Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ডেটলাইন শান্তিনিকেতন || Tarapada Roy

ডেটলাইন শান্তিনিকেতন || Tarapada Roy

ডেটলাইন শান্তিনিকেতন

হেডলাইনটা ডেটলাইন হয়ে খবরের কাগজের ভাষা হয়ে গেল। খুব ছোট বা অখ্যাত জায়গা যখন সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে, সেই অকুস্থল থেকে বাঘা বাঘা সাংবাদিকেরা প্রতিবেদন প্রেরণ করেন,

‘ডেটলাইন জুগুয়া:

এখানে ভূমিকম্পের দোলা থামেনি। শত শত বাড়িঘর রাস্তার পাশে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, চারদিকে মৃতদেহ।’…

অথবা,

‘ডেটলাইন গোবিন্দগঞ্জ:

মা কালীর ভর হওয়ার পরে বাতাসীবালা দেবী যে পাঁঠাকাটা খাঁড়া দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাসুর-জা এবং সেই সঙ্গে আরও ষোলো জন বাড়ির লোক এবং পাড়াপ্রতিবেশীর মুণ্ডু ছেদন করেন, স্থানীয় থানার দারোগা ভূতনাথবাবু সেই খাঁড়াটিকে একটি নয়ানজুলি হতে উদ্ধার করেছেন।’…

…ভূতনাথবাবুর মনে গভীর সন্দেহ দেখা দিয়েছে, এত ভোঁতা একটা খাঁড়া দিয়ে কী করে অতগুলো মাথা সাবলীলভাবে কাটা হয়েছে।’

ভূতনাথবাবুর সমস্যার সমাধান নেই। তা ছাড়া ডেটলাইন মার্কা সংবাদগুলো ধারাবাহিকতা রক্ষা করে না। নতুন যুগের সদা চঞ্চল রিপোর্টাররা অবলীলাক্রমে এক ডেটলাইন থেকে অন্য ডেটলাইনে সরে যায়।

ডেটলাইন নয়, আমাদের ছিল ক্যাম্প। চাকরির অনেকটাই কেটেছে মাঠেঘাটে দৌড়াদৌড়ি করে। আমরা হেডকোয়ার্টারে প্রতিবেদন পাঠাতাম,

ক্যাম্প রামপুরহাট:

‘আজ এক বিশাল জনসভায় স্থানীয় বিধায়ক একশো তেরো জন ভূমিহীন কৃষককে পাট্টা বিলি করেছেন।’

অথবা, ক্যাম্প সন্দেশখালি:

‘গতকাল এক সান্ধ্য বৈঠকে এগারো জন বর্গাদারকে নথিভুক্ত করা হয়েছে।’


সে যা হোক, ক্যাম্প নয় আমরা এবার ডেটলাইনে আসছি। ডেটলাইন শান্তিনিকেতন:

কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের মহীশূরস্থ ভারতীয় ভাষা সংস্থান বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় শিশুদের জন্য ছড়া রচনার কর্মশালা করছেন। বাংলা ভাষার কর্মশালাটি বিশ্বভারতীর সহযোগিতায় শান্তিনিকেতনে হচ্ছে। এই ছড়া কর্মশালায় প্রবীণ জ্যোতিভূষণ চাকী থেকে শুরু করে অতি তরুণ নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত জনা দশেক ছড়াকার এসেছেন। আমি সেই অর্থে ছড়াকার নই, কেন আমাকে ডাকা হয়েছে জানি না। তবে আমি এসেছি এক পক্ষকাল শান্তিনিকেতন থাকার লোভে।

এসে দেখছি ভিড়, হইচই, উত্তেজনা নেই। শীত-শেষের চমৎকার সব দিন। পাখির গান, মলয় পবন, বাগানে বাগানে মরশুমি ফুল, গাছে গাছে নব মুকুল।

সবই ভাল। কিন্তু দল বেঁধে ছড়া লেখা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। দৈনিক দুপুরে ছড়া কর্মশালায় দশজনকে বসতে হচ্ছে ছড়া রচনার জন্যে। শীতল দুপুরে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, কাপের পর কাপ চা। সে এক প্রাণান্তকর পরিবেশ। এই পরিবেশে আমি এখন পর্যন্ত একটি মাত্র ছড়া লিখে উঠতে পেরেছি। যার শেষ কয় পঙ্‌ক্তি হল,

একটা ছড়া হামা দেয়

একটা ছড়া হাঁটে

ভুবনডাঙার মাঠে

দশটা মানুষ

ভুতের মতন খাটে।

শান্তিনিকেতনে এসে আমার সবচেয়ে বড় লাভ যেটা হয়েছে সেটা হল নিমাই চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা। অনেকদিন পরে রীতিমতো জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। সুদর্শন, সুশিক্ষিত নিমাই চট্টোপাধ্যায় সুরসিক এবং সুভাষী।

নিমাই চট্টোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের পুরনো ছাত্র। শুভময় ঘোষ, অমর্ত্য সেনের প্রায় সমসাময়িক। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নিমাই লন্ডনে যান। সেই থেকে তিনি সেখানে। কিন্তু কলকাতা বা শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। শান্তিনিকেতন পূর্বপল্লীতে বাড়ি কিনেছেন, নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে।

নিমাই এবং স্ত্রী শ্রীমতী জয়া চট্টোপাধ্যায়কে লন্ডন শহরের সমস্ত বাঙালি, বহু ভারতীয় এবং বেশ কিছু সাহেব এক ডাকে চেনেন। নিমাই দীর্ঘদিন বি বি সি-র সঙ্গে যুক্ত আছেন।

নিমাইয়ের কথা নয়। নিমাইয়ের গল্পের কথা বলি। শান্তিনিকেতনের সেই যুগে নিমাইয়ের স্ত্রী জয়ার সঙ্গে একটি ছাত্র পড়তেন, তাঁর নাম ছিল সত্যিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রাঢ় অঞ্চলে ঠাকুর পদবি দুর্লভ নয় আর রবীন্দ্রনাথ নাম তো বাংলার কেন ভারতের ঘরে ঘরে। কিন্তু এই মণি-কাঞ্চন যোগটি মারাত্মক।

পঞ্চাশের দশকের এক পৌষমেলার গল্প বললেন নিমাই। এখনকার মতো না হলেও তখনও বেশ ভিড় হত। সেই পৌষমেলায় আরও অনেক ছাত্রের মতোই স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন নিমাইসখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যথারীতি সেই পৌষমেলায় অফিসঘরের মাইকে প্রচারিত হয়েছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তুমি যেখানেই থাকো অবিলম্বে মঞ্চে চলে এসো।’ সেই হিমশীতল পৌষের রাতে মেলায় সমবেত হাজার হাজার মানুষ মাইকে এই ঘোষণা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

নিমাই এবং জয়া, উভয়েই এই নতুন রবি ঠাকুরের জীবনের একটা ট্র্যাজেডির কথা বললেন। এক বিখ্যাত পণ্ডিতের কন্যার প্রেমে পড়েছিলেন নিমাইদের রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কন্যার প্রেমিকের নাম শুনে সেই পণ্ডিত সম্ভাব্য বিবাহ বরবাদ করে দেন শুধু একটি যুক্তিতে, ‘রবি ঠাকুরের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে আমি কিছুতেই দেব না।’

নিমাই শান্তিনিকেতন পূর্বপল্লীতে তাঁর বাড়ির নাম দিয়েছেন, ‘প্রত্যাবর্তন’; কিন্তু এই নামকরণ সহজে হয়নি। শান্তিনিকেতনে বাড়ির নামকরণ রবীন্দ্র অনুসারী হওয়া উচিত এই ভেবে তিনি প্রথমে বাড়ির নাম রাখেন ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা।’ এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রতিবাদের মুখে পড়ে নাম বদল হয়ে দাঁড়ায়, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, শান্তিনিকেতনের ছেলে শান্তিনিকেতনে ফিরেছে সেই অর্থে। এটাও চলেনি তাই অবশেষে শুধুই ‘প্রত্যাবর্তন’।

নিমাই-চরিত মানস সহজে শেষ হওয়ার নয়। আপাতত সত্যজিৎ রায়ের গল্পটা বলে শেষ করি।

নিমাইকে খুব পছন্দ করতেন সত্যজিৎ। বিলেতেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। নিমাই নিজে লম্বা-চওড়া, সত্যজিৎ আরও বেশি লম্বা। একদিন হঠাৎ সত্যজিৎকে নিমাই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি পাঞ্জাবি কেনেন কোথা থেকে?’ মৃদু হেসে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘তুমি বোধ হয় জানো না, দরজি বলে একটা ব্যাপার আছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *