তমাল পারের পাঁচালী -2
তমাল পারের গ্রাম খসলা। পান্না সবুজ গাছগাছালি, দিগন্তবিস্তৃত শস্যক্ষেত্র ঘেরা ছোট্ট সুন্দর গ্রাম! মরকত মনির মতো সবুজ ধান ও সবজি ক্ষেত ভোরের মিঠেল হাওয়ায় আড়মোড়া ভাঙ্গে। নদীর বুকে চরে বেনেকাশের জঙ্গলে তেলেমুনিয়া র ঝাঁক কলরব তোলে। একলা জেলে জাল ফেলে মাছ ধরে। বক তপস্বী একপা একপা করে কাশবনে হেঁটে বেড়ায়। দূরে দিগন্তে সীমায় গ্রামের আভাস। সোনালী রোদ সোনারং ধানের বুকে সোহাগী পরশ বোলায়। পাকা ধানে বাতাসের হিল্লোল যেন প্রকৃতিরানীর সোনালী আঁচলের দোলা —বড় মনমোহনিয়া। দূরে নদীর অপর পাড়ে শাল জঙ্গলের রূপসী উপস্থিতি। দলমার দামাল মহাকালের দল এখানে মজলিস জমায়। নদী কুলের ধান সবজি খেতে উৎপাত করে। আবার হুলা পার্টির তাড়া খেয়ে ঢুকে পড়ে জঙ্গলের গভীরে—- এই বৃত্তান্ত চিরদিনের।
দলমার দামাল দলের পরিযান পথের এই বৃত্তান্ত চিরকালীন।
তমাল পারের যাপন বৃত্তান্ত শুরু হয় পাখপাখালির ভোরাই শুনে। বাঁশ কাশের জঙ্গলে মিঠেল হাওয়াটা মর্মর ধ্বনি তুলে পাখির কাকলি কে সঙ্গত করে। বেনে বউ এর মিষ্টি” পিলো” —-“পিলো” ডাকের সাথে বুলবুলি দোহার ধরে । দূর থেকে ভেসে আসে পাপিয়ার বিরহী পিউ কাঁহা সুর। সারা আকাশ সোনা রোদের মিষ্টি আলোয় ঝলমল করে। পাকা ধানের সোনালী আভাতে সোনারোদ সোহাগ পরশ লাগায়। সারা চরাচরে যেন সোনার ঝরতে থাকে।
সবুজ সোনালী প্রান্তরের প্রান্তর খায় আবছা গ্রামের আভাস। দিগন্ত বিস্তৃত এই শস্যক্ষেত্র যেন মা লক্ষ্মীর সোনালী আঁচল— ঝাঁপি উজাড় করা সম্পদে উপচে পড়ছে— বড় মন মোহনিয়া।
তমাল বুকে বেনাকাশের জঙ্গল। চরে জলজ দামের সাথে কাশবেনার সহবস্থান। গাঙশালিখের গম্ভীর উপস্থিতি সেখানে। কটা বক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তমাল জলের ছোট্ট ছোট্ট ঘূর্ণি। জল পাক খাচ্ছে। নদীর বাঁকে কাদার বাঁধ দিয়ে জল আটকে মাছধরা চলেছে। দূরে —পূব পাশের মাঠে সবজি খেতে চাষির ভীড়। সবজি তুলছে সব।
আস্তে আস্তে রোদের তেজ বাড়ে ।সুন্দর মিষ্টি সকালটা বিষণ্ন দুপুরের আলিঙ্গনে ধরা পড়ে। কুবোর বিষণ্ণ স্বরে সারা দুপুরের পরিবেশ বিষাদ কাতর। মাঝে মাঝে ঘুঘুর ডাক বিষাদের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তমাল তীরের সরজমিন সুখ-দুঃখের পরান কথা শোনায় প্রকৃতিকে। বেনাকাশের ঝাড় মাথা দুলিয়ে সমব্যথী হয়। কর্মক্লান্ত চাষির ঘামঝরা কপোলে মৃদুমন্দ হাওয়া আরামের পরশ বোলায়। ধীরে ধীরে দুপুরের রোদের তীব্রতা কমতে থাকে। বুলবুলির ঝাঁক দলবেঁধে সবজি ক্ষেতের মাচায় বসে। সবুজ বাতাসি গুলো ঘুঙুরের রব তুলে ধানক্ষেতে হঠাৎ হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে। ধানের সবুজ আর ওদের ডানার সবুজ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। দূর থেকে ভেসে আসে চিলের তীক্ষ্ণ স্বর। তমাল তীরের দুপুর আলস্যের আড়মোড়া ভাঙ্গে।
চাকা গডিয়ে চলে। দিনমণি অস্তাচলগামী হন। অস্তরাগের লালিমায় থাকা পডে চরাচর। বকের ঝাঁক নদীর চর ছেড়ে পশ্চিমের পানে উডান টানে। ওদের ডানায় দিনান্তের শেষ আলোর রেশটুকু মুছে যায়। রাক্ষসী বেলার লালিমা মাখা চরাচরে মায়াবী আঁধার নেমে আসে। পেঁচা দম্পতির উড়ানে শুরু হয় অন্য এক নিশি জাগর কাব্যের।
তমাল তীর নিস্তব্ধতার চাদরে প্রতীক্ষায় থাকে।
তমাল নদী—খসলা,শালবনী