লাঞ্চ প্যাক করে দিই। জগদিন্দ্রর আবার ব্লাড সুগার, তার খাবার-দাবারে ভীষণ ধরা কাট। মহেন্দ্রর এদিকে ভাল মন্দ না হলে চলে না। আজই তো ফিশ তন্দুরি, স্যালাড, মেয়নেজ দিয়ে স্যান্ডউইচ আর চকলেট পুডিং করে দিয়ে এসেছি। ফ্লাসকে কফি। বাইরে ওরা জলটা পর্যন্ত খায় না।

আমরা তিনজনেই বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর দীপু বলে; সমানে একটা ডেঞ্জার সিগন্যাল পাই। সমানে। যেন ওঁ-ওঁ করে একটা সাইরেন কোথাও বেজে উঠেই থেমে গেল। একটা লাল আলো দব্‌দব্‌ করে জ্বলার শব্দ। কিন্তু সেটা যে এই রকম একটা ব্যাপার হবে তা তো আমি ঘুণাক্ষরেও…নাঃ, রুণু, ভয়েসটা আমাকে বিট্রে করছে, না আমিই ভয়েসটাকে বিট্রে করছি বুঝতে পারছি না রে।

আমার এত বিরক্তি ধরে যায় যে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরতে উদ্যত হই। মাসিমা হঠাৎ একটু ব্যস্ত হয়ে বলেন—রুণু এক মিনিট। ভেতর থেকে উনি প্লেটে করে কয়েকটা নারকোল নাড়ু নিয়ে আসেন। রিন্টিকে কীরকম আনমনাভাবে আদর করে বলেন—আমাদের বাড়ি প্রথম এলে খোকন, মিষ্টিমুখ করবে না? রিন্টি আমার দিকে চায়। আমি জানি ও নারকোল নাড়ু ভীষণ ভালবাসে। আমি ঘাড় নাড়ি। ও তৎক্ষণাৎ দুটো তুলে নেয়। একটা মুখে পুরে দেয়। মাসিমা বলেন—রুণু তুমি দুটো নাও। আমি বলি —‘আমার একদম ইচ্ছে করছে না পিসিমা, প্লিজ।’ —‘আচ্ছা একটা, অন্তত একটা, মণি এসে খুব রাগ করবে নইলে আমার ওপর’—কী আর করা! আমি একটা তুলে নিয়ে মুখে ফেলি। আর সঙ্গে সঙ্গে এক অবর্ণনীয় সুস্বাদে আমার মুখের ভেতরটা ভরে যায়। একে কি নারকোল নাড়ু বলে? এরকম নারকোল নাড়ু আমি জীবনেও কখনও খাইনি। অজান্তেই আমার হাত চলে গেছে প্লেটের দিকে। আর একটা তুলে আমি দীপুর মুখের ভেতর ঠেসে দিই। চারজনের মুখেই একটা আলগা হাসি এসে যায়। দীপু বোধহয় আমার জিভের উল্লাস পড়তে পারে। বলে—মা তো এইরকমই সব খাবার-দাবার বানায়। তবে বামনী তো সব সময়ে জিনিসপত্তর পায় না। মাঝে মাঝে জঙ্গলের বাঘ বামনীর নাড়ু খেতে চেয়ে দোকানে দোকানে হুড়ুম হুড়ুম করে পড়ে জিনিস এনে দেয়, সে গল্প মনে আছে। তো?

আমি বলি—মাসিমা, আপনি আর আমি একটা কেটারিং বিজনেস খুলি চলুন। হ্যাঁ সাবধানে থাকবেন, ওদের বাড়িতে সবাইকার ওপর এখন পুলিশ চড়াও হবে, ঝামেলা করবে।

মাসিমা নিঃশব্দে ঘাড় নাড়েন। আমি আর এগোই না। ফিরতি পথ ধরি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress