কাশীবাবু সামনের বাগানে
ঘণ্টাখানেক পরে যখন কাশীবাবু সামনের বাগানে একটা মোড়া পেতে বসে আছেন, তখনও তাঁর মাথাটা ভোম্বল হয়ে আছে। চোখের সামনে যা আছে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর মাথার মধ্যে কেবল ঘুরছে, বাঁ পাশে কাত হয়ে হাঁ করে ঘুমালে এক রকম সংকেত, নাক ডাকলে তার এক অর্থ, হাই তুললে আবার অন্য ইশারা, আঙুল মটকালে বা আড়মোড়া ভাঙলে আর-এক ইঙ্গিত, এই সংকেতময় নতুন বিষয়টা অনুধাবন করার পর তাঁর বাহ্যজ্ঞান নেই। ওঃ, পৃথিবীতে কত কিছু শেখার আছে। ওকালতি পাশ করে তাঁর তো তেমন জ্ঞানার্জনই হয়নি! এই যে নতুন একটা জগতের দরজা তাঁর সামনে খুলে দিল খাঁদু, তার বিস্ময়, তার রোমাঞ্চই আলাদা। কাশীরাম আজ অভিভূত, বিস্মিত, বাকরহিত।
এরকম তুরীয় অবস্থা না হলে কাশীবাবু ঠিকই টের পেতেন যে, তাঁদের বাড়ির সামনে এই পড়ন্ত বিকেলে একটা পুলিশের জিপ এসে থামল। পুলিশের ইউনিফর্ম পরা চারজন লোক নিঃশব্দে নেমে ফটক খুলে ভিতরে ঢুকল। অগ্রবর্তী লোকটার হাতে একটা
কম্পিউটারে আঁকা ছবি, সে বাগানে ঢুকেই সামনে সম্পূর্ণ আনমনা কাশীবাবুকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ছবিটার সঙ্গে তাঁর চেহারাটা মিলিয়ে বলে উঠল, “এই তো!”
বাকি তিনজনও ছবিটা দেখে কাশীবাবুর সঙ্গে চেহারার আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ করে খুশি হয়ে বলল, “বাঃ, মেহনতই করতে হল না।”
“তবু কানের দাগটা দেখে নেওয়া ভাল। ভুল হলে সর্দার আস্ত রাখবে না।”
একজন গিয়ে কাশীবাবুর পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁর কানটা উলটে দেখে নিয়ে বলল, “বাঃ, এই তো কাটা দাগ!”
এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরও কাশীবাবু কিছুই টের পেলেন না। শুধু বাঁ কানে একবার হাত বুলিয়ে গভীর অন্যমনস্কতার সঙ্গে বললেন, “ও কিছু নয়। ছেলেবেলায় ঘুড়ি ধরতে গিয়ে মাঞ্জা সুতোয় কেটে গিয়েছিল!”
সর্দার গোছের পুলিশটা এগিয়ে এসে বলল, “পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ। আপনাকে আমরা একটা ডাকাতির চার্জে অ্যারেস্ট করতে এসেছি।”
বলেই লোকটা কাশীবাবুর হাতে একজোড়া হাতকড়া পরিয়ে দিল, অন্য একজন একটা মোটা দড়ির এক প্রান্ত চট করে কোমরে বেঁধে ফেলল।
কাশীবাবু এবার যেন মাটিতে পা রাখলেন। ভারী অবাক হয়ে বললেন, “এসব হচ্ছে কী? আঁ! এসব কী ব্যাপার?”
আর ঠিক এই সময়েই কাশীবাবুর দাদু শশীরাম তাঁর বৈকালিক ভ্রমণ সেরে ফিরে ফটক খুলে ঢুকেই পুলিশ দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তিনি বিশাল মাপের পুরুষ, হাতে মোটা লাঠি, বাজখাই গলায় বললেন, “আমার বাড়িতে পুলিশ কেন হে? কী হয়েছে?”
কর্তাগোছের লোকটা বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “আমরা এঁকে অ্যারেস্ট করতে এসেছি। এই যে ওয়ারেন্ট।”
শশীরাম ওয়ারেন্টের কাগজখানাকে মোটে গ্রাহ্যই করলেন না। গলাটা নামিয়ে বললেন, “ওরে বাপু, চার্জটা কীসের সেটা বললেই তো হয়।”
“আজ্ঞে, ডাকাতির। তিন-তিনটে দুর্ধর্ষ দুঃসাহসিক ডাকাতি।”
শশীরাম বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, “বলো কী হে? সত্যি নাকি? না মশকরা করছ?”
“আজ্ঞে, মশকরা নয়।”
শশীরাম ভারী আহ্লাদের সঙ্গে একগাল হেসে বললেন, “ডাকাতির কেস, ঠিক তো!”
“আজ্ঞে, ডাকাতির কেসই।”
শশীরাম আহ্লাদে ফেটে পড়ে লাঠিন্ধু দু’হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “জয় মা কালী! জয় করালবদনী! এত দিনে মুখ তুলে চাইলে মা! ওরে ও নসে! ও গিন্নি! ও বউমা! আরে তোমরা সব ছুটে এসো। দ্যাখো, আমাদের কেশো কী কাণ্ড করেছে। আগেই জানতুম, এই বীরের বংশে কাপুরুষ জন্মাতেই পারে না!”
হাঁকডাকে নসিরাম ছুটে এলেন। পিছু পিছু কাশীবাবুর ঠাকুরমা কমলেকামিনী দেবী, মা নবদুর্গা।।
নাতির অবস্থা দেখে কমলেকামিনী দেবী ডুকরে উঠলেন, “ওরে এই অলপ্পেয়ে মিনসেগুলো কে রে, আমার কেশোকে অমন করে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধেছে! আঁশবটিটা নিয়ে আয় তো রে মালতী, দেখি ওদের মুবোদ!”
শশীরাম গর্জে উঠে বললেন, “খবরদার, ওসব কোরো না। ওরা আইনমাফিক কাজ করছে। যাও বরং, শাঁখটা নিয়ে এসো। শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি করো সবাই। এত দিনে ব্যাটা বুকের পাটা দেখিয়েছে!”
কমলেকামিনী দেবী আকাশ থেকে পড়ে বললেন, “শাঁখ বাজাব! উলু দেব! কেন, কোন মোচ্ছব লেগেছে শুনি! আমার দুধের বাছাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ! আজ কোথায় তোমার বীরত্ব? হাতের লাঠিগাছা দিয়ে দাও না ঘা কতক।”
শশীরাম মাথা নেড়ে বললেন, “না, না, ও তুমি বুঝবে না। স্নেহে অন্ধ হলে কি এসব বোঝা যায়! এত দিনে তোমার কেশো মানুষের মতো মানুষ হল, বুঝলে! ওই ম্যাদামারা, নাদুসনুদুস, অপদার্থ, কাপুরুষ ছেলে কি এবংশে মানায়! আজ ছাইচাপা আগুন বেরিয়ে পড়েছে গিন্নি, আজ দুঃখের দিন নয়, আনন্দের দিন।”
নসিরাম প্রথমটায় ব্যাপার বুঝতে পারেননি। এখন খানিকটা বুঝে তিনিও গোঁফ চুমরে বললেন, “ডাকাতি করেছে নাকি ব্যাটা?”
শশীরাম বুক চিতিয়ে বললেন, “তবে! ডাকাতি বলে ডাকাতি? তিন-তিনটে দুর্ধর্ষ ডাকাতি। এই তো পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করে দ্যাখো না।”
নসিরাম পুলিশের সদারকে বললেন, “সত্যি নাকি?”
“যে আজ্ঞে।” কাশীরাম এতক্ষণে ফাঁক পেয়ে বললেন, “না, না, এসব বানানো গল্প।”
নসিরাম গর্জন করে বললেন, “চোপ! ডাকাতি করেছিস তো করেছিস। তার জন্য অত মিনমিন করে কাঁদুনি গাওয়ার কী আছে! বুকের পাটা আছে বলেই করেছিস। মাথা উঁচু করে জেল খেটে আয় তো দেখি!”
নসিরাম আহ্লাদে ফেটে পড়ে বললেন, “আহা, ডাকাতি তেমন খারাপ জিনিসই বা হতে যাবে কেন? চেঙ্গিস খাঁ থেকে আলেকজান্ডার, সুলতান মামুদ থেকে ভাস্কো ডা গামা, কে ডাকাত নয় রে বাপু? আগেকার রাজারাজড়ারাও তো বাপু, বকলমে ডাকাত ছাড়া কিছু নয়। রবিন হুডকে নিয়ে তবে নাচানাচি হয় কেন? ও গিন্নি, ওকে বরং একটা চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দাও। ওরে তোরা শাঁখ বাজা, উলু দে, পাঁচজনে জানুক।”
নবদুর্গা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, “ও যে রাতে দুধভাত খায়, নরম বিছানা ছাড়া শুতে পারে না, ভূতের ভয়ে একলাটি থাকতে পারে না, জেলখানায় গেলে কি ও আর বাঁচবে। সেখানে লপসি খাওয়ায়, কুটকুটে কম্বলের উপর শুতে দেয়, মারধর করে। খবর রটলে যে বিনয়বাবু বঁচির সঙ্গে ওর বিয়ে ভেঙে দেবেন।”
শশীরাম মোলায়েম গলায় বললেন, “বীরের জননী হয়ে কি তোমার এসব বিলাপ মানায় বউমা? আপাতদৃষ্টিতে ডাকাতি জিনিসটা ভাল নয় বটে, কিন্তু এ তো ভেড়ুয়াদের কাজ নয় বউমা। পুরুষকার লাগে। কেশোর ভিতরে যে পুরুষকার জেগেছে তা কি টের পাচ্ছ? আহা, আজ যে আনন্দে আমার চোখে জল আসছে!”
বলে শশীরাম ধুতির খুঁটে চোখ মুছলেন। নসিরাম পুলিশের দিকে চেয়ে বললেন, “ওহে বাপু, তোমাকে তো ঠিক চেনা চেনা ঠেকছে না!”
“আজ্ঞে, এই সবে নতুন বদলি হয়ে এসেছি।”
“আর তোমাদের কানাইদারোগা ! সে এল না?”
“আজ্ঞে, তিনি আর-একটা থানায় বদলি হয়ে গেছেন।”
শশীরাম বললেন, “খুব ভাল হয়েছে। কানাইদারোগা কোনও কম্মের নয়। ওরে বাপু, তোর নাকের ডগায় একটা লোক তিন তিনটে ডাকাতি করে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তোর হুঁশই নেই! ওহে বাপু, তোমাদের একটু মিষ্টিমুখ না করিয়ে ছাড়ছি না। ওরে নরহরি, যা তো, দৌড়ে গিয়ে হারুময়রার দোকান থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে আয়।”
নরহরি পড়ি-কি-মরি করে ছুটল।
শশীরাম পুলিশ অফিসারটিকে ভারী বন্ধুর মতো বললেন, “শোনো বাবারা, জাঁতা পেষাই করাবে, পাথর ভাঙাবে, ঘানিগাছে ঘোরাবে। কোনওটা যেন ফাঁক না যায়। একেবারে মজবুত করে গড়ে দাও তো বাবা ছেলেটাকে।”
ছোকরা মুচকি হেসে বলল, “ওসব নিয়ে ভাববেন না। আমাদের হাতে পড়লে দু’দিন পরেই এঁর ভোল পালটে যাবে।”
“খুব ভাল, খুব ভাল, তা তোমরা দুর্গা দুর্গা বলে এসো গিয়ে। দেরি করে কাজ নেই। শুভ কাজে কখন কী বাধা এসে পড়ে, বলা তো যায় না।”
নরহরিও হাঁপাতে হাঁপাতে রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে এসে হাজির হয়ে গেল। চারজন পুলিশ টপাটপ রসগোল্লা সাফ করে দিল কয়েক মিনিটেই। তারপর জিপে উঠে কাশীবাবুকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল।
কমলেকামিনী দেবী এবং নবদুর্গা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
জিপে দু’জন পুলিশের মাঝখানে বসে কাশীবাবুর মাথাটা ফের ডোম্বল হয়ে গেল। এতক্ষণ যা দেখলেন, যা শুনলেন, তা কি বিশ্বাসযোগ্য? তাঁর বাবা নসিরাম এবং দাদু শশীরাম কি আসলে তাঁর কেউ নন। তিনি কি কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে? নইলে তাঁর এই ভয়ংকর বিপদের দিনে নসিরাম এবং শশীরাম এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেন কী করে? তিনি যখন ঘোর বিপন্ন, তখন শ্রদ্ধেয় শশীরাম ও শ্রদ্ধেয় নসিরামের এত স্ফুর্তি আসে কী করে? এ তো সেই রাজা নিবোর মতো আচরণ, যখন রোম পুড়ছে তখন নিরো আহ্লাদে তারবাদ্য বাজাচ্ছিলেন। ছিঃ ছিঃ, পূজ্যপাদ শশীরাম ও পূজনীয় নসিরাম সম্পর্কে তাঁর সব পূর্ব ধারণা যে তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ল! এর পরও যদি বেঁচে থাকেন, তবে কাশীরাম হয়তো শশীরামকে ‘দাদু এবং নসিরামকে ‘বাবা’ বলে ডাকবেন, কিন্তু সেই ডাক কি আর অন্তরের অন্তস্তল থেকে উঠে আসবে?
মনের দুঃখে এত অভিভূত হয়েছিলেন কাশীবাবু যে, জিপটা তাঁকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে লক্ষই করলেন না। যেখানে খুশি নিক, তাঁর কিছু আসে যায় না। পৃথিবীকে তাঁর চেনা হয়ে গিয়েছে। দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস নেই। এখন পুলিশ তাঁকে ফাঁসিতে লটকালেও তিনি বিশেষ আপত্তি করবেন না। এবং তাঁর এমন সন্দেহও হচ্ছে যে, তাঁর ফাঁসি হয়েছে শুনলে শ্রদ্ধাস্পদ শশীরাম এবং পুণ্যশ্লোক নসিরাম হয়তো বা আনন্দের চোটে হরির লুট দিয়ে বসবেন।
একটা ঘোর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে জিপটা নানা বাঁক নিয়ে, খানাখন্দ পেরিয়ে, ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে একটা দুর্গম জায়গায় এসে থামল। একজন পুলিশ তাঁর হাতকড়া আর দড়ি খুলে দিয়ে হাতজোড় করে বলল, “অপরাধ নেবেন না। আপনার খুড়োমশাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আসুন।”
কাশীরাম আর অবাক হচ্ছেন না। আজ দুপুর থেকে তিনি বারবার এত অবাক হয়েছেন যে, আর অবাক হওয়া সম্ভব নয়। অবাক হওয়ারও তো একটা শেষ আছে রে বাবা! তবে তিনি যত দূর জানেন, তাঁর বড়খুড়ো বাঞ্ছারাম বামুনগাছিতে এবং ছোটখুড়ো হরেরাম হরিদ্বারে থাকেন। এই নীলপুরের জঙ্গলে থাকার মতো বাড়তি খুড়ো তাঁর নেই। তবু তাতেই বা কী যায়-আসে। নিজের বাপ-দাদাই যদি এমন পর হয়ে যান, তা হলে খুড়ো নিয়ে মাথাব্যথা কীসের?
জিপ থেকে নেমে তিনি চারটে লোকের পিছু পিছু বেশ গটগট করে হেঁটে গিয়ে একটা গোলপাতার ছাউনিওয়ালা ঘরে ঢুকে একজন লম্বা পাঠানি চেহারার লোকের সামনের দাঁড়ালেন।
“আপনার ভাইপোকে এনেছি কর্তা। ইনিই খাঁদু গড়াই।”
পাঠানি লোকটা বলল, “কানের পিছনকার দাগটা দেখে নিয়েছিস তো!”
“যে আজ্ঞে। এই যে।” বলে লোকটা টর্চ ফোকাস করে কাশীবাবুর বাঁ কানের লতিটা উলটে দিয়ে দেখাল। কাশীবাবু আপত্তি করলেন না।
পিছন থেকে কে একজন কাশীবাবুর কোমরে একটা গুঁতো দিয়ে বলল, “পেন্নাম করুন। ইনি আপনার পূজনীয় খুড়োমশাই শ্রীরাখালহরি গড়াই।”
একথায় কাশীবাবু আপত্তিকর কিছুই খুঁজে পেলেন না। দুনিয়ার উপর, জীবনের উপর এমনই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন যে, এই আখাম্বা লোকটাকে মাসি’ বলে ডাকতে হলেও তিনি রাজি। সবাই যখন পর, তখন ডাকে আর কী আসে-যায়। তিনি তাড়াতাড়ি রাখালহরিকে প্রণাম করে ফেললেন।
রাখালহরি বাঘা হাতে তাঁর পিঠ চাপড়ে বলল, “বাঃ, বেশ! বেশ।”
কাশীবাবু বিলক্ষণ জানেন যে, তিনি খাঁদু গড়াই নন এবং এই লোকটা কস্মিনকালেও তাঁর খুড়ো নন। তাঁর দুই খুড়ো হরেরাম ও বাঞ্ছারাম ডাকাবুকো হলেও ডাকাত নন। কিন্তু আজ তাঁর দুনিয়াটাই পালটে গিয়েছে।
রাখালহরি অতি তীক্ষ্ণ এবং সন্ধানী নয়নে কাশীরামকে যেন কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল, “নাঃ, এ বড় নধর চেহারা। ঘি-দুধ খাওয়া শরীর, কসরতের কোনও চিহ্নই নেই। ওরে হাবু, কাল থেকেই একে তৈরি করতে লেগে যা বাবা। কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়তি চর্বি ঝরিয়ে একটু চাঙা করে দিবি। সনাতন আর গাব্ব একটু প্যাঁচপয়জার শেখাবে। গদাই বন্দুক-পিস্তলের তালিম দেবে। আর কালীকেষ্ট শেখাবে কম্পিউটার। আর শোন, ওর ভাল নাম হল ক্ষুদিরাম, ‘খাঁদু’ বলে কেউ ডাকবি না। ও নামে শুধু আমি ডাকব।”
নীলপুরের জঙ্গলে যখন এই কাণ্ড চলছে, তখন মামুনগড় গাঁয়ে শশীরামের বাড়িতে এক বিরাট কীর্তনের দল এসে হাজির। প্রায় পনেরো-যোলোটা খোল, মেলা করতাল, কাঁসি, ঢোল বাজিয়ে সে একেবারে উদ্দণ্ড তারকব্রহ্ম নাম। বাড়িসন্ধু লোক বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে। এমনকী চোখের জল মুছতে মুছতে কমলেকামিনী দেবী এবং নবদুর্গা দেবীও। বাড়ির কাজের লোকজন, আত্মীয় বন্ধু সবাই জুটে গেছেন। এমনকী খাঁদু গড়াইও।
কীর্তনীয়ারা নাচতে নাচতে এক এক করে তাদের চক্রের মধ্যে প্রথমে কাশীরাম, তারপর নসিরাম, তারপর নরহরি থেকে শুরু করে খাঁদু গড়াই পর্যন্ত সবাইকেই টেনে নিল। কীর্তনটা হচ্ছিলও বেশ ভাল। সুরেলা গলা, তালে তালে উদ্দণ্ড নাচ, মাঝে মাঝে উচ্চকিত হরিবোল হরিবোল’ ধ্বনি, মাঝে মাঝে শাঁখ আর উলু—সব মিলিয়ে একেবারে নেশা ধরিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার।
তারপর একসময়ে জয়ধ্বনি দিয়ে কীর্তন স্তিমিত হয়ে শেষ হয়ে গেল। প্রায় টলতে টলতে নসিরাম, শশীরাম, নরহরি আর অন্য পুরুষরা বেরিয়ে এলেন। তারপর কীর্তনের দলটা টপ করে যেন ভভাজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেল। নবদুর্গা দেবী সিধে আর পয়সা দিতে এসে দেখেন, কেউ নেই।
কীর্তনের দলের সঙ্গে খাঁদু গড়াইও যে অদৃশ্য হয়েছে এটা প্রথমে কেউ টের পায়নি। টের পেল রাত্রে খাওয়ার ডাক পড়ার পর। নসিরাম হাঁকডাক করতে লাগলেন, “ওরে, খাঁদু কোথায় গেল দ্যাখ তো! পালাল নাকি?”
নবদুর্গাও চেঁচামেচি করতে লাগলেন, “পালাবে না! দ্যাখো খোঁজ নিয়ে, পোঁটলা বেঁধে সব নিয়ে গিয়েছে কিনা। যেমন তোমার আক্কেল!”