Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তনু অতনু সংবাদ || Samaresh Majumdar » Page 2

তনু অতনু সংবাদ || Samaresh Majumdar

বিকেল থেকে আকাশে মেঘ

আজ বিকেল থেকে আকাশে মেঘ। দুপুরের পরে আলিপুর দুয়ারের জেলেপাড়ায় গিয়েছিলেন সতীশ রায়। সেখান গিয়ে জেনেছেন জালে মাছ ধরতে হলে কী কী উপকরণ লাগে। জাল দুরকমের। হাত জাল আর টানা জাল। হাত জাল নদীতে ছুঁড়ে ফেলতে একটু কসরত লাগে। মাছও বেশি পাওয়া যায় না। টানাজাল ঘণ্টা তিনেক ফেললে ভালো মাছ ওঠে। তবে তার জন্য অন্তত দুটো ছোট নৌকো দরকার। দুজন খুব দক্ষ মাছ ধরিয়েকে ভাড়া করেছেন সতীশ রায়। তারা এসে ছেলেদের দুদিন ধরে মাছ ধরা শেখাবে। আসবে আগামীকাল।

বানারহাটের সঙ্গে খেলে তিন এক গোলে হেরে ছেলেগুলো মনমরা হয়ে ছিল। এই খবরে উৎসাহিত হল। ট্রেনার দুজন থাকবে ক্লাব ঘরে। তাদের খাওয়া দাওয়া বিভিন্ন বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হবে।

আজ ঘরেই আসর বসেছিল। মেঘ আছে বলে দিনের আলো বেশ আগেই ফুরিয়েছিল। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে।

নাগেশ্বর বলল, বড়বাবু। একটা কথা বলব?

সতীশ রায় ওদের উলটোদিকে ইজিচেয়ারে বসেছিলেন। চুরুটের ধোঁয়া ছাড়লেন, কথা বললেন না।

নাগেশ্বর বলল, পাঁচ বছর ধরে এক ব্র্যান্ড খাচ্ছি, অরুচি ধরেছে।

ওই দামের মধ্যে অন্য কি পছন্দ, কিনতে পারো।

দশ বিশ টাকা বেশি দিলে—।

অভ্যেস খারাপ কোরো না নাগেশ্বর। সতীশ রায় বললেন।

হক কথা। গোরক্ষ বলল, খারাপ অভ্যেস মানেই সর্বনাশ।

হরিপদ এল, ঘটকবাবু এসেছেন।

এই অসময়ে! সাড়ে সাতটা বাজতে না বাজতেই তো ছুটবে। ডাকো তাকে। সতীশ রায় বললেন। হরিপদ চলে গেল।

নাগেশ্বর বলল, লোকটা খুব লোভী।

কী করে বোঝা হল? গোরক্ষ বলল।

বড়বাবু মুখের ওপর নাকচ করে দিলেন তবু আশা ছাড়েনি।

ঘটকমশাই ঘরে এলেন, ও, আজ আপনারা এখানেই।

বসে পড়। সতীশ রায় বললেন।

ঘটকমশাই বসলেন। মানিকজোড়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

কী মনে করে?

বড়বাবু, সুখবর আছে। ঘটকমশাই মাথা নাড়লেন।

কীরকম কী রকম?

মনে হচ্ছে আপনি যেরকম চেয়েছিলেন সেরকম পাত্রীর সন্ধান পেয়েছি। একেবারে একশতে একশ বলছি না, আমি তো চোখে দেখিনি।

কানে শুনেছ? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বৃত্তান্ত বল।

আজ একটা দরকারে মালবাজারে গিয়েছিলাম। বেলা এগারোটা নাগাদ পেট্রোল পাম্পের পাশে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় ওঁরা এলেন। ঘটকমশাই গল্প বলছেন।

কারা? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন।

দেখেই বুঝলাম বাইরের লোক। বাস ধরবে ফিরে যাবে বলে। কাছে। এসেই তাঁরা নিবন্ধ শুরু করলেন। কথাবার্তায় বুঝলাম মেয়ে দেখতে এসেছিলেন। হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। ওঁদের দলে ঘটক ছিল। সে বেচারা খুব বকুনি খাচ্ছিল। সুযোগ বুঝে লোকটাকে একটু আলাদা ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার? লোকটা বলল, মুখ পুড়িয়ে দিল মেয়েটা। ও মেয়ের বিয়ে হবে না।

কার মেয়ে?

মহাদেব সেনের নাতনি। আমার পার্টি না হাতছাড়া হয়ে যায়। বলেই লোকটা দলে মিলে গেল। ঘটকমশাই থামলেন।

আচ্ছা বেকুব ত! অন্য পার্টি যে মেয়েকে ছি ছি ছি করছে তার খবর এনেছেন এখানে? ডুডুয়া কি আবর্জনা ফেলার জায়গা? গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল।

আহা, পুরোটা শুনুন আগে। ঘটকমশাই বললেন, একে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম কে মহাদেব সেন? খবর মিলল। বাজারের কাছে বড় স্টেশনারি দোকান আছে। নিকামের রাস্তায় বেশ বড় বাগানওয়ালা বাড়ি। গেলাম দোকানে। বুঝলাম খুব ভালো বিক্রি। একজন কর্মচারী তখন সবে বাড়ি থেকে দোকানে ঢুকেছে। মুখ গম্ভীর। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মহাদেববাবু কোথায়? লোকটা বলল, বাড়িতে। তবে আজ যাবেন না। খুব মন খারাপ।

কেন? কী হয়েছে?

পাত্রপক্ষ এসেছিল নাতনিকে দেখতে। পছন্দও করেছিল। কিন্তু নাতনি। শেষে এমন একটা প্রশ্ন করল যে তারা বিগড়ে গিয়ে বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে।

নাতনি মানে? ছেলের মেয়ে?

না। কোনও ছেলে নেই। একমাত্র মেয়ে বিধবা। তার মেয়ে। হঠাৎ লোকটার খেয়াল হল, আপনার কি দরকার?

আমি একজন ঘটক। ভালো পাত্র আছে সন্ধানে।

অন্য জায়গায় দেখুন। এখানে লাভ হবে না।

কেন? দেখতে খারাপ?

দূর! বেশ সুন্দর দেখতে। ডানা কাটা পরী নয় কিন্তু সুন্দর। তবে মুখ খুললে চোখ কপালে উঠবে। মা-দিদারা মেরেধরেও শেখাতে পারছে না।

কীরকম?

এই তো, আজ। পাত্রপক্ষ অনেক প্রশ্ন করেছিল। সব কটার উত্তর ঠিকঠাক দিয়েছে। শেষে বলে কিনা আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি? পাত্রের বাবা বললেন, নিশ্চয়ই। বল। মেয়ে বলল, আপনার ছেলে এত ম্যাদামারা কেন? বোবা হয়ে বসে আছে।

হো হো করে হেসে উঠলেন সতীশ রায়। হাসি থামতেই চাইছিল না তার। তাকে হাসতে দেখে নাগেশ্বর আর গোরক্ষ হাসতে লাগল। শেষপর্যন্ত উরে ব্বাবা বলে হাসি থামালেন সতীশ রায়।

ঘটকমশাই বললেন, মেয়ের কথা শুনে এক সেকেন্ডও দাঁড়াননি পাত্রপক্ষ। হন হন করে বেরিয়ে গেছেন বাড়ি থেকে। ওঁদেরই আমি দেখেছিলাম বাসস্ট্যান্ডে। একবার ভাবলাম সেনবাড়ি থেকে ঘুরে আসি। তারপর ঠিক করলাম আপনার মতামতটা নেওয়া দরকার। তাই চলে এলাম।

হরিপদ। হাঁকলেন সতীশ রায়।

হরিপদ অবাক হয়ে হাসি শুনছিল। ছুটে এল ভেতরে।

ঘটকবাবুকে আমার থেকে এক পাত্র দে। সতীশ রায় দরাজ হলেন।

আপনার থেকে? নাগেশ্বর বিমর্ষ হল।

আমার থেকে দিলে তোমাদের কম পড়বে না।

কিন্তু বড়বাবু, আমি যে পান করি না। ঘটকমশাই কুঁকড়ে গেলেন।

এরকম পাত্রী তোমার অভিজ্ঞতায় কটা আছে?

একটাও না।

তাহলে ব্যতিক্রমও হয়। তুমি পান করলেও তাই হবে। নাও, গ্লাস তোল। বলো, চিয়ার্স! উঃ কি শব্দ। ম্যাদামারা!

ঘটকমশাই বাধ্য হয়ে গ্লাসে চুমুক দিলেন। দিয়ে মুখ বিকৃত করলেন।

গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল, বড়বাবু। ম্যাদামারা মানে কি?

খুব ভালো কথা। নইলে বড়বাবু খুশি হবেন কেন? নাগেশ্বর বলল।

সতীশ রায় গ্লাস শেষ করলেন, কবে যাব?

ঘটকমশায় বুঝতে পারলেন না, কোথায়?

তোমার সঙ্গে আমি তীর্থ করতে যাব নাকি? মালবাজারের মহাদেব সেনের নাতনিকে দেখতে কবে যাব? সতীশ রায় আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

আপনি-আপনি যাবেন? ঢক করে অনেকটা খেয়ে ফেললেন ঘটকমশাই।

আমার মন বলছিল, ঠিক বলছিল?

আরে এই মেয়েকে দেখব না তো কাকে দেখব? সতীশ রায় বললেন, যে মেয়ে মুখের ওপর বলতে পারে ম্যাদামারা, সে ফালতু না।

ছবি এনেছেন? দেখি? নাগেশ্বর হাত বাড়াল।

আমি তো সেনমশাই-এর বাড়িতে যাইনি। ছবি কি করে পাব?

গিয়ে যদি দেখি মেয়ে ট্যারা তাহলে? নাগেশ্বর বলল।

না না। কর্মচারী বলেছে সে সুন্দরী।

গোরক্ষ বলল, কেউ নিজেদের জিনিস খারাপ বলে? কানা পটল বিক্রি করার সময় বলে রাজার পটল।

উহুঁ। যে মেয়ে ট্যারা অন্য কোনও খুঁত আছে সে কখনও এমন কথা পাত্রপক্ষকে বলবে না। সে চাইবে যেন তেন প্রকারে সিঁদুর পরতে! আমি হলফ করে বলতে পারি এই মেয়ে শুধু সুশ্রী নয়, সুন্দরীও। ঘটকবাবু, তুমি ওঁদের সঙ্গে কথা বলে দিন ঠিক করো। আমি এই মেয়েকে দেখতে যাব। সতীশ রায় ঘোষণা করলেন।

ঘটকমশাই-এর এত আনন্দ হল যে তিনি চোখ বন্ধ করে হাসতে লাগলেন।

গোরক্ষ বলল, আপনার শেষ বাস চলে গেল।

অ্যাঁ। চমকে উঠলেন, কটা বাজে।

সাড়ে সাতটা।

কী হবে? কী করে ফিরব এখন?

সতীশ রায় বললেন, ফিরতে হবে না। হরিপদ।

হরিপদ এল। সতীশ রায় বললেন, ঘটকবাবুকে আর এক পাত্র দে। এমন সুখবর নিয়ে এসেছেন আজ, আনন্দ করা যাক।

কিন্তু বড়বাবু, আমার স্ত্রী!

ফোন আছে বাড়িতে? আশেপাশে?

আজ্ঞে আছে। পাশের বাড়িতেই আছে।

নাম্বার বলুন।

নাম্বার! উঃ। নাম্বার মনে পড়ছে না! গুলিয়ে যাচ্ছে। ঘটকমশাই মাথায় হাত দিলেন।

যাক। আপনার কোন চিন্তা নেই। এখানেই দুটি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়বেন? আরে মশাই রাস্তায় তো পড়ে যাননি।

অগত্যা দ্বিতীয় গ্লাস নিলেন ঘটকমশাই। প্রথমটি শেষ করার পর তার মনে বেশ ফুর্তি এল। গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনার তো অনেক অভিজ্ঞতা?

তা আপনাদের বাপ-মায়ের আশীর্বাদে প্রায় চল্লিশ বছরের।

সবচেয়ে যেটা সেরা সেটা শোনান। গোরক্ষ বলল।

শুনবেন! গ্লাসে চুমুক দিলেন ঘটক মশাই। এখন আর মুখ বিকৃত করছেন না তিনি। বললেন, বছর দশেক আগের কথা। ছেলের বয়স বাইশ। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। বাপের বয়স ছেচল্লিশ। বিপত্নীক। ছেলের জন্যে মেয়ে দেখতে বলেছিলেন আমাকে। দেখলাম। রামসাই-এর জমিদারবাবুর মেয়ে। বছর উনিশ বয়স। রূপের দেমাক আছে। তা থাক। বাপ গেলেন পাত্রী দেখতে। পছন্দ হয়ে গেল। দেনাপাওনার কথাও চুকে গেল। কিন্তু ছেলে বসল বেঁকে। সে বিয়ে করবে না। অনেক অনুরোধ, চোখরাঙানি বৃথা গেল। সে নাকি আরও পড়াশুনা করবে। বাপ বেশি চাপ দিতে পালিয়ে গেল কলকাতায় মাসির বাড়িতে। কর্তা ফঁপরে পড়লেন। বিয়ের কাজ অনেক এগিয়ে গেছে। কেনাকাটাও হয়ে গেছে। আমায় বললেন, খবরটা রামসাই গিয়ে দিয়ে আসতে। কাঁপতে কাঁপতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে। কিছু আত্মীয়স্বজন বাইরে থেকে এসে গিয়েছে। মেয়ের বাপ চুপচাপ শুনলেন। বললেন, কী করা যাবে। তবে বিয়ে হবে। ওই দিন ওই লগ্নেই হবে। হাতে অন্য পাত্র আছে। একটাই অনুরোধ পাত্রের বাবাকে বলবেন আমি নিমন্ত্রণ করছি, উনি যেন বিনা সংকোচে আমার মেয়ের বিয়েতে আসেন। তাহলে আমার রাগ থাকবে না।

বাঃ। খুব বড় মন তো। গোরক্ষ বলল।

কথাটা বললাম। পাত্রের বাবা বললেন, আমার কি যাওয়া ঠিক হবে! ছেলেটা মুখ পুড়িয়ে চলে গেছে, এই মুখ দেখাব?

বললাম, অত করে বলেছেন, গেলে যদি খুশি হন, যাওয়াই ভালো।

বিয়ের দিন বিকেল বিকেল পৌঁছলাম আমরা। আদর করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন পাত্রীর বাবা। একটু গল্পগাছার পর জিজ্ঞাসা করলাম, এত তাড়াতাড়ি পাত্র পেয়ে গেলেন, মেয়ে লগ্নভ্রষ্টা হল না। তা কোথায় থাকে পাত্র?

পাত্রীর বাবা বললেন, ওই তো, আপনার পাশে বসে আছে।

গোরক্ষ আর নাগেশ্বর একসঙ্গে বলে উঠল, অ্যাঁ?

ঘটকমশাই বললেন, আমিও চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু আমাদের কথা শুনতেই চাইলেন না ভদ্রলোক। ভয় দেখালেন ওঁর কথা অমান্য করলে রামসাই থেকে ফিরে যেতে দেবেন না। ছেলের বাবা বললেন, দেখুন আমার বয়স ছেচল্লিশ, আপনার মেয়ের উনিশ। ডাবলের চেয়ে বেশি। ওর শ্বশুর হওয়ার কথা আমার।

ছিল। কিন্তু আপনার শরীর দেখে মনেই হয় না অত বয়স হয়েছে। এখনও চল্লিশ বছর দিব্যি বেঁচে থাকবেন। তখন আমার মেয়ে বুড়ি হয়ে যাবে। আপনার ছেলে যে অন্যায় করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত আপনাকেই করতে হবে। ওই বাড়ির বউ হয়ে যাবে আমার মেয়ে।

তার পর? গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল।

তারপর আর কি? জোরজবরদস্তি করে বিয়ে হয়ে গেল। ঘটকমশাই বললেন।

আমার খাওয়ার সময় হয়েছে। উঠছি। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সতীশ রায়।

নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, এই দশ বছরের খবর কী?

ছেলে প্রেম করে বিয়ে করে ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করছে। এঁরাও খুব দুঃখে নেই। বড় মেয়েটির বয়স নয়, ছোট ছেলের বয়স সাত। কিন্তু বড়বাবু হঠাৎ উঠে গেলেন কেন? গল্পটা কি খারাপ লাগল? ঘটকমশাই জিজ্ঞাসা করলেন।

উত্তর দেওয়ার আগেই হরিপদ এল, এবার উঠুন।

উঠুন? বললেই হল। ঘটকবাবু অতিথি। এখানে থাকবেন। এখনও ওঁর গ্লাস শেষ হয়নি দেখতে পাচ্ছ না। খিঁচিয়ে উঠল নাগেশ্বর।

উনিও উঠবেন। ওঁকে খাবার দিয়ে তবে এলোকেশী বাড়ি যাবে। হরিপদ জানাল।

এলোকেশী? সে আবার কোত্থেকে এল? গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল।

ঘটকমশাই তাড়াতাড়ি গ্লাস শেষ করে বললেন, আমার শরীরটা কিরকম গুলোচ্ছে। আমি যদি না খাই?

ঝটপট গ্লাস বোতল সরিয়ে নিয়ে ঘটকমশাইকে নিয়ে পাশের বাথরুমে গেল হরিপদ, নিন, গলায় আঙুল দিয়ে বেসিনে বমি করুন। অভ্যেস নেই খান কেন?

বলমাত্র বমি বেরিয়ে এল।

সেই শব্দে নাগেশ্বর বলল, তাড়াতাড়ি চল। ওই শব্দ বড় ছোঁয়াচে। এখানে থাকলে আমারও হয়ে যাবে।

মানিকজোড় দ্রুত বেরিয়ে গেলে মুখে মাথায় জল দিলেন ঘটকমশাই। হরিপদ জিজ্ঞাসা করল, কেমন লাগছে?

অনেক ভালো।

পাখার তলায় বসুন। বড়বাবুর খাওয়া শেষ হলেই ডাকব। সে বেরিয়ে গেলে ঘটকমশাই নিজেকে শক্ত করতে চেষ্টা করলেন। এই বাড়িতে আজ তার প্রথম ভাত খাওয়া। বিয়েটা দিতে পারলে সেটা পাকা হয়ে যাবে। এই সুযোগ ছাড়া উচিত নয়। শরীর, তুই ঠিক হ! মনে মনে বললেন ঘটকমশাই।

হরিপদ যখন ডাকতে এল তখন ঘটকমশাই পাশের তক্তাপোশে শরীর এলিয়ে দিয়েছেন। বার তিনেক ডেকেও সাড়া পাওয়া গেল না। অতিথি অভুক্ত হয়ে রাত কাটালে বড়বাবু অসন্তুষ্ট হবেন। হরিপদ ঘটকবাবুর শরীর ধরে নাড়ল।

ঘটকবাবু পাশ ফিরে শুলেন।

অগত্যা আলো নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হরিপদ।

সকালেই চলে এল ওরা আলিপুরদুয়ার থেকে। লোকদুটোর হাতে দুটো পুঁটলি ছাড়া কিছু নেই। লোকদুটোর নাম যতীন আর মতিন।

সতীশ রায় হাসলেন, তোমরা কি দুই ভাই?

যতীন বলল, না বাবু। পাশাপাশি ঘর। আমি আগে জন্মেছি, ও পরের দিন।

মতিন বলল, ওর বাবা নাম রাখল যতীন, তাই শুনে আমার আব্বা মতিন রাখল।

তাহলে তোমাদের ধর্ম আলাদা?

কিন্তু কর্ম এক। যতীন হাসল।

হরিপদকে পাঠিয়েছিলেন ছেলেদের খবর দিতে। তারা এসে গেল।

সতীশ রায় বললেন, এই ছেলেদের মাছধরা শেখাতে হবে তোমাদের।

এবার মতিন বলল, কেন বাবু? এঁরা সব ভদ্রলোকের ছেলে, মাছ ধরবেন কেন?

ওরা মাছের ব্যবসা করবে। তাই নিজেরাই মাছ ধরুক, অন্যের ওপর নির্ভর করলে ব্যবসায় মায়া বসে না। এখন তোমার দরকার দুটো নৌকো আর হাতটানা জাল। মঙ্গল। মঙ্গলের দিকে তাকালেন সতীশ রায়।

এগুলোর ব্যবস্থা দু দিনের জন্যে করে রেখেছি বড়বাবু। মঙ্গল বলল।

ও। কিন্তু এগুলো কিনে নিতে হবে।

যতীন বলল, চিন্তা করবেন না, আমরা অল্প দামে ব্যবস্থা করে দেব।

ভালো কথা। শোন, তোমরা ওদের দুপুর একটা পর্যন্ত যা শেখাবার তা শেখাবে। আজ আর কাল। একটার পরে আর নয়।

মতিন বলল, আমাদের থাকার ব্যবস্থা।

মঙ্গল বলল, ক্লিাবঘরে থাকতে পারেন ওরা।

বাঃ। সতীশ রায় বললেন, আমার বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যেয়ো।

যতীন জিজ্ঞাসা করল, আপনারা সাঁতার জানেন তো?

সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ।

সতীশ রায় বললেন, যাও, কাজ শুরু করে দাও। আমি কাল দুপুরে গিয়ে দেখব তোমরা কেমন কাজ শিখলে।

মতিন বলল, শেখাবার সময় যে মাছ জালে উঠবে—

সেগুলোকে জলেই ছেড়ে দেবে। সতীশ রায় গম্ভীর গলায় বললেন।

ছেলেরা ওদের নিয়ে চলে গেল ডুডুয়ার দিকে।

জলখাবার খেয়ে ছেলেকে ডেকে পাঠালেন সতীশ রায়। সত্যচরণ দরজার কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। ওই ত্রিভঙ্গমুরারির ভঙ্গি দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন মনে মনে। সেটাকে চেপে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কবিতা লেখো?

সত্যচরণ কথা বলল না। মুখ তুলল না।

এই ডুডুয়ার কোন পাখি কথা বলে না? বোবা হয়ে আছে এমন পাখি দেখেছ তুমি?

মাথা নেড়ে না বলল সত্যচরণ।

তুমি কি বোবা? কথা বলতে পারো না?

বলি তো। সত্যচরণ কথা বলল।

কার সঙ্গে বল? উত্তর দাও।

মতির মায়ের সঙ্গে বলি। কাল থেকে এলোকেশীদির সঙ্গে বলছি। সরল গলায় জবাব দিল সত্যচরণ।

বাঃ! কথা বলার চমৎকার সঙ্গী। শোন, এইসব উলটোপালটা কবিতা লেখা বন্ধ কর। ওই শোন, কাক চেঁচাচ্ছে। অথচ তুমি লিখছ সব পাখি বোবা হয়ে গেছে। যে জন্যে তোমাকে ডেকেছি, এখনই ডুডুয়া নদীতে যাও।

ডুডুয়া নদীতে?

হ্যাঁ। তরুণ সঙেঘর ছেলেরা পেশাদার জেলের কাছে মাছ ধরা শিখছে। তুমি তো সাঁতার জানো না। জলে নামতে হবে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দ্যাখো। দেখেও শেখা যায়, যেটা কবিতা লেখার চেয়ে অনেক বেশি কাজে লাগবে।

আপনাকে আমি বলেছিলাম–।

কী?

এই মাসটা আমাকে কিছু করতে বলবেন না।

হাঁ হয়ে গেলেন সতীশ রায়। সামলে গিয়ে বললেন, ও। খুব শোকে আছ?

মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ বলল সত্যচরণ।

তুমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গাণ্ডেপিণ্ডে গিলছ না? তখন শোক হাওয়া হয়ে যাচ্ছে নাকি? এখন থেকে দিনের বেলায় তোমার খাওয়া বন্ধ। রাত্রে যত পারো খেয়ো, কিন্তু যতদিন তোমার শোকপর্ব চলবে ততদিন সূর্য-উদয় থেকে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকবে। যাও হাত নাড়লেন সতীশ রায়। আর সেটা দেখামাত্র অদৃশ্য হয়ে গেল সত্যচরণ।

বাইরে বেরিয়ে এলেন সতীশ রায়। তার স্থির ধারণা, এই ছেলেটি একটি মিচকে শয়তান। নিশ্চয়ই নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে তাঁকে ভ্যাঙাচ্ছে। অথচ মাতৃহারা হওয়ার পর ওর যাতে কোন অসুবিধে না হয় তার সব ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। মতির মা তো আছেই, দুজন মাস্টার ওকে পড়াতে আসত। ভালো ভালো জিনিস কিনে দিয়েছেন। কিন্তু ছেলের ওই এক স্বভাব, তাকে দেখলেই শামুক হয়ে যায়। এখন মনে হচ্ছে সেটাকেই কাজে লাগাচ্ছে।

কেউ একজন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সতীশ রায় এগিয়ে গেলেন, কে? কী চাই আপনার?

লোকটি প্রৌঢ়। দেখেই বোঝা যায় দরিদ্র।

নমস্কার। আমার নাম গুরুচরণ হালদার। হাতজোড় করলেন ভদ্রলোক।

নামটা যেন শোনা বলে মনে হল। ঠিক ঠাওর করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন, আমি কি করতে পারি?

আপনি বোধহয় আমাকে চিনতে পারলেন না।

না।

আমি ব্লক অফিসে কেরানির কাজ করি।

এবার মনে পড়ল। মতির মা এর কথাই বলছিল। গুরুচরণ বললেন, বেশি দিন আসিনি। তেমন বের হই না। আপনার সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ হয়নি।

ও। এলোকেশী–।

হ্যাঁ। আমার মেয়ে। সমস্যা ওকে নিয়েই।

বলুন।

অনেক ঋণ করে বিয়ে দিয়েছিলাম। ছেলের যে ক্যানসার আছে জানতাম না। বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই বিধবা হল। তারপরে শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। সেখানে বনিবনা না হওয়ায় চলে এসেছে আমার কাছে।

ও।

বুঝতেই পারছেন, অভাবের সংসার। ঘাড়ের ওপর একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষ এসে পড়ল। খরচ চালাতে আমি হিমসিম খাচ্ছি। তা এইসময় আপনার বাড়ির মতির মা প্রস্তাবটা দিল। মেয়ে এককথায় রাজি হয়েছে দেখে আমি খুশি হলাম। বললাম, কাজের কোন ছোটবড় নেই। সব কাজই কাজ।

হ্যাঁ। এটা খুবই সত্যি কথা।

কিন্তু আমার ওয়াইফের আপত্তি হচ্ছে।

কেন? সতীশ রায় অবাক হলেন।

এখানে সমাজ আছে। পাড়া-প্রতিবেশী আছে। দুদিন পরেই তারা কথা বলবে বলে আমার ওয়াইফের ধারণা। ভদ্রলোেকের বাড়ির মেয়ে রাঁধুনির কাজ করতে যাচ্ছে। সম্মান ধুলোয় লুটোবে। তাছাড়া আমার আর একটি কন্যা আছে। তার বিয়ের সময় পাত্র পাব না। এটাও আমার ওয়াইফের ধারণা। দিদি অন্যের বাড়িতে রান্না করে শুনলে পাত্রপক্ষ তাচ্ছিল্য করবে। গুরুচরণ বললেন।

আপনার ওয়াইফের এইসব কথাকে আপনি সমর্থন করেন?

আজ্ঞে করি না। কিন্তু হাজার হোক তিনি তো ওয়াইফ।

তাহলে তো কথাই ওঠে না। মেয়েকে আর আসতে দেবেন না।

সেটা তো করাই যায়। কিন্তু তাতে তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এই যে ভোরে একবার আসছে, দুপুরে আবার ফিরে যায়। তারপর বিকেলে এসে মাঝরাত্রে একা ফেরে। প্রত্যেকেই তো দ্যাখে। অত রাত্রে একজন যুবতী বিধবা হেঁটে এতটা পথ যাচ্ছে, লোকে তো কুকথা বলবেই। তাই আমার ওয়াইফ বলছিলেন মানুষজনের মুখ বন্ধ করা দরকার। গুরুচরণ খুব ভেবেচিন্তে কথাগুলো বলে ফেললেন, দুটো উপায় আছে।

কিভাবে?

আমার ওয়াইফ বললেন, ওকে ওর শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। সে ওই পরিবারের পুত্রবধূ। স্বামীর ভিটে আঁকড়েই তার থাকা উচিত। যত কষ্ট হোক কিন্তু সম্মানহানি হবে না। আর এর ফলে আমার ওপর চাপ কমে যাবে। গুরুচরণ মাথা নাড়লেন।

দ্বিতীয়টা?

ও যদি যাওয়া-আসা না করে তাহলে কেউ দেখতে পাবে না। আপনার বাড়ির অন্দরমহলে থাকলে কারও পক্ষে ভাবাও সম্ভব নয় যে এখানে কি করছে।

এটাও আপনার ওয়াইফের কথা?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কিছু মনে করবেন না, উনি কি এলোকেশীর গর্ভধারিণী?

আজ্ঞে না। আমার দ্বিতীয় পক্ষ। বুঝতেই পারছেন, কি অশান্তিতে আছি।

অনুমান করছি। কিন্তু যার ব্যাপারে এসব ভাবছেন তার কী ইচ্ছে তা জেনেছেন?

এলোর আবার কী ইচ্ছে হবে? আমি যা বলব তাই ও মেনে নেবে।

তাহলে আমি বলব ওকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিন।

অ্যাঁ?

দেখুন, আমরা বাড়িতে মেয়েমানুষ বলতে শুধু মতির মা। আমার স্ত্রী গত হওয়ার পর অন্দরমহলের সব ব্যাপার আমি ওর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। ও যদি চায় তাহলে এলোকেশী রাত্রে এখানে থাকতে পারে। কিন্তু তাকে থাকতে হবে বাড়ির অন্য কাজের লোক যেমন থাকে সেইরকম। আপনি মতির মায়ের সঙ্গে কথা বলুন, সে-ই তো আপনার বাড়িতে গিয়ে ওকে নিয়ে এসেছে। সে যদি না রাজি হয় তাহলে মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিন। কথা শেষ করতে চাইলেন সতীশ রায়।

বেশ, আপনি যখন বলছেন তখন ওর সঙ্গে কথা বলব। ও হ্যাঁ, সে রাজি হয় তাহলে বেতন কী দেবেন? গুরুচরণ হালদার জিজ্ঞাসা করলেন।

আপনিই বলুন।

চব্বিশ ঘণ্টা থাকার, মাসে অন্তত দু হাজার না হলে—

আপনি বরং মেয়েকে নিয়ে যান।

না না, আপনি কত পারবেন?

আপনি ডুডুয়াতে তো কিছুকাল আছেন, দুহাজার টাকার মাইনেতে কোন রাঁধুনি এখানে চাকরি করছে? শুনুন, মতির মায়ের মাইনে বেড়ে বেড়ে এখন পাঁচশো হয়েছে। তার আন্ডারে সে কাজ করবে তাকে ওর বেশি দিতে পারব না।

সতীশ রায় ঘুরে দাঁড়াতেই গুরুচরণের গলা মিনমিনে হয়ে গেল।

বেশ। আমার ওয়াইফ অবশ্য অসন্তুষ্ট হবেন কিন্তু মেনে নিচ্ছি। তাহলে মাসের এক তারিখে আমি এসে টাকাটা নিয়ে যাব।

আগে মতির মায়ের সঙ্গে কথা বলুন। সতীশ রায় বারান্দার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

গুরুচরণ পেছন পেছন এসে বললেন, আজ্ঞে, একটু যদি ডেকে দেন।

হরিপদ। হরিপদ। হাঁক ছাড়লেন সতীশ রায়। হরিপদকে দেখতে পেয়ে বললেন, মতির মাকে ডেকে দে। উনি কথা বলতে চান।

নিজের ঘরে চলে এলেন সতীশ রায়। চেয়ারে বসে সিগারেট ধরালেন। মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল তার। অদ্ভুত মানুষ। এখানে দু-এক বছরের জন্যে সরকারি দপ্তরে বদলি হয়ে যারা আসে তাদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের এই কারণে মিলমিশ হয় না। একই বিষয় নিয়ে এত কথা বলে না কেউ। তাছাড়া তাঁর বাড়ির একজন কর্মচারীর পারিবারিক সমস্যা নিয়ে তাঁকে কেন এত কথা শুনতে হবে।

সিগারেট যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন বাইরে চিৎকার শুরু হল। সবাইকে ছাপিয়ে গেল যার গলা সে অবশ্যই এলোকেশী। এসব কি হচ্ছে? সতীশ রায় হাঁকলেন, হরিপদ! ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ঝগড়া করতে বলল।

হরিপদর গলা শোনা গেল, সবাইকে চুপ করতে বলছে।

মতির মা এল দরজায়। ঘোমটা মাথায় দিয়ে, খোকার তো খেতে ভালো লেগেছে, সকালের জলখাবারও পেট ভরে খেয়েছে, কিন্তু এলোকেশীকে রাত্রে এখানে থাকতে দেওয়াটা কী ঠিক হবে?

আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন? তুমি ঠিক করো।

যদিও খোকা বলছিল এতদিনে একজন দিদি পেয়েছে।

আঃ। খোকা খোকা করো না তো! আমিও তো রান্নার প্রশংসা করেছিলাম কিন্তু তোমার মনে পড়ল খোকার কথা। ও হ্যাঁ, খোকা জলখাবার খেয়েছে। কখন? আমার ঘরে আসার আগে না পরে? সতীশ রায় তাকালেন।

আজ্ঞে আগে।

হুঁ। কি খেয়েছে জলখাবারে?

আজ্ঞে, লুচি, বেগুনভাজা, কুমড়োর ছক্কা আর সন্দেশ।

বাঃ। চমৎকার। মাতৃশোকের জন্যে কটা লুচি খেয়েছে? এক ডজন?

শুনলে আয়ু কমে যায় বলে শুনিনি।

শোন মতির মা। ও যদ্দিন বাড়ির বাইরে না যাবে তদ্দিন ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত ওকে কোনও খাবার দেবে না। কথাটা ওকেও বলেছি, তোমাকেও বললাম। আমার আদেশ অমান্য হলে সবাইকে বাড়ি থেকে দূর করে দেব।

খোকা তো না খেয়ে মরে যাবে। মতির মা শিউরে উঠল।

কোনও চান্স নেই। কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ একমাস ধরে নিলা উপোস করেন। সন্ধের সময় তারা উপপাসভঙ্গ করেন। রাত্রে যত খুশি খাইয়ো, সে বহাল তবিয়তে থাকবে। যাও। হাত নাড়লেন সতীশ রায়।

আমি ভেতরে আসব বড়বাবু? দরজায় এসে দাঁড়াল এলোকেশী। আজ তাকে বেশ ছিমছাম দেখাচ্ছে। আঁচল কোমরে জড়িয়েছে। মতির মা বেরিয়ে যাচিছল, তাকে দাঁড়াতে বললেন সতীশ রায়। ঘরে ঢুকল এলোকেশী, আপনি আমার বাবাকে বলেছেন শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিতে?

তোমার সন্দেহ হচ্ছে?

হ্যাঁ। লোকটা মিথ্যেবাদী। অসৎ।

তুমি ভুলে যেয়ো না উনি তোমার বাবা।

না ভুলছি না। কিন্তু যে বাবা টাকার লোভে নিজের মেয়েকে একটা ক্যানসার রুগীর সঙ্গে বিয়ে দেয় তাকে সৎ বলা যায় কি?

উনি জানতেন না?

সব জানতেন, সম্বন্ধ এনেছিল আমার সৎমায়ের ভাই। বাবা পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে নিজের ঘাড় থেকে আমাকে নামিয়েছিল।

খুব অন্যায় করেছিল। দ্যাখো এলোকেশী, আমি যতটুকু বুঝলাম, তোমার সম্মা চাইছেন না তোমাকে ওবাড়িতে রাখতে। ওখানে থেকে লোকের সামনে দিয়ে আমার বাড়িতে রোজ কাজ করতে আসাও তার অপছন্দ। এক্ষত্রে সম্মানের সঙ্গে, বাপের বাড়িতে না থেকে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়াই ভালো। তাই নয় কি?

আমার সন্দেহ হচ্ছে সম্মায়ের কাছে টাকার প্রস্তাব এসেছে। এলোকেশী বলতে বলতে এবার আঁচলে চোখ ঢাকল।

কী রকম?

বিধবা হওয়ার পর আমার দেওর আমাকে জ্বালিয়ে শেষ করেছিল। এমন কি স্নান করার সময় উঁকি দিত। লজ্জায় কাউকে বলতে পারতাম না। তারপর এতে যোগ হল ভাসুর। স্বামীর চেয়ে দশ বছরের বড়। তার বউ বাপের বাড়িতে গেলেই রাত্রে কোনও না কোনও বাহানায় আমাকে তার ঘরে ডাকত। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বলত। ওর সঙ্গে যেদিন শুতে বলল সেদিন আমি পালিয়ে এসেছিলাম বাপের বাড়ি। এসব কথা আমি মা-বাবাকে বলেছি। দেওর নিতে এসেছিল আমি যাইনি। সৎ মা বলেছিল, একটু মানিয়ে নিলে যদি সবার সুবিধে হয় তাহলে ক্ষতি কি! কদিন আগে ভাসুর চিঠি লিখেছিল সত্মাকে। পথখরচা বাবদ কত টাকা পাঠালে তিনি মেয়েকে পাঠাতে রাজি হবেন। তার স্ত্রী বাচ্চা হতে বাপের বাড়িতে গিয়েছে, তিনমাসের জন্যে। এখন হাত পুড়িয়ে খেতে হচ্ছে। পথ-খরচার নামে টাকা নিয়ে ওরা যখন জোর করে আমাকে পাঠাবে ভাবছে তখনই মতির মা গিয়ে এই কাজটার কথা বলল। আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। এরপরেও আপনি কি বলবেন শ্বশুরবাড়িতে যেতে? এলোকেশী গড়গড় করে বলে গেল।

মতির মা চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, তাহলে থাকুক।

শান। তোমাকে আমি পাঁচশো টাকা বেতন দেব। মতির মা, তোমার বেতন পঞ্চাশ টাকা বাড়ালাম। এলোকেশী, তোমার বাবা বলেছে প্রত্যেক মাসের এক তারিখে এসে টাকাটা নিয়ে যাবে।

না। খুব জোরে উচ্চারণ করল শব্দটা এলোকেশী।

অবাক হয়ে তাকালেন সতীশ রায়। মাথা নাড়ল এলোকেশী, আমার রোজগারের টাকা আমি কাউকে দেব না।

সেটা তোমার ব্যাপার। তবে দুদিন অপেক্ষা করো। পরশু থেকে তুমি এ বাড়িতে থাকতে পারবে। আসার আগে আমাকে যা যা বললে তা বাবাকে বলে আসবে। এখন যাও তোমরা, আমি বেরুবো। সতীশ রায় উঠে দাঁড়ালেন।

বড়বাবু। মতির মা ঘোমটা সামনে টানল।

আবার কী হল?

আমার মাইনে বাড়াবার দরকার নেই।

সেকি! তুমি কি গোত্রছাড়া।

শুধু একটা কথা।

আবার কী কথা?

খোকাকে দিনের বেলায় খেতে দিন।

অবাক হয়ে তাকালেন সতীশ রায়। সামান্য মাইনের একটি কাজের মহিলা পঞ্চাশ টাকা মাইনে বাড়ার প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিচ্ছে স্নেহের কারণে। বেচারা জানে না হাতে ক্ষমতা পেলেই ওর ছায়া মাড়াবে না সত্যচরণ।

মাথা নাড়লেন সতীশ রায়, তাহলে তাকে বলে রাজি করাও বাইরে বের হতে। ডুডুয়ায় মাছ ধরা শিখছে ছেলেরা, সেখানে যাক। কাঠচেরাই-এর কারখানায় গিয়ে বসুক। তখন তুমি দিনরাতে যত খুশি ওকে খাওয়াও, আমার কোন আপত্তি থাকবে না। যাও।

গাড়ি নিয়ে এস. ডি. ও.-র অফিসে যাওয়ার আগে ডুডুয়ার দিকে যেতেই এপারে বেশ ভিড় চোখে পড়ল। গাড়ি থেকে নেমে এগোতেই সবাই উল্লসিত গলায় বলল, উঃ কত বড় কাতলা, দুটো রুই যা উঠেছিল না। কিন্তু বড়বাবু ওরা মাছ ধরেই আবার জলে ফেলে দিচ্ছে। এত করে বলছি তবু আমাদের দিচ্ছে না। সবাই ঘিরে ধরল তাঁকে।

সতীশ রায় হাসলেন। তারপর ওদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন ব্যাপারটা। তাঁকে দেখে যতীন উঠে এল, খুব ভালো মাছ আছে বাবু।

ছেলেরা কেমন শিখছে?

কোনদিন করেনি তো। হয়ে যাবে। নাহলে তো আমরা আছি।

তা আছ। তবে ওদের শিখতেই হবে।

মঙ্গল এল সাঁতার কেটে এপারে, এরা সবাই আমাদের পাগল করে দিচ্ছে। বড়বাবু। ফুটবল খেলা দেখতে মাঠে ভিড় করে না, মাছ ধরা দেখতে এসেছে।

ওদের ওপর রাগ কোরো না। মাছ ধরা দেখতে সবারই ভালো লাগে। আবার গাড়িতে উঠলেন তিনি।

এস. ডি. ও.-র অফিসে যেতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল। ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর ভালো আলাপ আছে। খাতির করে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, চা খাবেন?

না। একটা অপ্রীতিকর কাজে এসেছি। বলুন।

ডুডুয়ার ব্লক অফিসের একজন কেরানির নাম গুরুচরণ হালদার। চেনেন?

মনে করতে পারছি না। কী করেছে সে?

ক্যান্সার পেশেন্টের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে টাকা নিয়ে।

সেকি?

মেয়ে বিধবা হয়েছে। জোর করে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে চায় টাকার লোভে। বিধবা ভ্রাতৃবধূর ওপর ভাসুর দেওরের নজর আছে। এই মেয়েটি আমার বাড়িতে রান্নার কাজে লেগেছে। দুবেলা আসা-যাওয়া করছে বলে ওর বাপ মায়ের নাকি সম্মানহানি হচ্ছে। মেয়েটিকে আমি যদি দিন রাতের জন্যে রাখি তাহলে তারা রাজি কিন্তু মোটা মাইনে দিতে হবে। অথচ মেয়েটি চাইছে বাবার লোভের শিকার না হতে। মেয়েটির মা নেই। সৎ মা-ই বাবার পরামর্শদাতা। সতীশ রায় বললেন।

এস. ডি. ও. বড়বাবুকে ডাকলেন। তিনি এলে জিজ্ঞাসা করলেন, ডুডুয়ার ব্লক অফিসে গুর চরণ হালদার বলে যে লোকটি আছে তাকে চেনেন?

চিনি স্যার।

কীরকম?

ও আগে ছিল ফালাকাটায়। কমপ্লেন হচ্ছিল বলে ডুডুয়াতে বদলি করা হয়েছে। ব্যবহার ভালো না। বড়বাবু বললেন।

হুঁ। এক কাজ করুন। নাথুয়াতে তোক কম আছে। আজই অর্ডার করুন যাতে সে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে নাথুয়াতে জয়েন করে। দেরি করা চলবে না। এস. ডি.ও. সাহেব জানিয়ে দিলেন।

আর ডুডুয়াতে কাকে পাঠাবো?

আমাদের অফিসে যে নতুন ছেলেটি জয়েন করেছে, বিয়ে থা করেনি, ওকে পাঠিয়ে দিন কয়েকমাসের জন্যে। তারপর দেখছি।

বড়বাবু চলে গেলে সতীশ রায় বললেন, খুব ভালো কাজ করলেন।

এসব লোককে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত কিন্তু সে-ক্ষমতা তো আমার নেই। এস. ডি. ও. সাহেব বললেন।

সতীশ রায় বললেন, সামনের মাসের পনেরো তারিখে আপনাকে একবার ডুডুয়ায় আসতেই হবে।

কী হবে সেদিন?

ছেলেরো কো-অপারেটিভ করেছে। তার উদ্বোধন হবে। ডি. এম. সাহেবকে দিয়ে উদ্বোধন করাব। আপনাকে থাকতে হবে।

কো-অপারেটিভ? কেন?

ওরা স্বনির্ভর হবে। কো-অপারেটিভ করে ব্যবসা করবে।

কী ব্যবসা?

মাছ ধরবে ডুডুয়া থেকে। বিক্রি করবে বিভিন্ন হাটে।

মাছ ধরে ব্যবসা করবে বাঙালি ছেলেরা? অবাক হলেন এস. ডি. ও.।

হ্যাঁ। আজ থেকে ট্রেনিং নিচ্ছে ওরা।

কি করেছেন মশাই? নিশ্চয়ই যাব।

আমি আর একবার মনে করিয়ে দেব আপনাকে।

বেরিয়ে এলেন সতীশ রায়। ডুডুয়াতে ঢোকার সময় ড্রাইভারকে বললেন, একবার নদীর ধারে চলো তো।

এখন একটা বেজে গেছে। নদীর ধারে গিয়ে দেখা গেল জনশূন্য। ছেলেরাও চলে গেছে যে যার বাড়িতে। ওদের বলেছিলেন একটা পর্যন্ত নদীতে থাকতে। কথা শুনেছে। হঠাৎ ড্রাইভার বলল, খোকাবাবু।

চমকে তাকালেন সতীশ রায়। একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সত্যচরণ নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ির শব্দ পেয়েও এদিকে তাকায়নি। মনে মনে হাসলেন তিনি। পেটের দায় বড় দায়। ড্রাইভারকে বললেন, বাড়ি চলো।

ড্রাইভার কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। গাড়ি ঘোরাবার আগে সে একবার সত্যচরণের দিকে তাকাল। সেটা লক্ষ করেও কিছু বললেন না সতীশ পায়।

বাড়ির পথে দূর থেকে হরিপদকে দেখতে পেলেন। হন্তদন্ত হয়ে আসছে। ড্রাইভারকে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন সতীশ রায়। বড়বাবুর গাড়ি দেখতে পেয়ে হরিপদ বেশ বিব্রত হয়ে কাছে এসে বলল, মতির মা বলল খোকাবাবুকে খুঁজে আনতে।

কেন?

কোনদিন বাড়ির বাইরে যায় না, আজ বেরিয়েছে। কিন্তু তার আর ফেরার নাম নেই। বেলা প্রায় দেড়টা হয়ে গেল, খাওয়া দাওয়া করেনি। মতির মা আমাকে এমন তাড়া দিল।

উঠে ড্রাইভারের পাশে বসো। সতীশ রায় হুকুম করলেন।

হরিপদ উঠে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করলে সতীশ রায় বললেন, একটা দামড়া ছেলে, দিনদুপুরে বেরিয়েছে, তাকে খুজতে যাচ্ছ তুমি? এখানেই তো তার জন্ম। তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি!

আমি বলেছিলাম, কিন্তু মতির মা প্রায় কান্নাকাটি করছিল।

বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। তিনকুলে কেউ নেই নইলে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম ওকে। বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। সতীশ রায় গেট খুলে ভেতরে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন, মতির মাকে বলো আমার খাবার টেবিলে দিতে।

হরিপদ মাথা নাড়ল।

খাওয়া শেষ করে আয়েসে সিগারেট খেয়ে সতীশ রায় ঘড়ি দেখলেন। দুটো বাজে। তার খাওয়ার টেবিলের খানিকটা তফাতে মতির মা দাঁড়িয়ে ছিল (মটা মাথায়। একটাও কথা বলেনি। এখন তাকে শত্রু ভাবছে মতির মা। এলোকেশী দুবার জিজ্ঞাসা করেছে এটা ওটা লাগাবে কিনা।

বিশ্রাম নিতে সবে খাটে বসেছেন, হরিপদ এল, একজন দেখা করতে এসেছেন সদর থেকে। অপেক্ষা করতে বলব?

না। যাচ্ছি। ও হ্যাঁ, এবার যাও, শ্রীমানকে ডেকে আনো। নদীর ধারে গাছের তলায় বসে তিনি বোধহয় কবিতা ভাবছেন। সনীম বায় বললেন।

খোকাবাবু তো এসে গেছে।

কখন?

আপনি যখন খাচ্ছিলেন।

অ। কী করছিলেন তিনি কিছু বলেছেন?

হুঁ। বলেছে আপনি মাছ ধরা দেখতে বলেছিলেন, কতক্ষণ সেখানে থাকতে হবে বলেননি। এখন খেতে বসেছে। হরিপদ বলল।

মিচকে শয়তান। বিড়বিড় করলেন সতীশ রায়। তারপর বাইরের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। ঘরে ঢুকে চমকে উঠলেন তিনি। আরে! আপনি?

চলে এলাম। কিন্তু এ সময়ে এসে বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটালাম বোধহয়।

না না। দুপুরে সাধারণত ঘুমাই না আমি। সতীশ রায় বললেন, নিশ্চয়ই খাওয়া-দাওয়া হয়নি। ভাত দিতে বলি?

না না। আমি রোজ দশটায় দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। কিন্তু ভাই, তাদের সঙ্গে কখন দেখা করা যাবে?

অবনীদা, আপনি ব্যস্ত হবেন না। একটু রোদ পড়ুক, ওরা আসবে।

ব্যাপারটা কী হয়েছে। তোমার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হল ছেলেগুলোকে দেখা উচিত একবার। মনে হওয়ামাত্র চলে এসেছি। বাড়িতে বলে আসিনি। সন্ধের আগেই ফিরে যেতে হবে।

বেশ তো, তাই যাবেন। সতীশ রায় বললেন, ধরুন, আজ ওদের সঙ্গে কথা বলে, খেলা দেখে আপনার ভালো লাগল। তখন কী হবে?

যদি দেখি ওদের মধ্যে সম্ভাবনা আছে তাহলে নিজেকে উজাড় করে দিতে আমার একটুও আপত্তি থাকবে না। দ্যাখো ভাই, ভালো ছাত্র পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। বেশির ভাগই চায় ফাঁকি দিতে। এখন ফুটবল খেলা একেবারে বিজ্ঞানের পর্যায়ে চলে গেছে। দুমদাম বলে কিক মারা আর ফুটবল নয়। অবনীদা বললেন।

বেশ। আমার প্রস্তাবটা তাহলে গ্রহণ করেছেন?

কী প্রস্তাব?

ফুটবল খেলা যেমন বিজ্ঞানসম্মত হয়েছে তেমনি কোচকেও পেশাদার হতে হবে। পেশাদার কোচ কোচিং করাচ্ছেন জানলে ছেলেরা উজ্জীবিত হবে। তাদের উৎসাহ অনেক বেড়ে যাবে। সতীশ রায় বললেন।

ঠিক আছে। গাড়ি ভাড়া দিয়ে দিয়ো। তাহলেই হবে।

আপনি সপ্তাহে দুদিন আসবেন। একটা রাত থাকবেন এখানে। আপাতত গাড়িভাড়া ছাড়া আপনাকে মাসে দু-হাজার টাকা দেব। এ ব্যাপারে আর নেও কথা নয়। আপনার ছেলেরা ফুটবল খেলে?

না ভাই, ঈশ্বর সন্তান দেননি। তাতে আমার বিন্দুমাত্র আপসোস নেই। কত হাজার ছেলেকে ফুটবল শেখাতে গিয়ে কাছে পেয়েছি। আমরা দুই ভাই। ছোট আসামের চা-বাগানের ম্যানেজার ছিল। পঞ্চাশ বছর বয়সেই অবসর নিয়ে বাড়িতে বসে আছে। অবনীদা বললেন।

কেন?

মালিকের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল। ইচ্ছে করলে এখানকার কোনও চা-বাগানে ঢুকতে পারে কিন্তু ওর সেই ইচ্ছে আর নেই। ও কিন্তু স্কুলে পড়ার সময় ভালো ফুটবল খেলত।

সতীশ রায় কথাটা শুনে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, আপনার ভাই-এর সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই।

কেন? অবনীদা হাসলেন।

একটু আলোচনা করব।

বেশ। ওকে বলব এখানে আসতে।

চা খেয়ে বেলা পৌনে চারটের সময় অবনীদাকে নিয়ে মাঠে গিয়ে দেখলেন মঙ্গলরা নেই। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে বল পেটাপেটি করছে।

দুটো ছেলেকে পাঠালেন তিনি মঙ্গলের খোঁজ নিতে। অবনীদা বললেন, কি হে, এদের কি বাড়ি গিয়ে নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসতে হয়?

না না। কিছু একটা হয়েছে।

পনেরো মিনিটের মধ্যে ছেলেরা এসে গেল। তাদের দেখে চক্ষু চড়কগাছ। সতীশ রায়ের। খুঁড়িয়ে হাঁটছে কেউ কেউ। কারও হাতে ফোস্কা। প্রত্যেকেই বেশ কাহিল। মঙ্গল বলল, প্রথম দিন তো, অভ্যেস ছিল না আর ওরা খাটিয়েছেও খুব। কাল ঠিক হয়ে যাবে।

তাহলে আজ তোমরা প্র্যাকটিস করছ না?

না মানে, সবাই বলল আজ বিশ্রাম নেবে–। মঙ্গল বলল।

কী হয়েছে? অবনীদা জিজ্ঞাসা করলেন।

ঘটনাটা কী এবং কেন অল্প কথায় বললেন সতীশ রায়। শোনামাত্র অবনীদা বললেন, বাঃ! চমৎকার। নিজের খাবার নিজেই জোগাড় কর। এর চেয়ে আনন্দ কিছুতেই নেই। আজ যে পরিশ্রম করেছ তা যদি রোজ করো তাহলে দেখবে শরীরের সহ্য করার ক্ষমতা বেড়ে যাবে।

সতীশ রায় বললেন, ইনি অবনীদা। টাউন ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন অনেক বছর। তারপর কোচিং করেন। আজকের আধুনিক ফুটবলের কোচিং ট্রেনিং করে এসেছেন। আমি ওঁকে অনুরোধ করেছি তোমাদের ফুটবল শেখাতে।

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা লাইন দিয়ে প্রণাম করে গেল।

অবনীদা বললেন, আমি ভুল দিনে এসেছি। তোমাদের শরীরের যা অবস্থা তাতে কিছু করে দেখাতে পারবে না তোমরা। আচ্ছা, এই কুচোগুলোকে দেখা যাক।

দুজন দুজন করে দশজনকে পরপর দাঁড় করালেন তিনি। এদের বয়স দশ কী বারো। তারপর একজন আর একজনকে পিঠে তুলে দু মিনিট দৌড়ে যেতে বললেন। আগে পরে পাঁচটা দল দু মিনিট দৌড়াতেই থামতে বলে উলটোটা করতে বললেন। অর্থাৎ যে পিঠে উঠেছিল সে এবার পিঠে তুলবে। তারা দুমিনিট দৌড়ে ফিরে আসতেই জিজ্ঞাসা করলেন, কার কার কষ্ট হল? কারও হয়নি? বাঃ। এবার পাঁচজন সামনের দিকে মুখ করে পাশাপাশি দাঁড়াও! এবার তোমরা পাঁচজন যে যার পার্টনারের একেবারে পেছনে এমনভাবে দাঁড়াও যাতে দুই ইঞ্চির বেশি কাঁক না থাকে। ওরা বুঝতে পারছিল না, অবনীদা নিজে প্রত্যেকের অবস্থান ঠিক করে দিলেন। বললেন, ধরে নাও সামনে যে আছে সে বল পায়ে নিয়ে দৌড়াচ্ছে পেছনে যে আছে সে বলটা কেড়ে নেবে। কিন্তু সেটা করার আগে দুমিনিট এমনভাবে দৌড়াবে যেন সামনের ছেলের শরীরে তোমার শরীর স্পর্শ না করে। করলেই ফাউল হয়ে যাবে।

দুজন কোনরকমে পারল, তিনজন পারল না।

অবনীদা বললেন, আজ বল নিয়ে না খেলে তোমরা এইটাই প্র্যাকটিস করো। যখন ঠিকঠাক পারবে তখন বুঝব তোমাদের শরীরের ব্যালেন্স এসে গেছে।

মঙ্গল জিজ্ঞাসা করল, এটা আমরা করব?

না। তোমরা মাটিতে শুয়ে পড়ো সবই।

বড় ছেলেরা শুয়ে পড়ল। অবনীদা বললেন, এবার উপুড় হও। হ্যাঁ। ঘাসের ওপর চিবুক রেখে গোলপোস্টের দিকে তাকাও। কেউ মুখ তুলবে না। ওপরের আকাশ দেখতে পাচ্ছ?

সবাই বলল, না।

কী দেখছ?

তিনটে পোস্ট। মঙ্গল জবাব দিল।

না। পোস্টের মাঝখানের আয়তক্ষেত্রটাকে দ্যাখো। যখন ফুটবল খেলবে তখন শুধু ওই জায়গাটায় বল মারবে, ওপরে পাশে নয়। দেখতে দেখতে বুকের মধ্যে ছবিটাকে ঢুকিয়ে ফেলো। এবার চিৎ হয়ে শোও। মনে করো সাইকেল চালাচ্ছ। কোমরের নিচের অংশ থেকে পা পর্যন্ত সাইকেলের প্যাডেল ঘোরানোর সময় যেমন করতে হয় তেমন করো তিন মিনিট। আজ পাঁচবার করলেই হবে। আমি সামনের শনিবার দুপুরে আসব। এ কদিন তোমরা নিজেদের মতো খেলো আর আমি যা শিখিয়ে গেলাম সেটা অন্তত আধঘণ্টা প্র্যাকটিস করবে। চলুন, যাওয়া যাক। অবনীদা বললেন।

যেতে যেতে সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী বুঝলেন।

কিছুই না। বল পায়ে পড়লে তবে বুঝতে পারব। কিন্তু আমি ওদের শনিবার আসব বলে এলাম কেন জানেন? বললাম কারণ আজ সকালে অত পরিশ্রম করে যখন শরীরের ওই হাল করেছে তখন নিজে থেকেই আমার কাছে। আজ কিছু শিখতে চাইল। দিস ইজ ইম্পর্টেন্ট।

অবনীদা বাসে চেপে চলে গেলেন।

কাল রাত্রে ঘটকমশাই ফোন করেছিলেন। মালবাজারের মহাদেব সেনের বাড়িতে গিয়ে কথা বলেছেন। ওঁরা খুব খুশি। সতীশ রায়ের যদি অসুবিধে না থাকে তাহলে আগামীকালই তারা মেয়ে দেখাতে রাজি আছেন। সতীশ রায় বলেছেন, কোনও অসুবিধে নেই। তবে তুমি দুপুরে চলে এসো এখানে।

আজ সকালে চা খাওয়ার পর ছেলেকে ডেকে পাঠালেন। হরিপদ ফিরে এসে জানাল, খোকা এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি।

ঘড়ি দেখলেন সতীশ রায়। সকাল আটটা। বললেন, এক বালতি জল ওর। গায়ে ঢেলে দাও। বিছানা ভিজুক।

মিনিট আটেক বাদে সত্যচরণ এসে দাঁড়াল। সতীশ রায় ছেলেকে আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, বেলা আটটা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছ, লজ্জা করে না তোমার?

রাত্রে ঘুম আসে না। মিনমিন করে বলল সত্যচরণ।

কেন?

মায়ের কথা মনে পড়ে।

উফ্! যাকে তুমি ভালো করে চেনোনি তার জন্যে রাত জাগছ? শোনো, আজ আমি মালবাজারে যাচ্ছি। ওখানে একটি ভালো মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। সে যদি তোমার উপযুক্ত হয় তাকে এই বাড়ির বউ করে নিয়ে আসব। সতীশ রায় ঘোষণা করলেন। সত্যচরণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

কথাটা কি কানে গিয়েছে?

এটা মায়ের মৃত্যুমাস, এখন না দেখলেই কি নয়?

মৃত্যুমাস শেষ হয়ে এল বলে। আচ্ছা, এর আগে অনেকবার এই মৃত্যুমাস এসেছে, কই, কখনও তোমাকে এসব বলতে তো শুনিনি। সতীশ রায় সন্দেহের চোখে তাকালেন, কথাটা জানিয়ে রাখলাম। আজ মেয়েটিকে দেখতে যাব।

আমি–।

না না। তোমাকে নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে হ্যাঁ, পাত্রীপক্ষ চাইতে পারেন তোমাকে দেখতে। তুমি যে বোবা কালা হাবা ল্যাংড়া নও তা ওঁরা কী করে জানবেন! সেক্ষেত্রে তাঁরা দেখতে আসবেন। তখন দয়া করে মুখ বন্ধ করে থেকো না। কাল থেকে কাঠের কারখানায় গিয়ে বসবে। পাত্র বেকার, এটা শুনলে কোনো পাত্রীপক্ষের ভালো লাগার কথা নয়। কারখানায় নিয়মিত বসলে বলতে পারব তুমি আমাকে ব্যবসায় সাহায্য করছ। যাও।

ছেলে চলে গেলে হিসেবপত্র নিয়ে বসেছিলেন সতীশ রায়, দরজায় শব্দ হল। মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন এলোকেশী আর মতির মা দাঁড়িয়ে আছে।

কী চাই? বিরক্ত হলেন তিনি।

ভগবান আছেন বড়বাবু। এলোকেশী বলল।

ও। তার সঙ্গে দেখা হল বুঝি? যত্ত বাজে কথা। কাজের সময় বিরক্ত না করলেই নয়। কী বলতে এসেছ বলে ফেলো।

বাবার বদলির অর্ডার এসেছে গতকাল। আজকের মধ্যেই যেতে হবে। এলোকেশীর গলায় খুশি স্পষ্ট।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। বাবা তো ভেবেই পাচ্ছে না এত তাড়াতাড়ি কী করে বদলি হতে হচ্ছে! আজ দুপুরের মধ্যে বাবাকে নাথুয়াতে যেতে হবে। বাবা গেলে মাও সঙ্গে যাবে।

সেটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে তুমিও তো ওদের সঙ্গে যাচ্ছ!

না। কিছুতেই না। মাথার ওপর ভগবান আছেন তা আপনি যতই ঠাট্টা করুন। এখানে ওরা থাকলে আমার ওপর জোর ফলাতো তাই ভগবান ওদের দূরে পাঠিয়ে দিলেন। এলোকেশী বলল, আজ দুপুরে গিয়ে আমার সব জিনিসপত্র এ বাড়িতে নিয়ে আসব।

এবার মতির মায়ের দিকে তাকালেন সতীশ রায়। তোমার কোনও কাজকর্ম নেই?

বাবু, একটা কথা বলব।

তোমার ছোটখোকার ব্যাপার ছাড়া যে কোন ব্যাপারে বলতে পারো।

আজ্ঞে ও ছাড়া আমার তো কেউ নেই।

কী বলতে চাও?

ওর তো বয়স খুব কম। একটু-আধটু কাজকর্মে সড়গড় তোক তারপর মেয়ে দেখাশোনা করলে হয় না?

একথা তোমাকে সে বলেছে?

হ্যাঁ বাবু।

আমাকে বলেনি কেন?

আজ্ঞে, আপনাকে মুখের ওপর বলতে ভয় পায়।

ওই যে সড়গড় শব্দটা বললে না? ওটা করাবার জন্যে বাড়িতে বউমা আনছি। যাও, বিরক্ত কোরো না।

যেতে যেতে মতির মাকে বোঝাচ্ছিল এলোকেশী, কানে এল সতীশ রায়ের, ছোটবাবু তো নরম মনের মানুষ তাই ভেঙে পড়েছে। বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।

মনে মনে হাসলেন সতীশ রায়। নরম মনের মানুষ! মা চলে গেছে পনেরো বছর আগে আর এখন ওর মন নরম হয়ে ভেঙে পড়ছে। ম্যাদামারা। এবার শব্দ করে হেসেই চেপে গেলেন। লোকে শুনলে পাগল বলে ভাববে। মেয়েটা যদি তার প্রশ্নের জবাব ঠিকঠাক দেয় তাহলে সত্যচরণকে নিয়ে কোনও চিত্ত নেই।

সকালে মাছ ধরার কোচিং দেখতে গেলেন। আজ আর গতকালের মতো ভিড় নেই। লোকে যখন জানতে পেরে গেছে চাইলেও মাছ পাওয়া যাবে না তখন আর গিয়ে লাভ কি। যতীন আর মতিন কীভাবে জাল টানতে হয় তা শেখাচ্ছিল। এইসময় গোরক্ষ আর নাগেশ্বর চলে এল।

নাগেশ্বর বলল, কাণ্ড দেখুন। একবার মুখ তুলে দেখাবি তো কে এসে দাঁড়িয়ে আছে পাড়ে। বাড়িতে না খাওয়া হোক, পাত্রী দেখতে যাব, হাতে পাঁচ কেজি টাটকা কালা থাকলে লোকে মাথা নুয়োবে। বড়বাবু, ওদের ডেকে বলি?

না। আমার জন্যে নিয়ম ভাঙতে হবে না। যখন বলেছি কোচিং-এর সময় যত মাছ জালে পড়বে তাদের আবার জলে ফেলে দিতে হবে তখন নিজের জন্যে মাছ চাইব কেন? সতীশ রায় ঘড়ি দেখলেন।

কখন শুভযাত্রা হবে বড়বাবু? গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল।

তিনটে থেকে সাড়ে তিনটে। ঘটকবাবু বলছিল ওই সময়টা নাকি যাত্রা শুরু করার পক্ষে খুব ভালো। সতীশ রায় নদীর ধার থেকে বাড়ির পথ ধরলেন।

নমস্কার বড়বাবু। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কম্পাউডারবাবু নমস্কার করলেন।

নমস্কার। সব ঠিক আছে তো?

কী করে ঠিক থাকবে বলুন। জ্বর পেট খারাপ আর ব্যান্ডেজ ছাড়া কোন ওষুধ তো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেই। ওষুধে জ্বর না কমলে রক্ত পরীক্ষা করাতে হয়। সেটার জন্যে সদরে যেতে বললে গালাগাল খেতে হয়। তার ওপর হয়েছে নতুন জ্বালা। কম্পাউন্ডারবাবু মুখ ঘোরালেন।

সেটি কী? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন।

যার পেটে ভালো করে ভাত পড়ে না সে পয়সা হাতে এলে ভাটিখানায় গিয়ে আকণ্ঠ মদ গিলছে। কাল বিকেলে ধরাধরি করে নিয়ে এল একজনকে। ডাক্তারবাবু ভাগ্যিস ছিলেন। নুনজল খাইয়ে বমি করালেন। একটু সুস্থ হলে বললেন শহরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করাতে। কম্পাউন্ডারবাবু বললেন।

লোকটা যে হাতে লাইসেন্স পেয়ে গেছে। আর দোকানও করেছে গ্রামের বাইরে জঙ্গল ঘেঁষে। দেখছি, কী করা যায়।

আরও কিছুটা এগিয়ে ঘড়ি দেখলেন তিনি। বারোটা বেজে দশ। বললেন, লোকটার নাম হরেকৃষ্ণ।

ওই ভাটিখানার মালিক তো, জানি। নাগেশ্বর বলল।

জানো। গিয়েছ নাকি সেখানে?

ছি ছি বড়বাবু। আপনার অনুমতি ছাড়া কোথাও গিয়েছি?

শোনো, তোমরা দুজন একবার সেখানে যাও। হরেকৃষ্ণকে আমি শর্ত দিয়েছিলাম বেকার লোক এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের মদ বিক্রি করতে পারবে না। সেটা মানছে কিনা দেখবে। বলবে তার বিক্রি করা মদ খেয়ে একজন এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে ডাক্তার বলেছে শহরে নিয়ে যেতে। এরকম যেন আর না হয়। পারবে তো তোমরা? সতীশ রায় বললেন।

গোরক্ষ বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

তাহলে তোমরা যাও। ঠিক তিনটের সময় সেজেগুজে এসো।

সে আর বলতে– নাগেশ্বর হাসল।

আজ দুপুরের খাবার মতির মা পরিবেশন করল। জানা গেল এলোকেশী গিয়েছে বাপের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র আনতে। কিন্তু তার চেয়ে অন্য খবর জানতে উৎসাহ বেশি মতির মায়ের, ছোটখোকা আজও মাছ ধরা দেখতে গেছে।

কখন?

এই তো, আপনি বাড়ি ফিরে চানে গেলেন, তখন—।

কথা বাড়ালেন না সতীশ রায়।

খাওয়া-দাওয়া সিগারেট শেষ পর্ব চুকলে গুরুচরণ হালদার দেখা করতে এল, মেয়ে নিশ্চয়ই বলেছে আমি বদলি হয়ে গেছি।

হ্যাঁ। বদলির চাকরির তো এই বিপদ।

মাত্র দুবছর হল এসেছি, আসরফ এক জায়গায় আট দশ বছর মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে অথচ আমার ঘাড়েই কোপ পড়ল। গিয়েছিলাম বি. ডি. ও. র অফিসে। উনি কিছুই জানেন না। গুরুচরণ ফুঁসছিল।

আমার কাছে কেন এসেছেন সেটা বলুন।

আজ্ঞে, আচমকা বদলি করল কিন্তু জিনিসপত্র নিয়ে নতুন জায়গায় যাওয়ার খরচ পরে বিল করে আদায় করতে হবে। এখন এই খরচ আমি কীভাবে করি? যদি কিছু ধার দেন।

কত?

এই ধরুন, হাজার পাঁচেক। গাড়ি ভাড়া করে মালপত্র নিয়ে যাওয়ার খরচ তো কম নয়। নতুন জায়গায় সংসার পাততেও তো খরচ হবে।

কতদিনে শোধ করবেন?

বেশিদিন না। দশ মাসে। মাসে পাঁচশো করে। গুরুচরণ বলল।

কথার খেলাপ হবে না তো?

একদম না। কারণ প্রত্যেক মাসে এলোর মাইনে বাবদ যে টাকা আপনি আমার হাতে দিতেন সেটা দশমাস দিতে হবে না। ঘরের টাকা ঘরেই রইল। সেই সঙ্গে যে ধার নিচ্ছি তা শোধ হয়ে গেল। গুরুচরণ হাসল।

তাহলে তো হল না।

মানে? হকচকিয়ে গেল গুরুচরণ।

আপনার মেয়ে বলেছে যে তার রোজগার করা টাকা কাউকে দেবে না।

একথা হারামজাদি বলেছে?

গালাগাল দিয়ো না। আমি দ্বিতীয়বার বরদাস্ত করব না।

হায় কপাল। দুধকলা দিয়ে এ কোন্ কালসাপ পুষলাম? আমার ওয়াইফ ঠিক কথা বলে! পাঁচ হাজার টাকা পথখরচা নিয়ে ওকে জোর করে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়াই উচিত ছিল। আমি ভাবলাম মাসে পাঁচশো পেলে বছরে তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। যে মুরগি ডিম দেবে তাকে কেন কাটব? আপনি ওর কথা কানে তুলবেন না বাবু। গুরুচরণ ভেঙে পড়ল।

সতীশ রায় ডাকলেন, হরিপদ।

হরিপদ এল। সতীশ রায় বললেন, দুলালকে বল শুরুচরণবাবুর মালপত্র আজই নাথুয়াতে পৌঁছে দিতে। যা ভাড়া হবে তা যেন আমার কাছ থেকে নেয়। যান আপনি ওর সঙ্গে। এর বেশি কিছু আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।

হরিপদ গম্ভীর গলায় বলল চলুন।

ঘটকমশাই এসে গিয়েছেন ঠিক সময়ে। আজ বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। খেতে বললে রাজি হলেন না। বললেন, গিন্নিকে বলে এসেছি যদি বাবুমশাই-এর পাত্রী পছন্দ হয় তাহলে রাত্রে ওঁর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে থেকে যাব। আজ কোন চিন্তা নেই।

সতীশ রায় আজ একটু সাজলেন। শ্বশুর হওয়ার এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইলেন। ভালো পাঞ্জাবি, ধুতি, পাম্প স্যু বের করলেন। অনেককাল ব্যবহার না করা পারফিউম দুই বগলে ছড়ালেন। চুল আঁচড়ালেন পরিপাটি করে।

বড়বাবু। দরজায় এলোকেশী।

কী ব্যাপার? মুখ ফেরালেন বা সতীশ রায়।

সম্পর্ক শেষ করে এলাম। জিনিসপত্র যা ছিল নিয়ে এসেছি।

ভালো।

আপনার কাছে টাকা চাইতে এসেছিল, দেননি তো?

যাও স্নান-খাওয়া করে নাও।

যাই। পরে তো, মানে যাওয়ার সময় বলতে পারতাম না, তাই তড়িঘড়ি বলতে এলাম।

পরে পারতে না কেন?

কনে দেখতে যাবেন। শুভ কাজ। সেইসময় বিধবার মুখ দেখতে নেই। এলোকেশী চলে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। তারপর স্ত্রীর ছবির দিকে তাকালেন। স্ত্রী নেই, তিনি তো বিপত্নীক। বিধবাদের যদি অত নিয়ম মেনে চলতে হয়, তাহলে বিপত্নীকদের এত স্বাধীনতা কেন?

সাড়ে তিনটে বাজতে চলল তবু মানিকজোড়ের দেখা নেই। ঘটকমশাই অধৈর্য হচ্ছেন। পাঁজিতে বলেছে সাড়ে তিনটের আগেই বেরুতে হবে।

তিনটে আঠাশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলেন তারা। ঘটকমশাই বসলেন ড্রাইভারের পাশে। তিনি বললেন, ওঁরা কেন এলেন না, সময়টা জানতেন তো? আপনাকে এত মান্যি করেন।

এরকম ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। সতীশ রায় বললেন।

ও হ্যাঁ। বানারহাট থেকে রসগোল্লা নেবেন নাকি?

রসগোল্লা? অন্যমনস্ক ছিলেন সতীশ রায়।

প্রথমবার যাচ্ছেন, খালি হাতে যাবেন?

ও। কিন্তু ধরো, মেয়ে দেখলাম, পছন্দ হল না, তখন ওই রসগোল্লা ওরা খুশি হয়ে খেতে পারবে? আমারও মনে হবে অনর্থক নিয়ে গেলাম।

তা অবশ্য। ঘটকমশাই বললেন, তবে রেওয়াজ আছে বলেই–।

ঠিক আছে। মেয়ে পছন্দ হলে মালবাজারের মিষ্টির দোকানে অর্ডার দেব চার রকমের মিষ্টি সেন বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে। সতীশ রায় বললেন।

ডুডুয়া থেকে ন্যাশনাল হাইওয়েতে ওঠার মুখে ওদের দেখতে পেয়ে ড্রাইভার গাড়ির গতি কমিয়ে বলল, ওই যে ওখানে।

গাড়ি থামাও। সতীশ রায় বললেন।

ড্রাইভার ওদের পাশে গাড়ি থামাতেই ওরা সামনের দরজা খুলে উঠে পড়ল। ঘটকমশাই চেঁচালেন, আরে কী করছেন! এতখানি সরে গেলে ড্রাইভার গাড়ি চালাবে কী করে?

গোরক্ষ দরজা বন্ধ করে মুখ নিচু করল।

সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় গিয়েছিলে?

দুজনে দুজনের দিকে তাকাল, জবাব দিল না।

সেই একই পোশাকে আছ, বাড়িতে স্নান খাওয়া করে আসনি?

দুজনে মাথা নিচু করল। ঘটকমশাই চাপে পড়ে উসখুস করছিলেন, এবার ওদের দিকে তাকাতেই বলে উঠলেন, ইস। কী দুর্গন্ধ।

সঙ্গে সঙ্গে দুজনের হাত দুই পকেটে ঢুকে গেল। রুমাল বের করে দুজনেই মুখ চাপা দিলেন।

সেকি! তোমরা এই ভরদুপুরে মদ গিলে এসেছ? সতীশ রায় রেগে গেলেন, নামো, নেমে যাও গাড়ি থেকে। তোমাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই আমার।

গোরক্ষ মিনমিন করল, দোষ আমাদের না, বিশ্বাস করুন।

নাগেশ্বর বলল, আমরা ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলাম।

গাড়ি থেমে গিয়েছিল। গোরক্ষ বলল, একটু শুনুন, প্লিজ। আমরা হরেকৃষ্ণের ভাটিখানায় গিয়ে কোনও বেকার বা অপ্রাপ্তবয়স্ককে দেখতে পাইনি।

পেলে ঝাড়ব কী করে ওকে। তখন নাগেশ্বর বলল, ওখানকার চোলাই খেয়ে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে। শোনামাত্ৰ ক্ষেপে গেল্ল হরেকৃষ্ণ। সে চিৎকার করল, সে হয়তো অন্য দোষ করে কিন্তু কখনই ভেজাল চোলাই বিক্রি করে না। এই বদনাম সে সহ্য করতে পারবে না। আমাদের প্রমাণ দিতে হবে সে খারাপ চোলাই বিক্রি করেছে। আমি অসুস্থ লোকটার কথা বললাম। শুনে সে উড়িয়ে দিল। তিনটুকরো ইলিশ সবাই খায়। কিন্তু দু-টুকরো খেলেই কারও কারও অম্বল হয়। তাই বলে কি ইলিশটা খারাপ? সে বলল, আপনারা নিজেরা খেয়ে দেখুন, খেয়ে মন্দ বলুন। আমি মেনে নেব। এই দোকান বন্ধ করে চলে যাব।

নাগেশ্বর বলল, আমি ভাবলাম দারুণ মোকা পাওয়া গেল। খেয়ে খারাপ বললে ভাটিখানা উঠে উঠে যাবে। আমি তো কখনও চোলাই খাইনি। ঠিক বুঝতে না পেরে গোরক্ষকে বললাম খেতে। ও ঠিক ধরতে পারল না ভালো না খারাপ।

তারপর একের পর এক গ্লাস গিলে গেছ?

আজ্ঞে তখন আর খেয়াল ছিল না।

দাম দিয়েছ?

গোরক্ষ বলল, দিতে চেয়েছিলাম কিছুতেই নিতে চাইল না।

নিতে চাইল না বলে খুব খুশি হলে?

না বড়বাবু। আপনার কাছে প্রসাদ পাই তাই বলে অন্য লোক, ছিঃ।

কাল সকালে গিয়ে দাম মিটিয়ে আসবে। না নিলে ফেলে দেবে ওর সামনে। যাও, নামো। সতীশ রায় বিরক্ত।

বড়বাবু। গোরক্ষ বলল।

পরিবারের কাছে তো বটেই। নিজের কাছেও মুখ দেখাতে পারব না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল নাগেশ্বর, আমাদের নামাবেন না।

কী চাও?

পাত্রী দেখতে যাব। গোরক্ষ বলল, মাথা নাড়ল নাগেশ্বর।

চমৎকার। দু-দুটো মাতালকে সঙ্গে নিয়ে পাত্রী দেখতে যাব আমি। কী ভেবেছ তোমরা। চিৎকার করলেন সতীশ রায়।

বেশ। আমরা গাড়িতেই বসে থাকব, নামব না। তবু তো বলতে পারব বড়ার সঙ্গে পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম। গোরক্ষ বলল।

কথাটা মনে থাকে যেন। গাড়ি চালাও।

মিনিট তিনেকের মধ্যে ঠাণ্ডা বাতাস ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিল, ঘটকমশাইকে খোঁচা মারতে হচ্ছিল ওদের সরাতে।

মালবাজারে পৌঁছাতে পাঁচটা বাজতে দশ। পেট্রল পাম্পের কাছে গাড়ি থামিয়ে ওদের নামতে বললেন সতীশ রায়।

তখন চোখে ঘুম ওদের। সতীশ রায় বললেন, ওপাশের ওই মাঠে শুয়ে ঘুমাও। ফেরার সময় ডেকে নিয়ে যাব।

সারাদিন খাইনি–। গোরক্ষ বলল।

ওসব খাওয়ার পর শরীরে খাবার খাওয়া উচিত। নাগেশ্বর বলল।

এই অবেলায় ভাত খেতে হবে না। পুরি তরকারি খেয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থেকো। ধরো। কুড়িটা টাকার নোট নাগেশ্বরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সতীশ রায় বললেন, ঘটকবাবু, কোন পথে যেতে হবে?

ঘটকমশাই পথ চিনিয়ে নিয়ে এলেন।

বাগান এবং বাড়ির চেহারা দেখে সতীশ রায় অনুমান করতে পারলেন এদের অবস্থা বেশ ভালো। গাড়ির শব্দে একজন বৃদ্ধ হাতজোড় করে বেরিয়ে এলেন বারান্দা থেকে। ঘটকমশাই ফিসফিস করে বললেন, মহাদেব সেন।

মহাদেব সেনের বয়স সত্তরের ওপাশে। বোঝাই যাচ্ছিল, উনি সতীশ রায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বাগানের গেট খুলে আপ্যায়ন করলেন, নমস্কার। আসুন।

গাড়ি থেকে নেমে সতীশ রায় হাত জোড় করলেন, বাঃ, আপনার বাড়িটি বেশ সুন্দর।

ওই আর কী! আসতে অসুবিধে হয়নি তো? মহাদেব জিজ্ঞাসা করলেন।

বিন্দুমাত্র না। ঘটকবাবু পথ চিনিয়ে আনলেন। সতীশ রায় জবাব দিলেন।

মহাদেব সেন ঘটক মশাইয়ের দিকে তাকালেন, আপনি বলেছিলেন ওঁর সঙ্গে আরও দুজন আসতে পারেন–!

সতীশ রায় বললেন, আমি একাই এলাম। আসলে আমার বাড়ির বউ করে যাকে নিয়ে যাব তাকে আমিই দেখতে চাই প্রথমবার।

কথা বলতে বলতে ওঁরা বারান্দা পেরিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকলেন। মহাদেব সেন বললেন, বসুন।

ওঁরা বসতেই ভেতর থেকে একটি কাজের মেয়ে ট্রে-তে জলের গ্লাস রেখে সামনে এল। ঘটকমশাই জল খেলেন, সতীশ রায় বললেন, না।

মেয়েটি চলে গেলে সতীশ রায়ের দিকে তাকিয়ে মহাদেব সেন বললেন, অনেকটা পথ এসেছেন, একটু চা।

হবে। ব্যস্ত হবেন না। আমি যাকে দেখতে এসেছি সে আপনার নাতনি?

হ্যাঁ। আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম শিলিগুড়িতে। পাত্র ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের দুবছরের মাথায় মেয়ে হল। সেই মেয়ের পাঁচ বছর বয়সে দুর্ঘটনা ঘটল! সেবকের রাস্তায় জিপ দুর্ঘটনায় মারা গেল জামাই। তখন থেকে ওরা এখানে। নাতনি এখানকার স্কুলে পড়েছে। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর ওর দিদিমা চাইছে বিয়ে দিয়ে দিতে। পড়াশুনোয় তেমন মেধাবী নয় যে কলেজে পড়ে উন্নতি করতে পারবে। বুঝতেই পারছেন ওই মেয়েই আমাদের সবকিছু। মহাদেব সেন বললেন।

কি নাম?

প্রতিমা।

বাঃ।

আপনার ছেলে শুনলাম আপনাকে ব্যবসায় সাহায্য করে?

প্রশ্নটা শুনে ঘটকমশাই-এর দিকে তাকালেন সতীশ রায়। তারপর নীরবে মাথা নাড়লেন।

ভালো। আপনার কথা আমরা মালবাজারে বসেও শুনেছি। ডুডুয়ার সতীশ রায় আমার বাড়িতে আসছেন শুনলে অনেকেই দেখতে আসতে চাইত।

আপনি আমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছেন। আমি সামান্য ব্যক্তি। কিছু জমিজমা আর কাঠের কারখানা ছিল, আমি আরও কিছু বাড়িয়েছি। স্ত্রী চলে গেছেন পনেরো বছর আগে। সব কিছু দেখে ছেলেকে মানুষ করা যে কী সমস্যা তা আমিই জানি। তবে হ্যাঁ, ছেলে এখনকার মতো অবাধ্য, বারমুখো নয়। আবার এত ঘরমুখী যে সেটাই সমস্যা হয়েছে। এক ছেলে, তাকে ভালভাবে সংসারী করে যেতে না পারলে চুপ করলেন সতীশ রায়।

একি! এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথা বলছেন কেন? আপনার বয়স আমার চেয়ে অনেক কম। মহাদেব সেন কথাটা বলতেই ভেতরের দরজায় টোকা পড়ল। এক মিনিট, বলে মহাদেব সেন ভেতরের দরজার পর্দা সরিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলেন। ঘটকমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন বুঝছেন?

বোঝার মত কিছু কি ঘটেছে? চাপা গলায় বললেন সতীশ রায়।

মহাদেব- সেন ফিরে এসে বললেন, এবার নাতনিকে এঘরে আসতে বলি?

অবশ্যই। সতীশ রায় মাথা নাড়লেন।

সঙ্গে সঙ্গে পর্দা সরিয়ে যে এঘরে ঢুকল তার পরনে দামী শাড়ি যেটা সামলাতে অনেকগুলো সেফটিপিন ব্যবহার করা হয়েছে। মুখে পাউডারের প্রলেপ, চিবুক বুকের দিকে। চুল পাতা করে বাঁধা।

মহাদেব সেন বললেন, ওই চেয়ারে বসে দিদি।

জানি। চিবুক উঠল না, মুখ থেকে শব্দ বেরুল। বেরুতেই ভেতরের দরজায় দুবার টোকা পড়ল।

তুমি প্রতিমা?

মাথাটা একবার ঈষৎ ওপর-নিচ হল।

তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছ না কেন?

ধীরে ধীরে মুখ উঠল। সতীশ রায় দেখলেন মুখটি নিখুঁত। এতটা নিখুঁত তিনি আশা করেননি। দুবার কেন দশবার দেখেও হতচ্ছাড়াটার আশ মিটবে না।

আচ্ছা মা, তুমি কি বাড়িতে এরকম শাড়ি পরে থাকো?

মাথা নেড়ে না বলল প্রতিমা।

তাহলে এক কাজ কর। ভেতরে গিয়ে খুব চটপট বাড়িতে যা পর তাই পরে এসো। আর আসার আগে মুখ ধুয়ে ফেলবে, চুলও খুলে যেমন থাকো তেমন হয়ে আসবে।

বলমাত্র তড়াক করে উঠে প্রতিমা যেভাবে ভেতরে চলে গেল তাতে ঘটকমশাই-ও হেসে ফেললেন। ভেতরে তখন শাসানি চলছে আর প্রতিমা চাপা গলায় বলছে, আমি কী করব?

সতীশ রায় মহাদেব সেনকে বললেন, আমি ওকে ওর মতো দেখতে চাই, এই কথাটা যদি ভেতরে বলে দেন–।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। মহাদেব সেন বললেন, সাধারণত যারা দেখতে আসেন তারা সাজাগোজা অবস্থাতেই দেখতে চান।

কাজের মেয়েটি চা নিয়ে এল। ঘটকমশাই হাত বাড়ালেন কিন্তু সতীশ রায় নিলেন না। যতটা সময় লাগতে পারে বলে সতীশ রায় ভেবেছিলেন তার অনেক আগেই প্রতিমা ফিরে এল। তার দিকে তাকিয়ে সতীশ রায় বলে উঠলেন, বাঃ। এই তো। এখন তোমাকে অনেক সহজ লাগছে।

আটপৌরে শাড়ি, মুখে রঙ নেই, চুল হাত খোঁপায় আটকানো, প্রতিমা বাইরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপল।

আচ্ছা, তুমি নিশ্চয়ই জানো, আমি কে?

মাথা নাড়ল প্রতিমা।

কে বল তো?

তাকাল প্রতিমা, ডুডুয়ার সতীশ রায়।

শব্দ করে হাসলেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, আমার ছেলের নাম। সত্যচরণ রায়। তোমার যেমন বাবা নেই, ওরও তেমন মা নেই। তবে ওর একটা অভ্যেস আছে। বেশির ভাগ সময় ঘরে বসে লেখালেখি করে।

কী লেখে?

কী জানি! আমাকে দেখায় না। চুপ করে প্রতিমাকে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর রুমাল বের করে মুখ মুছলেন।

আমি কি হাঁটব? প্রতিমা জিজ্ঞাসা করল।

অ্যাঁ? শুধু শুধু হাঁটবে কেন?সতীশ রায় বুঝতে পারলেন না।

যারা দেখতে আসে তারা তো হাঁটতে বলে। একজন আবার ভেজা পায়ে হাঁটতে বলেছিল। মেঝেতে পায়ের ছাপ পরীক্ষা করেছিল। প্রতিমা বলল।

কেন?

ওমা, আপনি এসব জানেন না? প্রতিমা প্রশ্ন করা মাত্রই ভেতরের দরজায় শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ নামাল সে, না। আমি কিছু বলব না।

তোমাকে হাঁটতে হবে না, খোঁপা খুলে দেখাতে হবে না কত চুল!

তাহলে সেলাই আনব?

এনে কী করবে? আমাদের বাড়ির সেলাই দর্জি করে।

ও।

আমি কি রাঁধতে পারি–।

সেটা জেনেও কোনও উপকারে আসবে না। কারণ রান্না করে মতির মা আর এলোকেশী। তোমাকে তারা রান্নাঘরে ঢুকতেই দেবে না।

তাহলে এখন কি আমাকে গান গাইতে হবে?

গান–! সতীশ রায় তাকালেন।

আমি গান গাইলে সবাই চুপ করতে বলে।

তাহলে গাইতে হবে না। সতীশ রায় বললেন, আমি তোমাকে মাত্র একটি প্রশ্ন করব। বুঝতে পারছ?

না। মাত্র একটা প্রশ্ন? এর আগেরবার যারা এসেছিল তারা চৌদ্দটা প্রশ্ন করেছিল। আপনি মাত্র একটা করবেন?

হ্যাঁ।

কোনও অথবা দেবেন না?

না।

প্রতিমা অসহায় চোখে মহাদেব সেনের দিকে তাকাল। মহাদেব সেন বললেন, প্রশ্নটা শোন, উত্তর জানা থাকলে জবাব দিবি।

আর না জানা থাকলে ফেল করব! বলে সতীশ রায়ের দিকে তাকাল প্রতিমা, জানেন, গতবার প্রশ্ন করেছিল, অসুরকে মেরে দুর্গাঠাকুর কি দশ হাত নিয়ে কৈলাসে ফিরে গিয়েছিল না আট হাত খুলে ফেলেছিল?

সর্বনাশ, এর উত্তর তো আমারও জানা নেই। কি ঘটকবাবু, তুমি জানো?

ঘটকমশাই মাথা নেড়ে না বললেন।

সতীশ রায় বললেন, তারপর?

আমি বললাম, সিংহ তো দুর্গার সঙ্গে কৈলাসে যেতে পারে না। ও হিমালয়ের জঙ্গলে থাকে। দুর্গা নেমে এসে ওর পিঠে ওঠেন প্রত্যেক বছর, তার আটটা হাত দুর্গা সিংহের কাছে জমা রেখে যান। সিংহ পাহারা দেয়। প্রতিমা হাসল।

সতীশ রায় বললেন, চমৎকার, চমৎকার উত্তর।

ঠিক আছে। আপনি প্রশ্ন করুন।

আমার একটাই প্রশ্ন। তোমাকে ওই প্রশ্নের পাঁচটা উত্তর দিতে হবে। যেমন, যদি জিজ্ঞাসা করি তোমার জানা পাঁচটা ফলের নাম বলো। তুমি কী বলবে?

আম, লিচু, আপেল, ন্যাসপাতি, কাঁঠাল। উত্তর দিল প্রতিমা।

গুড। আমার প্রশ্নটারও পাঁচটা উত্তর চাই। তুমি এতদিন ধরে যত গালাগাল শুনেছ তার সেরা পাঁচটা আমাকে বলো।

গালাগাল? চোখ গোল হয়ে গেল প্রতিমার। মহাদেব সেন উঠে বাইরের বারান্দায় চলে গেলেন। ভেতরের দরজায় শব্দ হলো না।

হ্যাঁ। তুমি কি গালাগাল জানো না?

হুঁ।

পাঁচটা বেস্ট গালাগাল বলল।

অসভ্য। নিচু গলায় বলল প্রতিমা।

এ তত তোমরা সাত আট বছরেই বলতে। সবার সামনে বলতে। তবু এটাকে এক বলে ধরলাম।

বদমাশ? গলা একটু উঠল।

হ্যাঁ। দুই। তবে খুব নিরীহ গালাগাল।

মুখপোড়া? গলা আরও উঠল।

তিন। চলবে।

মাকাল? এবার গলা ছাড়ল।

বাঃ। এবার পাঁচ নম্বর। এটাই আসল। যেগুলো বলেছ তাদের থেকে কড়া একটা কিছু বল। সতীশ রায় উত্তেজিত।

প্রতিমা ভাবছিল কিন্তু কোনও শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। তার মুখে অনেক

অভিব্যক্তি কিন্তু কোনও শব্দ নেই।

সেটা লক্ষ্য করে সতীশ রায় বললেন, আমি তোমাকে সাহায্য করছি। কিন্তু যেহেতু তুমি বললে না তাই এটা পাঁচ নম্বর হবে না। বলে একটু থেমে হেসে বললেন, ম্যাদামারা।

হ্যাঁ। চোখ বড় করল প্রতিমা।

আগের বার যারা দেখতে এসেছিলেন তাঁদের ছেলের সম্পর্কে তুমি একথা বলেছিলে, ঘটকবাবুর মুখে শুনেছি।

হ্যাঁ। কিরকম কেঁচোর মত বসেছিল।

অতএব পাঁচ নম্বরটা। সতীশ রায় বললেন।

মনে আসছে না।

এক মিনিট সময় দিচ্ছি।

চোখ বন্ধ করে বসে থাকল প্রতিমা। পঞ্চাশ সেকেন্ড যখন পার হয়েছে ৩খন চেঁচিয়ে উঠল, পাঁচ নম্বর হল, ঢ্যামনা।

সতীশ রায় প্রাণখুলে হেসে উঠলেন, পারবে, মা তুমিই পারবে। ঘটকবাবু, ডাকুন ওর দাদুকে।

ডাকতে হল না। তার আগেই মহাদেব সেন ঘরে ফিরে এলেন। সতীশ রায় এগিয়ে গিয়ে তার পায়ে হাত দিতে চাইলে তিনি চমকে সরে গেলেন, একি করছেন আপনি? ছি ছি। আপনার মতন মানুষ আমাকে–।

আপনি বয়সে বড়। সম্পর্কে আমার বেয়াই-এর বাবা। আমার পিতৃসমই।

বেয়াই?

আপনার ছেলে থাকলে তাকে ওই সম্বোধনই তো করতাম। সতীশ রায় বললেন, আপনার নাতনিকে আমি পুত্রবধূ হিসেবে দেখতে চাই।

এ তো খুব আনন্দের কথা–।

প্রথমে এক কাপ চা খাব। সতীশ রায় বললেন।

প্রতিমা দৌড়ে গেল ভেতরে।

ঘটকমশাই বললেন, এবার বলুন, আপনি যেমনটি চেয়েছিলেন তেমনটি পেয়েছেন তো?

একশতে একশ। কী বলে তোমাকে ধন্যবাদ দেব আমি জানি না। হাসলেন সতীশ রায়।

মুখোমুখি বসে মহাদেব সেন ইতস্তত করেও শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু মনে করবেন না, এর আগে যারা মেয়ে দেখতে এসেছে তাদের মতো কোনও প্রশ্ন করলেন না কেন? মানে, যাকে বলে যাচাই করে নেওয়া!

অর্থ হয় না। ওর মাথার চুল গোড়ালি ছুঁয়েছে কি কোমর পর্যন্ত নেমেছে তা জেনে আমার সংসারের কী লাভ হবে? ও তো স্কুলে পড়াতে যাচ্ছে না যে সাধারণ জ্ঞান কেমন সেইসব প্রশ্ন করে জানব মেধা কী রকম? একটা সুস্থ মেয়ে যার মানসিক বিকার নেই, দেখলে মন্দ লাগে না, ব্যবহার ভালল, এই তো যথেষ্ট। আজকাল বাড়িতে রাঁধুনি থাকায় রান্না কীরকম জানে এই প্রশ্নের দরকার পড়ে না। প্রয়োজন হলে বিয়ের পর রান্না শিখে নেবে। সতীশ রায় বললেন।

কিন্তু।

বলুন।

আপনি ওর কাছে গালাগালি শুনতে চাইলেন কেন?

ওটা আমার গোপন ব্যাপার।

কিন্তু গতবার ওর একটা কথা শুনেই পাত্রপক্ষ রেগেমেগে চলে যায়।

ভাগ্যিস গিয়েছিল নইলে আমি সুযোগ পেতাম না।

আমি কিন্তু এরকম কখনও শুনিনি। মেয়ে দেখতে এসে কেউ কি কখনও জানতে চেয়েছে পাত্রী কীরকম গালাগাল জানে? আচ্ছা, যদি ও না জানত?

তাহলে বলতাম না চা খাব।

তার মানে আপনার সংসারে যে পুত্রবধূ যাবে তার গালাগাল জানা জরুরি।

বলেছি তো ওটা আমার গোপন ব্যাপার।

প্রতিমা এল ট্রেতে মিষ্টি আর চা নিয়ে। সঙ্গে যিনি এলেন তাঁকে দেখে বোঝা যায় উনি মহাদেববাবুর স্ত্রী।

মাথা নাড়লেন সতীশ রায়, না মা মিষ্টি নয়, আমি চা খাব।

এখানকার মিষ্টি খুব ভালো। প্রৌঢ়া বললেন।

মহাদেব সেন বললেন, আমার স্ত্রী।

ওহো! নমস্কার। হ্যাঁ, আজ নয়, মিষ্টি খাব বিয়ের দিনে। ঘটকবাবু, তুমি আমার প্লেট সাবাড় করে দাও।

অসম্ভব, একসঙ্গে খেতে পারব না।

তাহলে পরে খাবেন। প্যাক করে দেব। প্রৌঢ়া বললেন।

সতীশ রায় হাসলেন, তুমি দেখছি পুজোরি বামুন হয়ে গেলে। চায়ের কাপপ্লেট তুলে নিলেন তিনি।

প্রৌঢ়া বললেন, আমার নাতনিকে পছন্দ হয়েছে শুনে মন ভরে গেল। আপনার বাড়িতে ও গেলে কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না।

চায়ে চুমুক দিয়ে সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী করে বুঝলেন?

আপনার কথাবার্তা শুনে।

কিন্তু ওকে অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন পনেরো বছর আগে। অন্দরমহল কাজের মেয়েদের হাতে। ওর মাথার ওপর শাশুড়ি বা ননদ থাকছে না। ও হ্যাঁ, আমি তো মেয়ে দেখলাম, ভালো লাগল। কিন্তু আপনারা কবে আসছেন ডুডুয়াতে?

প্রতিমা বলে উঠল, দিদা মাকে নিয়ে ডুডুয়াতে গিয়েছিল।

তাই নাকি? প্রৌঢ়ার দিকে তাকালেন সতীশ রায়।

অনেক বছর আগে। প্রৌঢ়া বললেন।

মহাদেব সেন বললেন, তিরিশ বছর তো বটেই। আমার মামাতো ভাই এখানেই মানুষ হয়েছিল। সে চাকরি পায় পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে। প্রথমেই পোস্টমাস্টার হয়ে ডুডুয়াতে পোস্টিং পায়। তার আবদারে উনি মেয়েকে নিয়ে দিন দশেক সেখানে থেকে সংসার গুছিয়ে আসেন। এখন সেই ছেলে প্রমোশন পেয়ে পেয়ে অনেক বড় পোস্টে চলে গেছে।

তিরিশ বছর আগে? কি নাম ওঁর?

শিবশংকর রায়।

মাথা নাড়লেন সতীশ রায়, খুব ঝাপসা মনে পড়ছে। বেশিদিন থাকেননি ডুডুয়াতে। আপনারা মাত্র দশদিন ছিলেন?

হ্যাঁ। তখন ওখানে খুব অসুবিধে হত। এখন শুনেছি শহরে যা পাওয়া যায় তা ওখানেও পাওয়া যাচ্ছে। প্রৌঢ়া বললেন।

দিদা, ওই ঘটনাটা বলো। প্রতিমা প্রৌঢ়াকে ইশারা করল।

কী ঘটনা? সতীশ রায় তাকালেন।

ও কিছু না। প্রৌঢ়া মাথা নাড়লেন।

মা তো খুব সুন্দরী ছিল তাই ওই দশদিন বাড়িতেই বসে থাকত দিদা মাকে নিয়ে। রাস্তায় বেরুলেই লোকে নাকি হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। একটা সম্বন্ধও নাকি এসেছিল। প্রতিমা জানিয়ে দিল।

তাহলে আপনারা কবে যাচ্ছেন?

আপনি বলছেন যখন তখন নিশ্চয়ই যাব। ঘটকমশাই-এর মুখে যা শুনেছি তাতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। আপনাকে জানিয়ে দেব।

তাহলে উঠি। হ্যাঁ, তোমাকে ভালো লাগল, একেবারে খালি হাতে এসে ফিরে যাই কী করে! পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা গয়নার বাক্স বের করে সেটা খুললেন সতীশ রায়। তারপর একটা একভরি চেন তুলে বললেন, এটি আমার মায়ের ছিল। মা আমার স্ত্রীকে দিয়েছিলেন। তিনি নেই, তার হয়ে আমি তোমাকে দিলাম। এটিকে কখনও হারিয়ো না। বাক্সে চেন রেখে এগিয়ে ধরলেন সতীশ রায়।

প্রৌঢ়া বললেন, একি করছেন? এমন মূল্যবান জিনিস ওকে এখনই দিচ্ছেন কেন? বিয়ের পর দিলে ভালো হত।

কেন? আমার মন ওকে স্বীকার করে নিয়েছে সেটাই তো শেষ কথা। বিয়ে তো সমাজের স্বীকৃতির জন্যে। ওকে পরিয়ে দিন।

প্রৌঢ়া সোনার চেন পরিয়ে দিতেই প্রতিমা সতীশ রায়কে প্রণাম করল। তারপর দাদু দিদাকে প্রণাম সেরে ঘটকমশাই-এর দিকে এগোলে তিনি না না বলে সরে গেলেন।

সতীশ রায় বললেন, বিয়ের দিন আপনার সুবিধে মতো ঠিক করুন। যখন ছেলেকে দেখতে যাবেন তখন জানিয়ে দেবেন।

দরজার কাছে গিয়ে মহাদেব সেন বললেন, দাবিদাওয়ার ব্যাপারটা।

মিটে গেছে। যা চেয়েছিলাম তা পেয়ে গেছি। আচ্ছা নমস্কার। চল হে ঘটকবাবু। অনেকটা পথ যেতে হবে। সতীশ রায় গাড়ির দিকে এগোলেন।

পেছনে সতীশ রায় সামনে ড্রাইভারের পাশে ঘটকমশাই। গাড়ি ছাড়ার আগে সেই কাজের মেয়েটি দৌড়ে এসে একটা বড় বাক্স ঘটকবাবুর হাতে তুলে দিল। ঘটকবাবু লজ্জা লজ্জা মুখে সেটি ড্যাশবোর্ডের ওপর রেখে দিলেন।

গাড়ি চলতে শুরু করলে ঘটকমশাই বললেন, আপনি চমকে দিয়েছেন বড়বাবু।

কীরকম?

খালি হাতে না গিয়ে মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। আপনি যে পকেটে সোনার গয়না নিয়ে যাচ্ছেন তা ভাবতেই পারিনি। ঘটকমশাই বললেন, তখন বলেছিলেন পছন্দ হলে এখানকার দোকানে অর্ডার দিয়ে চাররকমের মিষ্টি ওবাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। ভাল মিষ্টির দোকানে।

না। আর দরকার নেই।

ও। আমার কথাটা মনে রাখবেন বড়বাবু।

কী কথাটা?

এই যে, আপনার মনের মতো পাত্রী জোগাড় করে দিলাম।

ও! নিশ্চয়ই।

পেট্রল পাম্পের মোড়ে ওরা দাঁড়িয়েছিল। সঙ্গে আর একজন লোক। তফাতে ছোটখাটো ভিড়। গাড়ি থামতেই ভিড়টা বলে উঠল, সত্যি বলেছে, এসেছে, এসেছে।

সতীশ রায় গাড়িতে বসেই জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

তৃতীয় লোকটি বলল, পঞ্চাশ টাকার খাবার খেয়েছে এরা। কুড়িটা টাকা দিয়ে বলেছে অপেক্ষা করতে, লোক এলে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শোধ করবে। আপনি কি সেই লোক?

তিরিশ টাকা পকেট থেকে বের করে লোকটির হাতে দিতেই মানিকজোড় দৌড়ে সামনের আসনে উঠে বসল। গোরক্ষ বলল, আজকাল মানুষ অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে।

নাগেশ্বর বলল, ঠিক হল না, বিশ্বাস করতে কেউ শেখেইনি।

ঘটকমশাই বললেন, বড়বাবু আপনাদের কুড়িটাকার পুরি তরকারি খেতে বলেছিলেন, পঞ্চাশ খেতে গেলেন কেন যখন পকেটে টাকা নেই?

ওই তো দোষ। হিসেব করে খেতে পারি না। বড়বাবু এটা জানেন। নাগেশ্বর বলল।

গাড়ি চলছিল। গোরক্ষ বলল, আমার ডানচোখ নাচছে। তার মানে শুভ খবর। বড়বাবু, পাত্রী পছন্দ হয়েছে?

হুঁ। সতীশ রায় বললেন চোখ বন্ধ করে।

গোরক্ষ চেঁচাল, দারুণ খবর!

দারুণ! চেঁচাল নাগেশ্বর।

আঃ! সরে বসুন। চেঁচালেন ঘটকমশাই।

নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, দেখলেন?

কী? চোখ খুললেন সতীশ রায়।

ওই যে, যেটা চেয়েছিলেন। নাগেশ্বর বলল, নষ্টামির–।

ঝোঁক। গোরক্ষ জুড়ে দিল।

ঘটকমশাই বললেন, বড়বাবুর মনের মতো হয়েছে।

বাঃ। কী আনন্দ। এটা কী? ড্যাশবোর্ডের ওপর রাখা প্যাকেটের ওপর নজর পড়তেই সেটা তুলে নিয়ে খুলে ফেলল নাগেশ্বর। ঘটকমশাই বাধা। দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। নাগেশ্বর বলল, গোরক্ষ! ভগবান আছেন। পঞ্চাশ টাকা খাওয়া হয়ে গিয়েছে, সন্দেশ খেতে পারিনি। ভগবান সন্দেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। নাও, শুরু করো।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress