হাওড়া স্টেশনে
উদিত হাওড়া স্টেশনে, বুকস্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিন দেখছিল। তেমন যে মনোযোগ দিয়ে দেখছে, তা মনে হয় না। মাঝে মাঝেই, হাত উলটে ঘড়ি দেখছে আর ঠোঁট উলটে বিরক্তি প্রকাশ করে, ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছে। কোনও পাতায় একটা ছবি হয়তো কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দেখছে, তারপরেই আবার যাত্রীদের আসা যাওয়ার দিকে চোখ পড়ছে। যত যাত্রী আসছে, তাদের পায়ে পায়ে জল আর কাদা ছড়াচ্ছে।
একে কী ধরনের বৃষ্টি বলে, উদিত বুঝতে পারে না। আকাশের থেকেও, ওর মুখের অবস্থা খারাপ হয়ে ওঠে। ঝরঝর করে বৃষ্টি হয় বা ঝিরঝির করে হয়, তার একটা মানে বোঝা যায়। মাঝে মাঝে হচ্ছে, মাঝে মাঝে থামছে, অথচ আকাশ মুখ কালো করেই আছে। আর এই কলকাতার বৃষ্টি, আরও বিশ্রী। ঝরতে না ঝরতেই, রাস্তা ডুবে যাবে, আর ঠিক কাজের সময় কোথাও বেরোবার মুখেই, বৃষ্টিটি বেশ আনন্দে গদগদ হয়ে নেমে আসবে।
কলকাতার বৃষ্টির দস্তুর এইরকম। উদিত নিজের ভেজা জামা-প্যান্টের দিকে এক বার তাকাল। আর এক বার ঝাড়া নাড়া দিল, যদিও, ঝরবার মতো জল এখন আর জামা-প্যান্টে নেই, সবই প্রায় গায়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। তারপরে ফ্যাঁচর ফ্যাঁচর হাঁচো, নাক চোখ দিয়ে জল গড়াক, গা হাত পা ব্যথা হোক, ফ্লু বাগিয়ে শুয়ে থাকো। যাচ্ছেতাই। কিন্তু তা হলে তো চলবে না। উদিতের অনেক কাজ আছে।
আর একটু দেরি করে এলেও অবিশ্যি ক্ষতি ছিল না। গাড়ি ছাড়তে এখনও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি। কিন্তু যাত্রীর ভিড়ে, উদিতের বিরক্তি যেন আর ধরছে না। এত লোকের আজ বাড়ি থেকে বেরোবার কী দরকার। দুর্যোগ দেখলে কি লোকের বাইরে যাওয়ার দরকার বেড়ে যায় নাকি। দেখেশুনে সেইরকমই মনে হচ্ছে। অথচ এর মধ্যেও, সকলের সাজগোেজ চাই, আর সে সাজগোজের কী দুর্দশা। বিশেষ করে মেয়েদের। মুখের রং উঠে গিয়েছে, কপালের টিপ জলে ধুয়ে গিয়েছে, শায়ার ফ্রিল পায়ে জড়িয়ে, হাঁটতে গিয়ে, আছাড় খাবার জোগাড়। তার ওপরে যারা ফিনফিনে পাতলা শাড়ি পরেছে, তাদের তো কথাই নেই। নিজেদের নিয়ে, নিজেরাই বিব্রত। ধুতি পাঞ্জাবি পাগড়িওয়ালাদের দুর্দশাও কম না। সব থেকে খারাপ অবস্থা বাচ্চাদের। এমন দিনে কেউ মেয়ে আর বাচ্চাদের নিয়ে বেরোয়। আজকাল লোকের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।
অবিশ্যি, সকলের অবস্থাই এ রকম কাক ভেজা না। অনেকে বেশ ঝরঝরে শুকনো অবস্থাতেই ভেতরে এসে ঢুকছে। শুকনো ঝরঝরে মেয়ে পুরুষ দেখলেই বোঝা যায়, এ সব সৌভাগ্যবান ও বতীরা ট্যাক্সিতে বা নিজেদের গাড়িতে এসেছে। জামাকাপড়ের সঙ্গে, চুলের পাটও ঠিক আছে। আর যারা গাড়ি নিয়ে সরাসরি প্ল্যাটফরমের গায়ে চলে যাচ্ছে, তাদের তো কথাই নেই। বৃষ্টির জন্য তাদের ভাবনা নেই।
কিন্তু তা-ই কী? এর নাম কলকাতা। বৃষ্টি ভেজা কলকাতায় আবার গাড়ি চলা চাই, তবে তো। মাঝপথেই হয়তো, কারবোরেটর এক টোক জল খেয়ে, বিগড়ে বসে রইল। তারপরে ঠ্যালার নাম বাবাজি। তখন মনে হবে, সরকারি বড় বড় গাড়িই ভাল। ভিজে হলেও, গন্তব্যে পৌঁছনোর আশা থাকে।
উদিত বুকস্টলে দাঁড়িয়ে, ম্যাগাজিন দেখতে দেখতে, এইরকম সাত-পাঁচ ভাবছিল। মাঝে মাঝে লোকজনের দিকে দেখছিল। প্ল্যাটফরমে গিয়েও সেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সেখানে আরও ভিড়। অল্প পরিসরে লোক বেশি, মালপত্রের গাদাগাদি। তার চেয়ে এখানেই ভাল। ওর নিজের ঘাড়ে একটা মাত্র বড় ব্যাগ, তাতেই ওর দরকারি সবকিছু আছে। দাড়ি কামাবার জিনিসপত্র থেকে, নখ কাটবার নরুণ পর্যন্ত।
কথাটা ভেবে, উদিতের হাসি পেল। নরুণ পর্যন্ত আছে, কিন্তু জামাকাপড়ের বহর সেই পরিমাণে, সত্যি হাস্যকর। নেহাত শীতকাল না, তা-ই রক্ষে। আরও গোটা দুয়েক প্যান্ট, খান তিনেক জামা, সবই সস্তা আর মোটা। একজোড়া হাওয়াই চপ্পল। তার সঙ্গে জাঙি গেঞ্জি মিলিয়ে চার-পাঁচ পিস! যথেষ্ট। অনেক গরিব মানুষের থেকে অনেক বেশি। চপ্পলটার কথা মনে হতেই, পায়ের দিকে তাকাল ও। এখন ওর পায়ে বুট জুতো। মোটা লেদারের জুতোজোড়া ভিজে এখন ওজন দাঁড়িয়েছে, কেজি দশেক। গাড়িতে উঠে, আগেই এটাকে ছাড়তে হবে, ব্যাগ থেকে বের করে চপ্পল পরতে হবে। সেইভাবেই জামা প্যান্টও বদলে নিয়ে, কোথাও শুকোতে দেবার চেষ্টা করতে হবে। তারপরে দেখা যাক, কত বড়লোক হতে ও যাত্রা করেছে।
কথাটা মনে হতেই, এই বর্ষার মতোই বিরক্ত আর তিক্ত হয়ে উঠল উদিতের মন। লোকে কাজের জন্য আসে কলকাতায়, ওকে ফিরে যেতে হচ্ছে কলকাতার বাইরে। না, কলকাতায় কোনও চাকরি নেই। কলকাতায় কোনও কাজ নেই। কলকাতায় আছে কেবল কথা। কে যেন লিখেছিলেন, কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে। বিরক্তির এইসব কবিতা। যখন কবিদের যা মনে আসবে, তখন তাই লিখবেন, তারপর মরোগে পাঠকেরা। তার চেয়ে বলা ভাল, কলকাতা হবে কোটি কোটি মানুষের শহর, গাদাগাদি গাঁজাগাজি কাড়াকাড়ি মারামারি। একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের শহর। যেখান থেকে মানুষ প্রতি মুহূর্তে পালাতে চাইবে।
আসলে, উদিতের এটা আঙুরফল টকের মতো রাগের মনোভাব। যা পাওয়া যায় না, তাই শেষ পর্যন্ত খারাপ। কলকাতা ছেড়ে যেতে হচ্ছে, সেই দুঃখে আর বিরক্তিতেই ওর এসব মনে হচ্ছে। কলকাতাতেই ও থাকতে চেয়েছিল, একটা কোনও কাজ নিয়ে। অনেক দিনের চেষ্টাতেও কিছু হল না। এমনকী, উদিত নিজে চেয়েছিল, মোটর ড্রাইভারের কাজ করতে। তাতে আবার দাদার আপত্তি।
তার বক্তব্য, এতটা নীচে নামার কী দরকার। এতটা জলে পড়ার মতো অবস্থা তো আসেনি। বাড়ির অবস্থা এত খারাপ না, কোনওরকমে চলে যাবে যাই হোক, বাবার নামে চা বাগানের যা শেয়ার আছে, তাতে এখনও বছরে ডিভিডেন্ড হিসাবে প্রায়, চার-পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া যায়। দাদা নিজেও, বাড়িতে মাসে প্রায় দেড়শো-দুশো টাকা পাঠায়।
সেটা উদিতের ভালই জানা আছে। তার জন্য, মোটর ড্রাইভারিটা ছোট কাজ কেন, নীচে নামারই বা কী আছে। এ ধরনের ভদ্রলোকের জীবনযাপনে বা বোধে, ওর কোনও আস্থা নেই। অবিশ্যি, গাড়ি চালানো বিদ্যেটা ও কোনওদিনই, জীবিকার জন্য শেখেনি। ওটা একটা হয়ে যাওয়ার ব্যাপার। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থেকে, এর তার গাড়ি চালিয়ে, চালানোটা শেখা হয়ে গিয়েছে। এবং বেশ ভালভাবেই শেখা হয়েছে। যে কোনও পেশাদার ভাল ড্রাইভারের থেকে, ওর শেখাটা আরও কয়েক ডিগ্রি ওপরে। কারণ ও জীবিকার জন্য শেখেনি। গাড়ি চালানোটাকে, একটা সহজ খেলনার মতো কবজা করতে চেয়েছিল, পেরেছেও। স্টিয়ারিং ধরে বসলে, ও নতুন মানুষ হয়ে ওঠে। যদিও আজ অবধি কোনও লাইসেন্স করা হয়নি। কারণ, তার কোনও দরকার পড়েনি।
কিন্তু সত্যি কি, ভদ্রতাবোধের এই চিন্তাটা, নিতান্ত বাস্তববোধ আর মনের উদারতা থেকে এসেছে উদিতের মনে। নাকি আসলে কলকাতায় থাকতে পারার জন্যই, যা পারা যায়, তার জন্যই এই মনোভাব। এ কথা নিজের কাছে একটা প্রশ্নের মতো এসে দাঁড়াতেই, রেখার কথা ওর মনে পড়ে গেল। রেখা বউদির বোন, ওরা কলকাতায় থাকে। আসলে, উদিতের কাছে, এক হিসাবে দেখতে গেলে, এখন কলকাতার আর এক নাম বোধ হয় রেখা। কে জানে, বেকার ভাইকে দাদা হয়তো সেজন্যই আরও তাড়াতাড়ি কলকাতা থেকে পাঠিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
উদিতের মন তখন অন্যদিকে বাঁক নিল। একটু কুটিল আর জটিল দিকে। বউদি কোনওরকমে দাদাকে ওর বিরুদ্ধে বলেনি তো। রেখার সঙ্গে ওর মেশামেশি, রেখার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, সিনেমা দেখতে যাওয়া, এ সব হয়তো ইদানীং বউদির আর ভাল লাগছিল না, দাদাকে নানারকম ভাবে তাই হয়তো বলেছে। দাদা তো আর সারাদিন দেখতে আসছে না, উদিত কোথায় যাচ্ছে, কে বাড়িতে আসছে, কার সঙ্গে ও বেড়াতে যাচ্ছে। দাদা বউদি হয়তো শলাপরামর্শ করেই ওকে তাড়াল।
কিন্তু, না কথাটা ঠিক মনে ধরল না। বউদির পূর্বাপর কোনও ব্যবহারেই এ ধরনের কিছু বোঝা যায়নি। বরং অন্যদিকেই যেন, ইয়ার্কি ঠাট্টার ঝোঁক দেখা যেত। দাদার সঙ্গে, এ সব বিষয়ে হয়তো কোনও কথাই হত না, হলেও, সেটা নেহাতই হাসির পর্যায়ে পড়ে। কেনো, রেখা তা হলে, উদিতকে কিছু বলত। এ সব ক্ষেত্রে, যদি সাবধানতার দরকার হয় তা হলে মেয়েদেরই আগে বলা হয়, তাদের সাবধান করা হয়। বাড়িতে, দিদি আর বোনদের ক্ষেত্রেও তাই দেখা গিয়েছে। এটা ভাল হচ্ছে না, বা, এটা মন্দ হচ্ছে, আগেই বলা হয়। বউদিদি যদি সেরকম কিছু মনে করত, তা হলে, নিজের বোনকে সে আগেই কিছু বলত।
তবে এর মধ্যে একটা কথা আছে। বলবার মতো কোনও অবস্থার সৃষ্টিই হয়নি। রেখার সঙ্গে উদিতের এমন কিছু ঘটেনি বা দেখাও যায়নি, যাতে কিছু বলা যায়। উদিতের যেমন একটা ভাল লাগার ব্যাপার ছিল, রেখারও সেইরকম। কলকাতায় এসে, প্রথম পরিচয়ের আড়ষ্টতা কেটে যাবার পরে, এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, ওদের দুজনের দুজনকে ভাল লাগছে। দাদার বাসা থেকে, তার শ্বশুরবাড়ি বেশি দূরে না। রেখার পক্ষে যাতায়াত, বিশেষ অসুবিধার ছিল না। উদিতের মনে আছে, রেখা একদিন বিকালে আসার পরে, বউদি হেসে বলেছিল, কীরে রেখা, এত ঘন ঘন আসছিস কেন?
রেখা অবাক হয়ে বলেছিল, ঘন ঘন আবার কী, এরকমই তো আসি তোমার বাড়িতে।
বউদির গলা আর একটু রহস্যে তরল হয়ে উঠেছিল, বলেছিল, মোটেই না, দিদির বাড়িতে তো এত টান আর দেখিনি।
রেখা বলেছিল, দেখ দিদি, এরকম বলো না, তা হলে আর আসব না।
বউদি হেসে উঠেছিল, বলেছিল, আহা চটছিস কেন। আসলে আমার দেওরটি তো কোনওদিক থেকে খারাপ না। মেয়েদের একটু টনক নড়তে পারে।
উদিত অবিশ্যি তখন সামনে ছিল না, কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে সব কথাই শুনতে পাচ্ছিল।
রেখা বলেছিল, কাঁচকলা তোমার দেওর। দেখতে মাকাল ফল গুণে বেকার। আমার কোনওদিন টনক নড়বে না।
ইস, তোর যে দেখি অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না।
অহংকার কীসের, যা সত্যি, তাই বললাম। নেহাত, কলকাতায় তোমার দেওরের কোনও বন্ধুবান্ধব নেই, রাস্তাঘাট চেনে না, কোন বাস ট্রাম কোথায় যাবে জানে না, অজ পাড়াগেঁয়ে বাঙাল, তাই একটু সঙ্গে যাই।
তারপরে আর বিশেষ কিছু শোনা যায়নি, কেবল একটু হাসি। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হবার পরে, উদিত কিছু বলেনি। যেন ও দুই বোনের কথাবার্তার কিছুই শোনেনি। পরে রাস্তায় বেরিয়ে, উদিত আর থাকতে পারেনি। যদিও, রেখার ব্যবহারে ওর কিছুই খারাপ মনে হয়নি, তবু না বলে পারেনি, দেখতে মাকাল ফল, গুণে বেকারের সঙ্গে বেরোতে, তোমার খারাপ লাগে না তো রেখা?
রেখা চমকে উদিতের দিকে তাকিয়েছিল। তারপরে, রাস্তার ওপরেই খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। রেখার হাসিটা এমনই, উদিতের মনের কোণে কিছু থাকলেও, তা ধুয়ে গিয়েছিল। রেখা বলেছিল, আপনি সব শুনেছেন বুঝি?
তা শুনেছি।
শুনেও, আমার কথায় চটে গেছেন?
চটিনি, মানে—
রেখা বলে উঠেছিল, বিশ্বাস করেছেন, আমি সত্যি তাই ভেবে বলেছি?
না না, তাও ঠিক না।
কিন্তু বলব না-ই বা কেন শুনি? দিদি কেন আমাকে ওরকম করে বলছিল। যেন আপনার থেকে সুপুরুষ আর হয় না।
তখন উদিতের নিজেরই হাসি পেয়েছিল। সব ব্যাপারটাই ঠাট্টা। এইভাবেই ওদের দুজনের মধ্যে, কিছুটা ঘনিষ্ঠতা জমে উঠেছিল। যদিও সেটা দুয়ে দুয়ে চারের মতো, একটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকেই যাচ্ছিল না। কিন্তু মনে মনে কোথাও দুজনের, কিছু একটা ঘটছিল। তার প্রমাণ, দুজনের সঙ্গে দুজনের দেখা হলে, চোখে মুখে ঝলক ফুটে উঠত। দেখা না হলে, দুজনেরই খারাপ লাগত। বউদির ঠাট্টায় সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠত।
আরও বেশিদিন কলকাতায় থাকলে, কী হত বলা যায় না। কিছু হওয়ার আগেই, দাদার সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, এভাবে কলকাতায় বসে থাকলে কিছু হবে না। তার চেয়ে বাড়ি যাওয়াই ভাল। ওদিকেও, বাবার চিঠি এল, একটা বড় চা বাগানে, উদিতের মোটামুটি একটা ভাল চাকরি এখন হতে পারে। ভবিষ্যতে ওপরে ওঠবার সম্ভাবনা আছে।
ওপরে না, একেবারে স্বর্গে উঠে যাবে উদিত। কলকাতা ছেড়ে যাবার ওর একেবারেই ইচ্ছা ছিল না। বাবা পরিষ্কার করে লেখেননি, চা বাগানের চাকরিটা কী। চা বাগানেই যদি, চাকরি করতে হবে, তা হলে আর কলকাতায় আসবার দরকার কী ছিল। উত্তরবঙ্গে থেকে গেলেই হত।…
.
উদিতের গায়ে খানিকটা জলের ছিটে লাগতে, বিরক্ত হয়ে একটু সরে দাঁড়াল। দেখল, একটি মেয়ে, রেনকোট গায়ে রেখেই ম্যাগাজিনের ওপরে ঝুঁকে পড়েছে। তার কোট থেকেই, ওর গায়ে জল পড়েছে। মেয়েটি ওর দিকে এক বার তাকাল মাত্র। আবার ম্যাগাজিনের ওপর ঝুঁকে পড়ল। উদিত বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলল, মহারানি এলেন। রংচঙে রেনকোট গায়ে দিয়ে, সং সেজে দাঁড়িয়ে থাকবেন, তা থেকে কারোর গায়ে জল পড়লেও ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন ওটা আর গায়ের থেকে খোলা যায় না।
মেয়েটির দৃষ্টি পড়েছে তখন, উদিত যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনের বইগুলির ওপর। সে আরও এগিয়ে এল, আর উদিত রীতিমতো বিরক্ত হয়ে, অন্যদিকে সরে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি ফিরে চেয়েও দেখল না। তার ভেজা বর্ষাতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটা যেন, উদিতকে সরিয়ে দেবার জন্যই। উদিত একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে, ঘাড় কাত করে মেয়েটির দিকে তাকাল। হাতে একটি মাঝারি ব্যাগ ছাড়া, কিছু নেই। বর্ষাতির হাতা গুটিয়ে নিয়েছে, তাই ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে। কবজির ঘড়িটা বেশ দামি মনে হল। দু হাতের নখ সযত্ন লম্বিত এবং রঞ্জিত। ঠোঁটে চোখেও রং, চুল ঘাড় ছাড়িয়ে নীচে নামেনি। দেখতে অবিশ্যি মেয়েটি সুন্দরী বা রূপসী, সেই জাতীয়। টানা চোখ, টিকোলো নাক, ফরসা রং, শরীরের গঠনটিও ভাল। বয়স তেইশ-চব্বিশ হবে। কিন্তু এ সব পোশাক-আশাকের মেয়ে দেখলেই, উদিতের বিরক্ত লাগে। বড়লোকি ফ্যাশান। দিশি মেমসাহেব।
হঠাৎ মেয়েটি এক বার ঘাড় ফিরিয়ে উদিতকে দেখল। বোধ হয়, একটি লোককে তার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে দেখে, না তাকিয়ে পারল না। উদিতের আপাদমস্তক দেখল মেয়েটি। উদিত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল, একটা সিগারেট ধরাল। মেয়েটি ইতিমধ্যে দেশি আর বিদেশি, ইংরেজি আর বাংলা, প্রায় আধ ডজন ম্যাগাজিন হাতে তুলে নিয়েছে। নিয়ে, স্টলের লোকটির দিকে বাড়িয়ে দিল। লোকটি সব দেখে বলল, সতেরো টাকা বারো আনা।
মেয়েটি ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পার্স বের করল, দুটো দশ টাকার নোট এগিয়ে দিল। খুচরো আর ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে, চলে যাবার আগে, পিছন ফিরে স্টেশনের ঢোকবার দিকটা দেখল। মনে হল যেন, দেখার মধ্যে একটা সতর্কতা আছে। তারপরে, সবদিকেই এক বার চোখ বুলিয়ে, প্ল্যাটফরমের গেটের দিকে এগিয়ে গেল। উদিত দেখল, ওর যে প্ল্যাটফরমে যাবার কথা মেয়েটি সেদিকেই গেল।
এই সময়েই স্টলের লোকটি বলে উঠল, একটু সরে দাঁড়ান মশাই।
স্বরে স্পষ্ট বিরক্তি। উদিতের নিজেকে কী রকম অপমানিত মনে হল। ও তাড়াতাড়ি সরে গেল, আর সেই মেয়েটির ওপর রাগ হতে লাগল। নিশ্চয়ই লোকটা, ওর ওপর রেগে গিয়েছে, ও এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, একটা কাগজও কেনেনি। আর একজন ওকেই সরিয়ে দিয়ে প্রায় কুড়ি টাকার কাগজ কিনে নিয়ে গেল। উদিতের মনে হল, টাকা থাকলে ওরকম ডাঁট সবাই দেখাতে পারে। তার ওপরে আবার মেয়ে! নিশ্চয়ই নিজের আয়ের পয়সায়, ওরকম করকরে নোট বের করে, রঙিন ম্যাগাজিন কেনা যায় না। ও প্ল্যাটফরমের দিকে এগিয়ে গেল।
যা ভেবেছিল, তাই, প্ল্যাটফরমে একটু গা বাঁচিয়ে দাঁড়াবার জায়গা নেই। এখন ইলশেগুঁড়ি ছাট বৃষ্টি হচ্ছে। সবাই শেডের তলায় থাকবার চেষ্টা করছে। তাই ভিড় আরও বেশি। মালে মানুষে একেকার। উদিত হাত তুলে ঘড়ি দেখে অবাক হল। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি আছে গাড়ি ছাড়তে, অথচ এখনও প্ল্যাটফরমে গাড়ি দিল না। মাইকে অনবরতই, হেঁড়ে গলায় কিছু না কিছু শোনা যাচ্ছে। কী যে বলে, উদিত কিছুই বুঝতে পারছে না, বুঝতে চায়ও না। কেবল গোলমাল খানিকটা বাড়তি মনে হচ্ছে মাইকের জন্য।
ফার্স্ট ক্লাস কোচ যেখানে থাকতে পারে, সেই মেয়েটি সেইরকম জায়গাতে দাঁড়িয়েই, মাথা নিচু করে ম্যাগাজিন দেখছে। কিন্তু এই মেঘলা দিনে, এখন তার চোখে সানগ্লাস আঁটা। চোখের জ্যোতি বোধ হয় বেশি। ঠোঁট বেঁকে উঠল উদিতের। ও আগের দিকে এগিয়ে গেল।
গাড়ি যখন ছাড়বার সময় হল, তখন প্ল্যাটফরমে গাড়ি এল। তারপরের চেহারাটা অতি কুৎসিত। ধাক্কাধাক্কি, মারামারি, চিৎকার, জায়গার জন্য ঝগড়া! উদিত দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখল। যাদের রিজারভেশন আছে তাদেরও তাড়া কম না। ও জানে, সকলের ওঠা হয়ে গেলে, কোনও একটা রিজারভ ছাড়া কামরায় ধীরে সুস্থে উঠবে। বসতে পেলে ভাল, না হলে দাঁড়িয়েই যাবে। কোনও এক জায়গায় গিয়ে, নিশ্চয়ই একটু জায়গা হয়ে যাবে। ওর কোনও ভাবনা নেই।
কিন্তু এই মারামারি ধাক্কাধাক্কির চেহারাটা দেখলে, ওর মনে হয়, কারোর জন্য কারোর কোনও মায়া দয়া দায়িত্ব নেই। এই সময়টার জন্য যত বড় বড় কথা, সভ্যতা ভদ্রতা সব কোথায় যেন হারিয়ে যায়। প্রত্যেকটা মানুষকেই কেমন হিংস্র, আর একই সঙ্গে অসহায় মনে হয়।
উদিত ট্রেনের পিছন থেকে সামনে পর্যন্ত এক বার টহল দিল। ফার্স্ট ক্লাসের দিকে এক বার বক্র দৃষ্টি হানল। আর মনে মনে বলল, টাকার বড় দরকার, তা না হলে চলে না। লোকগুলো আর যাই হোক নিঝঞ্ঝাটে যাবে।
তারপরে ভাবল, থার্ড ক্লাসের মেজাজ ওখানে নেই। ওখানে সবাই সবাইকে নাক সিটকোচ্ছে, সবাই সকলের থেকে বড়, কারোরই গ্যাদা ঘোচে না। সেকেন্ড ক্লাসটা হচ্ছে সব থেকে খারাপ। নামে সেকেন্ড ক্লাস, কিন্তু ব্যবস্থা থার্ড ক্লাসের থেকে খারাপ। বসবার জায়গা ছাড়া ওখানে রিজারভেশন হয় না। নামটাই যা একটু গালভারী, অবস্থাটা না ঘরকা না ঘাটকা। এর নাম মধ্যপন্থা, ভদ্রলোকের ভদ্রতা।
উদিত শেষ পর্যন্ত একটা কামরায় উঠল। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে, তিলধারণের ঠাঁই নেই। নিজেকেই বেকুফ মনে হতে থাকে। যেখানেই তাকাও, হয় তোক বসে আছে অথবা মালপত্র এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছে, একটুও বসবার জায়গা নেই। জিজ্ঞেস করলে এক জবাব, লোক আছে দাদা।
দাদাও সেটা দেখবে, গাড়িটা ছাড়ুক। যারা আত্মীয় বিদায় দিতে এসে, জায়গা দখল করে বসে আছে, তারা নামলে কিছু জায়গা হবে। মালপত্রও গোছগাছ করে সরানো যাবে, কিছু বাঙ্কে তোলা যাবে। গাড়িটা না ছাড়লে, সুবিধা হবে না।
যে জায়গাটা সবথেকে বেশি সন্দেহজনক মনে হল, সে জায়গায় গিয়ে ও দাঁড়াল। একটি গোটা পরিবার, পুরো দুটো লম্বা বেঞ্চ আর দুটো বাঙ্ক দখল করে আছে। একটি দশ-বারো বছরের মেয়ে একদিকে শুয়ে আছে। যেন কোলের শিশুটি ঘুমোচ্ছে। তেমনি ব্যাঙ্কের ওপর আট-দশ বছরের একটি ছেলেও শুয়ে আছে। নীচে মাঝখানে মালপত্র! আঠারো থেকে পঞ্চাশ, মহিলার সংখ্যা চার। পুরুষ তিন, দুই প্রৌঢ়, এক যুবক। যুবকটি বিশ-বাইশ এবং আঠারো-উনিশ বছর বয়স মেয়ে দুটির সঙ্গে কথা বলছে। এবং উদিতকে এক বার বাঁকা চোখে দেখল। যে-দৃষ্টির বক্তব্য হল, এখানে সুবিধে হবে না।
উদিত মনে মনে বলল, দেখা যাক গাড়িটা ছাড়ুক।
এ সময়ে ওয়ার্নিং বেল বাজল। কামরা জুড়ে আবার ব্যস্ততা দেখা দিল। দুই প্রৌঢ়ের মধ্যে একজন ব্যস্ত হয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন, বললেন, চলি তা হলে রায়মশাই।
অপরজন, হাঁ হাঁ, আসুন। এই জল বাদলায় এতটা কষ্ট করে…
লো না, তাতে আর কী হয়েছে। কই গো, এসো।
এক প্রৌঢ়া গল্প ছেড়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, হ্যাঁ, চলো। সুবোধ আয়।
উদিত হিসাব করল, তিন জন নেমে যাচ্ছে। এখন প্রণামের পালা শেষ হলে, তিন জন দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তা হলে, আটজনের জায়গায় দাঁড়াল মহিলা তিন, (দুটি যুবতী) পুরুষ এক, খোকা-খুকু দুই, সাকুল্যে ছয়। একটা জায়গা হওয়া উচিত। মনে হয়, বর্ধমান বীরভূম ছাড়িয়ে যেতে যেতে কিছু ফাঁকা হবে। যদিও সুবোধ নামক যুবকটি যাবার আগে বলে গেল, মেসোমশায়, আপনারা ভালভাবে জায়গা নিয়ে বসুন।
অর্থাৎ এখানে আর কাউকে বসতে দেবেন না। উদিত আর এক বার সমস্ত কামরাটা তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিল, আর কোথাও এক জনের বসবার জায়গা আছে কি না। এক জায়গায় আছে, তবে সেখানে একটি বছরখানেকের শিশুকে শোয়ানো আছে। আবার ঘণ্টা বাজল। হুইসল শোনা গেল, গাড়ি দুলে উঠল। এই পরিবারটি জানলায় দাঁড়িয়ে তখনও সবাইকে বিদায় দিতে ব্যস্ত। কেবল উদিতের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে আছে, বারো আর দশের খুকু-খোকা। উদিত মনের সব বাধা ঝেড়ে ফেলে, একটা ধারে বসল। জানলার ধারটা ছেড়ে দেওয়াই উচিত, কেনো এরাই যখন জায়গাটা আগে দখল করেছে।
বসতে না বসতেই রায়মশাই নামক প্রৌঢ় ভদ্রলোক হুমকে উঠলেন, ও মশাই ওটা আমাদের জায়গা।
গাড়ি তখন চলছে। বারো বছরের ফ্রক পরা খুকু উঠে বসেছে। তার পাশে প্রৌঢ়া গিন্নি। দুই মেয়ে তখনও পঁড়িয়ে, বিরক্ত চোখে উদিতকে দেখছে। খোকা বাঙ্ক থেকে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল। বোধ হয় বাবাকে সাহায্য করার জন্য নেমে এল। উদিত বলল, আপনাদের জায়গা ছেড়েই বসেছি।
তার মানে?
উদিত সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, আপনাদের ছজনের জায়গা ঠিকই আছে। আট জন তো এখানে ভালভাবেই বসতে পারে।
ভদ্রলোক ক্রুদ্ধ হলেন, একই সঙ্গে অসহায়ভাবে কন্যা দুটির দিকে তাকালেন। দুই কন্যা উদিতকে, বিরক্ত চোখে দ্রুকুটি করল। বড় কন্যা বলল, এ জন্যই রিজারভেশনের দরকার হয়। তা হলে আর এ সব বাজে ঝামেলা হয় না।
পিতা বললেন, ঝামেলা বলে ঝামেলা, যাচ্ছেতাই। সুবোধ-টুবোধ থাকলে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।
অর্থাৎ সুবোধ থাকলে, উদিতের বসা হত না। কথা হয়তো ও বলত না, কিন্তু ইঙ্গিতগুলো সহ্য করতে না পেরে, পিতার উদ্দেশে বলল, রিজারভ করলে তো আট জনেই বসত। তার থেকে এ আর খারাপ কী হল বলুন।
ভদ্রলোক আর সে কথার জবাব দিলেন না। উদিতের পাশ ঘেঁষে এমনভাবে বসলেন, যেন এখান থেকে তিনি গোটা পরিবারকে উদিতের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন, এইরকম একটা ভাব। মেয়েরা উলটো দিকে বসল। একদিকে মা, দুই বড় কন্যা। আর একদিকে পিতার পাশে খোকা-খুকু। মেয়েদের ঘাড় বাঁকানো, বিনুনি ফেরানো, ধপাস করে বসা, সমস্ত ভঙ্গির মধ্যেই, একটা বিক্ষোভ ফুটে উঠল। সকলের ভাবভঙ্গি দেখে উদিতের অস্বস্তি হতে লাগল। ও যেন সহজভাবে বসে থাকতে পারছে না। মনে হল, এর চেয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া ভাল। কী দরকার এত মেজাজ খারাপ আর বিক্ষোভ দেখার। উদিত প্রৌঢ় ভদ্রলোকের দিকে ফিরে, বেশ সহজ গলাতেই বলল, আর আপনাদের যদি অসুবিধে হয়, তা হলে আমি সরে গিয়ে দাঁড়াতে পারি।
কথাটা ও এত আচমকা বলল যে, ভদ্রলোক ঠিক যেন বুঝে উঠতেই পারেননি, কেবল শব্দ করলেন, অ্যাঁ?
পরিবারের বাকিরাও অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। ভদ্রলোক তাকালেন কন্যাদের দিকে, এবং স্ত্রীর দিকে। দুই কন্যাই কেমন যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল। উদিত উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিতা বললেন, না থাক, বসেছেন যখন…।
উদিত দেখল, কন্যাদের চোখে, পিতার কথার অনুমোদন ফুটে উঠল, গিন্নির মুখেও! উদিত মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, পিতার এটুকু ভদ্রতাবোধ আছে। আশেপাশের বেঞ্চের যাত্রীরা একটু তাকিয়ে দেখল। অবসরে আবার সবাই যে যার কথায় মেতে গেল। সকলের কথা থেকে, উদিত বুঝতে পারল, অধিকাংশ যাত্রীর মনেই, একটা বিশেষ উদ্বেগ রয়েছে, শেষ পর্যন্ত গাড়িটা তাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারবে কি না। কারণ বন্যা পরিস্থিতি মোটেই ভাল না।
এতক্ষণ কথাটা উদিতের এক বারও মনে আসেনি। অথচ উত্তরবঙ্গ আর বিহারে জলস্ফীতির বিষয়, গতকালই ও একবার কাগজে দেখেছিল যেন। কিন্তু পরিস্থিতি যদি সেরকম হত, তা হলে, দাদা কি কিছু বলত না। কিংবা, দাদার হয়তো খেয়াল হয়নি। এখন ও কান পেতে যাত্রীদের কথা শুনে বুঝতে পারছে, অনেকেই বন্যার কথা বলাবলি করছে। অবিশ্যি, অধিকাংশ লোকের মনেই আশা ব্যাপার তেমন গুরুতর না। তা হলে, ট্রেন হয়তো ছাড়ত না।
পাশ থেকে প্রৌঢ় যাত্রী বললেন, কৃষ্ণা, কাগজে কী লিখেছে ভাল করে দেখেছিস?
বিশ বাইশ বছরের মেয়েটি বলল, সেরকম কিছু না, তবে গঙ্গার জল যেরকম বেড়েছে, তাতে যে কোনও সময়ে, একটা বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে।
আঠারো-উনিশ বলল, শুধু গঙ্গা নয় দিদি, ওদিকেও জল বেড়েছে। জলঢাকা তিস্তা মহানন্দা, আজকের কাগজে আছে। লিখেছে, সবাইকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে।
আশ্চর্য, উদিত ব্যাপারটা এক বারও ভাবেনি, ওর মাথাতেই আসেনি। অবিশ্যি, ও একলা যুবক, পথ চলতে কোনও বিষয়েই দুশ্চিন্তা আসে না। রায়মশাই বললেন, তাই তো রে মীনা, আরও কয়েক দিন কলকাতায় থেকে গেলেই যেন ভাল হত।
বলে তিনি গিন্নির উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে তাকালেন। যার নাম মীনা, সে বলল, তুমিই তো ব্যস্ত হয়ে উঠলে।
ব্যস্ত কি আর সাধে হলাম, শুনলি তো, কৃষ্ণার আবার…।
কথাটা শেষ করলেন না। কৃষ্ণা নামী যুবতী যেন একটু রাঙা হয়ে উঠল, আর মীনা তার দিকে চেয়ে হাসল। ব্যাপারটা বোঝা গেল না। রায়মশাই আবার জিজ্ঞেস করলেন, মেখলিগঞ্জের কথা কিছু লিখেছে কাগজে?
কৃষ্ণা বলল, হ্যাঁ, সেখানকার লোকদেরও যে কোনও সময়েই বিপদের জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
রায়মশাই প্রায় অসহায়ের মতো বললেন, বোঝ এখন।
তারপরেই তিনি যেন একটা অবলম্বনের জন্যই, হঠাৎ উদিতকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় যাবেন?
উদিত বলল, জলপাইগুড়ি।
উদিতেরও এবার স্বাভাবিকভাবেই একটু কৌতূহল দেখা দিল। রায়মশাইদের গন্তব্য কোথায়, সেটা ওর জানবার ইচ্ছা হল। ওকে যখন জিজ্ঞেস করেছে, তখন ওরও জিজ্ঞাসার কোনও সংকোচের কারণ নেই। জিজ্ঞেস করল, আপনারা কোথায় যাবেন?
মেখলিগঞ্জ।
মীনা বলে উঠল, কিন্তু জলপাইগুড়ির আশেপাশের অবস্থা খুব ভাল না, কাগজে সেইরকম লিখেছে।
উদিতের সঙ্গে একবার মীনার চোখাচোখি হল। উদিত রায়মশাইকে বলল, সেরকম বুঝলে, শিলিগুড়িতেই থেকে যাব। সেখানেও আত্মীয়স্বজনের বাড়ি আছে। কিন্তু আপনাদের মেখলিগঞ্জ যাবার রুট কী, মানে ট্রেনে যাবেন না অন্য কিছুতে?
রায়মশাই বললেন, আগে জলপাইগুড়িতক তো যাই, যদি ট্রেন যায়। তা হলে, সেই গাড়িতেই, একেবারে হলদিবাড়ি পর্যন্ত, তারপর সেখান থেকে বাসে করে যাব।
মীনা বলল, যদি রাস্তা ডুবে গিয়ে না থাকে। তিস্তা আমাদের পার হতেই হবে। তার চেয়ে, বার্ণেসঘাটে গিয়ে, আমরা তো চ্যাংরাবান্ধা হয়েও যেতে পারি বাবা।
রায়মশাইয়ের মুখের রেখায় উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার ছায়া ফুটে উঠল। ঘাড় নেড়ে বললেন, চ্যাংরাবান্ধা থেকে রাস্তা সুবিধার না।
উদিতের মনে পড়ে গেল, একটা গানের লাইন, চ্যাংরাবান্ধার রেশমি চুড়ি, পাইসা পাইসা দাম। তার মধ্যে লেখা আছে, চ্যাংরাবন্ধুর নাম।..মানে যুবক বন্ধুর নাম।
কৃষ্ণা তার বাবার উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে চেয়ে বলল, এত ভাবছেন কেন বাবা, কত লোক তো যাচ্ছে। সকলের যা হবে, আমাদেরও তাই হবে।
রায়মশাই বললেন, সেটা ঠিক। কিন্তু দুশ্চিন্তা তো যেতে চায় না।
উদিত এক মুহূর্ত দ্বিধা করে, একটা সিগারেট ধরাল। ওরকম বহু বয়স্ক লোকের সামনে সিগারেট খেয়ে থাকে। উদ্বেগে আর দুশ্চিন্তাতেই রায়মশাই চুপ করে থাকতে পারছেন না। একটি অল্প বয়সের যুবক তাঁর সামনে সিগারেট খাচ্ছে, সেটা তিনি চেয়েও দেখলেন না। উদিতই বরং অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। রায়মশাই ওকে জিজ্ঞেস করলেন, জলপাইগুড়িতে আপনাদের বাড়ি।
উদিত মুখ ফিরিয়ে বলল, হ্যাঁ।
শহরের ওপরেই?
হ্যাঁ।
অ! কলকাতায় কি চাকরি করেন না পড়েন?
উদিত বুদ্ধিমানের মতো জবাব দিল, কলকাতায় দাদা থাকেন, বেড়াতে এসেছিলাম।
রায়মশাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, বুঝেছি। জলপাইগুড়ি শহরে কোন পাড়ায় বাড়ি, মানে অনেকেই চেনাশোনা আছে কিনা। সেই জন্যই জিজ্ঞেস করছি।
গোলমেলে প্রশ্ন। এত কথা জানবার কী দরকার। ওই ধরনের বয়স্ক লোকদের এ সব বোঝানো যায় না। কৃষ্ণা মীনা যে বাবার কথায় একটু অস্বস্তি বোধ করছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু রায়মশাইয়ের মতো ব্যক্তিরা এটাকে একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন হিসাবেই মনে করেন। বরং না জিজ্ঞেস করাটাই অস্বাভাবিক। উদিত বলল, পুরকায়স্থ পাড়ায়।
কৌতূহলিত জিজ্ঞাসায় রায়মশাইয়ের কপালে রেখা সর্পিল হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করলেন, পুরকায়স্থ পাড়ায়? কার বাড়ি বলুন তো, আপনার বাবার নাম কী?
না, লোকটা জ্বালালে। এত পরিচয় পাড়ার কী আছে? ভদ্রলোক আবার বাবার নামও জিজ্ঞেস করছেন। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে উদিত বলল, বলরাম চট্টোপাধ্যায়।
রায়মশাই একেবারে আঁক করে উঠলেন, অ্যাঁ, বলরামবাবুর ছেলে? বলরাম চাটুয্যে মানে আদি নিবাস পাবনায় তো?
উদিত এটাই ভয় করেছিল। সিগারেটটা মাটিতে ফেলে, জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ।
রায়মশাই খুশি আর বিস্ময়ে হেসে তাঁর সমস্ত পরিবারের দিকে এক বার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর উদিতের দিকে ফিরে বললেন, কী আশ্চর্য, বলরামবাবু তো আমার বিশেষ পরিচিত, বলতে গেলে বন্ধু ব্যক্তি। আমি তো পুরকায়স্থ পাড়ার বাড়িতেও গেছি। আপনার–আপনি বলার কোনও মানে হয় না, তুমি মেজো না সেজো।
মেজো।
রায়মশাই নিজের মনেই ঘাড় নেড়ে বললেন, সেজোটি এখনও অনেক ছোট, মাঝে তো তোমার তিন বোন আছে না?
দুই বোন, এক দিদির বিয়ে হয়ে গেছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই হবে, তাই হবে। তোমার দিদির বিয়েতে যেতে পারিনি বটে, নেমন্তন্ন পেয়েছিলাম। তোমার মায়ের হাতের রান্না বড় ভাল।
কথাটা মিথ্যা না, কিন্তু উদিতের খারাপ লাগছে, একজন অভিভাবক জুটে গেল দেখে। তারপরে নাম জিজ্ঞাসা, রায়মশাইয়ের নিজের পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। রায়মশাই হেসে বললেন, দ্যাখ দিকিনি তুমি এত চেনাশোনা বাড়ির ছেলে, আর একটু হলেই তোমার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যাচ্ছিল।
উদিত হেসে বলল, আমি ঝগড়া করতাম না।
ওর কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। উদিত বুঝতে পারল না, এর পরে, রায়মশাই এবং রায়গিন্নিকে একটা প্রণাম করা উচিত কি না। একটা পারিবারিক পরিচয়ের কথা যখন জানাই গেল, এটাও একটা পারিবারিক নিয়মের মধ্যেই পড়ে। ওর নিজের মনের দিক থেকে কিছু যায় আসে না, প্রণাম না করলে হয়তো, রায়মশাই একটু মনে মনে কষ্ট পাবেন, অসামাজিক অভদ্র ভাববেন। অতএব, ও রায়মশাইকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল, বলল, পরিচয় যখন হয়েই গেল।
রায়মশাই খুশি হয়ে, উদিতের গায়ে হাত দিয়ে বললেন, আহা, তাতে কী হয়েছে, তাতে কী হয়েছে।
বললেন, কিন্তু মুখে একটি সন্তুষ্ট হাসি ফুটে উঠল। রায়-গিন্নিকেও প্রণাম করল উদিত। তিনি বললেন, আহা থাক না। বেঁচে থাকো বাবা।
রায়মশাই এবার উৎসাহের সঙ্গে তাঁর ছোট ছেলের হাত টেনে ধরে সরিয়ে নিয়ে বললেন, খোকা, সরে বসো। তুমি ভাল হয়ে বসো উদিত।
এবার উদিতেরই লজ্জা করতে লাগল। বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে।
উদিতের হাসি কৌতুকোজ্জ্বল চোখ এক বার কৃষ্ণা মীনার দিকেও পড়ল। ওরাও হাসি চাপতে পারল না। রায়মশাইও হেসে বললেন, এতে আর হাসির কী আছে। ওরকম একটু হয়ে যায়, না কী বলো হে উদিত।
নিশ্চয়।
মীনা বলল, সুবোধদা কী বলছিল জানেন বাবা?
কী?
কৃষ্ণা হেসে ধমক দিয়ে বলল, যাঃ মীনা, ও কথা আবার বলে নাকি?
মীনা বলল, তাতে কী হয়েছে। এখন তো জানাশোনা হয়ে গেছে।
বলে, উদিতের দিকে চেয়ে হেসে বলল, সুবোধদা উদিতবাবুকে দেখিয়ে বলছিল, এ ঠিক বসবার তালে এসেছে, খবরদার বসতে দিস না।
আবার একটা হাসির ঝংকার বাজল। সকলেই বেশ সহজ হয়ে উঠল।
.
আস্তে আস্তে উদিতের আর খারাপ লাগল না। ভাবল, তবু যা হোক, একেবারে মুখ বুজে যেতে হবে না। ওর সঙ্গে অবিশ্যি দু-তিনটি বই রয়েছে পড়বার জন্য। সব মিলিয়ে এখন পরিবারটিকে ওর ভালই লাগল। রায়গিন্নি খুবই কম কথা বলেন। রায়মশাই একটু বেশি, বোধ হয় এভাবেই ভারসাম্য রক্ষিত হয়।
কৃষ্ণা শ্যামবর্ণের ওপর, রোগা ছিপছিপে ভাবের। মাথায় বেশ বড় চুল আছে। বড় বড় চোখ দুটো উজ্জ্বল, কিন্তু শান্ত। তার ভাবভঙ্গিও শান্ত। মীনা সেই তুলনায়, একটু চঞ্চল, গায়ের রং ফরসা, চোখ তেমন বড় নয়, কিন্তু চাহনিতে একটা হাসির ছটায়, দেখতে ভালই লাগে। বারো বছরের হেনা লাজুক, ঠাণ্ডা, কিন্তু বড় হয়ে উঠছে, সে ভাবটা ওর শরীরে, চোখেমুখে সবখানে ছড়িয়ে আছে যেন। যদিও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বিশেষ বনিবনা হচ্ছে না। ইতিমধ্যে কয়েকবার, কোনও কিছু নিয়ে, হাত টানাটানি এবং ছোটখাটো গুঁতোগাতা হয়ে গিয়েছে।
রায়মশাইয়ের কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল, উদিতের বাবার সঙ্গে, তাঁর পরিচয় অনেক দিনের। পরিচয়টা এখানে নয়, পাবনাতে থাকতেই। রায়মশাইরাও পাবনার আদি বাসিন্দা। দেশ বিভাগের পরে সকলেই উত্তরবঙ্গের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। রায়মশাইয়ের কথা থেকে আরও জানা গেল, উদিতদের যে চা বাগানে শেয়ার আছে, ওঁরও সেখানে শেয়ার আছে, এবং এক সময়ে উদিতের বাবা এবং তিনি একসঙ্গে পরামর্শ করেই, শেয়ার কিনেছিলেন। রায়মশাই বললেন, ভাগ্য ভাল সে সময়ে কষ্টে ছিষ্টে কোনওরকমে শেয়ার কেনা হয়েছিল। তা না হলে এত দিনে সে টাকাও খরচ হয়ে যেত, কাজে কিছুই হত না। এখন তো তবু চায়ের দৌলতে, বছরে যাই হোক কিছু ঘরে আসে।
রায়মশাইয়ের কথা শুনে, উদিতের বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওর বাবাও মাঝে মাঝে রায়মশাইয়ের মতো শেয়ারের কথা বলেন। পাবনা থেকে সব বিক্রি করে দিয়ে যখন জলপাইগুড়িতে এসে আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল, তখনই শেয়ার কেনা হয়েছিল। অবিশ্যি তার জন্যও নাকি অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল, এবং জলপাইগুড়ির চা জগতের একজন ক্ষমতাবান বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ধরেই, শেয়ার পাওয়া সম্ভব হয়েছিল! উদিত শুনেছে, সেই বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে, ওদের কিঞ্চিৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। উদিত জানে, ওর বাবাকে সেই শেয়ারের ওপর নির্ভর করেইএক সময়ে সমস্ত সংসার এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালাতে হয়েছে। রায়মশাইয়ের কথায় বাবার কথারই প্রতিধ্বনি। এমনি নানান কথাবার্তার মধ্যে আবার বন্যা প্রসঙ্গ এল। রায়মশাই বললেন, থেকে যাবার উপায় নেই, কৃষ্ণার একটা বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে কিনা।
কৃষ্ণা লজ্জা পেয়ে হেসে, মীনাকে বলল, দেখছিস, বাবা ঠিক গল্প করবেনই।
উদিত মুচকে হাসল। রায়মশাই সেদিকে কান না দিয়ে বললেন, তোমার কী মনে হয় উদিত, গঙ্গা পর্যন্ত নিশ্চয় পার হওয়া যাবে!
উদিত বলল, আমার তো তাই মনে হয়।
মীনা বলে উঠল, বলা যায় না। কী একটা নদীর নাম করে যেন লিখছে কাগজে, কাটিহারের ওদিকে অবস্থা খুব সুবিধার না।
উদিত বলল, আমি ব্যাপারটা এত তলিয়ে ভাবিইনি। দাদাও নিশ্চয় ভাবেনি, তা হলে বোধ হয় আমাকে আসতে দিত না।
মীনা এ সময়ে উদিতের দিকে তাকিয়েছিল। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল, আর উদিতের মনে হল, মেয়েটা ওকে ভীরু যাদুগোপাল ভাবছে বোধ হয়। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি লেগে রয়েছে যেন।
রায়মশাই বললেন, তা বটে, তোমার তো আর জরুরি দরকার কিছু নেই। দুটো দিন দেখে বেরোলেই ভাল করতে।
উদিত বলল, আমার কী ভাবনা বলুন। যে কোনও অবস্থাতেই আমি ঠিক চলে যেতে পারব। বান বন্যাকে আমার তেমন ভয় নেই। আপনাদেরই হবে মুশকিল
উদিত কথাটা শেষ না করে, কৃষ্ণা মীনাদের দিকে এক বার তাকাল। রায়মশাইয়ের মুখে উদ্বেগ যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। বললেন, সেই তো ভাবছি বাবা।
মীনা উদিতের দিকে চেয়ে বলে উঠল, মুশকিল আসানের জন্য আপনিই তো আছেন।
উদিত অবাক হয়ে মীনার দিকে তাকাল। কৃষ্ণাকে হেসে উঠতে দেখে, ও হাসল। রায়মশাইও হাসলেন এবং একটা আশা নিয়ে উদিতের দিকে তাকালেন।
উদিত বলল, তা সেরকম বিপদআপদ ঘটলে কি আর ছেড়ে যেতে পারব।
রায়মশাই খানিকটা খুশি ও কৃতজ্ঞতায় হেঁ হেঁ করে হেসে উঠে বললেন, তা তো বটেই বাবা, তা তো বটেই। আমাদের বিপদ হলে কি আর তুমি ছেড়ে যেতে পারবে?
কৃষ্ণা মীনা দুজনেই উদিতের দিকে তাকিয়েছিল। চোখাচোখি হতে মীনা যেন একটু লজ্জা পেল, ঠোঁট টিপে হাসল। বাইরে এখন বৃষ্টি নেই বটে, আকাশ মেঘলা। মাঠ ঘাট জলে থইথই করছে। বর্ষার সময়, এরকম থাকেই। তবু এ বছর বৃষ্টির যেন বাড়াবাড়ি।
উদিত কয়েকবার উঠে গিয়ে, দরজার কাছে আড়ালে সিগারেট খেয়ে এল।
উদিত বুঝতে পারছিল, মীনা ওর সঙ্গে একটু গল্প করতে চাইছে। উদিত যত বার দরজার কাছে উঠে গিয়ে সিগারেট খেল, প্রায় প্রতি বারেই মীনাও, একটা না একটা অছিলা করে উঠে এসেছে। প্রথম এক বার কথা না বলে, হেসে চলে গিয়েছে। উদিতের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে গেলেই মীনার চোখে একটু রং ধরে যায়। উদিত নিজেকে বিদ্রূপ করেই একটু হাসল। মীনা নিশ্চয়ই, এইটুকু সময়ের মধ্যে, ওর প্রেমে পড়ে যায়নি। আসলে মীনা কৌতুকপ্রিয়। একটু কথাবার্তা গল্প করতে ভালবাসে।
একবার মীনা বাথরুম থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল। উদিতের দিকে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, খুব ফ্যাসাদে পড়ে গেছেন, না?
উদিত প্রথমে মীনার কথাটা ঠিক ধরতে পারেনি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ফ্যাসাদে পড়ব কেন?
মীনা বলল, এই বারে বারে দরজার কাছে উঠে এসে সিগারেট খেতে হচ্ছে।
উদিত হাসল, বলল, এতে আর ফ্যাসাদের কী আছে। এ সব আমার অভ্যাস আছে।
মীনা ঠোঁট টিপে হেসে, চোখে ঝিলিক দিয়ে বলল, তবু অসুবিধে তো। বারে বারে দরজার কাছে উঠে আসতে হচ্ছে।
উদিত বলল, তা গুরুজনের সামনে যখন খেতে পারব না, তখন আর অসুবিধের কথা মনে রাখলে চলবে কেন।
মীনা বলল, এদিকে নেশা সামলানো দায়।
উদিত হেসে বলল, বোঝেন তো সবই।
মীনা যেন চলে যাবে এভাবে ঘুরতে গিয়ে, আবার উদিতের দিকে ফিরে তাকাল। বলল, দেখুন আরও কত ফ্যাসাদ আপনার কপালে আছে।
উদিত বলল, ফ্যাসাদ বলে মনে করলেই ফ্যাসাদ। আমি সে রকম কিছু মনে করছি না।
মীনার চোখের ছটার মধ্যেও একটু কৃতজ্ঞতার আভাস দেখা দিল। বলল, তা হলে আপনার দেখা পাওয়াটা সত্যি ভাগ্য বলে মানতে হবে।
বাইরে থেকে জলো হাওয়ার ঝাপটা আসছে। উদিত একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, কোনওরকম ফ্যাসাদে যে পড়তেই হবে, তা ভাবছেন কেন? দেখবেন হয়তো, শেষ পর্যন্ত বেশ ভালভাবেই পৌঁছে গেছেন।
মীনা ঘাড় নেড়ে বলল, কাগজে যা পড়ে দেখেছি তাতে আমার মনটা কেমন যেন খচ খচ করছে। একটা নদীর অবস্থাও কাগজে ভাল লেখেনি।
মীনার চোখে একটু দুশ্চিন্তার ছায়া। উদিত বলল, এত জেনেশুনে, বেরোলেন কেন?
মুহূর্তেই মীনার চোখ আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, শুনলেন না, দিদির একটা বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়ে গেছে?
উদিত বলে ফেলল, বিয়েটার সম্বন্ধ কি আর দুদিন দেরি হলে, ভেঙে যেত?
মীনা বলল, তাও যেতে পারে। আপনি ও সব বুঝবেন না।
উদিত মীনার দিকে তাকাল। মীনা হাসল। বলল, মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ কিনা। ছেলেদের মর্জি মাফিক চলতে হয়। তা না হলেই ভেঙে যায়।
উদিত কোনও কথা বলল না। এ সব ব্যাপার ও বোঝে না, মীনা সত্যি বলেছে। তথাপি, মীনার কথায় যেন উদিতকেও একটু খোঁচা দেবার চেষ্টা আছে। উদিত ছেলে বলেই বোধ হয়।
মীনা আবার বলল, আর বাবার অবস্থা দেখেছেন তো। না এসে আমাদের উপায় ছিল না। কিন্তু।
কথাটা শেষ না করে, মীনা সকৌতুকে ভুরু বাঁকিয়ে উদিতের দিকে তাকাল। উদিতও তাকাল। মীনা বলল, কিন্তু আপনি কেন এই দুর্যোগ মাথায় করে বেরিয়েছেন? আপনারও সেরকম কিছু ব্যাপার নাকি?
উদিত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, সেরকম কিছু ব্যাপার মানে?
মীনা কথা না বলে হাসল। উদিত মীনার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত ভাবল। ওর মুখেও একটু বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। মীনার বক্তব্য বুঝতে ওর অসুবিধে হয়নি। বলল, বিয়ে করতে যাচ্ছি কিনা বলছেন?
মীনা কথা না বলে, উদিতের চোখের দিকে তাকাল। ওর ঠোঁটে টেপা হাসি। উদিত বলল, ধরেছেন ঠিকই, তবে বিয়ে নয়, তার চেয়ে বড়, চাকরির জন্য যাচ্ছি।
মীনা ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল, বিয়ের থেকে চাকরিটা বড় বুঝি?
উদিত বলল, অন্তত ছেলেদের বেলায়। বেকার ছেলের বিয়ে হয় না।
মীনা মেনে নিয়ে বলল, তা ঠিক।
তারপরে চলে যেতে উদ্যত হয়ে বলল, আবার যখন সিগারেট খেতে আসবেন, তখন আসব। এখন যাচ্ছি।
মীনা জবাবের প্রত্যাশা না করেই চলে গেল। উদিত হাসল। মীনাকে ওর বেশ ভালই লাগছে। সহজেই কথা বলতে পারে হাসতেও পারে। মনের ভিতরে কোনও রকম প্যাঁচ পয়জার নেই। মীনার কথা ভাবতে ভাবতে, রেখার কথা মনে পড়ে গেল। রেখাও প্রথম থেকে, এমনি অনায়াসেই সেই উদিতের সঙ্গে মিশেছিল। তবে মীনা আর রেখার মধ্যে তফাতও আছে। মীনা অল্প আলাপেই বন্ধুর মতো হয়ে উঠতে চাইছে। যেন কয়েক ঘণ্টার পরিচয় নয়, তার চেয়ে বেশি। রেখা যে ওর সঙ্গে অনায়াসে মিশেছিল, তার সঙ্গে কোথায় যেন একটু অন্যরকম ভাব মিশেছিল। উদিত জানে না, সেটাকে মুগ্ধতাবোধ বলে কি না। তবে বউদির ঠাট্টার কথাগুলো, সবই কি নিছক ঠাট্টা ছিল? দিদির এই বেকার দেবরের প্রতি, রেখার মন কি, মনে মনে একটু সীমা ছাড়িয়ে যায়নি। হয়তো সেই সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াটা তেমন দৃষ্টিকটু বা সমস্যা হয়ে ওঠেনি।
উদিত প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। যেমন একদিন রেখা বাইরে বেরিয়ে বলেছিল, খুব মুশকিলে পড়ে গেছি।
উদিত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কী মুশকিলে পড়লে?
উদিত দেখেছিল, কথাটার জবাব দিতে, রেখার যেন লজ্জা করছে। ঠোঁট টিপে হেসেছিল, মাথা নিচু করেছিল, আবার উদিতের দিকে তাকিয়েছিল। বলেছিল, এই রোজ রোজ আপনার সঙ্গে বেড়াতে বেরুনো।
উদিত বলেছিল, আমার সঙ্গে কোথায়। আমিই তো তোমার সঙ্গে বেড়াতে বেরোই।
রেখা বলেছিল, একই কথা।
উদিত বুঝতে পারেনি। জিজ্ঞেস করেছিল, মুশকিল কেন?
রেখা বলেছিল, মুশকিল না? বিকেল হতে না হতেই রোজ বেরিয়ে পড়ি।
উদিত রেখার মেয়েলি সংকোচ এবং লজ্জার কথা বুঝতে পারেনি। মনে করেছিল, বেড়াতে বেরোতে বুঝি রেখার অনিচ্ছা। সরলভাবেই বলেছিল, তা হলে না বেরোলেই হয়।
রেখা উদিতের চোখের দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়েছিল। বলেছিল, আপনি কিছু বুঝতে পারেন না। আমার ভীষণ লজ্জা করে।
তারপরেও উদিত জিজ্ঞেস করেছিল, কেন?
রেখা সোজা কথা এড়িয়ে গিয়ে, ঠোঁট উলটে বলেছিল, কী জানি।
দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়েছিল। উদিত ঠিক কিছু বুঝতে না পেরে, চুপ করে ছিল। রেখাই আবার বলেছিল, সারাদিন মনে হয়, কখন বিকেল হবে। বাড়ির লোকেরাও বুঝতে পারে।
উদিত বলেছিল, আমিও তো সারাদিন বিকেলের পথ চেয়ে বসে থাকি, কখন তুমি আসবে, কখন একটু বাড়ি থেকে বেরোব।
রেখা আর কিছু বলেনি, কেবল উদিতের মুখের দিকে চেয়ে হেসেছিল। তারপরেই ওরা অন্য কথায় চলে গিয়েছিল। রেখা যেন মনে মনে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল, কবে উদিতের একটা চাকরি হবে। প্রায়ই বলত, চাকরিটা হচ্ছে না কেন?
উদিত বলত, দাদা জানে। আমার তো কিছু করার নেই। যা করছে, সবই দাদা করছে।
রেখা হেসে বলত, আমার উপায় থাকলে, আপনাকে একটা চাকরি দিয়ে দিতাম।
উদিতও হেসে বলত, আমিও বেঁচে যেতাম।
রেখার মুখ হঠাৎ হঠাৎ শুকিয়ে উঠত। বলত, এর পরে কোন দিন শুনব, আপনি কলকাতা থেকে চলে যাবেন।
তা চাকরি না পেলে তো চলে যেতেই হবে। দাদার ঘাড়ে আর কত দিন চেপে থাকব।
রেখার কথা আঁকাবাঁকা। ও বলে উঠত, আপনার সঙ্গে আর না মেশাই ভাল। উদিত বুঝতে না পেরে বলত, কেন, আমি কী করেছি।
কী আবার। কিছুই না। কলকাতায় এলেন, আমি নিয়ে বেড়ালাম, তারপরে একদিন চলে যাবেন।
রেখার স্বরে কিছু ছিল, উদিত হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারেনি। ও রেখার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল। তারপরে বলেছিল, সেভাবে চলে যেতে আমারও কষ্ট হবে।
রেখা যেন অবাক হয়ে উদিতের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ যেন একটু লজ্জাও পেয়েছিল। কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, সত্যি?
উদিত বলেছিল, নিশ্চয়ই।
উদিত রেখার কথা থেকে অনুমান করে নিয়েছিল, ও কলকাতা ছেড়ে চলে গেলে, রেখার খারাপ লাগবে। তাই ও নিজের কষ্টের কথা বলেছিল। সেই শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছেড়ে ওকে চলে যেতেই হচ্ছে।
রেখার অবর্তমানে যখন ওর কথাগুলো ভেবেছে, তখন মনে হয়েছে, বউদির ঠাট্টাগুলো নিতান্ত ঠাট্টা না। রেখা যেন ক্রমেই একটু অন্যরকম হয়ে উঠছিল। উদিতের নিজেরও কি সেইরকম কিছু হয়েছিল। বুঝতে পারে না। তবে রেখাকে ওর ভাল লেগেছিল। সারাদিনে এক বার রেখার দেখা না পেলে, ওর দিনটা যেন পূর্ণ হয়ে উঠত না। রেখাকে দেখলেই ওর চোখমুখ ঝলকে উঠত। কিন্তু একলা একলা চিন্তা ভাবনার বেশির ভাগটাই ওর চাকরির ব্যাপারটা জুড়ে থাকত। রেখা ছিল, সারাদিনের মুক্তি।
নিজের কাছে কিছু গোপনীয়তা নেই এখন উদিত নিজেকে স্পষ্টই জিজ্ঞেস করতে পারছে, রেখাকে কি কখনও বিয়ে করার কথা ভেবেছে? না, এ কথা ওর কখনও মনে হয়নি। রেখার সঙ্গে ও সহজ আর সরলভাবে মিশেছে। প্রেম বলতে যা বোঝায়, তা কখনও ওর মনে আসেনি। কিন্তু আরও দু-একটি ঘটনা মনে পড়লে, রেখাকে একটু অন্যরকম মনে হয়।
বউদির ইচ্ছাতেই, একদিন উদিত, বউদির সঙ্গে দুপুরের শোতে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিল। রেখা এসে অপেক্ষা করেনি, শুনেই চলে গিয়েছিল। তারপরে আর দুদিন আসেনি। তখন রেখাদের বাড়িটা উদিতের চেনা হয়ে গিয়েছিল। বউদি ওকে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিল। রেখাকে সেরকম গম্ভীর আর কখনও দেখা যায়নি। যেন উদিতের সঙ্গে কথা বলতেই চাইছিল না। তারপরে যখন বাড়ির বাইরে প্রথম কথা বলেছিল, জিজ্ঞেস করেছিল, আমাকে আগের দিন জানাতে কী হয়েছিল যে, আপনি দিদির সঙ্গে ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখতে যাবেন।
উদিত অসহায় বিস্ময়ে বলেছিল, আগের দিন কোনও কথা না হলে বলব কী করে। বউদি খেয়ে উঠে হঠাৎ বলল, সিনেমায় যাবে।
রেখা যেন অভিমানহত গলায় বলে উঠেছিল, আর অমনি আপনি চলে গেলেন।
উদিত কী জবাব দেবে, বুঝতে পারেনি। রেখা আবার বলেছিল, আর আমি যে আপনার জন্য আসব, সে কথা ভুলেই গেছলেন।
কথাটা সত্যি। রেখা যে বিকেলে আসবে, সিনেমা যাবার সময়ে, সে কথা ওর মনে ছিল না। বলেছিল, বউদি এমন তাড়া লাগাল। সব থেকে ভাল হত, আপনাকেও বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গেলে।
রেখা কথা না বলে, উদিতের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। যতক্ষণ রেখা হাসেনি, ততক্ষণ উদিতের খুব খারাপ লেগেছিল। রেখাকে গম্ভীর দেখতে মোটেই ভাল লাগে না। পরে বউদি তার বোনকে হেসে বলেছিল, আমি না হয় আমার দেওরকে নিয়ে এক দিন সিনেমায় গেছি। তা বলে তুই বেচারিকে দু দিন বাড়িতে বসিয়ে রাখলি কেন?
রেখাও হাসতে হাসতেই বলেছিল, আমিই বা কেন খালি বাড়ি ঢুরে যাব?
বউদি তেমনি হেসেই বলেছিল, তোর অবস্থাটা দেখলাম।
রেখা তাতেও বিচলিত হয়নি। বলেছিল, দ্যাখোগে। ওরকম হলে, সকলেরই রাগ হয়ে যায়।
উদিত আর একটা সিগারেট ধরাল। বড় করে একটা নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল, হয়তো এরকমই হয়। কিন্তু রেখা বেশ ভাল মেয়ে। আসবার সময় রেখা যথেষ্ট হাসি খুশি থাকবার চেষ্টা করেছে। চাকরি পেলে, জলপাইগুড়িতে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করতেও বলেছে। তবে হাসিখুশির আড়ালেও, ওর মুখে একটা বিষণ্ণতা দেখা গিয়েছে। এক বার উদিতকে একলা পেয়ে, হাসতে হাসতেই বলেছিল, দেখলেন তো, বলেছিলাম আপনার সঙ্গে না মেশাই ভাল।
উদিতও হেসে বলেছিল, ইচ্ছে করে তো আর যাচ্ছি না। আপনাদের কলকাতায় একটা চাকরি হল না তো কী করব।
রেখা ঘাড় নেড়ে বলেছিল, তা জানি না। মোটের ওপর আপনার সঙ্গে মেশা ঠিক হয়নি।
বলে রেখা সামনে থেকে চলে গিয়েছিল।
উদিত জানে, ওর চলে আসায় রেখা একজন বন্ধুকে হারাল। তার বেশি কিছু না। এটাকে নিশ্চয়ই প্রেম বলা যায় না। উদিতের সেরকম মনোভাব কখনও আসেনি।