Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ডাকিনীতন্ত্র || Syed Mustafa Siraj » Page 3

ডাকিনীতন্ত্র || Syed Mustafa Siraj

কর্নেলের বাড়িতে এমন অনেক ছুটির দিন কাটিয়ে দিয়েছি এবং ষষ্ঠীচরণের সুস্বাদু রান্নায় আপ্যায়িত হয়েছি। তবে ওই এক জ্বালা। আমার বৃদ্ধ বন্ধু কোনও বিষয়ে মুখ খুললে কান ঝালাপালা করে দেন। এদিনের বিষয় ছিল অকাল্ট বা গুপ্তবিদ্যা।

কিন্তু আজ আমি কান করেই ওঁর বকুনি শুনছিলাম। কারণ গোপাদেবীর কাণ্ডকারখানা দেখে আমার তাক লেগে গিয়েছিল। আঁঝালো সুগন্ধ, ওপর থেকে পড়া দুটি গোলাপকুঁড়ি এবং কফির পেয়ালা হঠাৎ রক্তের পেয়ালায় রূপান্তর ম্যাজিক, নাকি সত্যি অলৌকিক শক্তির ক্রিয়াকলাপ? কর্নেল আমার প্রশ্নের কোনও সদুত্তর না দিয়ে দেশবিদেশের আদিম জনজাতির মধ্যে এখনও প্রচলিত নানা গুপ্তবিদ্যা নিয়ে জ্ঞান ছড়াচ্ছিলেন। এক সময় ওঁর বকুনি থামল এবং আমি ড্রয়িংরুমের সোফায় ভাতঘুমে লম্বা হলাম। চোখ বুজে আসার আগে দেখলাম, উনি বইয়ের র‍্যাক থেকে কী একটা মোটা বই বের করে এনে ইজিচেয়ারে বসলেন।

চোখ বুজে ভাবছিলাম গোপাদেবী কর্নেলের পরিচয় জানে এবং তার স্বামী সুদর্শনও জানেন, এতে অবশ্য অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। মার্কিন বিজ্ঞানপত্রিকা নেচার পাখি-প্রজাপতি-পোকামাকড় নিয়ে কর্নেলের অনেক সচিত্র লেখা ছেপে আসছে। তার ছবি এবং বিচিত্র জীবনকাহিনী সংক্ষেপে ছেপেছে। জৈবরসায়নবিজ্ঞানী দম্পতির সেটা চোখে পড়া স্বাভাবিক। দৈনেক সত্যসেবকে প্রকাশিত আমার ডাইনিসংক্রান্ত রিপোর্টাজও ওরা পড়েছে। কাজেই এক্ষেত্রে দুইয়ে-দুইয়ে চার করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কাল সন্ধ্যায় সুদর্শন কি আমার কাছে নিছক ডাইনির সত্যাসত্য জানাতেই গিয়েছিলেন?

তার চেয়ে বড় কথা, আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত কি কেউ ওভাবে অপরের কাছে। ঘোষণা করে?

কখন ভাতঘুম এসে গিয়েছিল। কলিংবেলের শব্দে ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখলাম, ষষ্ঠীচরণ এক যুবতাঁকে নিয়ে এল। মহিলাদের সঠিক বয়স আঁচ করা আমার পক্ষে কঠিন। গোপার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি মনে হয়েছিল। এর বয়স কিছু কম হতে পারে। চেহারায় নম্র লাবণ্য আছে এবং পরনে সাধারণ কিন্তু রুচিসম্মত শাড়ি। কাধ পর্যন্ত ছাঁটা চুল। চোখে চশমা। নমস্কার করে বলল, আমার নাম অপর্ণা রায়।

কর্নেল তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, বসুন। আপনার চিঠি কাল পেয়েছি।

আমাকে তুমি বললে খুশি হব।

অপর্ণা আমার দিকে ঘুরলে আমি সোজা হয়ে বসলাম। কর্নেল বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরী। সাংবাদিক।

অপর্ণা আমাকে নমস্কার করে বলল, পুরুলিয়ায় ডাইনিহত্যা নিয়ে আপনার লেখাটা পড়ে সত্যসেবক পত্রিকায় টেলিফোন করেছিলাম। আপনি তখন অফিসে ছিলেন না।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, জয়ন্ত! অপর্ণা কলকাতার কাছেই একটা কলেজে পড়ায়। অপর্ণা, তোমার চিঠি পড়ে মনে হয়েছিল, তুমি নিজের জন্যই উদ্বিগ্ন। এখন মনে হচ্ছে, তুমি অন্যের জন্য উদ্বিগ্ন।

অপর্ণা আস্তে বলল, হ্যাঁ।

তুমি কি সুদর্শন সান্যালের জন্য উদ্বিগ্ন?

অপর্ণা মুখ তুলল। চোখে বিস্ময়ের ছাপ। বলল, আপনার সম্পর্কে যা সব শুনেছি বিশ্বাস করতাম না। আপনি সত্যিই

সুদর্শন কি তোমার আত্মীয়?

না। য়ুনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তারপর ও আমেরিকা চলে গেল। সেখান থেকে রেগুলার চিঠি লিখত। তারপর হঠাৎ চিঠি লেখা বন্ধ করে দিল। প্রায় এক বছর পর, মাস তিনেক আগে আবার ওর চিঠি পেলাম। প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছে। স্ত্রী রিসার্চ স্কলার। একসঙ্গে কাজ করে। কিন্তু বউকে নিয়ে ও খুব সমস্যায় পড়েছে। কী সমস্যা, তা খুলে লেখেনি। হঠাৎ গত সপ্তাহে সুদর্শন লেকটাউনে আমাদের বাড়িতে হাজির। সব কথা খুলে বলল। তারপর বলল, আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। ওকে অনেক বোঝালাম। কিন্তু–অপর্ণা শ্বাস ছেড়ে বলল, আমার ধারণা ওর মানসিক অসুখ হয়ে গেছে।

ওর স্ত্রী গোপার সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে?

না। ভদ্রমহিলা সম্পর্কে সুদর্শন যা বলেছে, তা শোনার পর তার সঙ্গে আলাপ করা সম্ভব নয়।

অবনী মৈত্রকে তুমি চেনো?

চিনতাম না। সুদর্শনের বাড়িতে কখনও আমি যাইনি। সুদর্শনের কাছে সেদিন। ওঁর পরিচয় পেলাম।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, যাই হোক, তুমি কী করতে বলছ আমাকে?

সুদর্শনকে আপনি বাঁচান!

কর্নেল হাসলেন। সে তো দিব্যি বেঁচে আছে।

কর্নেল সরকার! আমার ভয় হচ্ছে, ও যে-কোনও সময় ঝোঁকের বশে আত্মহত্যা করে বসবে। ও মানসিকভাবে মোটেও সুস্থ নয়।

ওকে কোনওভাবে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাও। তোমার কথা শুনে মনে হলো, সুদর্শন তোমাকে বিশ্বাস করে। সম্ভবত তোমার সাহায্য চায়।

অপর্ণা মুখ নিচু করে ঠোঁটের কোনা কামড়ে ধরল। একটু পরে বলল, আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। সুদর্শন বলছিল, ও বাঁচতে চায়। কিন্তু আত্মহত্যা ওকে নাকি করতেই হবে। কারণ ওর বউ ওকে আত্মহত্যা করিয়ে ছাড়বে। এ একটা অদ্ভুত ব্যাপার। দেখুন কর্নেল সরকার, আমি যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতাম, ওর বন্ধু হতাম, তাহলে ওর বউকে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম। সেইসঙ্গে ওই ভণ্ড তান্ত্রিক লোকটাকে গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলতাম।

সুদর্শনের কোনও বন্ধু নেই?

ছাত্রজীবনে ছিল। এখন কে কোথায় আছে, জানি না। তবে ও বরাবর অমিশুকে স্বভাবের ছেলে। বন্ধু বলছি বটে, কিন্তু সেই অর্থে তত ঘনিষ্ঠতা ওর কারও সঙ্গে ছিল না।

তোমার বাড়িতে কে আছেন?

মা আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা বেঁচে নেই।

তুমি সুদর্শনকে তোমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করো। একজন সাইকিয়াট্রিস্টকেও করো। বুঝেছ?

বুঝেছি। কিন্তু ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার সমস্যা আছে।

কেন? টেলিফোনে করো।

ওর বউ সত্যিই ডাইনি। কীভাবে টের পায় সম্ভবত। ওদের কাজের লোকটা ফোন ধরে বলে, ধরুন, ডেকে দিচ্ছি। একটু পরে বলে সাহেব ঘুমুচ্ছেন।

কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। একটু পরে বললেন, তুমি সুদর্শনের হিতাকাঙিক্ষনী। আমার মতে, তোমার রিস্ক নেওয়া উচিত।

অপর্না ব্যগ্রভাবে বলল, বলুন, কী রিস্ক নেব।

তুমি ওর বাড়ি চলে যাও।

ওর বউ যদি বাড়ি ঢুকতে না দেয়?

চেষ্টা করে দেখ।

অপর্ণার মুখ দেখে মনে হলো, সে দ্বিধায় পড়ে গেছে। একটু পরে রুমালে মুখ স্পঞ্জ করে সে বলল, ঠিক আছে। আমি এখনই গিয়ে দেখছি। কী হলো, আপনাকে টেলিফোনে জানাব। প্লিজ, আপনার নাম্বারটা দিন।

কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা নেমকার্ড দিলেন। তারপর বললেন, একটা কথা। আমার ঠিকানা তুমি কার কাছে পেয়েছিলে?

আমার মামা অপরেশ মজুমদার রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। সল্টলেকে বাড়ি করেছেন। প্রথমে মামার কাছেই গিয়েছিলাম। সুদর্শনের ব্যাপারে কোনও হেল্প করতে পারেন কি না। মামা বললেন, পুলিশ এ ব্যাপারে আইনত কিছু করতে পারে না। বরং তুই কর্নেল সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে দ্যাখ। আমি সরাসরি আপনার কাছে আসার আগে চিঠি লিখেছিলাম। জবাবের জন্য ধৈর্য ধরতে পারিনি। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন। অপর্ণা একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর আমাকে নমস্কার করে বেরিয়ে গেল।

বললাম, হাই ওল্ড বস!

বলো ডার্লিং!

অপর্ণাদেবীর সঙ্গে সুদর্শনের যোগাযোগ কি আপনিও গুপ্তবিদ্যার জোরে জেনে ফেলেছিলেন?

নাহ্। কর্নেল চোখ খুলে সিধে হলেন। অপর্ণা তোমার রিপোর্টাজ পড়ে তোমার খোঁজ করেছে বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছিলাম। লেগে। গেল। বলে হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী! কফি!

বিকেল সাড়ে চারটে বাজে। জানালার বাইরে মাঠের সোনালি রোদ্দুর ঘরবাড়ির সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। কফিতে কয়েকটা চুমুক দিয়েছি, টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, ধরো জয়ন্ত!

ফোন তুলে সাড়া দিতেই কেউ ছ্যাাৎরানো গলায় বলল, এই ব্যাটা বুড়োঘুঘু! নাক গলাতে এসো না। গলা কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেব।

তারপর ফোন রাখার শব্দ। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কর্নেল বললেন, কী হলো? তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন?

ফোন রেখে বললাম, কেউ হুমকি দিল এবং আপনাকে গালাগাল!

বলো কী! কী বলল?

এই ব্যাটা বুড়োঘুঘু! নাক গলাতে এসো না। গলা কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেব।

কর্নেল গম্ভীর মুখে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে?

হ্যাঁ।

তার মানে সুদর্শনের বাড়ির পেছনে গঙ্গায়। কর্নেল হঠাৎ ব্যস্তভাবে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। নাম্বার ডায়াল করতে থাকলেন। কয়েকবার ডায়াল করার পর বললেন, এনগেজড।

কোথায় ফোন করতে চান?

সুদর্শনের বাড়িতে।

কর্নেল! আমার এখন মনে হচ্ছে, কেউ চাইছে সুদর্শন আত্মহত্যা করুক।

ঠিক ধরেছ। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘড়ি দেখে বললেন, চলো। বেরুনো যাক।

কোথায়?

বাগবাজারে। অবনী মৈত্রের সঙ্গে এখনই দেখা করা দরকার। কুইক!

আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। সকালে কর্নেল যে বাড়ি থেকে আমরা এখানে অবাঞ্ছিত বলে চলে এলেন, সেখানে আবার যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? তাছাড়া একটু আগে টেলিফোনে ওই কুৎসিত হুমকি! বড্ড বেশি ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে না কি?

পথে যেতে যেতে কর্নেল যেন আমার মনোভাব আঁচ করেই বললেন, ফোনে যারা হুমকি দেয়, তারা কাওয়ার্ড। যারা সত্যি ক্ষতি করার হিম্মত রাখে তারা আড়াল থেকে গর্জন করে না। মুখোমুখি ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, লোকটি ভীতু। ভীতু, কিন্তু ধূর্ত আর বদমাশ! তার উদ্দেশ্যটা এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না অবশ্য।

লোকটা সম্ভবত অবনী মৈত্র।

কেন তাকে সন্দেহ করছ?

সুদর্শন আত্মহত্যা করলে লোকটা তার সাধনসঙ্গিনী গোপাকে বিয়ে করবে এবং সুদর্শনের সম্পত্তির মালিক হতে পারবে।

কর্নেল হাসলেন। সুদর্শনের কথা সত্যি হলে বিয়ের কী দরকার? গোপাকে তো সে অবাধে পেয়েছে। সম্পত্তির ভোগদখলও করে আসছে।

একটু অবাক হয়ে বললাম, সুদর্শনের কথা সত্যি হলে মানে?

কর্নেল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, জয়ন্ত! অবনী মৈত্রের সঙ্গে গোপার অবৈধ সম্পর্কের কথা আমরা সুদর্শনের মুখেই শুনেছি। তবে শুধু এটুকু জানি, অবনী মৈত্র তান্ত্রিক সাধুর মতো জীবনযাপন করে এবং গোপার উইচক্র্যাফটের বাতিক আছে।

বাতিক কী বলছেন? আচমকা সুগন্ধ, গোলাপকুঁড়ি, কফির পেয়ালায় রক্ত!

কর্নেল আর কোনও কথা বললেন না। বাগবাজার স্ট্রিট দিয়ে সোজা এগিয়ে ট্রামলাইন পেরিয়ে গঙ্গার ধারে গলির মোড়ে পৌঁছুতে রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছিল। কর্নেলের নির্দেশে গলির মুখে গাড়ি রাখলাম। গলিটা এঁকেবেঁকে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছেছে। বাঁধানো প্রাচীন ঐতিহাসিক ঘাটের পাশে বিশাল একটা বটগাছ। গাছটার তলা একসময় বাঁধানো ছিল। এখন ভেঙেচুরে গেছে। একদল লোক বসে আড্ডা দিচ্ছে। গাঁজার ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। খড়বোঝাই একটা নৌকো ঘাটে বাঁধা আছে। সন্ধ্যাস্নান এবং আহ্নিকরত কয়েকজন ধর্মানুরাগীকে দেখা গেল। কাকের চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা হচ্ছিল। একটু পরে কাকগুলো চুপ করল। কর্নেল ঘাটের মাথায় দাঁড়িয়ে গঙ্গাদর্শন করছিলেন। জলে আলোর ঝিকিমিকি ছটা। কেউ গঙ্গার জল থেকে বিড়বিড় করে মন্ত্র জপতে জপতে উঠে আসছিল। কর্নেলের পাশে আসতেই কর্নেল বললেন, অবনীবাবু!

ছায়ামূর্তি থমকে দাঁড়াল। এখানে গাঢ় ছায়া। লোকটা বলল, কে?

আপনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম অবনীবাবু! কথা আছে।

আপনারা সকালে এসেছিলেন না গোপার ইন্টারভিউ নিতে?

হ্যাঁ, এবার আপনার ইন্টারভিউ নেব।

গোপা বলছিল আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। সুদর্শন আপনাকে ওর পেছনে লাগিয়েছে। একজন উন্মাদের কথায় আপনি

অবনীবাবু! আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। কিন্তু এখানে নয়।

তান্ত্রিক আস্তে বলল, আচ্ছা। আসুন!

কয়েক পা এগিয়ে বাঁদিকে ঘুরে খিড়কির সেই দরজা। ঠেলতেই খুলে গেল। পায়েচলা পথের দুধারে ঝোঁপঝাড়। সামনে মন্দির। মন্দিরের নিচে একটা চওড়া বেদি। বাড়ির পোর্টিকোর মাথায় যে বাস্তু জ্বলছে, তার আলো ক্রমশ ফিকে হতে হতে এখানে কোনও ক্রমে এসে নেতিয়ে পড়েছে। অবনী মৈত্র বললেন, এখানে অপেক্ষা করুন। ভিজে কাপড়চোপড় ছেড়ে আসি।

কর্নেল বেদিতে পা ঝুলিয়ে বসলেন। আমিও বসলাম। বাড়িটা একেবারে সুনসান স্তব্ধ। ওপরের কয়েকটা ঘরে আলো জ্বলছে। একবার কেউ খক খক্‌ করে কাশল।

আমি বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি লক্ষ্য করে কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, ভয় নেই জয়ন্ত! তোমাকে বলেছি, আড়াল থেকে যারা হুমকি দেয়, তারা ভীতু।

অবনী মৈত্র শিগগির এসে গেল। সকালে দেখা সেই বেশভূষা। তবে এখন হাতে একটা বেঁটে ছড়ি। বেদির একপ্রান্তে বসে বলল, পাগলটা বিকেলে কোথায় বেরিয়েছে নইলে ঠিকই টের পেয়ে যেত এবং এখানে এসে ঝামেলা বাধাত।

কর্নেল বললেন, আপনার সাধনসঙ্গিনী এখন কী করছেন?

কী বললেন? সাধনসঙ্গিনী? তান্ত্রিক রেগে গেল। কী বলছেন মশাই? গোপা আমার শিষ্যা।

সুদর্শন বলছিল–

ও যে সত্যি পাগল হয়ে গেছে, আপনার বোঝা উচিত ছিল। আমেরিকায় এক সাইকিয়াট্রিস্ট ওর চিকিৎসা করছিলেন। সারল না বলেই গোপা কলকাতায় নিয়ে এল। পাগলামির জন্য ওর চাকরি গেছে জানেন?

তাই বুঝি? তা গোপা তো নিজেই স্বামীর অসুখ সারাতে পারে।

চেষ্টা করছে। আমিও করছি। যাক গে, বলুন কী আপনার কথা?

সুদর্শনের বাবার প্রপার্টি এই বাড়িটা। তাই না?

হ্যাঁ। পিসেমশাই উইল করে গেছেন ছেলের নামে। উইলের ট্রাস্টি আমি।

এই বাড়ি ছাড়া আর কী প্রপার্টি আছে?

আগে বলুন কেন একথা জানতে চাইছেন?

পরে বলছি। প্লিজ, আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

ব্যাঙ্ক ফিক্সড ডিপজিট আর কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বড়জোর লাখ পাঁচেক।

সুদর্শন কি বাবা-মার একমাত্র সন্তান?

হ্যাঁ।

সুদর্শন যদি মারা যায়, প্রপার্টি কে পাবে?

সুদর্শনের স্ত্রী এবং সন্তানাদি থাকলে, তারাই পাবে। উইলে এই ব্যবস্থা করা আছে।

আপনি কিছু পাবেন না?

আমি যতদিন বাঁচব, মাসোহারা পাব এক হাজার টাকা করে। এখনও পাচ্ছি। অর্থাৎ নিচ্ছি।

সুদর্শনের স্ত্রী বা সন্তানাদি না থাকলে কে প্রপার্টি পাবে?

আপনি স্বামী ব্রহ্মানন্দের নাম শুনেছেন? চণ্ডীতলায় ওঁর আশ্রম। পিসেমশাই ওঁর ভক্ত ছিলেন। কাজেই সেই আশ্রম এই প্রপার্টি পাবে।

চণ্ডীতলা কোথায়?

নদীয়ায় কেষ্টনগরের কাছে।

আশ্রমের কেউ এ বাড়ি আসেন?

ডোনেশন নিতে আসে। প্রতি বছর গুরুপূর্ণিমায় ব্রহ্মানন্দজীর জন্মোৎসব। টাকা দিই। অবনী মৈত্র হঠাৎ চাপাস্বরে বললেন, আপনি তো মশাই প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ওই ভণ্ড সাধুকে ধরিয়ে দিন না। আশ্রমের আড়ালে ড্রাগ আর আর্মস স্মাগলিং করে। গভর্নমেন্টের হোমরা-চোমরা লোকেরা ওর ভক্ত। নৈলে কবে ওর বুজরুকি ফঁস করে দিতাম।

আপনি এর প্রমাণ পেয়েছেন?

ধ্যানবলে জেনেছি।

আশ্রমে কখনও গেছেন আপনি?

নাহ্। নেমন্তন্ন করে। যাই না।

গোপা গেছে এখানে আসার পর?

কক্ষণো না। ওকে সব বলেছি। গোপা ডাকিনীতন্ত্রের খেল দেখাবে। অপেক্ষা। করুন।

তাহলে সুদর্শনের মৃত্যু হলে এখন প্রপার্টি পাবে গোপা।

পাবে। অবনী মৈত্র আবার চাপাস্বরে বললেন, সুদর্শনের কাছে আপনি কত ফি নিয়েছেন?

ফি নেওয়া আমার অভ্যাস নয় অবনীবাবু! কারণ আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই।

তাহলে আপনি আমাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন কেন মশাই? তান্ত্রিক আবার রেগে গেলেন। নাক গলানোর স্বভাব থাকলে ব্রহ্মানন্দের ডেরায় গিয়ে গলান। দেখি আপনার কত হিম্মত।

আচ্ছা অবনীবাবু, সুদর্শন কি এখানে আসার পর ওই আশ্রমে গেছে?

যেতে চেয়েছিল। গোপা যেতে দেয়নি। গোপার মধ্যে হিরোটিক পাওয়ার আছে। ইচ্ছে করলে ও যে-কোনও মানুষকে দিয়ে যা খুশি করাতে পারে। ওর চোখদুটি দেখেছেন?

হুঁ, দেখেছি। দৃষ্টিতে অস্বাভাবিকতা আছে।

তাহলেই বুঝুন।

আপনারা দুজনে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে গিয়েছিলেন সম্প্রতি?

গিয়েছিলাম। আপনি-আশ্চর্য! অবনী মৈত্র নড়ে বসল। তাহলে সুদর্শন এখানে এসেই আপনাকে আমাদের পেছনে লাগিয়েছে? দেখুন মশাই! খুলেই বলি। গোপা ইন্ডিয়ান ডাকিনীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আমার সাহায্য চেয়েছিল। আমি ওকে পুরুলিয়ার আদিবাসী এরিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ব্যস! আর আমি কিছু বলব না।

আপনি অপর্ণা রায় নামে কোনও মেয়েকে চেনেন?

নাহ্। বলে অবনী মৈত্র উঠে দাঁড়াল। আপনারা এবার আসুন। আমার জপের সময় হয়ে গেছে।

আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি, সেই সময় কেউ বলে উঠল, কর্নেল সরকার! প্রত্যেক ফ্যামিলির রাইট অব প্রাইভেসি আছে। আই ওয়ার্ন য়ু, ডোন্ট ইন্টারফিয়ার।

কর্নেল বললেন, মিসেস সান্যাল! আপনি বিপন্না। সাবধানে থাকবেন।

গোপা এগিয়ে এসে ক্ষিপ্তভাবে বলল, দ্যাটস নট ইওর বিজনেস, ওল্ড ম্যান! অ্যাওয়ে! গো অ্যাওয়ে আই স্যে।

আমরা খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। অবনী মৈত্র দরজা বন্ধ করে দিল গলিরাস্তায় গিয়ে বললাম, সাংঘাতিক মেয়ে। বেচারা সুদর্শনের জন্য আমার ভয় হচ্ছে।

গাড়িতে ওঠার পর কর্নেল বললেন, এবার নাটকটা জমে উঠবে আশা করি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress