ডাক ঘরের ভুত
রামকানাই বাবু সপরিবারেই এসেছেন। ভুবনেশ্বর থেকে ওয়ালটেয়ার । মানে এখন কার বিশাখাপত্তনমে ।বদলির চাকরি । যেতেই হবে । তবে এবারের বদলিতে তিনি খুশি হয়েছেন । ওয়ালটেয়ারের জলহাওয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা অনেক শুনেছেন । ওয়ালটেয়ার ষ্টেশনে নেমে আরো খুশি হলেন । কারণ জানুয়ারি মাসে পাখা চলছে প্ল্যাটফর্মে । ভুবনেশ্বরে এখন ভালো ঠান্ডা । ওখানে রাতের ডিউটি মানে কাঁড়ি কাঁড়ি গরম জামা গায়ে চাপানো । ভাবতে ভাবতে মোটঘাট নিয়ে চললেন । স্ত্রী কে বললেন,- চপলা কেমন দেখছো?কি বলো বদলি নিয়ে ভালো করেছি না? চার দিকে তাকিয়ে চপলাও খুশি । হাসতে হাসতে বললো-হ্যাঁগো,খুব সুন্দর জায়গা । সাতদিন হলো,রামকানাই বাবু রেল স্টেশনের কাছের পোস্ট অফিসে কাজে যোগ দিয়েছেন । পাশেই কোয়ার্টার । রাত করে কাজ করতে সুবিধে হয় । সবই ঠিক আছে । ঝকমারি দেখা দিচ্ছে রাতের বেলা । রাতের ডিউটিতে কেউ থাকতে চায় না । নতুন এসেছেন তিনি । পুরনো স্টাফদের চটানো যাবে না । তাই বললেন- রাতের কাজ কে করবে? একে একে শংকরা,রাজু ওরা সবাই বলেছে । – আপনার কোনো অসুবিধা হবে না । আমরা রাত আটটার মধ্যে ‘মেইল ব্যাগ ‘ সিল করে চলে যাব । বাকি রইলো ট্রেন এ তোলার কাজ । সেটা পোর্টাররা তুলে দেবে । রামকানাই বাবু বললেন- সে কি কথা! মেইল ব্যাগ ঠিক মতো উঠলো কিনা ,তা দেখতে হবে না? ওসব বাপু আমি পারবো না । শংকরা বললো,- আপনার আগের পোস্ট মাস্টার ও ঐ ভাবেই চালিয়েছেন। দেখতে দেখতে মাস ও পার হয়নি । তবে মনটা ভালো আছে। ছুটির দিন সাগর সৈকতের দৃশ্য মনটাকে ভালো করেছে। আর সমুদ্রের কোল ঘেঁষে পাহাড়ের সারি,চোখ জোড়া ভালো রাখছে । মাস ও পেরিয়ে গেল না রামকানাই বাবুর কাঁধে আর একটা বোঝা চাপলো । সেটা হলো চিন্তার।
এখানে রাতের ডিউটি কেউ নিতে চায় না । তা জানা হলে ও কারণটা জানা যায় নি । সে দিন ও অন্য দিনের মতো চিন্নাবাবু, “মেইল ব্যাগ”বাছাই করে ভাগে ভাগে রাখলো । শঙ্করা পার্সেলগুলো গুনতে গুনতে ব্যাগে ভরে রাখল । চিন্নাস্বামী গালা দিয়ে ব্যাগ এর মুখ বন্ধ করে দিল।সবগুলো ভরা হতে কালো রং দিয়ে প্রতিটি ব্যাগ এর ঠিকানা লিখে ফেললো। রামকানাই বাবু বললেন,কটা ব্যাগ হলো? শংকরা বললো, প্রায় কুড়িটা।এবার আমরা যাই? রামকানাই বাবু বললেন,এতো ভয় পাস কেন? শংকরা বললো,কয়েক দিন পর বুঝতে পারবেন । – এক মাস পেরিয়ে গেল । কিছু তো বুঝলাম না। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ,কি বোঝার কথা বলছে ওরা! শঙ্করা ,চিন্না চলে যেতে পোস্ট অফিসের দরজা বন্ধ করে দিলেন । মনে ভাবলেন-এসব দায়িত্ব পূর্ণ কাজ কি পোর্টার এর ওপরে ছাড়া যায়? না। তিনি ও পোর্টার এর সঙ্গেই থাকবেন। ঘড়িটা দেখে নিলেন । সবে সাড়ে আটটা। এখন ও দেড় ঘণ্টা আছে । রাত দশটায় মাদ্রাজ মেইল আসবে । কোলকাতার ডাক উঠিয়ে দিয়ে তবে তিনি বাড়ি যাবেন । এখন অফিসের রেস্ট রুম এ একটু গড়িয়ে নেবেন । নিশ্চয়ই ভয়ের কোনো কারণ আছে নইলে সবাই কেন তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে? তবে রামকানাই বাবু ওসবের তোয়াক্কা করেন না । যুবক বয়সে অনেক মরা পুড়িয়েছেন । ভুত তার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবে না ।
চেয়ারে বসে ঢুলছিলেন। হঠাৎ ই গাড়ির হুইসল শুনে কেঁপে ওঠেন। আরে! ট্রেন কি ছেড়ে দিলো? কিন্তু “মেইল ব্যাগ” নিতে তো কেউ এলো না ! ধরমর করে উঠতে গেলেন কিন্তু পারলেন না ।
এতোক্ষনে দেখলেন তিনি বসে নেই । শুয়ে আছেন। চেয়ারে বসেন নি। চেয়ার তো পাশের ঘরে । তিনি তো শুয়ে আছেন । কখন এলেন এ ঘরে? আর শুলেন ই বা কখন? তখনই পার্সেল আর চিঠির ব্যাগগুলোর দিকে তাকালেন। এ কি!দরজা খোলা!একটা ও ঝোলা নেই । তবে কি- !তখনই দেখলেন একটা কালো ছায়া বাইরে চলে যাচ্ছে ।
রামকানাই বাবু বিছানা ছেড়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটলেন । হ্যাঁ । ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে । আর.এম.এস. কামরার দিকে যেতেই দেখলেন কেউ নেই সেখানে ।অথচ ডাক গাড়িতে মাল গুলো আপনা আপনি উঠে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে কেউ যেন ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে । শেষের বস্তা ওঠার সাথে সাথে দরজা বন্ধ হয়ে গেল । কি মনে করে তিনি ডাক কামরার দিকে ছুটতে লাগলেন । কিন্তু ট্রেন এর দরজার হাতল ধরার আগে এক শক্তিমান অশরীরী ছায়া রামকানাই বাবু কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। জ্ঞান ফিরতেই রামকানাই বাবু বুঝলেন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন । তাঁকে ইন্ ভ্যালিড চেয়ারে বসানো হয়েছে । চার দিকে লোক জন। সবাই মিলে কোয়ার্টারে পৌঁছে দিলো। সব শুনে ঘাবড়ে গেল চপলা । বলল,- চলো ,এখান থেকে চলে যাই। চিন্নাবাবু চপলাকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে । বলেছে,- বৌদি স্যারের ভূতের পেছনে দৌড়ানো ঠিক হয়নি । শরীর ঠিক হতে অফিসে এলেন রামকানাই বাবু ।একখানা ফাইল খুলতেই শঙ্করা এসে হাজির হলো ।
– কেমন আছেন স্যার? আপনার এতো সাহস জানলে আগেই বলতাম আপনাকে ।
রামকানাই বাবু বললেন- কি হয়েছিল ? শঙ্করা বললো- হরি বোস বলে একজন কর্মচারী ডাক ব্যাগ ট্রেন এ ওঠাতে রেল লাইন পার হতে গিয়ে ট্রেন এ কাটা পড়ে । খুব সিনসিয়ার লোক ছিলেন। কাজের কখনও গাফিলতি করতেন না । মারা যাবার পর ও আসেন ট্রেন এ ডাক তুলে দিতে।
পরদিন রামকানাই বাবু একটা চিঠি নিয়ে জি.পি. ও তে দেখা করেন । সেখানকার বড়বাবু বললেন, – কি,বদলি চাই? আমি জানি যে আসে সে এক মাসের মধ্যে ই বদলি চায়। – না। ছুটী চাই । গয়ায় হরিবোল এর পিণ্ডদান করতে যাব । খুশি হয়ে বড়োবাবু ছুটি দিয়ে দিলেন। রামকানাই বাবু সময় মতো পিন্ড দান করে ফিরে এলেন এবং এবার থেকে রামকানাই বাবু নির্ঝঞ্ঝাট এ কাজ চালাতে লাগলেন। চাকরিতেও উন্নতি হতে লাগল ।