Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিন সিংহ ধান খায় || Samaresh Majumdar

তিন সিংহ ধান খায় || Samaresh Majumdar

প্রথম দর্শনে লোকটিকে সন্ন্যাসী বলিয়া মনে হইলেও মদনমোহন তাহার বাম হস্তের ঘড়িটিকে লক্ষ করিয়া ধারণা পরিবর্তন করিল। সন্ন্যাসীরা ঘড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। যদিও লোকটির পরনে রক্তাম্বর আলখাল্লা বাবরি চুল এবং শ্মশ্রুল মুখ কিন্তু মদনমোহনকে লক্ষ করিয়া প্রসন্ন হাসি তাহার অধরে খেলিয়া গেল।

এখন ঊষাকাল। সূর্যদেব ভালো করিয়া উদিত হন নাই। আধুলি গ্রামের মানুষজনের আলস্য ভাঙে নাই। এইসময় চাষবাস হয় না। বৃষ্টি না হওয়ায় পথ শুষ্ক। মদনমোহন এই অপরিচিত মূর্তিটিকে দূর হইতে দেখিয়ে অবাক হইতেছিল। কারণ শহর অন্তত আড়াইক্রোশ দূরে। এই লোকটি কী উদ্দেশ্যে কাঁধে ঝোলা লইয়া আধুলিতে আগমন করিল? কিন্তু হাসির বিপক্ষে সৌজন্য দেখানোই যুক্তিযুক্ত। মদনমোহন বিনীত গলায় জিজ্ঞাসা করিল, কিছু বলবেন?

লোকটি আবার হাসিল। বড় মধুর সে হাসি। তারপর উদাত্ত কণ্ঠে কহিল, আমি বলার কে! বলবেন তিনি যিনি চোখ দিয়েছেন দেখবার, মুখ দিয়েছেন বলবার, কান দিয়েছেন শুনবার–আর মন দিয়েছেন, মন দিয়েছেন কেন বলো তো?

মদনমোহনের কৌতুকবোধ হইতেছিল। সে রহস্য করিতে কহিল, বুঝবার।

সঙ্গে-সঙ্গে লোকটি খুশিতে আটখানা হইল, সাবাস! বুঝবার! বোঝ হেরসিকজন যে জানো যেমন। তা ভাইটির নাম কী?

মদনমোহন বিশ্বাস।

চমৎকার নাম। কী করা হয়?

এই বিষয়ে মদনমোহনের কিঞ্চিৎ গর্ব আছে। আধুলি গ্রামের অধিকাংশই ভাগচাষি। একমাত্র সে–শহরে নিত্য যাতায়াত করে, কারণ সরকারি আপিসের পিওনের চাকরি পাইবার সৌভাগ্য

তাহার হইয়াছে। সে উত্তর করিল, চাকরি করি। শহরে। আপনি এই ভোরে কার কাছে এসেছেন?

আমি কি এলাম ভাই, তিনিই আনালেন। এখন বলো শিবকালীর বাড়ি কোথায়? তাকে আমার দরকার, তারও আমাকে প্রয়োজন।

শিবকালীর নাম শুনিয়া মদনমোহনের ললাট কুঞ্চিত হইল। আজকের দিনটিতে আর কি কি অঘটন ঘটিবে তাহা ঈশ্বর জানেন নতুবা এইরকম সময়ে ওই নাম শুনিতে হয়! শিবকালী ঘোষের হস্ত সর্বদা চিৎ হইয়া থাকে। এই গ্রামের অধিকাংশ জমির মালিক সে, গোলাভরতি ধান। অথচ বছর কয়েক আগেও শিবকালী অতি দরিদ্র ছিল। হঠাৎ কোন জাদুমন্ত্রে সে বড়লোক হইয়া গেল তাহা রহস্যময়। অন্তত লক্ষ টাকার সম্পত্তি হইয়াছে বলিয়া মদনমোহনের অনুমান। এই কৃপণ। ব্যক্তিটিকে গ্রামের মানুষ ঈর্ষা করে কিন্তু এড়াইতে পারে না। মদনমোহন আগন্তুকের দিকে নজর করিল, আপনার পরিচয়?

আমি, আমি ঈশ্বরের সেবক। সেই প্রসন্ন হাসি অধরে।

নতুন মানুষের কাছে মনের কথা বলিয়া কোনও লাভ নাই। মদনমোহন বলিল, এই সাতসকালে কি ওদের কেউ ঘুম থেকে উঠেছে! ওই যে বাঁক দেখছেন, ঘুরলেই একটা গেটওয়ালা সিমেন্টের বাড়ি দেখতে পাবেন।

ঊষাকালে মানুষের মন শান্ত থাকে। কিন্তু শিবকালী ঘোষের হৃদয় আজ অত্যন্ত চঞ্চল। বিনিদ্র রাত্রি শেষে শিবকালী বাগানে দাঁড়াইয়া দাঁতন করিতে করিতে সেই চিন্তায় মগ্ন ছিল। পারুলবালা দুইদিন হইল হাসপাতালে পড়িয়া আছে। তাহার উদরে যন্ত্রণা দীর্ঘকালই হইত, এইবার অসহ্য বোধ হওয়ায় শিবকালী তাহাকে সদরে লইয়া যায়। ডাক্তারবাবু উদরের ছবি তুলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন অবিলম্বে অপারেশন করিতে হইবে। আগামীকাল সকালটি এইজন্যে নির্দিষ্ট।

স্ত্রীর ওপর শিবকালীর অন্যবিধ আকর্ষণ নাই। সে রূপসীনহে, কিঞ্চিৎ ক্ষীণাঙ্গীও বটে। অন্য নারীতেও সে আসক্ত নহে। এই বয়সেই নারীমাংস সম্পর্কে শিবকালী নিস্পৃহ হইয়া পড়িয়াছে। যদিও তাহার সন্তানাদি হয় নাই বলিয়া একটি আক্ষেপ ছিল, ইদানীং তাহাও বিলীন হইয়াছে। দ্বিতীয়বার কোনও রমণীর দাসত্ব যখন সে গ্রহণ করিবে না তখন আর আক্ষেপের কি দরকার। পারুলবালা টেবিল চেয়ার কিংবা খাটের মতোই এই বাড়িতে পড়িয়া ছিল। কিন্তু গত দুইদিনে শিবকালী হাড়ে-হাড়ে টের পাইয়াছে, ওই স্ত্রীলোকটিকে তাহার প্রয়োজন, নহিলে এই সংসার বিকল। গতকাল ডাক্তারের মুখে যে সংবাদ সে শুনিয়াছে তাহাতেই তাহার নিদ্রা ঘুচিয়াছে। পারুলবালার অবস্থা ভালো নহে, জীবন এবং মরণের পাল্লা দুটির শেষেরটিতে ভার বাড়িয়া যাইতেছে। এই প্রথম শিবকালীর মনে হইল ডাক্তারবাবুকে অতিরিক্ত অর্থ দান করিলে নিশ্চয়ই পারুলবালা সুস্থ হইবে। এইসময় সে দেখিল একটি রক্তবস্ত্রধারী তাহার বাঁশের গেটে উপস্থিত হইয়া মৃদু হাস্য করিতেছে। দেবদ্বিজে কোনওকালেই তাহার ভক্তি নাই, সন্ন্যাসীদের সে দুচক্ষে দেখিতে পারে না। তিক্ত গলায় সে খিচাইয়া উঠিল, কী চাই?

আমার তো চাওয়ার কিছু নেই। তিনি যা চাওয়ান তাই চাই। বড় চঞ্চল তোমার মন শিবকালী! আপনি আমাকে চেনেন? আগন্তুকের দৃষ্টির সামনে দাঁড়াইয়া শিবকালীর সমস্ত অঙ্গে শীতল স্রোত বহিয়া গেল।

না। আমরা কেউ কি নিজেকেই চিনি যে অপরকে চিনব! বড় ছায়া পড়েছে রে, কালো ছায়া, এই বাড়ির ওপরে। তারপর কণ্ঠের স্বরে কঠোরতা আসিল, অমন লক্ষ্মী মেয়েটাকে জেনেশুনে খুন করছ শিবকালী?

খুন? কার কথা বলছেন?

যাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছ। ও মরে যাবে, নির্ঘাৎ মরে যাবে।

কী বলছেন? শিবকালীর মাথার চুল খাড়া হইয়া উঠিল। এক লাফে সে বাঁশের গেটের নিকট চলিয়া আসিল, কে আপনি? আবার বললে জিভ টেনে নেব।

তাতে তো বউটা বাঁচবে না বাবা। শিবকালী, যে চায় সে আকাশেও হেলান দেয়। দেওয়ার ইচ্ছেটাই আসল। অপারেশন করিও না।

শিবকালী এবার হতভম্ব হইয়া পড়িল। আগন্তুক তাহার পরিবারের সমস্ত খবর রাখে! এই মানুষটি কি প্রতারক? তবে শোনা কথা কেউ-কেউ নাকি! সে সন্দেহযুক্ত কণ্ঠে কহিল, করব না?

না। অস্ত্র শরীরে লাগলেই যমদূতের বাঁধন খুলে যাবে। এইবার আগন্তুকের ঝুলিতে হস্ত প্রবেশ করিল। দুই চক্ষু বন্ধ, অধরে কিছু নিঃশব্দ উচ্চারণ। তারপর ঈষৎ ঝাঁকুনি দিয়া তাহার শরীর স্থির হইল, এই শেকড়টা নিয়ে এক্ষুনি শহরে যাও। এটাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নিতে বলো তাকে। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করবে–যদি দ্যাখো কোনও যন্ত্রণা নেই, কষ্ট নেই, সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসো। আমি রইলাম।

সন্মোহিতের ন্যায় শিবকালী শেকড়টি গ্রহণ করিল। মাত্র দুই ইঞ্চি লম্বা পরিচ্ছন্ন শেকড়। শিবকালী বুঝিতেছিল তাহার অঙ্গে টান ধরিতেছে। ইহা কি ধরনের টান তাহা সে ধারণা করিতে পারিতেছিল না। কিন্তু তাহার বোধ হইতেছিল যে নিজের শরীরের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব সে হারাইতে বসিয়াছে। তবু যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল তাহা সঞ্চয় করিয়া সে ঘোষণা করিল, ঠিক আছে আমি সদরে যাচ্ছি। যদি এসব ভাঁওতা হয় তাহলে আধুলি থেকে জন্মের মতো বের হওয়া বন্ধ করে দেব। আমার নাম শিবকালী ঘোষ, আমি পিঁপড়ের পোঁদ টিপে মধু বের করে কাশি সারাই।

আগন্তুকের অধরে আবার হাসি খেলিয়া গেল। বাঁশের গেট খুলিয়া তাহাকে ভেতরে প্রবেশ করিতে দিল শিবকালী। তখনও ঘাসে এবং গাছের পাতায় শিশিরবিন্দুমুক্তোর মতো জ্বলিতেছে। নবীন সূর্যকিরণে পৃথিবীকে চমৎকার দেখাইতেছিল। গোয়ালঘর হইতে গাভীর ডাক ভাসিয়া আসিল। এইরকম ডাক সদ্যপ্রসবা না হইলে ডাকা যায় না। শিবকালী দ্রুত গৃহে প্রত্যাগমন করিল। এইসময় তাহার ডান চক্ষু অকস্মাৎ নৃত্য শুরু করিল।

মুখভরতি দাড়ি যার সেই লোকটিকেই নেতা বলে ভাবা অন্যায় হবে না। কারণ সে কথায়-কথায় বিরক্ত হচ্ছিল। তার কথার ভঙ্গিতেও সেটা স্পষ্ট। তাকে ঘিরে ছয়জন যুবক বসে আছে। যুবকেরা

আধুলি গ্রামের মানুষ। নেতা শহর থেকে এসেছেন, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, এটা। তিরাশি সাল অথচ আপনাদের মানসিকতার কোনও পরিবর্তন হয়নি। অদ্ভুত ব্যপার! আপনাদের গ্রামের শতকরা নিরানব্বইজন সারা বছর আধপেটা খেয়ে থাকে, শিবকালী ঘোষের জমি চাষ করছে, এই মানুষগুলোকে বাঁচাবার কোনও চেষ্টা আপনারা করবেন না? তাহলে রাজনীতি করতে এলেন কেন?

যুবকদের একজন মিনমিনে গলায় বলল, আমরা চেষ্টা করছি–।

কী চেষ্টা করছেন? নেতা তাঁর দাড়িতে হাত রাখলেন, না না, এ ভালো কথা নয়। আপনারা হলেন পার্টির ক্যাডার। আপনাদের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে–। আচ্ছা আপনারা আমার প্রশ্নের জবাব দিন, লোকটা জোতদার?

হ্যাঁ।

বুর্জোয়া?

হ্যাঁ।

মজুতদার?

হ্যাঁ।

শোষক?

হ্যাঁ।

ব্যাস। আর কী দরকার? এইরকম মানুষ দেশে যত থাকবে তত সর্বহারাদের সর্বনাশ। এদের বিরুদ্ধে লড়াই করে উৎখাত করতে হবে। আপনারা সেটা জানেন না?

জানি। কিন্তু মুশকিল হয়েছে গ্রামের মানুষদের নিয়ে। তারা লোকটাকে পছন্দ করে না, সকালে উঠে কেউ নাম উচ্চারণ করতে চায় না, ঘৃণাই করে, আবার ওই লোকটার বিরুদ্ধাচারণ করতে সাহস পায় না।

এসব পুরোনো সেন্টিমেন্ট। একবার ভেঙে দিলেই চুকে যাবে।

কিন্তু আর একটা ব্যাপার সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কী ব্যাপার?

গ্রামের মানুষ জানে লোকটার একসময় কিছুই ছিল না। খেতে পেত না। সেই যে বাংলাদেশ থেকে ওর দুই পিসি সোনার গয়না নিয়ে এল সেটা হাতিয়েই ওর রবরবা। তা সেইসময় কংগ্রেসিরা ওকে খুব খাতির করত।

করে, সেটাই স্বাভাবিক। কংগ্রেসের চরিত্র সাধারণ মানুষকে বোঝানো।

কিন্তু লোকটা ঠিক কংগ্রেসিও ছিল না। গতবার পঞ্চায়েতে দাঁড়াবার জন্যে আমাদের পার্টি থেকেও ওকে অনুরোধ করেছিল। মুশকিল হল খবরটা গ্রামের লোক জানে। লোকটা রাজি হয়নি। শহরের নেতারা ওর বাড়িতে এসেছিল।

নেতাকে একটু সঙ্কুচিত মনে হল কিন্তু তাঁর মুখ দাড়িতে ঢাকা থাকায় অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। নেতা শেষ পর্যন্ত কাঁধ নাচালেন, ওরকম একটু-আধটু হয়ই, পরিস্থিতি অনুযায়ী অনেক সময়। ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয়। মার্কস বলেছেন, শত্রুর শত্রু আমার মিত্র। এ আপনারা বুঝবেন না। হিটলারকে ঠেকাতে আমরা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছি, কেন করেছি? অনেক গভীরের কথা। যাক, আমার বক্তব্য হল এই শোষকটিকে আপনারা নাজেহাল করুন। ওর জমিতে যাঁরা চাষ করেন তাঁদের মধ্যে বিক্ষোভ সংগঠিত করুন। ওর লোকজন বাধা দিতে এলে সংগ্রাম শুরু করুন।

এবার আর একজন বলল, শিবকালীর ছেলেমেয়ে নেই।

গুড। তাতে তো আরও ভালো হল। ওর মৃত্যুর পর সব সম্পত্তি এই গ্রামের জনগণের হয়ে যাবে। এতগুলো সর্বহারার মধ্যে একজন বুর্জোয়া থাকবে তা মেনে নেওয়া যায় না। শহরে সর্বহারার সংখ্যা কম, বুর্জোয়ার সংখ্যাই বেশি। কিন্তু আপনাদের ক্ষেত্রে তো সম্পূর্ণ উলটো। লোকটার সম্পত্তির হিসাব পেয়েছেন?

জোতজমি এবং ধানগম নিয়ে লক্ষ টাকার মতো হবে।

আর আপনাদের? আপনাদের পকেটে কিছু নেই–টু-টু! তাছাড়া লোকটার মধ্যে সহযোগিতামূলক মনোভাব নেই। আর দেরি করবেন না, আমরা আগামীকাল আবার বসব এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করতে। একটা গ্রামের অর্থনৈতিক কাঠামো যদি সমান করতে পারি তাহলে সমস্ত দেশ উদ্বুদ্ধ হবে।

নেতার কথা শেষ হলে সবাই উঠে দাঁড়াল। প্রত্যেককেই খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। নেতা যা বলছেন তাতে তারা মিথ্যে কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। কিন্তু শিবকালীর কাছে গ্রামের মানুষ যে ঋণগ্রস্ত। কিন্তু এটাও তো ঠিক, সকালে উঠে লোকটার নাম শুনলে হাঁড়ি ফেটে চৌচির হয়।

মদনমোহন সাইকেলে চাপিয়া সদরে যাইতেছিল। শিবকালী ঘোষের বাড়ির সামনে আসিতেই সে ডাক শুনিতে পাইল, চললে কোথায়? আপিসে? সে দেখিল শিবকালীর গেটের নিকট দাঁড়াইয়া সেই আগন্তুক হাসিতেছে। নিকটে কেহ নাই।

মদনমোহন গতি কিঞ্চিৎ শ্লথ করিয়া জবাব দিল, হ্যাঁ।

তাহলে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। এখানে প্রসাদ নিয়ে যেও।

মদনমোহনের কিছুই বোধগম্য হইল না। কিসের প্রসাদ, কোথায় পাওয়া যাইবে এইসব বৃত্তান্ত অজানাই রহিল। তাহার যথেষ্ট বিলম্ব হওয়ায় সে দ্রুত ওই স্থান অতিক্রম করিলেও হঠাৎ ঠাওর হইল প্রত্যুষে যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল, এই অল্প সময়ের ব্যবধানে সে মালিকের ন্যায় কথা বলিতেছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে শিবকালীর সম্মুখে একটি অভিনব দৃশ্য উদঘাটিত হইল। পারুলবালা যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছিল, তাহার বাক্যালাপ প্রায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে। নার্স শিবকালীকে কহিয়া গেল, আগামীকাল নহে ওইদিন অপরাহ্নেই অপারেশন করিতে হইবে নহিলে অবস্থা বিপজ্জনক হইতে পারে। তিনবার পত্নীর নাম উচ্চারণ করিয়াও শিবকালী কোনও সাড়া পাইল না। হঠাৎ তাহার মনে হইল এই স্ত্রীলোকটি গত হইলে তাহার অতিশয় দুর্দশা হইবে। অতএব যেমন করিয়া হোক ইহাকে সুস্থ করিতেই হইবে। ডাক্তারবাবুরা যখন অপারেশন একমাত্র উপায় বলিয়া ধারণা করিয়াছেন তখন তাহা মানিয়া লওয়াই শ্রেয়। সে আদার ব্যাপারি জাহাজের খবর রাখে না। কিন্তু ওই সাধুবাবা তো আর মিছিমিছি তাহার কাছে আসে নাই। বস্তুত এখন পর্যন্ত তাহার একটি পয়সাও তিনি খসান নাই। পকেটে যে শিকড়টি আছে তাহা গোপনে পারলবালাকে খাওয়াইলে কেমন হয়! যদি কোনও সুপ্রতিক্রিয়া না দেখা দেয় তাহা হইলে যথানিয়মে অপারেশন হইতে দেওয়া মঙ্গল। শিকড়ের জন্যে যদি কোনও মন্দ প্রতিক্রিয়া হয় তাহাতে ভয়ের কিছু নাই কারণ অপারেশন অনিবার্য। এইসব সাতকাহন ভাবিয়া শিবকালী চারপাশে তাকাইল। পাশাপাশি বিছানায় অনেক মহিলা শুইয়া আছে। তাহাদের আত্মীয়-স্বজনদের ভিড় এখন। কেহই এইদিকে লক্ষ করিতেছেনা। শিবকালী গোপনে শিকড়টি পারুলবালার মুখের ভিতরে খুঁজিয়া দিল। সেই মুহূর্তে বোধহয় পারুলবালার যন্ত্রণা তীব্র হওয়ায় সে শেকড়টিকে দাঁতের তলায় চাপিয়া ধরিল। শিবকালী নিম্নস্বরে কহিল, খেয়ে নাও, চিবিয়ে খেয়ে নাও, যন্ত্রণা কমে যাবে।

অসহায় পারুলবালা একবার স্বামীর মুখ দর্শন করিল তারপর পাশ ফিরিয়া শুইল। খানিকবাদেই নার্স আসিয়া কহিল, উনি ঘুমুচ্ছেন, এখন আর বিরক্ত করবেন না। যাওয়ার আগে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন।

শিবকালী উঠিল না। একটু আগে যে মানুষ কাতর ছিল সে শিকড় মুখে দেওয়ামাত্র নিদ্রিত হইল। হঠাৎ তাহার শরীর শিহরিত হইল। সাধুবাবা কি দৈবপ্রেরিত? কিন্তু তবু সংশয় হইতেছিল। আধঘন্টা নিদ্রা যাওয়ার পর পারুলবাবা নয়ন মেলিল, ওমা, কখন এলে?

শিবকালীর জিহ্বা আড়ষ্ট, কেমন আছ? যন্ত্রণা–।

পারুলবাবা কহিল, সকালে খুব ছিল, এখন–। সে নিজের পেটে হাত বুলাইয়া কহিল, টাটিয়ে আছে কিন্তু ব্যথা নেই গো! কী করে হল?

শিবকালীর হৃৎপিণ্ড যেন গলায় উঠিয়া আসিল। সে দুই উজ্জ্বল চক্ষু মেলিয়া কহিল, উঠে দাঁড়াও তো, বিছানা থেকে নামো–।

পারুলবালা কহিল, না, পারব না। আজ দুদিন বিছানা থেকে নামিনি। মাথা ঘুরে যাবে আর যন্ত্রণাটা বাড়বে।

শিবকালী একটু কঠোর হইল, নামতে বলছি নামো!

পারুলবালা চিরকালই এই মানুষটিকেই সমীহ করে। বাংলাদেশি আত্মীয়দের স্বর্ণালঙ্কার উধাও হইবার পর সে তটস্থ হইয়া থাকে। অতএব আদেশ অমান্য করিবার সাহস রইল না। মাটিতে পা ফেলিয়া সে নিজেই তাজ্জব হইয়া গেল। সামান্য ব্যাথাও বোধ হইতেছে না, এমনকী আড়ষ্ট ভাবটিও মিলাইয়া গেল। পারুলবালা স্বচ্ছন্দে খানিকক্ষণ পদচারণ করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, আমার আর কোনও কষ্ট হচ্ছে না গো, আমি ভালো হয়ে গিয়েছি। তাহাকে শিশুর ন্যায়। দেখাইতেছিল।

শিবকালী আরও কিছুক্ষণ স্ত্রীকে পর্যবেক্ষণ করিল। তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ডাক্তারের নিকট উপস্থিত হইল।

ঠিক দ্বিপ্রহরে শিবকালী সস্ত্রীক আধুলিতে প্রত্যাগমন করিল। ইতিমধ্যে পারুলবালার রক্তশূন্য মুখে প্রাণের ছোঁওয়া লাগিয়াছে। তাহার চেহারা দেখিয়া ডাক্তার খুবই বিস্মিত হইয়াছিল। নানারূপ পরীক্ষা করিয়াও পারুলবালার পূর্বের রোগটিকে পাকড়াও করা যায় নাই। শেষপর্যন্ত অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়া শিবকালীর নিকট হইতে বন্ড লইয়া পারুলবালাকে মুক্তি দিয়াছেন। পথে স্ত্রীর নিকট সাধুবাবা এবং তাহার শিকড়ের মাহাত্ম্য বর্ণনা করিয়া শিবকালী কহিয়াছিল, ভাগ্যিস, তোমার গায়ে অস্ত্র ছোঁয়ায়নি, নইলে আর দেখতে হত না।

পারুলবালা স্বাস্থ্যের ফুর্তিতে জবাব দিয়াছিল, মরলে তো সুবিধে হত, আর একটা ঘুড়িকে জুটিয়ে আনতে। ব্যাটাছেলেদের চরিত্রির!

দূর হইতে রক্তাম্বর দেখা যাইতেছিল। রিকশা হইতে পড়ি কি মরি করিয়া নামিয়া আসিল শিবকালী, পাগলিনীর মতো প্রায় পারুলবালা। তারপর দুইজনে সাধুবাবার পদপ্রান্তে সাষ্টাঙ্গ হইল। সাধুবাবা মৃদু হাস্য করিয়া কহিলেন, তাহলে অপারেশন হল না! বেঁচে গেলি, বেঁচে গেলি।

শিবকালী আপ্লুত কণ্ঠে কহিল, তুমিই বাঁচালে। তোমার কৃপা।

আমি কে? আমি কেউ না। সবই তাঁর ইচ্ছে। কিন্তু ছায়া নেমে আসল, কালো ছায়া। সর্বনাশ এগিয়ে আসছে ধীরে-ধীরে।

পারুলবালা কোনওক্রমে কহিল, বাঁচান, আমাদের বাঁচান।

সাধুবাবা বলিলেন, ওঠ। পড়ে থাকিস না, এখন তোদের দাঁড়াবার সময়।

শিবকালী উঠিল। সাধুবাবার দুই চক্ষুর দিকে তাকাইলেই তাহার সমস্ত গোলমাল হইয়া যায়। সে কহিল, বাঁচান, বাঁচান।

সাধুবাবার মুখশ্রী কঠোর হইল, তোদের চারপাশে এখন অনেক শত্রু। এদের দূর করতে হবে। মায়ের নামগান করতে হবে। বাহাত্তর ঘণ্টার নামগান। এখানে শামিয়ানা টাঙা। তিনদিন ধরে নাম চলবে। আমি যজ্ঞ করব। তিনদিনের পর ছায়া সরে যাবে, তোদের নতুন জীবন শুরু হবে। কি, রাজি আছিস?

পারুলবালা সোৎসাহে কহিল, হ্যাঁ বাবা, আপনারা যা ইচ্ছে তাই করুন।

অপরাহ্নে মদনমোহন সাইকেলে চাপিয়া আফিস হইতে ফিরিতেছিল। সেইদিনই মাহিনা পাওয়ায় তাহার পথে দাঁড়াইবার অবকাশ ছিল না। কিন্তু শিবকালী ঘোষের গৃহের দিকে দৃষ্টি পড়িতেই সে স্তব্ধ হইয়া গেল। বিরাট শামিয়ানা টাঙানো হইয়াছে। কয়েকজন কিষাণ পরিশ্রম করিতেছে। শিবকালী নিজে দাঁড়াইয়া তদারক করিতেছে। এইসময় একজন দৌড়াইয়া মদনমোহনকে খবর দিল, বাবা আপনাকে ডাকছেন।

বাবাটি কে তাহা অনুমান করিল মদনমোহন। নিতান্ত কৌতূহলে সে ভিতরে প্রবেশ করিতেই সাধুবাবার দর্শন লাভ করিল। যজ্ঞের কুম্ভ প্রস্তুত হইয়াছে। তাহার নিকটে উচ্চ আসনে সাধুবাবা প্রশান্ত মুখে বসিয়া কহিলেন, কিহে, বাড়ি ফিরছ? মদনমোহন নিজের চক্ষুকে অবিশ্বাস করিতেছিল। আজ প্রভাতে যাহাকে নিতান্তই সাধারণ মনে হইতেছিল অপরাহ্নে তাহাকেই মহাশক্তিমান বলিয়া বোধ হইতেছে। যে শিবকালীর আঙুল ফাঁক হয় না সে ইহার সামনে। করজোড়ে দণ্ডায়মান। মদনমোহন নীরবে মস্তক দোলাইল। সাধুবাবা কহিলেন, বেশ বেশ। আজ থেকে এখানে নামগান শুরু হচ্ছে। সন্ধের পরে এসে প্রসাদ নিয়ে যেও। আর একটা কথা, এই নামগান যজ্ঞ যেমন শিবকালীর অমঙ্গল দূর করবে তেমনি গ্রামের মানুষদের উপকার হবে। তাই যে দুবেলা এখানে প্রসাদ না নিতে আসবে সে নিজের ক্ষতি করবে। একথা গ্রামের মানুষকে বলে দিও।

মদনমোহনের মনে হইল সাধুবাবা নন স্বয়ং মহাদেব কথা বলিতেছেন। সে পরম ভক্তিদের প্রণাম জানাইলে সাধুবাবা কহিলেন, যাও বাবা, সারাদিন খাটুনি খেটে এলে, এবার একটু বিশ্রাম করো। রাতে ঠিক এসো বাড়ির মানুষদের নিয়ে।

মদনমোহন খানিকটা কৃতজ্ঞচিত্তে বাহিরে আসিতে-আসিতে নিজেকে ধিক্কার দিল। তাঁহার দুই চক্ষু কেবলই সাধুবাবার ঘড়ির দিকে চলিয়া যাইতেছিল। বড় সন্দেহপরায়ণ সে। সন্দেহ মানুষকে ছোট করিয়া দেয়।

হরিনাম নয়, তারানাম শুরু হইল রাত্রি আট ঘটিকায়। শহর হইতে চারজন বাদ্যযন্ত্র লইয়া যথাসময়ে উপস্থিত হইয়াছিল। ওপাশেদুইটি উনুনে প্রসাদ পাক দেওয়া হইতেছে। খিচুড়ি, আলুর দম, বেগুনভাজা আর দুইটি রসগোল্লা। যজ্ঞ হইবে বাহাত্তর ঘণ্টা অতিক্রান্ত হইলে। সাধুবাবা নামগানে যোগদান করিতে করিতে মাঝে-মাঝে বাহিরে আসিয়া পর্যবেক্ষণ করিতেছিলেন সবাই প্রসাদ ঠিকমতন পাইল কিনা। প্রথম রাত্রে মাত্র দুশো মানুষ প্রসাদ পাইল। পার্শ্ববর্তী গৃহের মহিলারা পারুলবালার পার্শ্বেবসিয়া আবিষ্কার করিল এ পারুলবালা সে পারুলবালা নহে। সাধুবাবার শিকড় মানুষটিকে মাটির মানুষ করিয়া দিয়াছে। এমনকী শিবকালী ঘোষও বিনীত ভঙ্গিতে প্রত্যেককে আহ্বান করিতেছিল। অধিক রাত্রে যখন কয়েকজন নামগানকারী সুর বাঁচাইয়া রাখিয়াছে তখন সাধুবাবা শিবকালীকে কহিলেন, বাবা শিবু এবার তুমি একটু বিশ্রাম করো। কাল তো সাতসকালে উঠতেই হবে। যাও।

নিভৃতে আসিয়া শিবকালী পারুলবালাকে কহিল, শরীর কেমন?

পারুলবালা উজ্জ্বল হইল, খুব ভালো। কোনওদিন অসুখ করেছিল বলে মনেই হয় না। ওঃ সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি! তারপর একটি প্রশান্ত হাসি অধরে রাখিয়া কহিল, আমার অনেকদিনের সাধ। পূর্ণ হল। আগে ভাবতাম খোকা হলে অন্নপ্রাশন করব, শামিয়ানা টাঙিয়ে লোক খাওয়াব। সে সাধ তো পূর্ণ হচ্ছিল না। আজ হল।

শিবকালী কিয়ৎকাল স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাইয়া কহিল, সাধুবাবা বলেছেন এসব করলে আমার ভালো সময় আসবে। যা খরচ করব তার ডবল ফিরবে, কি বলো? আমারই টাকায় হাভাতেগুলো গিলবে আর আমি কিছু পাব না–!

পারুলবালা স্বামীর মুখে হাত চাপা দিল, ছি, ওরকম কথা বলো না। যিনি আমার জীবন দিয়েছেন তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখো।

পরদিন সকালে শিবকালীর বাড়ির সম্মুখে যেন মেলা বসিয়া গেল। আধুলির মানুষ বটেই, নিকটবর্তী অন্য গ্রামের মানুষজনও এই সাধুবাবার দর্শনে উপস্থিত হইল। সাধুবাবার আদেশ, কেহ যেন যজ্ঞবাড়িতে আসিয়া প্রসাদ না লইয়ানা ফেরে। গৃহে যা ছিল তা গতরাত্রের আয়োজনে ব্যয় হইয়াছে। অতএব শিবকালী শহর হইতে চাল ডাল সবজি আনাইল। উনুনের সংখ্যা বাড়িল। শহর হইতে একাধিক বামুনঠাকুর আনাইতে হইল। সাধুবাবার আদেশমতো পরদিবসে গ্রামের সমস্ত বাড়িতে উনুন আর জ্বলিল না। মদনমোহন স্নান করিয়া যজ্ঞবাড়িতে প্রসাদ খাইয়া আপিস করিতে গেল। দ্বিপ্রহরে তিন হাজার মানুষ খেপে-খেপে প্রসাদ গ্রহণ করিয়া তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলিতে লাগিল। তারামায়ের নামগান তখন সোচ্চার। বোধহয় দুইক্রোশদূর হইতে তাহা শোনা। যাইতেছিল। যে আসে সেই খানিকটা চেঁচাইয়া যায়। শিবকালী দুইদিনে যেন কিছুটা কৃশ হইয়াছে। দুই বেলা এখন সমস্ত দিনে বিস্তৃত হইয়াছে। যে যখন ইচ্ছা আসিলেই প্রসাদ পাইতেছে। শিবকালীর আর নামগান করিবার সময় নাই, চরকির ন্যায় তাহাকে প্রসাদের ব্যবস্থা করিতে চারিধারে ছোটাছুটি করিতে হইতেছিল। মদনমোহন অতি স্বল্পমূল্যে তাহার নিকট হইতে পাঁচমণ গম ক্রয় করিল। শিবকালীর গমে প্রয়োজন নাই।

নেতা বললেন, দেখুন, লোকটার স্পর্ধা দেখুন। দুবেলা খাইয়ে সমস্ত গ্রামের মানুষকে কিনে। নিচ্ছে। নিশ্চয়ই ইলেকশনে দাঁড়াবে। এই জনপ্রিয়তার বিরুদ্ধে আমরা কনটেস্ট করতে পারব।

একজন বলল, না, ঠিক সেরকম নয়। এক সাধুবাবা এসে বলেছে যজ্ঞ করে লোক খাওয়ালে ভালো হবে, তাই–।

ছাড়ো! একটা না একটা ধান্দা ঠিকই আছে। এই ফাঁকে গ্রামের মানুষ লোকটার জয়গান করবে। অ্যাদ্দিন হিংসে করত, নিন্দে করত, এখন প্রশংসা করবে, যাক। আমরা কী দেখছি? দেখছি লোকটা পুঁজিপতি বুর্জোয়া শ্রেণীর। টাকার গরমে পৃথিবীকে নস্যাৎ করছে। এরকম মানুষ পৃথিবীতে থাকলে বিপ্লবের ক্ষতি হবে। কারণ এরা মানুষকে ভুল পথে চালায়। এদের কাছ থেকে মানুষের কোনও উপকার আসে না, এরা যা করে তা নিজের স্বার্থের জন্যে করে। এ বিষয়ে কারও বক্তব্য আছে? নেতা বাঘের মতো সামনে বসা মুখগুলোর দিকে তাকালেন, নেই! থাকতে পারে না। কারণ আপনারা সবাই বিচক্ষণ মানুষ। সর্বহারা মানুষ। আপনারা শুনেছেন লোকটার স্ত্রীর অপারেশন অনিবার্য ছিল। ওই সাধুর শেকড় খেয়ে মহিলা ড্যাঙডেঙিয়ে চলে এলেন। এই বিজ্ঞানের যুগে কেউ একথা বিশ্বাস করবে? পুরো ব্যাপারটাই বানানো। ওর বউ-এর কিছুই হয়নি। ডাক্তারের সঙ্গে ব্যবস্থা ছিল, যাতে ওই সাধুবাবার কীর্তির কথা সাহকাহন করে শোনানো যায়। গ্রামের সরল মানুষদের ব্ল্যাকমেল করছে লোকটা।

একজন একটু উসখুস করছিল। নেতা থামতেই বলল, কিন্তু এত টাকা খরচ করছে কেন তাহলে?

এ্যাই, এ্যাই হল প্রশ্ন! হোয়াই? নিশ্চয়ই কোনও ধান্দা আছে। যা খরচ করছে তার দশগুণ কামাবে। এছাড়া হতেই পারে না। কই, আমার আপনার বাড়ির কারও অসুখ হলে তাকে বাঁচাতে তো সন্ন্যাসী আসে না। গ্রামের মানুষ যখন বুঝবে তখন ওদের কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু আমরা তো সেটা হতে দিতে পারি না। কিছু ভাবলেন আপনারা?

একজন বলল, মাথায় কিছু আসছে না। এই উৎসবের পরে তো ওর ভাগচাষিদের উত্তেজিত করা মুশকিল হবে।

নেতা বললেন, ঠিক। আমাদের দেশের স্বার্থে, বিপ্লবের স্বার্থে আরও কঠোর হতে হবে। ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিন। এই সর্বহারাদের মধ্যে ওর স্থান নেই। দিন ঠিক করুন।

একজন বলল, এখন তো ওর বাড়িতে হাজার-হাজার মানুষ। এখন কিছু করতে গেলে পাবলিক খেপে যাবে।

না, না, এখন নয়। তবে খুব দেরিতেও নয়। ওদের যজ্ঞ কবে শেষ হবে?

পরশু রাত্রে।

গুড। তারপর যে যার বাড়িতে ফিরে যাবে?

হ্যাঁ, আর থেকে কী করবে? এই কদিনের পরিশ্রমে শিবকালী ঘুমে নেতিয়ে থাকবে?

নিশ্চয়ই।

তখনই–তখনই আসল সময়। এ খবর এই ঘরের বাইরে যেন না যায়। আর অ্যাকশন পার্টিতে আপনারাই থাকবেন। নেতা তৃপ্তির হাসি হাসলেন। একটা বড় সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে।

শিবকালীর হাঁটিতে কষ্ট হইতেছিল। পারুলবালা তাহাকে ধরিয়া যজ্ঞের নিকট লইয়া আসিল। বিশাল অগ্নিকুণ্ড হইতে তাপ বিকিরিত হইতেছিল। সেই লেলিহান শিখার পার্শ্বেবসিয়া সাধুবাবা মন্ত্রপাঠ করিতেছিলেন। গ্রামের সমস্ত মানুষ পরমভক্তিভরে তাঁহার দিকে তাকাইয়াছিল। শিবকালীকে দেখিয়া সাধুবাবা কহিলেন, বাবা শিবু, আমার যজ্ঞ শেষ। তোর বাড়িতে যে গভীর কালো ছায়া নেমেছিল তাকে সরিয়ে দিয়েছি। বল, আর কোনও বাসনা আছে?

শিবকালী দুর্বল কণ্ঠে কহিল, বাবা, সব দিলাম তোমাকে, তুমি যা ভালো বোঝো তাই করো।

সাধুবাবা হাসিলেন, সবই তাঁর ইচ্ছে। মা, মা, মা! পাবি সব পাবি। খুব বেশি করে পাবি। তার আগে দুটো প্রশ্ন করি, কি চাস তুই?

শিবকালীর শরীর রোমাঞ্চিত হইল। সে ওই অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকাইয়া যেন অনেক কিছু দেখিতে পাইল। অনেক অর্থ, অনেক জমি, শস্য ইলেকশনের অনুরোধ, পঞ্চায়েতের প্রধান হওয়া, রাশি-রাশি সোনা কিন্তু ও কে? ওই যে বিধবা? সাদা থান পরা, হাতে পুঁটুলি যাহাতে সোনার গহনা আছে। যে পুঁটুলি বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় ওই বিধবা তাহার কাছে পরম বিশ্বাসে গচ্ছিত রাখিয়াছিল! কিন্তু সেই বিধবাকে তো সে তাড়াইয়া দিয়াছে। সে কেন এখন ওই অগ্নিকুণ্ডে দাঁড়াইয়া সমস্ত সম্পদ আড়াল করিয়া রাখে? বারংবার চক্ষু রগড়াইয়াও শিবকালী সেই মৃত বিধবাকে সরাইতে পারিল না। তাহার এই আত্মীয়টি যেন মিটিমিটি হাসিতেছে। সে উত্তর করিতে পারিল না। তখন সাধুবাবা পারুলবালার দিকে চাহিলেন, তোমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ কী? তাই চাও, তুমি তাই পাবে মা।

পারুলবালা মাথার ঘোমটা আর একটু টানিল। কোনটি যে মূল্যবান তাহা সে কিছুতেই ঠাওর করিতে পারিতেছিল না। শেষ পর্যন্ত বাল্যকাল হইতে শোনা বাক্যটি তাহার স্মরণে আসিল, পতিই পরম দেবতা, স্বামীই স্ত্রীর সবচেয় বড় সম্পদ। সে নিম্নস্বরে কহিল, ওঁকে সুস্থ রাখুন।

সমবেত মানুষজন সপ্রশংস বাক্য কহিতে লাগিল। সাধুবাবা হাসিলেন, তথাস্তু। সাবিত্রীসমান হও মা।

আধুলি গ্রাম এখন নিস্তব্ধ। এমনকী কুকুরেরাও এখন নিদ্রিত। যজ্ঞ শেষ হওয়ামাত্র যে যার বাড়িতে ফিরিয়া গিয়াছে। সাধুবাবা গরুর গাড়িতে শহরে রওনা হইয়া গিয়াছেন। যজ্ঞের শেষে। ওইস্থানে থাকা নাকি তাঁহার গুরুর নিষেধ। শহর হইতে যাহারা আসিয়াছিল তাহারা সাধুবাবার অনুগামী হইয়াছে। এখন শিবকালীর গৃহের সন্মুখে ছেঁড়া কলাপাতা উড়িতেছে, অজস্র ভাঁড় এবং উচ্ছিষ্ট চারিধারে ছড়াইয়া আছে। সমস্ত পরিবেশ শ্মশানের মতো খাঁ-খাঁ করিতেছে।

এতদিনের ক্লান্তি অদ্যরাত্রে পারুলবালাকে আজ নিষ্কৃতি দেয় নাই। ঘরের ভিতর মড়ার মতো ঘুমাইতেছে সে। শিবকালীর চক্ষে কিন্তু ঘুম নাই। সে ধীরে-ধীরে ঘরের বাহিরে আসিয়া বারান্দায় বসিল। চারিপাশে এখন রাত্রির কালো ছায়া। শিবকালী দুই হস্তে মুখ লুকাইল।

এইসময় একটা জিপ প্রায় নিঃশব্দে শিবকালী ঘোষের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। টপাটপ কয়েকজন মানুষ ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে। প্রত্যেকের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা, হাতে ছুরি এবং তলোয়ার। আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে আছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছিল না। তারা সতর্ক চোখে চারধার দেখল। তারপর বাড়ির পেছন চলে এল। খিড়কির দরজা খোলাই ছিল। আগন্তুকরা একটু অবাক হল। প্রতিরোধ নেই কেন? খবরটা ফাঁস হয়ে গেল নাকি? তারা সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকল। গোটাচারেক ঘর। কিন্তু কোনও ঘরেই আসবাব পর্যন্ত নেই। সব খাঁ-খাঁ করছে। একটি ঘরে। পারুলবালা শুয়ে আছে। ওরা চটপট ওকে বেঁধে ফেলল। পারুলবাবাকে খুন করার পরিকল্পনা ওদের নেই। তারপর সিন্দুক খুলল। বিশাল লোহার সিন্দুকের মধ্যে কিছুই অবশিষ্ট নেই। আগন্তুকদের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। এইসময় তারা শিবকালীকে আবিষ্কার করল। দ-এর মতো বারান্দায় বসে আছে। ওরা ছুরি বের করে নিঃশব্দে শিবকালীর পেছনে এসে দাঁড়াতেই একজন থাকতে ইঙ্গিত করিল। এই মানুষ কি সেই মানুষ! এমন হতশ্রী বৃদ্ধের চেহারায় ওরা শিবকালীকে কল্পনা করেনি। ওদের মনে হচ্ছিল কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।

দুজনকে পাহারায় রেখে বাকিরা আবার তদন্তে বের হল। গোলায় ধান নেই, গোয়ালে গরু নেই। ওরা ফিরে এসে কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, গোলায় ধান নেই, কোথায় গেল? সিন্দুক খালি, মাল কোথায় গেল?

শিবকালী ইহাদের চিনিতে পারিতেছিল না। সে মাথা নাড়িল, বেচে দিয়েছি–সব বেচে দিয়েছি।

বেচে দিয়েছে? কেন?

হুঁ বাবা! বিশ হাজার লোক খেয়েছে চারদিনে–কত টাকা লাগে, অ্যাঁ! যত জমি ছিল, যত গয়না ছিল, ধানগম ছিল, গরু বলদ ছিল সব বেচে লোখ খাইয়েছি।

এখন কি আছে তোমার, এই বুর্জোয়া?

এখন শুধু এই প্রাণটা। আমার বউয়ের পরম সম্পদ। শিবাকালী চক্ষু বন্ধ করিয়া কাঁপিতে লাগিল।

তুমি এরকম করলে কেন? একজন ছুরিটা গলায় ঠেকিয়ে প্রশ্ন করল।

মাথা নাড়িল শিবকালী, সবই তাঁর ইচ্ছে, সবই তাঁর ইচ্ছে! এই বসতবাটিটাও বন্ধক রেখেছি মদনমোহনের কাছে। যাও, খবর নাও।

ছুরিটা সরে গেল। প্রত্যেকে প্রত্যেকের চোখের দিকে তাকাল। কেমন অসহায় বোধ করছিল। সবাই। শেষ পর্যন্ত একজন কথা বলল, যাঃশালা! আর একটা সর্বহারা বাড়ল। এখন একে খুন করে কী করব?

ওরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। বুর্জোয়া যদি সর্বহারা হয়ে যায়, তাহলে?বারান্দার শীতল বাতাসে বসিয়া শিবকালী তখন আপনমনে গুনগুন করিতেছিল, সব হারিয়ে এসে গেছি, আয় মা এবার কাছাকাছি।

ওরা পকেট থেকে একটা টাকা বের করে টস করল। তিন সিংহ শূন্যে দুটো ধানের শিষ গপগপিয়ে গিলে ফেলছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress