Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ডাকাতের ভাইপো || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 7

ডাকাতের ভাইপো || Shirshendu Mukhopadhyay

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলে

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে ঝড়াক করে কথাটা মনে পড়ে গেল। খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে। কাশীবাবু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলেন, আচ্ছা, শুধু একথাটা বলার জন্য খাঁদু গড়াইয়ের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অত কষ্ট করে মাঝরাতে এসে হানা দেওয়ার কোনও মানে হয় ? জলবতরলং একটা কথা, ঘোরপ্যাঁচ নেই!

তবে কাশীবাবু ভাবতে লাগলেন। ভাবতে ভাবতে উঠে বাইরে এলেন। গাছগাছালির ফাক দিয়ে সূর্যোদয় দেখতে দেখতেই ভাবতে লাগলেন। হ্যাঁ, কথাটা হল, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে। তা কথাটার মধ্যে প্যাঁচটাই বা কোথায়, ধরতাই বা কোথায়! কাশীবাবু প্রাতকৃত্যাদি সারলেন এবং সারতে সারতেও ভাবতে লাগলেন। আচ্ছা জব্বর একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে তো খাদু! মাছির মতো ঘুরে ঘুরে এসে মাথায় বসছে। জ্বালাতন আর কাকে বলে!

ভারী নির্জন বনভূমি। ভারী শান্তি। ভারী আরাম। ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর হঠাৎ কাশীবাবুর চটকা ভাঙল। তাই ততা! এরা সব গেল কোথায়? চারদিকে কোথাও কারও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তো! এত নির্জন, এত শান্ত তো মনে হওয়ার কথা নয়!

কাশীবাবু তাড়াতাড়ি গিয়ে হাবু আর সনাতনের তাঁবুতে উঁকি মারলেন। কেউ নেই। তারপর এ-তবু সে-তাবু, সর্বত্র গিয়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখলেন। কোথাও কেউ নেই। এমনকী খুড়োমশাই রাখালহরির ছাউনি পর্যন্ত ফঁাকা। দু’দুটো রাঁধুনি এ-সময়ে গোছ গোছা রুটি বানাতে গলদঘর্ম হয়। দু-দুটো জোগালি তাল তাল আটা মাখতে হিমশিম খায়। কিন্তু তারা কেউ নেই। উনুন নেভানো। গাছে বসে যারা দিনরাত পাহারা দেয়, তাদের কারও টিকিটিও খুঁজে পেলেন না কাশীরাম। তবে কি আজ সকালেই কোথাও বড় ডাকাতিতে বেরিয়ে পড়ল সবাই? তাই বা কী করে হবে! সবাই মিলে একসঙ্গে তো কখনও যাওয়ার নিয়ম নেই। ঠেক তা হলে পাহারা দেবে কে?

কাশীবাবু ভারী তাজ্জব হয়ে গেলেন। আশ্চর্যের বিষয়, কারও তাবুতে একটাও অস্ত্রশস্ত্র পড়ে নেই। গোটা জায়গাটা হাঁ-হাঁ করছে ফঁাকা।

চোখ কচলে এবং গায়ে চিমটি দিয়ে স্বপ্ন দেখছেন কিনা পরীক্ষা করলেন কাশীবাবু। না, জেগেই আছেন। জেগে থাকার আরও একটা লক্ষণ হল, তার খিদে পাচ্ছে। কিন্তু খাবারদাবারের কোনও জোগাড়ই নেই। ভারী বেকুবের মতো কাশীবাবু এ-তাবু থেকে সে-তবু ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আর তার মাথার মধ্যে সেই কথাটা ঘুরে ঘুরে মাছির মতো বসতে লাগল বারবার, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে।।

খিদে চড়ে গেলে কাশীবাবুর মাথার ঠিক থাকে না। তাই কাশীবাবু ভারী হতাশ হয়ে মাটিতে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিলেন। এমন সময় জঙ্গলের রাস্তায় ঘরঘর শব্দ তুলে একটা জিপগাড়ি এসে দাড়াল। ভারী বিরক্ত মুখে কানাইদারোগা গলা বাড়িয়ে বললেন, “চটপট উঠে আয় তো! হাতে মোটেই সময় নেই। মরছি নিজের জ্বালায়, তার উপর আবার এইসব উটকো ঝামেলা।”

কাশীবাবু দ্বিরুক্তি না করে জিপে উঠে পড়লেন।

কানাই আঁশটে মুখ করে বলেন, “মাথা খারাপ না হলে কেউ দশ মাইল হেঁটে জঙ্গলে মর্নিংওয়াক করতে আসে?”

“মর্নিংওয়াক! কে বলল মর্নিংওয়াক?”

“তাই তো বলল।”

“কে বলল?”

কানাই খিচিয়ে উঠে বলেন, “তোর অত খতেনে দরকার কী? বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা, দিচ্ছি।”

কাশীবাবু আর কথা কইতে সাহস পেলেন না।

বাড়ির ফটকের কাছেই শশীরাম আর নসিরাম দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। জিপটা এসে থামতেই কাশীরামকে প্রায় ঠেলে জিপ থেকে নামিয়ে দিয়ে কানাইদারোগা শশীবাবুকে বললেন, “এই নিন আপনার আদরের নাতি।”

শশীবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, “এটা কী হল হে কানাই, তুমি কাশীকে অ্যারেস্ট করলে না যে বড়? আঁ! ব্যাপারটা কী?”

কানাই হাতজোড় করে বললেন, “আমাকে মাপ করবেন শশীবাবু। ওটি পারব না। আমাদের পাঁচ-পাঁচটা থানার লকআপে ঠাসেঠাস ভরতি। চার জনের সেল-এ চল্লিশ জনকে পোরা হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের লিস্টে কাশীরামের নামও নেই।”

“নেই মানে? নেই বললেই হবে? জলজ্যান্ত আমাদের চোখের সামনে ডাকাতি করেছে, আর তুমি বলছ লিস্টে নাম নেই?”

“মশাই, শুধু নিজের কথাই ভাবছেন, একটু পুলিশের কথাও ভাবুন। আপনার মায়া হয় না পুলিশের জন্য? একশো-দেড়শো দাগি ডাকাত নিয়ে আমরা এখন হিমশিম খাচ্ছি, আর আপনি পড়েছেন আপনার নাতি নিয়ে।”

“ওরে বাপু, অ্যারেস্ট হলে যে প্রেস্টিজ বাড়ে। তার উপর ডাকাতির কেস। কী বলিস রে নসে?”

নসিবাবুও কথাটা সমর্থন করলেন। কাণ্ড দেখে কাশীবাবু এতটাই মর্মাহত হলেন যে, এই ঘটনার দিন দুই পর তিনি নিজে উকিল হয়েও একজন বড় উকিলের কাছে গিয়েছিলেন, বাবা আর দাদুকে ডিভোর্স করার কোনও আইন আছে কিনা জানতে। উকিল দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে জানিয়েছিলেন, “না, নেই। ইহজন্মে বাপ-দাদার সঙ্গে সম্পর্ক কোনওক্রমেই নাকি ছাড়ান-কাটান করা সম্ভব নয়। এমনকী মরার পরও তারা পিছু ছাড়েন না। সারাজীবন এঁটুলির মতো লেগে থাকেন।”

তবে হ্যাঁ, কাশীরামের প্রতি শশীবাবু এবং নসিবাবুর আগেকার নাক সিঁটকনোর ভাবটা আর নেই। তারা এখন কাশীরাম কাছে এলে সপ্রশংস চোখে তাকান এবং কাশীবাবু কোনও কথা বললে আগেকার মতো উড়িয়ে না দিয়ে গুরুত্ব সহকারে শোনেন। গাঁয়ের মাতব্বরদের মধ্যেও বিপুল পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা এখন কাশীবাবুকে দেখলেই শশব্যস্তে ভাল তো বাবা’, সব ঠিক আছে তো বাবা’, ‘কোনও অসুবিধে হলে বোলো বাবা’ বলে কুশলপ্রশ্নাদি করে থাকেন। বাজারে গেলে দোকানিরা অন্য খদ্দেরদের উপেক্ষা করে কাশীবাবুকেই আগে জিনিস দেয়। দ্বিজপদ একদিন শশব্যস্তে এসে বলল, “খবর শুনেছেন কাশীদা! আপনার ডাকাতির খবর শতগুণ করে কে বা কারা গিয়ে বিজয়বাবুকে বলে বিয়েটা ভন্ডুল করার উপক্রম করেছিল। বিজয়বাবুও বিয়ে ভাঙার তোড়জোড় করছিলেন। কিন্তু কী কাণ্ড! কুঁচি সাফ বলে দিয়েছে, বিয়ে করতে হলে কাশীরামকেই, আর কাউকে নয়। সামনের শুক্রবার বিজয়বাবু আপনাকে আশীর্বাদ করতে আসছেন।”

দিন পনেরো পরে, এক সকালে কাশীবাবু খুব মন দিয়ে তাঁর বাগানে একটা বিরল প্রজাতির গোলাপ গাছের কলম লাগাচ্ছিলেন।

হঠাৎ নরহরি বলে উঠল, “ওই যে আবার এসেছে! এবার কী বিপদ হয় কে জানে!”

কাশীবাবু অন্যমনস্ক গলায় বললেন, “কে রে?”

“ওই যে দেখুন না?” কাশীবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, ফটকের কাছে খাঁদু গড়াই দাড়িয়ে। তেমনই উলোঝুলো পোশাক, হাড়হাভাতে চেহারা। মুখে গ্যালগ্যালে হাসি, চোখে চোখ পড়তেই ভারী আপ্যায়িত হয়ে বলল, “নাঃ, বাগানখানা বড় সরেস বানিয়েছেন মশাই।”

কাশীবাবু হাত ঝেড়ে উঠে পড়ে বললেন, “এ আপনার ভারী অন্যায় খাঁদুবাবু! না হয় আমাদের মস্ত উপকারই করেছেন, তা বলে নিজের পরিচয়টা আজ অবধি দিলেন না, এটা কি ভাল হচ্ছে?”

খাঁদু গড়াই জিভ কেটে ভারী কাচুমাচু হয়ে বলে, “ওকথা কবেন না। পরিচয়টা পাঁচজনকে বলার মতো নয়। তবে চাপাচাপি যদি করেন, তা হলে চুপিচুপি বলছি মশাই, আমি হলুম গে দয়ালহরি গড়াইয়ের ছেলে, রাখালহরি গড়াইয়ের ভাইপো শ্ৰীক্ষুদিরাম গড়াই। লোকে খাঁদু বলেই জানে।”

কাশীবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “ওতে আর ভবি ভুলছে না। তা না হয় আসল কথাটা না-ই বললেন। আপনি হয়তো স্পাইডারম্যানই হবেন। কিংবা কে জানে, সুপারম্যানও হতে পারেন। কিন্তু আজ আপনার সঙ্গে আমার অনেক আলোচনা আছে। আজ ছাড়ছি না আপনাকে। সেই যে নীলপুরের জঙ্গলে মাঝরাতে এসে ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে, সেই ব্যাপারটা আজ আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছি মশাই।”

“সে না হয় হবে। কিন্তু সাতসকালে উঠে খালি পেটে সেই বিষ্ণুপুর থেকে তিন মাইল ঠেঙিয়ে আসছি মশাই, মানুষের খিদে-তেষ্টা বলেও তো একটা কথা আছে।”

কাশীবাবু হেসে ফেললেন, বললেন, “ও নিয়ে ভাবতে হবে না আপনাকে। ভিতরে আসুন তো, জুত করে বসি।”

তারপর, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে নিয়ে দু’জনের মধ্যে ঘোরতর আলোচনা হতে লাগল।

তা সে যাই হোক, আসল কথাটা হল, মহিষবাথানের জঙ্গলে আর নীলপুর অরণ্যে আগে অনেক ডাকাত ছিল। এখন আর ডাকাত নেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 7 of 7 ): « পূর্ববর্তী1 ... 56 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress